রণরঙ্গিণী প্রেমরঙ্গা পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
2

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

ঝিরিঝির বৃষ্টি পড়ছে। মৃদুমন্দ বাতাসের দাপটে সেই বৃষ্টির কণা বারান্দা এবং জানালার রেলিং ভেদ করে লুটোপুটি খাচ্ছে ছোটো ছোটো ফুলের সফেদ মেঝেতে। আজ হসপিটালে যাননি মেহরাব শিকদার। হুট করেই শরীরটা সকাল থেকে খারাপ লাগছে। প্রেসার বেড়েছে অনেকটা। স্বামীর অসুস্থ শরীর নিয়ে চিন্তায় ভুগছেন ফিরোজা। সকাল থেকেই সেবা যত্নে লেগে পড়েছেন তিনি। মেহরাব শিকদারকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন কী নিয়ে এত চিন্তা করছেন তিনি! কিন্তু কিছুতেই জবাব মিলল না। অর্পণ নিজেই তার বাবার জন্য ঔষধ আর কিছু ফল কিনে দিয়ে গেছিল৷ হসপিটালে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল‚ “ডক্টর হয়ে কী করে নিজের শরীরে এতটা ক্ষতি করতে পারো? তুমি ঠিক কী নিয়ে এত টেনশন করছ আমি জানি না! তবে নিজের শরীরের খেয়াল রাখতে হবে। অন্তত আমার এবং মায়ের জন্য। এই ফলগুলো টাইম টু টাইম খাবে। আর মা যা রান্না করে দেবে চুপটি করে সেটাই খেয়ে নেবে৷” ছেলের কথা কিছুতেই ফেলতে পারলেন না তিনি। দুপুরে মেহরাব শিকদারের জন্য হালকা মসলা জাতীয় খাবার রান্না করেছিলেন ফিরোজা। ফুলকপি‚ টমেটো‚ মটরশুঁটি দিয়ে সবজি আর ছোটো মাছ দিয়ে পালংশাক রান্না করেছিলেন। গরম ভাতের সঙ্গে দুই টুকরো লেবু আর শসাও দেওয়া হয়েছিল৷ তারপর খাওয়া শেষে অর্পণের কিনে আনা কমলা‚ মাল্টা‚ আর নাশপতি খেতে দিয়েছিলেন ফিরোজা। কর্তব্যের খাতিরে একবার দেখা করে গিয়েছিল ভূমি। লোকটার মুখ অবধি দেখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু অসুস্থ মানুষের উপর রাগ‚ হিংসা বা ঘৃণা দাবিয়ে রাখতে নেই। ঘরে শুয়ে বসে সময়ও কাটছিল না তার। এদিকে ঘুমও আসছিল না। পূর্ণতা পুষ্পিতা দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়েছে। তাই সে ভাবল একবার গুলবাহারের ঘরে যাওয়া যাক। ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর সিঁড়ি ভেঙে নিচতলায় চলে গেল। গুলবাহারের ঘরের দরজার সামনে এসে ভূমি দাঁড়াল। দরজার টোকা দিয়ে বলল‚

“নানিমণি আসব?”

তসবি পড়ছিলেন গুলবাহার৷ সেটা থামিয়ে ভূমিকে ঘরে আসার জন্য ইশারা করলেন। অনুমতি পেয়ে ভূমি উনার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। গুলবাহার কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। আজ হুট করেই পা আর হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে৷ ভূমি গিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়াল। গুলবাহার বিছানায় বসতে বললেন। উনার কথানুযায়ী ভূমি বিছানায় বসল। তসবিখানা বালিশের পাশে রেখে হাঁটুতে হাত রাখলেন। এরপর ভূমিকে জিজ্ঞেস করলেন‚

“হঠাৎ আমার ঘরে? কী দরকার?”

“আসলে নানুমণি ঘরে শুয়ে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছিল না৷”

চুপ করে রইলেন গুলবাহার৷ পরপরই ভূমি উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে আবারও বলল‚ “আমি কী আপনার পায়ে মালিশ করে দেব নানুমণি?”

চট করেই গুলবাহার তাকালেন ভূমির দিকে। না বলতেও মেয়েটা কী অবলীলায় বুঝতে পেরে গেল যে‚ উনার পায়ে ব্যথা করছে। মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ করলেন না তিনি। নিজেকে কঠোর ভাবেই উপস্থাপন করলেন। কড়া গলায় বললেন‚

“এত ভাব জমাতে হবে না। আমার মন জয় করা এত সোজা নয়!”

ক্ষীণ স্বরে ভূমি বলল‚ “তেমন কিছুই না নানুমণি। তখন খাবার টেবিলে বসার সময় দেখছিলাম আপনি বারবার হাঁটুতে ধরছিলেন। আর চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে ছিল৷ আমি ভাবলাম হয়তো আপনার হাঁটুতে ব্যথা।”

এবার কিছুটা নরম হলেন গুলবাহার৷ ব্যাপারটা সহজ করেই মেনে নিলেন। আপস করে নিলেন ভূমির সঙ্গে। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো ভূমি। অন্তত গুলবাহার কিছুটা নরম হয়েছেন। একদিন মাধুরীও তাকে আপন করে নেবেন। সম্পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে তার। ভূমি সরিষার তেল হাতে নিয়ে গুলবাহারের পায়ে মালিশ করতে শুরু করল। ভদ্রমহিলা বেশ আরাম পাচ্ছেন। চোখ দুটো মুদে আসছে৷ ঘুম আসছে ভীষণ। এতক্ষণ কি-না ব্যথায় কাতড়াচ্ছিলেন!

গোধূলি বিকেল…

খুব একটা ছাদে ওঠা হয় না ভূমির। সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে বসে আর সংসারের কাজেই সময় কাটায় সে৷ এভাবেই দিব্যি চলছে তার। আজ খুব ইচ্ছে হলো ছাদে ওঠার। তবে একা যাওয়ার অনুমতি নেই। প্রলয় তাকে বারণ করেছে একা বাড়ির বাহিরে অথবা ছাদে না উঠতে৷ এখন সময়টা গোধূলি বিকেল৷ পশ্চিমাকাশে প্রকাণ্ড সূর্যটা ক্রমশ নিভন্ত৷ আকাশ এখন একদমই পরিষ্কার। দেখে মনে হচ্ছে না দুপুরে বৃষ্টি হয়েছিল৷ বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গেই রোদ উঁকি দিয়েছিল তখন। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি৷ ছাদ বাগানের গাছ গুলোর পাতায় পাতায় বৃষ্টির কণা। গাছে অনেক ফুল ফুটেছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা বাগান করতে ভালোবাসে। নানান জাতের ফুল গাছ লাগিয়ে রেখেছে৷ একটা বড়ো কাঠগোলাপ গাছ লাগিয়েছে৷ সাদা আর ম্যাজেন্টার সংমিশ্রণে ফুল গুলো খুবই পছন্দের৷ তীব্র সুবাস ছড়ায়৷ পাশেই আরেকটা মাঝারি কাঠগোলাপের গাছ৷ সাদা আর হলুদের সংমিশ্রণে ফুল ফুটেই থাকে সবসময়। এছাড়াও বেলী‚ গোলাপ‚ চন্দ্রমল্লিকা আর নয়নতারা তো রয়েছেই। সেদিন প্রলয়ের প্রতি অভিমান ছিল প্রচণ্ড তাই এসব খেয়ালই করেনি ভূমি৷ দোলনায় বসেই সময় কাটিয়েছিল৷ তবে আজ তার মন একদমই ফুরফুরে। এদিকে ফুলগুলোর ফটোগ্রাফি করছে পূর্ণতা পুষ্পিতা। কাল পরীক্ষা নেই৷ আবার দুদিন পর পরীক্ষা। তাই একটু সময় কাটাতে পারছে৷ পুষ্পিতা মুঠোয় করে অনেকগুলো কাঠগোলাপ ফুল তুলে ভূমির কাছে এলো৷ হলুদ ম্যাজেন্টা দুটোই রয়েছে৷ ফুলগুলো পেয়ে ভূমি খুশি হয়ে গেল৷ অধর কোণে হাসি ফুটে উঠল। এ সুযোগে ভূমির কয়েকটা ছবিও তুলে ফেলেছে পূর্ণতা৷ সে ভালো ছবি তুলতে পারে৷ পুষ্পিতা জিজ্ঞেস করল‚

“ভাবিমণি এই ফুলগুলো তোমার বিনুনিতে লাগিয়ে দিই?”

ভূমি আশেপাশের ছাদ আর জানালাগুলোর দিকে তাকাল। না! কেউই নেই আশেপাশে৷ মাথার উপর থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলল ভূমি। পুষ্পিতা তার লম্বা বিনুনিতে ফুলগুলো লাগিয়ে দিল৷ সবটা ভিডিও করেছে পূর্ণতা৷ শেষে কানের পেছনটাতেও একটা ফুল গুঁজে দিল৷ ভূমিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে পূর্ণতা বলল‚

“ভাবিমণি তোমাকে পুরো ফুলপরী লাগছে৷”

প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হাসল ভূমি৷ পুষ্পিতার হাত থেকে দুটো ম্যাজেন্টা রঙের কাঠগোলাপ নিয়ে একটা পূর্ণতার কানের পেছনে তো আরেকটা পুষ্পিতার কানে পেছনে গুঁজে দিল। এরপর দুবোনের গাল টেনে বলল‚

“তোমাদেরও ফুলপরী লাগছে রায়বাঘিনী ননদিনীরা।”

পূর্ণতা এবার জিজ্ঞেস করল‚ “আচ্ছা ভাবিমণি! মা যে তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন‚ তোমার কী আমাদের মায়ের উপর রাগ হয় না?”

হাসি থেমে গেল ভূমির। সহসাই চিন্তার ভাজ পড়ল চোখমুখে৷ একটু অপেক্ষা করিয়ে মনে মনে উত্তর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পূর্ণতা পুষ্পিতা প্রত্যুত্তরের আসায় একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে ভূমির দিকে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্ষীণ হেসে ভূমি বলল‚

“উনার মাঝে আমি এমন একজন মাকে দেখতে পাই। যিনি তার সন্তানের খুশির জন্য সবকিছু করতে পারেন। একদম আমার আম্মার মতো। আমি উনার অবস্থা বুঝতে পারি। আমি জানি একদিন উনি আমাকে আপন করে নেবেন৷ ক্ষণে ক্ষণে চোখে হারাবেন।”

যমজ বোন দুটোতে হা করে চেয়ে রয়েছে ভূমির দিকে। তাদের ভাবিমণি যতই শান্তশিষ্ট হোক না কেন! প্রচণ্ড ভালো। তাইতো এই অল্প সময়েই তারা মিশে যেতে পেরেছে। এমনিতে ওরা অচেনা মানুষদের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যেতে পারে না। ভূমির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। পূর্ণতা পুষ্পিতা এসে জাপ্টে ধরল ভূমিকে৷ দুজনের একসাথেই বলে উঠল‚

“তোমাকে আমাদের বড়ো ভাইয়ার বউ অর্থাৎ ভাবিমণি হিসেবে পেয়ে আমরা সত্যিই খুব খুশি। তুমি খুব ভালো ভাবিমণি।”

মেয়ে দুটোর বাচ্চামোতে হেসে উঠল ভূমি। মনটা খুবই ফুরফুরে লাগছে। ভাগ্যিস ওদের সঙ্গে আজ ছাদে এসেছিল৷ এমন করে মাঝে মাঝে ছাদে আসা প্রয়োজন। ওরা আরও কিছুক্ষণ ছাদেই সময় কাটাল। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ছাদ থেকে নেমে গেল পূর্ণতা পুষ্পিতা আর ভূমি৷ মাথায় ওড়না পেঁচালে এত যত্নের ফুলগুলো পড়ে যেতে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই মাথায় আর ওড়না পেচাল না ভূমি। সেভাবেই পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে নিচে নেমে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ভূমিকে আগে আগে যেতে দিয়েছিল ওরা দুবোন। পেছন থেকে যেন ভূমির চুলের ভিডিও করে বড়ো ভাইয়াকে পাঠাতে পারে সেই জন্য এমন বুদ্ধি।

ঘরে এসে ফোনের লক খুলে ভূমি দেখতে পেল প্রলয় তাকে অনেকবার কল করেছিল। তখন সে ছাদে ছিল। ফোন সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি। হাতে করে ফোনটা বহন করতে ইচ্ছে করে না তার। ভারী ভারী লাগে। এবার ভূমি নিজে থেকে প্রলয়ের নাম্বারে ডায়াল করল। রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দেওয়া হলো। হয়তো প্রলয় ব্যস্ত আছে আর নয়তো কল ব্যাক করবে। হয়েছেও তাই। প্রলয় কল ব্যাক করেছে। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করল ভূমি। সে কিছু বলবে তার আগেই অপাশ থেকে প্রলয় বলল‚

“কী ব্যাপার বরকে খুব বেশি মিস করছিলে বুঝি? এইতো আর ঘণ্টা খানেক পরেই চলে আসব সোনা।”

প্রলয়ের কথা শুনে মাথায় হাত ভূমির। কোথায় সে মনে করেছিল‚ হয়তো জরুরি কোনো কাজে লোকটা তাকে কল করেছিল৷ কিন্তু হলো তার উল্টো। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ভূমি বলল‚

“আপনি তো আগে এমন ছিলেন না! হঠাৎ করে পাল্টে গেলেন কী করে?”

“কোথায় পাল্টে গেলাম? তোমাকে তো প্রতিদিনই ভালোবাসি।”

“গম্ভীর এমপি মশাই হুট করেই কেমন হয়ে গেল! কেমন দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে!”

ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি বুকে হাত রাখল। আলহামদুলিল্লাহ! ভূমি কন্যা কথা বলতে শিখছে। সহজ হতে চেষ্টা করছে এটাই অনেক৷ ভূমিকে আরেকটু বাজাতে প্রলয় বলল‚ “তোমার কথা শুনে আমার ভীষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে। কী করা যায় বল তো?”

“দশ হাজার হাত দূরে থাকুন এমপি মশাই।”

“এখন তো দশ ইঞ্চি দূরত্ব সহ্য হচ্ছে না জান।”

“রাখছি। নানুমণি ডাকছেন।”

একপ্রকার মিথ্যে বলেই কল কে’টে দিল ভূমি৷ লোকটা দিনকে দিন লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছেন। কোনো কথাই আটকায় না৷ তিনি কী বুঝতে পারছেন না‚ উনার এহেন কথায় অষ্টাদশী কন্যার মনে প্রেমের মাদল বাজছে? উনি কী বুঝতে পারছেন না‚ অষ্টাদশী কন্যার মনে অনুভূতির তীব্র জোয়ার আছড়ে পড়ছে? থম মে’রে বিছানায় বসে পড়ল ভূমি। প্রলয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই লজ্জারা হানা দেয়!

সময় প্রবহমান। দেখতে দেখতে তিনটে মাস কী অবলীলায় কে’টে গেল। প্রলয়ের সঙ্গে সংসার জীবন বেশ ভালোই কাটছে ভূমির৷ এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে৷ দুজনেই গোল্ডেন প্লাস পেয়েছে৷ পরিবারের সবাই খুব খুশি ওদের এই রেজাল্টের জন্য। মহুয়া এসেছিলেন আরশের সঙ্গে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসে দুদিন থেকে গিয়েছেন তিনি। একমাত্র ভূমির জোরাজুরিতেই তিনি এসেছিলেন। শিকদার বাড়িতে আসার কোনো ইচ্ছেই উনার ছিল। মেয়ের কথা ফেলতে পারেন না তিনি। দুদিন থেকে আজ ফিরে গিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। তিনি যতদিন ছিলেন একমুহূর্তের জন্য উনাকে সহ্য করতে পারছিলেন না মেহরাব শিকদার। মহুয়া উনার সম্পর্কে এমন কিছু সত্যি জানেন যেটা উনার জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে৷ তাইতো মহুয়া উনার চক্ষুশূল। যাওয়ার আগে মহুয়া ঘুরেফিরে সেই একই কথা বলে গিয়েছিলেন‚ “একটু সাবধানে থাকবেন৷ আপনার মুখোশ ক্রমশ উন্মোচিত। যেই সন্তানকে এতদিন অবহেলা করেছেন একদিন সেই সন্তানকেই দুনিয়ার কাছে পরিচয় দিতে হবে। তখন কোথায় পালাবেন? আপনার জন্য পালানোর পথ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে।” মেহরাব শিকদারের সেদিন খুব মাথা গরম হয়েছিল। মহুয়াকে খু’ন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই তিনি ভাবলেন ভূমিকে আজ সাফ সাফ কিছু কথা বলে দেওয়াই প্রয়োজন। ভূমির ঘরের সামনে এসে কড়া নাড়লেন মেহরাব শিকদার। সঙ্গে সঙ্গেই ভূমি গিয়ে ঘরের দরজা খুলে দিল৷ কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে মেহরাব শিকদার ঘরের ভেতরে চলে এলেন। কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই বললেন‚

“তোমার আম্মাকে বলে দিও পরবর্তীতে যেন এ বাড়িতে আর না আসে।”

“শিকদার বাড়ির লোকেরা বুঝি কুটুমদের আপ্যায়ন করতে ভয় পায়?”

“তোমরা মা মেয়ে মিলে চাইছটা কী? শিকদার বাড়ির বউ হয়েছ বউয়ের মতই থাকবে‚ বাড়ির মেয়ে হওয়ার চেষ্টাও করবে না। তোমার মায়ের কাছ থেকে এই কথাটা তো জেনেছ যে‚ আমি তোমাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করি না। আর না কোনদিন করব।”

“আপনাকে যতই দেখি ততই আপনার প্রতি ঘৃণা তড়তড় করে বাড়তে শুরু করে। বাবারা বুঝি এমনই হয়? যতই সত্যিটা লুকানোর চেষ্টা করুন না কেন— সত্যিটা একদিন সবার সামনে আসবেই! একটা মানুষ কী করে এতটা জঘন্য হতে পারে!”

“তোমার যা ইচ্ছে তুমি ভাবতে পারো। আমার কিছু যায় আসে না।”

“আপনাকে নিজের বাবা ভাবতেও ঘৃণা করে।”

“আমি তো তোমাকে মেয়ে বলেই মানি না। আর না তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে আমার।”

তাচ্ছিল্য করে হাসল ভূমি। প্রথম দিনের সম্মানবোধ আজ আর নেই৷ এমন একটা লোকের প্রতি কী করে সম্মান আসবে? এত পাপ— এত অন্যায় করার পরও তার মাঝে কোনো অপরাধবোধ নেই। চোখে চোখ রেখে তেজি স্বরে বলল‚

“র’ক্তের সম্পর্ক কী এত সহজে মুছে ফেলা যায়?”

ভুমির এমন আত্মবিশ্বাস আর সাহস দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে মেহরাব শিকদারের৷ সমস্ত রাগ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেও রাখতে পারছেন না তিনি। চোখ দিয়ে যে আগুন ঝড়ছে। শিকদার বাড়ির র’ক্ত বলে কথা। রাগ তো এদের র’ক্তে রয়েছে। মেহরাব শিকদার মৃদু চেঁচিয়ে বললেন‚

“বেশি বাড় বেড় না মেয়ে। আমার সম্পর্কে এখনো তোমার কোনো ধারণাই হয়নি।”

“ধারণা হবার বাকিটা কী রেখেছেন? কী মনে করেছেন‚ আমি আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না?”

“একটু বেশিই জেনে ফেলেছ! আমার অন্য রূপটা স্বচক্ষে দেখনি তাই এত সাহস দেখাচ্ছ।” বলেই বাঁকা হাসলেন মেহরাব শিকদার। তবে উনার হাসিকে খুব বেশি সময় স্থায়ী হতে দিল না ভূমি৷ সে বলল‚

“একটিবার ভাবুন তো! যদি আপনার সব সত্যিটা আমি সবার কাছে বলে দিই? আর ভয়? সেটা তো আমি আমার বাবাকেও পাই না। ভুলে যাবেন না শিকদার বাড়ির র’ক্ত আমার শরীরেও বইছে।”

“তুমি কী ভেবেছ তুমি বলবে আর সবাই তোমার মুখের কথা বিশ্বাস করে নেবে?”

“শুধু মুখে কেন বলব? প্রমাণ করে দেখাব।”

এবার কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। ক্রমশ ঘামতে শুরু করেছেন তিনি। সত্যিই কী ভূমি মুখে যা বলছে তেমনটাই করবে? না! এমনট তো হতে দেওয়া যায় না। এত বছরের সমস্ত খ্যাতি‚ সম্মান এক নিমিষেই যে শেষ হয়ে যাবে। তা কী করে হতে দেওয়া যায়! আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না তিনি। বড়ো বড়ো পা ফেলে ভূমির ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেহরাব শিকদার চলে যেতেই কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা আঁখিপল্লব হতে গড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণ নিজেকে ক্রমাগত শক্ত রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেও তো একটা মানুষ। বাবাকে বাবা বলার অধিকার তো তারও আছে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস— যেখানে বাবাকে বাবা বলে ডাকা যায় না। তাকে তো সন্তান হিসেবে পরিচয়ই দেন না মেহরাব শিকদার। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভূমির। মাঝে মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতাকে দেখলে বড্ড আফসোস হয় তার। মোর্শেদ শিকদার কত স্নেহ করেন ওদের দুটোকে! এমনটা তো তার ক্ষেত্রেও হতে পারত। বহু কষ্টে কান্না সংবরণ করল ভূমি। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে নিল সঙ্গে সঙ্গে। ঘরের দরজা খোলা। যে কেউ চলে আসতে পারে। প্রলয়ও যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। এরই মাঝে দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। ভূমি নিজেকে একবার আয়না পর্যবেক্ষণ করল। ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল অর্পণ। তার হাতে একটা লাল ব্যাগ। আসার সময় আইসক্রিম কিনে এনেছিল। ব্যাগটা ভূমির দিকে এগিয়ে দিয়ে অর্পণ বলল‚

“এটা তোমার জন্য।”

“এটাতে কী আছে ভাইয়া?”

“তোমার জন্য আইসক্রিম। এটা শুধুই তোমার জন্য। পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্যও এনেছি।”

ভূমির চোখমুখে দারুণ চঞ্চলতা। অজান্তেই অর্পণ তার ভাই হবার দায়িত্ব পালন করছে। ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে করতে ইচ্ছে করছে। উঁহু! দুঃখে নয়— সুখে কান্না পাচ্ছে তার৷ কম্পিত কণ্ঠে বলল‚ “ধন্যবাদ ভাইয়া৷”

“তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“জি ভাইয়া বলুন।”

“তখন তুমি বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিলে কেন? আর বাবাই বা তোমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিল কেন?”

ভূমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু চেষ্টা করেও এড়িয়ে যেতে পারল না৷ হুট করেই অর্পণের হাতটা নিজের মাথায় রাখল। কথাগুলোকে মনে মনে সাজিয়ে বলল‚

“তার আগে আমার মাথায় হাত রেখে বল‚ এই কথাগুলো আর কাউকে কোনোদিন বলবে না?”

ভূমির এমন ব্যবহার খুবই অবাক করল অর্পণকে৷ কী এমন কথা আছে যা শোনার জন্য মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে তাকে? কিন্তু জানাটাও খুবই প্রয়োজন। অর্পণ মেনে নিল৷ শুকনো ঢোক গিলে বলল‚

“কাউকে বলব না৷ তুমি বল!”

ভূমি সব কথাই বলল অর্পণকে৷ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অর্পণ। না কথাগুলো ফেলে দিতে পারছে। তখন মেহরাব শিকদার আর ভূমির মাঝে হওয়া কথাগুলো সবই শুনেছে সে। তবুও ভূমির মুখ থেকে আরও কিছু সত্যি জানার ছিল তার। যাকে নিজের আইডল‚ নিজের ইন্সপিরেশন মনে করত‚ সেই লোকটাই এতদিন মুখোশ পড়ে ভালো মানুষের নাটক করেছেন৷ বাবার প্রতি ঘৃণায় জর্জরিত হলো চিত্ত এবং মস্তিষ্ক। দাউদাউ করে জ্বলছে ভেতরটা। ভূমির চোখের দিকে চোখ মেলাতে পারছে না। অজান্তেই যাকে বোনের সম্মান দিয়েছে‚ সেই মানুষটাই তার আপন বোন৷ তারও ছোটো বোন রয়েছে৷ ভূমির হাতখানা ধরে কান্না করে দিল অর্পণ। কথায় আছে পুরুষ মানুষের কান্না করতে নেই । অথচ আজ নিজের চোখেই নিজেকে খারাপ মনে হচ্ছে। নিজের র’ক্তকে কলুষিত মনে হচ্ছে। ওড়না দিয়ে অর্পণের চোখের পানি মুছে দিয়ে ভূমি বলল‚

“আম্মা আর উনার পর আমার এটা মনে হবে না যে আমার কেউ নেই। আমি একা নই— আমার নিজের ভাই রয়েছে৷”

স্নেহময় হাতে ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে অর্পণ বলল‚ “আমারও একটা বোন রয়েছে। কেউ তোর পাশে থাকুক বা না থাকুক— আমাকে তোর পাশে সবসময় পাবি বোন।”

একটু থেমে অর্পণ আবারও বলল‚ “পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে ভাই বোনের সম্পর্ক। ছোটো বেলা থেকেই খুব করে চাইতাম আমার একটা বোন হোক। পূর্ণতা পুষ্পিতা তো আমার বোন তবুও আমার একজন বোনের অভাব ছিল। আল্লাহ আমার সেই অভাবটা তো বহু আগেই পূরণ করে দিয়েছিলেন। অথচ তা অজানাই ছিল। আমার বোন আমার চোখের সামনেই ছিল কিন্তু আমি জানতেই পারলাম না৷ ভাই বোনের নাকি রক্তের টানের থেকে আত্মার টান বেশি গভীর হয় তবে আমি কেন একটুও বুঝতে পারলাম না?”

ভূমি অশ্রুসিক্ত চোখে অর্পণের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। এক হাতে এখনো আইসক্রিমের ব্যাগটা ঝুলছে৷ এতক্ষণে হয়তো গলতে শুরু করেছে৷ অর্পণ তা খেয়াল করে বলল‚

“দেখেছিস— আমাদের বাক্যালাপে আইসক্রিম হয়তো গলতে শুরু করেছে৷ তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি ঘরে যাচ্ছি।”

আঁখিপল্লব ঝাপ্টে সায় জানাল ভূমি। অর্পণ আর দাঁড়াল না৷ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেল৷ সমস্ত মন খারাপকে দূরে রেখে ভূমি বিছানায় বসে আইসক্রিম খেতে শুরু করল৷ এটা তার ভাই অনেক ভালোবেসে তার জন্য কিনে নিয়ে এসেছে। আনন্দ হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে হচ্ছে আইসক্রিমের বক্সটাকেই বুকের ভেতরে আগলে রাখতে। এই কথাটা অন্তত আম্মাকে জানানো দরকার। এরই মাঝে বেহায়া ফোনটা বাজতে শুরু করল৷ একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসছে৷ অচেনা নাম্বার বিধায় ধরল না ভূমি৷ ফোনটা সেভাবেই ক্রমাগত বাজতেই থাকল৷ এদিকে মনের সুখে আইসক্রিম খাচ্ছে ভূমি। ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম খেতে বেশ লাগছে৷ আবারও ফোন বেজে ওঠায় বিরক্ত হলো ভূমি। এবার ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করল৷ লাউড স্পিকারে রেখে সালাম জানাল সে।

“আসসালামু আলাইকুম! কে বলছেন?”

“আমি তোমার দুষ্টু বর বলছি।”

ভূমি চট করে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল৷ নাম্বারটা চেনে না কিন্তু এমপি মশাইয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। ভূমি ফোনটাকে আবারও কানে রাখল। প্রলয় বলছে‚

“আমার ভোলা ভালা বউটা কী করছিল?”

“আইসক্রিম খাচ্ছিলাম৷ আপনি খাবেন?”

“তুই এইসময় আইসক্রিম পেলে কোথায়? আর খাচ্ছ যেহেতু কম খাবে! নয়তো ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।”

“ভাইয়া এনে দিয়েছে৷ আর ইতিমধ্যেই খেয়ে নিয়েছি সবটা।”

“ঠান্ডা লাগলে তোমাকে বারান্দা নয়তো ওয়াশরুমে ঘুমতে পাঠাব।”

ছোটো বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে জিজ্ঞেস করল‚ “ঘরে থাকতে দেবেন না কেন?”

“আমার বারণ শুনলে না কেন?”

“আইসক্রিম খেতে বেশ ভালো লাগছিল তাই আপনি কিছু বলার আগেই সবটা খেয়ে নিয়েছি। ঠান্ডা লাগবে না।”

কথাটা বলতে দেরি কিন্তু ভূমির হাঁচি দিতে দেরি হলো না৷ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো৷ ভূমি আবারও গাল ফোলাল৷

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

প্রকাণ্ড সূর্যটা প্রায় নিভন্ত। বুকে দুহাত গুজে বিছানায় বসে রয়েছে প্রলয়৷ আড়চোখে ভূমিকেও দেখছে সে। সর্দি খুব ভালোভাবেই লেগেছে। হাঁচি দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করছে ভূমির। মেঝেতে টিস্যু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। নাক মুছতে মুছতে বেহাল দশা৷ টমেটোর মতো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। জ্বালা করছে ভীষণ। তারউপর হাড় জ্বালাতে জ্বালাময়ী ভাব নিয়ে প্রলয় বলল‚

“সত্যি হলো তো আমার কথা?”

“বেশি কথা না বলে আমার মাথাটা একটু টিপে দিন। খুব ব্যথা করছে।”

“আমার বয়েই গেছে৷ আরও খাও আইসক্রিম। আমি অর্পণকে বলছি তোমার জন্য আরও কয়েক বক্স আইসক্রিম এনে দিতে।”

কথা বলতে বলতেই বিছানা ছেড়ে নামল প্রলয়৷ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই অর্পণকে ডাক দিল। তার ঘরের পাশের ঘরটাই অর্পণের। প্রলয়ের ডাক শুনেই ঘর থেকে ছুটে এলো অর্পণ। এতক্ষণ ইরার সঙ্গে কথা বলছিল। ইরা আজ গ্রামে গিয়েছে। মহুয়া আর আরশের সঙ্গেই গিয়েছে৷ অনেকদিন বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হয় না তার৷ এদিকে আজ সারাদিনে একটিবারের জন্যও ইরার সঙ্গে কথা হয়নি অর্পণের। সবে পাঁচ মিনিট হয়েছিল ইরাকে কল করায়। অর্পণ আসা মাত্রই দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল প্রলয়। অর্পণ ঘরে এসে দেখল ভূমি এক হাতে টিস্যু আরেক হাতে মাথা চেপে ধরেছে৷ কোমরে হাত গুজে ধরমের স্বরে অর্পণ বলল‚

“সঙ্গে সঙ্গে সর্দি লাগিয়ে ফেললি? সবটা আইসক্রিম খেতে কে বলেছিল? আমি ঔষধ নিয়ে আসছি। চুপচাপ খেয়ে নিবি।”

অর্পণ চট করে ভূমির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে প্রলয় হা করে তাকিয়ে রয়েছে। অর্পণ ঝড়ের বেগে এলো আবার ঝড়ের বেগে চলেও গেল। সে যে ঘরে রয়েছে‚ তাকে একটিবার গুরুত্বও পর্যন্ত দিল না। ভূমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে। অর্পণের ধমক বাচ্চাদের মতো মাথা নিচু করে শুনছিল। ভাইয়ের বকা খেতে বেশ ভালো লাগছিল তার। এরই মাঝে অর্পণ আবারও চলে এলো। হাতে করে সর্দির ঔষধ নিয়ে এসেছে। ভূমিকে ঔষধটা এগিয়ে দিয়ে এক গ্লাস পানিও দিল। সবাটাই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে প্রলয়। ভূমি ঔষধটা খেয়ে নিল। প্রলয় হাতে তালি দিয়ে বলল‚

“বাহ্! কী দরদ!”

“আমার বোন! দরদ তো থাকবেই।”

হাঁটে হাড়ি ভাঙার ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো হলো ভূমির। প্রলয় কিছুই বলল না। সবই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ কালে কালে এমপি মশাইয়ের কী দুর্দশা নেমে এলো। প্রলয় আগের ভঙ্গিতেই চেয়ে রইল অর্পণ আর ভূমির দিকে৷ তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিক করে হেসে উঠল ভূমি। তার সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে অর্পণও হাসছে। এবার প্রলয় বলল‚

“তোর বোনকে বলিস আজ বারান্দায় আর নয়তো ওয়াশরুমে থাকতে।”

“ও কেন থাকবে? যেহেতু ওর সর্দি লেগেছে তাই সে বিশ্রাম নেবে। তুমিই গিয়ে বারান্দায় আর নয়তো ওয়াশরুমে গিয়ে থাকবে।”

“ওয়াশরুম আমার‚ বারান্দা আমার‚ ঘর আমার‚ বিছানা আমার এমনকি বউটাও আমার। সেই তোরা আমাকে আমার বউয়ের কাছ থেকে আলাদা করে দিলি!”

প্রলয়ের এহেন কথায় সব সময়কার মতো আজও ভড়কে গেল অর্পণ। এভাবেই প্রলয় তাকে সবসময় বোকা বানায়। বিদ্রোহ করে এবার অর্পণ বলল‚ “তুমি নিজেই তো আমার বোনকে আলাদা করে দিচ্ছিলে।”

দুহাত জোড় করে প্রলয় বলল‚ “ঘাট হয়েছে আমার৷ আমার বোঝা উচিত ছিল— এখানে আমার পক্ষে কেউ নেই।”

এবার শব্দ করে হেসে উঠল অর্পণ আর ভূমি। ছোটো বাচ্চাদের মতো করে গাল ফোলাল প্রলয়। অর্পণ তার ঘরে চলে গেল। এত হাসাহাসির মাঝে ভূমি বেমালুম ভুলে গেল‚ তার মাথা ব্যথা করার ব্যাপারটা। হাঁচি দেওয়া আপাতত কমেছে৷ প্রলয় দরজা চাপিয়ে এসে ভূমির পাশে বসল। ভূমির মাথাটা নিজের বুকের উপর রেখে আলতো হাতে চুল টেনে দিল। মাঝে মাঝে মাথাটাও টিপে দিল৷ চোখে বন্ধ করে রয়েছে ভূমি। হয়তো এখন কিছুটা ভালো লাগছে। প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“আরাম লাগছে জান?”

ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে ভূমি বলল‚ “হুম!” প্রলয় বুঝল সর্দির ঔষধ খেয়ে ভূমির ঘুম পাচ্ছে। তাই আর বেশি কথা বাড়াল না৷ কিন্তু এই সন্ধ্যে বেলায় ঘুমলে রাতে ঘুম হবে না। সারাদিনের রুটিন এলোমেলো হয়ে যাবে৷ পরক্ষণেই ভাবল‚ হলে হবে। এই ভেবে ভূমির চুলে আবারও হাত বুলিয়ে দিল প্রলয়৷

অন্যদিকে…

বারান্দায় দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন মেহরাব শিকদার। ফিরোজাকে চা করে আনার বাহানায় ঘর থেকে বের করেছেন তিনি। একটা বড়ো বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেহরাব শিকদার। সেটা তো যে করেই হোক বাস্তবায়ন করতেই হবে৷ ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটার সঙ্গে এতক্ষণ কুশল বিনিময় করলে এবার মোদ্দা কথায় এলেন তিনি।

“তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে৷”

“……”

“শেকড় নড়াতে পারলে গাছ এমনিতেই নড়ে যাবে।”

“……”

“আপাতত এই কাজটা করে দাও। আর হ্যাঁ এর জন্য মোটা টাকা পাবে তুমি। এরপর আমার পথের কা’টা আরেকজনকে সরাতে হবে।”

“……”

“এই জন্যই তো তুমি আমার এতটা বিশ্বস্ত। তোমাকে ভরসা করি বলেই তো সব কথাই তোমাকে বললাম। তা তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?”

“……”

“সময় পেলে আমি নিজেই গিয়ে তোমাকে সব ডিটেইলস দিয়ে আসব। এরজন্য পুরষ্কার হিসেবে টাকা আর মেয়ে দুটোই পাবে।”

“কার সঙ্গে কথা বলছ? আর পুরষ্কার আর মেয়ে এসবের মানে কী?”

হুট করেই ফিরোজার গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। কী করে ব্যাপারটা সামাল দেবেন সেটাই ভাবছেন তিনি! এভাবে হুট করে কথার মাঝেই যে ফিরোজা চলে আসবেন এমনটা তিনি ভাবতেই পারেননি। বড্ড ভুল হয়ে গেল যে! তিনি বললেন‚

“ও কিছু না। আমার একজন কলিগ তার ছেলের জন্য পুত্রবধূ খুঁজছে। আমাকে বলছে পুত্রবধূ খুঁজে দিতে পারলে নাকি পুরষ্কার দেবে।”

জগাখিচুড়ি যা তা বলেই ব্যাপারটা ধামাচাপা দিলেন মেহরাব শিকদার। আপাতত এই ঝামেলা থেকে বাঁচুক তারপর বাকি সব হবে। বোকা ফিরোজাও স্বামীকে বিশ্বাস করে নিলেন অল্পতেই। আর অবিশ্বাস করার মতো তো কোনো কারণ নেই উনার কাছে।

প্লেটে করে ভূমির জন্য খাবার নিয়ে এসেছে প্রলয়। সবে ঘুম থেকে উঠেছে ভূমি। লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিল। এখনো মাথাটা ঝিমচ্ছে। প্রলয় জোড় করেই ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। একবার ঘুম যেহেতু ভেঙেছে‚ এখন আর সারা রাতে ঘুম আসতে চাইবে না৷ বিছানায় থম মে’রে বসে রয়েছে সে। আর প্রলয় তাকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। এই তিনমাসে আগের থেকে কিছুটা মোটা হয়েছে ভূমি৷ নতুন বউ থেকে এখন পুরোনো বউয়ের তকমা লেগেছে। আগে যে-ই বাড়িতে আসত সে-ই বলত‚ ‘কী গো নতুন বউ কেমন আছ?’ আর এখন বলে‚ ‘কী গো প্রলয়ের বউ কেমন আছ? অথবা ভূমি কেমন আছ?’ যাক এই তিনমাসে সম্বোধনের দিক থেকে পরিবর্তন এসেছে৷ বসে বসে হাই তুলছে ভূমি। প্রলয় এসে তার সামনে বসল। হাত ধুয়ে খাবার মেখে মুখের সামনে ধরে ইশারায় ‘হা’ করতে বলল ভূমিকে৷ ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গেই খাবার খেতে শুরু করল ভূমি। ক্ষিধে পেয়েছিল তার৷ সেই দুপুরে খেয়েছিল। এরপর আইসক্রিম ছাড়া আর কিচ্ছুটি খায়নি সে। ঘুমের জন্য আলসেমি ধরছিল বিধায় খেতে ইচ্ছে করছিল না। ওইযে আলসেমি ধরছিল খুব।

বেশ কিছুক্ষণ সময় পর ভূমিকে খাবার খাইয়ে এঁটো প্লেট রান্নাঘরে রেখে এলো প্রলয়। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল ভূমি অলস ভঙ্গিতে বিছানাতেই বসে রয়েছে। মাঝে মাঝে ফোলা ফোলা চোখ কচলে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে হাই তুলছে। চুলগুলো এলোমেলো বিনুনি গাঁথা। ভূমির গাল দুটোতে শব্দ করে চুমু খেতে ইচ্ছে করল প্রলয়ের। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে খুবই অভিলাষিণী লাগছে। প্রলয় গিয়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে দিল। এরপর সোজা বিছানায় চলে এলো। এসির পাওয়ার কমিয়ে দেওয়া। ভূমিকে টান দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। প্রলয়ের এহেন কাজে ভড়কে গেল ভূমি। তবুও কিছু বলল না৷ প্রলয় কখন কী করে বুঝে আসে না তার। এমপি মশায়ের এই বাচ্চামো স্বভাবটা হয়তো কখনো যাবার নয়। এসব ভাবনার মাঝেই ভূমির বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে প্রলয়। একহাতে এমপি মশাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ভূমি। আর এদিকে প্রলয় তার ভূমির কন্যার আরেক হাতের উল্টো পিঠে বেশ কয়েক বার চুমুও এঁকে দিচ্ছে। ঘরে নীলচে ঘুম বাতি জ্বলছে। ভূমির বুকের উপর থেকে মাথা তুলে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“আজ একটু আদর করি বউ?”

“ঘুমান। আমারও ঘুম পাচ্ছে।”

“কিন্তু আমার তো বাসর রাতের ফিলিংস হচ্ছে।”

“বাসর রাত তিনমাস আগেই শেষ। তাই আপনিও ঘুমান আর আমাকেও ঘুমতে দিন।”

“বউ যদি কাছে থাকে তাহলে প্রতিটা রাতই বাসর রাত।”

“আপনি আবারও বাজে বকা শুরু করলেন?”

“বাজে কথা কোথায় বললাম? সত্যি কথাই তো বললাম৷ এটা শুধু আমার কথা না— সমগ্র পুরুষজাতির মনের কথা।”

“আপনি তো সর্বজ্ঞ!”

“অবশ্যই। আমি হচ্ছি এ শহরের এমপি। পুরুষজাতির মনের কথা জানাটা আমার দায়িত্ব।”

শুরু হয়ে গেল প্রলয়ের অযৌক্তিক কথাবার্তা। একে তো সন্ধ্যে বেলা ঘুমনোর কারণে এখন তার মোটেও ঘুম পাচ্ছে না তারউপর এই রাতবিরেতে প্রলয়ের এই সমস্ত কথাবার্তা হজম করতে হচ্ছে তাকে৷ ভূমি প্রত্যুত্তর করছে না দেখে প্রলয় নিজে থেকেই আবার বলল‚

“তুমি একটা জিনিস খেয়াল করেছ? আমাদের এখনো মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া হয়নি।”

“তাতে কী? আর গিয়েই বা কী হবে?”

“আমাদের ভালোবাসায় মিষ্টত্ব বাড়বে।”

“কেন এখনের ভালোবাসা বুঝি তেঁতো হয়ে গেছে?”

“তেঁতো হবে কেন? আমার বউ এবং তার ভালোবাসা তো মিষ্টির থেকে অধিক মিষ্টি৷ তবে আমার এই অধিক মিষ্টির চাইতেও অধিক মিষ্টি চাই৷ ইউ নো না— তোমার এমপি মশাই একটু বেশিই রোমান্টিক?”

“এত লাগাম ছাড়া হবেন না এমপি মশাই।”

“বউয়ের সামনেই তো লাগাম ছাড়া হতে হয়। তা না হলে কী এত আদর করতে পারতাম নাকি?”

ভেংচি কাটল ভূমি। অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। রাত তো কম হচ্ছে না। এদিকে ঘুমও আসছে না। কেমন প্যাঁচার মতো করে জেগে রয়েছে। প্রলয় ভূমিকে নিজের দিকে ফেরাল। সে থাকতে কেন তার বউ অন্যপাশ ফিরে ঘুমবে? বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জাপ্টে ধরে না ঘুমবে! তাহলেই তো ঘুমটা গভীর হবে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রান্নাবান্নার কাজে লেগে পড়েছে ভূমি। ফিরোজার খুব জ্বর। আজ রান্নাঘরে মাধুরীকেও কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। তিনি ভূমির সঙ্গেই হাতে হাতে কাজ করছেন৷ সাবিনা বাড়িতে নেই। এইতো দিন তিনেক হলো সে তার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে৷ বলে তো গিয়েছে এক সপ্তাহের মতো থাকবে। বাকিটা সে-ই জানে। একটা বাড়িতে তো আর কম কাজ থাকে না! আজ পূর্ণতা পুষ্পিতা কলেজে এডমিশন নেবে। প্রলয় তাদের দুজনকে কলেজে নিয়ে যাবে। সকাল দশটা থেকে ভর্তির কার্যক্রম শুরু হবে৷ স্কুলের বান্ধবীরা একেকজন একেক কলেজে ভর্তি হচ্ছে৷ এখন থেকেই সবাই আলাদা আলাদা জায়গায় পড়াশোনা করবে। স্কুলজীবনের এই দশটা বছর খুবই মধুর স্মৃতিবিজড়িত হয়। স্কুলজীবন হচ্ছে একটা আবেগ। একটু একটু করে হওয়া বন্ধুত্ব যখন গভীর হতে শুরু করে তখনই কয়েক লহমায় তা স্মৃতিপাতায় আটকা পড়ে যায়। সকালের নাস্তা হিসেবে খিচুড়ি‚ বেগুন ভাজা আর ঝাল ঝাল করে মুরগী রান্না করা হয়েছে৷ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকেই পূর্ণতা পুষ্পিতার দৈনন্দিন রুটিন পালটে গেছে৷ দুপুর বারোটার আগে তাদের দেখা মেলে না৷ মাধুরী চলে গেলেন পূর্ণতা পুষ্পিতাকে ঘুম থেকে জাগাতে। যাওয়ার আগে ভূমিকে বলে গেলেন‚ এই দিকটা সামলে নিতে। ডাইনিং টেবিল গোছাতে গোছাতেই মোর্শেদ শিকদার‚ মেহরাব শিকদার‚ প্রলয় আর অর্পণ চলে এসেছে। ফিরোজাকে হালকা খাবার আর ঔষধ খাইয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই। এরই মাঝে মাধুরীও চলে এলেন। এতক্ষণ ধরে পূর্ণতা পুষ্পিতাকে জাগানোর অভিযান চালিয়েছেন তিনি। সবে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েছে। দুটোর তৈরি হতে আরও দশ বা পনেরো মিনিট সময় লাগতে পারে।

সকাল সাড়ে নয়টা…

মোর্শেদ শিকদার আগেই বেরিয়ে পড়েছেন। অর্পণ তার বাইক নিয়ে আগেই বেরিয়ে পড়েছে। যাবার আগে একটিবারও মেহরাব শিকদারের সঙ্গে কথা বলেনি। বাবার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে। মেহরাব শিকদার ছেলের এমন ব্যবহারে চরম অবাক। তিনি খেয়াল করলেন কাল থেকেই অর্পণের এমন অদ্ভুত ব্যবহার। যেই ছেলে কি-না বাবা বলতে অজ্ঞান। আজ সেই ছেলেই কি-না ক্রমাগত দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছে৷ হুট করে হলোটা কী ছেলেটার? পূর্ণতা পুষ্পিতাকে নিয়ে প্রলয়ও হয়তো কিছুক্ষণের মাঝেই বের হবে। মেহরাব শিকদার নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে মাধুরীকে বললেন‚

“ফিরোজার একটু ভালো করে খেয়াল রেখ ভাবি।”

মেহরাব শিকদারের এহেন কথায় তাচ্ছিল্য করে বাঁকা হাসল ভূমি। এমনই একটা জীবন তো তার মায়েরও পাওনা ছিল৷ অথচ ভাগ্য কী খেলটাই না খেলছে! ব্যাপারটা একদমই দৃষ্টি এড়াল না প্রলয়ের। ভূমিকে এভাবে হাসতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। মেহরাব শিকদার চলে গেলেন৷ মাধুরী গিয়েছেন পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে। দরকারি কাগজপত্র গুলো গুছিয়ে নিতে হবে। বৈঠকখানায় শুধু মাত্র প্রলয় আর ভূমি উপস্থিত। প্রলয়ের মনে প্রশ্নটা আবার জাগতেই সে ভূমির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল‚

“তখন চাচ্চুর কথায় এভাবে হাসছিলে কেন?”

কথাটা পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে চাইলেও ভূমি তা করতে পারবে না। কিন্তু প্রলয়কে তো কিছু একটা বলতে হবে। তাই আর কোনো কিছু না ভেবেই ভূমি বলল‚

“উনাদের ভালোবাসা দেখে। কতটা গভীর উনাদের ভালোবাসা! একে অপরের প্রতি এত চিন্তা— এত ভালোবাসা।”

“সারা দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসা নজরে পড়ল৷ অথচ আমি যে তোমাকে চোখে হারাচ্ছি— সেটার বেলা?”

এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতা আর মাধুরী নিচে নেমে এলেন। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল ভূমি। প্রলয় তার বোনদের সঙ্গে করে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ভূমি এদিকে হাতের কাজগুলো শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল। দুপুরের আগে আর কোন কাজ নেই। যেহেতু সাবিনা নেই আর ফিরোজা অসুস্থ তাই সোনার কাজগুলো তাকে দেখতে হবে। অবশ্য সে পারবে সব কাজ করতে। এতদিনে সংসারের কাজ সে ভালোই শিখে গেছে।

গাড়ি থেকে নেমে পূর্ণতা আর পুষ্পিতাকে আগে আগে হাঁটতে বলে প্রলয় গাড়ি লক করল৷ ওরা দুবোন ধীর পায়ে সামনে এদিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ আর মাত্র কয়েক কদম তার পর থেকে কলেজ জীবন৷ কলেজ গেইট থেকে কিছুটা সামনে দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রলয় সামনে আর পূর্ণতা পুষ্পিতা দুজন দুজনের হাত ধরে সামনের দিকে এগোচ্ছে। তোদের দুবোনকে দেখে ছেলে দুটো শিস বাজিয়ে উঠল। কেমন করে যেন দাঁত কেলিয়ে হাসছে! পেছন থেকেই প্রলয়কে ডাকার জন্য উদ্যত হলো।

“বড়ো ভা…!”

পুষ্পিতাকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়ে তার হাতটা ধরে ফেলল পূর্ণতা৷ ইশারায় চুপ থাকতে বলল৷ বড়ো ভাইয়ার রাগ সম্পর্ক ওরা দুজন বেশ ভালোই অবগত৷ এখনো পেছনে দুটো বখাটে ছেলে শিস বাজাচ্ছে৷ দেখে বোঝা যাচ্ছে বাবা মায়ের বিগড়ে যাওয়া ছেলে এরা। কোনো কাজকর্ম নেই। পূর্ণতা পুষ্পিতা আর প্রলয়কে কেউই চিনল না কারণ গাড়ি থেকে নামার আগেই মাস্ক পড়ে নিয়েছিল। ধুলোতে এলার্জি আছে প্রলয়ের। পূর্ণতা পুষ্পিতা কাঁচুমাচু হয়ে প্রলয়ের পেছন পেছন হাঁটছে। দুজনকে কলেজের গেইটের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে সেই ছেলে দুটোর সামনে এসে দাঁড়াল প্রলয়। রাগে তার চোয়ালে শক্ত হয়ে আছে। তখন সে স্পষ্ট শুনেছে যে এরা দুটোতে মিলে তার বোনদের টিজ করছিল। নেহাতই পূর্ণতা পুষ্পিতা পাশে ছিল তাই রাস্তা দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট করেনি৷ তাই বলে এই নয় যে‚ সে সবটা মেনে নিয়েছে। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে ছেলে দুটোর সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রলয়৷ তাকে দেখা মাত্রই চোখমুখ কুঁচকে রাগান্বিত হয়ে একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল‚

“সমস্যা কী?”

“ওই মিয়া সামনে থেকে সরেন তো!”

মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলল প্রলয়। এ শহরে তাকে চেনে না এমন মানুষ খুবই কম আছে। ছেলে দুটো নড়েচড়ে দাঁড়াল। সামনে স্বয়ং এমপি ‘সেহরিশ আরশান প্রলয়’ দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে কি-না রেগে গেলে প্রলয়ঙ্কারী রূপ ধারণ করে। তবে তারা তো তেমন কিছুই করেনি। আর না এমপির চ্যালাপেলাদের সঙ্গে কিছু হয়েছে। দ্বিতীয় ছেলেটা জিজ্ঞেস করল‚

“কিছু হয়েছে স্যার?”

প্রলয় এবারও কিছু বলল না৷ ঠাস করে প্রথম ছেলেটাকে একটা থা’প্পড় মে’রে বসল। হুট করে এভাবে থা’প্পড় খেয়ে থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটা। বুঝে উঠতে পারল না— সে করেছেটা কী? আশেপাশের পথচারীরাও কয়েকজন দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। কেউ কেউ তো ভিডিও করতেও শুরু করে দিয়েছে৷ আজকালকার জেনারেশনটাই এমন। যা-ই ঘটুক— ভিডিও করা চা-ই চাই। ভাইরাল হবার ব্যাপার আছে কি-না!

“কী হয়েছে স্যার? ও কী কিছু করেছে?”

এবার এই দ্বিতীয় ছেলেটাকেও শরীরের শক্তি দিয়ে থা’প্পড় মে’রে বসল। পরপরই চেঁচিয়ে উঠল প্রলয়। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ছেলে দুটোর। এখনো তারা কিছুই বুঝতে পারছে না৷ ভয়ে গলা শুয়ে আসছে৷ হাতপা থরথর করে কাঁপছে ক্রমাগত। এমপির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চারটে খানি কথা না। এবার কিছুটা ভীড় জমেছে চারিপাশে৷ ট্রাফিক পুলিশ ছুটে এলেন। রাস্তা অপাশেই উনি ডিউটি করেন৷ প্রলয়কে চিনতে পেরেই বললেন‚

“কিছু কী হয়েছে স্যার? এরা কিছু করছে?”

এবার মুখ খুলল প্রলয়। ট্রাফিক পুলিশকে বলল‚ “এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েদের টিজ করছিল।”

ছেলে দুটো নিজেদের বাঁচানোর জন্য বলল‚ “আপনার কোথাও ভূল হচ্ছে স্যার। আমরা তো এমনিতেই এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

ট্রাফিক পুলিশ ওদের কথা বিশ্বাস করলেন না। কারণ তিনি এর আগেও এদের দুজনকে মেয়েদেরকে বিরক্ত না করার হুমকি দিয়েছিলেন কিন্তু এরা একটা কথাও শোনেনি। উল্টো আরও বেশি করে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেছিল৷ ট্রাফিক পুলিশ অফিসার সরাসরিই ছেলে দুটোর খারাপ আচরণের কথা সকলের সামনে বলে দিল৷ ছেলে দুটো তাকাল প্রলয়ের দিকে। এবার যেন চোখ দিয়েই গিয়ে খাবে ছেলে দুটোকে৷ শুকনো ঢোক গিলল। মানে মানে কে’টে পড়লেই যেন বাঁচে৷ পালাতে নিলেও পালাতে পারল না৷ এবার একটা শেষ হু’মকি দিল প্রলয়৷ ছেলে দুটো মনে মনে ভাবল‚ এ জীবনে আর রাস্তায় দাঁড়াবে না। মানসম্মান যা খোয়ানোর তার ইতিমধ্যেই খুইয়ে ফেলেছে ওরা৷ এতক্ষণে হয়তো লোকজন এটাকে লাইভ টেলিকাস্ট করে দিয়েছে।

সন্ধ্যে বেলা…

বৈঠকখানায় বসে রয়েছেন মোর্শেদ শিকদার‚ মেহরাব শিকদার‚ প্রলয় আর অর্পণ। রান্নাঘর থেকে তাদের জন্য চা আর গরম গরম পকোড়া ভেজে দিয়ে গিয়েছে ভূমি। ডাইনিং টেবিলের উপর লাল শাক বিছিয়ে রাখা৷ মাধুরী বসে বসে সেগুলোর আগাছা ময়লা পরিষ্কার করে শাকগুলো একটা ঝুড়িতে রাখছেন৷ রাতের খাবার রান্না হবে এখন। রান্নাঘরে ভূমি বাকি কাজগুলো করছে। এদিকে প্রলয় মুখ ফুটে মধুচন্দ্রিমার কথাটা বলতেই পারছে না৷ কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তার! চার দেয়ালের মাঝে স্ত্রীর সামনে যে কথাগুলো বলা যায় তা তো আর সবার সামনে বলা যায় না! পুরুষ মানুষ হয়ে যে সব লাজলজ্জা ধুয়ে খেয়েছে এমনটাও নয়। মাঝে মাঝে পুরুষ মানুষও লজ্জা পায়। কিন্তু লজ্জা পেলে যে মনের কথা কখনোই মুখে আসবে না৷ মনে মনে ‘এক‚ দুই‚ তিন’ বলে সমস্ত লাজলজ্জার মাথা খেয়ে প্রলয় বলল‚

“আমি ভাবছি দু-একদিনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঘুরে আসি? মুশফিকা বার বার বলছে ওদের ওখানে যেন যাই।”

খাওয়া থামিয়ে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “তোমার ব্যস্ততা কাটিয়ে যদি সময় থাকে তাহলে ঘুরে আসতেই পারো।”

শুকনো ঢোক গিলে প্রলয় আবারও বলল‚ “আমার বউকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব।”

ঠোঁট টিপে হাসলেন মোর্শেদ শিকদার আর অর্পণ। এবার একটা মোক্ষম সুযোগ পেলেন মেহরাব শিকদার। নিজের পথের কা’টা উপড়ে ফেলবার জন্য এর থেকে ভালো সুযোগ আর হয়তো একটাও আসবে না৷ মনে মনে এক পৈশাচিক পরিকল্পনা করছেন তিনি। অতি উল্লাসে তিনি বলে উঠলেন‚

“তোদের দুজনের জন্য আমি নিজ দায়িত্বে রিসোর্ট বুক করছি। নিজেদের প্রয়োজনীয় শপিং করে নে৷ কালই রওনা দিস।”

সায় জানাল প্রলয়। ডাইনিং স্পেসে বসে সবটাই শুনলেন মাধুরী। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না তিনি। উনার এমন ব্যবহার আজ সত্যিই অবাক করল ভূমিকে৷ এদিকে সে মেহরাব শিকদারের ব্যবহারেও খুবই অবাক। এই লোককে বিশ্বাস করা দায়। না জানি কোন ফন্দি আটছেন।

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

আজ কলেজে প্রথম দিন পূর্ণতা পুষ্পিতার। কলেজের প্রথম দিন নিয়ে দুজনের মাঝে বেশ উচ্ছাস। সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগেছে দুজন। উচ্ছ্বসিত হয়ে খুব তাড়াতাড়িই তৈরি হয়ে নিয়েছিল দুজনে। ফিরোজার জ্বর অনেকটাই কমে এসেছে। সকাল থেকে জ্বর নেই বললেই চলে। তবুও উনাকে বিছানা ছাড়তে বারণ করেছেন মাধুরী। সবে জ্বর থেকে উঠছেন। দু একদিন বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। সকালের নাস্তা মাধুরী নিজের হাতেই করেছেন। ভূমি আজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে সেই সকাল থেকেই। প্রলয় আজ কিছুটা ব্যস্ত থাকবে। আজ তার সংসদ সভায় যাওয়ার কথা। সেও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। উঠেই গোসল করে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে নিয়েছে। তার উপর কালো কটি। ভেজা চুলগুলো তাড়াতাড়ি করে শুকিয়ে নিয়ে স্যাট করেছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার কলেজ সকাল আটটা পনেরো থেকে শুরু। প্রলয় নিজেই ওদের দুজনকে কলেজের সামনে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এরপর আবার বের হবে সকাল দশটার দিকে। ভূমি রান্নাঘরে এসে যখন দেখল মাধুরী সকালের নাস্তা সব বানিয়ে রেখেছেন‚ তখন কিছুটা কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল তার৷ না জানি শাশুড়ী মা কখন কী বলে উঠেন! তিনি যে এখনো তাকে মেনে নিতে পারেননি সেটা ভূমি খুব ভালো করে বুঝতে পারে। অন্যদের ক্ষেত্রে ভালোবাসা মিললেও তার প্রতি অবহেলায় জুটেছে৷ এ বাড়িতে দুজন মানুষ হয়তো তাকে কখনোই মেনে নিতে পারবেন না৷ এক হলো মাধুরী। আরেকজন হলো তার জন্মদাতা পিতা। যিনি কি-না তাকে জন্মের আগেই মে’রে ফেলতে চেয়েছিলেন৷ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যান নিজের পথের কা’টা কীভাবে সরাবেন! ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভূমি।

মাধুরী টেবিলে খাবার রাখছেন৷ ভূমিকে বললেন ফিরোজাসহ বাকিদেরকে ডেকে নিয়ে আসতে। ভূমিও উনার কথানুযায়ী সবাইকে ডাকতে চলে গেল। প্রথমে পূর্ণতা পুষ্পিতা‚ প্রলয় আর অর্পণকে ডেকে ভূমি নিচে নেমে এলো। এরপর মোর্শেদ শিকদারকে ডেকে ভূমি গেল মেহরাব শিকদারের ঘরের দিকে। তখনই দেখা হয়ে গেল মোরশেদ শিকদারের সঙ্গে। তিনি সবে ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন। ভূমিকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এই সময় ভূমিকে আশা করেননি তিনি। আজকের দিনটার কথা ভাবতেই উনার খুব আনন্দ লাগছে। এবার খুব বড়োসড়ো পরিকল্পনা করেছেন তিনি। ভূমিকে কিছুটা বাজিয়ে দেখার জন্য মেহরাব শিকদার বললেন‚

“ডক্টর মেহরাব শিকদারের মুখোশ কীভাবে উন্মোচন করবে‚ কিছু ভেবেছ?”

ভূমি চকিত দৃষ্টিতে তাকাল মেহরাব শিকদারের দিকে। লোকটার চোখমুখে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। দুদিনের মাঝে কী এমন হলো যে‚ নিজের মাঝে এতটা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেলেন তিনি? সেদিন তো ভূমির কথার প্রত্যুত্তরে কোনো উত্তরই দিতে পারছিলেন না৷ এত পরিবর্তনের কোনো উত্তর খুঁজে পেল না ভূমি। মেহরাব শিকদার আবারও বললেন‚

“আমার সঙ্গে লাগতে এসো না মেয়ে৷ দুনিয়াটা তুমি এখনো দেখনি।”

“আপনার এই ভালো মানুষের মুখোশ সবার সামনে উন্মোচন করতে দুনিয়াটা ঠিক কতখানি দেখা উচিত?”

চরম বিরক্ত মেহরাব শিকদার। চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না উনার। চোখ দিয়েই অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। মেহরাব শিকদার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন‚

“আচ্ছা ঢাঁট আর ধুরন্ধর মেয়ে তো তুমি!”

ভূমি তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল‚ “একই র’ক্ত কি-না!”

“বয়স কম তো তাই র’ক্ত গরম। অন্যের চরকায় তেল না দিয়ে নিজের চরকায় তেল দাও।”

“সেটাই দিচ্ছি।”

কথাটা বলেই ভূমি ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। মেহরাব শিকদার বৈঠকখানার দিকে চলে গেলেন। ঘরে ফিরোজা বিছানা গোছাচ্ছেন। ভূমি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি গাল এলিয়ে হাসলেন। উনার হাত থেকে বিছানা ঝাঁট দেওয়ার ঝাঁটাটা নিজের হাতে নিয়ে বলল‚

“আমি করে দিচ্ছি চাচি মা৷ তুমি এখন কেমন আছ?”

“আমি ঠিক আছি ভূমি। তুমি এত ব্যস্ত হইয়ো না।”

ভূমিকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন ফিরোজা। ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মেহরাব শিকদার। চেয়ারে বসে রয়েছে অর্পণ। দুজনের দৃষ্টিই ফিরোজা আর ভূমির দিকে। দুজনেই জানেন ভূমির আসল পরিচয়। অর্পণ ক্ষীণ হাসল ওনাদের ভূমি আর ফিরোজাকে দেখে৷ দুজন কী সুন্দর মা মেয়ের মতো একসঙ্গে হেঁটে এলো৷ অর্পণের খুবই ভালো লাগল। এদিকে মেহরাব শিকদারও এদিকেই তাকিয়ে অথচ উনার চিন্তাভঙ্গিই আলাদা। তিনি ভাবছেন কী করে ভূমিকে সরানো যায়!

দুপুরে…

আজ দুপুর থেকে মনটা ভালো না ভূমি। ভেতরটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগতে শুরু করেছে! কোনো কাজে মন বসাতেই পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই। এইতো দুপুরেও রান্না করতে গিয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। তারপর আর কী? পুরোটা তরকারি পুরে কয়লা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভূমির ওড়নায় আগুন লেগেছিল। তখন রান্নাঘরে মাধুরী ছিলেন৷ তিনিই তাড়াহুড়ো করে চুলো নিভিয়েছেন। ভূমির ওড়না থেকে আগুন নিভিয়েছেন। তবে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন‚ “মন কোথায় থাকে? কী এত ভাবছ? রান্নাতে মনোযোগ দাও। আমি না থাকলে কী হত ভাবতে পারছ?” ঠিকই তো বলেছেন তিনি। যদি ওড়নায় পুরোপুরি ভাবে আগুন লেগে যেত? কী অঘটনটাই না ঘটত! ভাবতে শিউরে উঠল ভূমি৷ মাধুরী তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। বাকি কাজটা তিনি আর ফিরোজা সামলে নিতে পারবেন৷ ঘরে এসে আবারও অন্যমনস্ক হয়ে গেল ভূমি। সে কী ভাবছে নিজেও বুঝতে পারছে না! সময় অতিবাহিত হতে লাগল। ভূমি একটিবার ভাবল হয়তো গোসল করলে শরীরটা হয়তো একটু ভালো লাগবে তাই সে নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

সন্ধ্যেবেলা পূর্ণতা পুষ্পিতার নতুন টিউটর এসেছিলেন। শুরু থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে ওরা। মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে খুবই স্ট্রিক্ট মোর্শেদ শিকদার। যা-ই হয়ে যাক না কেন পড়াশোনা সময় মতো হওয়া চা-ই চাই! ছোটো থেকেই ওদের জন্য বাসায় টিউটর রাখা হয়৷ স্কুল‚ কলেজ ছাড়া বাহিরে যাওয়া হয় না ওদের। যা দরকার হয় তা বড়ো ভাইয়া আর নয়তো ছোটো ভাইয়া কিনে এনে দেয়। আর নয়তো মাকে জানায়। এদিকে টানা দেড় ঘণ্টা পড়াশোনা করে খুবই ক্লান্ত পূর্ণতা পুষ্পিতা। ভাবল একটিবার তাদের ভাবিমণির সঙ্গে দেখা করে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ৷ দুবোনই চলে গেল তাদের ভাবির কাছে। ভূমি তখন হাতে থাকা কাপড়চোপড় গুলো বিছানার উপর রাখছিল। এগুলো সবেই বারান্দা থেকে এনেছে। পূর্ণতা পুষ্পিতা এবার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ভূমি এবার তাদের দুজনকে জিজ্ঞেস করল‚

“তোমাদের কলেজের প্রথম দিন কেমন কাটল?”

দাঁড়িয়ে থেকে আড়মোড়া ভেঙে পূর্ণতা বলল‚ “খুবই ভালো কেটেছে ভাবিমণি।”

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে পুষ্পিতা বলে উঠল‚ “তুমি জানো ভাবিমণি আমাদের অনেকগুলো নতুন বন্ধু হয়েছে৷ মেয়েগুলো খুব ভালো আর মিশুক।”

“ওদের মিশুক মনে হয়েছে কারণ আমার রায়বাঘিনী ননদিনীরা যে এত এত ভালো আর মিশুক!”

পূর্ণতা এসে ভূমিকে জড়িয়ে ধরে বলল‚ “আমাদের ভাবিমণিও যে খুব খুব খুব ভালো আর মিশুক। এইযে কত তাড়াতাড়ি আমাদের সবার সঙ্গে সহজ হয়ে গিয়েছ৷ আমাদের পরিবারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছ। মায়ের সমস্ত কটু কথা নীরবে সহ্য করেছ।”

“হয়েছে— হয়েছে!”

এবার পুষ্পিতা এসে ভূমির গাল দুটো টেনে দিয়ে বলল‚ “অ্যাই পূর্ণ! তুই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”

পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল‚ “কী?”

“আমাদের ভাবিমণি আগে থেকে গোলুমোলু হয়ে গিয়েছে৷ এখন তাকে দেখতে আরও বেশি সুন্দরী লাগে।”

পূর্ণতা পুষ্পিতার গাল দুটো টিপে দিয়ে এবার ভূমি বলল‚ “তোমাদের বেশি বেশি ভালোবাসায় আমি মোটু হয়ে গিয়েছি।”

এরপর তিনজনই খিলখিল করে হেসে উঠল৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা গিয়ে বিছানায় আয়েশ করে বসল। এদিকে ভূমি শুকনো কাপড়চোপড় গুলোকে গোছাতে শুরু করল৷ দুপুরে ধুয়ে দিয়েছিল। সবগুলোই প্রলয়ের জামাকাপড়। বিছানায় আধশোয়া হয়ে নিজেদের মাঝেই কথায় মশগুল পূর্ণতা পুষ্পিতা। এরই মাঝে হতভম্ব হয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল প্রলয়। তাকে দেখা মাত্রই পূর্ণতা পুষ্পিতা নিজেদের ঘরে চলে গেল৷ বড়ো ভাইয়া সবে বাহির থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজন তাই তারা তার ভাই ভাবিকে কিছুটা স্পেস দেওয়ার জন্যই মূলত চলে গিয়েছে। বিছানার উপর গুছিয়ে রাখা কাপড়চোপড় গুলোকে ওয়ারড্রব রেখে দিল৷ এদিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে প্রলয়। সে যে গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পারল ভূমি৷ সে গিয়ে প্রলয়ের সামনে দাঁড়াল৷ কাঁধে হাত রাখতেই প্রলয় মুখ তুলে তাকাল। লোকটার চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে৷ লোকটা কী কোনো কারণে রেগে আছে? বুঝতে পারল না ভূমি। হুট করে প্রলয় তাকে জড়িয়ে ধরল৷ প্রলয়ের শরীরটা কিছুটা গরম রয়েছে। জ্বর টর এলো না তো? ভূমি তার কপালে হাত রাখল। কপালও কিছুটা গরম। প্রলয় তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতেও অসুবিধে হচ্ছে ভূমি। এভাবেই কিছুটা সময় কে’টে গেল৷ ভূমিও কিছু বলল না। কিছু হলে তো নিজে থেকেই বলবে! এমন কোনো কথা নেই যা এমপি মশাই তার থেকে লুকিয়ে রাখে৷ অথচ সে তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্যিটাই লুকিয়েছে প্রলয়ের কাছ থেকে। হয়তো কোনো একদিন সব সত্যিই উদঘাটন হবে অথবা হবে না! সময় অতিবাহিত হতে থাকল। প্রলয় মুখ তুলে ভূমিকে তাড়া দিয়ে বলল‚

“আমাদের আজ অনিন্দ্যনগর যেতে হবে।”

অনিন্দ্যনগরের নাম শুনে সহসাই অবাক হলো ভূমি। সেই সঙ্গে চিন্তার ভাজ পড়ল গৌর সুশ্রীতে। ভূমি জিজ্ঞেস করল‚

“কিন্তু কেন? হঠাৎ করে গ্রামে কেন যাব? আপনি আগে তো বলেননি যে‚ আজ আমরা গ্রামে যাব?”

এই মুহূর্তে কোনো কিছুই ভালো লাগছে না প্রলয়ের৷ তারউপর ভূমির ক্রমাগত প্রশ্নে চরম বিরক্ত সে। তাই কিছুটা ধমকে বলল‚

“এত প্রশ্ন ভালো লাগছে না। তুমি রেডি হবে?”

হুট করে প্রলয়ের এমন ব্যবহার খুবই অবাক করল ভূমিকে৷ সেই সঙ্গে কিছুটা খারাপও লেগেছে৷ কই এই তিনমাসে তো ভুল করে খারাপ ব্যবহার করেনি লোকটা। তাহলে আজ কী হলো? অনিন্দ্যনগরের নাম শুনে হুট করেই ভূমির মনটা কু গাইছে। ভেতরটা ধক করে উঠল ভূমি। অসাড় হাত-পা কেঁপে উঠল৷ মনের ভেতর তো অনেক কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে! প্রলয়কে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। ভূমি শুকনো ঢোক গিলে বলল‚

“এমপি মশাই! আমার আম্মা ঠিক আছে তো?”

শেষরাতের দিকে কালো রঙা গাড়িটি এসে থেমেছে মোড়ল বাড়ির বাগানে। মণ্টু‚ মণিসহ মোড়ল বাড়ির সবাই সদর দরজার কাছে বসে রয়েছেন। সকলেই কাঁদছেন৷ শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমা খুবই স্নেহ করতেন মহুয়াকে। ছোটো বোনের নজরেই দেখে এসেছেন তিনি। মোড়ল বাড়িতে প্রায় পনেরো বছর ধরে কাজ করছেন মহুয়া। নিজের কাজ সবসময় খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। কখনো কোনো কাজে গাফেলতি করেননি। আরশ‚ ইরা‚ মণি আর মন্টুও খুবই সম্মান করত মহুয়াকে। এমনটা কেউ-ই আশা করেনি। সামনেই একটা খাটিয়ায় পড়ে রয়েছে একটা নিথর দেহ। যার আপাদমস্তক সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই ভূমির মাঝে। হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে। প্রলয় তার হাতটা শক্ত করে ধরে রয়েছে। সারাটা রাস্তা বেশ অস্থিরতায় কেটেছে৷ এক মুহূর্তের জন্য দুচোখের পাতা এক করেনি ভূমি। বারবার প্রলয়কে জিজ্ঞেস করেছে তার আম্মা ঠিক আছে তো? আশানুরূপ কোনো জবাবই মেলেনি প্রলয়ের কাছ থেকে। ভূমিকে নিয়ে সামনে দিকে এগোলো প্রলয়। তাদের দেখা মাত্রই দাঁড়িয়ে পড়েছে সকলে। ইরা উঠে এগিয়ে এলো ভূমির কাছে। অর্পণও এসেছে সঙ্গে। প্রলয়ের কাছ থেকে কথাটা শোনার পর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সে। মায়ের সমতূল্য মহুয়াকে খুবই সম্মান আর শ্রদ্ধা করত সে৷ ওরা তিনজনই সদর দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছে। প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚

“এখানে ক..কে শুয়ে রয়েছে?”

কেউ-ই কোনো উত্তর দিতে পারল না৷ প্রলয়ও কিছু বলছে না। কী করেই বা কথাটা বলবে সে? তারও যে বড্ড খারাপ লাগছে৷ মহুয়া যে তারও মায়ের সমতূল্য। কেউ কিছু বলছে না দেখে এবার ভূমি কিছুটা চেঁচিয়ে প্রলয়কে বলল‚

“আপনি অন্তত কিছু বলুন! সে সন্ধ্যে থেকে এখন অবধি চুপ করেই রয়েছেন।”

ইরা এগিয়ে এসে ভূমিকে শান্ত করার চেষ্টা করল৷ কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারল না। ভূমি ক্রন্দনরত কণ্ঠে ইরাকে বলল‚

“অন্তত তুমি কিছু বল ইরা!”

ভূমির কাঁধে হাত রেখে ইরা বলল‚ “নিজেকে সামলাও ভূমি। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্যি হচ্ছে— সবাই চিরকাল বেঁচে থাকে না৷ মৃ’ত্যু দিয়েই তাদের জীবনের উপসংহার ঘটে। মহুয়া আন্টি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। উনি আর কোনো আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। এই সত্যিটাকে তুমিও মেনে নাও।”

মাথা ঘুরে উঠল ভূমির। নিটোল পা দুটো কাঁপছে। শরীরে শক্তি পাচ্ছে না সে। প্রলয় এখনো তার হাতখানা শক্ত করে ধরে রেখেছে৷ “তার আম্মা আর নেই” কথাটা শ্রবণ করা মাত্রই জীবনটা যেন এখানেই থমকে গেল। “তার আম্মা আর নেই” তারমানে আজ থেকে তার দুনিয়াটাই বৃথা৷ নিজের বলতে আর কেউ রইল না তার। হাঁটু গেড়ে মাটির উপর বসে পড়ল ভূমি। লা’শের কাছে গিয়ে মুখের উপর থেকে সাদা কাপড়টা তুলল৷ লাইটের আলোতে মায়ের মায়াময়ী মুখটা মুহূর্তেই দৃষ্টিগোচর হলো। সঙ্গে সঙ্গে হুহু করে কেঁদে উঠল ভূমি। আলতো হাতে মায়ের মুখটা ছুঁয়ে বলতে লাগল‚

“অ্যাই আম্মা চোখ খুলে দেখ— তোমার ভূমি এসেছে! কথা বলবে না আমার সঙ্গে? তুমি তো বলেছিলে অহর্নিশ আমার পাশে পাশেই থাকবে। কখনো একা করে দেবে না। তাহলে আজ কেন কোনো কথা বলছ না আম্মা? তুমি কী তোমার কথা রাখবে না? তাহলে কেন আমাকে বিয়ে দিয়েছিলে? কেন আমাকে তোমাকে কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলে আম্মা? অভাবের মাঝেও তো আমরা ভালোই ছিলাম আম্মা। না আমাকে বিয়ে দিতে আর না আজকে এমন একটা দিন আসত। তুমি বড্ড স্বার্থপর আম্মা! বড্ড স্বার্থপর!”

ভূমির এত কাতরতাও আজ তার আম্মাকে স্পর্শ করছে না৷ দিব্যি চোখ দুটো বন্ধ করে আছেন। লা’শ কী আর তাকাতে বা কথা বলতে পারে? স্তব্ধ চাহনিতে ভূমি চিৎকার করে বলল‚ “আম্মা…!”

ভূমিকে শান্ত করার জন্য প্রলয় এবার চেঁচিয়ে বলল‚ “চুপ! আর একটা কথাও না৷”

কিছুটা শান্ত হলো ভূমি। তবে নীরবে অশ্রুপাত করছে মেয়েটা। ভূমিকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল প্রলয়৷ সে অনুভব করল ভূমির শরীরটা নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়েছে তার উপর। পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে এবং ভূমিকে। পাঁজো কোলে তুলে মোড়ল বাড়ির ভেতরে চলে গেল৷ ভূমির কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন। মেয়েটা জার্নি করতে পারে না। বেশ কয়েকবার বমিও করেছে গাড়িতে৷ তারপরও দুচোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ করেনি। ভূমির অবস্থা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে প্রলয়।

ভোর হতে শুরু করেছে। গ্রামে পাড়াপড়শি অনেকেই আসছে। কেউ কেউ তো মিথ্যে কান্নায় মন ভোলানোর চেষ্টা করছে। মহুয়া জীবিত থাকাকালীন এমন কোনো মানুষ বাকি ছিল না যারা উনাকে কটু কথা শোনাননি। কৌশলে অনেকেই অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছেন। অথচ আজ তারাই মিথ্যে কান্নায় মন ভোলাচ্ছেন। ইরা আর নাজমা কোরআন তেলাওয়াত করছেন। ভূমি কেমন নিশ্চুপ ও নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছে! নিজেকে তার অভিশপ্ত মনে হচ্ছে৷ তার আম্মার এমন জীবনের জন্য একমাত্র দোষী সে নিজেই। আজ থেকে ভূমির জীবনে শুধুই হাহাকার নেমে এসেছে। সকাল দশটার পর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পুরো মোড়ল বাড়িতে মানুষের ভীড় জমেছে। এমন নিশ্চুপ ভূমিকে দেখে বুকের ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে প্রলয়ের৷ মহুয়ার নিথর দেহটা এখনো বাহিরের খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে৷ লা’শকে গোসল করানো হয়েছে ভোর রাতে। মহুয়ার মৃ’ত্যুর সংবাদ মসজিদে মাইকিং করা হচ্ছে। শোক সংবাদের প্রতিটা ধ্বনি কানে ঝংকার তুলছে।

সকালে ঘুম ভাঙতেই মায়ের লা’শের সামনে এসে বসে পড়ল ভূমি। মায়ের শঙ্কাহীন বুকটা কেমন শক্ত আর হিম হয়ে আছে! মুখ তুলে তাকাল চির নিদ্রায় শায়িত প্রাণপ্রিয় মায়ের নিষ্পাপ মুখাবয়বে। ভূমি কন্যার সিক্ত ফোলা আঁখিদ্বয়ে অস্পষ্ট অভিলাষ। এই বুঝি আম্মা চোখ মেলে তাকাল৷ এই বুঝি ভূমি বলে কাছে ডাকল। কিন্তু হায়! আম্মা যে আর চোখ মেলে চাইবেন না। একটিবার ভূমি বলে ডাকবেন না। ভূমি ডুকরে উঠল। বাস্তবতা যে বড়ো-ই তিক্ত! ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলতে লাগল‚

“তোমার ভূমি যে একা হয়ে গেল আম্মা। একদম একা। না তার বাবা আছে আর না তার আম্মা৷ তুমি কেন আমাকে একা করে চলে গেলে আম্মা? এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় তোমার ভূমি যে বড্ড একা।”

বেলা বাড়তে শুরু করছে৷ সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোদের রুষ্টতা। ভূমিকে কিছুতেই লাশের পাশ থেকে সরানো যাচ্ছে না। মেয়েটা কেমন পাথর হয়ে গেছে! চোখ দুটো হয়ে আছে শুকনো। প্রলয় জোর করে ভূমিকে তুলে নিয়ে ইরার কাছে দিয়ে এলো৷ এতে করে পাগলামি আরও বেড়েছে মেয়েটার। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করেছে অনবরত।

শোকের মাঝে সারাটাদিন কী অবলীলায় কেটে গিয়েছে! বিষণ্ণা উদাসীন ভূমি সুনিপুণ ভাবে নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রেখেছে। কারো সাথে কোনো কথা পর্যন্ত বলেনি। কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে! খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করেনি। এতে করে আরও দূর্বল হয়ে পড়েছে। সারাক্ষণ শুয়েই থেকেছে। মাথা তুলে উঠে বসার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। এদিকে তিনদিন অনিন্দ্যনগর থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রলয়। মহুয়ার কুলখানির আয়োজন বেশ বড়োসড়ো করে করা হবে৷ মসজিদে মিলাদ দোয়া পড়ানো হবে৷ পুরো গ্রামবাসী আর এতিমদেরকে খাওয়ানো হবে। সেটা নিয়ে বৈঠকখানায় কথাবার্তা চলছে। শাহাদাৎ মোড়ল‚ আরশ আর অর্পণও এখানেই বসে রয়েছে। কথায় কথায় প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“মহুয়া আন্টির কী হয়েছিল আঙ্কেল?”

“কাল দুপুরের খাবার খাওয়ার পর আমরা সবাই ঘুমিয়েছিলাম৷ মহুয়াও নিজের ঘরে গিয়ে হয়তো শুয়েছিল৷ এরপর যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো তখন তোমার আন্টি মহুয়াকে ডাকতে গেল। গিয়ে দেখল কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে মহুয়া। অথচ কাল খুব গরম ছিল। তো যাই হোক! তোমার আন্টি ডাকল মহুয়াকে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেল না। মুখের উপর থেকে কাঁথা সরাতেই দেখতে পেল মহুয়া একদম নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রয়েছে। নিশ্বাস অবধি নিচ্ছিল না। তাড়াহুড়ো করে আমাদেরকে ডাকে। এরপর আরশ নিজে মহুয়ার নাড়ী পরীক্ষা করে। কিন্তু ততক্ষণে মহুয়া আর নেই!”

নাজমা বললেন‚ “এমন কিছু যে ঘটবে এটা আমাদের কল্পনাতীত ছিল৷ কখনো ভাবিইনি যে‚ মহুয়া আমাদেরকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে! ভূমির দিকে তাকানো যাচ্ছে না বাবা। মেয়েটা খুবই ভেঙে পড়েছে। একমাত্র মা-ই তো তার সব ছিল।”

মহুয়ার জন্য খুবই খারাপ লাগতে শুরু করেছে৷ ভূমিকে কী করে সামলাবে সেটাই ভেবে যাচ্ছে প্রলয়! মেয়েটা খুবই ভেঙে পড়েছে। মহুয়াকে হারিয়ে ভূমি দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়েছে। কেমন পাথর হয়ে গিয়েছে! শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমার কথা শুনে খুবই খারাপ লাগল অর্পণের। মহুয়া জীবিত থাকাকালীন সময় কখনোই নিজের যোগ্য সম্মান পাননি। অর্পণ মনে মনে একটা কথা আওড়াল‚ “নিজের অপারগতা আমি ধিক্কার জানাই। সত্য জেনেও আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি আন্টি। আপনাকে ন্যায় দেওয়াতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। বাবার অন্যায়কে আমি নীরবে হজম করেছি৷ তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি‚ বড়ো ভাই হয়ে ভূমির পাশে আমি সবসময় ছায়ার মতো থাকব। কোনো বিপদ ওকে ছুঁতে পারবে না। বাবার ভালো মানুষের মুখোশ একদিন সবার সামনে উন্মোচন হবে।” মনে মনে খুবই আফসোস করতে শুরু করল অর্পণ। কিছুই ভালো লাগছে না তার৷ মেহরাব শিকদারের সত্যিটা যদি তার মা জানতে পারে তাহলে কী হবে? মাকে কী করে সামলাবে সে? মহুয়া আর ভূমির মতো তার মায়ের জীবনটাও যে এলোমেলো হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখনই খুব চিন্তিত সে।

অদ্ভুত অস্থিরতায় সাঁঝ পেরুল। কেটে গেল আরও কয়েকঘণ্টা। ব্যস্ততার মাঝে ভূমির সঙ্গে দেখা হয়নি বেশ অনেকটা সময় হয়েছে। ইরার কাছে ভূমির দায়িত্ব দিয়ে সে একটু বেরিয়েছিল। এরপর ঘরে গিয়ে ভূমিকে কোথাও পায়নি। প্রলয় যখন ঘরে আসে তারপরই ইরাও খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে আসে। ইরাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল‚ “ভূমির নাকি খুব ক্ষিধে পেয়েছিল তাই সে রান্নাঘরে গিয়েছিল ভূমির জন্য খাবার নিতে।” এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল প্রলয়। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? এমনিতেই ভূমির শরীরটা খুবই দূর্বল। একা একা কোথাও যাওয়ার মতো শক্তি অন্তত নেই! প্রলয় তাড়াতাড়ি করে সারাবাড়ি খুঁজতে শুরু করল৷ না! কোথাও নেই ভূমি! খুবই চিন্তায় রয়েছে প্রলয়৷ যেন দম আটকে আসছে তার। এরপর অর্পণের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“ভূমিকে দেখেছিস?”

অবাক হয়ে অর্পণ বলল‚ “কেন ও কী ঘরে নেই?”

চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রলয় বলল‚ “ঘরে আর সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোথাও পাচ্ছি না তো।”

“সে কী! কোথায় গেল মেয়েটা? ভাই চল— একটিবার বাহিরের দিকটা খুঁজে আসি। অথবা ওদের সেই পুরোনো বাড়িটায়।”

সায় জানাল প্রলয়। মুখে বলল‚ “হুম— চল!”

চলবে?…..