#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
রাত তখন বারোটার কাছাকাছি। একটু একটু করে জ্ঞান ফিরছে ভূমির৷ মাথা ভার হয়ে আছে৷ এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল। সংকীর্ণ কামরায় লাল নীল আবছা বাতি জ্বলছে। আবছায়ায় সবকিছুই অচেনা লাগছে৷ শোয়া থেকে উঠে বসার শক্তিটুকু নেই৷ সকালে নাজমা জোর করে দুটো রুটি খাইয়ে দিয়েছিলেন। এরপর আর সারাদিন তার খাওয়া হয়নি। মাথা তুলে উঠতে পারছে না। ঘরের লাল নীল বাতি নিভে গিয়ে আবছায়া ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল৷ চোখমুখ কুঁচকে এলো ভূমির। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে‚ দুটো মেয়েকে তার মাথার আর পায়ের কাছে বসে থাকতে দেখতে পেল। মেয়ে দুটোকে সে চেনে না। আর না কখনো দেখেছে। পরক্ষণেই আম্মার কথা মনে পড়তেই ডুকরে কেঁদে উঠল সে। শুয়ে থেকেই ভূমি বলল‚ “এটা কোথায়? আমি এখানে কী করে এলাম?” ভূমির কাছ থেকে একথা শুনে পায়ের কাছে বসে থাকা মেয়েটা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল‚
“ন্যাকামি না করে উঠ তো৷ পড়ে পড়ে তো অনেক ঘুমোলি!”
মাথার কাছে বসে থাকা মেয়েটা এবার বলল‚ “এভাবে বলিস না চামেলি। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা অসুস্থ।”
“এসব অসুস্থতা তো ভান। ইচ্ছে করেই এমন করছে৷”
কিছুই বুঝল না ভূমি৷ আধস্বরে বলল‚ “আপনারা কারা? আমি এখানে কী করে এলাম?”
মাথার কাছে বসে থাকা মেয়েটা বলে উঠল‚ “তোমাকে আমরা রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়তে থাকতে দেখেছিলাম৷ এরপর আমাদের এখানে নিয়ে এসেছি।”
ভূমির মনে পড়ল‚ সে তো তার মায়ের কবরের সামনে গিয়েছিল৷ দূর থেকেই মায়ের কবরটা দেখতে চেয়েছিল। দূর্বল শরীর নিয়েই একটু একটু করে বেরিয়ে এসেছিল। প্রলয়কে পর্যন্ত বলেনি। হুট করেই ভূমির শরীরটা আবারও খারাপ করতে শুরু করে৷ শরীর ঘামতে শুরু করছিল। হাত পা দুটো নিঃসাড় হয়ে পড়ছিল৷ ভূমি দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না৷ এরপর অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়েছিল৷ তারপর আর কিছু মনে নেই তার৷ সবকিছু মনে পড়ায় ভূমি বলল‚
“এই জায়গাটা কোথায়? দয়া করে আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিন। আমার স্বামী হয়তো আমার জন্য চিন্তা করছেন।”
এরইমাঝে এখানকার সর্দারনি এলেন। পাতলা ফিনফিনে বাসন্তী রঙা শাড়ি৷ রঞ্জিত অধর কোণে হাসির ছোঁয়া। বড়ো বড়ো পা ফেলেই ঘরের ভেতরে এলেন তিনি। উনাকে দেখা মাত্রই মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ভূমি উঠে বসার চেষ্টা করল। অবশেষে সফল হলো সে। বালিশে আধশোয়া হয়ে বসল। মহিলা এবার বলে উঠলেন‚
“অসুস্থ বলে পাড় পেয়েছিস মেয়ে। একটা দিনের সময় দিলাম। ভালো মতো খাওয়াদাওয়া করে নিজেকে সুস্থ করে তোল। অ্যাই চামেলি‚ তিথি!”
“জি ম্যাডাম।”
“কাস্টমারদের ডিমান্ড বাড়ছে। তাদের নাকি নতুন মেয়ে লাগবে৷ এই মেয়েকে তোদেরই তৈরি করতে হবে৷ দেখতে শুনতে তো আগুন সুন্দরী। কাস্টমারের ভীড় জমে যাবে৷”
চামেলি বলল‚ “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাডাম।”
ভূমি এদের কথা কিছুই বুঝতে পারল না৷ তবে এরা যে মোটেও সুবিধের নয় সেটা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে। একটু একটু করে বিছানা থেকে নামতে আরম্ভ করল। মুখে বলল‚
“আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিন। আমার স্বামী আর পরিবার হয়তো খুব চিন্তা করছেন।”
নিজের কাজে হস্তক্ষেপ সহ্য হয় না পিংকির। অল্পতেই রেগে গেলেন ভূমির উপর। রেগে গিয়ে ভূমির গাল চেপে ধরে বললেন‚
“এখানে একবার যে আসে মৃ’ত্যুর আগ অবধি এখান থেকে বেরতে পারে না। তুমি নিজেকে তৈরি কর। শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলছি— পুরুষ মানুষদের আনন্দ দিবি। আমার কথা না শুনলে তোর এমন হাল করব!”
তিথি এগিয়ে এসে বলল‚ “আমি সব বুঝিয়ে দেব ম্যাডাম।”
“হুম! বুঝিয়ে দিস ভালো করে। চামেলি আয় তো আমার সঙ্গে।”
সর্দারনি পিংকির পেছন পেছন চামেলিও চলে গেল। ভূমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বিছানায় বসে পড়ল। মাথা ঘোরাচ্ছে তার৷ তিথি তাকে ধরল। হাতটা সরিয়ে ফেলল ভূমি। সদ্য মাকে হারিয়ে এ কোন বিপদের মুখে পড়েছে সে? এরই মাঝে খাবার দিয়ে গেল চামেলি৷ পিংকি তাকে দিয়ে ভালো ভালো খাবার পাঠিয়েছেন৷ ভূমিকে যে দ্রুত সুস্থ হতে হবে। এখন থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার চূড়ায় উঠে নাচছেন পিংকি৷ ঘর থেকে চামেলি চলে যেতেই তিথি খাবারের প্লেটটা বিছানার উপর রেখে ভূমিকে বলল‚
“খাবারটা খেয়ে নাও মেয়ে।”
“খাব না আমি। আমাকে দয়া করে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিন।”
“খাবার না খেলে তুমি আরও দূর্বল হয়ে পড়বে।”
“আমি কিছু খাব না৷ চলে যান আপনি আমার সামনে থেকে।”
ভূমি এই তেজি ছটফটানো দেখে খুবই খারাপ লাগল তিথির। এখানে যখন প্রথম এসেছিল তখন তো সে-ও এমনই ছটফট করেছিল৷ এখান থেকে পালানোর কম তো চেষ্টা করেনি সে! এর জন্য দিনের পর দিন মার খেয়েছে পিংকিং হাতে৷ একটা সময় পর সবটাই সহ্য করে নিয়েছে৷ জানালা বিহীন চার দেয়ালের মাঝেই নিজেকে স্থাপন করেছে। হতে হয়েছে প্রতিদিন নিত্যনতুন পুরুষের শয্যাসঙ্গী। আজ ভূমিকে দেখে পুরোনো নিজের কথা মনে পড়ে গেল তিথির৷ বড্ড মায়া হলো মেয়েটার উপর৷ খাবারের প্লেটটা বিছানাতেই ডেকে রেখে বলতে লাগল‚
“শোন মেয়ে তোমাকে একটা কথা বলি।”
“আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার উপর দয়া করুন। যেতে দিন আমাকে এখান থেকে।
“এখানে যারা থাকে তারা কিন্তু সবাই খারাপ না৷ জীবনই তাদের পুরোপুরি বদলে দিয়ে খারাপে রূপান্তর করে। এখন থেকে পালাতে হলে তোমাকে আগে সুস্থ হতে হবে।”
চুপ করে গেল ভূমি। তিথির কথা শুনতে ইচ্ছে হলো। তিথিকে তার অন্যরকম মনে হলো৷ ভূমিকে বুঝতে পেরে এবার তিথি বলতে শুরু করল‚
“পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলাম। বিয়েও করেছিলাম৷ এরপর ছোট্টো একটা সংসার পেতেছিলাম দুজনে। স্বামী সংসার নিয়ে স্বপ্ন আমারও ছিল৷ কিন্তু সেই স্বামীই আমাকে ধোকা দিয়ে পিংকি ম্যাডামের কাছে বিক্রি করেছিল৷ প্রায় দুই বছর ধরে আমি এখানে বন্ধি। অনেক চেষ্টা করেছি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার। তবে আমি বারবারই ব্যর্থ হয়েছি।”
ভূমি থম মে’রে রইল। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা আর ধোকা পাওয়ার কষ্টটা হয়তো তার জানা নেই কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারে৷ এমন এক বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা তো তার আম্মার সাথেও ঘটেছিল। আম্মার কথা মনে পড়তেই আবারও কাঁদতে শুরু করল ভূমি। তিথি ব্যস্ত হয়ে ভূমির চোখের পানি মুছিয়ে দিল। এখানে অনেক মেয়েই এসেছে তবে তাদের মাঝে টাকার একটা তীব্র লোভ ছিল। তারা আপসেই গণিকার জীবনটাকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ভূমিকে তার আলাদা মনে হলো। তিথি ভেবে নিল— যত যা-ই হয়ে যাক‚ সে ভূমিকে এখান থেকে পালাতে সাহায্য করবে। সে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমার নাম কী?”
ক্ষীণ দূর্বল স্বরে ভূমি বলল‚ “ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”
“নামের মতই তুমি ভীষণ সুন্দরী‚ স্নিগ্ধ আর কোমল।”
“আমাকে এখানে কেন আটকে রাখা হয়েছে?”
“পিংকি ম্যাডাম যা যা বলল তা তো শুনেছই। এখানে আমাদের নিত্যদিন নিত্যনতুন কারোর না কারোর শয্যাসঙ্গী হতে হয়৷ পুরুষেরা এই জায়গাটাকে গণিকালয় অর্থাৎ নিষিদ্ধ পল্লিও বলে থাকে৷ রাতের আঁধারে এই সভ্য সমাজের পুরুষেরা এখানে আমাদের মতো গণিকাদের ভোগ করতে আসে৷”
‘গণিকা‚ গণিকালয়‚ নিষিদ্ধ পল্লি’ এই শব্দ গুলোর সঙ্গে পরিচিত নয় ভূমি৷ তবে তিথির কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছে সে৷ রুহ কেঁপে উঠল তার৷ কী করে এই নরক থেকে রেহাই পাবে সে! অঝোরে কেঁদে দিল মেয়েটা৷ তিথি উঠে গিয়ে একবার দরজার কাছে গেল৷ না বাহিরে এখন কেউ নেই। সেই সুযোগে ভূমির কাছে এসে বলল‚
“তুমি বড্ড সহজ সরল মেয়ে। আমি চাই না আমার মতো করে তোমার জীবনটাও এভাবে নষ্ট হয়ে যাক। আমি তোমাকে পুরোপুরি সাহায্য করব এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার৷ তবে তার আগে তোমাকে তো সুস্থ হতে হবে। তাই বলছি খাবারটা খেয়ে নাও।”
খাবারের প্লেটটা এবার ভূমির দিকে এগিয়ে দিল তিথি। নিঃশব্দে ভূমি তা নিয়ে নিল। তিথিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো। এত অচেনার মাঝে তিথিকে সহযোগী মনে হলো। বিশ্বাস নিয়ে বলল‚
“দয়া করে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। সত্যিই আমার পরিবারের সবাই আমার জন্য খুবই চিন্তিত। আমি আমার পরিবারের কাছে যেতে চাই। আমি এখানে থাকতে চাই না।”
তিথি বেশি কিছু না বলে শুধু এই কথাটাই বলল‚ “খাবারটা ঝটপট খেয়ে নাও।”
রাত আড়াইটা…
রাত তখন গভীর। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মোড়ল বাড়িতে ফিরেছে প্রলয়৷ মোড়ল বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ ভূমির জন্য প্রচণ্ড চিন্তা করছে৷ অনিন্দ্যনগরে এমন কোনো বাড়ি বাকি নেই যে‚ ভূমির খোঁজ করা হয়নি। অনিন্দ্যনগর থানাতেও যোগাযোগ করা হয়েছে৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মেয়েটা যেন উবে গেল৷ ভূমির জন্য পাগল প্রায় অবস্থা প্রলয়ের। কোথায় খুঁজবে ভূমিকে? কেউ তার হদিস জানে না৷ বোনের জন্য অর্পণও খুব চিন্তিত। নিজের বোনকে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেলল না তো? ভূমির চিন্তায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ দুই ভাইয়ের৷ প্রলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে‚ অনিন্দ্যনগরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও খোঁজ নেবে। বিরোধী দলের কোনো চক্রান্তও হতে পারে৷ এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না সে। যদি এমন কিছু হয় তাহলে সে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় হানবে। তার ভূমি কন্যার কোনো ক্ষতি হলে কাউকে ছাড়বে না সে। কারো তোয়াক্কা করবে না। অর্পণ নিজের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাইকেও সামলাচ্ছে৷ এ দুনিয়ায় ভূমির তো তাদের ছাড়া আর কেউই নেই। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? অর্পণ মনে মনে তার বাবাকে সন্দেহ করছে। পরপর এই ঘটনাগুলো অবশ্যই কাকতালীয় হতে পারে না। কোনো না কোনো রহস্য তো জড়িয়ে আছেই৷ তবে প্রলয়কে তা বলা যাবে না৷ আর না ভূমিকে দেওয়া ওয়াদা সে ভঙ্গ করবে। বহু কষ্টে প্রলয়কে হালকা কিছু খাবার খাইয়ে ঘমোতে পাঠিয়েছে অর্পণ। ভূমিকে খুঁজতে হলে তাদেরও সুস্থ থাকতে হবে।
প্রত্যুষের আলো ফুটতে শুরু করেছে। করিডরে হাঁটাহাঁটি করছে প্রলয়। সারাটা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। বারবার শুধু ভূমির সেই ক্লান্ত মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আজকের রাতটা অর্পণ প্রলয়ের সাথেই ছিল। এক মুহূর্তের জন্য নিজের ভাইকে একা করেনি। মাঝরাতের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল তার৷ অর্পণ এখনো ঘুমচ্ছে৷ করিডরে হাঁটাহাঁটি করতে করতে একবার ঘরেও এসেছিল প্রলয়। এরপর কী মনে করে যেন‚ নিজের লাগেজটা গুছিয়ে নিল। ভূমির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো। আর না থানা থেকে কোনো খবর এসেছে৷ প্রলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ফিরে যাবে৷ চার্জে বসানো ফোনটাকে হাতে নিয়ে ভূমির একটা ছবি বের করল সে। হাস্যজ্বল মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল? একটা দিনের মাঝে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল! প্রলয় নিজে নিজেই আওড়াল‚
“হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলে ভূমি কন্যা? তোমাকে ছাড়া আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো। তুমি ছাড়া আমি একটুও ভালো নেই। আমার সবকিছুই নিঃস্ব তুমি বিহীন।”
প্রলয়ের কথা কিছুটা কর্ণগোচর হতেই ঘুম হালকা হয়ে এলো অর্পণের৷ উঠে দেখল বিছানার এক কোণায় বসে রয়েছে প্রলয়৷ একা একাই কথা বলছে৷ অর্পণের সুবিধের মনে হলো না৷ দ্রুত উঠল পড়ল সে। প্রলয়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল‚
“ভাই তুমি ঠিক আছ?”
অর্পণের ডাকে মুখ তুলে তাকাল প্রলয়৷ নিজেকে আটকে রাখতে পারল না৷ অর্পণকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ভূমিকে না পেয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা তার৷ না নিজের অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারছে‚ না সে তার নিজের অবস্থা প্রকাশ করতে পারছে আর না নিজেকে সামলাতে পারছে। কোথায় যাবে— কোথায় পাবে তার প্রেয়সীকে? অর্পণ তাকে সামলে নিয়ে বলল‚
“নিজেকে সামলাও ভাই। ভূমিকে আমরা অবশ্যই খুঁজে পাব।”
“হুট করে কোথায় চলে গেল? আচ্ছা ওর কোনো বিপদ হয়নি তো? বিরোধী দলের কেউ এমনটা করেনি তো? ভূমি তো অসুস্থ‚ দূর্বল৷ মেয়েটা নিজেকে কী করে সামলাবে?”
“এভাবে কেঁদ না ভাই৷ খুব শীগ্রই আমরা ভূমিকে খুঁজে বের করব৷ ভূমিকে খুঁজতে হলে তো তোমাকে আগে স্ট্রং হতে হবে৷”
চোখের পানি মুছে প্রলয় বলল‚ “আমি স্ট্রং আছি। একদম স্ট্রং৷” একটু থেকে প্রলয় আবারও বলল‚
“আমি আজই ঢাকা ফিরে যেতে চাই৷ শহরের প্রত্যেকটা থানায় ভূমির ছবি পাঠাতে হবে৷ নিউজে ভূমির ছবি ছাঁপাতে হবে। যেভাবেই হোক ভূমিকে আমার চাই৷ ও ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”
অর্পণ বুঝল ভূমির প্রতি তার ভাইয়ের ভালোবাসার গভীরতা। প্রলয়কে সামলে নিল সে। মহুয়ার মৃ’ত্যু নিয়ে কাল থেকেই মনটা খচখচ করছে। তবে নিশ্চিত হয়ে কিছুই ভাবতে পারছে না সে। মনে মনে ভেবে নিল‚ এ সমস্ত ঘটনার জন্য যে বা যারা দায়ী তাদেরকে নিজে শাস্তি দেবে। এতে যদি তার বাবার হাতও থাকে তবুও সে পিছুপা হবে না। এক একটাকে শাস্তি পেতে হবে।
সকাল গড়িয়ে বেলা দুপুরে এসে ঠেকল৷ সংকীর্ণ জানালা বিহীন কামরায় রোদেরা উঁকি দিল না। ভূমি বুঝতেই পারল না বেলা কীভাবে গড়াচ্ছে! অদতেও তার জানা নেই। শরীর ভীষণই দূর্বল তার৷ সকালে খাবার খেতে গিয়ে দু’বার বমি করেছে৷ আর তা দেখে চামেলি নাক সিটকালেও তিথি যত্ন নিয়ে ভূমির খেয়াল রেখেছে৷ সবকিছু সে নিজেই পরিষ্কার করে দিয়েছে। পরবর্তীতে ভূমির জন্য চুরি করে একটি আপেল আর বেদানা নিয়ে এসেছিল৷ যা পিংকি নিয়ম করে দু’বেলা খান। তখন চামেলি কোথাও ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই নালিশ দিয়ে বসত পিংকির কাছে৷ এই মেয়ের আবার কথা লাগানোর স্বভাব আছে। আর বাকিরাও নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। অন্য খাবার মুখে তুলতে না পারলেও ফল দুটো খেতে পেরেছিল ভূমি। এখান থেকে পালাতে হলে তো সুস্থ হতেই হবে। শরীরে শক্তি না পেলে পালাবে নী করে?
এদিকে সর্দারনি পিংকি তখন নিজের কামরায় ছিল৷ উনার কামরা দেখতে বেশ সুন্দর এবং পরিপাটি৷ রঙিন বিছানার চাদর। ঘরের আসবাব গুলোও সাজানো গুছানো। রঙ বেরঙের ফুল এবং ফুলদানি। সচরাচর কাউকে নিজের কামরায় ঢুকতে দেন না তিনি। তবে আজ নিজে থেকেই চামেলিকে নিজের ঘরে ডেকেছেন৷ সকালে চম্পার কাছ থেকে নতুন মেয়েটার ব্যাপারে একটু আধটু কথা শুনেছিলেন তিনি৷ এখানে চামেলি হচ্ছে পিংকির ডান হাত৷ গণিকা মহলে কী চলছে আর কী কী কথাবার্তা হচ্ছে তার সমস্ত খবরাখবর চামেলিই উনাকে দেয়! একে করে বখশিশও ভালো পায় চামেলি। পিংকির ভাবনার মাঝেই ঘরের দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ হলো। হয়তো চামেলিই এসেছে। পিংকি বিছানায় আয়েশ করে বসে‚ ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিল। অনুমতি পেতেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করল চামেলি৷ পিংকি তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন‚
“ওদিকের কী খবর রে চামেলি?”
পিংকির কথার প্রত্যুত্তরে চামেলি বলল‚ “ম্যাডাম ও মেয়ে তো সেই সকাল থেকেই বমি করছে। আমার কিন্তু বিষয়টা ভালো ঠেকছে না৷”
“সকালে খাবার দিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম। খাবার মুখের সামনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছে। সকাল থেকে দুইবার বমি করেছে।”
এবার কিছুটা চিন্তায় পড়লেন পিংকি। মনে মনে ভাবলেন এই মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা নয় তো? তাহলে তো আরেক সমস্যা৷ বিবাহিত মেয়ে নিয়ে এলেও উনার ডেরায় এখনো পর্যন্ত অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে আসেনি। পিংকি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন‚
“তাহলে তো চিন্তার বিষয়। এ কেমন মেয়ে ধরিয়ে দিল মেহরাব শিকদার!”
“ম্যাডাম আমার মনে হয় একবার ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন।”
“আমি আগে মেহরাব শিকদারের সঙ্গে কথা বলে নিই।”
চামেলি চলে গেল। পিংকি নিজের ফোন বের করে মেহরাব শিকদারের নাম্বারে কল লাগালেন৷ রিং হলেও অপাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করল না৷ পিংক আবারও কল লাগালেন। রাগে গা কাঁপছে৷ উনার এই এক সমস্যা! অল্পতেই রেগে যান তিনি৷ ইচ্ছে মতো বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে শুরু করলেন। চতুর্থ বার ডায়াল করার সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ হয়ে গেল৷ মেহরাব শিকদার কিছু বলবেন তার আগেই পিংকি বলে উঠলেন‚
“মিয়া এ কেমন মেয়ে দিলেন? মেয়ের অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা।”
অপাশ থেকে মেহরাব শিকদার বললেন‚ “ডক্টর দেখিয়েছ?”
পিংকি তো আন্দাজেই ঢিল মেরেছিলেন। এখনো পর্যন্ত ডাক্তার দেখানো হয়নি। তাই তিনি বললেন‚ “না।”
“আগে ডাক্তার দেখাও তারপর নিশ্চিত হয়ে কথা বলবে। আর যখন তখন আমাকে কল দেবে না।”
“এখন কী করতে হবে সেটাই বলুন! যদি এই মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয় আর এই মেয়েকে দিয়ে যদি ব্যবসাই করতে না পারি তাহলে এই মেয়েকে তো বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারি না। আমার টাকা তো আর উড়ে উড়ে আসে না।”
এবার বিরক্ত হলেন মেহরাব শিকদার। কালই এতগুলো টাকা দিলেন তিনি৷ কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বললেন‚ “আচ্ছা সমস্যা নেই। কাল আমি এসে একবার দেখা করে যাব৷”
কথাটা বলেই কল কেটে দিলেন মেহরাব শিকদার। পিংকি ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য ভূমিকে একবার দেখে আসবেন৷ যেতে যেতে ডাক্তারের নাম্বারে কল লাগালেন তিনি। বিকেলে একবার দেখা করার কথা বললেন তিনি। কথা বলতে বলতেই ভূমিকে যেই ঘরটার রাখা হয়েছে সেই ঘরটার সামনে গেলেন। ভূমি তখন বিছানায় শুয়ে ছিল। ঘুমচ্ছে কি-না সেটা দরজার কাছ থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। তিথি এ ঘরেই ছিল। পিংকি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই তিথি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল৷ সারাদিন এ ঘরের সামনেই তাকে ঘুরঘুর করতে দেখে কিছুটা সন্দেহ হলো পিংকির। সন্দেহের সুরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚
“কাল থেকে দেখছি এ ঘরের সামনেই ঘুরঘুর করছিস! কী ব্যাপার?”
“ম্যাডাম মেয়েটা অসুস্থ। তাই ভাবলাম ওর কাছে কাছেই থাকি৷ যদি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে!”
“এই মেয়েকে এত সঙ্গ দিতে হবে না৷ শুধুমাত্র খাওয়ার সময় দেখে দেখে যাবি৷ আজ গ্রাহক আসছে। রেডি হয়ে থাকিস।”
“আচ্ছা ম্যাডাম।”
ভেতরটা হুহু করে উঠল৷ আর কতদিন সভ্য সমাজের পুরুষদের কাছে ভোগ্যবস্তু হতে হবে? এ জীবন থেকে কী কখনোই মুক্তি মিলবে না? নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে গুলোকে ভূমি চোখেও দেখতে পায় সে। মেয়েটা একটু একটু করে তড়পাচ্ছে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার কাতরতা স্পষ্ট দৃশ্যমান। তিথি মনে মনে ভেবে নিল‚ খুব শীগ্রই ভূমিকে সুস্থ হবার সঙ্গে সঙ্গেই এখান থেকে পালাতে সাহায্য করবে৷ তা না হলে যা সর্বনাশ হবার তা হয়েই যাবে৷ পিংকি তো পারে না এক্ষুনি ভূমিকে নিজের কাজে ব্যবহার করেন!
অন্যদিকে…
ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একাই হাসছেন মেহরাব শিকদার। সত্য লুকোনোর তাড়নায় দিনকে দিন উন্মাদ হয়ে উঠছেন তিনি৷ প্রথমত উনিশ বছর আগে মহুয়াকে চরম ভাবে ঠকিয়েছেন। দ্বিতীয়ত নিজের অনাগত সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বেই নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন৷ তৃতীয়ত নিজের অজানা সত্যি যেন দুনিয়ায় সামনে না আসে সেই জন্য মহুয়াকে খু’ন করান। নিজের ভাড়া করা লোক দিয়ে খু’ন করিয়েছেন তিনি। খু’ন এমন ভাবে করিয়েছেন যেন‚ সারা দুনিয়ার কাছে মনে হয় মহুয়ার মৃ’ত্যুটা নিছকই স্বাভাবিক মৃ’ত্যু। এতে করে তিনি সফলও হয়েছেন৷ মহুয়াকে খু’ন করার সময় তিনি ভিডিও কলেই ছিলেন৷ নিজের চোখে মহুয়ার মৃ’ত মুখখানা দেখে পৈশাচিক আনন্দ লুটেছেন তিনি৷ মহুয়াকে বালিশ চাপা দিয়ে মা’রা হয়েছে৷ তখন মোড়ল বাড়ির সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে গভীর নিদে আচ্ছন্ন ছিল৷ আর মহুয়াও নিজের ঘরে ঘুমচ্ছিলেন৷ ভূমির কাছে থেকে অর্থাৎ শহর থেকে আসার পর থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন৷ আরশ বলেছিল‚ নিয়ম করে প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেয়ে কয়েকঘণ্টা ঘুমনোর কথা। অতএব মহুয়া যে খু’ন হয়েছে এতে কাকপক্ষীতেও টের পায়নি। চতুর্থত কারণ হচ্ছে‚ ভূমিকে গণিকালয়ে পাঠানো৷ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মেহরাব শিকদার এমনই উন্মাদ হয়ে উঠছেন যে‚ নিজের সন্তান‚ নিজের রক্তকে পর্যন্ত বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একটা একটা করে নিজের পথের কা’টা দূর করছেন৷
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষের দিবসপতি ম্লানোন্মুখ। পশ্চিমাকাশের দিকে ক্রমশ হেলে পড়ছে৷ নিজের উত্তপ্ততা কমিয়ে মলিন হয়েছে। মালঞ্চ নীড় ফেরার পর থেকে প্রলয় তার ঘর থেকে বের হয়নি। আর না দুপুরে কিছু খেয়েছে! ফিরোজা একবার খাওয়ার জন্য প্রলয়কে ডেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রলয় তার ঘর থেকে একবারও বের হয়নি। পূর্ণতা পুষ্পিতা দরজার কাছ থেকে ফিরে গিয়েছে কিন্তু ওদের দুজনকে ঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়নি প্রলয়। নিজেকে একা কিছুক্ষণ সময় দিতে চাইছে সে। বাড়ি ফেরার পর এখানকার থানার ওসির সঙ্গে কথা হয়েছিল। তারা বলেছে ভূমিকে খোঁজার যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন। প্রত্যেকটা থানায় থানায় ভূমির ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই ভূমিকে খোঁজার যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাধুরী এবার প্রলয়ের জন্য প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসেছেন। দরজা খোলাই ছিল। তিনি ঘরে ঢুকে খাবারের প্লেটটা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রাখলেন। কারণ প্রলয় বিছানার বাঁ পাশে শুয়ে রয়েছে। তিনি তাকে ডাকলেন। প্রথমবার প্রলয়ের কাছ থেকে সাড়া না পেলেও‚ পরেরবার এপাশ ফিরে তাকাল। চোখ মুখ ফুলে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কান্না করছিল। ভড়কে গেলেন মাধুরী। শশব্যস্তভাবে ছেলের মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। প্রলয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন‚
“তোর কী হয়েছে বাবা? তুই কী কাঁদছিলি?”
গম্ভীর স্বরে প্রলয় জবাব দিল‚ “আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। প্লিজ তুমি এখন যাও।”
শুনলেন না মাধুরী। একই ভঙ্গিতে বসে রইলেন। আবারও জিজ্ঞেস করলেন‚ “আগে তো তুই এমন ছিলি না! মায়ের সঙ্গে তো অনেক কথাই শেয়ার করতিস। তাহলে এখন তোর কী হয়েছে? বিয়ের পর অনেকটাই বদলে গেছিস তুই! মায়ের সঙ্গে কী মনের কষ্টগুলো শেয়ার করা যায় না?”
প্রলয় কিছুই বলল না৷ একই ভঙ্গিতে শুয়ে রইল৷ মাধুরী সমস্ত রাগ গিয়ে চড়াও হলো ভূমির উপর। তিনি ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন‚
“আমি আগেই জানতাম এই মেয়ের চরিত্র ভালো না। হতে পারে কোন ছেলের সাথে পালিয়েছে। মায়ের স্বভাব যেমন ছিল মেয়ের স্বভাবও তো তেমনই হবে তাইনা?”
মায়ের মুখে ভূমির সম্বন্ধে এমন কথা শুনে প্রলয়ের রাগ হলো। শোয়া থেকে উঠে বসে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে উঠল‚ “তুমি চুপ করবে মা? বাড়িতে আসার পর থেকে দেখছি ভূমির নামে উল্টোপাল্টা কথা বলেই যাচ্ছ। কীসের ভিত্তিতে এসব কথা বলছো তুমি?”
“এখন তো আমার কথা তেঁতোই লাগবে। সত্যি কথা কারোরই ভালো লাগে না। তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন ছিল! কিন্তু ওই মেয়েকে বিয়ে করে তুই আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিলি। ভালোই হয়েছে ওই মেয়ে পালিয়েছে। আমি আমার ছেলেকে আবার বিয়ে দেব।”
“তুমি চুপ করবে মা? নাকি আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব? মনে শান্তি নেই তারউপর এখন বাড়িতেও শান্তি নেই। তোমাকে একটা কথা খুব ভালো ভাবে জানিয়ে দিচ্ছি‚ যেখান থেকেই হোক ভূমিকে আমি খুঁজে বের করবই। ওকে আমার চা-ই চাই।”
মুখ ঝামটা দিলেন মাধুরী। কিছুতেই প্রলয়ের মন থেকে ভূমিকে সরাতে পারছেন না তিনি। মেয়েটা কী জাদু করেছে জানা নেই উনার! শুরু থেকেই ভূমিকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। ভূমির জন্য ছেলেটা উনার গুমরে গুমরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ছেলের প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে মাধুরী বললেন‚
“মায়ের প্রতি হয়তো তোর অনেক রাগ। কিন্তু মায়ের মন কখনোই তুই বুঝতে পারলি না। হ্যাঁ আমি ভূমিকে দেখতে পারি৷ তার কারণ তো তোর অজানা নয়! তুই আমার একমাত্র ছেলে৷ তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল৷ যেটা তুই একমুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিস। এতে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি তা তুই একবারও জিজ্ঞেস করেছিস? আমার ছেলের কষ্ট আমি তো কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না৷ খাবার রেখে গিয়েছি— খেতে ইচ্ছে হলে খেয়ে নিস!”
এই বলে মাধুরী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ প্রলয় তার মায়ের কথাগুলো ভাবতে শুরু করল৷ ঠিকই তো বলেছেন উনি। বিয়ের পর এই সাড়ে তিনমাস ধরে‚ মায়ের কাছে এসে মন খুলে কথা বলা হয়নি। মায়ের হালচাল জিজ্ঞেস করা হয়নি। কাজে এতটাই ডুবে ছিল যে‚ মায়ের খেয়াল নেওয়া হয়নি তার। মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে খারাপ লাগল প্রলয়ের৷ টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করল।
সংকীর্ণ সেই কামরা হতে ডক্টর বেরিয়ে এলেন। ভূমিকে দেখানোর জন্যই পিংকি উনাকে ডেকেছিলেন। ঘরের ভেতরেই সবাই রয়েছে৷ তিথি বসে রয়েছে ভূমির মাথার কাছে৷ তার সেবায় কিছুটা সুস্থ ভূমি৷ দুপুরে জোর করে পেট ভরে খাইয়েছিল৷ না না করতে করতেও শুটকি ভর্তা দিয়ে অনেকগুলো ভাত খেয়েছে আজ৷ ডক্টরের পেছন পেছন যখন সবাই বেরিয়ে গেল তখন তিথিও আর বসে থাকেনি৷ তারও তো জানা উচিত ডক্টর কী এমন কথাবার্তা বলছেন পিংকির সঙ্গে! তিথি তখন দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ ডক্টরের কথা আবছা হলেও বুঝেছে সে। ডক্টর বলছিল‚
“আই থিংক শি ইজ প্রেগন্যান্ট। তারপরও হসপিটাল থেকে চেকআপ করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।”
এরপর ডক্টর চলে গেলেন। ডক্টরের কথায় খুবই রাগান্বিত হলেন পিংকি। সিদ্ধান্ত নিলেন দিন দুয়েকের মাঝেই ভূমিকে হসপিটাল থেকে চেকআপ করিয়ে আনবেন। যদি ভূমি অন্তঃসত্ত্বা হয় তাহলে সেখানেই অ্যাবর্শন করিয়ে নেবেন৷ এদিকে ডক্টরের কথায় খুবই খুশি হলো তিথি। শশব্যস্তভাবে ঘরের ভেতরে গিয়ে ভূমিকে জড়িয়ে ধরল৷ হুট করে জড়িয়ে ধরার মানে খুঁজে পেল না ভূমি। অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল‚
“কী হয়েছে আপু?”
“সে কী তুমি কিছু জানো না? মায়েরা নাকি সব জানে! তারা নাকি আগে থেকেই অনুভব করে৷ ভূমি তুমি আসলেই খুব বোকা।”
“কেন আপু কী হয়েছে?”
ভূমির পেটে আলতো করে হাত রেখে তিথি বলল‚ “এখানে ছোট্টো এক অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে৷”
তিথির কথা বোধগম্য হতেই আঁখিদ্বয় অশ্রুপ্লুত হলো ভূমির৷ ভাবতেই পারছে না‚ সে মা হতে চলেছে। খুশি খুশি লাগছে তার৷ অতি উল্লাসে সারা শরীর শিরশির করে উঠছে। মা হওয়ার সুন্দর এক অনুভূতি সে এখন থেকেই অনুভব করতে শুরু করছে৷ এই খবরটা আগে কেন জানতে পারল না সে? প্রলয় জানলে হয়তো খুবই খুশি হবে৷ ছুটে যদি প্রলয়ের কাছে চলে যাওয়া যেত? ভূমি ভেবে নিল‚ এখন থেকেই নিজের খুব যত্ন নেবে৷ বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাবে৷ যাতে করে তার বাচ্চা সুস্থ থাকে। পরক্ষণেই ভাবল এখান থেকে পালানোর কথা৷ এমন একটা পরিবেশে নিজের সন্তানের জন্ম দেবে না সে। কম্পিত হাতে নিজের পেটেই স্নেহমাখা হাত বুলাতে শুরু করল ভূমি। ভূমিকে নিয়ে এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেল তিথি৷ পিংকিকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে৷ জোড় করে অ্যাবর্শন করানো উনার কাছে বড়ো কিছু না৷ তিনি টাকার জন্য সবই করতে পারেন। এইতো মাস ছয়েক আগে রুমাকে জোর করে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে অ্যাবর্শন করিয়ে এনেছেন৷ থমথমে মুখ নিয়ে ভূমির কাছে বসে তিথি বলল‚
“তোমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে৷ আমি জানি এই বাচ্চা নষ্ট করার জন্য ম্যাডাম এখন উতলা হয়ে উঠবেন।”
ভয় পেল ভূমি৷ কিছুতেই সে তার সন্তানকে মে’রে ফেলতে দেবে না৷ সে তিথিকে বলল‚ “আপু আমাকে এখান থেকে পালাতে সাহায্য করুন দয়া করে।”
“তুমি চিন্তা কোরো না বোনু৷ আমি তোমার পাশে আছি৷ দিন দুয়েকের মাঝে তোমাকে আমি এখান থেকে পালাতে সাহায্য করব।”
এদিকে…
নিজের ঘরে বসে রয়েছেন পিংকি৷ ক্রমাগত রাগে ফুঁসছেন তিনি৷ পান চিবোচ্ছেন। আজ চুনটা একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছেন মনে হচ্ছে৷ মুখ জ্বালা করছে৷ পান চিবোনোর দরুন মুখ ঠোঁট লাল হয়ে রয়েছে৷ পিংকি সবসময় সুগন্ধি মসলা দিয়েই পান খান। খেতে মিষ্টি মিষ্টি লাগে আর ঘ্রাণ বেশ সুন্দর। পানের বাটা থেকে আরেকটা পান বের করে মুখে পুরলেন তিনি৷ এদিকে ভূমির কথাটাও ভাবছেন। মেয়েটাকে এখানে রাখলে লাভবান উনিই হবেন৷ এখনকার গ্রাহকদের সুন্দরী মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ আর চাহিদা একটু বেশিই৷ সেক্ষেত্রে ভূমিকে দিয়ে কাজ করালে মোটা টাকা পাবেন তিনি৷ টাকার জন্য সবকিছুই করা যায়৷ বাচ্চা নষ্ট করা এ আর নতুন কী? এর আগেও তো এখানকার পাঁচটা মেয়ের বাচ্চা নষ্ট করিয়েছেন তিনি৷ ফোন বের করে মেহরাব শিকদারের নাম্বার কল লাগালেন তিনি৷ যেহেতু মেয়েটাকে মেহরাব শিকদার এখানে এনে দিয়েছেন তাই তাকেও তো কথাটা জানানো প্রয়োজন৷ পিংকি কল করার সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ হয়ে গেল৷ ওপাশ থেকে মেহরাব শিকদার বলে উঠলেন‚
“আবার কী হলো? তোমাকে কতবার বলেছি সময় অসময়ে আমাকে কল করবে না?”
বেশি কথা না বাড়িয়ে পিংকি বললেন‚ “যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই হয়েছে৷ মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা। এখন কী করা উচিত?”
“আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? অন্য মেয়েদের সঙ্গে যা কর— এই মেয়ের সঙ্গেও সেটাই করবে।”
মেহরাব শিকদারকে সন্দেহ হলো পিংকির। তাই তিনি আজ সরাসরিই জিজ্ঞেস করলেন‚ “আপনি মিয়া বেশ ধূর্ত মাল৷ কোথা থেকে আনলেন এই মেয়েকে? আগে তো কখনো মেয়ে এনে দেননি। হঠাৎ এই মেয়েকে কোথায় পেলেন আর আমার এখানেই বা কেন পাঠালেন?”
“সেটা দিয়ে তোমার কোনো কাজ নেই৷ নিজের চরকায় তেল দাও।”
বিছানায় এবার আয়েশ করে বসে পিংকি বললেন‚ “সময় করে একবার দেখা করে যাবেন।”
“সেটা তোমাকে বলতে হবে না৷ আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ।”
“হুম বলুন! শুনিছি আমি।”
“সময়ে অসময়ে আমাকে কল করবে না৷ দরকার পড়লে আমি নিজেই কল করে সব খবরাখবর জেনে নেব।”
“বুঝেছি।”
কল রেখে দিলেন মেহরাব শিকদার। নিজের চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিলেন৷ এখন তিনি হসপিটালে আছেন৷ কিছুক্ষণ পরেই একটা ওটি আছে৷ এবার তিনি একেবারেই নিশ্চিন্ত। একসঙ্গে পথের কা’টা দুটোই উপড়ে ফেলতে পেরেছেন তিনি। যা উনাকে পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে৷ এবারের পরিকল্পনাটা মারাত্মক ছিল। এই না হলে একজন যোগ্য ব্যবসায়ীর কাজ! মনে মনেই নিজের উপর গর্ব বোধ করলেন তিনি।
সারা সন্ধ্যা পেরিয়ে রজনি নেমেছে ধরিত্রীর বুকে। বেলা কী অবলীলায় অতিবাহিত হচ্ছে! পুরো একটা দিন ভূমির কোনো খোঁজ নেই। বিকেলে প্রলয়ে বেরিয়েছিল‚ কারো সঙ্গে দেখা করতে। এরপর ভর সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরেছে। এসেই একঘণ্টা লাগিয়ে গোসল করেছে৷ বিকেল থেকেই তার মাথা ব্যথা৷ কড়া করে একবার কফি খেয়েছিল কিন্তু মাথা ব্যথা কমা তো দূর উল্টো বেড়ে গিয়েছে। অন্য সময় হলে ভূমি তার মাথাটা টিপে দিত। তবে আজ তার ঘর ফাঁকা৷ শূন্য ঘরটায় থাকতে ইচ্ছে করে না। ভূমির স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে৷ ভেতরটা হাহাকারে নিমজ্জিত। বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষে তারার মেলা। একফালি রূপালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। ভেজা চুল নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়৷ একদৃষ্টে জোছনায় আচ্ছাদিত অম্বরে তাকিয়ে রয়েছে সে৷ বারবার ভূমির বলা কথা গুলো মনে পড়ছে। প্রলয় যখনই ভেজা চুল না মুছে বসে থাকত তখনই ভূমি বলত‚ “আপনাকে কতবার বলেছি— অসময়ে গোসল করবেন না।” ভূমির কথাগুলো মনে পড়তেই একা একা হাসতে লাগল প্রলয়৷ একা একাই বলল‚
“কেন তুমি আমার পাশে নেই ভূমি কন্যা? আমার যে তোমাকে ছাড়া একমুহূর্ত সহ্য হয় না। তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী যে বেরঙিন। নিজের একাকীত্ব আমি বেশ ভালো উপলব্ধি করতে পারছি। প্লিজ তুমি আমার কাছে ফিরে এসো!”
বিছানায় বসে রয়েছে ভূমি। কিছুক্ষণ আগেই এশারের নামায আদায় করে বিছানায় এসে বসেছে৷ ঘরে সে একাই রয়েছে। দরজা বাহির থেকে আটকে দেওয়া। পুরো ঘরটা জানালাবিহীন। এ ঘরে থাকতে দমবন্ধ লাগে ভূমির। তিথি কোথাও নেই৷ হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত৷ যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল ঘর থেকে বের না হতে৷ তিথি নিজেই বাহির থেকে দরজা আটকে দিয়ে গিয়েছে। বাহিরে এখন বেগানা মানুষের চলাচল শুরু হয়ে যাবে। ভূমিকে দেখলে যে কেউই আকর্ষণ অনুভব করতে পারে। সভ্য সমাজের মুখোশধারী পুরুষদের হাত থেকে বাঁচাতে তিথি ঘরের দরজাটা বাহির থেকে আটকে দিয়ে গিয়েছে। এঘরে অ্যাটাচড ওয়াশরুম রয়েছে তাই আর কোনো অসুবিধে হবে না ভূমির। এরই মাঝে ঘরের দরজা খোলার শব্দ হয়। ভূমি ভেবে নেয় হয়তো তিথি এসেছে৷ তাই সে সেভাবেই বসে থাকে। তবে হুট করে এ ঘরে মেহরাব শিকদারকে দেখে অবাকের চরম শীর্ষে ভূমি৷ ঠিকঠাক হয়ে বসতেই মেহরাব শিকদার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। সুযোগ বুঝে হসপিটাল থেকে ফেরার পথে এখানে এসেছেন৷ সন্ধ্যেবেলা ফিরোজাকে কল করে বলেছেন আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে উনার৷ উনাকে এখানে দেখে চকিত কণ্ঠে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚
“আপনি এখানে?”
“কেন আমাকে এখানে আশা করোনি বুঝি?”
আজ আর নিজেকে দূর্বল ভাববে না ভূমি। এখন থেকে প্রত্যেককেই যোগ্য জবাব দিতে হবে৷ তাই ভূমি কিছুটা তেজি স্বরে বলল‚
“ভেবেছিলাম আপনিই সবকিছুর মূলে রয়েছেন। তবে আমার ভাবনাই যে সঠিক তা ভাবতেই পারিনি। একটু বেশিই অবাক হয়েছি৷ একটা মানুষ এতটা নরপি’শাচ কী করে হতে পারে?”
ভূমির কথাতে রাগ হলেও আজ নিজের রাগ সংবরণ করলেন মেহরাব শিকদার। ভূমিকে কথা বলার সুযোগ দিলেন তিনি। মুখে বললেন‚ “আজ সুযোগ আছে যা ইচ্ছে বলতে পারো।”
“একটা সত্যি কথা বলুন তো!”
মেহরাব শিকদারের চোখমুখ বলে দিচ্ছে তিনি ভূমির উপর চরম বিরক্ত। সেই বিরক্তিমাখা কুঁচকানো চোখে ভূমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “কী?”
“আমার আম্মার মৃ’ত্যুর পেছনে আপনার হাত আছে তাইনা?”
“খুবই বুদ্ধিমতী তুমি৷ এত তাড়াতাড়ি বুঝে যাবে ভাবতেই পারিনি।”
“কেন মে’রেছেন আমার আম্মাকে?”
“কেন আবার! তোমার আম্মা আমাকে হুমকি দিয়েছিল‚ সব সত্যিটা ফিরোজা আর সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবে৷ আমি তা কী করে হতে দিই? তাইতো সময় থাকতেই একটা পথের কা’টা দূর করেছি৷”
“তাহলে আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন? আমিও তো আপনার পথের কা’টা!”
“কেন জানি— তোমাকে আমার মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করল না। র’ক্তের টানও বলতে পারো।”
তাচ্ছিল্য করে হেসে ভূমি বলল‚ “র’ক্তের টান? বাহ্!”
“তবে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তো নরপি’শাচ! তোমাকে পিংকির হাতে তুলে দিয়েছি তার একটাই কারণ— তোমাকে সারাজীবন তড়পাব বলে।”
একটু থেমে মেহরাব শিকদার আবারও বললেন‚ “মৃ’ত্যুর আগে তোমার আম্মা খুব তড়পেছে৷ ভিডিও কলে তো সবটাই দেখছিলাম।”
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ভূমির। সবকিছু ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে করল৷ তুমুল ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে শুরু করল‚
“যেভাবে আপনি আমার আম্মাকে খু’ন করেছেন— তার থেকে কঠিন মৃ’ত্যু আমি আপনাকে দেব৷ বাঁচতে কে না চায়? আপনিও বাঁচার জন্য একটু একটু করে তড়পাবেন। কিন্তু আমি আপনাকে এমন মৃ’ত্যু দেব যে‚ আপনার ❝কাঁটামুকুট❞ এর প্রত্যেকটা কামরা কেঁপে উঠবে৷ সেখানেই আপনার মৃ’ত্যু শিরোধার্য। আপনার ধ্বংসোন্মুখ ক্রমশ এগিয়ে আসছে৷ যতদিন ইচ্ছে হয় নিজের পাপ আরও বাড়িয়ে নিন। আমি যদি বেঁচে থাকি তবে মেহরাব শিকদারের মতো পাপকৃৎ-কে একদিন না একদিন এই আমার হাতেই ম’রতে হবে। আপনার ধ্বংসেই আমি হব রণরঙ্গিণী।”
এদিকে রাগের পাশাপাশি “কাঁটামুকুট” এর নাম শুনে ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। এই কথা তো ভূমির জানার কথা না৷ তাহলে কী মহুয়া সব সত্যিই ভূমিকে জানিয়ে দিয়েছিল? মেহরাব শিকদার ভয় পেতে শুরু করলেন৷ তবে ভূমির সামনে তা প্রকাশ করলেন না৷ মেহরাব শিকদারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ দমিত হয়েছেন। আড়ালেই ভূমি হাসল৷ মেহরাব শিকদারকে বলল‚
“ভয় পেলেন নাকি?”
কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই মেহরাব শিকদার বললেন‚ “কাঁটামুকুটের কথা তুমি কী করে জানলে?”
“কাঁটামুকুটের কথা শুনেই ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার? আপনার কী মনে হয়েছিল— আমি কিছুই জানি না? তাহলে আপনি ভুল। আপনার সব অপকর্মের সাক্ষী যেমন আমার আম্মা ছিল। তেমনই আমিও সব সত্যি জানি। এমন আরেকজন আছেন‚ যিনি আপনার অপকর্ম সম্পর্কে অবগত।”
একটু থেমে ভূমি আবার বলল‚ “আপনি আম্মাকে আর আমাকে মে’রে ফেলতে পারলেও‚ তাকে কখনো ছুঁতেও পারবেন না৷ তাকে মে’রে ফেলার কথা ভাবলেও আপনার বুক কেঁপে উঠবে।”
ভূমির কথাগুলো শুনে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালেন না মেহরাব শিকদার। বড়ো বড়ো পা ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান নিলেন। উনাকে ভয় পেতে দেখে ভূমি হাসল। শব্দ করেই হাসল সে। মেহরাব শিকদারকে ভয় পেতে দেখে আনন্দ লাগছে ভীষণ। ধ্বংসলীলা সবে তো শুরু। এখনো অনেক কিছুই দেখার বাকি আছে। মহুয়াকে কষ্ট দেওয়া‚ খুন করার শাস্তি তো মেহরাব শিকদার অবশ্যই পাবেন৷ একদিন পরে হোক বা এক বছর পরে— শাস্তিও উনাকে পেতেই হবে।
রাত সাড়ে এগারোটা…
সবাই এতক্ষণে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ শুধু ঘুম নেই প্রলয়ের চোখে৷ বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ভূমির চিন্তা তাকে একমুহূর্তের জন্য ঘুমতে দেয় না। মেয়েটা কী অবস্থায় আছে তা জানা নেই তার৷ আদতে সুস্থ আছে তো? না! এমন কথা সে কিছুতেই ভাববে না৷ অবশ্যই তার ভূমি কন্যা ঠিক আছে— সুস্থ আছে৷ প্রলয় তার ফোনটা বের করে রবিনের নাম্বারে কল লাগাল। কল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রবিন রিসিভ করল। প্রলয় নিজে থেকেই বলল‚
“রবিন তোকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কালকের মধ্যেই আমার সব ডিটেইলস চাই।”
“……”
“চব্বিশ ঘণ্টা চোখে চোখে রাখবি৷ কোথায় যাচ্ছে— কী করছে! সব খবর আমার চা-ই চাই।”
“……”
“ওকে তো আমি হাতেনাতে ধরতে চাই৷ যদি আমার সন্দেহ সঠিক হয় তাহলে ওকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব৷ আর সেহরিশ আরশান প্রলয়ের পক্ষ থেকে শাস্তিটা হবে ভয়ঙ্কর। কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।”
“……”
“নিজের কাজে লেগে পড় ভাই৷ কাল আমি একবার দেখা করে আসব। রাখছি এখন।”
কল কে’টে দিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল৷ বিছানার অয়াশের টেবিলের উপর সিগারেটের প্যাকেট রাখা। কিন্তু প্রলয় তা ছুঁয়েও দেখল না৷ ভূমিকে বলেছিল সিগারেট ছোঁবে না৷ পরপরই তাচ্ছিল্য করে হাসল৷ আজ সিগারেটের ধোঁয়াও তাকে মানসিক প্রশান্তি দেবে না৷ মানসিক প্রশান্তি তো একমাত্র তার ভূমি কন্যার বক্ষঃস্থলেই মেলে।
গভীর রাত…
দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না ভূমি। আম্মা তার জীবন থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত বিপদ এসে হানা দিয়েছে৷ প্রিয় মানুষগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে৷ দুটো মানুষই তো তার জীবনের একটিমাত্র অবলম্বন। প্রলয়কে খুব মনে পড়ছে না৷ সে কেন তাকে উদ্ধার করতে আসছে না? আদতেও কী প্রলয়ের সঙ্গে তার দেখা হবে আর? নাকি এভাবেই দুজনের পথ চিরতরে আলাদা হয়ে গেল? অক্ষিকোটর হতে উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। একদিকে মায়ের শূন্যতা অন্যদিকে প্রিয়র কাছ থেকে এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া মানতে পারছে না ভূমি৷ গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ জীবনটা কেন সহজ সরল হলো না? জীবনে এত জটিলতা তো সে কখনোই চায়নি। ডুকরে কেঁদে উঠল ভূমি৷ ভেতরে তীব্র হাহাকার। রাতের এই নিস্তব্ধতার গুমোট অনুভূতি জেঁকে বসেছে৷ একা ভয় লাগতে শুরু করল৷ পরক্ষণেই মনে পড়ল সে তো আর একা নেই। তারই মাঝে আরেকটি অস্তিত্ব একটু একটু করে বেড়ে উঠছে৷ নিমিষেই সমস্ত মন খারাপেরা পালিয়ে গেল৷ বাঁচার আশা খুঁজে পেল ভূমি। এখান থেকে যে করেই হোক সে পালাবেই৷ বাহিরে কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। একেরও অধিক হতে পারে৷ ভূমি তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে নামল। এরপর গিয়ে দরজাটা ভালো করে আটকে দিল৷ যাতে করে কেউ এ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে৷ তিথির কথা মনে পড়তে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখানে বন্দী পড়ে কতই না কষ্ট সহ্য করছে৷
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
কেটে গেল আরও চারটে দিন। এ চারদিনে প্রলয় নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া ভুলে গিয়েছে। শ্যাম পুরুষের গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো বড়ো হয়েছে। চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছে৷ চোখের নিচে আবছা কালচে দাগ জন্মেছে। দেখে মনে হয় কত রাত ঘুম হয় না তার! নিজের পাশাপাশি আশেপাশের মানুষগুলোকে মাতিয়ে রাখা মানুষটা পাল্টে গেছে৷ সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ঘরবন্দী থাকে। ক’দিন ধরে নিজের কাজের প্রতি বড্ড অবহেলা করছে প্রলয়৷ এমনটা কখনই একজন এমপির কাজ হতে পারে না৷ প্রলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে‚ নিজের ভেতরকার অবস্থা দুনিয়ার মানুষকে কিছুতেই বুঝতে দেবে না। চারদিন পর আজ প্রলয় বাড়ি থেকে বের হয়েছে। হুট করেই মন বলল কোথাও একটা যেতে! এক উদ্দেশ্যহীন সফরে। জীবনের প্রতি এখন আর কোনো মায়া কাজ করে না। রাজনীতির স্বপ্নটাও আজকাল রঙহীন মনে হয়। ভূমিকে না পেয়ে প্রলয়ের অবস্থা ছন্নছাড়া। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। তবে শক্ত হাতে তো পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণ করতেই হবে৷ রবিনকে দিয়ে‚ নাজিম চৌধুরীর উপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার কাজে নিয়োগ করেছিল সে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। যা থেকে বোঝাই যাচ্ছে৷ ভূমির হারিয়ে যাওয়ার পেছনে নাজিম চৌধুরীর কোনো হাত নেই৷ তাহলে কী হয়েছিল সেদিন? ভূমি হারিয়ে গেল কী করে?
এদিকে ছেলের চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হয় না মাধুরীর। ছেলেকে এভাবে গুমরে গুমরে নিঃশেষ হতে দেখে ক্রমশ তড়পাচ্ছেন তিনি। এরচেয়ে ভালো ছিল ভূমির এ বাড়িতে থাকা। অন্তত উনার ছেলেটা তো ভালো থাকত। এ কদিনে তিনি এই কথাটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন যে‚ প্রলয় একমাত্র ভূমির সঙ্গেই ভালো থাকবে। মাধুরী মনে মনে দোয়া করছেন যাতে করে ভূমিকে তাড়াতাড়ি ফিরে পাওয়া যায়। মসজিদে টাকা দান করবেন বলে মানতও করেছেন তিনি। শিকদার বাড়ির একজন ব্যক্তি বাদে সকলেই ভূমির জন্য ভীষণ চিন্তিত৷ ফিরোজারও খুব খারাপ লাগে ভূমির জন্য। মেয়েটা সদ্য তার মাকে হারিয়েছে৷ তারউপর হুট করে কোথাও একটা হারিয়ে গিয়েছে। হসপিটালের পাশাপাশি অর্পণ অনেক জায়গায় খোঁজখবর নিয়েছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ভূমি তাকে দিয়ে এমন ভাবে ওয়াদা করিয়েছে যে‚ সে তার বাবার আসল রূপটা কারো কাছেই বলতে পারছে না৷ বলেও লাভ হবে বলে মনে হয় না৷ এরজন্য তো প্রমাণ প্রয়োজন। ভূমির হারিয়ে যাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। বিষয়টি এমন ভাবে সাজানো যে‚ বোঝাই যাচ্ছে— ভূমি কারো সঙ্গে নিজে থেকেই পালিয়ে গিয়েছে।
মধ্যাহ্নে…
এখন সময়টা খাঁ খাঁ মধ্যদুপুর। মেদিনীর বুকে রাক্ষুসে রোদ আবির্ভূত হয়েছে। তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে আজ ছ’দিন হচ্ছে৷ পুরো ছয়দিন পর খোলা আকাশের নিচে গা ভাসাবে ভূমি। এ কদিনে অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে। ফুটফুটে সুশ্রীতে মলিনতার ছাপ৷ আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই। দুটো মানুষ আলাদা আলাদা জায়গা হতে একে অপরের বিরহে বিলীন হচ্ছে৷ আজ তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে। ডক্টরের সঙ্গে আগে থেকেই কথা বলা হয়েছে৷ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজই অ্যাবর্শন করানো হবে৷ সঙ্গে শুধুমাত্র সর্দারনি পিংকি যাবেন৷ অন্য আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। তিথিকে ভূমির কাছে পাঠিয়েছেন পিংকি৷ এদিকে ঘরে ভূমিকে তৈরি করিয়ে দিচ্ছে তিথি। রুমার কাছ থেকে বোরকা জোগাড় করে এনে দিয়েছে সে৷ ভূমির পড়নে রুমার সেই কালো বোরকা আর হাঁটু সমান ঢেকে রাখা হিজাব৷ মুখে নেকাব পড়িয়েছে তিথি। বাহিরে গেলে ভূমি সম্পূর্ণ পর্দায় থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে৷ বাহির থেকে পিংকি কিছুক্ষণ পরপর তাড়া দিচ্ছেন। এইতো এখনই বের হবে ওরা। রওনা হবার পূর্বে ভূমির কাছে দুটো কাগজ এগিয়ে দিয়ে তিথি বলল‚
“তোমাকে কায়দা করে হসপিটাল থেকে পালাতে হবে। আমি তোমার সাথে হসপিটালে যেতে পারব না। বাকিটা তোমাকে একাই করতে হবে। এ লড়াই তোমার একার। এই দুটো কাগজের মধ্যে একটা ঠিকানা আর একটা চিরকুট রয়েছে। আশা করি ঠিকানা নিয়ে সঠিক জায়গায় তুমি পৌঁছে যেতে পারবে। এটুকু মনের জোর অন্তত তোমার আছে।”
“ইনশাআল্লাহ! আমি অবশ্যই পারব৷ তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আপু।”
তিথি আবারও বলল‚ “আরেকটা কথা! পানির বোতলে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি। ভুলেও তুমি ওই পানি পান করবে না। পারলে পিংকি ম্যাডামকে খাওয়ানোর চেষ্টা করবে।”
মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে ভূমি সায় জানাল। তিথিকে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরল। এ ক’টা দিন তিথি খুব খেয়াল রেখেছে তার৷ তিথির কাছে ভূমি চিরকৃতজ্ঞ। তিথির উপকার সে কোনোদিনও ভূলবে না। নিজে নরকে থেকেও তাকে স্বর্গে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। এমন মানুষ হাজার খুঁজেও পাওয়া যায় না। তিথির হাত ধরে ভূমি বলল‚
“তোমার এই উপকারে কোনদিন ভুলব না। আমি সারা জীবন তোমাকে মনে রাখব।”
“আমার তোমাকে খুব মনে পড়বে। তুমি ভালো থেক। তোমার সন্তানের খেয়াল রেখ। তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া আর শুভকামনা।”
বাহির থেকে পিংকির বাজখাঁই কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এই মহিলার কথা কানে আসতেই বিরক্ত হলো ভূমি। তিথিকে বলল‚ “আসছি আপু। তুমি ভালো থেক।”
“এই নরকে ভালো থাকার কথা বলছ? আমি ভালো থাকব শুধুমাত্র তোমার পুচকুর ভালো থাকায়৷ ওর খুব খেয়াল রাখবে। একজন ভালো মানুষ তৈরি করবে।”
অশ্রুসিক্ত আঁখিপল্লব ঝাপ্টে সায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ভূমি। তার পেছন পেছন তিথিও বের হলো। বাহিরে পিংকি সহ আরও সাতজন মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ এই মেয়েগুলো এখানেই থাকে। এদের মাঝে চামেলিও রয়েছে। যে কি-না পিংকির খুবই বিশ্বস্ত। ভূমিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পিংকি৷ যাওয়ার পূর্বে ভূমি একটিবার তিথির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। যদি এমন হত— সে তিথিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারত? কিন্তু আফসোস! এমন কোনোদিনও হতে পারে না৷ ভূমি এখান থেকে বের হবার সময় জায়গাগুলো ভালো করে দেখে দেখে যাচ্ছিল৷ যেহেতু মাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা করেছে তাই বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিও একটু আধটু বুঝতে পারে সে। জায়গাটা আর ঠিকানাটা খুব ভালো করে দেখে নিয়েছে ভূমি৷ ভালোই ভালোই বেঁচে ফিরতে পারলে একদিন অবশ্যই সে তিথিকে এখান থেকে উদ্ধার করবে।
হসপিটালে নিজের কেবিনে বসে রয়েছেন মেহরাব শিকদার। আজ আর রোগী দেখার ঝামেলা নেই। আর না কোনো ওটি রয়েছে। তাই নিজের কেবিনে আয়েশ করে বসে রয়েছেন তিনি। এই সময়টায় অন্যদিন হলে ব্যস্ততায় পাড় হত। তবে আজ সম্পূর্ণই আলাদা। এভাবে বসে থেকেও বিরক্ত হচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে ব্যস্ততার মাঝেও আলাদা শান্তি বিরাজ করে৷ এই যে এখন তিনি একেবারেই ফ্রী কিন্তু তবুও উনার কাজ করতে ইচ্ছে করছে৷ এমন ইচ্ছে কিন্তু সবসময় হয় না। আজই হঠাৎ মনে হচ্ছে। এরই মাঝে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল মেহরাব শিকদারের৷ যেহেতু তিনি আজ ফ্রী তাই তিনি তৎক্ষনাৎ ফোন রিসিভ করলেন। পিংকি কল করছেন৷ হতে পারে কোনো কাজেই কল করেছেন। তিনি কিছু বলবেন তার আগেই অপাশ থেকে পিংকি বলে উঠলেন‚
“আপনার মেয়েকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি অ্যাবর্শন করাতে।”
পিংকির মুখে ‘মেয়ে’ শব্দটা শুনে সহসাই অবাক হলেন তিনি৷ মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “হোয়াট ননসেন্স! কীসের মেয়ে?”
এবার কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই বক্তে আরম্ভ করলেন‚ “ওই মিয়া ভাব কম নিন। কী মনে করেছেন আমি কিছুই জানি না? সেদিন আমি আপনাদের কথা সব শুনেছি। আপনি মিয়া একটা নরপি’শাচ। আমি তো পেটের দায়ে মেয়ে ব্যবসা করে খাই। আর আপনি? ছিহ্! বাবারাও এমন হয়? আপনাকে দেখলে শরীরও ঘৃণায় জর্জরিত হয়।”
“মুখ সামলে কথা বল। আমাকে তুমি এখনো ভালো করে চেন না তাই আমার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বলা বন্ধ কর।”
“আপনাকে তো সেদিনই ভালো করে চিনে নিয়েছিলাম৷ আপনি তো মিয়া বাবা জাতের কল’ঙ্ক। আমার বাবা যদি এমন হত না? তাহলে আমি তাকে খুন করে তার নিথর দেহটাকে কু’কুর দিয়ে খাওয়াতাম।”
“একটু বেশি বলে ফেলছ না? তা হঠাৎ করেই অন্য সত্তা জেগে উঠল ব্যাপার কী?”
“কিছু কথা অজানা থাকুক। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি— এমন বাবা কারো ভাগ্যে না জুটুক।”
কথাটা বলেই কল কে’টে দিলেন পিংকি। গাড়ি ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানকার রাস্তা খুব একটা ভালো না। গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে ভূমি৷ সে গাড়িতে জার্নি করতে পারে না৷ বমি পায়— তারউপর আবার সে অন্তঃসত্ত্বা। তবে এখনো পর্যন্ত একবারও বমি করেনি সে৷ আসার সময় তিথি সঙ্গে করে দুটো লেবু পাতা দিয়েছিল। বমি পেলে যেন সঙ্গে সঙ্গে নাকের কাছে ধরে রাখে৷ লেবু পাতার তীব্র সুবাসে গা গোলানো বন্ধ হয়েছে আপাতত। এদিকে পিংকি মোবাইলে গেইম খেলছেন৷ এতক্ষণ মেহরাব শিকদার আর পিংকির মধ্যেকার হওয়া সমস্ত কথাবার্তা সে শুনেছে৷ পিংকির কথাবার্তায় একটা মায়া ছিল৷ আজকের পিংকিকে একদম অন্যরকম মনে হয়েছে ভূমির কাছে৷ একদৃষ্টে পিংকির দিকেই তাকিয়ে রইল ভূমি। হুট করে মোবাইলের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকালেন পিংকি। এভাবে মুখ তুলে তাকানোতে ভূমি ঘাবড়ে গেল মুহূর্তেই৷ আড়ালেই ক্ষীণ হেসে তিনি ভূমিকে বললেন‚
“মেয়ে মানুষ কখনো ইচ্ছে করে খারাপ পথে পরিচালিত হয় না৷ তার পেছনে বিভিন্ন গল্প লুকিয়ে থাকে৷ সাধেই কী মেয়েদের রহস্যময়ী বলা হয়! সমাজের সকল লাঞ্ছনা বঞ্চনার শুধুমাত্র একজন নারীকেই সহ্য করতে হয়। সভ্য সমাজের পুরুষেরা তো শুধু পারে ভোগ করতে।”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করছে প্রলয়। আজ সে পার্টি অফিসে যাবে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে একটা কলেজে যাবে৷ আজ শহীদ মিনার উদ্ভোদন করার রয়েছে। আজও প্রলয় সাদা পাঞ্জাবি তার উপর কালো কোটি পরিধান করেছে৷ হাতে একটা দামি ঘড়ি। এই ঘড়িটা মেহরাব শিকদার তাকে উপহার দিয়েছিলাম৷ ব্যক্তিগত ভাবেই প্রলয়ের ভীষণ পছন্দের৷ কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কাজে গেলেই এই ঘড়িয়ে পড়ে যায়৷ চুলগুলো জেল দিয়ে স্যাট করা। শ্যাম গড়ন মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতেও তাকে দারুণ লাগছে৷ দাঁড়িগুলো ঘন বড়ো হয়ে যেন তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে৷ ভূমি তার এমন অবস্থা দেখলে ভাববে হয়তো লোকটা দেবদাস হয়ে গিয়েছে৷ আনমনে হেসে উঠল প্রলয়। চশমা আর মোবাইলটা নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই যাবে তখনই অর্পণ সামনে এসে দাঁড়াল। হুট করে এভাবে আসায় অবাক হলো বৈকি৷ তাই সে জিজ্ঞেস করল‚
“তুই হঠাৎ এ ঘরে? হসপিটালে যাসনি?”
“আজ আমি হসপিটালে যাব না৷ তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে ভাই।”
প্রলয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “কী কথা?”
যদিও কথাটা বলতে তার অসুবিধে হচ্ছে তবুও কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই অর্পণ বলে দিল‚ “ভাই আমাদের উচিত নিষিদ্ধ জায়গাগুলোতে গিয়ে ভূমির খোঁজ করা৷”
রাগ তড়তড় করে মাথায় চড়াও হলো৷ প্রলয় ক্ষিপ্রবেগে এসে অর্পণের কলার চেপে ধরল। চেঁচিয়ে বলে উঠল‚
“তোর সাহস কী করে হলো এমন কথা বলার? আমি তো স্বপ্নেও ওসব জায়গার কথা ভাবতে পারিনা আর তুই কিনা মুখের উপর বলে দিলি?”
“ভাই মাথা ঠান্ডা কর। আমার পুরো কথাটা তো একবার শুনবে।”
“কিছুই শোনার নেই আমার। যা বুঝার আমি বুঝে নিয়েছি।”
“তুমি কিছুই বুঝলে না— উল্টো আমাকে ভুল বুঝলে।”
“আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাইছি। তুই এখন এখান থেকে যা। পরে যখন দরকার পড়বে‚ আমি তোকে ডেকে নেব।”
আর কিছু বলল না অর্পণ। প্রলয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সরাসরি না বললেও অর্পণ আপনার বাবাকে সন্দেহ করছে। তাই তার বাবার ফোন নাম্বার ট্র্যাক করেছিল। এরপর মেহরাব শিকদারের ফোন নাম্বার একটা নিষিদ্ধ জায়গায় দেখা গিয়েছে। অর্পণের সন্দেহ রয়েছে যে‚ তার বাবা ভূমিকে সেখানেই রেখেছে। ইনিয়েবিনিয়ে প্রলয়কে কথাটা বলারও চেষ্টা করল সে। কিন্তু হলো তার উল্টো। প্রলয় তাকে ভুল বুঝেছে। মন খারাপ হলো অর্পণের। তার ভাই তাকে ভুল বুঝল। সত্যিটা এবার সে প্রমাণ করেই ছাড়বে। সে যে করেই হোক। হসপিটাল যাওয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল অর্পণ। যদিও ভেবেছিল আজ হসপিটালে যাবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বের হতেই হবে।
বিকেলে…
রূপালি গাড়িটা একটা জায়গায় এসে থেমেছে। মিনিট দুয়েক হলো গাড়িটা এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভূমি বুঝতে পারল না এ কোথায় এসেছে? আদতে কী হসপিটালে পৌঁছে গেছে? জানালার কাঁচ তুলে রাখা৷ ভেতরে এসি চলছে। গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েছেন৷ আজ ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগিয়েছেন। অন্যদিনের থেকে আজকের সাজে আকাশপাতাল তফাৎ। ভূমি একবার বাহিরে তাকায় তো আরেকবার পিংকির দিকে তাকায়। এবার ভূমিকে এমন করতে দেখে পিংকি নিজে থেকেই বলে উঠলেন‚
“এত খারাপের মাঝে একটু কিছু ভালো হোক। এই সভ্য সমাজে তো মন্দ লোকের অভাব নেই৷”
পিংকির কথা বোধগম্য হলো না ভুমির। এমনিতে তো মহিলা প্রয়োজন অনুযায়ী কমই কথা বলেন তবে আজ নিজে থেকেই তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে৷ ব্যাপারটা চোখে লাগার মতই। পিংকি এবার জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলেন। বাহিরের দিকে চোখ পরতেই বুঝতে পারল জায়গাটা ভীষণ চেনা। চেনা চেনা মনে হতেই গভীর দৃষ্টিতে জায়গাটাকে আবারও পরখ করতে শুরু করল। এটা তো তাদেরই এলাকা। মনে মনে খুবই খুশি হলো সে। চোখ মুখে প্রবল উচ্ছ্বাস। পিংকি এবার ভূমির কাছে পানি বোতল চাইল। অতি উৎসাহের সঙ্গে পানির বোতলটা এগিয়ে দিল ভূমি। সে জানে এ পানিতে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেওয়া রয়েছে৷ এখন অপেক্ষা পিংকি কখন পুরো পানিটা পান করবেন আর ঘুমিয়ে পড়বেন। এরই মাঝে এক নিঃশ্বাসে অনেকটা পানি পান করেছেন পিংকি। তেষ্টা পেয়েছিল ভীষণ। ভূমি মনে মনে অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করল। যেই পিংকি ঘুমিয়ে পড়বে অমনি সে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। সোজা মালঞ্চ নীড়ে গিয়ে পৌঁছাবে। যত দ্রুত সম্ভব পালানোর চেষ্টা করবে। এখান থেকে প্রায় দশ মিনিটের রাস্তা। প্রলয়ের সঙ্গে বহুবার ঘুরতে যাওয়ার দরুন জায়গাগুলো বেশ ভালোই চেনা হয়েছে তার। কিছু কিছু জায়গা প্রলয় নিজে চিনিয়েছে। ভূমি এতক্ষণ ধরে বাহিরের দিকে একদৃষ্টে গিয়েছিল তা দেখে পিংকি মুচকি হেসে বললেন‚
“সেদিন আমি তোমার আর মেহরাব শিকদারের কথা সব শুনেছিলাম। আমি জানতাম না যে‚ মেহরাব শিকদার তোমার জন্মদাতা পিতা। কোনো বাবা যে তার সন্তানের সঙ্গে এমনটা করতে পারে এমনটা হয়তো কেউ-ই কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি।”
‘পিতা‚ বাবা’ শব্দগুলো কর্ণগোচর হতেই তীব্র রাগ শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছলকে উঠল। অত্যন্ত তেজি স্বরে ভূমি বলে উঠল‚ “ওই নোংরা লোক আমার কিছুই হয় না৷ ঘৃণা করি আমি তাকে।”
প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না পিংকি। চোখ দুটো মুদে আসছে। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। ভূমি উনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মহিলা গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে রেখেছে। তাকিয়ে থাকতে পারছেন না বিধায় চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছেন। ভূমি বুঝতে পারল না যে‚ পিংকি জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে! এখনই সুযোগ গাড়ি থেকে নামার‚ এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার। আর মাত্র কয়েক কদম— তারপরই ভূমি প্রলয় আবারও মিলিত হবে। এভাবেই আরও মিনিট পাঁচেক সময় অতিবাহিত হলো। গাড়িতে ড্রাইভার নেই। ভূমি এবার হাত দিয়ে পিংকির মুখের উপর নাড়াচাড়া করতে শুরু করল। বোঝার চেষ্টা করছে পিংকি ঘুমিয়ে গেছে কি-না। না! পিংকি এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ কাগজ দুটো হাতে শক্ত করে ধরে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ভূমি। এই বুঝি সকল অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলল! বড়ো বড়ো পা ফেলে সামনের দিকে এগোতে শুরু করল সে। অপেক্ষারা বাঁধ মানছে না।
অন্যদিকে…
মাধুরীর ঘরে বসে রয়েছেন ফিরোজা৷ অন্য সময় সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলেও আজ তা হলো না। মাধুরী নিজেই ডেকে এনেছেন ফিরোজাকে৷ একা একা ভালো লাগছিল না উনার। পূর্ণতা পুষ্পিতা এখনও কলেজে। তাদের ফিরতে আজ কিছুটা দেরি হবে৷ মাধুরী আর ফিরোজা দুজনেই বিছানার উপর বসে রয়েছে। ভূমির জন্য খুবই চিন্তা হয় ফিরোজার৷ মেয়েটা নিখোঁজ হবার পর থেকে এ বাড়ির ছেলে দুটো কেমন মন মরা হয়ে গিয়েছে! অনেকদিন ধরেই ভূমিকে নিয়ে অর্পণকে খুবই যত্নশীল হতে দেখেছেন তিনি। মাঝে মাঝে হসপিটাল থেকে ফেরার পথে এটা সেটা নিয়ে আসত। আগে তো পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্যই আনত এরপর হঠাৎ করে অর্পণ ভূমিকেও একজন ভাইয়ের মতো ট্রিট করতে শুরু করল৷ ফিরোজা বিষয়টিকে খুব ভালো করে খেয়াল করেছেন৷ একদিন তো সরাসরিই জিজ্ঞেস করে বসেছিলেন। তখন অর্পণের জবাব ছিল‚ “তুমি তো জানোই— ছোটো বেলা থেকেই একটা ছোটো বোনের জন্য আমি কতটা পাগল ছিলাম! তবে আল্লাহ আমার প্রার্থনা হয়তো অনেক আগেই শুনে নিয়েছিলেন। তাইতো ভূমিকে ভাইয়ের বউ হিসেবে এ বাড়িতে পাঠিয়েছেন। ভূমিকে আমি আমার ছোটো বোনের মতোই ভালোবাসি। এই সত্যিটা কখনোই পরিবর্তন হবে না।” সেদিন অর্পণের সব কথার মর্মার্থ ধরতে না পারলেও ফিরোজা এটা বুঝেছিলেন যে‚ উনার ছেলে একজন দায়িত্বশীল ভাইয়ের মতো ভূমির চিন্তা করে। এই ব্যাপারটায় ভীষণ খুশি তিনি৷ ছেলেকে নিয়ে খুবই গর্বিত তিনি৷ মা ছেলের মাঝে সম্পর্কটা একদমই বন্ধুত্বের মতো৷ আনমনেই হেসে উঠলেন ফিরোজা। কিন্তু পরক্ষণেই ভূমির কথা মনে পড়তেই খারাপ লাগতে শুরু করল। তিনি এবার মাধুরীকে বললেন‚
“ভূমি কোথায় আছে‚ কেমন আছে— কে জানে! ও যেখানেই আছে আল্লাহ ওকে ভালো রাখুক। তাড়াতাড়ি আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিক। এমনিতেই মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো না। সদ্য সে তার মাকে হারিয়েছে। তারউপর পরিবারের থেকে দূরে৷ মানসিক ভাবে হয়তো বড্ড ভেঙে পড়েছে মেয়েটা।”
“একটিবার চিন্তা করেছিস আমার ছেলেটার কী অবস্থা হয়েছে এতে? মেয়েটা গেল তো গেল আমার ছেলের কাছ থেকে সমস্ত সুখ শান্তি নিংড়ে নিয়ে গেল।”
“এভাবে কেন বলছ ভাবি? একবার নিজেকে ভূমির জায়গায় চিন্তা করে দেখ! ভূমিও তো তোমার মেয়ে সমতূল্য। ওকে মেয়ে হিসেবে আপন করে নিতে এত কেন বাধাবিঘ্ন? তুমি হয়তো জানো না— মেয়েটা তোমার কাছ থেকে একটু ভালোবাসা‚ একটু স্নেহ পাবে বলে তোমার সমস্ত অবহেলা মুখ বুঝে সহ্য করে। আমি বুঝি মেয়েটার মনের অবস্থা। মা তো— কী করব বল!”
ফিরোজার সমস্ত কথা চুপটি করে শুনলেন মাধুরী। টু শব্দটি পর্যন্ত করলেন না তিনি। ফিরোজা আবারও বললেন‚ “মেয়েটাকে কী একটুও ভালোবাসা যেত না ভাবি?”
“যাকে তাকে আমি ভালোবাসতে যাব কেন?”
“তোমাকে একটা কথা বলি ভাবি! তুমি প্রচণ্ড স্বার্থপর। আল্লাহ না করুন‚ ভূমির জীবনের মতো যদি আমাদের পূর্ণতা পুষ্পিতার জীবনটাও হয়ে যায়?”
সমস্ত রাগ গিয়ে চড়াও হলো ফিরোজার উপর৷ মাধুরী এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলেন‚ “আজকেই বলেছিস— বলেছিস। এমন কথা তোর মুখে আমি দ্বিতীয়বার শুনতে চাই না৷”
এরই মাঝে কলিং বেল বেজে উঠল৷ বাড়িতে এখন মাধুরী‚ ফিরোজা আর সাবিনাকে ছাড়া আর কেউ নেই। নিচতলায় মাধুরীর ঘর থেকে আগে বেরিয়ে এলেন ফিরোজা। উনার পেছন পেছন মাধুরীও বেরিয়ে এলেন৷ এদিকে সদর দরজা খোলার জন্য উদ্যত হলো সাবিনা। সে এতক্ষণ টিভি দেখছিল৷ একটা কষ্টের মুভি দেখছিল। সে একটু বেশিই আবেগী৷ একটু কষ্টের সিন দেখালেই কান্নায় সব ভাসিয়ে দেয়৷ কলিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই টিভি বন্ধ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে৷ এভাবে টিভি দেখার মাঝেই কলিং বেল বাজায় বিছুটা বিরক্ত সে। মুভির কাহিনিতে মাত্রই টুইস্ট শুরু হয়েছিল। সব শেষ! মনে মনে হাজার খানেক বকা দিয়ে সদর দরজা খুলেই ফেলল সাবিনা৷ বিষ্ময়কর দৃষ্টি সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে৷ একবার অর্পণ তো আরেকবার তার পাশে থাকা মানুষটার দিকে তাকাল।
চলবে?…..