#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বৈঠকখানায় উপস্থিত মাধুরী ফিরোজা সাবিনা অবাক ও বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ভূমির দিকে। আজ ছ-দিন পর ভূমিকে পাওয়া গিয়েছে। সাবিনা আর ফিরোজা খুশি হতে পারলেও মাধুরীর মুখটা আগের মতই। তিনি খুশি হয়েছেন কিনা মুখ দেখে বলা যাচ্ছে না! গম্ভীর মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অর্পণ তা দেখেও না দেখার ভান করে সাবিনাকে বলল‚
“সাবিনা যা তো ভূমির জন্য একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।”
চট করেই সাবিনা জবাব দিল‚ “আইচ্ছা ছোটো ভাইজান।”
সাবিনা রান্নাঘরে চলে যেতেই ফিরোজা জিজ্ঞেস করলেন‚ “তুই ভূমিকে কোথায় পেলি বাবা?” এরপর ভূমির দিকে তাকিয়ে বললেন‚ তুমি বোরকা‚ হিজাব আর নেকাবটা খুলে বসো ভূমি৷”
ভূমি কিছুই বলল না৷ সে তো পুরো বাড়িটা দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে৷ যেন যুগ পর দেখছে। ছ-দিনকেও ছ-বছরের সমতূল্য মনে হচ্ছে তার৷ সবটাই ঘোরের মাঝে কাটিয়ে গেল। ভূমির মৌনতা কাটছে না আজ৷ তবে ফিরোজার কথানুযায়ী বোরকা‚ হিজাব আর নেকাব খুলে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। পড়নে তার একটা ঢিলাঢালা গোল জামা৷ এই বোরকা‚ হিজাব আর নেকাব কোনোটাই তার না৷ বরঞ্চ জামাটা পর্যন্ত রুমার৷ মাথায় ওড়না পেচিয়ে নিল ভূমি। অর্পণ তার মায়ের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলল‚
“ভূমিকে আমি গলির মোড়ে পেয়েছি। প্রথমেই চিনতে পারিনি এরপর নিজে থেকেই পরিচয় দিয়েছে। তাই দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরেছি।”
ফিরোজা এগিয়ে এসে ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল‚ “এতদিন কোথায় ছিলেন মা? তুমি ঠিক আছ? শরীর ভালো আছে তোমার?”
ভূমিকে কিছু বলতে না দিয়ে মাধুরী এবার বললেন‚ “নির্বোধ তুমি? সভ্য বাড়ির বউ কখনো এমন কাজ করে? কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলে তুমি? আমার ছেলেটার দিকে তাকানো যায় না। ছেলেটা আমার গুমরে গুমরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।”
ভূমিকে নিজের কথা বলার সময় বা সুযোগটুকু দিচ্ছেন না মাধুরী। অর্পণ আর ফিরোজা সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অর্পণ সাবিনাকে পাঠিয়েছে রান্নাঘর থেকে যেন ভূমির জন্য পানি নিয়ে আসে। এদিকে মাধুরীর এমন ব্যবহারে বিরক্ত হচ্ছে সে। তারই সামনে তার বোনকে অহেতুক কথা শোনাচ্ছেন তিনি। এদিকে বাবার উপর ভীষণ রেগে আছে সে। পথে আসতে আসতেই ভূমি তাকে সব সত্যি জানিয়েছে। অর্পণ ভেবে পায় না— একটা মানুষ কী করে এতটা জঘন্য হতে পারে! শুধুমাত্র ভূমির কাছে করা ওয়াদার কারণে সে কিছুই বলতে পারছে না। আর না প্রলয়কে এসব কিছু জানাতে পারছে। এইজন্য ভেতরে ভেতরে ভূমি ওপর রেগে রয়েছে। কেন যে তাকে দিয়ে ওয়াদা করাল! সাবিনা পানি নিয়ে আসতেই অর্পণ তাকে পানি পান করতে দিল। অনেকক্ষণ যাবৎ তেষ্টা পেয়েছিল বিধায় ঢকঢক করে একগ্লাস পানি পান করল ভূমি। মাধুরী দুহাত আড়াআড়ি ভাজ করে ফিরোজার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অনেকক্ষণ আগেই ভূমিকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু তার উত্তর এখনো পাননি তিনি। সে নিয়ে মূলত কিছুটা ক্ষেপে আছেন ভূমির উপর। মাধুরী আবারও বললেন‚
“তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম!”
ভূমিকে কিছু বলতে না দিয়ে ফিরোজা বললেন‚ “মেয়েটাকে এখন একটু বিশ্রাম করার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত। তোমার প্রশ্নের উত্তর তো পরেও দেওয়া যাবে ভাবি।”
অর্পণ তার মায়ের কথাতে সায় জানাল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল ভূমিকে তার ঘরে চলে যেতে। কিছু সময় বিশ্রাম নিক তারপর নাহয় সবার সামনে সব কথা বলবে। কিন্তু অর্পণের কথায় ভূমি রাজি হলো না। সে এখনই মাধুরীর সকল প্রশ্নের উত্তর দেবে৷ তাই সে সব কথা খুলে বলল। ফিরোজা আফসোস করতে শুরু করলেন কারণ এ কদিন ভূমি মানসিকভাবে ভীষণই কষ্টে ছিল। যার একাংশ ধারণাও এখানে উপস্থিত কারোর নেই। একে তো সদ্য তার আম্মাকে হারিয়েছে তারউপর আবার একটা খারাপ জায়গায় আটকা পড়েছিল। ভাগ্যিস কোনো বিপদ হয়নি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন ফিরোজা। মাধুরী বললেন‚
“তা ওমন একটা জায়গায় তুমি পৌঁছালে কী করে?”
ক্ষীণ স্বরে ভূমি জবাব দিল‚ “আমি নিজেও জানিনা মা— আমি কী করে ওমম একটা জায়গায় পৌঁছালাম!”
মেহরাব শিকদারের কথাটা পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে গেল ভূমি৷ সে এখন চাইছে না মেহরাব শিকদারের কথাটা অর্পণ ব্যাতিত অন্য কেউ জানুক! ওই লোককে তো সে নিজের হাতে শাস্তি দেবে। এমন মৃ’ত্যু দেবে যেন‚ ওই লোক নিজেই নিজের মৃ’ত্যু কামনা করেন। যতটা কষ্ট আর যন্ত্রণা তার আম্মাকে পেতে হয়েছে ততটাই সে সুদে আসলে ফেরত দেবে৷ মনে মনে সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। অর্পণ জানিয়েছে ভূমির প্রত্যেকটা পদক্ষেপে সে তাকে সাহায্য করবে৷ এবার ভূমি কিছুটা মনোবল পেয়েছে৷ এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতা কলেজ থেকে এসেছে। বৈঠকখানায় ভূমিকে দেখে ওরা দু-বোন খুবই খুশি হয়েছে। আনন্দে আটখানা পুষ্পিতা দৌঁড়ে এসে ভূমিকে জড়িয়ে ধরল৷ এ কদিন ওরাও তাদের ভাবিমণিকে ভীষণ মিস করেছে। ভূমিকে ফিরে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে তাদের। ভূমির হাত ধরে পুষ্পিতা বলল‚
“তুমি এতদিন কোথায় ছিলে ভাবিমণি? তুমি জানো আমরা তোমাকে কত মিস করেছি?”
আদরের রায়বাঘিনী ননদিনীদের ভালোবাসায় সিক্ত ভূমি৷ ক্ষীণ হেসে ভূমি কিছু বলতেই নেবে তার আগেই অর্পণ বলে উঠল‚ “অনেক কথা হয়েছে। ভূমি এখন বিশ্রাম নেবে৷ তোরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে। পরে যত পারিস ভাবিমণির সঙ্গে কথা বলে নিস।”
অর্পণের কথাই ওরা মেনে নিল। নিজেদের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেল৷ এদিকে অর্পণ তার মাকে ইশারা করতেই ভূমিকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলেন ফিরোজা৷ এখানে থাকলে আরও বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভূমিকে। যেটা অর্পণ এই মুহূর্তে কিছুতেই চাইছে না। এদিকে ওদের এমন ব্যবহারে বেজায় বিরক্ত মাধুরী। বড়ো বড়ো পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি। আনমনেই তাচ্ছিল্য করে হাসল অর্পণ। মাধুরী যে শুধুমাত্র প্রলয়ের জন্যই সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছেন তা সে বেশ ভালই বুঝতে পারছে। সত্যিটা তো একদিন সবার সামনে আসবেই সেদিন হয়তো ভূমি সকল অবহেলা থেকে মুক্তি পাবে। মাধুরীও হয়তো তাকে কাছে টেনে নেবে৷ অর্পণ খুব করে চায় তার বোন মাধুরীর থেকে মায়ের মতো ভালোবাসা পাক। আদতে কী সেই দিনটা কোনোদিন আসবে?
রাতে…
প্রলয় সেই যে দুপুরের বেরিয়েছিল তারপর রাত করে বাড়ি ফিরেছে সে৷ আজ ব্যস্ত থাকায় কারো ফোন তোলেনি সে৷ বিকেলে অবশ্য অর্পণ আর মাধুরী কয়েকবার কল করেছিল। প্রলয় খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি কারণ এমন কল তোর প্রতিদিনই আসে। এখন সময় রাত সাড়ে নয়টায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রলয়। আজকাল বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না তার৷ শূন্য ঘরটায় শুধুই হাহাকার। কোথাও শান্তি মেলে না। প্রলয় নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত তার ফলাফল শূন্য। নিজের ঘরে যাওয়ার পূর্বে প্রলয় একটিবার পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরের দিকে গেল৷ ওদের দুজনের জন্য চকলেট কিনে এনেছিল৷ চকলেট দিয়েই প্রলয় নিজের ঘরে চলে এলো। তখন খেয়াল করল পূর্ণতা পুষ্পিতা মুচকি মুচকি হাসছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পারল না প্রলয়। তারউপর আরেক আজব ঘটনা ঘটল তা হচ্ছে‚ তার ঘর আঁধারিয়ায় আচ্ছন্ন। বারান্দা থেকে আবছা আলো ঘরে প্রবেশ করছে ঠিকই। বাহিরের ল্যাম্পপোস্ট থেকেই মূলত হরিদ্রাভ আলোর দেখা মিলছে। প্রলয় অনুভব করল‚ সে ছাড়াও ঘরের ভেতর কারো অস্তিত্ব রয়েছে। চট করে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিল। অকস্মাৎ ভূমিকে দেখে অবাকের শীর্ষে পৌঁছাল প্রলয়। একই স্থানে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল সে। চোখ থেকে চশমা একবার খুলে‚ পরিষ্কার করে আবারও চোখে পড়ে নিল। সে ভাবছে হয়তো সবটাই তার চোখের ভুল। কারণ এ কদিনে ভূমিকে বহুবার সে কল্পনা করেছে। তবে বারবারই সে মিথ্যে ছিল৷ আজ কী সত্যিই তার ভূমি কন্যা ফিরে এসেছে? প্রলয় ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ভূমির দিকে৷ একটিবার ছুঁয়ে দেখল ভূমিকে৷ না! আজ সে ভুল না। সত্যি সত্যিই তার ভূমি কন্যা ফিরে এসেছে৷ ভূমির সারা মুখে আদুরে ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিল প্রলয়৷ অতি খুশিতে কান্না পাচ্ছে তার। ভূমির হাতের পিঠে বার কয়েক চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে ছাড়া আমি একটুও ভালো ছিলাম না ভূমি কন্যা।”
সহজ কথা বলতে গিয়েও পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠনালি কাঁপছে৷ প্রলয়ের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পারল ভূমি। নিজে থেকেই প্রলয়কে জড়িয়ে ধরল। মনে হচ্ছে যেন একযুগ পর নিরুপদ্রব বুকটায় মাথা রেখেছে সে৷ আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়েছে ভূমি৷ সেই চিরচেনা সুবাসে মুগ্ধকারিণী আরও লেপ্টে রইল তার অর্ধাঙ্গের বক্ষঃস্থলে। ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚
“কোথায় ছিলে তুমি? তুমি জানো তোমাকে আমি কত খুঁজেছি! তবুও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়িনি৷”
এবার ভূমি বিগত ছয় দিনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই বলতে শুরু করল ভূমি। তার পাশে বসে নীরবে সব কথা শুনতে লাগল প্রলয়। ভূমি বলল‚
“সেদিন যখন আমার জ্ঞান ফেরে তখন আমি নিজেকে একটা সংকীর্ণ জানালা বিহীন কামরায় আবিষ্কার করি৷ আমার সামনে দুটো মেয়ে বসে ছিল৷ তাদের ভাষ্যমতে তারা নাকি আমাকে রাস্তা অচৈতন্য অবস্থায় পেয়েছিল। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে‚ আমি আম্মার কবরটা দূর থেকেই দেখতে গিয়েছিলাম। আপনি তখন বাড়ি ছিলেন না তাই আপনাকে জানানো হয়নি। তো হঠাৎ করেই তখন আমার শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। উপলব্ধি করছিলাম শরীর প্রচণ্ড ঘামছে। হাত পা দুটো নিঃসাড় হয়ে পড়ছিল৷ দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকার শক্তিটুকু ছিল না৷ এরপর কখন যে জ্ঞান হারাই আমার মনে নেই৷ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমি গ্রাম ছেড়ে কী করে অন্য একটা জায়গা পৌঁছে গেলাম আমার জানা নেই। মনে হচ্ছিল ঘটনাগুলো সব আকস্মিকভাবেই ঘটছে৷ হুট করে একটা নিষিদ্ধ জায়গায় কী করে পৌঁছে গেলাম জানা নেই আমার! বারবার শুধু মনে হয়েছে কী করে এখান থেকে পালিয়ে আসা যায়! প্রতি মুহূর্ত আমি দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ছিলাম। একমাত্র তিথি আপু আমার খেয়াল রেখেছেন। ওখান থেকে পালাতে উনিই আমাকে সাহায্য করেছেন। আজ ওখানকার সর্দারনি আমাকে নিয়ে বের হয়েছিল। বের হবার কথাটা আগে থেকেই জানা ছিল তাই তিথি আপু উনার পানির সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল৷ ওই পানি পান করার সঙ্গে সঙ্গেই পিংকি ঘুমিয়ে পড়েন আর আমি সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসি।”
এতগুলো কথা বলে একটু থামল ভূমি৷ পরবর্তী আরও কথা বলতে নেবে তার আগেই প্রলয় তাকে থামিয়ে দিল৷ তার আর কিছুই শোনার নেই৷ তার ভূমি কন্যাকে ফিরে ফেয়েছে সেটাই অনেক৷ আর কিছুই চাই না তার।
অন্যদিকে…এশার নামাযের পরপরই গণিকালয়ে ফিরে এসেছেন পিংকি। অনেক খুঁজেও আশেপাশে কোথাও ভূমিকে পাননি তিনি। গণিকালয়ে ফিরে এসেই চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। সমস্ত রাগ ঝাড়ছেন তিথির উপর। ভূমির পালিয়ে যাওয়া নিয়ে মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ্যে সকলের সামনে নিজের ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করলেন পিংকি৷ চামেলি অনেকক্ষণ ধরেই তিথির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে যাচ্ছে৷ তার ভাষ্যমতে তিথি কোনো কলকাঠি নেড়েছে ভূমিকে পালাতে সাহায্য করবে বলে। একমাত্র সেই তো সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে লেগেই ছিল৷ তিথির বাহু ধরে ঝাকিয়ে চামেলি জিজ্ঞেস করল‚
“ভূমিকে কোথায় পাঠিয়েছিস? তাড়াতাড়ি বল! নয়তো তুই বুঝতেই পারছিস ম্যাডাম তোর সঙ্গে ঠিক কী কী করবে! তাই বলছি ভালোই ভালোই সত্যিটা বলে দে।”
“আমি ওকে কোথাও পাঠাইনি। ওই মেয়ে যে পালাতে পারে সেটাই তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷ আমাকে বিশ্বাস কর! আমি কিছুই জানি না।”
কিছুটা তাচ্ছিল্য করে চামেলি বলল‚ “তুই বললি আর তোকে আমরা বিশ্বাস করে নেব?”
“সত্যি আমি কিছুই করিনি।”
“তুই চুপ থাক। যা বিচার করার ম্যাডামই করবেন।”
এবার পিংকি চেঁচিয়ে বললেন‚ “থামবি তোরা? এই নিয়ে এখন আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না৷ ওই মেয়েকে খুঁজে আনা আমার বাঁ হাতের খেলা৷ এখন আমি একটু একা থাকতে চাই। বাকিরা যে যার কাজে যা।”
পিংকির কাছ থেকে ধমক খেয়ে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল চামেলি৷ বাকিরা যে যার কাজে আগেই লেগে পড়েছে৷ গণিকামহলের সকলেই পিংকি এবং তার রাগকে ভীষণই ভয় পায়৷ রাগ মাথায় চড়লে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন পিংকি৷ সেই রাগ গিয়ে ঝড়ে পড়ে গণিকামহলে থাকা সকল মেয়েদের উপর৷ চামেলি রান্নাঘরে চলে গেল। পিংকিকে এক কাপ কড়া করে দুধ চা বানিয়ে খাওয়াবে। আপাতত বৈঠকখানায় পিংকি আর তিথি ছাড়া আর কেউই নেই৷ সুযোগ বুঝে পিংকি জিজ্ঞেস করলেন‚
“পানিতে তুই-ই ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছিলি?”
ঘাবড়ে গেল তিথি৷ কী উত্তর দেবে ভেব পেল না৷ না জানি পিংকি এখন কী করবে! ভয়ে আঁটসাঁট অবস্থা তার৷ আমতা আমতা করতে শুরু করল। তার অবস্থা বুঝতে পেরে পিংকি বললেন‚
“আমার জন্য একগ্লাস পানি দে৷ দেখিস এখন আবার ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিস না৷ সারা বিকেল ধরে ঘুমিয়েই ছিলাম৷”
পিংকির কাছ থেকে এমন নমনীয় ব্যবহার কস্মিনকালেও আশা করেনি তিথি৷ কিছুটা ভড়কে গেল বৈকি৷ পিংকি সত্যিটা জেনেও কিছুই বললেন না দেখে ভীষণই অবাক হয়েছে সে৷ তিথি তাড়াহুড়ো করে জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে পিংকিকে দিয়ে দিল৷ ভূমি ঠিকঠাক ভাবে তার ঠিকানায় পৌঁছেছে কি-না জানা নেই তার! আর না কখনো জানতে পারবে৷ তবে ভূমির যে এই নরক থেকে মুক্তি মিলেছে এটাই বা কম কীসের? এতেই সে খুখি। তিথিকে এভাবে মৌনতা পালন করতে দেখে পিংকি বলে উঠলেন‚
“যাকে নিয়ে এত চিন্তা করছিস— সে তার নিজের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে।”
চকিত দৃষ্টিতে তাকাল তিথি৷ তার বিশ্বাস হচ্ছে না এ কথা পিংকি তাকে বলছে। আজ পিংকিকে একদম অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে অনেকটা বদলে গিয়েছেন তিনি৷ তারমানে পিংকি সবটাই জানত৷ তবুও কিচ্ছুটি বললেন না৷ অবিশ্বাস্য কম্পিত কণ্ঠে তিথি বলল‚
“ম্যাডাম আ..আপনি?”
নিজ ঠোঁটে তর্জনী ছুঁয়ে পিংকি বললেন‚ “হুস! এই কথাটা শুধুমাত্র আমাদের দুজনের মাঝেই থাকবে৷”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা আঁখিপল্লব দ্রুত ঝাপটাল তিথি৷ যার অর্থ এই কথা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি কখনো জানবে না৷ পানি গ্লাসটা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন পিংকি৷ আর এদিকে আড়াল থেকে ওদের সব কথাই শুনেছে চামেলি৷ শুনেও খুব একটা লাভ হবে না তার৷ এখানে সর্দারনি হচ্ছে পিংকি৷ তিনি যা ভালো মনে করেন সেটাই হয়৷ তার উপর দিয়ে কেউ আদতে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। আর বাকি রইল তিথি! তাকে তো সে একাই সামলে নিতে পারবে৷ বাঁকা হেসে রান্নাঘরে চলল তদারকি করতে৷
রাত সাড়ে সাড়ে দশটা…
খাবার টেবিলে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছেন৷ ফিরোজা আর মাধুরী এখনো খেতে বসেননি। উনারা পরে খেতে বসবেন। সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন উনারা। আজ রান্নার কাজ শেষ হয়েছে রাত সাড়ে আটটার দিকে৷ দুটো খাবার ভূমির খুবই পছন্দের। সেগুলোই আজ ফিরোজা নিজের হাতে রান্না করেছেন। এক হলো শিং মাছ‚ টমেটো আলু দিয়ে ঝোল আর একটা খাবার হলো ঝাল ঝাল করে দেশি মুরগীর মাংস ভুনা৷ ভূমির থেকেই শুনেছিলেন‚ এই খাবার গুলো নাকি মহুয়া খুবই যত্নসহকারে রান্না করতেন মেয়ের জন্য৷ ভূমির মায়ের মতো রান্না করতে পেরেছেন কি-না জানা নেই তবে তিনি চেষ্টা করেছেন ভূমির পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়ার। ওর মায়ের মতো করে ওর খেয়াল রাখার৷ খাবার টেবিলে ভূমিকে দেখে তখন চক্ষু চড়কগাছ। তিনি আশা করতে পারেননি যে‚ ভূমি এভাবে পালিয়ে এসে খুঁজে খুঁজে ঠিক বাড়িতেই চলে আসবে৷ এমনটা উনার কল্পনাতীত ছিল৷ গ্রামের এই সহজ সরল মেয়েটাকে তিনি একটু বেশিই সহজ সরল মনে করেছিলেন। তাই এখন উনাকে পস্তাতে হচ্ছে। খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে অর্পণকে মেহরাব শিকদার জিজ্ঞেস করলেন‚
“ভূমিকে তুমি কোথায় পেলে?”
“এক কথা বারবার বলতে আমি সাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না।”
অর্পণের কথা শুনে সকলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে৷ যে ছেলে কি-না সবসময় সকলের বাধ্যগত হয়ে থাকত সেই ছেলেই কি-না তার বাবার। মুখে মুখে কথা বলছে! ছেলের কথার প্রত্যুত্তরে ফিরোজা বললেন‚ “বাবার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে? কী হয়েছে তোর?”
“কিছু হয়নি। আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে৷ আমি ঘরে যাচ্ছি৷”
বাকিরা কেউই অর্পণকে জোর করল না৷ হাত ধুয়ে নিজের ঘরে চলে গেল অর্পণ। বাবার সঙ্গে কখনোই সে এমন ব্যবহার করে না তবে আজ তার কী হলো? সবাই মনে করছে হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে মন খারাপ আর নয়তো কিছু নিয়ে চিন্তা করছে৷ তাই তারা বিষয়টিকে নিয়ে খুব একটা ঘাটলেন না৷ অর্পণের মুড এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে৷ উপস্থিত কেউ অর্পণের মনের অবস্থা বুঝতে না পারলেও ভূমি ঠিকই বুঝল। এমন ব্যবহারের মানেটা বুঝতে তার এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি তার। মেহরাব শিকদার আড়চোখে বার কয়েক তাকালেন ভূমির দিকে৷ প্রলয় নিজের হাতে ভূমিকে খাইয়ে দিচ্ছে৷ আজ লাজলজ্জার মাথা খেয়েছে যেন৷ ভূমিও কিছু বলছে না৷ অপলক দৃষ্টে প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছে৷ বাচ্চা আসার কথাটা এখনো প্রলয়কে জানাতে পারেনি সে৷ তখন বলতেই নিচ্ছিল কিন্তু প্রলয় তাকে কিছু বলতেই দিল না৷ সে চায় তার অনাগত সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে যেন প্রলয়ের মতই হয়। পানি পান করে আলতো স্নেহময় হাতটা নিজের পেটের উপর রাখল ভূমি৷ মা হবার অনুভূতি সত্যিই খুবই অসাধারণ। কথাটা জানলে হয়তো প্রলয় খুবই খুশি হবে৷ তাকে আরও বেশি বেশি ভালোবাসবে৷ ভালো তো বাসতেই হবে৷ এ সময় মায়েরা তার আর সন্তানের জন্য দ্বিগুণ ভালোবাসা পায়৷ তার ক্ষেত্রেও অবশ্যই সেটা হবে৷ আজ অনেকটা তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেয়েছে ভূমি। বাড়িতে ফেরার পর একবারের জন্যও গা গোলায়নি তার৷ বরঞ্চ শরীরটা বেশ ভালো লাগছে৷ ওখানকার নোংরা আর অপবিত্র পরিবেশে থাকতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তার৷ যদিও তাকে একটা জানালা বিহীন ঘরের ভেতরে একপ্রকার আটকে রাখা হয়েছিল৷ বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে আকাশে উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে ভূমির৷ খাওয়া হয়ে গেলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল৷ তাকে খাইয়ে দেওয়ার চক্করে প্রলয় এখনো কিচ্ছুটি খায়নি৷ আসার পর থেকে লোকটা তার যত্ন নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ছেলের এমন ব্যবহার করার কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না মেহরাব শিকদার। অর্পণ কেন উনাকে না দেখার ভান করছে— কেন উনার সঙ্গে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে তার কোনো উত্তরই উনার কাছে আপাতত নেই।
রআত দেড়টা…
রাত গভীর হচ্ছে। শুধুমাত্র ঘুম নেই ভূমির দুচোখে। গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে সে। মেহরাব শিকদারকে হালকা ভাবে নেওয়া তার একদমই উচিত হচ্ছে না। যে নিজের অপকর্ম ঢাকতে মানুষ খু’ন করাতে পারে সে যাচ্ছেতাই করতে পারে। তার এখন একটাই ভাবনা কী করে মেহরাব শিকদারের সমস্ত অন্যায় কাজের প্রমাণ বের করবে৷ এই জঘন্য লোককে দুনিয়ায় মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেওয়া যাবে না৷ মেহরাব শিকদারের করা প্রতিটা পাপের শাস্তি সে নিজের হাতে দেবে৷ একমাত্র এই লোকের জন্য তার জীবনটা আজ এলোমেলো। তার আম্মাকে ম’রতে হয়েছে শুধুমাত্র এই লোকের জন্য৷ মাথার উপর থেকে আম্মা নামক বটবৃক্ষটা আর নেই৷ কয়েক ফোঁটা অশ্রুবর্ষণ হলো। আঁধারিয়া কামরা বিছানা হাতড়ে প্রলয়কে খোঁজার চেষ্টা করল সে। প্রলয় হয়তো ওপাশ ফিরে শুয়েছে৷ ভূমি আজ নিজ থেকেই এগিয়ে গেল। পেছন থেকে প্রলয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল৷ আম্মাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার সে প্রলয়কে হারাতে চায় না৷ সবে ঘুমোনোর চেষ্টা করছিল প্রলয়৷ সে মনে করেছিল ভূমি হয়তো ঘুমিয়ে পোরেছে। কিন্তু তার ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। তার ভূমি কন্যা তো দিব্যি জেগে রয়েছে৷ ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে প্রলয় বলল‚
“হঠাৎ করে বরকে এত ভালোবাসা হচ্ছে— কী ব্যাপার?”
প্রলয়ের কণ্ঠ শুনে অবাক হলো সে৷ লোকটা এখনো জেগে রয়েছেন৷ সে তো ভাবছিল প্রলয় হয়তো এতক্ষণে গভীর ঘুম তাইতো জড়িয়ে ধরল৷ ভূমি মুখে বলল‚ “তারমানে আপনি ঘুমাননি?”
“ঘুমিয়েছিলাম তো কিন্তু তুমি কোথায় আমাকে ঘুমতে দিলে ভূমি কন্যা?”
এই বলে পাশ ফিরে ভূমির উপর চড়ে কপালে আদুয়ে স্পর্শ ছুঁয়ে দিল৷ প্রলয় নিজের মাঝে নেই৷ সে মত্ত হতে চায় তার ভূমি কন্যার মাঝে৷ আর বিলম্ব না করে ভূমিকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে শুরু করল প্রলয়৷ যুগ্ম দেহাবয় নিজেদের অধরামৃ’তের স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করল। চেয়েও প্রলয়কে থামানো যাচ্ছে না৷ লোকটা যেন মুহূর্তেই উন্মাদ হয়ে গিয়েছে৷ ভূমিকে আগলে নিয়েছে নিজের মাঝে৷ বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত হবার পর ভূমির মুখের দিকে তাকাল প্রলয়৷ ঘরে ঘুমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। এই আবছা আলোতে ভূমিকে দেখে ক্ষীণ হাসল সে। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে ক্রমশ হাঁপাচ্ছে৷ ভূমির বুকের উপর মাথা রাখল প্রলয়৷ শরীরের মৃদু কম্পন খুব করে অনুভব করল সে। এবার চোখ মেলে তাকাল ভূমি। শরীরের উপর প্রলয়ের ভার সহ্য করতে না পেরে বলল‚
“একটু সরুন এমপি মশাই— আমার শরীরে চাপ লাগছে।”
প্রলয় শুনল না। সেভাবেই শুয়ে রইল৷ অনেকদিন পর তার ভূমি কন্যাকে সে কাছে পেয়েছে৷ আজ আর কোনো বাঁধা সে শুনবে না৷ না ভূমিকে কোনো বাঁধা দিতে দেবে৷ ভূমির গ্রীবাদেশে আদুরে ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে গ্রীবাদেশে কিছু চিনচিনে ব্যথাও অনুভূত হলো ভূমির৷ তবে সে তা সহ্য করে নিল। প্রলয় সেভাবেই শুয়ে থেকে ভূমিকে বলল‚
“আজকের রাতটা শুধুই তোমার আর আমার৷ তোমার মন থেকে সকল বিষণ্ণতা আর গ্লানি আমি নিংড়ে নিতে চাই ভূমি কন্যা৷ আজ আর বাঁধা দিয়ো না৷ ব্যাকুল হৃদয়ে একপশলা মেঘের আবির্ভাব ঘটুক৷ প্লিজ!”
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
এভাবেই আরও কিছুদিন কেটে গেল। নিজের প্রেগ্ন্যাসির কথাটা বলার সুযোগই হয়ে উঠল না ভূমির। প্রলয় তিনদিন হলো ঢাকার বাহিরে গিয়েছে। আজ ফিরে আসবে। এ কদিনে আগের থেকেও কিছুটা নাদুসনুদুস হয়েছে ভূমি। গাল দুটো ফোলা ফোলা। দিনকে দিন জৌলুস যেন বাড়ছে। আজ অনেকগুলো কাজ করে ফেলেছে সে৷ ঘরে যত আধোয়া জামাকাপড় ছিল সবগুলো একসঙ্গেই ধুয়ে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে এই অবস্থায় কাপড়চোপড় ধোয়া তার মোটেও উচিত হয়নি। শরীর অস্থির করতে শুরু করেছে। মাথা ঝিমঝিম করছে৷ অন্য কাজ করার সুযোগ হয়নি তার৷ নিজের প্রেগ্ন্যাসির কথাটা প্রলয়কে জানানোর জন্য মনটা আকুপাকু করছে দুদিন ধরেই। প্রলয় ঢাকা ফিরে এলেই জানিয়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ভাবতে ভাবতেই বিছানায় নতুন চাদর বিছানোর জন্য উদ্যত হলো ভূমি৷ তবে শরীরে কুলোচ্ছে না। ভাবল বিছানায় বসে কিছুটা সময় জিড়িয়ে নেবে। এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতা ঘরের ভেতরে এলো। ভূমিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল‚
“কী করছিলে গো ভাবিমণি?”
“বিছানায় চাদর বিছাতে নিচ্ছিলাম৷”
ভূমি তার খারাপ লাগাটাকে ওদের দুবোনের থেকে এড়িয়ে গেল। অন্যদিকে কিছু একটা মনে করে পূর্ণতা বলল‚ “ভাবিমণি আমরা দুজন তোমাকে সাহায্য করি?”
“আমি করে নিতে পারব। তোমরা কী কিছু বলবে?”
পূর্ণতাকে কিছু বলতে না দিয়ে পুষ্পিতা বলতে শুরু করল‚ “তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে এসেছিলাম। আজ তো কলেজ নেই। বাসায় থেকে থেকে বোর হচ্ছি। বাড়ি থেকে বের হবারও তো পারমিশন নেই। ইস যদি বড়ো ভাইয়া যদি একটু পারমিশন দিত!”
পুষ্পিতার বাহিতে চাপড় মে’রে পূর্ণতা বলল‚ “বড়ো ভাইয়া যা করে আমাদের ভালোর জন্যই করে। তাই তুই চুপ থাক৷ আমরা সারা দুপুর আজ ভাবিমণির সঙ্গে আড্ডা দেব।”
এই বলে একটু ঝুঁকে বিছানার চাদর একপাশে ঠিক করতে শুরু করল সে। ভূমি তাকে বাঁধা দিতে গেলেও শুনল না। নিজে থেকে বিছানাটা সুন্দর করে গুছিয়ে দিল। পুষ্পিতা এবার বিছানায় আয়েশ করে বসল৷ কাজে বড্ড অলস সে৷ ভূমি ঘর ঝাড়ু দেওয়ার জন্য উদ্যত হলে পূর্ণতা এবার তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই ঝাড়ু হাতে নিয়ে নিল৷ এবারও ভূমির কোনো বাঁধা সে শুনল না। কাজগুলো পূর্ণতাই করে দিল৷ এদিকে ভূমিকে জোর করে বিছানায় বসিয়ে পুষ্পিতা রাজ্যের কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। পূর্ণতাও ওদের সঙ্গে যোগদান দিল।
বিকেলে…
কিছুক্ষণ আগেই সাবিনাকে দিয়ে ডাক পাঠিয়েছেন ফিরোজা। ভূমি তখন সবে ঘুম থেকে উঠে আসরের নামায আদায় করে বিছানায় বসে ছিল। ক্লান্ত থাকায় দুপুরে পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই! ভূমিকে ডেকে সাবিনা নিজের কাজে চলে যায়৷ এরপর পেছন পেছন ধীর পায়ে ভূমিও সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো৷ ফিরোজার ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে সাড়া পেতেই সে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল৷ বিছানায় বসে উপন্যাসের বই পড়ছিলেন ফিরোজা৷ ভূমিকে দেখা মাত্রই বইটা বন্ধ করে বালিশের পাশেই রাখলেন৷ ক্লান্ত ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা৷ ফিরোজা এবার জিজ্ঞেস করলন‚
“তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে৷”
“তেমন কিছুই না চাচি মা৷ অনেকগুলো কাপড় ধুয়ে ফেলেছি আজ।”
“এত কাজ করতে কে বলেছে? বেশি বড়ো হয়ে গিয়েছ? সাবিনাকে তো বলতে পারতে৷ অথবা আমাকেও বলতে পারতে৷”
“তেমন বেশি জামাকাপড় ছিল না চাচি মা।”
“আচ্ছা তুমি বোসো। আমার তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে।”
বিছানায় বসে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “কী?”
ফিরোজা উনার আলমারি থেকে একটা বক্স বের করে ভূমির সামনে নিয়ে এলেন। এরপর ভূমির কাছে এসে বসলেন তিনি। হাসি মুখ নিয়ে বললেন‚
“তোমার আমার সম্পর্ককে একটা নতুন নাম দিতে চাই আমি।”
“নতুন নাম?”
“হুম— নতুন নাম!”
বক্স থেকে একটা চিকন চেইন বের করে ভূমির গলায় পড়িয়ে দিলেন ফিরোজা। মেয়েটাকে তিনি নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করেন। প্রতিটা মুহূর্ত মেয়েটাকে অবহেলা পেতে দেখছেন তিনি। খারাপ উনারও লাগে। এতকিছুর মাঝেও মাধুরী আর নিজেকে বদলালেন না। তাই তিনি ঠিক করেছেন নিজেদের সম্পর্ককে একটা নতুন নাম দেবেন। ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন‚
“তুমি এখন থেকে আমাকে মামনি বলে ডাকবে। তোমার যত সব বায়না আছে‚ নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে। তোমার আম্মা নেই তো কী হয়েছে— তোমার মামনি তো আছে! সে-ই তোমার বায়না পূরণ করবে।”
ফিরোজার কথায় ভূমি ভীষণই আবেগী হয়ে উঠল৷ আঁখিজোড়া ছলছল করছে। ফিরোজার কাছাকাছি এলে একটা সুন্দর মা মা গন্ধ পায় সে৷ মনে হয় যেন‚ তার আম্মা তারই সামনে আছে। কম্পিত কণ্ঠে ভূমি বলল‚ “মা..মামনি?” কথাটা মুখ থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা। বাচ্চাদের মতো গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। ফিরোজা বুঝতে পারলেন ভূমির অবস্থা। তিনি ভূমিকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলেন৷ আদুরে কণ্ঠে বললেন‚
“বোকা মেয়ে! এভাবে কান্না করতে আছে? আজ থেকে মামনির সামনে কান্না করা বারণ।”
“তোমার আমাকে খারাপ মেয়ে মনে হয় না মামনি? আমি তো জা..!”
ফিরোজা সেই কথাটাকে পুরোপুরি ভাবে বলতে দিলেন না তিনি। তার আগেই ভূমিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন‚ “মায়েদের কাছে সন্তান কখনো খারাপ হয়? তাই নিজেকে কখনোই ছোটো মনে করবে না। তুমি আজ থেকে আমার মেয়ে৷ আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
“তুমি খুব ভালো মামনি।”
“মেয়ের কাছে মায়েরা সবসময় ভালোই হয়।”
চোখের পানি মুছে হেসে উঠল ভূমি। এতকিছুর মাঝেই খুব আনন্দ হচ্ছে তার। আজ সে নতুন মা পেয়েছে৷ তবে যখন ফিরোজা তার পিতৃপরিচয় জানতে পারবেন তখনও কী এই ভালোবাসাটা থাকবে? তখনও কী এভাবেই ভূমিকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করবেন তিনি? ভেবে পায় না ভূমি। আপাতত সে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাইছে না। বর্তমান নিয়ে সুখে থাকতে চায় সে। তবে মেহরাব শিকদার কী আদতে তাকে সুখে থাকতে দেবে? আদতে সে এ বাড়িতে টিকে থাকতে পারবে? মাথায় হাজারো প্রশ্ন— হাজারো উত্তর হাতছানি দিচ্ছে৷ সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে পাগল মনে হয় তার৷ দুজনের মাঝে অবাক নীরবতা। ভূমিকে একপলক দেখে এবার ফিরোজা বললেন‚
“তুমি এখন গিয়ে বিশ্রাম নাও৷ বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে৷ ঘরে গিয়ে টানা দু-ঘণ্টা ঘুমবে৷ নিচে আসার প্রয়োজন নেই। এদিকটা আমি সামলে নেব।”
ভূমি সায় জানাল। তখন ঘুম থেকে উঠে নামায আদায় করে ফিরোজার ঘরে এসেছিল সে৷ এখন আবারও ঘুম পাচ্ছে তার। তার এই নাদুসনুদুস হবার পেছনে একমাত্র দায়ী হচ্ছে এই বেলা অবেলায় পড়ে পড়ে ঘুমোনো৷ ভূমি তার ঘরে চলে এলো। প্রলয়ের সঙ্গে সেই সকালে তার কথা হয়েছিল। লোকটা জানিয়েছিল আজ ফিরে আসছে৷ কিন্তু কখন আসছে সে ব্যাপারে সঠিক ভাবে কিছুই জানা হয়নি তার৷ দুপুর গড়িয়ে— বিকেলও গড়াতে চলল অথচ লোকটা একটিবার কল পর্যন্ত করল না। সুপ্ত অভিমান হলেও ভূমি নিজে থেকেই প্রলয়ের নাম্বারে কল লাগাল। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হলো। হয়তো তার কলের অপেক্ষাতেই ছিল প্রলয়। ভূমি কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই প্রলয় বলে উঠল‚
“আমার বউটা কী করছিল?”
বিছানার অন্যপাশ ফিরে ভূমি বলল‚ “শুয়ে ছিলাম।”
“সন্ধ্যায় নাস্তা করেছ?”
“হ্যাঁ। আপনি কিছু খেয়েছেন? কখন আসবেন আপনি?”
“দেরি হবে সোনা।”
মন খারাপ হয়ে গেল ভূমির৷ আজকাল প্রলয় তাকে একটুও সময় দিচ্ছে না। আর কল করার মতো সময় আছে এমপি মশাইয়ের? সে তো সারাক্ষণ জনগণের সেবায় নিয়োজিত। তার খেয়াল রাখার সময় কী আর এমপি মশাইয়ের আছে নাকি? আজকাল মন খারাপের আগমন হুটহাটই হয়। তাদেরকে ঘটা করে নিমন্ত্রণ করতে হয় না। ভূমি চুপ করে আছে দেখে ওপাশ থেকে প্রলয়ের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো‚
“আমার বউটা কী খুব বেশি মিস করছে তার এমপি মশাইকে?”
এবার মনে হলো যেন ফোনের লাউডস্পিকার আরও বেড়ে গেল। পরক্ষণেই ভূমি পেছন ফিরে তাকাল৷ প্রলয় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মানে লোকটা তার সঙ্গে মজা করছিল৷ কল কেটে ফোনটাকে বিছানার উপর রেখে প্রলয়ের কাছে গেল সে। টানা তিনদিন পর লোকটাকে দেখছে সে। নিজে থেকেই প্রলয়কে জড়িয়ে ধরল। তিনদিনের একাকীত্ব আজ ঘুচল। অর্ধাঙ্গের বক্ষঃস্থল হতে মুখ তুলে বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে ভূমি বলল‚
“ইদানীং আপনি আমাকে একটুও সময় দিচ্ছেন না এমপি মশাই।”
“তোমার বর কাজে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সোনা। এখন একটু ম্যানেজ করে নাও। ফ্রি হয়ে বেশি বেশি আদর করে সব পুষিয়ে নেব।”
সলজ্জে হাসল ভূমি। তার সারা মুখে আদুরে চুম্বন এঁকে দিয়ে প্রলয় বলল‚ “ভালোবাসি বউ৷”
ভূমি আবারও প্রলয়ের বুকে মাথা রাখল। এখানেই যে তার সকল প্রশান্তি লুকিয়ে রয়েছে। একমাত্র প্রলয় হলেই চলবে। তার আর কিচ্ছুটির প্রয়োজন নেই৷ সমস্ত অবহেলা হাসি মুখে সহ্য করে নেবে সে৷ পরবর্তীতে যা হবে দেখা যাবে। আর কোনো ভয় দ্বিধা কিচ্ছু নেই তার৷
পরের দিন…
সারাটাদিন একইভাবে কাটল ভূমির৷ এতকিছুর মাঝে নিজের শরীরের প্রতি কোনো খেয়ালই নেই তার। আবারও খাবারে অনিয়ম শুরু হয়েছে। এদিকে ব্যস্ততার কারণে ভূমিকে খুব একটা সময় দিতে পারছে না প্রলয়। তিনদিন শহরের বাহিরে থেকে কালই ফিরে এলো আবার আজ থেকেই তার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে৷ প্রলয়কে নিয়ে অভিমানের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে ভূমির মনে। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বমি আর মাথা ঘুরছিল৷ পেটের ভেতর যেন সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল৷ তবুও সাবিনার সঙ্গে থেকে বাড়ির সমস্ত কাজ সে একা হাতে করেছে৷ ফিরোজা উনার বোনের বাড়িতে গিয়েছেন। সন্ধ্যে হয়েছে বিধায় অর্পণ নিজেই তার মায়ের সঙ্গে গিয়েছে। আজ হয়তো বাড়ি ফিরবে না। সন্ধ্যেবেলা পূর্ণতা পুষ্পিতা বায়না ধরেছে আলু পুরি খাবে। তাই ননদিনীদের বায়না পূরণ করতে ভূমিই ছুটে এসেছে রান্নাঘরে৷ অনেকদিন পর আজ ওরা দুটোতে বায়না ধরেছে। সাবিনা অবশ্য সবকিছু আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল৷ বাকি কাজটা ভূমি নিজেই করেছে। আলু পুরি বানানো হয়ে গেলে সাবিনাকে বলে ভূমি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো। উদ্দেশ্য পূর্ণতা পুষ্পিতাকে ডেকে আনা। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বৈঠকখানায় আসতেই অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ল সফেদ মেঝেতে৷ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হতেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো সাবিনা। ভূমিকে এভাবে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেল ভীষণ। দ্রুত কাছে গিয়ে বসল। এরপর চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকতে শুরু করল। সাবিনার চেঁচামেচিতে মোর্শেদ শিকদার‚ মাধুরী‚ মেহরাব শিকদার বেরিয়ে এলেন। প্রলয় তখন বাড়িতে নেই৷ আর না ফিরোজা ও অর্পণ রয়েছে! পূর্ণতা পুষ্পিতা তখন নিজেদের ঘরেই৷ নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনেছে কি-না জানা নেই। উপায়ন্তর না পেয়ে মাধুরী আর সাবিনা মিলে ভূমিকে ধরে ধরে উনাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। অচৈতন্য ভূমিকে তো সিঁড়ি ভেঙে উপরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মাধুরী নিজে থেকেই ভূমির চোখমুখে পানি ছিটিয়ে দিলেন। মেহরাব শিকদার এসে ভূমির পালস পরীক্ষা করল। আসল খবরটা তো উনার জানাই ছিল৷ এবার শুধু একটা ঢোলে বাড়ি দেওয়া প্রয়োজন। নাচবেন তো মাধুরী নিজেই। মেহরাব শিকদার বললেন‚
“ভাবি আমার মনে হচ্ছে ভূমি প্রেগন্যান্ট।”
এ কথা শোনা মাত্রই মাধুরীর চোখমুখ থমথমে হয়ে গেল। উনার মনে এই মুহূর্তে কী চলছে তা জানার উপায়ন্তর আর কারোর নেই! তবে মেহরাব শিকদার কিছুটা হলেও আন্দাজ করছেন। এবার তো শুধু প্রলয়ের আসার অপেক্ষা। প্রলয়ের কাছ থেকে যদি পজেটিভ রেসপন্স আসে তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
ভূমির জ্ঞান ফেরার পর সে দেখল বিছানার এক কোণে গম্ভীর হয়ে বসে রয়েছে প্রলয়। ক্লান্ত দৃষ্টিতে পুরো ঘর একবার পর্যবেক্ষণ করল ভূমি। অচৈতন্য হবার আগে সে তো রান্নাঘরে কাজ করছিল। নিজেদের ঘরে কী করে এলো তার জানা নেই। এ ঘরে শুধু প্রলয় নয়— মাধুরীও রয়েছেন। প্রলয়ই হয়তো তাকে নিয়ে এসেছে। ভূমি একা একাই শোয়া থেকে উঠে বসল। প্রলয় তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সন্ধ্যেবেলা নিজের কাজ ছেড়ে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে৷ তাকে মেহরাব শিকদারই কল করেছিলেন। ভূমির অবস্থা জানিয়ে বলেছিলেন তাড়াতাড়ি যেন বাড়ি ফিরে আসে! এবার প্রলয় তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল‚
“ভূমির সঙ্গে আমার আলাদা করে কিছু কথা বলার আছে। মা তুমি এখন যাও।”
মাধুরী আগ বাড়িয়ে কোনো কথা না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল প্রলয়৷ হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚
“এই বাচ্চাটা কার? তুমি কী লুকোচ্ছ আমার কাছ থেকে?”
ভূমি কিছু বলতেই নিচ্ছিল কিন্তু প্রলয়ের ধমকে চমকে উঠল। তার এহেন রাগ দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ভূমির। এত রাগ করতে প্রলয়কে আগে দেখেনি৷ এই একটা স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে লোকটার এমন ব্যবহার খুবই অবাক করল তাকে। সে প্রলয়ের রাগ আর রিভলবারকে খুবই ভয় পায়৷ প্রলয় আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছি৷ বাচ্চাটা কার?”
কম্পিত কণ্ঠে ভূমি উত্তরটা দিচ্ছিল‚ “বাচ্চাটা…!”
এরই মাঝে মাধুরী ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন। ভূমিকে তার পুরো কথাটা বলতে দিলেন না তিনি। এতক্ষণ দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। ভূমি যেই না কিছু বলতে নিবে তার আগেই তিনি ঘরে ভেতর প্রবেশ করলেন। আর ভূমির কথাটা অপূর্ণই রয়ে গেল। এ সুযোগটাই লুফে নিলেন মাধুরী। আগ বাড়িয়ে দুজনের কথার মাঝে টিপ্পনী কে’টে বললেন‚
“কার না কার বাচ্চা পেটে ধরে আমার ছেলেকে ফুসলাচ্ছে। স্বভাব তো পুরো মায়ের মতই পেয়েছ। ন’ষ্টা মেয়ে।”
মাধুরীর ব্যবহারে আজ অবাক করছে ভূমিকে৷ এমনিতে এই মহিলা যে তাকে দেখতে পারে না এটা সে প্রথম থেকেই জানে। মাধুরীর এভাবে মিথ্যা অপবাদ দেওয়াতে সে ভীষণই কষ্ট পেয়েছে। নিজের কান্নাকে সংবরণ করে মাধুরীকে বলল‚
“সদ্য হারিয়ে ফেলা মাকে আমি আপনার মাঝে সবসময় খুঁজে বেড়াই। কিন্তু আফসোস আমার জন্য আপনার মনে একটুও মমতা নেই। যা আছে তা শুধুমাত্রই ঘৃণা। আচ্ছা মা— আমাকে কী একটুও ভালোবাসা যায় না?”
“কোনো জারজ সন্তানকে আমি ভালোবাসতে পারব না।”
মাধুরীর মুখে এমন কথায় ক্ষ’তবিক্ষ’ত হলো তরুণীর মন। এতটা কষ্ট দিয়ে কেউ কারো মুখের উপর কথা বলতে পারে? প্রত্যেকের অনাদরে বেড়ে ওঠা মেয়েটার মনে বিতৃষ্ণা জন্মাল। ভূমি অবাক চোখে তাকাল প্রলয়ের দিকে। মাধুরী এত খারাপ কথা শোনাচ্ছে— কই আজ তো সে কোনো প্রতিবাদ করছে না! দিব্যি নির্বিকার ভঙ্গিতে শুনছে। সে-ও কী তার মায়ের মতই চিন্তাধারা পোষণ করছে? প্রশ্ন জাগল ভুমির মনে৷ কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল‚
“আপনি কিছু বলছেন না কেন?”
প্রলয়ের মাথায় অনেককিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ভূমি তো প্রতিদিনই পিল খেত৷ আর আসল কথা হচ্ছে‚ মেহরাব শিকদার তাকে জানিয়েছিলেন ভূমি দুই সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। এই কথাটা শোনার পর খুবই অবাক হয় প্রলয়৷ এর আগে তো ভূমি নিয়ম করে প্রতিদিনই পিল খেয়েছে৷ সে নিজে থেকেই খোঁজ নিয়েছে৷ ভূমি অবশ্যই তাকে মিথ্যে বলবে না। তাহলে এই বাচ্চা? সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে তার৷ এসব কিছু নিজের মাঝে দাবিয়ে রাখতে না পেরে প্রলয় বলল‚
“মা ভুল কী বলেছে? তোমার থেকে আর কীই-বা আশা করা যায়?”
কয়েকটা বাক্য নিমিষেই ভূমির কোমল হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল। প্রলয় তাকে অবিশ্বাস করছে ভাবতেই নিশ্বাস আটকে এলো যেন! ভালোবাসার মানুষ অবিশ্বাস করলে যে— পুরো পৃথিবীটাই মিথ্যে হয়ে যায়। নেত্র যুগল অশ্রুপ্লুত হলো। ঝাপসা চোখে প্রলয়কে দেখতে লাগল ভূমি। মানুষটাকে খুব অচেনা মনে হচ্ছে। তাদের ভালোবাসায় হয়তো খাদ রয়েই গিয়েছিল৷ ঘন ঘন আঁখিপল্লব ঝাপ্টে অশ্রুকণা শুষে নিয়ে ভূমি বলল‚
“আমরা যা দেখতে পাই— সবসময় সেটা সত্যি নাও হতে পারে। যেখানে আমার নিজের বা…!” কথাটা পুরোপুরি না বলেই থেমে গেল ভূমি। একটু সময় নিয়ে আবারও বলল‚
“পরের বাড়ির মেয়ে পরেরই হয়— তারা কখনো আপন হতে পারে না। শুরু থেকে কম অবহেলা‚ লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়নি আমাকে। মানুষের জীবনটা যে কতটা দুর্বিষহ হতে পারে আমি তা আমার এই ছোটো জীবনেই উপলব্ধি করেছি। এ সংসারে এসে শাশুড়ী মায়ের ভালোবাসা কেমন হয় আমার জানাই হলো না! ভালোবাসার কাঙালি হয়ে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি অহর্নিশ। অথচ বিনিময়ে কিছুই পেলাম না। আজ আমার সমস্ত পিছুটান শেষ। যে ভালোবাসায় বিশ্বাস ভরসা নেই সেখানে আর একমুহূর্ত না। যা হারানোর আমি হারিয়ে ফেলেছি৷ না আমার কিছু চাওয়ার আছে আর না কিছু পাওয়ার আছে৷ আমার সন্তানকে আমি একাই মানুষ করতে পারব। কারো প্রয়োজন নেই আমার। যে নারী প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে হারিয়ে যায়— তাকে আর সহজে ফিরে পাওয়া যায় না।”
ভূমি এতকিছু বলার পরও প্রলয় টু শব্দটি পর্যন্ত করল না৷ ভূমির শেষ কথাটা শুনে ধুকপুক করতে থাকা হৃদয়টা ধক করে উঠল। বাঁ চোখটা আজ সকাল থেকেই লাফাচ্ছে। খারাপ কিছু ঘটবে না তো? সে তো এ সমস্ত কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। তবে আজ কী হলো? সে কী কোনো ভুল করছে? মুখে যেন আজ কুলুপ এঁটেছে সে। মুখ দিয়ে কথে বেরই হচ্ছে না। ভূমি আস্তে করে প্রলয় এবং তার পরিবারের দেওয়া সমস্ত গহনা শরীর থেকে খুলে ফেলল৷ আজকের পর থেকে তার জীবনে যে স্বল্প পরিমাণ সুখ ছিল সেটাও শেষ। গায়ের ওড়নাটা মাথায় সুন্দর করে পেচিয়ে প্রলয়ের উদ্দেশে বলল‚
“ভালো থাকবেন এমপি মশাই!”
ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল ভূমি। এ বাড়িতে আর একমুহূর্ত থাকবে না সে। এদিকে পুরোপুরি ঘোরের মাঝে আছে প্রলয়। কী থেকে কী বলে ফেলেছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ইদানীং রাজনীতির প্রেসারটা তার উপর একটু বেশিই। পাথরের ন্যায় বিছানায় বসেই রইল৷ ভূমিকে আটকানোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে।
মালঞ্চ নীড় থেকে বেরিয়ে গেল ভূমি৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে৷ মৃদু বাতাসে শরীর শিরশির করে উঠছে৷ নিস্পৃহ বোকাচণ্ডী একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ কোথায় যাওয়া উচিত তার জানা নেই! না তার কোথাও যাওয়ার আছে আর না এ শহরে তার কেউ আপন আছে! বিশাল অম্বর আজ গহীন আঁধারিয়ায় মত্ত। তারও হয়তো ভূমির জন্য মন খারাপ তাইতো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি একটু একটু করে মুষলধারায় রূপ নিচ্ছে। ভূমি সেই আকাশ পানে তাকিয়ে ভাবল‚
“ও পৃথিবী! আমি কী করে বলি— আমার বাবা আমাকে গণিকালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল? কোনো সন্তানকে কী তার বাবা এমন এক নিষিদ্ধ স্থানে ফেলে আসতে পারে? এতটা নিষ্ঠুর কেউ কী করে হতে পারে? নিজের সন্তানের ভালোর জন্য বাবারা নাকি সবকিছুই করতে পারে৷ তবে আমার ক্ষেত্রে কেন এত ভিন্নতা? আমিও তো বাবার স্নেহ ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলাম।”
ঘণ্টা খানেক পর…
হন্তদন্ত হয়ে ঘণ্টা খানেকের মাঝেই অর্পণ বাড়ি ফিরে এলো। ভূমির চলে যাওয়া নিয়ে সব কথাই বলেছে পূর্ণতা পুষ্পিতা। ফিরোজা নিজেও বাড়ি ফিরে এসেছেন। ভূমির জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে উনার। এই রাতে মেয়েটা কোথায় যাবে! শহরের কিছুই তো সে ভালো করে চেনে না৷ রাস্তায় যদি কোনো বিপদ হয়? বাড়ি ফেরার পর মাধুরী আর প্রলয়কে কয়েক দফা কথাও শুনিয়ে দিয়েছেন ফিরোজা৷ এতদিন তিনি প্রলয়কে দায়িত্বসম্পন্ন বুদ্ধিমান ছেলে ভেবে এসেছেন। কিন্তু সেই প্রলয়ই আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো বোকামিটা করেছে ভূমিকে অবিশ্বাস করে৷ ভূমির এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়া নিয়ে আর কেউ খুশি না হলেও মেহরাব শিকদার আর মাধুরী তো ভীষণই খুশি৷ অর্পণ তার বাবাকে একবার পর্যবেক্ষণ করল। সবচেয়ে বেশি রাগ তো হচ্ছে প্রলয়ের উপর৷ কাউকে কিছু বলতে না পেরে অর্পণ তার ঘরে চলে গেল৷ বোনকে ফিরে পেয়েও ধরে রাখতে পারল না সে। কেন যে আজ বের হয়েছিল! বাড়িতে থাকলে অন্তত ভূমির পাশে থাকতে পারত। অর্পণ খেয়াল করল তার ড্রেসিং টেবিলের উপর পেপার ওয়েটে নিচে একটা কাগজ চাপা পড়ে আছে৷ কিছুটা সন্দেহ হওয়াতে সে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে কাগজটাকে হাতে নিল৷ সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা‚
“উনার পাশে ছায়ার মতো থেক ভাইয়া৷”
~ভূমি!
মানে মেয়েটা যাওয়ার আগেও প্রলয়ের কথাই ভাবছিল৷ অর্পণের মাথা এবার ওলট-পালট হয়ে গেল৷ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আবারও প্রলয়ের ঘরে গেল কিন্তু ঘর ফাঁকা। এরপর অর্পণ বৈঠকখানায় চলে গেল৷ সেখানেই সবাই উপস্থিত। আর কেউ ভূমির খোঁজ না করতে গেলেও সে অন্তত যাবে৷ বৈঠকখানায় গিয়ে সেই কাগজটা প্রলয়ের সামনে তুলে ধরল অর্পণ। এরপর বলতে লাগল‚
“যাওয়ার আগে ভূমির অপূর্ণ কথাগুলো তুমি শুনেছিলে ভাই? একপাক্ষিক বিবেচনা করে মেয়েটাকে এভাবে অবিশ্বাস করতে পারলে তুমি? জেঠিমা তো শুরু থেকে ভূমিকে পছন্দ করে না। আজ তুমিও সেই তালেই এগিয়ে গেলে! কী করে পারলে তুমি এমনটা করতে? খুব বড়ো ভুল করলে ভাই। এই ভুলের দায় তোমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।”
সবার প্রতি রাগ বাড়ছে তড়তড় করে৷ বিশেষ করে মেহরাব শিকদারের উপর। ভূমিকে এ বাড়ি থেকে তাড়ানো আর তাকে অবিশ্বাস করানোর পেছনে কলকাঠি তো এই লোকেই নাড়ছে৷ বাবার প্রতি সুপ্ত রাগ আর দাবিয়ে রাখতে পারল না সে। সবার সামনে চেঁচিয়ে বলল‚
“ভূমির যদি কিছু হয় তাহলে আমি আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না। আর হ্যাঁ আমি ভুলে যাব আপনি আমার জন্মদাতা পিতা। কথাটা মাথায় রাখবেন আশাকরি।”
এই বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না বড়ো বড়ো পা ফেলে মালঞ্চ নীড় হতে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে করে বাইকের চাবি নিয়ে এসেছিল৷ কোথায় খুঁজবে সে তার বোনকে? ভূমিকে নিয়ে চিন্তা ক্রমশ বাড়তে শুরু করল৷ এদিকে অর্পণের ব্যবহারে অবাক হলেন মেহরাব শিকদার। প্রলয়কে তখন তিনি মিথ্যে বলেছিলেন। তিনি তো জানেন ভূমি আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল৷ তবুও তিনি ইচ্ছে করে প্রলয়ের কাছে মিথ্যে বলেছেন যাতে করে ভূমিকে সে অবিশ্বাস করতে পারে৷
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এখন মুষলধারার রূপ নিয়েছে৷ ল্যাম্পপোস্টের বাতিতে এঁটে থাকা ঝিঝি পোকা গুলো উড়া বন্ধ করে দিয়েছে। রাতের শহরটা নিরিবিলি। আশেপাশের দোকানপাট গুলো বন্ধ। রাস্তা দিয়ে একাকী হাঁটতে ভূমির খানিকটা ভয় করছে। তবুও সে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে‚ নাম না জানা এক গন্তব্যে। হঠাৎ করেই সামনে একটা জিপ গাড়ি এসে থামল। হুট করে সামনে চলে আসায় কিছুটা ঘাবড়ে গেল ভূমি। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। সেই গাড়ি থেকে নামল চারজন ছেলে। তাদের হাতে লাঠি। ভূমি বুঝতে পারল না‚ ছেলেগুলো কেন তার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে! বোকাসোকা স্বরে জিজ্ঞেস করল‚
“আপনার আমার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছেন কেন? সরে যান সামনে থেকে। আমাকে যেতে দিন।”
“তোমাকে যেতে দেওয়ার জন্য তো আসিনি মামনি। তোমার দেখভাল করার দায়িত্ব পড়েছে আমাদের উপর।”
ঘাবড়ে গেল ভূমি। এটা মেহরাব শিকদারের নতুন কোনো পরিকল্পনা নয় তো? তাকে বাড়ি থেকে বের করার পেছনে ওই জঘন্য লোকটার হাত তো নিশ্চয়ই আছে। কম্পিত কণ্ঠে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “মানে?”
“তোমাকে আজ আমরা পরপারে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।”
এবার বেশ ভয় পেতে শুরু করল ভূমি। নিজের জন্য ভয় করছে না তার। কিন্তু তার জীবনের সঙ্গে যে আরেকটা নিষ্পাপ জীবন জড়িয়ে রয়েছে। লোকগুলো এক পা দু পা করে ভূমির দিকে এগিয়ে আসছে৷ বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ হতে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে৷ ভূমি সমান তালে পিছতে শুরু করল। পালানোর আর রাস্তা নেই। ভূমি লোকগুলোর সামনে হাত জোড় করে বলতে লাগল‚
“আল্লাহর দোহাই লাগে— আমাকে মারবেন না৷ আমি বাঁচতে চাই৷ আমার অনাগত সন্তানের জন্ম দিতে চাই৷ আমাকে বাঁচতে দিন— আমাকে মা হবার সাধ থেকে বঞ্চিত করবেন না।”
ভূমির কথাটা কেউ-ই শুনল না বরঞ্চ লাঠি দিয়ে বেধড়ক মা’রতে শুরু করল। গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করছে ভূমি। অথচ সাহায্যের জন্য কেউ নেই আশেপাশে। ভূমির আর্তনাদে লোকগুলো যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে৷ দূর্বল নেত্রপল্লব মুদে যাবার আগে প্রলয়ের মুখটা ভেসে উঠল। ভূমির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে সহস্র নোনা জল। শরীরটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। ইঞ্চি পরিমাণ নড়ে ওঠার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই৷ চোখ বন্ধ করার আগ মুহূর্তে ভূমি দুটো কথাই আওড়াল‚
“এই ভূমি পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। তার অস্তিত্ব আর কোথাও থাকবে না— কোত্থাও না!”
মায়ের আদরের পদ্মিনী সে‚
বাবার অবহেলিত রাজকন্যা;
প্রত্যেকরই চোখের বালি‚
স্বামীর নির্মলা ভূমিকন্যা!
[ঊর্মি আক্তার ঊষা]
চলবে।