রণরঙ্গিণী প্রেমরঙ্গা পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
3

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

[তৃতীয় পরিচ্ছেদ]

ঘণ্টা দুয়েক সময় ধরে অর্পণ আর মৃত্তিকা এই আমগাছ তলায় বসে রয়েছে। নিজের জীবনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা সে অর্পণকে জানাল। মৃত্তিকার কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনে অর্পণের চোখ জোড়ায় পাবক শিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। আর যাই হয়ে যাক‚ আজ এবং এখন থেকে সে সব সময় ভূমির পাশে ছায়ার মত থাকবে। মেহরাব শিকদারের মুখোশ উন্মোচনে ভূমিকে সদা সহায়তা করবে। ভাগ্যের জোরে সে তার বোনকে আজ আবারও ফিরে পেয়েছে। একই ভুল না সে করবে‚ আর না তার ভাইকে করতে দেবে। যে করেই হোক বোনের মান ভাঙিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি দূর করবে। এভাবে দুজন ভালোবাসার মানুষ কিছুতেই আলাদা হতে পারে না৷ মৃত্তিকা খেয়াল করল অর্পণের হাতে থাকা কাগজটাকে। তাই সে জিজ্ঞেস করল‚

“তোমার হাতে এটা কীসের কাগজ ভাইয়া?”

বিলম্ব না করেই অর্পণ বলল‚ “ভাই তোর ডিএনএ টেস্ট করাতে দিয়েছিল।”

অবাক হলো ভূমি। ডিএনএ টেস্ট করতে গেলেও তো ভূমি আর মৃত্তিকা দুজনেরই স্যাম্পল লাগবে। মৃত্তিকার ডিএনএ স্যাম্পল যদিও পেয়ে যেতে পারে। তবে একবছর পর ভূমির ডিএনএ স্যাম্পল প্রলয় কোথা থেকে জোগাড় করল? প্রশ্ন একটা থেকেই যাই তাই সে অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚

“উনি আমার ডিএনএ স্যাম্পল কোথায় পেয়েছেন?”

“পুরো একবছর ধরে ভাই তোর ব্যবহার করা প্রত্যেকটা জিনিস গুলো খুব যত্নে আগলে রেখেছে৷ কাউকে তার ঘরে ঢুকতে দেয় না। যদি তোর ছোঁয়া জিনিসগুলোর উপর থেকে মুছে যায়। হয়তো সেখান থেকেই স্যাম্পল পেয়েছে৷ আর মৃত্তিকার ডিএনএ স্যাম্পল নেওয়া তার কাছে কোনো ব্যাপারই না।”

মৃত্তিকা তাচ্ছিল্য করে হাসল। এসব ভালোবাসা আর সম্পর্ক থেকে বহু আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নতুন করে কঠিন হৃদয়ে ভালোবাসার পুষ্প প্রস্ফুটিত হতে পারে না৷ আর না কখনো সেটার আভাস নিজের মনে উঁকি দিতে দেবে৷ বসে থেকে বাঁ হাত দ্বারা ডান হাতের নখ খুটতে গিয়েই কথাটা মন্দ পড়ল তার৷ তাই সে বলল‚

“তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে ভাইয়া!”

অবাক হয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “কী কাজ?”

“এই ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পাল্টে দিতে হবে৷”

“কিন্তু কেন? তুই আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে চল বোন।”

“আমি জীবনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। অতীত পানে আমি আর তাকাতে চাই না৷ আর যেখানে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায় সেখানে তো আমি কখনোই ফিরে যাব না৷ এই মৃত্তিকা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর স্ত্রী। নিষ্ঠুর তার হৃদয়। অবহেলা পেতে পেতে সে পাথর হয়ে গিয়েছে। আগের সহজ সরল ভূমি পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে ভাইয়া৷”

“এভাবে বলিস না বোন৷ তোকে অবিশ্বাস করার শাস্তি ভাই নিজেকে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে৷”

এবারও তাচ্ছিল্য করে ভূমি বলল‚ “উনার শাস্তি আগামী দশ বছরেও শেষ হবে না৷”

মৃত্তিকাকে শান্ত করানোর জন্য অর্পণ বলে উঠল‚ “আচ্ছা বোন আমাকে একটা কথা বল তো!”

সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকা জিজ্ঞেস করল‚ “কী কথা?”

“এই এক বছর তুই কোথায় ছিলিস?

সেই রাতের কথা মনে পড়তেই মৃত্তিকার আঁখিদ্বয় হতে উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। সে বলল‚ “সেদিন আমার অনাগত বাচ্চাটার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি সত্তাকে সমাধি দিয়েছি৷”

এক বছর আগের ঘটনা…

“সেদিন অতিরিক্ত ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ভূমি যখন অচৈতন্য হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ে‚ তখন ছেলেগুলো ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো মা‘রা গিয়েছে৷ তাই তাদের বসের কথানু্যায়ী ভূমির লা’শটাকে একটা লেকের ধারে ফেলে দিয়ে আসে। ভূমির নিথর শরীরটা সারাটা রাত বৃষ্টির পানিতে ভিজেছে৷ পরের দিন সকালে এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী জগিং করতে সেই লেকে আসেন। কিনারায় ভীড় দেখতে পেয়ে তিনি সেখানটায় যান৷ ভেজা শরীরে র’ক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ভূমির দেহটা৷ কোনো দিক না ভেবেই তিনি তার কাছে যান৷ কপালে কে’টে যাওয়া স্থানে র’ক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে৷ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী নিজের ডান হাতের তর্জনী ভূমির নাকের কাছে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন‚ নিশ্বাস পড়ছে কি-না। সঙ্গে সঙ্গেই চমকে ওঠেন। মেয়েটার নিশ্বাস পড়ছে৷ এরপর যত দ্রুত সম্ভব ভীড় কমানোর চেষ্টা করেন তিনি৷ দুটো মেয়ের সাহায্যে ভূমিকে লেকের কিনারা হতে তুলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন তিনি৷ মেয়েটা এভাবে ভেজা অবস্থায় থাকলে আরও সমস্যা হতে পারে৷ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী ভাবলেন‚ এত কিছুর পরও যেহেতু মেয়েটা বেঁচে রয়েছে তার মানে— উপর ওয়ালা এই মেয়ের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন৷ যে করেই হোক মেয়েটাকে উনার বাঁচাতেই হবে৷ এমনটাই জেদ ধরেছিলেন তিনি৷ এরপর একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভূমির চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা হয়৷ এই ক্লিনিকে সুদর্শিনীর স্বামী অর্ণব ডক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে মাস ছয়েক হবে। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মাঝেও দারুণ দারুণ কাজ করেছে সে। ভূমির সমস্ত চিকিৎসা মূলত অর্ণবই করেছে। পুরো বাহাত্তর ঘণ্টা পর ভূমির জ্ঞান ফেরে৷ সেদিন ভূমিকে বাঁচাতে পারলেও অনাগত নিষ্পাপ প্রাণটাকে বাঁচানো যায়নি। পেটে বেশ জোরে আঘাত পাওয়ার ফলে এমনটা হয়েছে। সেদিন ভূমি প্রচণ্ড কান্না করেছিল। প্রায় তিনমাস মেন্টাল ট্রমাতেই ছিল সে। নিঃসন্তান হওয়ার দরুন মি. এবং মিসেস রায়চৌধুরী মিলে ঠিক করেছিলেন‚ ভূমিকে দুনিয়ার সামনে নিজের মেয়ের পরিচয় দেবেন৷ ভূমি থেকে তার নামকরণ হবে “মৃত্তিকা” নামে৷ এরপর থেকে ভূমির একটা নতুন পরিচয় হয়। এই নতুন জীবনের পেছনে সবথেকে বড়ো অবদান হচ্ছে‚ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর৷ দুনিয়ার নজরে ভূমিকে স্মার্ট আর শিক্ষিত করতে তারা উঠে পড়ে লাগেন। বিশেষ করে‚ সুদর্শিনী! টানা সাত মাসের কষ্টের ফসল হচ্ছে ভূমি থেকে মৃত্তিকা হবার গল্পটা৷ মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী‚ তনুজা‚ সুদর্শিনী আর অর্ণব এটা উপলব্ধি করেছে যে‚ ‘জীবন যে নাটকের থেকেও নাটকীয়’ আর তার প্রমাণ তো ভূমি রয়েছেই৷ ভূমি তার লঙ্ঘিত অতীতের প্রত্যেকটা কথা উনাদের জানিয়েছে৷”

বর্তমান…

মৃত্তিকার এসব কথা শুনে অর্পণ বলে উঠল‚ “ওই মেহরাব শিকদারের ধ্বংস না দেখা অবধি আমার শান্তি হবে না। তুই আমাকে এ কোন যাঁতাকলে ফেললি বোন? টানা একবছর সব দেখেও না দেখার ভান করে আছি। একদিকে নিজের ভাইকে প্রতিনিয়ত গুমরে গুমরে নিঃশেষ হতে দেখছি আর অন্যদিকে সমস্ত সত্যিটা জানার পরও ওই অপরাধীকে চোখের সামনে দিব্যি ঘোরাফেরা করতে দেখছি। অথচ চেয়েও আমি সবাইকে সত্যিটা বলতে পারছি না৷ তোর কাছে দেওয়া ওয়াদাটা তুই তুলে নে বোন।”

“তুমি আর চিন্তা কোরো না ভাইয়া৷ এবার তো আমি এসে পড়েছি। আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি তাদের সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব।”

মৃত্তিকার কাছ থেকে বারবার একই উত্তর পেয়ে হতাশ অর্পণ। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে মৃত্তিকাকে বলল„ “তুই ভাইকে ভুল বুঝিস না।”

“ঠিকই ভাবছি আমি। উনার কাছে আমি আর ফিরে যেতে চাই না।”

আবারও হতাশ অর্পণ। জোর করে কিছুই যে হবে না তা সে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে। মৃত্তিকা আবারও বলল‚

“উনার কাছে আমি শুধুমাত্র ভালোবাসা আর বিশ্বাস চেয়েছিলাম৷ কিন্তু সে আমাকে এক আকাশসম অপূর্ণতা উপহার দিয়েছে৷ আসোল কথা হচ্ছে— যে যা চায় তা সচরাচর পায় না অথচ না চাইতেই মানুষ অনেক কিছু পেয়ে যায়। উনার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কোনো অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই ভাইয়া।”

মৃত্তিকার এহেন কথার পরিপ্রেক্ষিতে অর্পণ বলল‚ “একটা কথা ভুলে যাস না— ঘৃণা তাকেই করা যায়‚ যাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসা যায়।”

অতি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মৃত্তিকা বলল‚ “এসব বানোয়াট কথাবার্তায় আমি বিশ্বাসী নই।”

“তোকে এই কথাটা মানতেই হবে। ভালোবাসার বিপরীতরূপ হচ্ছে ঘৃণা৷”

ভালোবাসার কথা উঠতেই মৃত্তিকার পালাই পালাই শুরু হয়ে গিয়েছে৷ প্রলয়ের ব্যাপারে কোনো কথাই বলতে চাইছে না সে। কথাটা কাটাতেই মূলত এমন করছে৷ তাই অর্পণের শেষ কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে মৃত্তিকা বলল‚ “বেলা গড়াচ্ছে। আমাকে ফিরতে হবে৷”

চলে যাওয়ার কথা শুনে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “এখন কোথায় যাবি?”

“যারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। যাদের বদৌলতে আমি এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর মেয়ের পরিচয় পেয়েছি। মামনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন৷”

নিজের ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে মৃত্তিকা দাঁড়াল৷ তার সঙ্গে সঙ্গে অর্পণও দাঁড়াল৷ সেও এখন বাড়ি ফিরে যাবে। যাওয়ার আগে অর্পণের হাত ধরে মৃত্তিকা বলল‚

“আমি মৃত্তিকা হয়েই বাঁচতে চাই৷ তুমি প্লিজ এই রিপোর্টটাকে পাল্টে দিয়ো। আশাকরি তুমি আমার এই কথাটা রাখবে৷”

“তুই চিন্তা করিস না— আমি রিপোর্ট পাল্টে দেব।”

“আসছি ভাইয়া।”

“আমি পৌঁছে দিই?”

“আমি যেতে পারব।”

“কোনো কথা শুনছি না আমি। তুই একটু অপেক্ষা কর— আমি বাইক নিয়ে আসছি।”

মৃত্তিকা আর কিছুই বলল না৷ জানে‚ অর্পণ তার বারণ শুনবে না৷ সেই আম গাছটার নিচেই দাঁড়িয়ে রইল মৃত্তিকা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্পণ তার বাইক নিয়ে আম গাছটার নিচে চলে এলো৷ এরপর হেলমেট এগিয়ে দিতেই হাসি মুখে মৃত্তিকা সেটা পড়ে বাইকে চড়ে বসল৷ অর্পণ তার বোনকে আগে বাড়ি পৌঁছে দেবে তারপর সে রিপোর্ট পরিবর্তন করার কাজে লেগে পড়বে। এতে করে হয়তো তার ভাই কষ্ট পাবে কিন্তু কিছুই করার নেই। একদিন হয়তো ওদের দুজনের মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই নিয়ে মৃত্তিকাকে কোনো জোর জবরদস্তি সে করবে না। তার বোন যেদিন মনে করবে যে‚ প্রলয়ের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত সেদিনই যাবে। আর সেদিনের প্রহর গুনছে অর্পণ। কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দিল সে। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে৷ মিনিট দশেকের মাঝেই হয়তো সন্ধ্যা নেমে আসবে। আমগাছের ফাঁকফোকর থেকে হেলে পড়া প্রকাণ্ড সূর্যটা একটু একটু দেখা যাচ্ছে৷ বাইক চলছে তার আপন গতিতে। সূর্যের কমলাটে আলো আছড়ে পড়ছে দুজনের মুখের বাঁ পাশটায়। বাইক চলার গতিবেগ অনুযায়ী সাঁই বেগে বাতাস বইছে৷ বেশ ভালোই লাগছে মৃত্তিকার। সমস্ত ক্লান্তি যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গিয়েছে।

অবসাদগ্রস্ত আঁধারিয়া বাহ্যজগতে৷ বাতাবরণে নেমেছে নিস্তব্ধতা। বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দূরাকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রলয়। শ্যাম পুরুষের গম্ভীর মুখপানে আজ চিন্তার ভাজ৷ সে মূলত অর্পণের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছে৷ সেই যে সকালে বের হয়েছিল এখানো আসার নামগন্ধ নেই৷ আজই তো ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসার কথা৷ সে অসুস্থ বিধায় বাড়ি থেকে বের হবার অনুমতি নেই তার। মাধুরীকে বলেও কোনো লাভ হবে না৷ তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটুট। তাই অর্পণকে বলেছিল ল্যাব থেকে রিপোর্টটা নিয়ে আসতে। এখন দেখা যাচ্ছে‚ সে-ই তো কষ্ট করে নিয়ে আসতে পারত। ধৈর্যহারা হয়ে প্রলয় একটা সিগারেট ধরাল। আজ এর প্রয়োজন খুব করে। একটা সময় এই জিনিসটাকে জীবন থেকে বিতারিত করেছিল৷ ভূমি সিগারেটে ধোঁয়া সহ্য করতে পারত না। মেয়েটার নাকি নিশ্বাস নিতে কষ্ট হত। ভূমি তার জীবন থেকে চলে গিয়েছে কিন্তু ভূমির অপছন্দের এই জিনিসটা আজও তার জীবনে ছায়ার মতো পড়ে রয়েছে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। জীবনে এই দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। তার আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা‚

“যেদিন ভূমি তার জীবন থেকে চলে গিয়েছিল। তার একটা ভুলের জন্যই সবকিছু এলোমেলো হয়েছে। সেদিন রাতে ভূমিকে অনেক জায়গায় খুঁজেছে কিন্তু কোথায় পায়নি! সারারাত‚ পরের দিন পর্যন্ত ভূমিকে খুঁজে বেরিয়েছে। এরপর একদিন হঠাৎ খবর এলো‚ মাঠের এক কোণে একটা মেয়ের লা’শ পাওয়া গিয়েছে৷ পুলিশ তদন্ত করে বুঝতে পারে‚ সেটা নাকি ভূমির লা’শ৷ পুলিশের পাওয়া লা’শটার মুখ স্পষ্ট ছিল না। সবাই সেটাকেই ভূমির লা’শ ধরে নিয়েছিল। তবে একথা মানতে নারাজ প্রলয় এবং অর্পণ। তাদের ধারণা এটা কিছুতেই ভূমি হতে পারে না। তারপর একদিন প্রলয় তার নিজের ঘরে কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে বিছানার পাশের টেবিলের একেবারে নিচের ড্রয়ারে জন্ম নিরোধক টেবলেটের প্যাকেটটা পায়। পুরো চারটে পাতাই ভরতি ছিল৷ তার মানে ভূমি এই ঔষধ গুলো কখনোই খায়নি। দিনকে দিন মিথ্যে বলে গেল। সেদিন কিছু বলতে নিচ্ছিল মেয়েটা। কিন্তু তার কথাগুলো অপূর্ণই রয়ে গেল৷ বাচ্চাটা তারই ছিল আর সে কি-না ভূমিকে অবিশ্বাস করার মতো জঘন্য ভুল করেছে৷ একমাত্র তার ভুলের জন্য একটা নিষ্পাপ প্রাণ অবহেলিত হয়েছে৷ বাচ্চাটা আদতে বেঁচে আছে কি-না জানা নেই তার৷ যেখানে সে ভূমিকেই খুঁজে পাচ্ছে না। এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সে কীভাবে করবে তার জানা নেই? নিজের কাছেই সে আজ একজন নিকৃষ্ট জীব। এইসমস্ত ভেবেই নিজেকে গম্ভীর কঠোর প্রমাণ করা শ্যাম পুরুষও সেদিন ভেঙে গুড়িয়ে পড়েছিল৷ নিজেকে সে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। সেই ভুলের শাস্তিস্বরূপ হয়তো আল্লাহ তায়ালা তাকে একাকীত্ব আর বিষণ্ণতা উপহার দিয়েছেন।”

সবকিছু মনে পড়তেই প্রলয়ের অক্ষিকোটর হতে তরল অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নিল সে। তার চোখের পানি সে কাউকেই দেখাতে চায় না৷ পুরো দুনিয়ার কাছে সে একজন গম্ভীর এবং দাম্ভিক মানুষ হয়ে বাঁচতে চায়। এরই মাঝে অর্পণ চলে এসেছে। বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে অর্পণের বাইকটা লক্ষ্য করেছে প্রলয়৷ হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা নিচে ফেলে দিয়ে‚ দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল৷ বাড়ি ফিরে অর্পণ অবশ্যই তার ঘরে আগে প্রবেশ করবে। প্রলয় একবার ঘড়ির দিকে তাকাল৷ রাত নয়টা বাজতে চলল৷ এমনিতে তো অর্পণ হসপিটাল থেকে সন্ধ্যের পরপরই বেরিয়ে পড়ে। তবে আজ কেন দেরি হলো তার জানা নেই। মিনিট দুয়েকের মাঝে‚ অর্পণ প্রথমেই তার ঘরে এসেছে৷ তার ভাবনাই সঠিক হলো। তাকে এভাবে দেরি করে বাড়ি ফিরতে দেখে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“এত দেরি কেন হলো তোর?”

প্রলয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অর্পণ বলল‚ “হসপিটালে একটু ব্যস্ত ছিলাম ভাই। তাই রিপোর্ট আনতে দেরি হয়ে গিয়েছে।”

অর্পণ ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথা বলল। ভুল রিপোর্ট দেখে তার ভাইয়ের রিয়েকশন কী হতে পারে তা সে বেশ ভালোই জানে। তবে ব্যাপারটাকে তো ধামাচাপা দিতেই হবে৷ ভূমি যেহেতু চাইছে তারমানে তার অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। অর্পণ তার হাতে থাকা রিপোর্টটা প্রলয়ের হাতে দিয়ে নিজে থেকেই বলল‚

“ডিএনএ ম্যাচ করছে না ভাই৷”

প্রলয় ভাবল হয়তো অর্পণ তার সঙ্গে মশকরা করছে। তাই সে শশব্যস্তভাবে রিপোর্ট পড়ল৷ সেখান স্পষ্ট করে লেখা “নেগেটিভ” লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। স্বচক্ষে রিপোর্ট দেখে প্রলয়ের নিটোল পা দুটো টলে উঠল৷ এই একটাই আশা ছিল তার। আজ রিপোর্টটাকেও তার ভুল মনে হচ্ছে৷ তাই সে বলল‚

“এটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না৷ আমি অন্য কোনো ল্যাবে গিয়ে আবারও টেস্ট করাব।

“একটা কথা কেন ভুলে যাচ্ছ ভাই— পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন মানুষ রয়েছে৷”

“তার জন্য কী সব একই চেহারা কী বাংলাদেশেই বসবাস করছে? আমার কী মনে হয় জানিস? কিছু একটা গন্ডগোল অবশ্যই আছে৷ তা না হলে মৃত্তিকার কাছে গেলে কেন আমি ভূমিকে অনুভব করি?”

“দুজনের চেহারায় মিল আছে তাই হয়তো তোমার এমন মনে হচ্ছে৷”

“এতটা মিল আদতে হয়?”

”এতটা মিল কোথায়? তুমিই তো বললে— ভূমির সঙ্গে নাকি ওই মেয়ের আকাশ পালাত তফাৎ!”

“তা অবশ্য ঠিক৷ ভূমি যদি জল হয়‚ ওই মেয়ে নির্ঘাত পাবক শিখা। এক কথায় বলতে গেলে ধানিলংকা।”

প্রলয়ের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল অর্পণ। একমাত্র সে-ই জানে তার বোন কতটা বদলে নিয়েছে নিজেকে! ভূমির পরিবর্তন সে আজ লক্ষ্য করেছে। একদিকে যেমন প্রলয়ের জন্য তার খারাপ লাগছে‚ অন্যদিকে প্রলয়কে বোকা বানাতে পেরে হাসিও পাচ্ছে তার। এদিকে তার এই হাসির কারণ ধরতে পারল না প্রলয়। হুট করে হাসারই বা কী হলো? সে কী কোনো হাসির কথা বলেছে? চোখ ছোটো ছোটো করে অর্পণের দিকে তাকিয়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“হাসির কী বললাম আমি?”

ডান হাত দ্বারা মুখ বন্ধ করে অর্পণ বলল‚ “কই আমি তো তোমার কথায় হাসছি না! আমার একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাই হাসছিলাম৷ আচ্ছা শোন ভাই— আমার খুব ক্লান্ত লাগছে আমি ঘরে গেলাম।”

সায় জানাল প্রলয়। মুখে বলল‚ “হুম আয়!”

অর্পণ চলে যেতেই ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে সজোরে আঘাত করল প্রলয়৷ একবার নয়— বেশ কয়েকবার। মুহূর্তেই হাতের পিঠ র’ক্ত রঞ্জিত বর্ণ ধারণ করেছে৷ জ্বলছে ভীষণ। প্রলয় ভেতরে ভেতরে গুমরে ম’রছে। অপরাধবোধ তাকে শেষ করে দিচ্ছে। কেন সেদিন ভূমিকে ভুল বুঝেছিল সে? কেন বাবা হবার মতো সুন্দর‚ মিষ্টি গভীর অনুভূতি থেকে নিজেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছিল? এই নিয়ে সে মাধুরী বা মেহরাব শিকদারকে মোটেও দোষী করবে না। কারণ যে কেউ তাকে যা বোঝাবে‚ সেটাই তাকে কেন মেনে নিতে হবে? ভুল তো সম্পূর্ণ তার৷ নিজের ভালোবাসার উপর সে অবিশ্বাস করেছে৷ একমুহূর্তের জন্য হলেও ভরসা হারিয়েছে৷ সেই দোষেই তো সে ভূমিকে হারিয়েছে৷ সেই সঙ্গে হারিয়েছে নিজের অনাগত সন্তানকেও। মেঝেতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল প্রলয়৷ গলা ভেঙে আসছে। পুরুষ মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর রহস্যময় জীব। তাদের বুক ফাঁটে কিন্তু কারো সামনে চোখ ফেঁটে দু ফোঁটা জল গড়ায় না৷ তাদের কান্নাগুলো হয়তো গলাতেই আটকে যায়। মেয়েদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে পারে না। কিন্তু কষ্ট তাদেরও হয়। আড়ালে তারাও কাঁদে। প্রলয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটা হয়েছে৷ আড়ালে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। আর একা একাই কিছু কথা আওড়াচ্ছে৷

“পরিপূর্ণতাকে দূরে ঠেলে আমি অপূর্ণতাকে নিজেই আপন করে নিয়েছি। এর শাস্তি হয়তো আমাকে সারাজীবন ভর পেয়ে যেতে হবে৷”

বাহির থেকে কারো পায়ের শব্দ আসছে৷ প্রলয় দ্রুত উঠে দাঁড়াল। রিপোর্টটাকে তোশকের নিচে লুকিয়ে রাখল৷ এই রিপোর্ট কারো সামনে পড়তে দেওয়া যাবে না৷ এরই মাঝে কথা বলতে বলতেই তৃপ্তি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল‚

“আন্টি আপনাকে খেতে ডাকছেন৷”

তৃপ্তির এভাবে হুট করে চলে আসায় ভীষণ রাগ হলো প্রলয়ের৷ বেশ কয়েকবার এই মেয়েকে সে নিজের ঘরে আসতে বারণ করেছে৷ কিন্তু বেহায়া মেয়ে বারবার চলেই আসে। নিজের ওপর থাকা চাপা রাগটা এবার তৃপ্তির উপর চড়াও হলো৷ নিজের রাগ প্রকাশ করবে না করবে না বলেও প্রকাশ করেই ফেলল৷ প্রলয় চেঁচিয়ে বলল‚

“আপনাকে আমি ঠিক কতবার বলব যে‚ সময় অসময়ে কখনো আমার ঘরে আপনি আসবেন না।”

তৃপ্তি বুঝতে পারল প্রলয় এই মুহূর্তে মারাত্মক রেগে রয়েছে৷ তার সে আমতা আমতা করে বলল‚ “এভাবে হুট করে চলে আসায় আমি সত্যিই দুঃখিত। আন্টি আমাকে জোর করে পাঠালেন আপনাকে ডাকার জন্য।”

এবার প্রলয়ের হাতের দিকে খেয়াল করল তৃপ্তি। ঝরঝরে করে র’ক্ত ঝরছে। সে ব্যস্ত হয়ে প্রলয়ের হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করল‚

“এ কী আপনার হাত থেকে তো রক্ত ঝরছে। এটা কী করে হলো?”

প্রলয় এক ঝাড়া নিয়ে তৃপ্তির হাতটা সরিয়ে নেয়৷ এই মেয়েটার ঠিক কী উদ্দেশ্য রয়েছে সেটা তার জানা নেই৷ আর না সে জানতে চায়৷ তবে এসব মেয়েকে সে তার ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না৷ এবার কিছুটা গম্ভীর আর কঠিন স্বরে প্রলয় বলল‚

“ও কিছু না। আপনি এখন আসতে পারেন। আমার সময় হলে আমি নিশ্চয়ই খেতে যাব। এই কথাটা আপনার আন্টিকে খুব ভালো করে বলে দেবেন। আর হ্যাঁ আপনার আন্টি যতই বলুক আমার ঘরের সামনে ঘুরঘুর করার কথা। আপনাকে যেন পরবর্তীতে আমার ঘরে আর না দেখি।”

প্রলয়ের কাছ থেকে এমন অপমানজনক কথা শুনে তৃপ্তির মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছে। বেচারি বোধহয় যেকোনো সময় কেঁদে দিতে পারে। প্রলয় মোটেও গুরুত্ব দিল না৷ গম্ভীর স্বরে শুধু বলল‚

“আপনি এখন আসতে পারেন।”

তৃপ্তি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। অপমানে জর্জরিত হয়ে তার ভীষণই কান্না পাচ্ছে। এর আগে এমন ভাবে তার সাথে কেউ কথা বলেনি। সে তো সেধে সেধে প্রলয়ের ঘরে যেতে চায়নি। শুধুমাত্র মাধুরীর কথায় সবটা হলো। উনি তো কথা শুনলেনই না‚ উল্টো সবস্ত কটু কথা এসে জমা হলো তার উপর৷ না জানি তাকে নিয়ে প্রলয় কী না কী ভাবছে৷ তৃপ্তি চলে যেতেই প্রলয় একটা তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। হাতমুখ ধুয়ে এরপর নিচে যাবে৷ হাতটা জ্বালা করছে তার। তবে মনের জ্বালা থেকে এ জ্বালা নেহাতই কম।

চলবে?…..


#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবার খেয়ে অর্পণ নিজের ঘরে এসেছে৷ খাবার টেবিলে প্রলয়কে খুবই চুপচাপ মনে হলো৷ অন্যদিনের তুলনায় আরও বেশি গম্ভীর মনে হয়েছে। অর্পণ বুঝেছে ভূমিকে নিয়ে তার ভাইয়ের যত ভাবনা। এখন আপাতত ভাইকে সময় দেবে৷ খুব বেশি ভাইয়ের পেছন পেছন ঘুরঘুর করা যাবে না৷ এদিকে সেও তো শুধুমাত্র ভূমিকে নিয়েই ভাবছে৷ মাথায় তার অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করে ভূমি আর প্রলয়কে আবারও কাছাকাছি নিয়ে আসবে সেটাই পরিকল্পনা করছে। এমনিতে যে তার বোন এ বাড়িতে আর ফিরবে না তা সে বেশ বুঝেছে৷ অভিমানের পাহাড় খুব বেশি উঁচু কি-না! হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। নারী প্রচণ্ড অবহেলা আর অবিশ্বাসে নিজেকে পালটে ফেলে। অর্পণের মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ তা হলো‚ সে তার বোনকে আবেগের জালে জড়িয়ে এ বাড়িতে পুনরায় ফেরার জন্য রাজি করাবে। কীভাবে কী করতে হবে সেসব কিছু ভাবা হয়ে গিয়েছে তার৷ অর্পণের ভাবনার মাঝেই ইরার নাম্বার থেকে ভিডিও কল এলো। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ করল সে। স্ক্রিনে ইরার মুখটা দেখে ক্ষীণ হাসল অর্পণ। তাকে এভাবে হাসতে দেখে ইরা জিজ্ঞেস করল‚

“হাসলে কেন? আমাকে কী ফানি দেখাচ্ছে?”

“আমি কি সে জন্য হাসলাম?”

চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে ইরা বলল‚ “তাহলে?”

“তোমাকে সুন্দর লাগছে ইরাবতী। আচ্ছা তোমার কী মনে হয় না— আমাদের দ্রুত বিয়ে করে নেওয়া উচিত?”

হুট করে বিয়ের কথা শুনে সহসাই অবাক হলো ইরা। তারা তো বিয়ের প্ল্যান আরও দুবছর পর করেছিল৷ অর্পণ এখনই কেন বিয়ের কথা বলছে? বুঝতে পারল না সে৷ ইরা জিজ্ঞেস করল‚

“তা মশাই হুট করে বিয়ের ভূত মাথায় চাপল কেন?”

“পুরো এক বছর তো প্রেম করলাম। এবার ইরাবতীকে প্রেমিকা রূপে নয় বউ রূপে দেখতে চাই। তো এখন তোমার সিদ্ধান্ত বল! তাহলে আমি মাকে আজই জানিয়ে দেব।”

“তোমার মতো তো আমি নির্লজ্জ না। নিজের বিয়ের কথা আমি কী করে তাদের বলব?”

“তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না৷ যা ব্যবস্থা করার আমিই করব৷”

“হঠাৎ বিয়ে করার কথা তুললে কিছু কী হয়েছে? ভাই এনি চান্স— বাড়ি থেকে কী তোমার জন্য মেয়ে খুঁজছে?”

ইতিমধ্যেই ইরাকে এতদূর ভেবে ফেলতে দেখে এবার সশব্দে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল অর্পণ। যেন ইরা কোনো জোকস শুনিয়েছে। তাকে এভাবে হাসতে দেখে ইরা গাল ফুলিয়ে বলল‚

“আমাকে ছাড়া যদি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করার ভাবনা মাথায়ও এনেছ তাহলে তোমার কী অবস্থা হবে— সেটা তুমি ভাবতেও পারছ না!”

“তুমিও চাইলে আমার জন্য মেয়ে খুঁজে দিতে পারো। বয়স হচ্ছে তো। বিয়েথা করে বাচ্চা সামলাতে হবে না? এরপর বুড়ো হয়ে গেলে কেউই বিয়ে করবে না।”

“আমার সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে? বদ লোক একটা৷”

আবারও হেসে উঠল অর্পণ। সঙ্গে সঙ্গে বলল‚ “চোখের সামনে একটা বাচ্চাকে দেখছি। একেই তো আমাকে সারাজীবন চোখে চোখে রাখতে হবে। আমার কী আর অন্যদিকে তাকানোর সময় আছে?”

ইরা আর কিছুই বলল না৷ অর্পণের সঙ্গে কথা বলবে না সে৷ লোকটা কারণে অকারণে তাকে শুধু ক্ষেপায়৷ এরপর দুজনের মাঝে নেমে এলো এক অবাক নীরবতা৷ অর্পণ গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবছে। এদিকে নীরবতা সহ্য হচ্ছে না ইরা৷ তাই সে নীরবতা কা’টাতে নিজে থেকেই বলল‚

“কী ভাবছ?”

“তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছি।”

“কী কথা?”

“এ কথাটা কিন্তু পাঁচ কান হওয়া যাবে না।”

“এই বুঝি তুমি আমাকে ভরসা কর?”

“তেমনটা না রে পাগলি৷ ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত।”

“আচ্ছা বল— এ কথা আর কেউই জানতে পারবে না।”

“ভূমি বেঁচে আছে।”

অর্পণের কাছ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠল‚ “কীইইইইইই?”

নিজের ঠোঁটে তর্জনী ছুঁয়ে অর্পণ বলল‚ “আস্তে চেঁচাও। যা শুনেছ সেটাই বলেছি আমি।”

“ভূমিকে তুমি কোথায় পেলে?”

অর্পণ পরপর সব কথা খুলে বলল। শুধু মেহরাব শিকদার আর ভূমির মাঝে সম্পর্কের কথাটা এড়িয়ে গেল। সত্যিটা তো একদিন সবার সামনে আসবেই। সেদিনই না-হয় সবাই সব সত্যি জানবে। তার আগে কিছু কথা সকলেরই অজানা থাকুক৷ অর্পণ আবারও বলল‚

“ওহ হ্যাঁ আরেকটা কথা!”

“কী?”

“ভূমি কনে পক্ষ থাকবে। তোমার বন্ধু হিসেবে।”

“কেন?”

“তোমাকে তো বললাম— ভূমি ভাইয়ের জীবনে আর ফিরতে চায় না৷ আর আমি চাই ওরা দুজন আবারও এক হোক৷ তারজন্য আমাদেরই কিছু করা উচিত।”

“তোমার কী মনে হয় আমাদের পরিকল্পনা কাজে দেবে?”

“অবশ্যই দেবে৷ তবে কোনো তাড়াহুড়ো নয়৷”

এরপর দুজনে আরও অনেক কথাই বলতে শুরু করল৷ নিজের পরিকল্পনা একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করতে শুরু করল৷

অন্যদিকে…

নীলচে ঘুম বাতির আবছা আলোয় প্রলয়ের ভাবভঙ্গি টের পাওয়া যাচ্ছে না৷ তবে এটা বুঝা যাচ্ছে যে‚ সে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। বারবার এপাশ অপাশ করেও ঘুম আসছে না তার৷ এমনটা তার সঙ্গে প্রতিদিনই হয়। ভূমি তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থেকে গিয়েছে৷ আর তাদের অনাগত বাচ্চাটা হয়তো এতদিনে কিছুটা বড়ো হয়েছে৷ ভূমি আর তাদের সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় প্রতিনিয়ত দিন গুনছে প্রলয়৷ আদতে মৃত্তিকাই ভূমি কি-না তার জানা নেই। মৃত্তিকাই যদি ভূমি হয়ে থাকে তাহলে তার অভিমানের পাহাড় ভাঙানোর জন্য অনেক কাঠখড় পোহাতে হবে৷ নিজের সন্তানকে অস্বীকার করার মতো মস্ত বড়ো ভুল সে করেছে। সে-ও চায় ভূমি আর তাদের সন্তান দুজনেই তার জীবনে ফিরে আসুক। যতদিন না ভূমি তাকে ক্ষমা করবে‚ তার জীবনের পুনরায় ফিরে আসবে ততদিন ধরেই সে প্রায়শ্চিত্ত করে যাবে। এটাই তার প্রাপ্য। প্রলয় বালিশ আঁকড়ে ধরে বলতে শুরু করল‚

“তুমি যেমন এক আকাশসম অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছ। ঠিক তেমনই ভাবে আমার জীবনে রয়ে গিয়েছে এক আকাশসম বিষণ্ণতা। স্ত্রী‚ সন্তান আর ছোট্টো পরিবার থাকা সত্বেও আমি শূন্য। অপূর্ণ হয়ে থেকে গিয়েছি আমি। অপেক্ষার প্রহর যে আমাকে বড্ড তড়পাচ্ছে৷ ক্রমশ আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। তোমাদেরকে কী আমি কোনোদিনও ফিরে পাব না ভূমি কন্যা?”

এই বলে বালিশে আবারও মুখ গুজল। মনে হলো যেন ভূমিকেও জড়িয়ে ধরেছে সে। কপালের ক্ষ’ত কিছুটা শুকিয়েছে৷ তবে চিনচিনে ব্যথাটা এখনো রয়েছে। প্রলয় আবারও মুখ তুলল৷ বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে গ্যালারি থেকে ভূমির ছবিগুলো দেখতে শুরু করল। এই ছবিগুলো দেখেই তার রাত কে’টে সকাল হয়৷

বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষে ঘোর অমা। কোথাও কোনো আলোর দিশা নেই৷ ল্যাম্পপোস্টের বাতি গুলোতে ঝিঁঝি পোকার ঝাঁক বসেছে৷ অবসাদগ্রস্ত রাতটা মৃত্তিকার পাথর হৃদয়কে আরও বিচলিত করে তুলছে৷ বারান্দায় আলোয় বসে উপন্যাসের বই পড়ছে সে৷ আজ প্রলয়কে খুব করে মনে পড়ছে৷ ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় তা ঘুনাক্ষরেও আগে থেকে উপলব্ধি করা যায় না! যদি আগে থেকে উপলব্ধি করা যেত তাহলে হয়তো মানুষের জীবন আড়ালে আবডালে এলোমেলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে থাকত না৷ কোথাও কোনো বিচ্ছেদ থাকত না৷ বিষাদ নীল ব্যথায় প্রতি মুহূর্তে কাউকে ডুকরে ম’রতে হত না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃত্তিকা৷ ঘুম আসছিল না তার৷ তনুজা হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুদর্শিনীও হয়তো ঘুমচ্ছে৷ তখন দেখে এসেছিল অর্ণবের সঙ্গে কথা বলছিল৷ এদিকে ভূমিকে ঘরে দেখতে না পেয়ে সুদর্শিনী বারান্দায় চলে এসেছে৷ তার ভাবনাই সঠিক৷ মৃত্তিকা বারান্দাতেই ছিল৷ সে জিজ্ঞেস করল‚

“কী করছিস?”

“বই পড়ছিলাম। ঘুম আসছিল না।”

“আয় আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম চলে আসবে।”

“জানিস দিদিভাই— আমার এখন আর এই শহরটা ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই।”

“তুই আবারও পুরোনো কথা ভাবছিস? তোকে কতবার বলেছি না‚ ওসব কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিবি না। মেসো মশাই চলে যাওয়ার পর মাসিমণি তোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।”

ভাঙা গলায় মৃত্তিকা বলল‚ “পুরুষ যে নারীকে খুব সহজেই পেয়ে যায় তাকে মূল্যায়ন কম করে।”

“আবার সেই মানুষটার কথাই ভাবছিস? ভুলে গেলি— সেই মানুষটা তোকে অবিশ্বাস করে একা ছেড়ে দিয়েছিল?”

সুদর্শিনী এটুকু বলতেই মৃত্তিকা ফুঁপিয়ে উঠল। সুদর্শিনী শুধাল‚ “অ্যাই তুই কী কান্না করছিস? আমার দিকে তাকা তো!”

মৃত্তিকা তাকাল না। অশ্রুসিক্ত চোখে কী করে তাকাবে সুদর্শিনীর দিকে! তবুও মেয়েটা তার ভাঙা গলার স্বরেই বুঝে গেল। সুদর্শিনী আবারও বলল‚

“তাকাবি না আমার দিকে?”

“দিদিভাই আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও৷ কতদিন শান্তিতে ঘুমতে পারি না!”

সুদর্শিনী বুঝল মৃত্তিকা নিজেকে আড়াল করতে চাইছে৷ তাই সে খুব একটা ঘাটল না। ইচ্ছে হলে নিজেকে থেকে মনের দুঃখ গুলোকে শেয়ার করবে৷ মৃত্তিকার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল সুদর্শিনী। সে বিছানায় গিয়ে বসতেই তার পেছন পেছন মৃত্তিকাও চলল৷ বালিশে হেলান দিয়ে সুদর্শিনীকে জাপ্টে ধরল। অবসাদগ্রস্ত চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে মৃত্তিকা৷ সুদর্শিনী তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে চুলও টেনে দিচ্ছে৷ আরাম লাগছে কিছুটা৷ নিমিষেই যেন চোখের পাতায় গহীন নিদ এসে হানা দিচ্ছে৷

বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষে সূর্যের কমলাটে আলো নবোদিত। ভোরের আঁধার কাটিয়ে মেদিনী আলোকিত হচ্ছে৷ সোনালি রোদ উঁকি দিচ্ছে জানালার দুয়ার ভেদ করে পর্দার ফাঁকফোকর হতে। রোদ এসে আছড়ে পড়ছে প্রলয়ের পিঠে। রোদ দীর্ঘ সময় একই স্থানে আছড়ে পড়ায় প্রলয়ের পিঠে কিছুটা গরম লাগতে শুরু করেছে। পিঠ ঘেমে গিয়েছে। তারউপর বাতাসের ঝাপ্টায় ঘামে ভেজা পিঠে শীতলতার অস্তিত্ব। ঘুমের ঘোরে প্রলয়ের মনে হচ্ছে ভূমি তার পিঠে ভেজা চুল দিয়ে আঁকিবুঁকি চালাচ্ছে। ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে প্রলয় বলল‚

“আহ্ ভূমি কন্যা— বিরক্ত কোরো না৷ ঘুমতে দাও প্লিজ।”

পরক্ষণেই ঘুম ভেঙে গেল প্রলয়ের৷ যখনই মনে পড়ল ভূমি তো তার কাছেই নেই— বিরক্ত করবে কোত্থেকে? ঘুমু ঘুমু ফুরফুরে মনটা তখন নিমিষেই বিষাদের কৃষ্ণাভ মেঘমালায় ঢেকে গেল৷ আস্তে করে উঠে বসল প্রলয়। গা থেকে টিশার্ট খুলে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে জানালার কাছে গেল। হুট করে পর্দাগুলোকে সরিয়ে দিতেই সকালের মৃদুমন্দ শীতল সমীরণ এসে তার গা ভাসিয়ে দিল৷ ভালোই লাগছে ভীষণ। এরপর একটা আলমারি থেকে নিজের জামাকাপড় বের করে বিছানার উপর রাখল প্রলয়৷ আজ বের হবে। ঘরে বসে থেকে আর ভালো লাগছে না তার৷ বাহির থেকে ঘুরে এলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে। আজ থেকেই নিজের কাজে লেগে পড়বে সে৷ একটা তোয়ালে বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল প্রলয়৷ একটা লম্বা গোসল দিয়ে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি আর ভারাক্রান্ত দূর করবে।

অন্যদিকে…

বিছানায় আধশোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছে মেহরাব শিকদার। আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে গেল উনার৷ এমনিতে তো ফিরোজাই ডেকে দেন উনাকে। তবে আজ উনি নিজে থেকে উঠে গিয়েছেন৷ বারবার জানালার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছেন তিনি। মেহরাব শিকদার যখন কিছু নিয়ে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে ভাবনায় মত্ত তখনই ফিরোজা ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি খেয়াল করলেন‚ উনার স্বামী কিছু একটা চিন্তা করছেন। বিছানার চাদর গোছাতে নিয়ে তিনি বললেন‚

“সেই কখন থেকে দেখছি কিছু একটা ভেবে যাচ্ছ৷ কী এত ভাবছ শুনি?”

হুট করে ফিরোজার কণ্ঠস্বর শুনে ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। আজ সকাল সকাল মহুয়াকে স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। স্বপ্নেও যেন হুম’কি দিচ্ছিলেন। মেহরাব শিকদারের আগের মতো সেই তেজ নেই। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে। তারউপর ফিরোজার এভাবে চলে আসায় আরও ঘাবড়ালেন তিনি৷ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন‚

“কিছু বললে তুমি?”

“আচ্ছা আমাকে বল তো— কী হয়েছে তোমার? বেশি কিছুদিন ধরেই দেখছি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাক!”

কথা কাটাতে মেহরাব শিকদার বললেন‚ “ও তেমন কিছু না। কাজের খুব প্রেসার ইদানীং।”

“এত প্রেসার কেন নাও? তোমাকে কতদিন বলেছি কাজের এত প্রেসার নেবে না তুমি?”

“ও কিছু হবে না। তুমি আমাকে নিয়ে এত চিন্তা কোরো না।”

“আমি যেটা বলছি সেটাই শোনো। আজ হসপিটালে যেতে হবে না। বাড়িতে বিশ্রাম নেবে তুমি। তোমার শরীরটাও ভালো ঠেকছে না আমার৷”

নিজের প্রতি অর্ধাঙ্গিনীর এমন চিন্তা দেখে বরাবরের ন্যায় আপ্লূত মেহরাব শিকদার। ফিরোজাকে তিনি অন্তত বেশি ভালোবাসেন৷ তবে অতীত অর্থাৎ বিশ বছর আগের একটা ভুলের মাশুল আজও দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। উনার আজও মাথায় আসে না সেদিন ভূমিকে হত্যা কে করল? পুলিশ যখন লাশ আইডেন্টিফাই করে জানিয়েছিল সেটা ভূমিরই লা’শ তখন তিনি ভীষণই অবাক হয়েছিলেন৷ তবে এটা ভেবেও খুশি ছিলেন যে আপাতত উনার আর কোনো পথের কা’টা নেই৷ “কাঁটামুকুট” এর কথাটা কেউ-ই আর জানতে পারবে না৷ মাঝে মাঝে প্রলয়ের জন্য ভীষণই আফসোস হয় উনার। একমাত্র উনার জন্যই তো প্রিয় ভাতিজার আজ এই দশা! সেদিন যদি মিথ্যে কথা না বলতেন তাহলে হয়তো ঝোঁকের বশে এমন একটা কথা প্রলয় কখনোই বলত না। সে যথেষ্ট বিচারক্ষম একজন মানুষ। এটা মেহরাব শিকদার খুব করে মানেন৷ তিনি এও জানেন‚ সত্যিটা যদি কোনো ভাবে সবার সামনে আসে তবে প্রলয় উনাকে কখনোই ছাড়বে না। এর উচিত শাস্তি দিয়ে তবেই থামবে। এই সমস্ত ভাবনার মাঝে মেহরাব শিকদার যেন আলাদা এক দুনিয়ায় হারিয়ে গেলেন। ফিরোজার কোনো কথাই যেন উনার কর্ণগোচরে পৌঁছায়নি। একই ভঙ্গিতে বালিশে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন। ফিরোজা বলতে লাগলেন‚

“আবার কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?”

এবারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না মেহরাব শিকদারের কাছ থেকে৷ ফিরোজা এবার বিছানায় বসে স্বামীর হাত ঝাকিয়ে ডাকতে লাগলেন‚

“কী গো শুনছ? কোথায় হারিয়ে গেলে? দিনের বেলায় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছ নাকি?”

“শুনছি আমি।” এই বলে বিছানা ছাড়লেন মেহরাব শিকদার। ফিরোজা বিছানা গোছানার জন্য উদ্যত হলেন। ওয়ারড্রব থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতেই মেহরাব শিকদার স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন‚

“তুমি অহেতুক চিন্তা করছ আমার জন্য।”

“আমি অহেতুক চিন্তা করি? আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি আজকাল কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাক! আচ্ছা তোমার কী হয়েছে? আমার সঙ্গে অন্তত বল! তাহলে হয়তো নিজেকে কিছুটা হালকা লাগবে৷”

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। খুব ক্ষিধে পেয়েছে৷ তুমি আমার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা কর— আমি দু মিনিটে বের হচ্ছি।”

এই নিয়ে কোনো কথা বাড়াতে চান না মেহরাব শিকদার। কথাটা বলেই তিনি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লেন৷ পেছন থেকে প্রত্যুত্তরে ফিরোজার “আচ্ছা।” বলাটা শুধু শুনেছেন৷

মেহরাব শিকদার ওয়াশরুমে চলে গেলেন। এদিকে বিছানা আর ঘর ঝাড়ু দিয়ে ফিরোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সকালের নাস্তা আগেই বানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সাবিনা অন্য কাজগুলো করছিল। ডাইনিং টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয়ে গিয়েছে৷ বৈঠকখানায় ঝাড়ু দিচ্ছে সাবিনা। ফিরোজা বৈঠকখানার দিকে এসে দেখলেন মোর্শেদ শিকদার খেতে বসে পড়েছেন। আজ উনাকে একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। বাকিরা অর্থাৎ ছেলেমেয়ে গুলো এখনো পর্যন্ত নিচে আসেনি। এরই মাঝে অতিথিশালা হতে তৃপ্তি চলে এলো। তাকে দেখা মাত্রই মাধুরী দ্রুত পায়ে সেদিকটায় গেলেন৷ ফিরোজা দেখেও না দেখার ভান করে রইলেন৷ মাধুরীকে উনার আর কিছুই বলার নেই। নিঃশব্দে নিজের অন্য কাজ লেগে পড়লেন তিনি। এদিকে মাধুরী ফিসফিস করে তৃপ্তিকে শুধালেন‚

“উপরে গিয়ে ওদের সবাইকে একটু ডেকে নিয়ে এসো।”

মাধুরী যে এমন কোনো কাজ খুঁজে খুঁজে তাকেই দেবেন এটা যেন সে আগে থেকেই জানত। তাই গটগট করে তৃপ্তি জবাব দিল‚ “আপনি হয়তো একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন আন্টি।”

“কী বলতে চাইছ তুমি?”

“আমি এটাই বলতে চাইছি যে‚ আপনার ছেলে আমাকে পছন্দ করে না। তাই আমি উনাকে ডাকতে যেতে পারব না।”

তৃপ্তির এহেন কথায় চটে গেলেন মাধুরী। কিছুটা ধমকের স্বরে বললেন‚ “বড়োদের মুখে মুখে বুঝি এভাবেই তর্ক কর তুমি?”

সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা জবাব দিল তৃপ্তি‚ “আপনি যতই বলুন আমি উনার সামনে যেতে চাই না আন্টি। এতে যদি আপনি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন তাহলে তাই সই! কিন্তু আমি আপনার ছেলের ত্রিসীমানায় যেতে চাই না।”

এবার কিছুটা নরম স্বরে মাধুরী বললেন‚ “প্রলয়কে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তুমি এসেছ সবে দিন চারেক হলো। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ওর সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা কর। আর কতদিন আমার ছেলেটা এভাবে গুমরে গুমরে ম’রবে?”

“আই থিংক উনাকে একা ছেড়ে দেওয়া উচিত৷ এমন করতে থাকলে উনি আপনার থেকে আরও দূরে চলে যাবেন৷ আপনি তো মা! আপনার উচিত আপনার ছেলের মনের অবস্থাটা একটু বোঝা৷ আমি এসব কথা কোত্থেকে জেনেছি সেটা ম্যাটার করছে না। আসল কথা হচ্ছে— আপনার উচিত প্রকৃতপক্ষে আদর্শ মা হয়ে প্রলয়কে যথেষ্ট সময় দেওয়া৷ ”

মাধুরী ভাবলেন। গভীর ভাবে ভাবলেন। তৃপ্তির কথা কোনো অংশে ভুল নয়। শুরু থেকেই তিনি ভূমি আর প্রলয়কে আলাদা করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। কখনো এটা ভাবেননি যে ভূমিকে হারিয়ে প্রলয়ের মনে অবস্থাটা ঠিক কী? ছেলেটার মনের উপর থেকে ঠিক কী যাচ্ছে? কই আগে তো তিনি এমন ছিলেন না? মুখে কিছু বলার আগেই ছেলের মনের কথা বুঝে যেতেন তিনি৷ অথচ আজ ছেলের থেকে শত মাইল দূরত্ব বাড়ছে৷ মাধুরী আর কথা বাড়ালেন না। শুধু মুখে বললেন‚

“পূর্ণ পুষ্পকে ডেকে দিয়ো তো। ওদের কলেজে যাওয়ার সময় হয়েছে।”

“জি আন্টি।” এই বলে তৃপ্তি সিঁড়ি ভেঙে উপরতলায় যেতে শুরু করল৷ মাধুরীও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রলয়ের ব্যাপারে তিনি আর তৃপ্তিকে জোর করবেন না৷ উনার এটা বোঝা হয়ে গিয়েছে যে‚ জোর করে আর যা-ই হোক সম্পর্ক আর ভালোবাসা হয় না৷ এদিকে করিডরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তৃপ্তি। দোতলায় ডানপাশের ঘরটাই পূর্ণ পুষ্পর। আর বাঁ পাশের প্রথম ঘরটা অর্পণের আর দ্বিতীয় ঘরটা প্রলয়ের। আগের বারের ভুল এবার সে করবেন না। পূর্ণ পুষ্পকে ডাকতে ওদের ঘরের দিকে চলল তৃপ্তি৷ এতক্ষণে মেয়ে দুটো হয়তো ঘুম থেকে উঠেই পড়েছে।

সকাল সাড়ে দশটা…

সেই রোজকার রুটিন আজ থেকে আবারও শুরু। মৃত্তিকার নাচের ক্লাসে সিলেকশন হয়ে গিয়েছে৷ সে এখন একটা পারমানেন্ট জব পেয়ে গিয়েছে৷ অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল এই নাচের স্কুলেই সে জবটা করবে। তার সিলেকশন যে এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সেটা তার জানা ছিল না। দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা এই স্কুলে কাটাতে হবে৷ মনে মনে খুব খুশি মৃত্তিকা৷ তার ইচ্ছে যে পূরণ হয়েছে। টিফিন বক্সটা ব্যাগের ভেতর রেখে মৃত্তিকা বলল‚

“মামনি দুপুরের খাবার আর ঔষধ কিন্তু টাইম টু টাইম খেয়ে নেবে। আর ফোন সঙ্গে সঙ্গে রাখবে।”

নিজের প্রতি মৃত্তিকার এত খেয়াল আর চিন্তা দেখে তনুজা বললেন‚ “আগের জন্মে হয়তো তুই আমার মা ছিলিস। এত যত তো আমার জন্মদাত্রী মা-ও করেননি।”

“কী যে বল না তুমি! তবে তোমার জন্য আমার চিন্তা হয়।”

টিপ্পনী কে’টে সুদর্শিনী বলল‚ “বুঝলে মাসিমণি— তোমার মেয়ের হয়তো আমার প্রতি বিশ্বাস নেই৷

“মোটেও তেমন কিছু নয় দিদিভাই।”

“হাহা মজা করছিলাম তো পাগলি৷ তুই যা। আমি তো আছি মাসিমণিকে দেখার জন্য। বেস্ট অফ লাক৷”

“থ্যাংক ইউ দিদিভাই।” এই বলে সুদর্শিনীকে জড়িয়ে ধরল মৃত্তিকা৷ ওদের দুজনের মিল দেখে গাল এলিয়ে হাসলেন তনুজা৷ ওদের দুটোকে একসঙ্গে দেখলে মনে হয় যেন দু বোন। অথচ দুজনের ধর্ম আলাদা৷ তাতে কী দুজন মানুষের মাঝে মনের মিল তো রয়েছে! মেয়েটা যখন মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী অসুস্থ ক্ষ’তবিক্ষ’ত অবস্থায় পেয়েছিলেন তখনকার মৃত্তিকা আর এখকার মৃত্তিকার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। সদ্য নিজের অনাগত সন্তানকে হারিয়ে ফেলা ভিতু সহজ সরল মেয়েটা এখন রণরঙ্গিণী। যে কি-না যেকোনো পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়াতে পারে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে। সমাজ তাকে এখন আর অযোগ্য বলে আখ্যায়িত করে না। সে একজন অতি পারদর্শী নৃত্যশিল্পী। মৃত্তিকাকে মেয়ে হিসেবে পেয়ে খুবই গর্ববোধ হয় তনুজার। শুরু থেকেই মেয়েটা তাকে মামনি বলে আসছে। তনুজার কখনো মনেই হয় না তিনি নিঃসন্তান। এই মৃত্তিকাই তো উনার শেষ ভরসা। বাকিটা জীবন মা মেয়েতে মিলে খুব ভালো ভাবেই কাটিয়ে দিতে পারবেন। হঠাৎ মৃত্তিকার ডাকে ভাবনার ঘোর কা’টল তনুজার। মৃত্তিকা বলল‚

“কী এত ভাবছ মামনি?”

“কিছু ভাবছি না রে মা। আচ্ছা শোন— সাবধানে যাবি। নাচের জন্য নিজের অযত্ন করিস না। সময় মতো খাবারটা খেয়ে নিবি।”

“তুমি চিন্তা কোরো না মামনি। তোমার মৃত্তিকা তোমাকে প্রমিজ করছে‚ সে নিজের খেয়াল অবশ্যই রাখবে।”

মেয়ের কপালে স্নেহময় স্পর্শ এঁকে দিয়ে তনুজা বললেন‚ “আমার সোনা মেয়ে।”

“আসছি মামনি। আসছি দিদিভাই।”

“সাবধানে যাস বোনু।”

“হুম!”

সুদর্শনী এবং তনুজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মৃত্তিকা ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে এসেছে সদর দরজা যাতে ভালো করে আটকে দে। তার কথানুযায়ী সুদর্শিনী সদর দরজা ভালো ভাবেই আটকে দিয়েছে৷ সে হয়তো আরও কিছুদিন এখানেই থাকবে৷ অর্ণব এখনো ঢাকা ফেরেনি।

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

হসপিটালে যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি অর্পণ। তবে যাওয়ার আগে ফিরোজার কাছে তার আর ইরার বিয়ের কথাটা ঠিক কীভাবে বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না! সকাল থেকে বেশ কয়েকবার বলার জন্য উসখুসও করছে। স্বস্তি মিলছে না তার। অর্পণ সোজা তার মায়ের ঘরে চলে এসেছে। মেহরাব শিকদার হয়তো ছাদে গিয়েছেন। যেদিন তিনি হসপিটালে না যান সেদিন নাস্তা করার পর ছাদের গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। এই সুযোগে অর্পণ তার কথাটা বলে দেবে৷ ফিরোজা তখন নিজের ঘরেই ছিলেন। অর্পণ কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই তার মাকে বলল‚

“মা তোমাকে আমার কিছু বলার আছে৷”

“হ্যাঁ বাবা বল— কী বলবি?”

“আমি আর ইরা বিয়ে করতে চাইছি। সবাইকে রাজি করানোর ভার তোমার উপর।”

“মায়ের কাছে সোজা বিয়ে করার কথা বলছিস? ছেলে আমার বড়ো হয়ে গিয়েছে৷ তা হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলি যে?”

“তার একটা কারণ অবশ্যই আছে৷ তবে মা আজ আমি সেসব কিছু বলতে পারছি না। তুমি বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা বল। আঙ্কেল আন্টির সঙ্গেও কথা বল।”

“আচ্ছা যখন সময় হবে তখন আমাকে বলিস৷ আর হ্যাঁ আমি আজই সবার সঙ্গে কথা বলছি।”

এই বলে আলমারি থেকে একটা গহনার বাক্স বের করলেন ফিরোজা৷ অর্পণের বউয়ের জন্য গহনা গড়িয়ে রেখেছেন তিনি। একটা একটা করে বের করতে শুরু করলেন। গহনার বাক্সের ভেতরে আরও দুটো বক্স। ফিরোজা মনে প্রাণে ভূমিকে নিজের মেয়ের জায়গা দিয়েছিলেন। শুরুতে যখন ভূমি এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন এক জোড়া ঝুমকা আর একটা চেইন বানিয়ে রেখেছিলেন৷ ভূমি এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার দিন দুয়েকের মাঝেই গহনা গুলোকে আনা হয় স্যাকরার কাছ থেকে। এত কিছুর মাঝে কখনো এগুলো দেওয়ার সুযোগই হয়নি উনার৷ হবে কী করে? তার আগেই তো ভূমির ওই খবর! তবুও ভূমির এই জিনিস গুলো নিজের কাছে যত্ন করে আগলে রেখেছেন৷ অর্পণ দুটো বাক্স দেখে জিজ্ঞেস করল‚

“এখানে দুটো বক্স কেন মা?”

“একটায় ইরার জন্য গহনা আছে।”

“আরেকটায়?”

“ভূমির জন্য। ওর জন্যও আমি এক জোড়া ঝুমকা আর একটা চেইন বানিয়ে রেখেছিলাম।”

অর্পণ জানে তার মা ভূমিকে ঠিক কতটা স্নেহ করেন! অর্পণ তার মাকে আশ্বাস দিয়ে বলল‚

“এগুলো আরও কিছুদিন যত্ন করে তুলে রাখ মা৷”

নিজের মনের কথা মুখে পুরোপুরি ভাবে বলতে পারল না অর্পণ। সে ভাবতে লাগল যখন তার মা সব সত্যিটা জানবেন তখন কেমন প্রতিক্রিয়া করবেন? সে জানে মেহরাব শিকদারের রূপটা সামনে এলে তার মা ভীষণ কষ্ট পাবেন। কিন্তু কিছুই করার নেই। সত্যিটা সবার সামনে আসা খুবই জরুরি।

সবে নাচের স্কুল থেকে বের হয়েছে মৃত্তিকা। নাচের স্কুলটা পড়েছে শাহবাগের দিকে৷ ❝নৃত্য প্রকৌশল একাডেমি❞ নামক একটা প্রতিষ্টানে। যা তার বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। মৃত্তিকার অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার৷ নাচ নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার। টানা পাঁচ ঘণ্টা সময় এখানেই অতিবাহিত হয়েছে তার৷ সুযোগে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিয়েছিল৷ তনুজাকে প্রমিজ করে এসেছিল যে‚ সময় মতো খাবারটা খেয়ে নেবে৷ সেও কল করে তনুজা আর সুদর্শিনীর খবরাখবর নিয়েছে৷ রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্তিকা৷ এই সময়টাতে রিকশা পাওয়া যায় না বললেই চলে৷ সেদিনও এখানেই বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ অবশ্য ওই সময়টা বাসের আনাগোনা থাকে৷ কিন্তু এখন বা আরও ঘণ্টা খানেক পরও এখানে আর বাস পাওয়া যাবে না৷ বিরক্ত হয়ে বারবার ফোন ঘড়িতে সময় দেখছে মৃত্তিকা৷ এরই মাঝে পাশ থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল তাকে৷ মৃত্তিকাও সেখানটায় তাকাল। সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুশফিকা আর তার বর অর্থাৎ রিফাত। দুজনেই তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মৃত্তিকার পড়নে হাফসিল্কের ম্যাজেন্টা রঙা শাড়ি আর ডান কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগ৷ তাকে এভাবে দেখে মুশফিকা জিজ্ঞেস করল‚

“ভূমি তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

প্রায় এক বছরেরও অধিক সময় পর ভূমিকে দেখছে সে। মুশফিকার কণ্ঠেও কিছুটা উচ্ছ্বাস। তবে মৃত্তিকা তা এড়িয়ে বলল‚

“এক্সকিউজ মি! আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে৷ আমি ভূমি নই— মৃত্তিকা।”

বোকা হেসে মুশফিকা বলল‚ “তুমি আমার সঙ্গে মজা করছ তাই না?”

“কী আশ্চর্য! আমি আপনার সঙ্গে মজা করতে যাব কেন? আমরা কী একে অপরকে চিনি? কখনো কী আমাদের দেখা হয়েছিল?”

এবার মুশফিকার স্বামী রিফাত এগিয়ে এসে বলল‚ “চল মুশফি। আমাদেরই হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।”

মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে রিফাত আবারও বলল‚ “আপনি কিছু মনে করবেন না৷ আপনাকে একজন চেনা মানুষের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে ও৷”

“ইটস ওকে!”

রিফাত এবার মুশফিকার হাত ধরে নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগেও মুশফিকা তাকিয়ে ছিল মৃত্তিকার দিকে৷ ওরা চলে যেতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মৃত্তিকা৷ তবে মুশফিকার সঙ্গে এমন ব্যবহার করে তার বড্ড অনুশোচনাবোধ হচ্ছে৷ এমন ভাবে কথা না বললেও পারত কিন্তু সে চায় না তার বেঁচে থাকার কথাটা এখনই কেউ জেনে যাক৷ যতদিন না সবকিছু হাতেনাতে প্রমাণ দেবে ততদিনে নিজের পরিচয় সে লুকিয়েই রাখবে৷ কারো সামনে আসতে দেবে না৷ ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অর্পণের নাম্বার কল লাগাল। ওদিকে অর্পণও তার ফোনকল সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল। ভূমি জিজ্ঞেস করল‚

“ভাইয়া তুমি কোথায় আছ?”

“কেন বোন— তোর কী কিছু দরকার? কোনো বিপদ হয়েছে কী? আমি এক্ষুনি আসছি।”

“তুমি ব্যস্ত হয়ো না৷ আমার একটা কথা বলার ছিল।”

“কী কথা?”

“কিছুক্ষণ আগে মুশফিকা আপুর সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ উনার স্বামীও সাথেই ছিল। তো আমাকে ভূমি বলে ডাকছিল। নিজেকে আড়াল করতে উনার সঙ্গে কিছুটা মিসবিহেভ করে ফেলেছি।”

“এখন কী রিগ্রেট ফিল হচ্ছে?”

সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকা জবাব দিল‚ “হুম— হুম!”

“অনুশোচনাবোধ করার কিছু হয়নি। মাঝে মাঝে কিছু সত্যি লুকতে গিয়ে যদি মিথ্যে বা মিসবিহেভ করতে হয় তাহলে সেটা অন্যায়ের মাঝে পড়ে না৷”

“আরেকটা কথা।”

“এত সংকোচ করছিস কেন? নির্দ্বিধায় বল বোন।”

“আজ কী উনি হসপিটালে গিয়েছেন?”

মৃত্তিকার কথা বুঝতে না পেরে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “উনি কে?”

“ডক্টর মেহরাব শিকদার।”

“না। মা আজকে উনাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেননি।”

“আমি তাহলে হসপিটাল আসছি।”

“আচ্ছা আয়। চিনে আসতে পারবি? আমি গিয়ে কী নিয়ে আসব তোকে?”

“আমি একাই আসতে পারব ভাইয়া। তোমার বোন এখন আর আগের বোকা ভূমি নেই।”

ক্ষীণ হেসে অর্পণ বলল‚ “ওহ হ্যা আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম৷” একটু থেমে সে আবারও বলল‚ “সাবধানে আসিস?”

“হুম!”

ফোনটা ব্যাগে রেখে একটা রিকশা ডাকল মৃত্তিকা৷ উদ্দেশ্য হসপিটালে যাবে। যেহেতু মেহরাব শিকদার হসপিটালে নেই তাই সেই সুযোগে কিছু তথ্য বের করা যাবে৷ অর্পণের সাহায্যে মেহরাব শিকদারের কেবিনে ঢুকতে খুব বেশ বেগ পেতে হবে না তাকে। মনে মনে এক বড়োসড়ো পরিকল্পনা এঁটেছে সে৷ এখন থেকেই মেহরাব শিকদারের ধংসলীলা শুরু হবে। তার পাপের সম্রাজ্যেই তার ধ্বংস অবধারিত। যেমনটা সে একদিন মেহরাব শিকদারের কাছে ওয়াদা করেছিল। সেদিনের তার ওয়াদার প্রত্যেকটা শব্দ আজও তার মনে রয়েছে। মেহরাব শিকদারকে শাস্তি দেওয়া না অবধি এই কথাগুলোকে সে ভুলতে পারবে না৷

“যেভাবে আপনি আমার আম্মাকে খু’ন করেছেন— তার থেকে কঠিন মৃ’ত্যু আমি আপনাকে দেব৷ বাঁচতে কে না চায়? আপনিও বাঁচার জন্য একটু একটু করে তড়পাবেন। কিন্তু আমি আপনাকে এমন মৃ’ত্যু দেব যে‚ আপনার ❝কাঁটামুকুট❞ এর প্রত্যেকটা কামরা কেঁপে উঠবে৷ সেখানেই আপনার মৃ’ত্যু শিরোধার্য। আপনার ধ্বংসোন্মুখ ক্রমশ এগিয়ে আসছে৷ যতদিন ইচ্ছে হয় নিজের পাপ আরও বাড়িয়ে নিন। আমি যদি বেঁচে থাকি তবে মেহরাব শিকদারের মতো পাপকৃৎ-কে একদিন না একদিন এই আমার হাতেই ম’রতে হবে। আপনার ধ্বংসেই আমি হব রণরঙ্গিণী।”

অন্যদিকে…

মাধুরীর শত বারণ অগ্রাহ্য করে বাড়ি থেকে বের হয়েছে প্রলয়৷ বাড়িতে বসে থাকতে ভাল্লাগছিল না তার৷ ছেলের জেদের কাছে হার মেনে রাজি হতেই হয়েছে মাধুরীকে৷ কালো রঙা গাড়িটি থেকে নেমে ল্যাবের ভেতরে প্রবেশ করল প্রলয়৷ আজ সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ডিএনএ আবারও টেস্ট করাবে। কাল অর্পণকে তার কেন যেন সন্দেহ হয়েছিল! মনে হচ্ছিল সে তাকে মিথ্যে বলছে৷ কারণ অর্পণ সবসময় তার চোখে চোখ রেখে কথা বলে। কিন্তু কাল সে প্রতিনিয়ত দৃষ্টি আড়াল করছিল৷ প্রলয় আজ দেখবে কী করে রিপোর্ট ভুল আসতে পারে৷ রিপোর্ট যতই নেগেটিভ আসুক না কেন— তার মন অনুভব করে ওই মেয়েটাই ভূমি! কিন্তু ক্রমাগত এভাবে অস্বীকার করার যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি সে৷ এমনিতেই প্রলয়কে সবাই চেনে আর মান্যগণ্য করেন। তারউপর এই ল্যাবের একজন কর্মকর্তা তার ভালো বন্ধু। বন্ধুত্বের সুবাদে এখানে ডিএনএ টেস্ট করতে দিয়েছিল সে। বিশ্বাস করেই দিয়েছিল৷ তবে সন্দেহ বসত আজ তাকে আবার আসতে হলো৷ নিজের ভাবনার মাঝেই প্রলয় ল্যাবের ভেতরে প্রবেশ করল৷ সোহেল আজ ল্যাবে আসেনি। প্রলয় এ কথা আগে থেকেই জানত। সে ইচ্ছে করেই আজ এসেছে। এবার নিজ দায়িত্বে সব করবে সে। ফোনে একবার নিজের মুখটা দেখে নিল প্রলয়। না মাস্কের জন্য তাকে চেনা যাচ্ছে না। প্রলয় সামনে যেতেই রিসেপশনিস্ট ছেলেটা জিজ্ঞেস করল‚

“হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?”

প্রলয় নিজের চশমা ঠিক করে স্বাভাবিক স্বরেই বলল‚ “এখানে একটা ডিএনএ টেস্ট করতে দিয়েছিলাম। রিপোর্টটা আজ দেওয়ার কথা ছিল।”

ছেলেটা লিস্ট চেক করতে নিয়ে প্রলয়কে জিজ্ঞেস করল‚ “আপনার নাম?”

প্রলয় তার মুখ থেকে মাস্কটা খুলল। ওমনি ছেলেটা তাকে চিনে ফেলল। শশব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করল‚

“স্যার আপনি ব্যস্ত হবেন না। আপনি আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিন আমি এক্ষুনি রিপোর্ট নিয়ে আসছি।”

সায় জানাল প্রলয়। ছেলেটা ব্যস্ত হয়েই যেন ছুটল প্রলয়ের কাঙ্ক্ষিত রিপোর্ট নিয়ে আসার উদ্দেশে। মিনিট পাঁচেকের আগেই ছেলেটা চলে এলো৷ প্রলয়ের হাতে একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিল৷ প্রলয় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই রিপোর্ট খানা খুলল৷ যেন জ্বলজ্বল করে “পজিটিভ” লেখাটা ভাসছে। অতি আনন্দোচ্ছ্বাসে প্রলয়ের চোখ জোড়া টলটল করছে৷ যেকোনো মুহূর্তে যেন অশ্রুবর্ষণ শুরু হবে৷ তার এটা ভেবে আনন্দ লাগছে যে‚ তার ভূমি কন্যা বেঁচে আছে৷ আবার এটা ভেবে রাগ লাগছে যে‚ অর্পণ তাকে ইচ্ছে করে ভুল রিপোর্ট দিয়েছে৷ প্রলয় বুঝতে পেরেছে যে‚ অর্পণ হয়তো ভূমির সত্যিটা জেনে গিয়েছে৷ কিন্তু এর পেছন কী কারণ থাকতে পারে সেটা সম্পূর্ণই তার অজানা৷ জানার আগ্রহ তড়তড় করে বাড়তে শুরু করল৷ অতি উচ্ছ্বসিত হয়ে পকেট থেকে এক হাজার টাকার দুটো নোট ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রলয় সেই ল্যাব থেকে বের হয়ে গেল। প্রলয়ের এহেন কাণ্ডে ছেলেটা যারপরনাই অবাক হলো৷ কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই প্রলয়ের। সে এখন সোজা ভূমির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তার ভূমি কন্যা যে এতদিন অভিমান পাহাড়কে আকাশসম বানিয়েছে৷ অভিমান ভাঙাতে বেশ বেগ পেতে হবে তাকে৷ তবে তাই সই! পুনরায় ভূমি কন্যা আর তাদের সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য সে যেকোনো বাজি ধরতে পারে। অবারিত দুঃখ যন্ত্রণাকে আপন করে নেবে। যতটা দুঃখ তার ভূমি কন্যা সহ্য করেছে। তার থেকেও অধিক দুঃখকে সে আপন করে নেবে৷

“আল্লাহ আপনাকে শত কোটি শুকরিয়া— আমার ভূমি কন্যাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এ জীবনে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে ভুল বোঝার মতো অন্যায় আমি দ্বিতীয়বার করব না। নিজের সন্তানকে খুব ভালোবাসব৷ একজন ভালো বাবা হব। মানুষকে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া হয়। আমার ভূমি কন্যা কী পারবে আমাকে সে সুযোগটা দিতে? আমাকে যে দ্বিতীয়বার ওর বিশ্বাস অর্জন করতেই হবে! বউ বাচ্চা নিয়ে একটা ছোটো পরিবার তো আমারও প্রাপ্য।”

হসপিটালের সামনে এসে মৃত্তিকা অর্পণের নাম্বারে কল করে৷ মিনিট পাঁচেক সময় পর অর্পণ এসে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। প্রথমে মৃত্তিকা অর্পণের কেবিনেই যায়৷ সে এখানে কেন এসেছে সেটাও জানায়৷ এক্ষেত্রে অর্পণ তাকে সম্পূর্ণ সাপোর্ট করে। মৃত্তিকার মুখে মাস্ক লাগিয়ে মেহরাব শিকদারের কেবিনে নিয়ে যায়। কেবিনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্তিকার নিজের কাজে লেগে পড়ে৷ মহুয়া একদিন তাকে বলেছিলেন‚ মেহরাব শিকদার নিজের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস গুলোকে কখনোই বাড়িতে রাখেন না৷ হসপিটালে আর নয়তো নিজের দ্বিতীয় সেই বাড়িটাতে৷ যেই বাড়িটার কথা আর ঠিকানাটা মহুয়া তাকে দিয়েছিল। কিন্তু তার কাছে তো ওই বাড়ির চাবি নেই৷ আর না অর্পণ জানে ওই বাড়ির ব্যাপারে। তাই সে আগে হসপিটালেই তল্লাশি চালাতে এসেছে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খোঁজার একপর্যায়ে এসে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚

“কী খুঁজছিস বোন?”

খোঁজার ফাঁকে মৃত্তিকা বলল‚ “একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল৷”

“তুই শিওর সেটা এখানে আছে?”

সেই একই ভঙ্গিতে আবারও বলল‚ “থাকারই তো কথা৷”

“আমি কী হেল্প করব খুঁজতে?”

মৃত্তিকা মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে বলল‚ “হুম!”

“ফাইলটা ঠিক কেমন হবে?”

“একটা খুবই পুরোনো ফাইল। উপরে ❝কাঁটামুকুট❞ লিখে রাখা।”

“নামটা ভীষণ অদ্ভুত।”

“সেটা কর্মকাণ্ডও ভীষণ অদ্ভুত আর অমানবিক।”

অর্পণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”

“এ কথা পরে বলব ভাইয়া৷ এখন হাতে সময় নেই। ওই ফাইলটা আমাদের তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করতে হবে৷”

কাঙ্ক্ষিত ফাইলটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুজনে৷ মৃত্তিকা কিছুটা নিশ্চিত কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা সে এখানেই পাবে৷ একটু ভালো করে খুঁজতে হবে। আজই তার প্রথম আর শেষ সুযোগ। হয়তো আল্লাহ তায়াল এটাই চেয়েছিলেন তাই তো আজ মেহরাব শিকদার হসপিটালে আসেননি।

হসপিটাল থেকে সবেই বের হয়েছে মৃত্তিকা। সে যেটার খোঁজে গিয়েছিল সেটা পেয়ে গিয়েছে৷ আর মাত্র কয়েকটা দিন। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূর হেঁটে এলো সে৷ বাস স্টপেজ গিয়ে অপেক্ষা করবে বাসের জন্য। জ্যামে না পড়লে বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় মিনিট পঁচিশ সময় তো লাগবেই৷ আপন মনে হেঁটে যাচ্ছে মৃত্তিকা৷ আর তো কিছুটা পথ৷ এদিকে বাড়ি ফেরার পথেই রাস্তায় মৃত্তিকাকে দেখতে পেল প্রলয়। এদিকেই একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল৷ মৃত্তিকাকে দেখতে পেয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরেই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে৷ তবে তার মুখে মাস্ক লাগানো। রাস্তার কেউ হয়তো তাকে চিনবে না শুধুমাত্র তার ভূমি কন্যা ব্যাতীত। পেছন থেকেই ডাকল মৃত্তিকাকে।

“ভূমি কন্যা?”

বহু চেনা কণ্ঠস্বরে থমকে দাঁড়াল মৃত্তিকা৷ তবে পেছন ফিরে তাকাল না। সে বুঝতে পেরেছে প্রলয় ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ পেছন তাকালেই তাকে সন্দেহ করতে পারে৷ তবে এত সহজে ধরা দেওয়া তো যাবে না৷ মৃত্তিকা হাঁটতে শুরু করল প্রলয় এবার তার পথরোধ করে দাঁড়াল। এভাবে হুট করে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ায় যারপরনাই বিরক্ত হলো মৃত্তিকার৷ ভুরু যুগল কুঁচকে তাকাল প্রলয়ের দিকে৷ জিজ্ঞেস করল‚

“এ কোন ধরনের অসভ্যতা? কে আপনি?”

প্রলয় তার মুখ থেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাস্ক সরাল৷ এরপর আবার পড়ে ফেলল৷ আর মৃত্তিকাকে বলল‚

“কোথায় যাচ্ছিলে? চল আমি তোমাকে পৌঁছে দিই ভূমি কন্যা!”

“উফ! আপনি আবার এসেছেন? কতবার বলব আমি ভূমি নই— মৃত্তিকা!”

“তুমি যতবারই বল! আমি বিশ্বাস করছি না৷”

এই মানুষটাকে তার সবথেকে বেশি অসহ্যকর লাগছে৷ দাঁতে দাঁত চেপে মৃত্তিকা বলল‚ “গো টু হেল!”

এই কথাটা বলে চলে আসতে নিলে আকস্মিক ভাবে প্রলয় তার হাতটা ধরে ফেলল৷ ঠোঁট চেপে হেসে বলল‚ “চল এক সঙ্গেই যাই?”

সঙ্গে সঙ্গেই নিজের হাতটাকে ছাড়িয়ে নিল মৃত্তিকা৷ তেজি স্বরে বলে উঠল‚ “হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মি?”

প্রলয় কিছুটা কাছে এসে মৃত্তিকার কানে ফিসফিসিয়ে বলল‚ “সাহসটা কিন্তু আমার শুরু থেকেই ছিল।”

নিজের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে চলে যেতে উদ্যত হলো মৃত্তিকা৷ এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে৷ তনুজা হয়তো তারই জন্য অপেক্ষা করছে৷ তার বাড়ি ফেরার কথা দুপুর তিনটে। অথচ এখন সময় বিকেল ছয়টা৷ একটু একটু করে আবছা অন্ধকার নেমে আসছে মেদিনীর বুকে। এরই মাঝে তনুজা বেশ কয়েকবার কল করেছিলেন। তখন সে হসপিটালের ভেতরে থাকায় রিসিভ করতে পারেনি৷ তারউপর ফোন সাইলেন্ট করা ছিল৷ কল ব্যাক যে করবে তারও উপায় নেই৷ ফোনের ব্যালেন্স শেষ। আজই হয়তো সব ঝামেলা একই সঙ্গে আসার কথা ছিল। মৃত্তিকাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রলয় বলল‚

“ভূমি কন্যা আমাদের সন্তান…!

প্রলয় তার পুরো কথা শেষ করতে পারল না৷ গালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মৃত্তিকার হাত জ্বালা করছে। তবে সে তা প্রকাশ করল না। সুশ্রী রূপে লেপে রেখেছে রুষ্টতা। এরকম কাঠখোট্টা লোকের গালে চড় মা’রা মোটেও চারটে খানি কথা না। আগের মতো এখন আর প্রলয়কে সে ভয় পায় না। মৃত্তিকা এবার চেঁচিয়ে বলল‚

“কীসের বাচ্চা? কীসের কথা বলতে চাইছেন আপনি? অনেকক্ষণ ধরেই বিরক্ত করছেন। কিছু বলছি না দেখে ভাবছেন আপনার এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে? বাঁচতে চাইলে এখান থেকে চলে যান। নয়তো আমি মানুষ জড়ো করব।”

প্রলয় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে৷ এতটা নির্ভীকতা তার ভূমি কন্যার মাঝে কবে এলো? কোমল হাতের চড়টা খুব একটা জব্দ না হলেও তার মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বাস করতে কোশট হচ্ছে৷ প্রলয় ফ্যালফ্যাল করে মৃত্তিকার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে৷ আশেপাশে গুটিকয়েক মানুষ এদিকেই চেয়ে আছে৷ একটা মেয়ে একটা ছেলেকে থাপ্পড় মে’রেছে‚ এর থেকে ধামাকা আর কী হতে পারে? সেই জন্যই মজা লুটছে সকলে৷ মৃত্তিকা আশেপাশে একবার তাকাল৷ প্রলয়ের মুখে মাস্ক লাগানো বিধায় কেউ তাকে চিনতে পারেনি৷ তা নাহলে এতক্ষণে হয়তো ব্যাপারটা সব জায়গায় ছড়িয়ে যেত৷ মৃত্তিকা আর সেখানে দাঁড়াল না৷ এদিকে প্রলয় এখনো ঘোরের মধ্যে রয়েছে৷ তার ভূমি কন্যা তাকে থাপ্পড় মা’রতে পারে এটা সে কদাপি ভাবতে পারে না৷ তবে হলো তো সেটাই। প্রলয়ের স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগল৷ সে বুঝতে পারল মৃত্তিকাকে মানানো এতটাও সহজ হবে না৷ অনেক কাঠখড় পোহাতে হবে তাকে৷ আশেপাশে একবার তাকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান নিল প্রলয়৷ মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে তার৷ কী থেকে কী হয়ে গেল? ভালোই ভালোই এলো ভূমি কন্যার মান ভাঙাতে। কিন্তু তার কথাই তো শুনতে চায় না। কথায় কথায় ছ্যাঁৎ করে উঠছে আবার আচমকা চড়ও মে’রে বসল আজ। তবে প্রলয় মোটেও রাগ করেনি৷ এটাই তো তার প্রাপ্য৷ তার দোষের জন্যই তো দুজনের মাঝে সহস্রাধিক দূরত্ব৷ ছোটো বাচ্চাটাকেও তো সে নিজের করে পাচ্ছে না৷

রাতে…

শত জোর করার পরও প্রলয় আজ রাতের খাবার খায়নি। বারবার একই বাহানা দিয়েছে‚ তার ক্ষিধে নেই। মাধুরী বহুবার খাবার খেয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি মনে মনে ভাবছেন প্রলয় হয়তো উনার উপর কোনো কারণে রাগ করে রয়েছে। তিনি এবার ভেবে নিয়েছেন বিয়ে নিয়ে প্রলয়কে আর জোর করবেন না তিনি। ছেলে যেভাবে ভালো থাকতে চায় সেভাবেই থাকবে। যদি এক বছর আগের অতীতে ফিরে যেতে পারতেন তাহলে তিনি ভূমিকে প্রলয়ের জীবনে আবারও ফিরিয়ে দিতেন। ছেলের এই বেহাল দশা মা হয়ে উনি আর সহ্য করতে পারছেন না। এদিকে প্রলয়ের এমন ব্যবহার খেয়াল করল অর্পণ। আজ সারাদিনে একটিবারও প্রলয় তার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। হুট করে এমন পরিবর্তন নিমিষেই ধরে ফেলল সে৷ আসল কথা জিজ্ঞেস করতে প্রলয়ের ঘরে গেল। প্রলয় তখন বিছানায় বসে ছিল। অর্পণ কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করল‚

“ভাই কী হয়েছে তোমার? আজ কেমন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷”

প্রলয়ও সরাসরি বলে ফেলল‚ “মৃত্তিকা আমাকে লোক সম্মুখে থাপ্পড় মেরেছে৷”

এহেন কথা বিষম খেল অর্পণ। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। বিছানায় বসে প্রলয়কে আবারও জিজ্ঞেস করল‚

“তুমি কী বলেছিলে যে‚ তোমাকে সোজা থাপ্পড় মে’রে বসল?”

“বাচ্চাটার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

অর্পণ এবার বুঝল মৃত্তিকার মনের অবস্থা। কাঁটা ঘাঁয়ে নুনের ছিঁটে পড়েছে চড় তো খাওয়ারই ছিল। কিন্তু অর্পণ তার ভাইয়ের উপর রাগ করতে পারল না। তার ভাই তো সত্যিটা জানেই নাই। প্রলয়ের মা’র খাবার কথাটা শুনে হাসতে ইচ্ছে করছে না। আবার খারাপও লাগছে। গম্ভীর স্বরে অর্পণ বলল‚

“মেয়ে মানুষকে উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করলে তো এমনই হবে।”

চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল প্রলয়। সে যে সত্যিটা জেনে গেছে সেটা তো অর্পণ জানেই না৷ আর জানতেও দেবে না৷ ওদের অজান্তেই সে তার ভূমি কন্যার মান ভাঙাবে৷ একটা থাপ্পড় কেন— হাজারটা থাপ্পড় খেতেও প্রস্তুত সে! তবুও তার স্ত্রী সন্তানকে চা-ই চাই।

চলবে?…..