#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
হলুদিয়া সজ্জায় সেজে উঠেছে কমিউনিটি সেন্টার। ইতিমধ্যেই সকলে কাঙ্ক্ষিত স্থানে চলে এসেছে। অর্পণ এবং ইরার পুরো পরিবারের সকলেই উপস্থিত৷ ফটোসেশান শুরু হয়েছে অর্পণ ইরা স্টেজে আসার সঙ্গে সঙ্গেই। অর্পণের পুরো কাজিনমহল ছবি তোলায় ব্যস্ত। গায়ে হলুদের আয়োজন কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে যাবে। প্রলয় এখনো এসে পৌঁছায়নি। সকলে তারই জন্য অপেক্ষা করছে। তারউপর মৃত্তিকা এখনো আসেনি। অর্পণও তার জন্য অপেক্ষা করছে৷ তখন কল করেছিল কিন্তু মৃত্তিকা জানিয়েছে সে সবে রওনা দিয়েছে৷ পৌঁছাতে কিছুক্ষণ সময় লাগতে পারে। গায়ে হলুদ দেওয়া যাতে শুরু করে দেয়। কিন্তু অর্পণ তো তার বোনকে ছাড়া গায়ে হলুদ শুরুই করবে না। তারউপর তার ভাই এখনো এসে পৌঁছায়নি। কনেপক্ষ বরপক্ষ মিলে অতিথি আপ্যায়ন করছে৷ আরশও তার ব্যতিক্রম না৷ তৃপ্তি একাকী ঘুরে ঘুরে দেখছে। বেশ অনেকটা সময় পর তৃপ্তিকে একা দেখল আরশ। কাল ব্যস্ততার মাঝে সময় সুযোগ হয়নি কথা বলার৷ এবার সুযোগ বুঝে আরশ গিয়ে তৃপ্তির সামনে দাঁড়াল। হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল‚
“ভালো আছেন তো? কাল ব্যস্ততার জন্য বিয়াইনকে আলাদা ভাবে আপ্যায়ন করতে পারলাম না৷”
তৃপ্তি এবার আরশকে আপাদমস্তক দেখল৷ হলুদ রঙা পাঞ্জাবি পড়েছে। তার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথাগুলো বলছিল৷ তৃপ্তিও সৌজন্যপূর্ণ হেসে বলল‚ “জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷”
“আপনাকে কিন্তু হলুদ শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে।”
“ফ্লার্ট করছেন বুঝি!”
“এ বাবা আপনার কী তাই মনে হলো?”
“হুম! সেটাই তো মনে হচ্ছে।”
“মোটেও না। আপনাকে সত্যিই দারুণ লাগছে।”
এরই মাঝে আরশের ডাক পড়ল। শাহাদাৎ মোড়ল ডাকছেন তাকে। আরশ বিরক্ত হলো কিছুটা৷ সবে তৃপ্তিকে পটানোর চেষ্টা করছিল৷ বয়স হচ্ছে তো। তারও উচিত এবার বিয়ে করে নেওয়া৷ তৃপ্তিকে প্রথম দেখায় তার মনে ধরেছে৷ সমবয়সী সবগুলোই বিয়ে করে নিয়েছে। এতদিন অর্পণটা সিঙ্গেল ছিল। এখনো তারও একটা হিল্লে হয়ে যাচ্ছে৷ বাকি পড়ে রয়েছে শুধু সে৷ কিন্তু তার বাবা তা হতে দিলে তো? সেই তার পরিশ্রমে জল ঢেলে দিলেনই। আরশ বিরক্ত কাঁদো কাঁদো গলায় বলল‚
“আচ্ছা বিয়াইন— পরে কথা হচ্ছে।”
হাসি মুখে তৃপ্তি বলল‚ “হুম!”
আরশ চলে গেল৷ তৃপ্তি এবার গাল এলিয়ে হেসে উঠল। সে বুঝতে পেরেছে আরশ তাকে পটানোর চেষ্টা করছিল৷ কারণ বিয়ে বাড়িতে তো এমনটা হরহামেশাই হয়ে থাকে। বিষয়টা স্বাভাবিক নয় কী? তৃপ্তি চলে গেল পূর্ণতা পুষ্পিতার কাছে। তারা একটা টেবিলের চেয়ারে গোল হয়ে বসে রয়েছে৷ লাম আর লামিয়াও রয়েছে। তৃপ্তি গিয়ে বসল পূর্ণতার পাশে৷ পূর্ণতা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল‚
“কোথায় গিয়েছিলে আপু?”
“এখানেই ছিলাম। ডেকোরেশন বেশ ভালো হয়েছে তাইনা?”
“হ্যাঁ! এক কথায় দারুণ।”
পুষ্পিতা বলে উঠল‚ “গ্রুপ সেলফি তুলব না আমরা?”
সকলে একসঙ্গে বলে উঠল‚ “অবশ্যই।”
ওরা গ্রুপ সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অর্পণ আর ইরা সেই আগের ভঙ্গিতে স্টেজে বসে ফটোশুট চলছে। এরই মাঝে চলে এলো প্রলয়। সে একটা কাজে বের হয়েছিল৷ ভাইয়ের বিয়ে বলে তো আর নিজের কাজ ফেলে রাখতে পারে না। সবকিছুর উর্ধ্বে হচ্ছে তার রাজনীতি। ইদানীং রাজনীতি থেকে পিছু হটে যাচ্ছে সে। যেই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তার স্বপ্ন ছিল এখন তার প্রতি বেড়েছে দূরত্ব। তবে প্রলয় আর কোনো দূরত্বকে নিজের প্রিয় জিনিসগুলোর দিকে ঝুকতে দেবে না। প্রলয়কে পেয়ে অর্পণ খুশি হয়ে গেল৷ নিজে ফোন থেকে মৃত্তিকার নাম্বারে আবার কল লাগাল। এটা জানার জন্য যে‚ তারা এখন কোথায় আছে! তবে কল করে যে জানতে পারল মৃত্তিকারা প্রায় চলে এসেছে আর মিনিট পাঁচেক সময় লাগতে পারে৷
কেটে গেল আর বিশ মিনিট…
অর্পণ আর ইরাকে হলুদ লাগানো শুরু করা হয়েছে৷ মাধুরী খুব তাড়া দিচ্ছিলেন। এখন তো সবে রাত নয়টা বাজছে৷ এখনো অনেক আয়োজনের বাকি রয়েছে। ছেলে মেয়ে গুলো নাচের রিহার্সাল করেছে অর্পণের বিয়েতে নাচবে বলে৷ তাই গায়ে হলুদ দেওয়ার কাজটা আগেই সেরে রেখেছেন৷ অর্পণ যখন দেখল তার বোন চলে এসেছে তখন ইরাকে ইশারায় বলল মৃত্তিকাকে যেন স্টেজ ডেকে নিয়ে আসা হয়৷ ইরাও সেটাই করল। সে তার একজন বান্ধবীকে দিয়ে মৃত্তিকার কাছে পাঠাল। তনুজাকে নিয়ে স্টেজের কাছে গেল মৃত্তিকা৷ তাকে দেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে প্রলয়। আজ অন্য রূপে দেখছে সে তার ভূমি কন্যাকে। ধরিত্রীতে যেন হলুদিয়া পরী নেমে এসেছে৷ যার সর্বাঙ্গে নেই কোন সাজ আর নেই কোনো ভূষণ। এতেই যেন ভূমি কন্যাকে মারাত্মক সুন্দর দেখাচ্ছে৷ তাক লেগে যাওয়া সুন্দরী যাকে বলে! মৃত্তিকা আর তনুজা গেলে অর্পণ আর ইরাকে হলুদ লাগাতে। স্টেজে মৃত্তিকাকে দেখে সবাই অবাক হলো। বিশেষ করে মাধুরী। তিনি হা করে চেয়ে রয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের বাহিরেও অনেকেই ভূমিকে প্রলয়ের স্ত্রী হিসেবে চিনত৷ তবে তারা তো আর জানে না এক বছর আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। মৃত্তিকা আর তনুজা স্টেজ থেকে নিচে নামলেন। তনুজা চলে গেলেন হাত পরিষ্কার করতে৷ উনার হাতে অনেকটা হলুদ লেগেছে৷ এটা মুছে না নিলে শাড়িতে লেগে যেতে পারে৷ এদিকে মাধুরী এসে মৃত্তিকা হাত ধরে টেনে একপাশে নিয়ে গেলেন। প্রলয় তা খেয়াল করল৷ সে তখন থেকে মৃত্তিকাকেই দেখে যাচ্ছে। মাধুরী বললেন‚
“তুমি বেঁচে আছ? তাহলে এতদিন কেন আমাদের বাড়িতে ফিরে এলে না কেন? তোমার জন্য আমার ছেলেটা গুমরে গুমরে ম’রছে৷”
আশেপাশের কয়েকজনের দৃষ্টি এখন মৃত্তিকা আর মাধুরীর দিকে৷ মহিলাদের মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে৷ ফিরোজাও এগিয়ে এলেন। মৃত্তিকাকে দেখে তিনিও বেশ অবাক। খুশি হয়ে কাছে টেনে নিলেন। কিছু সময়ের জন্য চুপ করে থাকলেও এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না মৃত্তিকা। ফিরোজাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে আর মাধুরীর হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে সে বলল‚
“আপনাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে! আমি বুঝতে পারছি না সবার কেন একই ভুল হচ্ছে? প্রত্যেককে বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত। সত্যিই আমি ক্লান্ত!”
ফিরোজা বললেন‚ “আমাদের প্রতি বুঝি খুব অভিমান জমেছে?”
“আপনারা কীসব কথা বলছেন? আপনাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে! কারা আপনারা?”
এমন হেয়ালি পছন্দ হলো না মাধুরীর। তিনি বললেন‚ “ভূমি এবার একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”
“প্লিজ আমাকে ভূমি বলে ডাকবেন না। কতবার করে বলছি আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে— বুঝতেই চাইছেন না! দিস ইজ টু মাচ!”
প্রলয় একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মৃত্তিকার দিকে৷ তার ভূমি কন্যার এক অন্য রূপ দেখছে সে৷ সেই শান্ত মেয়েটার মাঝে আজ আকাশ পাতাল তফাৎ৷ দুটি অস্তিত্বের মাঝে ভিন্নতার দেয়াল আকাশসম৷ আগের সেই ভূমি কন্যাকে মৃত্তিকার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রলয় এগিয়ে তার মায়ের পাশে দাঁড়াল৷ তাকে দেখতে পেয়ে মৃত্তিকা বলল‚
“অহ এই যে এমপি সাহেব ওরফে মি. সেহরিশ আরশান প্রলয় প্লিজ বোঝান আপনার ফ্যামিলিকে। নাকি আপনার পুরো ফ্যামিলিই এমন? জনে জনে এসে মানুষকে বিরক্ত করা বুঝি আপনার ফ্যামিলির স্বভাব? দেয়ার শুড বি অ্যা লিমিট টু টলারেন্স!”
মৃত্তিকার এতগুলো কথাতেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না প্রলয়৷ চুপটি করে বুকে দুহাত গুজে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মৃত্তিকাকে এতগুলো কথা বলতে দেখে মাধুরী তেতে উঠে বললেন‚ “তোমার সাহস কী করে হয় এতগুলো কথা বলার?”
“এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইছি না আন্টি। প্লিজ এন্ড দিস ম্যাটার!”
“হাঁটু বয়সী মেয়ের কত দেমাক!”
“আপনি আপনার লিমিট ক্রস করছেন আন্টি৷ শুধু শুধু এভাবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার কোনো মানেই হয় না৷”
“বড়োদের সঙ্গে তর্ক করাই বুঝি তোমার মা শিখিয়েছেন?”
তনুজা এসে দেখলেন মৃত্তিকার সঙ্গে কারো ঝামেলা লেগেছে। তিনি গিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। এবার স্টেজ থেকে নেমে এলো অর্পণ আর ইরা৷ অর্পণের তো মাথায় হাত৷ কোথায় সে ভাবল মৃত্তিকা আর প্রলয়কে আবার এক করবে! কিন্তু হচ্ছে সবই উল্টো। এরা লড়াই শুরু করে দিয়েছে৷ বউ শাশুড়ীর লড়াই চলছে। এখানে কেউ কারো থেকে কম যায় না৷ মাধুরীকে উদ্দেশ্য করে তনুজা বললেন‚
“আপনি ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনার কোন রাইট নেই এভাবে কথা বলার।”
“আপনি কে এ কথা বলার?”
“যার সঙ্গে আপনি বাজে ব্যবহার করছেন আমি তার মা হই।”
মাধুরী কিছু বলতে নেবেন তার আগেই অর্পণ উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল‚ “এটা কী আমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান নাকি বিচার সভা?”
চুপ করে গিয়েও কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে মাধুরী বললেন‚ “মা যেমন মেয়েও তো তেমনই হবে।”
পুরোনো ক্ষ’ত আজ আবারও তাজা হয়ে গেল। এই কথাটা একবছর আগে মাধুরীই তাকে বলেছিলেন। আজ একবছর পর আবারও তিনি সেই একই কথা বললেন। এবার নতুন রূপে তেতে উঠল মৃত্তিকা৷ দীর্ঘসময়ের রুষ্টতা এখন রণরঙ্গিণী রূপ ধারণ করেছে৷ তাকে মাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আজ আর সে কাউকে তোয়াক্কা করবে না৷ হোক সে মহুয়া বা তনুজা! দুজনেই তাকে মায়ের ভালোবাসা দিয়েছেন। একজন পেটে ধারণ করে নিজের জীবন মেয়ের জন্য লুটিয়ে দিয়েছেন‚ আরেকজন হৃদয়ে ধারণ করেছেন৷ মৃত্তিকা এবার মাধুরীকে কিছু না বলে ইরাকে বলল‚
“ইরা তুমি কী আমাদেরকে এখানে অপমান হবার জন্য ইনভাইট করেছিলে? উনি আমার মামনিকে সহ অপমান করছেন৷ দিস ইজ রিয়েলি টু মাচ।”
একটা ছোটো কথা কাটাকাটি নিয়ে বিষয়টা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে৷ গায়ে হলুদের পুরো অনুষ্ঠান থেমে গিয়েছে৷ সকলের মনোযোগ এখন এখানেই। ভীড় জমেছে বলতে গেলে৷ প্রলয় এবার তার মাকে থামিয়ে বলল‚
“এবার একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? প্রত্যেকবার তুমি এমন কিছু কাণ্ড ঘটাও যার কারণে আমাদের মা ছেলের মাঝে দূরত্ব বাড়ছেই৷ হয়তো এই দূরত্ব কখনোই কমবে না৷ কারণ আমার মা তো নিজেকে কখনো বদলাবেই না৷”
প্রলয়ের কথাটা একেবারে বুকে গিয়ে লাগল৷ মাধুরী কষ্ট পেলেন। চোখ জোড়া অশ্রুপ্লুত হলো। প্রলয়ের কথায় কোনো ভুল নেই। ভূমির সঙ্গেও তিনি এমনই আচরণ করতেন। ছেলের পছন্দের গুরুত্ব উনার কাছে ছিলই না‚ যার কারণে তিনি প্রতিনিয়ত ভূমির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে গিয়েছেন। কখনো আপন করার চেষ্টাই তিনি করেননি। ভূমি বহুভাবে চেষ্টা করেছে উনার মন জুগিয়ে চলার৷ এই কথাটা তিনি মনে মনে হাজারবার স্বীকার করেন৷ আজ একটা অনুষ্ঠানের মাঝে তিনি অহেতুক একটা সন্তান সমতূল্য মেয়ের সঙ্গে বিবাদ শুরু করেছিলেন। মাধুরী অনুশোচনা বোধ করলেন। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বললেন‚
“আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।”
প্রলয় তার মায়ের খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল৷ মাধুরী এবার বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন‚ “আপনারা প্লিজ কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা ভুলে যান। এটা জাস্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি।”
মৃত্তিকাসহ বাকি সকলেই মাধুরীর ব্যবহারে অবাক। আর যাই হোক সে তো এই মহিলাকে হাড়ে হাড়ে চেনে৷ সংসার জীবনে তাকে তো কম কষ্ট দেননি এই মহিলা। কোনো কিছুই সে ভুলেনি। আর না কোনোদিন ভুলতে পারবে।
এখন পরিস্থিতি একেবারেই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ আগে যে একটা ঘটনা ঘটে গেছে সেটা হয়তো সবাই ভুলেই গিয়েছে৷ স্টেজে পূর্ণতা পুষ্পিতার একটা মিষ্টি পারফরম্যান্স চলছে। মেয়ে দুটো বেশ ভালো নাচছে। মাধুরী সামনে বসেছেন বিধায় মেয়ে দুটোর নাচ নিজের ফোনে ভিডিও করে রাখছেন৷ এদিকে এক কোণে একটা টেবিলে তনুজা আর মৃত্তিকা বসে রয়েছে৷ এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না। আনন্দের মাঝে অহেতুক একটা ঝামেলা ঘটে গেল। মেজাজ বিগড়ে আছে মৃত্তিকার। মাধুরী আজও তার মাকে নিয়ে কথা বলতে পিছুপা হলেন না৷ হুট করেই মহুয়ার কথা মনে পড়ে গেল মৃত্তিকার। জীবদ্দশায় কখনো শান্তিতে থাকতে পারেননি মহুয়া৷ সারাটা জীবন মেয়ের নামেই বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই তখন থেকে চুপ করে বসে রয়েছে মৃত্তিকা। মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ পর্যন্ত বের হয়নি। যেন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। তনুজা আগেই খাবার খেয়ে নিয়েছেন। কাল যেই সময়টাকে ঔষধ খাওয়ার কথা ছিল আজও সেই সময়টাতেই উনার ঔষধ খাওয়ার কথা৷ মৃত্তিকা আলাদা করে উনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল। যেহেতু উনি নিরামিষভোজী তাই উনার খাবার আলাদা ভাবেই আনা হয়েছিল ক্যাটারিং থেকে। সময় এখন রাত সাড়ে দশটা। অর্পণ বারবার মৃত্তিকার ফোনে মেসেজ করছে। গানের শব্দে নোটিফিকেশন কর্ণগোচর হয়নি যার কারণে অর্পণের মেসেজও সে দেখেনি। এরই মাঝে মৃত্তিকার হাতে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠল৷ সেই সঙ্গে কেঁপে উঠল মৃত্তিকা৷ হুট করে এমন হওয়ায় কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে সে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অর্পণ কল করেছে। মৃত্তিকা কল কেটে দিল। এই মুহূর্তে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার৷ অর্পণও থেমে নেই৷ দিব্যি সে আরশকে দিয়ে খবর পাঠিয়েই দিয়েছে৷ এত মানুষের মাঝেও মৃত্তিকাকে খুঁজে বের করল। তনুজা বসে স্টেজের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ আরশ হুট করেই মৃত্তিকার সামনে এসে দাঁড়াল। সে বলল‚
“ভূমি! স্যরি মৃত্তিকা আপনাকে ইরা ডাকছে।”
“আমাকে কেন ডাকছে?”
ক্ষীণ হেসে আরশ বলল‚ “আমি কী করে বলব ম্যাম! আপনি গিয়েই নাহয় শুনে নিন।”
আর কিছু বলল না মৃত্তিকা। আরশ চলে গেল। একটু পরেই তার আর তৃপ্তির পারফরম্যান্স রয়েছে৷ সে ভীষণ এক্সাইটেড। ভালো লাগার মানুষের সঙ্গে নাচবে বলে কথা৷ অবশ্য দুদিন নাচের রিহার্সাল করেছিল ওরা৷ মৃত্তিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তনুজাকে বলল‚ “মামনি তুমি একটু বোসো আমি এক্ষুনি আসছি।” এই বলে নিজের ব্যাগ আর ফোনটা তনুজার কাছে দিয়ে সে অর্পণ আর ইরার কাছে চলে গেল। ওরা কিছুটা দূরে সামনের টেবিলে বসেছে। মৃত্রিকা গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াতেই অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“কোথায় ছিলিস? জেঠিমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস?”
অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্বরে মৃত্তিকা বলল‚ “কষ্ট পাওয়া কথা ছিল বুঝি? তবে উনার এসব কথা আজ আর গায়ে মাখি না।”
“তাহলে মন খারাপ করে আছিস কেন? ভাইয়ের বিয়েতে বুঝি মুখ ভার করে থাকবি?”
নিমিষেই মুখে হাসি ফুটিয়ে মৃত্তিকা আবারও বলল‚ “তোমার কী তাই মনে হচ্ছে? কিন্তু আমি তো মুখ ভার করে নেই। এই দেখ আমি হাসছি।”
অর্পণ মনে মনে কিছু একটা ভাবল৷ মৃত্তিকার কাছে তার একটা আবদার রয়েছে৷ সে জানে না এখন এই মুহূর্তে এই আবদার করাটা ঠিক হবে কি-না! মৃত্তিকার মনটা এমনিতেই খারাপ সে তা খুব ভালোই বুঝতে পারছে৷ তবুও বলতে ইচ্ছে করল। অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও তো তার বোনের মনটা ভালো হবে। অর্পণ এবার কিছুটা আমতা আমতা করে বলল‚
“তোকে আমার একটা আবদার রাখতে হবে বোন।”
আবদারের কথা শুনে অবাক হয়ে মৃত্তিকা শুধাল‚ “আবার কী আবদার ভাইয়া?”
“ওদের পারফরম্যান্স শেষ হলেই তুই নাচবি।”
“এখন নাচানাচি করার মন মানসিকতা নেই আমার। তুমি একটু বোঝার চেষ্টা কর ভাইয়া।”
“একটা দিনই তো প্লিজ! আমি আমার বিয়েটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই।”
মৃত্তিকা এবার ইরার দিকে তাকিয়ে বলল‚ “ইরা তুমি প্লিজ ভাইয়াকে বোঝাও।”
“আমি কী বলব? এটা তোমাদের ভাই বোনের মধ্যেকার ব্যাপার।”
দূর থেকে সবটাই দেখছে প্রলয়। গান বাজনার কারণে কোনো কিছুই শোনা যাচ্ছে না৷ স্টেজে পূর্ণতা পুষ্পিতা নাচছে৷ ফটোগ্রাফার ভিডিও করছে। ওদের পরে হয়তো আরশ-তৃপ্তি আর অর্পণ-ইরা একসঙ্গে পারফরম্যান্স রয়েছে৷ অর্পণের ইচ্ছে ছিল প্রলয় আর মৃত্তিকাকে একসঙ্গে একটা কাপল পারফরম্যান্স করানোর৷ কিন্তু তার উপায় আপাতত নেই৷ তার বোন এমনিতেই তার উপর ক্ষেপে আছে৷ প্রমিজের দোহাই দিয়ে যাচ্ছেতাই করিয়ে নিচ্ছে সে। না জানি কখনো মৃত্তিকা রেগেমেগে আগুন হয়ে যায়৷ বহু কষ্টে একটা পারফরম্যান্সের জন্য রাজি করিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে…
আরিজিৎ সিং আর শ্রেয়া ঘোষালের একটা রোমান্টিক গান বাজছে। স্টেজে রয়েছে আরশ-তৃপ্তি আর অর্পণ-ইরা। ওরা মূলত কাপল পারফরম্যান্স দিচ্ছে। রিহার্সাল করেছিল সবাই মিলে।
মন একে একে দুই‚ একাকার আমি তুই
আর না চোখ ফিরিয়ে‚ একটু হাস
নেই মনে কি কিছুই? তোর ঠোঁটের ডানা ছুঁই
মিলবে সব জীবনের ক্যালকুলাস
স্মৃতিরা গেছে পরবাস‚ কথারা হয়েছে নিঝুম
এ বুকে তবু বারো মাস
ভালোবাসারই মরশুম‚ ভালোবাসারই মরশুম
ডাকনামে ডেকে যাই‚ সেই আগের তোকে চাই
সেই যে সেই তাকালেই সর্বনাশ
ঝড় এলে তুই সাথে থাকলে কী ভয়
তোর ঠিকানায় পাঠালাম এ হৃদয়
প্রেম হলে এক সুরে গান বেজে যায়
সে দেয় জখম, তবু সেই তো ভেজায়
ব্যথারা ফিরেছে এপাশ‚ বালিশে জমে ভাঙা ঘুম
এ বুকে তবু বারো মাস
ভালোবাসারই মরশুম‚ ভালোবাসারই মরশুম
দিন বদলে যাবে ফের‚ হাত ধরে সময়ের
ফুটবে ঠিক মনমাফিক মন-পলাশ (৩)
ওদের পারফরম্যান্স শেষ হলেই সবাই করতালি দিতে শুরু করল। অনেকে তো শিস বাজাচ্ছে। এবার স্টেজে দাঁড়িয়ে ইরা ঘোষণা করল‚ তার বান্ধবী মৃত্তিকা একটা সুন্দর নাচ সবাইকে উপহার দিতে চলেছে৷ প্রলয় মনে মনে হাসল। কী নাটকটাই না করছে ওরা! অথচ ওরা জানেই না যে‚ প্রলয় অনেক আগেই মৃত্তিকার সত্যিটা জেনে গিয়েছে৷ সে চায় না এক্ষুনি মৃত্তিকাকে এ কথাটা বলতে৷ প্রলয় একটা কথা ভেবে পাচ্ছে না‚ মৃত্তিকা তো এখানে রয়েছে সঙ্গে তনুজা রায়চৌধুরীও এসেছেন৷ তবে তাদের সন্তান? তাকে তো কোথাও দেখতে পেল না সে। তাকে কী অন্য কারো কাছে রেখে এসেছে? আর কিছু ভাবতে পারল না প্রলয়। সে এবার সামনে এসে অর্পণের পাশে বসল। মৃত্তিকাকে স্টেজে ডাকল ইরা। শিকদার বাড়ির সবার সামনে নাচতে হবে ভেবে খানিকটা ইতস্ততবোধ করল মৃত্তিকা৷ তবুও সে স্টেজে গেল। তাকে দেখে চোক্ষু চড়কগাছ মেহরাব শিকদারের। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। ইরা স্টেজ থেকে নেমে গেল। রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে। মৃত্তিকা তার শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে নিয়েছে৷ সামনেই প্রলয়কে এভাবে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ঘাবড়াল৷ পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে মনে সাহস সঞ্চার করল৷ এখানে এই মানুষগুলোর সামনে নাচার কোনো ইচ্ছেই নেই তার। শুধুমাত্র নিজের ভাইয়ের মন রক্ষার্থে একটা পারফরম্যান্সে অংশগ্রহণ নিচ্ছে৷
কিছু স্বপ্ন‚ কিছু মেঘলা‚ কিছু বইটই ধূলো লাগা
কিছু ইচ্ছে‚ সাড়া দিচ্ছে‚ এই বসন্ত রাত জাগা
মম চিত্তে‚ পাশ ফিরতে আজ পলাশ ফুলের কাব্য
নীতে নৃত্যে‚ ফুল ছিড়তে শুধু তোমার কথা ভাবব
আজ হাওয়া বেপরোয়া দিল সন্ধ্যে পাখির ঝাঁক
এই বিকেল আর বেল ফুল হৃদ মাঝারে থাক
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…লাগল
নীল দিগন্তে বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল… বসন্তে
নীল দিগন্তে!
দিগন্তে সুরের আগুন‚ জ্বলছে অবুঝ ফাগুন (২)
করছে কী ভয়-টয়‚ মন হলে নয়-ছয়
পাতা ঝরার মরশুম
আজ হাওয়া বেপরোয়া দিলো সন্ধ্যে পাখির ঝাঁক
এই বিকেল আর বেল ফুল হৃদ মাঝারে থাক
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…লাগল
নীল দিগন্তে বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল… বসন্তে
নীল দিগন্তে!
কিছু স্বপ্ন‚ কিছু মেঘলা‚ চোখে চোখ রাখা একরত্তি
কিছু ইচ্ছে‚ সাড়া দিচ্ছে‚ মন ইতিউতি‚ তিন সত্যি
তারই সঙ্গে-বিভঙ্গে দেখি কী হয় ভালো মন্দে
কী মৃদঙ্গে‚ সে তরঙ্গে এলো ঢেউ কুচকুচ সন্ধ্যে
আজ হাওয়া বেপরোয়া দিলো সন্ধ্যে পাখির ঝাঁক
এই বিকেল আর বেল ফুল হৃদ মাঝারে থাক
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…লাগল
নীল দিগন্তে বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল… বসন্তে
নীল দিগন্তে!
মৃত্তিকার নাচের সঙ্গে লম্বা বিনুনি দুলে উঠছে৷ চুল থেকে খুলে পড়েছে গাঁদা ফুলের মালাটা। হয়তো চুলে ঠিক করে লাগানো হয়নি। ফুলের মালাটা যে পড়ে গিয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই মৃত্তিকার। সে এক কোণে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। গরম লাগছে কিছুটা। কোমরে গুজে রাখা শাড়ির আঁচল নামিয়ে নিল সে। হুট করেই মনে হলো শীতল হাওয়া তার দিকেই আসছে৷ আশেপাশে তাকিয়ে দেখল‚ স্ট্যান্ডিং ফ্যান তার দিকেই তাক করা৷ কই এতক্ষণ তো ফ্যান এখানে ছিল না! হঠাৎ করে কোত্থেকে উদয় হলো? কেউ কী ফ্যানটাকে এদিকে তাক করে দিয়েছে?
স্টেজে মৃত্তিকাকে দেখে হতভম্ব মেহরাব শিকদার। তিনি ভাবতেই পারছেন না ভূমি এখনো বেঁচে আছে৷ পৃথিবী গোলাকার তার মানে এই নয় উনার জীবনটাও গোলাকার হতে হবে৷ নাছোড়বান্দা অতীত কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করল। তিনি দাঁড়ানো থেকে হঠাৎ করে চেয়ারে বসে পড়লেন৷ ডান হাত দ্বারা ক্রমাগত বুকের বাঁ পাশটায় ডলছেন৷ চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে৷ অতিরিক্ত চিন্তায় যেন মুহূর্তেই উনার প্রেসার ফল করতে শুরু করেছে। ফ্যানের বাতাসও যেন গরম লাগতে শুরু করেছে৷ পাঞ্জাবির বোতাম দুটো খুলে ফেললেন। ঘামছেন কিছুটা৷ ফিরোজা খেয়াল করলেন বিষয়টা৷ স্বামী এহেন অবস্থায় দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়লেন। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚
“অ্যাই তোমার কী হলো? এমন করছ কেন?”
বুকে হাত রেখেই মেহরাব শিকদার বললেন‚ “ফিরোজা আমার শরীরটা খারাপ লাগছে।”
“দাঁড়াও আমি অর্পণকে ডাকছি।”
মেহরাব শিকদার উনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন‚ “তুমি কী পাগল হলে? এমন একটা দিনে ছেলেটাকে দুশ্চিন্তা দেবে? একটু বিশ্রাম নিলেই আমি ঠিক হয়ে যাব৷”
“তাহলে আরশকে ডাকি? তোমার কোথায় অস্বস্তি হচ্ছে আমাকে বল!”
“বুকে খানিকটা ব্যথা হচ্ছে।”
“তুমি বলছ খানিকটা! তুমি একটু বোসো— আমি আরশকে ডাকছি।”
মেহরাব শিকদারকে বসিয়ে রেখে ফিরোজা চলে গেলেন আরশকে ডাকতে৷ স্বামীর জন্য ভীষণই চিন্তা হচ্ছে উনার৷ হুট করে লোকটার কী হলো? এতক্ষণ তো ঠিকই ছিলেন। এরই মাঝে তিনি আরশকে নিয়ে চলেও এলেন। আরশ এই আশেপাশেই ছিল। সে এসে মেহরাব শিকদারে পালস চেক করল৷ বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে কে আর স্টেথোস্কোপ সঙ্গে নিয়ে ঘুরে? তবে মেহরাব শিকদারের অবস্থা অনুমান করে আরশ বলল‚
“আঙ্কেল আপনি কী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছেন? তাহলে প্লিজ সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিন। আপনাকে বেশি বেশি বিশ্রাম নিতে হবে।”
“অর্পণকে এ ব্যাপারে কিছু বোলো না বাবা। বুঝতেই তো পারছ ওর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই দিনগুলো একবার চলে গেলে আর ফিরে আসবে না। আমি ওকে চিন্তায় ফেলতে চাইছি না।”
“আমি অর্পণকে কিছু জানাচ্ছি না। তবে আপনাকে আশ্বাস দিতে হবে যে‚ আপনি সময় মতো খাওয়া আর নিজের যত্ন নেবেন।”
প্রত্যুত্তরে শুধু গাল এলিয়ে হাসলেন মেহরাব শিকদার। ফিরোজা এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন স্বামীর দিকে।
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
কাল রাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বেশ রাত করে শেষ হয়েছিল৷ অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় না চাইতেও প্রলয়ের গাড়ি করে বাড়ি ফিরতে হয়েছে মৃত্তিকা আর তনুজাকে। অর্পণ তো ব্যস্ত ছিল৷ এত রাতে একা যাওয়ার সাহসও পাচ্ছিল না মৃত্তিকা৷ তার মাঝে একটা ভয় আজও থেকে গিয়েছে৷ এভাবে একরাতে একা বের হয়ে নিজের জীবনের সবথেকে বড়ো ক্ষতিটাই তো সে করেছিল। ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক সেটা সে চায় না। মেহরাব শিকদার পুনরায় মৃত্তিকাকে দেখে হয়তো নিজের দোষ গুণ সব গুলিয়ে ফেলছেন। না জানি কখন কী করে বসেন! আবার কার ক্ষতি করায় মত্ত হন! সেইজন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রলয়ের সঙ্গে ফিরতে হয়েছে তাকে৷ পথে কেউ কারো সঙ্গে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি। প্রলয়ের এহেন চুপ করে যাওয়াটা মৃত্তিকার ঠিক বলে মনে হলো না। এমনিতে তো প্রলয় চুপ করে থাকার লোক নয়। এর আগেও যতবার তাদের দেখা হয়েছে ততবারই প্রলয় নিজে থেকে কথা বলার চেষ্টা করেছে! না জানি কোন প্যাঁচ কষছে! লোকটা কথার জালে ফেলতে ওস্তাদ। পথিমধ্যে কাল তনুজার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছে প্রলয়। আজকের পুরোটা দিন কেমন পানসে যাচ্ছে! বাতাবরণ ম্লান করেছে। রোদ নেই আবার বৃষ্টির দেখাও মিলল না৷ কেমন একটা গুমোট রূপ ধারণ করেছে প্রকৃতি! এমন পরিবেশ মোটেও পছন্দ নয় মৃত্তিকার। তনুজাকেও ঘর থেকে বের হতে দেয়নি। দুপুরের রান্নাটাও সে নিজেই করেছে৷ তনুজার জন্য আলাদা করে বেগুন ভাজা আর সবজি করে দিয়েছিল৷ সেগুলোই মা মেয়েতে মিলে খেয়েছিল। এরপর দুজনের বাকি সময়টা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই পাড় হয়েছে। সন্ধ্যের পর মৃত্তিকা আর তনুজা বের হবে৷ বিয়ে পড়ানো হবে এশারের নামাযের পরপরই।
মালঞ্চ নীড়…নিজেদের রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত পূর্ণতা‚ পুষ্পিতা‚ তৃপ্তি আর লামিয়া৷ ফেস মাস্ক লাগিয়ে চারজন চার জায়গায় বসে রয়েছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করা৷ অন্যকারো ঘরের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি নেই৷ কিছুক্ষণ পরেই ওরা সাজুগুজু শুরু করে দেবে। একজন আরেকজনের চুল স্ট্রেইট করে দিচ্ছে তো আরেকজন কার্লি করছে। ওদের চারজনের গাউন হুবহু একইরকম। ফিরোজা আর মাধুরীর শাড়িও প্রায় মিলে যায়। সাবিনার জন্যও ম্যাজেন্টা রঙা থ্রিপিস দেওয়া হয়েছে। আর ছেলেদের সবার একই পাঞ্জাবি। অর্পণকে বাদ দিয়ে শিকদার বাড়ির সকলে ম্যাজেন্টা রঙা ড্রেসআপে থাকবে। শুধুমাত্র অর্পণ আর ইরা লাল শেরওয়ানি আর লেহেঙ্গা পরিধান করবে। বিয়ের উৎসব আমেজে কমিউনিটি সেন্টার সেজে উঠবে লাল রূপে৷ এশারের নামাযের পরপরই অর্পণ আর ইরার বিয়ে পড়ানো শুরু হবে৷
সাড়ে সাতটায়…
আজ তনুজাকে নিয়ে সময় হবার সঙ্গে সঙ্গেই চলে এসেছে মৃত্তিকা৷ নিমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব বর কনেকে স্টেজে বসানো হয়েছে। ফটোগ্রাফার নিজেদের মতো করে ছবি তুলছে। অতিথিরা এসেও ছবি তুলে যাচ্ছে। কাজিনমহলের বাকিরা ছবি তুলছে৷ সবার যে যার মতো ব্যস্ত৷ ক্যাটারিং এ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ অতিথিরা ইতিমধ্যেই খাবার খাওয়া শুরু করে দিয়েছে৷ ক্যাটারিং এর লোকেরাই খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে৷ মৃত্তিকা তখন তনুজাকে নিয়ে একটা টেবিলে বসে ছিল৷ অর্পণের সঙ্গে আগেই দেখা করে এসেছে৷ ছবিও তুলেছে কয়েকটা৷ তনুজাকে ওরা পাশেই বসিয়ে রেখেছে৷ অহেতুক কারো সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অপমানিত হতে হবে তাই উনাকে আর কোথাও যেতে দেয়নি সে৷ এরই মাঝে তৃপ্তি এসে জোর করে তার কাছ থেকে তনুজাকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে গেল৷ তনুজার পুরোপুরি খেয়াল রাখবে বলেও আশ্বাস দিল৷ মৃত্তিকা রাজি হয়ে গেল৷ তনুজাকে নিয়ে চলে যেতে প্রলয় এসে তার সামনে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল‚
“আর কত নিজেকে আমার থেকে আড়াল করবে?”
বুঝেও না বুঝার ভান করে মৃত্তিকা শুধাল‚ “আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?”
“তুমি সব বুঝেই এমন অবুঝের মতো আচরণ কেন করছ ভূমি কন্যা?”
“আপনাকে ঠিক কতদিন বললে আপনি বিশ্বাস করবেন‚ আমি ভূমি নই— মৃত্তিকা!”
“সারা দুনিয়াকে এ কথা বিশ্বাস করাতে পারলেও আমি বিশ্বাস করব না৷”
“আপনার বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আমার কোনো যায় আসে না। কিপ ডিসটেন্স ফর্ম মি!”
প্রলয় এবার মৃত্তিকার ডান হাতের কনুই ধরে বলল‚ “এক বছরের দূরত্ব কী কম ছিল?”
নিজের হাতটাকে ঝেড়ে সরিয়ে নিল মৃত্তিকা৷ প্রলয় তার হাত ছুঁয়েছে ভেবে রাগে গা রিনরিন করছে। শান্ত মোলায়েম কণ্ঠস্বরে নিমিষেই উঁকি দিল রুষ্টতা৷ মৃত্তিকা দাঁতে দাঁত চেপে বলল‚
“এই অনুষ্ঠানের জায়গায় আমি চাইছি না নতুন করে কোনো সিনক্রিয়েট করতে৷”
প্রলয়ের নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আজ সে মৃত্তিকার মুখ থেকে সমস্ত সত্যিটা জেনেই ছাড়বে৷ সেও ফিসফিসিয়ে বলল‚
“সাইডে এসো কথা আছে।”
মৃত্তিকা সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল‚ “আমার আপনার সঙ্গে কোনো কথা নেই। দেশের এমপি হয়ে আপনি বুঝি অচেনা মেয়েদেরকে এভাবেই সাইডে ডাকেন?”
“অন্যদের ডাকি কি-না জানা নেই তবে তোমাকে ডাকছি যখন— দ্যাট মিনস ইউ আর স্পেশাল!”
“আপনার ফালতু বকবকানি আপনার কাছেই রাখুন।”
মৃত্তিকা চলে যেতে নিলে প্রলয় তার হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে চলে যায়৷ তনুজাকে তৃপ্তির কাছে রেখে এসেছে প্রলয়। এখানে আসার পর থেকে মৃত্তিকাকে চোখে চোখে রাখছিল সে। কখন একা পাবে আর নিজের কথাগুলোকে উগলে দিতে পারবে সেটারই সুযোগে ছিল! তখন ইচ্ছে করেই তনুজাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল তৃপ্তি। প্রলয়ের কথাতেই সে এমনটা করেছে৷ এদিকে প্রলয়কে মৃত্তিকার সঙ্গে সঙ্গে দেখে গুলবাহার উনার মেয়েকে বললেন‚
“মাধুরী তোর ছেলে ওই মেয়ের পিছু পিছু ঘুরছে কেন— ভূমির মতো দেখতে বলে?”
মাধুরী বিরক্ত হয়ে বললেন‚ “আহ্ মা তুমি এ সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না৷ আমি চাই না প্রলয়ের কোনো বিষয়ে আমি তুমি বা অন্যকেউ মাথা ঘামাক।”
“হুট করে ভোল পাল্টে ফেললি কেন? এতদিন তো তুই-ই ভূমির বিপক্ষে ছিলি। মেয়েটা মরেও নাকি শান্তি দিচ্ছে না এমনটাই বলছিলি।”
“ভুল করেছি আমি। যার জন্য আমার নিজের ছেলের সঙ্গেই দূরত্ব বেড়েছে৷ ছেলেটা আমার আগের মতো নেই৷ নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে৷ কিন্তু আমি তো মা! ছেলের মনের খবর আমি বুঝতে পারি৷ সেদিন আমার এত এত মিথ্যে বলা উচিত হয়নি। ওদের ভুলবোঝাবুঝি সৃষ্টি কারণ তো আমি নিজেই৷ মেহরাবের কথায় আমার ছেলেটা খুশি হতে গিয়েও খুশি হতে পারেনি। ভূমি আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল আর মেহরাব বলেছিল দু সপ্তাহের। মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করার তাড়ানায় মা হয়ে আমি আমার ছেলের মনটাকে বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। রাগে বশবর্তী হয়ে জীবনের সকল ভুল কাজগুলো আমি করেছি।”
মেয়ের চোখে তীব্র অপরাধবোধ লক্ষ্য করলেন গুলবাহার। মেয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এটাই বা কম কীসের? ক্ষীণ হেসে বললেন‚
“নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো তোকে করতেই হবে৷ একটা মেয়ের উপর কম অত্যাচার করিসনি তুই! আমি মা হয়ে লজ্জিত। আমার শিক্ষায় হয়তো কোনো ত্রুটি ছিল! তোরও তো দুটো মেয়ে আছে। এমনটা যদি তোর মেয়ের সঙ্গেও হত তখন?”
মাথা নিচু করে সবটাই শুনলেন মাধুরী। কিছুই বলার নেই উনার। এদিকে মৃত্তিকাকে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টার দোতলায় এসেছে প্রলয়। এই জায়গাটা খালি। এখানে আপাতত কেউ-ই আসবে না। মৃত্তিকা আর সে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আজ সে মৃত্তিকার কাছ থেকে সমস্ত সত্যিটা জেনেই ছাড়বে৷ সে শুধাল‚
“কেন বারবার তুমি আমার কাছে নিজের পরিচয় লুকোচ্ছ ভূমি কন্যা? একটা ভুলের শাস্তি আর আমাকে কত কাল পেতে হবে?”
মৃত্তিকা মুখ ফুটে কিছু বলবে তার আগেই প্রলয় তার সামনে সেই ডিএনএ রিপোর্টটা তুলে ধরল৷ মৃত্তিকা প্রথমে বুঝলা না এটা কীসের কাগজ৷ তার অবস্থা বুঝতে পেরে প্রলয় নিজে থেকেই বলল‚
“এটা ডিএনএ রিপোর্ট! এখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে তুমিই ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি!”
“আপনার রিপোর্টে ভুল আছে মি. সেহরিশ আরশান প্রলয়।”
“আর কত? এবার তো স্বীকার কর।”
“মিথ্যে স্বীকার করে লাভ কী?”
“আমি তো কোনো মিথ্যে স্বীকার করতে বলছি না। তোমার জাস্ট সত্যিটা বলতে বলছি। কেন তুমি মিথ্যে পরিচয় বহন করছ? নিজের অস্তিত্বকে কেন বিলুপ্ত করে দিচ্ছ ভূমি কন্যা?”
“চুপ করুন! এই নামটাকে আমি ঘৃণা করি। আর এই নামের সাথে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষকে আমি ঘৃণা করি। চলে যান আমার চোখের সামনে থেকে।”
নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে মৃত্তিকা৷ কী থেকে কী বলছে সে নিজেও জানে না৷ প্রলয় আবারও বলল‚
“এত ঘৃণা কেন? আবার কী সব আগের মতো করে নেওয়া যায় না? আমাদের একটা ছোট্টো পরিবার হবে৷ যেখানে তুমি আমি আর আমাদের সন্তান।”
সন্তানের নাম শুনতেই শিরায় উপশিরার র’ক্ত ছলকে উঠল৷ হাত পা কাঁপছে মৃত্তিকার৷ মাথা ঝিমঝিম করছে। পুরোনো ক্ষ’ত তাজা হয়ে উঠছে৷ প্রলয়ের পাঞ্জাবির উপর থাকা কটিটা শক্ত করে ধরে মৃত্তিকা বলল‚
“শুধুমাত্র আপনার একটা ভুলের কারণে আমার সন্তান পৃথিবীর আলোটুকু দেখতে পারেনি। ওরা মে’রে ফেলেছে তাকে সেই সঙ্গে ভূমি সত্তাকেও মে’রে দিয়েছে ওরা। সবকিছুর জন্য দায়ী আপনি। প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি একটু একটু করে তড়পেছি। আমার কষ্টটা যদি আপনি একাংশিকও অনুভব করতেন তাহলে আমাকে অবিশ্বাস করতে পারতেন না। আমি আপনার কাছে একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম আর আপনি আমাকে অপূর্ণতা আর বিষণ্ণতা ছাড়া কিছুই দিতে পারলেন না৷ এ জীবনে আমি আপনাকে কখনোই ক্ষমা করব না এমপি মশাই।”
মৃত্তিকা কাঁদছে। খুব করে কাঁদছে৷ কেঁদে নিজের মনকে হালকা করার চেষ্টা করছে। এতদিনের জমে থাকা রাগটাকে বের করার চেষ্টা করছে৷ মৃত্তিকার কথাগুলো বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হলো প্রলয়ের৷ তার জীবনের সবথেকে বড়ো পাপটা সে করেছে৷ কিছু বলার মতো ভাষা আজ অবশিষ্ট নেই৷ পা দুটো অসাড় হয়ে আসছে৷ নিস্তব্ধ‚ নির্বাক প্রলয় মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল৷ সেদিন তার একটা ভূলের জন্য একটা নিষ্পাপ প্রাণকে ম’রতে হয়েছে৷ সবকিছুর জন্য দায়ী সে৷ প্রলয়কে এমতাবস্থায় দেখে তাচ্ছিল্য করে হাসল মৃত্তিকা। যাওয়ার আগে শুধু কয়েকটা কথাই বলে গেল‚
“এই মৃত্তিকা তার আম্মার খুনিকে নিজের হাতে শাস্তি দেবে৷ সে মৃ’ত্যুর জন্য একটু একটু করে তড়পাবে৷ তাকে খুব সহজ মৃ’ত্যু দেব না আমি৷ যেভাবে আমার আম্মাকে তড়পাতে তড়পাতে ম’রতে হয়েছিল ঠিক সেভাবেই তাকে মা’রব আমি। তার পাপের সম্রাজ্যেই তার মৃ’ত্যু হবে।”
অর্পণ ইরার বিয়ে পড়ানো হচ্ছে৷ শিকদার বাড়ি আর মোড়ল বাড়ির সকলেই সেখানে উপস্থিত৷ অর্পণ অনেকবার মৃত্তিকাকে মেসেজ করেছে তাড়াতাড়ি করে যেন সামনে চলে আসে। কিন্তু মৃত্তিকার কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর আসেনি। এদিকে মৃত্তিকা কাঁদতে কাঁদতে তনুজার সামনে এসে দাঁড়াল। আপাতত এদিকে কারো ধ্যান নেই৷ সবার মনোযোগ জুড়ে রয়েছে অর্পণ আর ইরা৷ মৃত্তিকাকে এমতাবস্থায় দেখে কিছুটা হতভম্ব হলেন তনুজা। হুট করে মেয়েটার কী এমন হলো যে‚ সে এমন একটা অনুষ্ঠানের জায়গায় কান্না করছে! আবার কেউ কিছু বলেনি তো? এমন অনেক কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মৃত্তিকা তার চোখ মুখ মুছে নিল৷ তনুজা জিজ্ঞেস করলেন‚
“তোর কী হয়েছে? কাঁদছিলি নাকি?”
মৃত্তিকা ভণিতা ছাড়াই বলল‚ “মামনি আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাইছি না।”
তার এমন ব্যবহারে অবাক হলেন তনুজা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “কেন? আবার কী হলো?”
“এখানে আমি কিছু বলতে পারব না৷ তোমাকে বাড়ি গিয়ে সবটা বলছি।”
মৃত্তিকাকে একদমই স্বাভাবিক লাগছে না৷ অনেকটাই অন্যরকম লাগছে৷ হয়তো কেউ কিছু বলেছে! তা নাহলে এত সহজে মৃত্তিকার চোখ থেকে পানি ঝরত না। তনুজা আবারও জিজ্ঞেস করেলন‚
“তুই ঠিক আছিস তো মা?”
“আমি ঠিক আছি। প্লিজ চল— আমরা বাড়ি ফিরে যাই৷”
“অর্পণকে বলে যাবি না?”
“না! ভাইয়াকে বলে গেলে আমাকে যেতেই দেবে না। ওকে পরে মেসেজ করে দিলেই হবে।”
“আচ্ছা চল তাহলে। তুই তো খাবারও খেলি না৷”
“আমার এখন কোনো কিছুই গলা দিয়ে নামবে না৷ আর না এখানে আমি কোনো খাবারই খেতে চাইছি!”
মৃত্তিকা এক হাতে তার পার্স আর ফোনটা নিয়ে আরেক হাতে তনুজাকে সামলাল। এরপর দুজনে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে গেল৷ একটা সিএনজি ডেকে উঠে পড়ে পড়ল দুজনে। তার এত সুন্দর সাজটা ইতিমধ্যেই মূর্ছা গিয়েছে। আজ সে তার ভাইয়ের দেওয়া লেহেঙ্গাটা পড়েছিল। লম্বা কেশগুচ্ছকে অযত্নে কোমর ছাড়িয়ে মেলে দিয়েছিল৷ যা সাজসজ্জা ছিল তা কান্না করার ফলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ কানের পাশে ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখেছিল দুটো সাদা গোলাপ। সাদা গোলাপ নাকি শুদ্ধতার প্রতীক কিন্তু তার জীবনটাই যে অশুদ্ধ। যার মেহরাব শিকদারের মতো নরপি’শাচ একজন বাবা আছে তার জীবনটা শুদ্ধ থাকে কী করে? সমস্ত সাজ ঘেটে ‘ঘ’ হয়ে গিয়েছে। সেটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই মৃত্তিকার৷ সে তার ফোনটা বের করে অর্পণের ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে দিল৷ অনলাইনে থাকলে অবশ্যই দেখে নেবে।
“এই মুহূর্তে আমার এখানে থাকা হচ্ছে না৷ আমি মামনিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। তুমি প্লিজ এই নিয়ে আমাকে জোর কোরো না৷ আশা করি তুমি আমার কথা রাখবে।”
অন্যদিকে…
দোতলা থেকে একাই নেমে এসেছে প্রলয়৷ সে নিজের মাঝে নেই৷ তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই মুখটা সে মৃত্তিকাকে কী করে দেখাবে? একটা ভুল যে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে৷ সেদিন যদি শান্ত হয়ে ভূমির না বলা কথাগুলো শুনত তাহলে হয়তো আজকে এই দিনটার মুখোমুখি তাকে হতে হত না। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। প্রলয় তার নিজের অবস্থা কারো কাছে বলতে পারছে না৷ আর না একাকী হজম করতে পারছে৷ অসহনীয় যন্ত্রণা তাকে একেবারেই নিঃশেষ করে দিচ্ছে৷ প্রলয় তার মায়ের কাছে এসে শুধু বলল‚
“মা আমার শরীরটা খারাপ লাগছে৷ আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি৷ এই দিকটা তোমরা সামলে নিয়ো। অর্পণ কিছু জিজ্ঞেস করলে‚ বোলো আমি বাড়ি ফিরে গিয়েছি।
হুট করে প্রলয়ের কী এমন হলো মাধুরী বুঝতে পারলেন না! দিব্যি তো এতক্ষণ হাসিখুশি ছিল। প্রলয়কে মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না উরনার৷ মৃত্তিকার সঙ্গে কী তার কিছু হয়েছে? শেষ বার তো ওই মেয়েটার সঙ্গেই যেতে দেখছিলেন৷ মাধুরী শুধালেন‚
“তোর কী হয়েছে বাবা? ওই মেয়েটা কী তোকে কিছু বলেছে?”
প্রলয় সন্তপর্ণে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু মায়ের সামনে কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। হুট করেই মাধুরীকে জড়িয়ে ধরল। বর্ষিত হলো অবাধ্য অশ্রুবর্ষণ৷ কিছুটা এলোমেলো স্বরে প্রলয় বলল‚
“তোমার ছেলে মানুষ হতে পারেনি মা। তোমার ছেলে একটা খু’নি। নিজেরই সন্তানের খু’নি সে।”
প্রলয়ের এমন কথার মানে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মাধুরী। উনার কাঠখোট্টা বেপরোয়া ছেলেটার হঠাৎ কী এমন হলো? প্রলয় কাঁদছে৷ ছেলের শব্দহীন কান্না মায়ের মনকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। মাধুরী কিছু বলবেন তার আগেই প্রলয় উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল‚
“আমি একটু একা থাকতে চাই। কেউ যাতে আমাকে না খোঁজে। তুমি একটু ব্যাপারটাকে হ্যান্ডেল কোরো।”
এই বলে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে পড়ল প্রলয়। দুচোখ যেদিকে চায় সেদিকে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে৷ এই পাপিষ্ঠ মুখ আর কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করছে না। ঝাপসা চোখে রুক্ষ ভাবে ড্রাইভ করছে সে৷ ভূমিকে অনুভব করে বারবার চোখ ভিজে আসছে তার৷ নিজের আজ আর দমিয়ে রাখবে না৷ অবাধ্য অশ্রুকে আজ সুযোগ দেবে৷ তার ভুলের জন্য ভূমি যা যা কষ্ট সহ্য করেছে সব সে অনুভব করতে চায়৷ প্রলয় নিজে থেকেই বিরবির করছে‚ “আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো ভূমি কন্যা। আমি আসলে কখনো তোমার যোগ্যই ছিলাম না৷ আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তোমাকে শুধু কষ্ট আর অবহেলাই পেতে হয়েছে৷”
বাড়ি ফিরে এসেছে মৃত্তিকা আর তনুজা৷ আজ রাতে আর গলা দিয়ে খাবার নামবে না৷ তনুজা অনেকবার জোর করেছিলেন কিছু অন্তত খেয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু মৃত্তিকা যখন একবার বলেছে সে খাবে না। তারমানে সে খাবেই না। তনুজা আর জোর করলেন না। মৃত্তিকার মনের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা উনার ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। তিনি তাকে স্বাভাবিক হবার জন্য সময় দিলেন। মৃত্তিকা তখন থেকে স্বাভাবিক আচরণ করারই চেষ্টা করছে৷ এমন ভান করছে যেন কিছুই হয়নি। তনুজা তো বুঝতেই পেরেছেন কমিউনিটি সেন্টারেই কিছু একটা ঘটেছে। তিনি মৃত্তিকাকে বললেন‚
“ওখান থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে এলি কেন? তোকে কী কেউ কিছু বলেছিল?”
মৃত্তিকা অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে তনুজাকে জানাল‚ “তোমাদের এমপি সেহরিশ আরশান প্রলয় কিছু পুরোনো ক্ষ’ত আজ আবারও তাজা করে দিয়েছে৷”
সহসাই চিন্তার ভাজ পড়ল তনুজার মুখপানে। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “কী করেছে সে?”
বাঁকা হেসে মৃত্তিকা জানাল‚ “তিনি আমার সন্তানের কথা জানতে চেয়েছিলেন।”
সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা জবাব তনুজার‚ “তুই কী বললি?”
“সত্যিটাই বলেছি৷ মিথ্যে লুকোচুরির খেলায় আমি হাঁপিয়ে উঠেছি৷ এবার এ খেলার সমাপ্তি টানতে হবে৷ অনুতাপের দহনে আজ থেকে সে-ও দগ্ধ হবে৷”
“তার দোষটা কোথায়?”
চট করে তনুজার দিকে তাকাল মৃত্তিকা৷ স্বাভাবিকের থেকেও অধিক কাঁপছে কণ্ঠস্বর। মৃত্তিকা জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি এ কথা বলছ মামনি? তুমি তো সবটাই জানো।”
“জানি দেখেই তো বলছি! মানছি প্রলয় তোকে ভুল বুঝেছিল— অবিশ্বাস করেছিল। কিন্তু কিছু সত্যি তো তুইও তার কাছ থেকে লুকিয়েছিস। প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা শুরুতেই বলে দিলে হয়তো ঘটনা এতদূর গড়াত না৷ বাচ্চা নেওয়ার মতো বড়ো সিদ্ধান্তটা তুই একাই নিয়েছিস৷ একবার প্রলয়কে জানানোর চেষ্টা করেছিস তুই? শান্ত ভাবে বসে দুজনের ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেওয়া যেত৷ তোরা দুজন কী সেই চেষ্টাটুকু করেছিস? প্রলয়কে নিজের পক্ষে কোনো কিছু বলার সুযোগটা অন্তত দেওয়া উচিত ছিল৷ তুই আমাকে ভুল বুঝিস না— প্রলয়ের পাশাপাশি তোরও কিন্তু সমান দোষ রয়েছে৷ তারমানে এই নয় আমি প্রলয়ের পক্ষে কথা বলছি৷ যে ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকে না সেটা কোনো ভালোবাসাই না৷ কোন ভিত্তিতে প্রলয় তোকে অবিশ্বাস করেছিল সেটা জানার দরকার ছিল। আমি কী বলতে চাইছি— ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করিস।”
তনুজার কথাগুলো শুনে মৃত্তিকা আবারও বলল‚ “আমাকে ভালোবাসার ব্যাপারটা কী শুধুমাত্রই তার মোহ ছিল?”
“কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ রাগের মাথায় অনেক কিছুই বলে দেয়৷ পরবর্তীতে তারা সেই কথাটা বলার জন্য অনুতপ্ত হয়। আসলে মানুষ নিজের ভুলটা বুঝতে একটু বেশিই দেরি করে ফেলে। প্রলয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে৷ তোর উচিত ছিল প্রথমে তার ভ্রান্তি দূর করে এরপর সারাজীবনের মতো সরে আসা। প্রলয় যেমন তোর কথাগুলো শোনেনি‚ তুইও কিন্তু তার পরবর্তী কথাগুলো না শুনেই বেরিয়ে এসেছিস। এই দুদিন প্রলয়কে আমি খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করেছি৷ তার চোখে মুখে অনুশোচনার বেষ্টনী। সম্পর্ক তৈরি হয় বহুকালের সাধনার আর ভেঙে যায় চোখের পলক ফেলার আগেই। তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী— আশা করি আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করবি৷”
বিছানায় বসে পড়ল মৃত্তিকা। আর কোনো কিছুই ভাবতে পারছে না সে৷ প্রলয়ের ব্যাপারে তো কোনো কিছুই ভাববে না৷ এখন শুধু তার মাথায় প্রতিশোধের নেশা৷ মহুয়ার খু’নের প্রতিশোধ তো তাকেই নিতে হবে৷ এরপর এই শহর ছেড়ে তনুজাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে সে৷ মাথা ধরে এসেছে মৃত্তিকার৷ কান্না করাটা তার মোটেও ঠিক হয়নি৷ এরজন্য এখন সারারাত ঘুম হবে না তার৷ মাথা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে যেন! বসে থেকেই কয়েকবার জোরে নিশ্বাস নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। কড়া লিকারের চা না হয়ে তার এই মাথা ব্যথা চাড়বে না। মৃত্তিকা চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তনুজা৷ মেয়ের কষ্টগুলো আর সইতে পারছেন না তিনি৷ শুরু থেকেই দেখে এসেছেন মেয়েটা কষ্টই পেয়ে যাচ্ছে। এবার একটু সুখের পথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। দুটো মানুষ আলাদা আলাদা ভাবে কষ্ট পাচ্ছে৷ তাদের কষ্টের কারণটা একই কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাদের পথ আলাদা৷
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
চিন্তিত ভঙ্গিতে ক্রমাগত পায়চারি করছেন মাধুরী। প্রলয় এখনো বাড়ির ফেরেনি। তাকে খুঁজতেই বের হয়েছেন মোর্শেদ শিকদার আর মেহরাব শিকদার। কিছুক্ষণ আগেই অর্পণ আর ইরাকে বরণ করে বাড়িতে আনা হয়েছে। অর্পণ যেতে চেয়েছিল।কিন্তু বাড়ির অন্যরা কিছুতেই তাকে বের হতে দিলেন না। প্রলয়ের জন্য বাড়ির প্রত্যেকেই খুব চিন্তা করছেন৷ চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক নয় কী? এই তো কিছুদিন আগে এত বড়ো একটা ফাড়ার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে৷ দুদিন হসপিটালে থাকতে হয়েছে। তখন কমিউনিটি সেন্টার থেকে ছেলেকে একা পাঠানোটাই বোকামি করেছেন মাধুরী৷ ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন তিনি৷ বাড়ি ভরতি মেহমান৷ অন্যদিকে লেকের ধারে একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়। তখনকার বলা মৃত্তিকার প্রত্যেকটা কথা কানে এখনো বাজছে। সে কিছুতেই মানতে পারছে না— তাদের অনাগত সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই চলে গিয়েছে। মৃত্তিকাকে সেদিন এই লেকের ধারেই পেয়েছিল প্রলয়। আজও সে এই জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মৃত্তিকার এই জীবনের জন্য একমাত্র দায়ী সে নিজেই৷ প্রলয় খুব করে ভাবছে‚ মহুয়াকে কে খুন করেছে? ভূমিকে মে’রে ফেলার চেষ্টার পেছনে কার হাত ছিল? সব সত্যির উন্মোচন তাকেই করতে হবে। প্রলয় বুঝল এর পেছনে অনেক বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে। কেউ একজন খুব ঠান্ডা মাথায় প্রত্যেকটা পরিকল্পনা করেছে। তার ভুমি কন্যাকে কষ্ট দেওয়ার পেছনে যারই হাত থাকুক না কেন‚ সে তাকে চরম শাস্তি দেবে। অপরাধীর শরীরের প্রত্যেকটা অংশ কুমিরকে খাওয়াবে। এর পেছনে যদি বিরোধীদলীয় নাজিম চৌধুরীর হাত থেকে থাকে তাহলে তাকেও শাস্তি দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না সে। এর জন্য যদি তাকে জেলেও যেতে হয় তবুও সে পিছুপা হবে না। এক একটাকে দেখে ছাড়বে।
রাত তখন সাড়ে এগারোটা৷ বারান্দায় বসে রয়েছে মৃত্তিকা৷ তনুজার কথাগুলো তাকে গভীর ভাবে ভাবাচ্ছে৷ একটা কথা তো ঠিক— সেদিন প্রলয়ের কোনো কথা না শুনেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ নিজের পক্ষে কথা বলবে সেই সুযোগটা পর্যন্ত সে প্রলয়কে দেয়নি৷ তবুও প্রলয়ের প্রতি চাপা অভিমানের পাহাড় আকাশসম৷ সহজে ভাঙবে না৷ প্রলয়কে তার শাস্তি পেতে হবে৷ তার ভালোবাসা যদি নিঃস্বার্থই থাকত তাহলে অবিশ্বাস শব্দটা জায়গা পেত না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃত্তিকা৷ কিছু একটা ভেবে ঘরের ভেতরে চলে গেল৷ তনুজা ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ সে তার মামনির পাশেই শুয়ে ছিল৷ ঘুম আসছিল না বিধায় বারান্দায় গিয়েছিল৷ কিছুক্ষণ সময় কাটাল৷ প্রলয়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে আজ৷ কেমন একটা অদ্ভুত গুমোট অনুভূতি হচ্ছে! মৃত্তিকা বুঝতে পারছে না। কোনো কিছুতেই যেন শান্তি নেই৷ ঘরে এসে চার্জিং এ বসিয়ে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করল৷ এই নাম্বারটা আর কারোর না‚ মেহরাব শিকদারের৷ নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী আর মাত্র তিনদিন সময় আছে মেহরাব শিকদারের কাছে। সময় ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে৷ মুখোশ উন্মোচন করার সময় হয়ে আসছে যে!
অন্যদিকে মেহরাব শিকদার আর মোর্শেদ শিকদার একটা লেকের ধারে এসেছেন৷ প্রলয়ের গাড়িটা শেষ বার এখানেই দেখা গিয়েছে। লেকের ধারে গাড়ি পড়ে আছে কিন্তু প্রলয় কোথাও নেই! ওকেই মূলত খুঁজছেন উনারা৷ এমন সময় একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এলো মেহরাব শিকদারের ফোনে৷ প্রথমত তিনি রিসিভ করলেন না৷ একমাত্র ভাইপোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আপাতত তাকেই খুঁজে বের করা উচিত। কিন্তু পরপর কয়েকবার রিং হওয়ায় খুবই বিরক্ত হলেন তিনি৷ কল রিসিভ করে রাগান্বিত স্বরে বললেন‚
“দেখছেন কল রিসিভ করছি না তার মানে‚ ‘ব্যস্ত অথবা বিরক্ত’ দুটোর একটা তো হবেই। এতটুকু কমন সেন্স নেই? বারবার কল করে বিরক্ত করছেন কেন?”
মৃত্তিকা শান্ত মোলায়েম কণ্ঠস্বরে বলল‚ “আস্তে ডক্টর মেহরাব শিকদার!”
মেয়েলি কণ্ঠ কিছুটা চেনা মনে হলো। কোথাও একটা শুনেছেন বোধহয়! মেহরাব শিকদার শুধালেন‚ “কে বলছেন?”
আফসোসের সুরে মৃত্তিকা আবারও বলল‚ “এ কী এত সহজে ভুলে গিয়েছেন? আমি আপনার পরিচিত একজন বলছি।”
“সেটা তো বুঝতেই পারছি৷ কিন্তু কে আপনি?”
“গেস করুন তো— কে আমি!”
যারপরনাই বিরক্ত হলেন মেহরাব শিকদার। এত হেয়ালি সহ্য হচ্ছে না উনার৷ তাই তিনি বললেন‚ “আশ্চর্য! আপনি পরিচয় না দিলে আমি বুঝব কী করে?”
“যাকে মে’রে ফেলার জন্য খু’নি মেহরাব শিকদার নরপিশাচে পরিনত হয়েছে‚ সে তার কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারছে না? লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেলে হবে?”
কেঁপে উঠল মেহরাব শিকদারের কণ্ঠনালি। কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন‚ “ভ..ভূমি!”
অপাশ থেকে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। মেয়েটা বলল‚ “উঁহু! আমি মৃত্তিকা।”
মোর্শেদ শিকদারের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এলেন মেহরাব শিকদার। না জানি কথা বলার সময় ভাইয়ের সামনে বেফাঁস কথাবার্তা বেরিয়ে যায়৷ কিছুটা চিন্তা তো অবশ্যই হচ্ছে উনার। মোর্শেদ শিকদারকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে মেহরাব শিকদার একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। ফোনটা আবারও কানের কাছে নিয়ে বললেন‚
“তুমি বেঁচে আছ?”
“ম’রে যাওয়া উচিত ছিল তাইনা?”
মেহরাব শিকদার ক্রমশ ঘামছে৷ মৃত্তিকাই যে ভূমি হবে এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন৷ দুদিন ধরে মৃত্তিকাকে গভীর ভাবে অবলোকন করছিলেন তিনি। মেহরাব শিকদারকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে মৃত্তিকা বলল‚
“কী হলো মেহরাব শিকদার— ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?”
ভাবনার ঘোর কাটল যেন! শুকনো ঢোক গিলে গলা পরিষ্কার করলেন মেহরাব শিকদার। প্রত্যুত্তরে বললেন‚ “মেহরাব শিকদার এত সহজে ভয় পায় না৷ সে হচ্ছে গভীর সমুদ্রের মাছ। তাকে দাবিয়ে রাখা অত সহজ না৷ তুমি এখনো মানুষ চেননি মেয়ে!”
“আপনিও এখনো আমাকে চিনলেন না। সমস্যা নেই খুব শীগ্রই চিনে যাবেন৷ আপনার প্রাণ ভোমরা তো এখন আমার হাতেই৷”
কিছুটা ঘাবড়ালেন মেহরাব শিকদার। কিন্তু বিপরীত পক্ষের কাছে প্রকাশ করলেন না৷ তাহলে যে লড়াইয়ে হেরে যেতে হবে। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বললেন‚
“এখন আমার‚ তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই৷ তোমার প্রাণ ভোমরা এখন বিপদে আছে৷ তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না— এই খবরটা হয়তো তোমার কাছে পৌঁছে গেছে৷”
“আপনি ভুল ভাবছেন। এ জীবনে আমার কোনো প্রাণ ভোমরা নেই৷ তাই আমাকে ভয় দেখালেও কাজে দেবে না৷”
“বেচারা প্রলয়! আজ একটা সত্যি কথা বলি। প্রলয় তোমাকে কেন ভুল বুঝেছিল— সেটা শুনবে না?”
“আপনার থেকে আমার সেসব জানতে হবে না।”
“আরে একটু শুনেই দেখ! আমি যে আমার ভাইপো-র কষ্টগুলো সহ্য করতে পারি না৷ ছেলেটার কষ্ট চোখে দেখা যায় না৷ তবে কী করব বল— পৃথিবীতে কী মেয়ের অকাল পড়েছিল? সেই তোমাকেই বিয়ে করতে হলো? আমি আমার ভাইপো-কে ভীষণ ভালোবাসি কিন্তু তোমাকে আমার সহ্য হয় না৷ তুমি আমার জন্য একপ্রকার এলার্জির মতোই। তাই তো তোমাদের দুজনকে আলাদা করে দিলাম৷ তোমার মতো দূর্বল নারীকে হারাতে আমার একটা ইশারাই যথেষ্ট।”
“আপনার অহেতুক কথা শুনতে আমি কল করিনি৷ আসল কথায় আসি! আপনার কী ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছে না?”
“তোমাকে আমার মোটেও ভয় করছে না৷ বরঞ্চ করুণা জন্মাচ্ছে৷”
“আমার কিন্তু আপনার প্রতি কোনো করুণা নেই। এত দয়ালু আমি নই। একটা সিক্রেট কথা বলি আপনাকে।”
মেহরাব শিকদার চরম বিরক্ত মৃত্তিকার উপর। সেটা উনার কথার ধরনেই বোঝা যাচ্ছে৷ সুযোগ পেলে নিজের হাতে পথের কাটা উপড়ে ফেলবেন তিনি।
মৃত্তিকা কিছুটা ফিসফিস করে বলল‚ “আপনার হাতে কিন্তু খুব বেশি সময় নেই৷ হুট করেই আপনার মুখোশ খুলে পড়ে যাবে। নিজের বউ আর পরিবারকে মুখ দেখাতে পারবেন তো? আমার মায়ের খু’নিকে কিন্তু আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব। আর আমার অনাগত বাচ্চাকে মে’রে ফেলার শাস্তিও তাকে পেতে হবে৷ সে যত বড়ো মানুষটাই হোক না কেন!”
এবার মেহরাব শিকদার বললেন‚ “সেটা কে?”
অতি সহজ করে মৃত্তিকা বলল‚ “কে আবার! আপনার বিজনেস পার্টনার।”
এবার কণ্ঠনালি কিছুটা কেঁপে উঠল৷ কম্পিত স্বরে মেহরাব শিকদার আবারও জিজ্ঞেস করলেন‚ “ক..কার কথা বলছ?”
“প্লিজ আমার সামনে অন্তত নাটক করবেন না৷ সমস্ত সত্যিটার একমাত্র সাক্ষী আমি নিজে৷”
“আর সেই সাক্ষীটাই যদি আর না থাকে?”
“মৃত্তিকাকে ভয় দেখাচ্ছেন? ভুলে যাবেন না— পুরোনো অবলা ভূমি নিজের খোলস ছেড়ে মৃত্তিকা সত্তা ধারণ করেছে৷ তাকে দাবিয়ে রাখা মোটেও সহজ কাজ নয়। যা আপনার দ্বারা হবে না৷ আমার যা যা বলার ছিল আমি বলেছি৷ আমাদের আবারও দিন তিনেক পর দেখা হবে৷ ততদিনের জন্য আপনাকে ভালো থাকতেই হবে৷ সময় মতো খাবার আর ঔষধ খাবেন৷ আপনি যদি নিজের খেয়াল না রাখেন তাহলে আমি আমার প্রতিশোধ নেব কী করে? আমার জন্য হলেও আপনাকে ভালো থাকতে হবে।”
এতগুলো কথার মাঝে চুপ করে রইলেন মেহরাব শিকদার। মাথায় অনেক চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ওদিকে মোর্শেদ শিকদার উনাকে ডাকছেন। সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। মেহরাব শিকদারকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে মৃত্তিকা আবারও বলল‚
“আল্লাহ হাফেজ খু’নি মেহরাব শিকদার।”
কল কে’টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাগে বি’স্ফো’রিত হলেন মেহরাব শিকদার। ভূমির কাছে কিছুতেই হেরে যেতে পারেন না তিনি৷ মেয়েটার এমন গা জ্বালানো কথাবার্তা মোটেও সহ্য হচ্ছে না উনার। ফোনটাকে পকেটে রেখে মোর্শেদ শিকদারের কাছে গেলেন। প্রলয়কে আবারও খুঁজতে শুরু করলেন৷
রাত হচ্ছে। এবার একটু ঘুমের প্রয়োজন। মৃত্তিকা বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল। অর্পণ মেসেজ দিয়েছিল তাকে। প্রলয়কে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। লোকটা কোথায় গিয়েছে সেই নিয়েও চিন্তা হচ্ছে৷ প্রলয়ের প্রতি জমা অভিমান দুজনের দূরত্ব বাড়িয়েছে। তার মানে তো এই নয় প্রলয়ের প্রতি চিন্তা‚ ভালোবাসা একচুল অবধি কমেছে। লোকটার জন্য তার চিন্তা হয়। সেদিনের এক্সিডেন্টের পর থেকে প্রলয়কে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে সে৷ নাজিম চৌধুরী উন্মাদ হয়ে উঠেছে৷ যখন তিনি জানতে পেরেছে উনার কালোবাজারি গোডাউন প্রলয়ের কথায় সরকারি লোকেরা সীল করে দিয়েছে৷ কাজটা চুপিসারে হয়েছিল বিধায় কারোরই জানা নেই। নাজিম চৌধুরীর অনেক টাকা লস হয়েছিল৷ তখন থেকেই প্রলয় উনার চক্ষুশূল। আরও বিরাট ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। যেগুলো প্রলয়েরও জানার কথা না৷ জানলে এতদিনে সবার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যেত। মৃত্তিকার নজর সবার উপরেই রয়েছে৷ সবাইকেই সে চোখে চোখে রাখছে৷ বিশেষ করে মেহরাব শিকদার। সমস্ত ভাবনাকে আলাদা করে মৃত্তিকা বিছানায় গিয়ে তনুজার পাশে শুয়ে পড়ল৷ হুট করে ঘুম ভেঙে গেলে‚ তাকে না পেলেই অস্থির হয়ে পড়বেন তিনি। মেয়েকে নিয়ে ভারী চিন্তা হয় উনার।
রাত তখন দেড়টা…
প্রলয়কে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন মোর্শেদ শিকদার এবং মেহরাব শিকদার। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ তার চিন্তায়‚ এতটা সময় ধরে জেগে ছিলেন। লেকের ধারে শানবাঁধানো সিঁড়িতে বসে ছিল। সকল ঝঞ্ঝাট থেকে পালাতে চেয়েছিল৷ কিন্তু তা আর হলো কোথায়? বাড়ির সকলেই খুব কথা শোনাচ্ছে প্রলয়কে৷ তার মতো দায়িত্বশীল একজন কী করে এমনটা করতে পারে! অর্পণ আর ইরাও বৈঠকখানায় রয়েছে। অর্পণ অপলক নেত্রে তার ভাইকে দেখছে৷ প্রলয়কে মোটেও ঠিক লাগছে না। তার চোখমুখ জানান দিচ্ছে— কিছু তো একটা অবশ্যই হয়েছে৷ যে কাউকে বলতে চাইছে না প্রলয়৷ অর্পণ এগিয়ে তার ভাইকে ধরল৷ জিজ্ঞেস করল‚
“তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে ভাই?”
সব সত্যিটা জেনে অর্পণ তার কাছ থেকে লুকিয়ে গিয়েছে৷ ভেবেছে হয়তো প্রলয় এর কিছুই জানবে না৷ অর্পণের প্রতি রাগ হলো৷ সত্যি মিথ্যার দারুণ যবনিকা তৈরি করেছে এরা। অর্পণের হাতটা ঝেড়ে সরিয়ে দিয়ে প্রলয় বলল‚ “সকলের এত এত প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”
মোর্শেদ শিকদার এবার চেঁচিয়ে উঠলেন। প্রলয়কে বললেন‚ “খুব লায়েক হয়ে গিয়েছ তাই না? যখন যা ইচ্ছে হবে তাই করবে৷ মনে রেখ— এটা যৌথ পরিবার। কোথাও গেলে তোমাকে বলেই যেতে হবে! সবাই যে এতক্ষণ তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছিল তার মূল্য কী তোমার কাছে আছে?”
“না নেই— এখানে কারোর মূল্য নেই আমার কাছে৷”
মেহরাব শিকদার এগিয়ে এসে বললেন‚ “এ তো কেমন পরিবর্তন হয়েছে? বাবার মুখে মুখে তো কখনো কথা বলিসনি!”
টি টেবিলের উপর থাকা ফুলদানিটা সজোরে মেঝেতে আছাড় মারল প্রলয়৷ রাগ এখন তড়তড় করে বাড়ছে৷ মেহরাব শিকদারের একটা টু পরিমাণ শব্দও সহ্য হলো না। প্রলয়ের এহেন রাগ দেখে থরথর করে কাঁপছে পূর্ণ পুষ্প৷ প্রলয় একবার তার বোনদের দিকে তাকাল। যত যা-ই হয়ে যাক বোনদের মেয়ে দুটো ভয় পেয়েছে তাই সে তৃপ্তিকে বলল‚ ওদের দুজনকে ঘরে পৌঁছে দিতে৷ প্রলয়ের কথানুযায়ী ওরা চলে গেল। প্রলয় এবার মেহরাব শিকদারের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল‚
“সেদিন তুমি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছিলে চাচ্চু? কেন সেদিন বলেছিলে— ভূমি দুই সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট? অথচ ও আড়াই মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল! এত বড়ো মিথ্যে কথাটা তুমি কেন বলেছিল? তোমরা তো জানো কাজের প্রেসার আমি একটু বেশি হাইপার হয়ে যাই। সেদিন যখন আমি ভুল করছিলাম তখন আমাকে কেন আটকাওনি?”
প্রলয়ের কথার সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই কণ্ঠে মাধুরী বললেন‚ “আমাদের উপর যে চেঁচাচ্ছিস— ওই মেয়ে যে বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছিল! তোকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করেছিল? ওই ঘটনার জন্য ভূমিই দায়ী ছিল। ও কেন সবকিছু খোলাসা করল না? কেন চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল? এতই যদি নির্দোষ থাকত তাহলে মুখে উপর কেন সত্যিটা বলল না? এই মেয়ে ম’রেও শান্তি দিচ্ছে না।”
ভূমির বিরুদ্ধে এ কথা শুনে প্রলয় আরও রেগে গেল৷ রেগে গেলে তার মাথার ঠিক থাকে না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে৷ আরেকটা ফুলদানি নিয়ে গ্লাসের টি-টেবিলটার উপর সজোরে আঘাত করল। মুহূর্তেই টি-টেবিলের কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ইরা তার কান চেপে রেখেছে৷ অর্পণ দ্রুত গিয়ে প্রলয়কে ধরল৷ এখন তাকে না আটকাকে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসলীলা কেউ আটকাতে পারবে না৷ প্রলয়কে জাপ্টে ধরে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“তুমি একটু শান্ত হও৷ হুট করে তোমার কী হলো? এমন রিয়েক্ট করছ কেন?”
প্রলয় আবারও অর্পণকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল‚ “একদম আমাকে ছুঁবি না৷ তোকে আমার ভাই মানতেও কষ্ট হচ্ছে৷ তুই আমাকে ঠকিয়েছিস। এতই যদি আমার ভালো চাইতি তাহলে সত্যিটা এভাবে লুকিয়ে যেতে পারতি না৷”
উপস্থিত কেউই বুঝল না প্রলয় কোন সত্যির কথা বলছে৷ প্রলয়ের এমন ব্যবহারের মেহরাব শিকদার সহ সকলেই হতভম্ব। প্রলয় তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল‚
“ভূমির উপর দোষ চাপানোর চেষ্টাও করবে না মা। সব দোষ আমি করেছি। আমিই অপরাধী। ওকে অবিশ্বাস করা আমার জীবনের সবথেকে বড়ো পাপ। আর আমার পাপের শাস্তি জীবদ্দশা বয়ে বেড়াতে হবে৷ মাঝে মাঝে আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে৷ আমি তো সেই একবছর আগেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। এ দহন আর নেয়া যাচ্ছে না৷”
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে কেঁদে দিলেন মাধুরী। কী থেকে কী হচ্ছে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না৷ শাড়ির আঁচলে মুখ গুজে কাঁদছেন৷ এবার তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কতবড়ো ভুল তিনি করেছেন! ছেলের এমন অবস্থা কোনো মা-ই সহ্য করতে পারবে না। অর্পণের খালা‚ মামী আর গুলবাহার সহ সকলেই এখন উপস্থিত। প্রিয় নাতির এমন অবস্থা দেখে খুবই খারাপ লাগল উনার। তিনি গিয়ে প্রলয়কে সামলে নিলেন। গুলবাহারকে পেয়ে কিছুটা ক্ষ্যান্ত হলো স্বাক্ষর। উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল৷ প্রলয়কে ছোটো বাচ্চাদের মতো কাঁদতে দেখে স্কলেরই খুব খারাপ লাগছে৷ আজ প্রলয় নিজের মাঝে নেই। অর্পণ দূরে সরে দাঁড়াল। এখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে৷ মনে।মনে ভাবছে‚ এই ভয়টাই তো সে এতদিন ধরে পেয়ে আসছে৷ ইরা দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্পণের পাশেই। ফোন বের করে মৃত্তিকাকে ভিডিও কল দিল অর্পণ৷ তার জানা নেই মৃত্তিকা এখনো জেগে রয়েছে কি-না! কয়েকবার রিং হলো কিন্তু কল রিসিভ হলো না। হতাশ হলো অর্পণ। একটা সুযোগ হাত থেকে ফসকে গেল৷ ভেবেছিল এই একটা সুযোগ রয়েছে দুজনের ভুল বোঝাবুঝি দূর করার৷ প্রলয়ের হুট করে কী হয়ে এটা সবারই অজানা। তবে প্রলয়ের কষ্টটা ঠিক কীসে সেটা সবাই জানেন। প্রলয় একবার গুলবাহারের দিকে তাকিয়ে বলল‚
“নানুমণি! আমার জীবন থেকে সব সুখ চলে গিয়েছে।”
প্রলয়কে শান্ত করার জন্য গুলবাহার বললেন‚ “তুই আমার সঙ্গে ঘরে আয়। আর বাকিরা সবাই নিজেদের ঘরে যাও। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। এবার সকলের ঘুমের প্রয়োজন।”
এবার যে যার ঘরে চলে যাচ্ছে। মাধুরীকে জোর করে মোর্শেদ শিকদার ঘরে নিয়ে গিয়েছেন। গুলবাহার উনার নাতিকে নিয়ে নিজের বরাদ্দকৃত কামরায় চলে এলেন। নিজে বিছানায় আগে বসে‚ প্রলয়কে উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে বললেন। ছোটো বাচ্চাদের মতো প্রলয়ও তেমনটাই করল। গুলবাহার আলতো হাতে নাতির চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। কিছুটা শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন‚
“তোর কী হয়েছে নানুভাই? আমাকে সবটা খুলে বল৷ কমিউনিটি সেন্টারে শেষ বার তোকে আমি মৃত্তিকা নামক মেয়েটার সঙ্গে দেখেছি। ও কী তোকে কিছু বলেছে?”
“ও মৃত্তিকা নয়। ও-ই আমার ভূমি কন্যা। ওকে চিনতে আমি মোটেও ভুল করিনি। যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে আমার কাছে। জানো নানুমণি— ভূমির বাচ্চাটা আর নেই। সেদিন রাতে বাচ্চাটা…!”
আর কিছু বলতে পারল না প্রলয়। গলা ধরে আসছে তার৷ বেশ অনেকটা সময় চুপ করে রইল প্রলয়৷ গুলবাহার তাকে সময় দিলেন‚ মনের সকল কষ্ট উগলে দেওয়ার জন্য। প্রলয় পুনরায় বলল‚
“আমার সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। আমি আর আগের আমিটা নেই। আমি যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। আসলে প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। ভূমির প্রতি অন্যায় তো আমিও করেছি। নিজের অজান্তেই সন্দেহের বশে নিজের স্ত্রীকে অবিশ্বাস করেছি আমি। এর শাস্তি তো আমাকে সারাজীবন ভর পেয়ে যেতে হবে। আমি এই মুখটা ভূমিকে আর দেখাতে চাই না। ও ঠিকই বলেছে— আমি ক্ষমারও অযোগ্য।”
“এভাবে বলে না নানুভাই। আমার নানুভাই সবথেকে ভালো। হয়তো এখন সময়টা খারাপ যাচ্ছে তার মানে এই নয় ভালো দিন আসবে না! ভালো দিন অবশ্যই আসবে৷ তোর ভূমি তোর কাছেই ফিরে আসবে। সম্পর্কের সুতো কী এত সহজে ছিড়ে ফেলা যায়?”
চলবে?…..