রণরঙ্গিণী প্রেমরঙ্গা পর্ব-৪৩+৪৪

0
2

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বিভীষিকাময় অহোরাত্র কাটিয়ে নব দিবস সূচনা। প্রকৃতি যেন মেতে উঠেছে নব দিবসের মহিমায়। বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ ঝলমলে। কানায় কানায় রোদ্দুরে মোহাবিষ্ট। সকাল সকাল মৃত্তিকাকে খুবই চনমনে লাগছে। কালই তো কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা করে ফেলেছিল আর আজই স্বাভাবিক। এ যেন এক নতুন মৃত্তিকা। এই তো সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুজনের জন্য নাস্তা তৈরি করল। এরপর মা মেয়েতে মিলে তা খেলও। এরপর সারাটাদিন তনুজার সঙ্গেই কাটিয়েছে মৃত্তিকা। খুব আড্ডা দিয়েছে দুজনে মিলে। যেন অনেক কথা জমে ছিল৷ একে অপরের সুখ দুঃখ আজ নিঃসারণ হয়েছে। সময় যে কীভাবে অতিবাহিত হয়ে গেল টেরই পাওয়া গেল না। চোখের পলকেই সকাল থেকে সন্ধ্যে নেমে এসেছে৷ আজ অর্পণ ইরার রিসেপশন। আয়নার সামমে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে মৃত্তিকা৷ কালো রঙা শাড়ি পড়েছে৷ ঘন দীঘল কেশগুছকে উঁচু করে খোঁপা করেছে৷ হালকা সেজেছে আজ। মৃত্তিকা খুবই খোশমেজাজে রয়েছে আজ৷ আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে আর গুনগুন করছে। তার এহেন কাজে কিছুটা অবাক হলেন তনুজা৷ তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন মৃত্তিকার ঠিক পেছন দিকটায়৷ তনুজা শুধালেন‚

“অর্পণের রিসেপশনে যাবি তুই?”

“যেতে তো আমাকে হবেই মামনি। কাঙ্ক্ষিত দিনটা যে চলেই এসেছে।”

তনুজা বুঝলেন না মৃত্তিকা ঠিক কোন দিনটার কথা বলছে। তাই তিনি পুনশ্চ শুধালেন‚ “কোন দিনটার কথা বলছিস তুই?”

আয়নার কে তাকিয়ে ক্ষীণ হেসে মৃত্তিকা বলল‚ “যেই দিনে আমি আমার আম্মাকে হারিয়েছিলাম— সেই দিনটা।”

“তুই কিছু ভাবছিস তাইনা?”

মৃত্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তনুজাকে নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানায়৷ মৃত্তিকা ঠিক কী করতে চাইছে বুঝলেন না তিনি৷ অবাক চোখে তাকিয়েই দেখতে লাগলেন। তনুজার হাতখানা নিজের হাতের মাঝে রেখে মৃত্তিকা ধরা গলায় বলল‚

“আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তুমি দিদিভাইয়ের কাছে চলে যেও।”

অস্থির হয়ে উঠলেন তনুজা৷ মৃত্তিকার কিছু হয়ে যাবে এটা শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার নেমে এলো৷ ত্রস্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি শুধালেন‚ “কেন— তোর কী হবে?”

“এই একটা দিনের জন্যই আমি এতগুলো দিন ধরে অপেক্ষা করছি। ওই লোককে নিজের হাতে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমার আম্মার আত্মা শান্তি পাবে না৷ জীবদ্দশায় আমার আম্মাকে কম কষ্ট পেতে হয়নি। সবকিছুর জন্য দায়ী ওই মেহরাব শিকদার। ওই লোককে আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না৷”

কিছুটা শান্ত হয়ে তনুজা বললেন‚ “শাস্তি দেবার পদ্ধতিটা কী অন্যভাবে করা যায় না? আমি তোকে হারাতে পারব না মা৷”

তনুজার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল মৃত্তিকা৷ মনে হচ্ছে যেন তার আম্মার কোলই এটা৷ শুয়ে থেকেই তনুজার হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলল‚ “আমি যে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

কাল রাতের ঘটনা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেননি। প্রলয়ও বেশ শান্ত। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে কাল রাতে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছে৷ মনে হচ্ছে যেন কোনো বড়ো ঝড়ের পূর্বাভাস। মাধুরী নিজের কর্মফলে অনুতপ্ত। দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলে তিনি ভূমির কাছে মন থেকে ক্ষমা চাইতেন। কম অন্যায় তো তিনি করেননি মেয়েটার উপর৷ তিনি এখনো জানেন না যেন মৃত্তিকাই আসলে ভূমি। আর না গুলবাহার উনাকে কিছু জানতে দিয়েছেন৷ সবকিছু জেনেও তিনি স্বাভাবিক আচরণই করছেন৷ এদিকে শিকদার বাড়ির সকলেই এখন কমিউনিটি সেন্টারে৷ ইরার পরিবারের সকলে আগে থেকেই উপস্থিত৷ কালই উনারা গ্রামে ফিরে যাবেন। কাজিনমহলের সবগুলো এখন অর্পণ ইরার সঙ্গে স্টেজে ফটোশুট করছে৷ এদিকে মৃত্তিকা এখনো আসেনি৷ প্রলয় ভেবেই নিয়েছে আজ হয়তো মৃত্তিকা আসবে না৷ মনকাননে অনেক প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে। মেহরাব শিকদারকে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়৷ বারবার মনে হয় সবকিছুর পেছনে হয়তো ওই লোকটার কোনভাবে হাত রয়েছে। আবার মনে হচ্ছে এসব নিয়ে অর্পণ হয়তো কিছু জানে৷ তা নাহলে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট কী করে পরিবর্তন হয়? ভূমির সত্যিটা হয়তো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্পণ সবটাই জানে। প্রলয় ভেবে নিল‚ যে করেই হোক আজই অর্পণের সাথে তার কথা বলতে হবে৷ কোনো কিছু না ভেবেই প্রলয় চলে গেল তৃপ্তির সামনে৷ কারণ ওরা সবাই এখন অর্পণ আর ইরার কাছেই রয়েছে৷ তৃপ্তি কিছুটা দূরে থাকায় তাকে দিয়েই কাজটা করাতে হবে। অর্পণের সঙ্গে একা কথা বলবে প্রলয়৷ তাই তৃপ্তিকে পেছন থেকে ডেকে উঠল‚

“তৃপ্তি!”

অকস্মাৎ প্রলয়কে দেখে যারপরনাই অবাক হলো তৃপ্তি৷ কারণ সচরাচর প্রলয় তার সঙ্গে কথা বলে না৷ এক কথায় তাকে সহ্যই করতে পারে না৷ তৃপ্তি জিজ্ঞেস করল‚ “জি! কিছু বলবেন?”

সঙ্গে সঙ্গেই প্রলয় বলে উঠল‚ “পূর্ণ পুষ্প‚ ইরা আর বাকিদেরকে নিয়ে একটু এখান থেকে যাও৷ অর্পণের সঙ্গে আমার আলাদাভাবে কিছু কথা বলার রয়েছে৷”

“ওরা জিজ্ঞেস করলে— কী বলব?”

“আমার কথা বললেই হবে।”

তৃপ্তি ঘাড় বাকিয়ে সায় জানাল৷ কিছুক্ষণের মাঝেই পূর্ণ পুষ্প‚ ইরা আর বাকিদেরকে নিয়ে ফটোগ্রাফার যেখানে ছবি তুলছে সেখানেই চলে গেল৷ এখন আপাতত এই দিকটায় কেউ নেই। অতিথিদের খাওয়াদাওয়া পর্ব চলছে৷ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রলয় সোজা চলে গেল অর্পণের কাছে৷ আজ সারাদিনে দুই ভাইয়ের মাঝে কোনোপ্রকার কথাবার্তা হয়নি। অর্পণ আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি প্রলয়কে৷ কিছু একটা আন্দাজ ঠিকই করছে সে৷ তারউপর সকালে ভূমির সঙ্গে কথা হয়েছিল তার৷ অর্পণ চিন্তিত! না জানি প্রলয় তাকে কখন কী জিজ্ঞেস করে বসে৷ তার কাছে যে‚ সত্যিটা বলার হিম্মত খুবই কম৷ অর্পণের ভাবনার মাঝে প্রলয় চলেই এলো তার সামনে৷ মনে হচ্ছে‚ মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির আগমন। অর্পণ জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে‚ চরম বিস্ময়ে অভিভূত। প্রলয় হয়তো বুঝল তার অবস্থাটা৷ অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে সোজাসুজি বলে ফেলল‚

“তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা বলার রয়েছে।”

যেটার ভয় ছিল সেটাই হচ্ছে৷ গলা শুকিয়ে আসছে অর্পণের। প্রলয় তার সঙ্গে কী কথা বলবে সেটা হয়তো জানা নেই কিন্তু ভূমির বিষয়ে কথা বলবে সেটা নিশ্চিত! অর্পণ ঠিক করে নিয়েছে আজ সমস্ত সত্যিটা প্রলয়কে জানিয়ে দেবে। আর কোনো লুকোচুরি নয়। অর্পণ কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য উদ্যত হবে তার আগেই প্রলয় বলে ফেলল‚

“তুই যদি আমার ভালোই চেয়ে থাকিস তাহলে আমাকে একটা কথা বল!”

পাল্টা জবাবে অর্পণ শুধাল‚ “কী কথা ভাই?”

“ভূমির সঙ্গে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পেছনে কী চাচ্চুর কোনো ভাবে হাত রয়েছে?”

প্রলয়ের কথায় ঠিক কী উত্তর দেওয়ার আছে অর্পণ জানে না৷ সকালে মৃত্তিকা জানিয়েছিল কাল রাতে সে প্রলয়কে তার বেঁচে থাকার সত্যিটা জানিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু বাকি কথাটা সে কী করে বলবে? কী করে বলবে— সবকিছুর পেছনে একমাত্র তার বাবা নামক পশুর হাত রয়েছে! যাকে এতকাল যাবৎ নিজের আইডল মনে করে এসেছে। একটা মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে তা মেহরাব শিকদারকে দেখলেই বোঝা যায়৷ দিনকে দিন উন্মাদ হয়ে উঠছে৷ কথাটা বলতে গিয়েও অর্পণ কিছুটা আমতা আমতা করছে। প্রলয় বুঝতে পেরে বলল‚

“আমি কোনো মিথ্যে শুনতে চাইছি না।”

মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে সঙ্গে সঙ্গে অর্পণ বলল‚ “কোন সত্যিটা তুমি জানতে চাও ভাই? একটা সত্যির থেকে মুখোশ উন্মোচন করতে গেলে আরও অনেকগুলো সত্যি সামমে চলে আসবে।”

অর্পণের কথায় মোটেও অবাক হলো না। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের হবে এটা সে ভেবেই নিয়েছিল৷ সে পুনশ্চ জিজ্ঞেস করল‚

“কী এমন সত্যি রয়েছে? আমি সব জানতে চাই৷”

শুকনো ঢোক গিলল অর্পণ। এরপর গলা ঝেড়ে বলল‚ “তাহলে সবার আগে জেনে রাখ— ভূমি শুধু শিকদার বংশের বউ নয়। সে মেহরাব শিকদারের ঔরসজাত সন্তান। শিকদার বংশের র’ক্ত তার শরীরেও বইছে। অথচ সারাজীবন তাকে জা’রজ সন্তানের তকমা পেতে হয়েছে৷”

অর্পণের কথায় চরম স্তম্ভিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রলয়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে৷ কাল থেকে একের পর এক সত্যি সামনে আসছে। কিন্তু এমন একটা সত্যি তার সামনে আসবে এটা কল্পনাতীত ছিল৷ প্রলয়ের অবস্থা বুঝতে পারল অর্পণ। সে পুনরায় বলল‚

“ভূমির আম্মা অর্থাৎ মহুয়া আন্টির খু’নি হচ্ছে মেহরাব শিকদার। ভূমিকে গণিকালয়ে কে পাঠিয়েছিল শুনতে চাইবে না?”

কম্পিত স্বরে প্রলয় শুধাল‚ “কে?”

“যাকে নিজের বাবা বলতে কুণ্ঠাবোধ হয়। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়৷ সেই মেহরাব শিকদার হচ্ছে সকল কিছুর মূলে৷ এত সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড হচ্ছে মেহরাব শিকদার।”

প্রলয় এখন নিশ্চুপ। কোনো উত্তর নেই তার কাছে৷ তাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে অর্পণ বলতে শুরু করল‚

“একজন ভালো নৃত্যশিল্পী হবার আশায় শহরে এসেছিলেন মহুয়া আন্টি৷ তখনই দেখা হয় মেহরাব শিকদারের সঙ্গে। মহুয়ার আন্টি জানতেন না— মেহরাব শিকদার বিবাহিত। নানান কৌশল অবলম্বন করে একুশ বছর আগে মেহরাব শিকদার বিয়ে করেছিলেন মহুয়া আন্টিকে। এরপর কেটে যায় আরও একটি বছর। যখন আন্টি প্রেগন্যান্ট হয় তখনই মেহরাব শিকদার নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দেয়। নিজেরই অনাগত সন্তানকে অস্বীকার করেন। বাচ্চাটাকে অ্যাবর্শন করিয়ে ফেলারও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন মেহরাব শিকদার। কিন্তু মহুয়া আন্টি এমনটা করতে নারাজ ছিলেন৷ তিনি শহর থেকে গ্রামে চলে যান৷ এরপর সময় গুলো খুব দ্রুতই কেটে যায়৷ শহর থেকে দূরে অনিন্দ্যনগরে মেয়েকে নিয়ে দিব্যি ছিলেন মহুয়া আন্টি৷ হঠাৎ করে আবারও সব এলোমেলো হয়ে গেল৷ হয়তো ভাগ্যটাই এমন ছিল। যে বাবা নিজের অনাগত সন্তানকে অস্বীকার করেছিলেন— ভূমিকে সেই লোকটার কাছে আসতে হলো। শিকদার বংশের মেয়ে হয়েও স্বীকৃতি না পাওয়া মেয়েটা‚ ভাগ্যের পরিহাসে শিকদার বংশেরই পুত্রবধূ হিসেবে এলো৷ এসমস্ত সত্যি জানার পর— মেহরাব শিকদার নতুন করে উন্মাদ হয়ে ওঠেন। কী করে নিজের পথের কাটা দূর করবেন সেটারই পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। হঠাৎ একদিন মহুয়া আন্টি ভূমিকে সমস্ত সত্যিটা জানিয়ে দেন। মাস তিনেক সময় পর খবর এলো মহুয়া আন্টি আর বেঁচে নেই। ভূমির দুনিয়া যেন ওলট-পালট হয়ে গেল৷ মেহরাব শিকদার লোক লাগিয়ে খু’ন করিয়েছেন মহুয়া আন্টিকে৷ তার পরপরই ভূমিকে অপহরণ করিয়ে গণিকালয়ে পাঠানো হয়৷ ভূমি তখন আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল৷ মেহরাব শিকদার সবটাই জানতেন৷ তিনিই সেখানকার সর্দারনি পিংকিকে নির্দেশ দেওয়া হয় ভূমির অনাগত বাচ্চাটাকে অ্যাবর্শন করানোর। বহু কষ্টে ভূমি সেখান থেকে পালিয়ে আসে৷ এরপর কিছুদিন যেতেই আরেক কাহিনি। মেহরাব শিকদার তোমাকে উষ্কাল যাতে ভূমিকে তুমি অবিশ্বাস কর৷ হলোও তাই। মেহরাব শিকদার নিজের পরিকল্পনায় সফলও হয়ে যায়৷ কিন্তু সেদিন রাতে ভূমির উপর কে বার কার লোক হা’মলা করিয়েছিল সেটা শুধু ভূমি জানে। খুব শীগ্রই মেহরাব শিকদারের কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে৷ তার সত্যিটা সবাই জানবে৷ ভূমি নিজের অপূর্ণ কাজে সফল হবেই৷ আমি জানি না এই সত্যিটা জানার পর মায়ের মানসিক অবস্থা ঠিক কেমন হবে? মাকে আমি সামলাব কী করে? মায়ের চিন্তা আজকাল আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আমার হাসিখুশি সহজসরল মাকে কষ্ট পাওয়া থেকে হয়তো আটকাতে পারব না কিন্তু মাকে সবকিছু থেকে আমাকেই আগলে রাখতে হবে।”

ঠান্ডা মাথার ষড়যন্ত্রের কথা ভাবতেই রাগে গা কেঁপে উঠল প্রলয়ের৷ এতটা ঠান্ডা মাথার গভীর পরিকল্পনা ছিল যে সে ধরতেই পারল না। ইচ্ছে করছে মেহরাব শিকদারকে নিজের হাতে খু’ন করে দিতে৷ শুধুমাত্র ওই লোকটার জন্য তার আর ভূমির জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। মহুয়াকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে৷ কিছুতেই নিজের রাগকে সংবরণ করতে পারছে না সে৷ অন্যদিকে….মৃত্তিকা অনেকক্ষণ ধরেই মেহরাব শিকদারকে চোখে চোখে রাখছে৷ এখানে এসেছে অনেকটা সময়ই অতিবাহিত হয়েছে৷ আজই সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। বারবার মনে সাহস জোগাচ্ছে মৃত্তিকা৷ বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট আর টিমটিম করছে৷ মেহরাব শিকদারের সঙ্গে শেষ বার তার কিছু কথা বলার খুবই প্রয়োজন। ভুলিয়ে ভালিয়ে লোকটাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে সফল হতে হবে। যেই কারণে সে উনার পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে৷ ব্যাপারটা বেশ নজর কেড়েছে মেহরাব শিকদারের৷ স্টেজ থেকে অর্পণও বিষয়টা খেয়াল করেছে৷ এদিকে মেহরাব শিকদার মৃত্তিকাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেই ফেললেন‚

“এভাবে আমার আগে পিছে ঘুরঘুর করছ কেন? মতলব কী তোমার?”

কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই মৃত্তিকা বলে উঠল‚ “আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার ছিল৷”

মৃত্তিকার সহজ স্বাভাবিক কণ্ঠ কিছুটা অবাক করলেন মেহরাব শিকদারকে৷ সেই সাথে সন্দেহ হলো উনার৷ না জানি এখন এই মেয়ে কী করবে! ভূমি অনেকটা পাল্টে গিয়েছে এটা তিনি খুব করে মানেন৷ মেহরাব শিকদার অত্যন্ত রুক্ষস্বরে বললেন‚ “তোমার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।

মৃত্তিকা তার পার্স থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করল৷ মেহরাব শিকদারকে দেখিয়ে বলতে লাগল‚ “আপনার কাছে দুটো অপশন রয়েছে৷ হয় আপনি আমার সঙ্গে চলুন আর নয়তো এই পেনড্রাইভ এখানেই লাইভ টেলিকাস্ট হবে৷ তারপর আপনার মুখোশটা খসে পড়বে সকলের সামনে৷ নিজের স্ত্রী আর পরিবারকে তখন সামলাতে পারবেন তো?”

“তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? কিন্তু আমি যে ভয় পাচ্ছি না৷”

“কে বলল আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছি? আমি তো আপনাকে একটা চান্স দিচ্ছি৷ আমি আবার সবাইকে দ্বিতীয় চান্স দিই না৷ আপনার পার্টনার নাজিম চৌধুরীকে তো মোটেও দেব না৷ আপনাকে কেন চান্স দিচ্ছি জানতে চাইবেন না?”

কিছুটা বিরক্তি নিয়ে মেহরাব শিকদার বললেন‚ “রক্তের টান আছে তাই হয়তো!”

অস্ফুটে ‘চ’ উচ্চারিত হলো৷ চোখ ছোটো ছোটো করে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন মেহরাব শিকদার। এবার মৃত্তিকাও অত্যন্ত তেজি স্বরে বলল‚ “সেই কথাটা কী ভুলে গেলেন— ডক্টর অমানুষ শিকদার?”

ক্ষিপ্ত হলেন মেহরাব শিকদার। মৃত্তিকার দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করলেন। ভেবেছেন আজও হয়তো সবকিছু দাবিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু হলো তার উল্টোটা৷ মৃত্তিকা মোটেও ঘাবড়াল না। নিজের অধরে তর্জনী ছুঁয়ে বলল‚ “হুশ! আমার ভাইয়ার রিসেপশনে কোনো সিনক্রিয়েট চাইছি না৷ চুপচাপ আমি যেটা করতে বলছি সেটাই করুন৷”

“কোথায় যেতে হবে আমাকে?”

“আগে তো এই কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হন। তারপর বলছি কোথায় যেতে হবে!”

মৃত্তিকার কথা মতো মেহরাব শিকদার বেরিয়ে পড়লেন। এই মুহূর্তটার অপেক্ষাই তো এতদিন ধরে করছে মৃত্তিকা৷ সুযোগ বুঝে নিজের পার্স থেকে ইঞ্জেকশনটা বের করে মেহরাব শিকদারের ঘাড়ে পুস করে দিল সে৷ আজ হয়তো ভাগ্যও তার সঙ্গ দিচ্ছে। তা না হলে এত সহজে লোকটাকে ফুসলানো যেত না৷ সে তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিল৷ ভেবে ছিল কাজটা খুব একটা সহজ হবে না। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল বলে সহজ হয়ে গেল। মেহরাব শিকদারের দিন ঘনিয়ে এসেছে৷ পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে৷ এবার শাস্তির পালা৷ যেটা মৃত্তিকা নিজ হাতে দেবে৷ যখনই মেহরাব শিকদার অচৈতন্য হয়ে পড়বে তখনই মৃত্তিকা উনাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিল৷ এতটা রাস্তা তো এই লোককে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না৷ এরপর গাড়িতে বসে পড়ল৷ অর্ণব ড্রাইভ করছে৷ এই ঝামেলার মাঝে তনুজা আর সুদর্শিনীকে জড়াতে চায়নি মৃত্তিকা৷ সবকিছু একাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু অর্ণব সুদর্শিনী তাকে একা ছাড়েনি। এতক্ষণ ধরে প্রলয়ও মৃত্তিকাকে নজরে নজরে রাখছিল৷ যখনই শুনেছে সবকিছুর পেছনে মেহরাব শিকদারের হাত রয়েছে তখন থেকেই তার মনে মৃত্তিকাকে আবারও হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে বসেছে। কমিউনিটি সেন্টারে মৃত্তিকা বা মেহরাব শিকদারকে কোথাও দেখতে না পেয়ে সে অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚

“ভূমি কোথায়?”

“যেখানে থাকার সেখানেই রয়েছে৷”

প্রলয় বুঝল অর্পণ মৃত্তিকার পরিকল্পনার ব্যাপারে সবকিছুই জানে। তাই সে পুনরায় শুধাল‚ “তুই কী আমাকে কিছু লুকচ্ছিস?”

অর্পণও সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলল‚ “হ্যাঁ।”

“লুকিয়ে লাভ হবে না তাড়াতাড়ি বলে দে৷ আমি চাই না দ্বিতীয়বার ভূমির কোনো বিপদ হোক৷”

অর্পণ নিজের ফোনটা বের করে প্রলয়কে বলল‚ “তোমাকে একটা লোকেশন শেয়ার করছি। ওখানে গেলেই ভূমিকে পাবে৷” এটুকু বলে থামল। পরপরই অর্পণ আবারও বলল‚ “আমার বোনের যেন কোনো বিপদ না হয়!”

প্রলয় যেতে যেতে বলল‚ “আমার জীবন থাকতে ওর আর কোনো বিপদ হবে না।”

এরপর কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হবার আগে প্রলয় চলে গেল কম্পিউটার রুমে৷ বাহিরে অনেক সিসি ক্যামেরা রয়েছে৷ মৃত্তিকা যে মেহরাব শিকদারকে নিয়ে গিয়েছে সেটা ধরা পড়ে যাওয়ার চান্স রয়েছে। তাই আপাতত কিছু ভিডিও নিজ দায়িত্বে ডিলিট করে দেবে প্রলয়। সেই সঙ্গে ক্যামেরা গুলোও বন্ধ করে দেবে। সে চায় না এসবে মৃত্তিকা কোনোভাবে ফেঁসে যাক। অর্পণ এতক্ষণে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে৷ রিসেপশনের অনুষ্ঠান ছেড়ে কোথাও গেলে সবাই সন্দেহ করতে পারে৷

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

পিনপতন নীরবতা বিরাজমান বিস্তীর্ণ কামরা বস্তুসামগ্রীহীন। ধুলোবালি মাখা কক্ষে কানায় কানায় আলো পরিপূর্ণ। ❝কাঁটামুকুট❞ জায়গাটা খুবই অস্বস্তিকর মনে হয়েছে মৃত্তিকার কাছে৷ এখানকার প্রত্যেকটা কামরা হসপিটালের কেবিন গুলোর মতো। এখানেই অর্গান ট্রাফিকিং এর কাজ করা হয়৷ এই খবরটা মহুয়াই দিয়েছিলেন৷ এই সত্যিটা যেন কেউ কোনোভাবে জানতে না পারে সেই জন্য মহুয়াকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে৷ কিন্তু শেষমেশ সত্যিটা ভূমিকে জানিয়ে গিয়েছিলেন মহুয়া৷ যখনই মেহরাব শিকদার জানতে পারলেন এই কথাটা ভূমিও জানে তখন থেকেই তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন। নানা ধরনের পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করলেন কী করে ভূমিকে শেষ করে দেওয়া যায়৷ সুযোগ তো তিনি একবছর আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু তবুও সক্ষম হলেন না। মৃত্তিকা এখানকার প্রত্যেকটা কামরা দেখেছে৷ এখানেই যে অর্গান ট্রাফিকিং এর সমস্ত কারবার হয় সেটা বুঝতে আর বেশিক্ষণ সময় লাগেনি তার কাছে৷ সে অপেক্ষা করছে কখন মেহরাব শিকদারের জ্ঞান ফিরবে! এতক্ষণ বোধহয় শিকদার বাড়িতে মেহরাব শিকদারের মুখোশ উন্মোচন হয়েই গিয়েছে৷ এখন না হলেও আজই সব সত্যিটা সবার সামনে চলেই আসবে৷ অর্পণকে সব প্রমাণ দিয়ে আসা হয়েছে৷ আরও অনেকটা সময় গড়াল। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন মেহরাব শিকদার। ক্লান্ত তবে উনার চোখ মুখে তেমন অসহায়ত্ব নেই। দিব্যি কিঞ্চিৎ হাসি মুখে এদিকে সেদিক তাকিয়ে দেখছেন। যেন কিচ্ছুটি হয়নি। উনার সামনেই মৃত্তিকা পায়ের ওপর পা তুলে চেয়ার চসে রয়েছে৷ সে এতক্ষণ ধরে এই লোকের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষাই করছিল৷ মৃত্তিকা কিছুটা নড়েচড়ে বসল। মেহরাব শিকদার পানি খেতে চাইলেন। মৃত্তিকা সঙ্গে সঙ্গেই পানি খাইয়ে দিল। মৃ’ত্যুর পথযাত্রীকে না হয় শেষ বারের মতো একটু আপ্যায়ন করা গেল৷ তবে মনে হচ্ছে এমন উপকার করাটা নেহাতই বোকামি ছিল৷ মেহরাব শিকদার পানি পান করার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন‚

“কী মনে করেছ— তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ?”

কথাটা বলেই ঠোঁট উঁচু করে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। খানিকটা অবাক হলো মৃত্তিকা। এতকিছুর পরেও সামান্যতম ভয় নেই লোকটার মাঝে। লোকটা ঠিক কী বলতে বা করতে চাইছে তার জানা নেই। কয়েক লহমার জন্য থমকাল মৃত্তিকা। বোঝার চেষ্টা করল সেই কথাটার মর্মার্থ। খুব একটা সময় ব্যয় হলো না৷ কিছুটা আন্দাজ ইতিমধ্যেই করে নিয়েছে সে। এবার মেহরাব শিকদার নিজে থেকে আবারও বলে উঠলেন‚

“নিজেকে এতটাও চালাক ভেব না! তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসনি— বরং আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আজ হয় আমি থাকব আর নাহয় তুমি। গল্পটা এখানেই শেষ করা উচিত। অনেক হয়েছে এই লুকোচুরি খেলা। সেদিন যদি মহুয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও মে’রে দিতাম তাহলে হয়তো এমন দিন আমাকে দেখতে হত না। কত বড়ো বোকামিটাই না করলাম আনি। আসলে আমার ভাগ্যটাই বড্ড খারাপ যাচ্ছে। তবে চিন্তা নেই— আজকের পর থেকে সব ভালোই হবে৷”

মৃত্তিকা খানিকটা অবাক হলো। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্ষীণ হাসলেন মেহরাব শিকদার। এ হাসি সহ্য হলো না যেন। মৃত্তিকা অত্যন্ত তেজি স্বরে বলে উঠল‚

“আপনি ঠিকই বলেছেন— আজকের পর থেকে সব ভালোই হবে৷ আর হ্যাঁ! নিজেকে এতটাও চালাক ভাববেন না মি. নরপি’শাচ! আমার কোনো পিছুটান নেই তাই মৃ’ত্যুকে আমি ভয় পাই না। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আপনার মতো পশুকে যেন নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারি এই কারণে৷ তাই আপনি যা ইচ্ছে করতে পারেন৷ তবে জিত এই রণরঙ্গিণীরই হবে।”

মৃত্তিকার কথায় তাচ্ছিল্য করে হাসলেন মেহরাব শিকদার। কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করলেন না যেন। এই মুহূর্তে এসেও নির্দ্বিধায় নিজের অন্যায়কে বাহবা দিচ্ছেন। তার অন্যায় গুলো যেন কিছুই না৷ মেহরাব শিকদার পুনশ্চ বললেন‚

“আজ বোধহয় আমার জীবনের সবথেকে আনন্দের দিন। কারণ আজকের দিনে আমার জীবনের প্রথম কাঁটাকে আমি উপড়ে ফেলেছিলাম৷ আজ আবারও একইদিনে দ্বিতীয় কাঁটাকে উপড়ে ফেলব।”

“ক্রমশ আপনি উন্মাদ হয়ে উঠছেন মি. নরপি’শাচ।”

“শাট আপ! বেয়াদব মেয়ে। বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলে? তোমার আম্মা বুঝি এমন শিক্ষাই দিয়েছে?”

“ওই নোংরা মুখে আমার আম্মার নাম নিলে আপনার জিভ আমি টেনে ছিড়ে ফেলব। আর কোন মুখে আপনি নিজেকে বাবার পরিচয় দিচ্ছেন? আপনি তো বাবা নামে কলঙ্ক। বাবা হওয়ার কোনো যোগ্যতা আপনার নেই৷”

“মুখে অনেক বুলি ফুটেছে। আফসোস কিছুক্ষণ পর কথা বলার সু্যোগই পাবে না৷” মেহরাব শিকদার ঘাড় কাত করে ডাকতে শুরু করলেন‚ “অ্যাই কে কোথায় আছিস রে? অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে আমি ক্লান্ত৷ কোমর পা ধরে গিয়েছে।”

সঙ্গে সঙ্গে দুটো কালো পোষাক পরিহিত লোক এসে মৃত্তিকার ঠিক সামনে দাঁড়াল। তার মুখে কোনো কথা নেই। চুপটি করে যা হচ্ছে সেটাই দেখে যাচ্ছে। লোক দুটো মিলে মেহরাব শিকদারের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল৷ ছাড়া পেয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলেন মেহরাব শিকদার। বসে থেকে যেন কোমর ধরে এসেছে। লম্বা হাই তুলে বললেন‚

“এবার কী হবে?”

অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে মৃত্তিকা বলল‚ “আজ আপনার মৃ’ত্যু নির্ণীত।”

“মেহরাব শিকদারকে মারা এতই সহজ?”

“জানি সহজ হবে না। কিন্তু এমনটাই হবে দেখে নেবেন।”

“অ্যাই তোরা ওর হাত পা দুটো সুন্দর করে বেঁধে ফেল দেখি৷ আর হ্যাঁ শিকারী তৈরি তো তার ভোজনের জন্য?”

একজন ব্যক্তি বলে উঠলেন‚ “বস আপনি যেমন যেমনটি বলেছিলেন ঠিক তেমনটাই করা হয়েছে।”

“একটা ট্রেইলার দেখিয়ে দে তো৷”

এই কামরার দেয়াল হতে সফেদ রঙা পর্দাটা নিমিষেই উঠে গেল৷ বন্দী অবস্থায় নিগড়ের চারিপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা সিংহটাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল মৃত্তিকা। এবার কিছুটা ভয় পাচ্ছে সে৷ মেহরাব শিকদার ওই লোক দুটোর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন‚

“তাহলে আর দেরি কীসের— ঝটপট একে বেঁধে ফেল! আমার নির্দেশনা অনুযায়ী যাতে সব হয়।”

দ্বিতীয় লোকটা বলল‚ “অলমোস্ট সব ডান।”

এই বলে মৃত্তিকার কোমল হাত দুটো বেঁধে দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই কারো শান্ত হুমকিতে থামকে গেল লোক দুটো। সেই সঙ্গে মেহরাব শিকদারও৷ “দুজনের একজনও যদি আমার স্ত্রীর গায়ে একটা টোকা পর্যন্ত দেয় তাহলে এই সেহরিশ আরশান প্রলয়ের থেকে খারাপ আর কেউ হবে না৷ দুজনের অস্তিত্ব এই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যাবে।”

লোক দুটো ভয়ে সিঁটিয়ে গেল৷ প্রলয়ের চোখ পড়ল ডান পাশের দেয়ালে। খাঁচায় থাকা সিংহটাকে দেখে প্রলয়ের সেদিনের একটা কথা খুব করে মনে পড়ল। নাজিম চৌধুরী যখন লোক দিয়ে ভূমির এক্সিডেন্ট করাতে চেয়েছিলেন তখন প্রলয় সেই লোকটাকে কুমিরের খাবার বানিয়েছিল৷ আজও হয়তো কেউ এই ক্ষুদার্ত সিংহের খাবার হতে যাচ্ছে৷ ভেবেই সেই কারো জন্য খুবই আফসোস হলো প্রলয়ের৷ সে মেহরাব শিকদারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিদ্রুপ করে বলল‚

“সেম সেম বাট ডিফারেন্ট!”

মেহরাব শিকদার কিছুটা কম্পিত স্বরে বললেন‚ “প্রলয়!”

“ইচ্ছে তো করছে তোমার ওই জিভ আমি টেনে ছিড়ে দিই৷ ইচ্ছে তো করছে তোমাকে নিজ হাতে প্রত্যেকটা অন্যায়ের শাস্তি দিই। ভাগ্য আমার এতটাই খারাপ যে আল্লাহ তোমাকেই আমার চাচ্চু হিসেবে পাঠিয়েছেন৷ একটা মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কী করে হয়? ভাবতেই আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। তোমার জন্য আমাদের অনাগত বাচ্চাটা আর নেই৷ তোমাকে তো আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব। তোমার অস্তিত্বকে আজ মুছে দেব আমি।”

“বিশ্বাস কর— আমি তেমন কিছুই করিনি৷ সব তো ওই নাজিম চৌধুরী করেছিল।”

মৃত্তিকা তেঁতে এসে বলল‚ “নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করা বন্ধ করুন মি. নরপি’শাচ। একই অঙ্গে কত রূপ ধারণ করবেন? আপনার পার্টনারকেও সমান শাস্তি দেওয়া হবে৷ তাই একদম চিন্তা করবেন না।”

মেহরাব শিকদার এবার প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন‚ “প্রলয় তুই অন্তত আমাকে বিশ্বাস কর! এই মেয়েটা সবকিছু মিথ্যে বলেছে।”

সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্তিকার জবাব এলো‚ “আর সমস্ত প্রমাণ? সেগুলোর কথা আপনি কী বলবেন?”

“ওর কথা বিশ্বাস করিস না বাবা৷ ও তোর ব্রেইনওয়াশ করার চেষ্টা করছে৷ আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে৷ তুই তো তোর চাচ্চুকে চিনিস।”

এবার যেন নিজের থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল প্রলয়৷ চিৎকার করে বলে উঠল‚ “ওই মুখে নিজেকে আমার চাচ্চুর পরিচয় একদম দেবে না৷ তুমি কী একবার ভেবে দেখছ— এসব কথা চাচি মা জানতে পারলে কী হবে? উনি তোমাকে সবথেকে বেশি বিশ্বাস করে৷ আর তুমি তাকেও এভাবে ঠকালে? চাচি মা তো একদমই ভেঙে পড়বে।”

“আমি ফিরোজাকে ঠকাইনি৷ ওকে আমি ভালোবাসি৷ আমার অর্পণকে আমি ভালোবাসি।”

প্রলয় পুনশ্চ শুধাল‚ “আর মহুয়া আন্টি— ভূমি?”

“ওরা আমার কেউ হয় না৷”

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল মৃত্তিকা৷ আজ আর কারো প্রতি করুণা নেই৷ যা আছে সেটা শুধুমাত্র ঘৃণা আর ঘৃণা। এই লোক কখনোই বদলাবার নয়। মৃত্তিকা মুখে বলল‚ “ছিহ্!”

রিসেপশন শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ সময় হয়েছে৷ সকলে এখন বাড়ি ফিরে এসেছেন৷ বৈঠকখানায় সকলেই উপস্থিত। আজ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাবে অর্পণ। যেগুলো আজই আর এক্ষুনি বলতে হবে৷ আর চাঁপা রাখা যাবে না৷ এবার অন্তত সত্যিটা সকলের সামনে আসুক৷ কিন্তু অর্পণ তার মায়ের জন্য খুবই চিন্তিত। না জানি উনি ঠিক কেমন রিয়েক্ট করেন! কোনো কিছুই ভেবে পেল না অর্পণ। তবুও মনে সাহস সঞ্চার করে সমস্ত ঘটনাগুলোকে একে একে বলতে শুরু করল৷ সেই সঙ্গে তার কাছে থাকা প্রমাণ গুলোকেও সকলের সামনে তুলে ধরল৷ এতদিন ধরে বহু মৃত্তিকা এই প্রমাণ গুলোকে জোগাড় করেছে৷ টিভি স্ক্রিনে নাজিম চৌধুরীর সকল জবানবন্দির ভিডিও দেখা যাচ্ছে। এই রেকর্ডিংটা কাল বিকেলে করা হয়েছিল৷ নাজিম চৌধুরী সব সত্যি নিজের মুখে স্বীকার করেছিলেন৷ প্রায় বিশ বছর ধরে দুজনে একসঙ্গে অর্গান ট্রাফিকিং এর কাজ করে আসছেন। এ কাজে আরও কয়েকজনের হাত রয়েছে। সকলের মনোযোগ এখন টিভি স্ক্রিনে। নাজিম চৌধুরী বলছেন‚

“মেহরাব শিকদারের প্রত্যেকটা অপকর্মের সাক্ষী আমি নিজে। দীর্ঘ বিশ বছর যাবৎ আমরা এই প্রফেশনে আছি। আমাদের আরও কয়েকজন কর্মচারী রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বেশকিছু অনুচর। হসপিটালে দুজন নার্স রয়েছে যারা আমাদেরকে রোগীর ব্যবস্থা করে দেয়৷ যারা গরীব অসহায় তাদের অনেক বেশি টাকার অফার করা হয়৷ আবার অনেকে রয়েছে যাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। মানে মৃত্যুর পথযাত্রী অথবা বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে তাদেরকে জোর করে বন্ড পেপারে সই করিয়ে অর্গান কালেক্ট করা হয়৷ বানিজ্যিক লেনদেনের উদ্দেশে মানুষের দেহ হতে অর্গান অপসারণ করা হয়। পুরোটা অবৈধ উপায়ে সম্পন্ন হয়। অতিরিক্ত লাভের জন্য বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায়ী ‘অর্গান ট্রাফিকিং’কে প্রফেশন হিসেবে নিজের করে নিয়েছে। জানা গিয়েছে— অর্গান বিক্রির বিরুদ্ধে অধ্যাদেশ সত্ত্বেও‚ এই অভ্যাসটি অব্যাহত রয়েছে। গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে যে‚ প্রতিস্থাপিত অর্গানগুলো শতকরা পাঁচ পার্সেন্ট থেকে বেয়াল্লিশ পার্সেন্ট পর্যন্ত অবৈধভাবে কেনা হয়। এগুলো বেশিরভাগই দেশের বাহিরে এক্সপোর্ট করা হয়৷ যা থেকে প্রতিবছর মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন মুনাফা অর্জন করা যেতে পারে। ইদানীং এ ব্যবসার চাহিদা বাড়ছে।”

নাজিম চৌধুরী একটু থেমে আবারও বলতে শুরু করলেন‚ “মহুয়াকে আমি শুরু থেকেই চিনি৷ মহুয়া অতিমাত্রায় সুন্দরী হওয়ার দরুন প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গিয়েছিল মেহরাব। মুহূর্তেই যেন ভুলতে বসেছিল‚ তার স্ত্রী সন্তানের কথা৷ মহুয়া তার বাবাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল৷ সেদিনই দেখা হয় ওদের৷ মেহরাব পরিকল্পনা করে কীভাবে মহুয়াকে নিজের প্রেমের জালে ফাঁসাতে পারে! কয়েকদিনের মাঝেই নিজের পরিকল্পনায় সফল হয়ে যায়৷ কয়েকমাসের মাথায় মহুয়াকে বিয়ে করে৷ সময় কাটতে থাকে৷ এভাবেই একবছর কেটে যায়৷ কোনো ভাবে মহুয়া আমাদের এসব কাজের কথা জানতে পেরে যায়৷ বহু চেষ্টা করে মেহরাবকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার। এরই মাঝে একদিন খবর আসে মহুয়া অন্তঃসত্ত্বা। মেহরাব যেন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে৷ বাচ্চাটাকে অ্যাবর্শন করিয়ে নিতে বলে। মহুয়া বারণ করায় মেহরাব তার ‘স্ত্রী সন্তান’ রয়েছে এই কথাটা জানিয়ে দেয়। মহুয়ার যেন পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে যায়৷ মেহরাব এও বলে যে‚ তার কথা না শুনলে এ বাচ্চাটা আর তাকে মে’রে ফেলতে দ্বিধাবোধ করবে না। এরপর আর কখনো মহুয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। প্রায় উনিশ বছর পর প্রলয়ের বিয়ের দিন মহুয়াকে দেখতে পাই। সেদিন জানতে পারি ভূমি হচ্ছে মহুয়া আর মেহরাবের মেয়ে। এই সত্যিটা পুরো দুনিয়ার কাছে অজানা৷ মহুয়া কখনোই নিজের আর নিজের সন্তানের অধিকার দাবি করেনি৷ আমি মেহরাবের কাছ থেকে জানতে পেরেছি‚ মহুয়া নাকি সব সত্যিটা ভূমিকে জানিয়ে দিয়েছিল৷ এরপর থেকে মেহরাব উন্মাদ হয়ে ওঠে মহুয়া আর ভূমিকে মে’রে ফেলার৷ মহুয়াকে যেদিন খু’ন করা হয় সেদিনই ভূমিকে অপহরণ করে আমার লোকেরা। মেহরাবের কথাতেই এমনটা করা হয়েছে৷ ভূমিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গণিকালয়ে৷ সেখান থেকেও যখন ভূমি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় তখন মেহরাব অনেক চেষ্টা করে ভূমিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার৷ সুযোগটা একদিন হয়েও যায়৷ সেদিন রাস্তায় আমার লোকেদের কবলে পড়ে ভূমি। বেধড়ক করাঘাতে মৃতপ্রায় ভূমি বাঁচার জন্য ফরিয়াদ করছিল। সেদিন বেঁচে গিয়েছিল ভূমি কিন্তু বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি। এরজন্য একমাত্র দোষী আমি নিজে। এর আগেও একবার আমার লোক ভূমির এক্সিডেন্ট করাতে চেয়েছিল৷ কিছু সফল হয়নি। সময় এভাবেই অতিবাহিত হয়। ভূমিই যে আসলে মৃত্তিকা এটা আমার জানা ছিল না। আমি কালই জানতে পেরেছি৷ আমি আমার সকল দোষ কবুল করছি।”

এসব কথা শোনা মাত্রই ফিরোজা অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়বার আগেই অর্পণ তার মাকে ধরে ফেলল৷ উপস্তিত সকলেই যেন কোনো স্বপ্ন দেখছেন। মেহরাব শিকদারকে একেকজনে একেক কথা শোনাচ্ছেন৷ কেউ কেউ বা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ইরার মা নাজমা আগে থেকেই এই সমস্ত কথা জানতেন। কিন্তু তিনি এটা জানতেন না মহুয়াকে খু’ন করা হয়েছিল। তিনি এতদিন জেনে এসেছেন মহুয়ার মৃ’ত্যুটা স্বাভাবিক ছিল। অবশ্যই এমনটা দেখানো হয়েছিল। আমরা মানুষ জাতি চোখের দেখাটাকে সবসময় সত্যি বলে মনে করি। আসলে আমাদের অদেখা এমন অনেক সত্যিই লুকিয়ে থাকে৷ যেটা আমরা দেখতে চাই না বা দেখতে পারি না৷ এদিকে ফিরোজা ঘৃণায় অপমানে কারোর দিকে মুখ তুলে তাকাতে অবধি পারছেন না৷ লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসছে৷ এই একটা লোকের সঙ্গে তিনি নিজের জীবনের আটাশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন অথচ এর মুখোশের আড়ালে থাকা পশুটাকে কখনো চিনতেই পারেননি৷ পারবেন কী করে? অহর্নিশ ভালো মানুষ হবার নাটক যে করে গেছেন। ফিরোজা বারবার নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছেন। জীবন নিয়ে বহু অভিযোগ জমা হয়েছে৷ নিজের প্রতি বাড়ছে ঘৃণা। উপস্থিত সকলেই ছিহ্— ছিহ্! করছেন। ফিরোজার বড়ো বোন ফাহমিদা বললেন‚

“মেহরাবের তো কঠিন থেকেও কঠিনতম শাস্তি হবে। এতগুলো মানুষকে ঠকানো‚ খু’ন করার মতো অপরাধ‚ অঙ্গ পাচারের মতো খারাপ কাজ।”

এবার মুখ খুললেন ফিরোজা৷ “ওর স্ত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আমার ঘেন্না হচ্ছে৷ সারাজীবন একটা সয়তানের সঙ্গে সংসার করে গেলাম৷ মহুয়া আর ভূমির সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে আর অর্পণকেও ঠকিয়েছে৷ ওকে আর আমাদের জীবনে চাই না। এর থেকে আমার ছেলে অনাথ হয়ে যাক৷”

অর্গান ট্রাফিকিং এর দোষটা ঢাকতে গিয়ে মেহরাব শিকদার আজ খু’নির তকমা নিয়েও ঘুরছে। সে তো পশুর চাইতেও অধম৷ কান্নায় ভেঙে পড়লেন ফিরোজা। এদিকে মাধুরী নিজের কাজে খুবই লজ্জিত। অপরাধ তো তিনি কম করেননি। এর ক্ষমা কোথায় মিলবে? হুহু করে কেঁদে উঠলেন মাধুরী। ধরা গলায় বললেন‚

“কোনো বাবা এতটাও খারাপ কী করে হতে পারে? ও পাগল হয়ে গিয়েছে৷ ওকে মেন্টাল অ্যাসায়লামে পাঠানো উচিত।”

চলবে?…..