#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। মোর্শেদ শিকদার আর মেহরাব শিকদার নিজেদের ঘরে চলে গিয়েছেন৷ সময় গড়াচ্ছে৷ উনাদেরও কাজে বের হতে হবে। এদিকে অর্পণের খাওয়া শেষ। সে প্রলয়কে বলল‚
“ভাই আমাকে হসপিটাল যেতে হবে।”
মুখে খাবার নিয়েই প্রলয় বলল‚ “জানি। অল দ্য বেস্ট। এ নতুন কিছু না৷ ডাক্তার হয়েছিস হসপিটালে তো জয়েন করতেই হবে।“
থতমত খেয়ে গেল অর্পণ। শব্দ করে হেসে উঠল পূর্ণতা পুষ্পিতা। একপলক সবার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল ভূমি। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্পণের অস্বস্তি হতে পারে বলে মনে হলো তার৷ পুষ্পিতা বলল‚
“ছোটো ভাইয়া তুমি তো বড়ো ভাইয়ার কাছ থেকে পাত্তাই পেলে না।”
আর একদণ্ড বসল না অর্পণ। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে নিজের ঘরে চলে গেল৷ হসপিটালে যেতে হবে তাকে৷ আজই হসপিটালে তার প্রথম দিন। কাল রাতেই মেহরাব শিকদার বলে দিয়েছিলেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আগেই দেওয়া হয়েছিল। মেহরাব শিকদারও সেই একই হসপিটালে কর্মরত। খুব কম সময়েই তিনি সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন এই হসপিটাল থেকে৷
খাবার পর্ব চুকিয়ে প্রলয় বলল‚ “পূর্ণ পুষ্প!”
পূর্ণতা পুষ্পিতা একই সঙ্গে বলে উঠল‚ “জি বড়ো ভাইয়া?”
“খাওয়া শেষ হলে তোদের ভাবিমণিকে ঘরে নিয়ে আসবি।”
বেশ কিছুক্ষণ পর ভূমি ঘরে এলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে প্রলয় দাঁড়িয়ে। মেদহীন দীর্ঘ দেহাবয়ব। গায়ে শুভ্র শার্ট জড়ানো। হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রাখা। হেয়ার ব্রাশ দিয়ে চুল স্যাট করে নিল প্রলয়। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করে চশমা ঠিক করল। এরই মাঝে ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রমণী খুব ধীরেই বিছানার কাছে এলো। কী করা উচিত বুঝতে পারছে না যেন। প্রলয় নিজে থেকেই অগ্রসর হলো ভূমির সমীপে৷ হাতে শীতল স্পর্শ অনুভূত হতেই কেঁপে উঠল যেন। হাতের মুঠোয় প্রলয়ের ঘড়ি। তাকে কেন দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারল না সে! প্রলয় হাতটা বাড়িয়ে বলল‚
“ঘড়িটা পড়িয়ে দাও।”
বিনাবাক্য ব্যয়ে ঘড়িটা পড়িয়ে দিল ভূমি। তবে মনে মনে ভাবল ‘ঘড়িটা তো নিজেও পড়ে নিতে পারতেন— আমাকে দিয়েই কেন পড়ালেন?’ তৈরি হয়ে প্রলয় বলল‚
“আমার আসতে দেরি হবে৷ আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করতে যেও না। মা এখনো ক্ষেপে আছেন৷ দরকার হলে উনি নিজেই তোমাকে ডেকে নেবেন।”
কোমল স্বরে ভূমি বলল‚ “জি!”
পরবর্তীতে প্রলয় আর কিছুই বলল না। চার্জে বসানো ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ের ঘরে গিয়ে বিদায় নিয়ে মালঞ্চ নীড় হতে বের হলো সে। নিজের গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছে৷ বাহিরে গেলে প্রলয় কখনো ড্রাইভার নিয়ে যায় না৷ নিজে ড্রাইভ করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।
মেজাজ খিটখিটে হয়ে রয়েছে মাধুরীর। চোখ মুখে এখনো আঁধার নেমে রয়েছে। খাবার টেবিলে তখন স্বামীর কথা একটুও পছন্দ হয়নি উনার৷ কই স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন তা না করে পরের বাড়ির মেয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন। মোর্শেদ শিকদারের দিকে অফিস ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললেন‚
“খাবার টেবিলে তুমি কাজটা ঠিক করলে না।”
ব্যাগটা নিয়ে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “কোন কাজটা?”
“তুমি আমার পক্ষ না নিয়ে ওই মেয়েটার পক্ষে কথা বলেছ।”
“তুমি মা! তুমি যদি সন্তানকে ক্ষমা করে না দাও‚ সন্তানকে বুকে টেনে না নাও তাহলে কে নেবে? আমি জানি আমার রূপমাধুরী এতটাও নির্দয়া নয়৷ এখন হয়তো রাগের মাথায় অনেক কিছুই বলছ কিন্তু একটা সময় গিয়ে তুমিও সবটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে।”
“ওই মেয়েকে আমি কোনোদিনও মেনে নেব না৷”
মোর্শেদ শিকদার মুখ কিছু না বললেও নিঃশব্দে হাসলেন। স্ত্রীকে তিনি খুব ভালো করেই চেনেন৷ ভূমিকে মেনে নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। রাগ পড়ে গেলেই সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মাধুরী গিয়ে আলমারি খুললেন। লকারে তালাবদ্ধ করে রাখা একটা মাঝারি দেখতে কাঠের বাক্স বের করলেন তিনি৷ আলমারি আটকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন বাক্সখানা। বহু বছরের যত্নে রাখা অলঙ্কার গুলো বের করে রাখলেন বিছানার উপর। একজোড়া কঙ্কণ বের করে দেখতে লাগলেন। উনি ছিলেন শিকদার বাড়ির বড়ো বউ৷ বিয়ের দিনই এই কঙ্কণ জোড়া উনার শাশুড়ী পড়িয়ে দিয়েছিলেন। বংশের পরম্পরায় এই কঙ্কণ জোড়া বাড়ির বড়ো বউয়ের হাতেই শোভা পায়৷ সেক্ষেত্রে মাধুরী পর এই কঙ্কণ জোড়ার হকদার প্রলয়ের বউ অর্থাৎ ভূমি।
“হঠাৎ গহনা বের করছ কেন?”
“তোমার ছেলে যে বিয়ে করেছে— এটা কী পাড়াপড়শির জানতে বাকি আছে নাকি? তারা যদি তোমার ছেলের বউকে দেখতে আসে তখন কী এভাবেই ছেলের বউকে দেখাবে নাকি?”
এবারও নিঃশব্দে হাসলেন মোর্শেদ শিকদার। মুখ ফুটে শুধু একটা কথাই বললেন‚ “আমার ছেলে বিয়ে করে বউ এনেছে। সে বুঝি তোমার কেউ না?”
“আমার হয়েছে যত জ্বালা।”
হাতের তালুতে রাখা কঙ্কণ জোড়া বাক্সতে ভরে নিলেন মাধুরী। অবিলম্বে বাক্স খানা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। নিচ তলা থেকে সোজা দ্বিতীয় তলায় চলে গেলেন। উপর তলায় ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা কামরা৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা ছোটো বেলা থেকে একসঙ্গে থেকে অভ্যস্ত। প্রলয়ের ঘরের সামনে এসে ভদ্রতার খাতিরে কড়া নাড়লেন মাধুরী। ভূমি তখন বিছানায় চুপটি করে বসে ওড়নার আঁচল হাতের আঙুলে পেঁচাচ্ছিল৷ এমন সময় বড়ো বড়ো পা ফেলে মাধুরী ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। উনাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াল ভূমি৷ তিনি এগিয়ে গেলেন বিছানার কাছে।
“বোসো দাঁড়াতে হবে না।”
মাধুরী এসে বিছানায় না বসা অবধি ভূমি দাঁড়িয়েই রইল। এভাবে গুরুজনদের সামনে বসে থাকা মানেই বেয়াদবি। আম্মা শিখিয়েছিলেন। আবারও গভীর দৃষ্টে পর্যবেক্ষণ করলেন মাধুরী। গম্ভীর স্বরে শুধালেন‚
“তা তোমার পুরো নাম কী?”
“ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”
“তোমার বাবা মায়ের নাম?”
“আমার বাবা নেই। আম্মার নাম মহুয়া। সারাটা জীবন খুব কষ্টে আমাকে মানুষ করেছেন৷”
শিথিল হলেন মাধুরী৷ কিছুটা নরম স্বরে বললেন‚ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না— বসো।”
মাধুরীর কথানুযায়ী ভূমি বসে পড়ল বিছানায়। এবার কিছুটা ব্যঙ্গোক্তি করে বললেন‚
“দুদণ্ড কথা বলছি বলে ভেব না আমি তোমাকে মেনে নিয়েছি! আমি মোটেও তোমাকে মেনে নিইনি।”
ভূমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেও কিছু বললেন না মাধুরী৷ কঙ্কণ জোড়া ভূমির হাতে পড়িয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে কানে‚ নাকে আর গলায় একটা চিকন চেইন পড়িয়ে দিলেন৷ এক অন্যরকম দীপ্তি ছড়াচ্ছে৷ এবার দেখে মনে হচ্ছে নতুন বউ৷
“এই খবর হয়তো পাড়াপড়শির জানতে আর বাকি নেই। ওরা হুমড়ি খেয়ে এলো বোলে৷ আমাদের পরিবারের একটা মানসম্মান আছে৷ যা বলবে বুঝে শুনে বলবে। এর প্রতিক্রিয়া যেন আমার ছেলের রাজনীতির ক্যারিয়ারে না পড়ে। আর হ্যাঁ সবসময় এগুলো পড়ে থাকবে৷ আমি না মানলেও শিকদার বাড়ির বউ তুমি।”
ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। মাধুরী যেভাবে এসেছিলেন আবারও ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ঘরের দরজা ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গেলেন।
বিকেলে…
রান্নাঘরে তাড়াহুড়ো করে কাজ করছে সাবিনা। আজ চাপটা একটু বেশিই। তারউপর ‘বিন বুলায়ে মেহমান’ হিসেবে হাজির হয়েছে পাড়াপড়শি। হাতে হাতে সাহায্য করছেন মাধুরী৷ ফিরোজা গিয়েছেন প্রলয়ের ঘরে৷ ভালো একটা শাড়ি পরিয়ে তৈরি করে দিলেন ভূমিকে৷ এরপর নিজের সঙ্গে করে ভূমিকে নিয়ে এলেন বৈঠকখানায়। মাধুরী এসে বসলেন ছেলের বউয়ের পাশে৷ না জানি কখন কী উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে বসেন অন্যরা৷ টি-টেবিলের উপর নাস্তা মিষ্টি দেওয়া হয়েছে। একজন জিজ্ঞেস করে উঠলেন‚
“তা বউমা তোমার নাম কী? বাড়িতে কে কে আছে?”
একসঙ্গে এত এত প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে গেল ভূমি। মাধুরী আর ফিরোজাও এখানেই বসে রয়েছেন। ভূমি বলল‚
“ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি। শুধু আমার আম্মা আছেন।”
মাধুরী কথা কা’টানোর জন্য বললেন‚ “উনাদের নাস্তা গুলো এগিয়ে দাও৷”
ভূমি মিষ্টির প্লেট গুলো এগিয়ে দিল সকলের হাতে হাতে। প্রতিবেশী লিপি ভাবি বললেন‚
“ছেলের বিয়ে নিয়ে একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেললে মাধুরী। আমার মেয়ে কী এই মেয়ের থেকে কম সুন্দরী ছিল?”
আরেকজন বলল‚ “বউ তো দেখতে শুনতে ভালোই। তা ছেলের জন্য এমন পরী কোথা থেকে আনলে মাধুরী?”
“অনেক খুঁজে বের করেছি এমন হিরে৷ যেমন রূপ তার তেমনই গুন। আমার প্রলয়ের যোগ্য জীবনসঙ্গী।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানসম্মান বাঁচাতে কিছুটা মিথ্যে বলতে হলো বৈকি। ভূমি মাথা নিচু করে রইল৷ পাশের বাড়ির তনিমা ভাবি বললেন‚
“কত মেয়ের ছবি দেখালাম তোমাকে। তখন তো কাউকে পছন্দ হলো না। বেছে বেছে গ্রামেই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আনলে। আর ছেলের বিয়ের এত তাড়াহুড়োই বা কেন?”
ভূমির কাঁধে হাত রেখে মাধুরী বললেন‚ “এমন সুন্দরী মেয়ে কী আর হাতছাড়া করা যায়? তবে তোমরা চিন্তা কোরো না। আসছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি বেশ বড়ো করে রিসেপশনের আয়োজন করা হবে।”
একটু থেমে মাধুরী গলা ঝেড়ে সাবিনাকে ডাকলেন৷ পরপরই সাবিনা ট্রে-তে করে আরও নাস্তা আর কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে এলো৷ সবাইকে হাতে হাতে নাস্তা আর কোল্ড ডিংকস এগিয়ে দিল সাবিনা৷ এরপর আবারও রান্নাঘরে ছুটে গেল। মাধুরী বললেন‚
“বউমা তুমি ঘরে যাও৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা তোদের ভাবিমণিকে ঘরে নিয়ে যা৷”
মাধুরীর মুখে বউমা ডাকটা শুনে আঁখিদ্বয় অশ্রুপ্লাবিত হলো৷ মিথ্যে হলেও ডাকটা ভীষণ আদুরে আর স্নেহমাখা ছিল৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা নিয়ে যেতে এলো ভূমিকে।
বিস্তীর্ণ অম্বর জুড়ে র’ক্তজবারয় বিচরণ। নীলিমা ম্লান করছে একটু একটু করে। অলিগলির সোডিয়াম বাতি গুলো একটা একটা করে জ্বলে উঠছে৷ অদূরে মসজিদে আযানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। মাথায় ওড়না জড়িয়ে বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলো ভূমি৷ পাড়াপড়শিরা চলে গিয়েছে আধ ঘণ্টা হবে হয়তো। ঘরে এসেই শাড়িখানা পাল্টে নিয়েছিল সে৷ শাড়িতে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না সে। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোধূলি লগ্ন উপভোগ করছিল। ভূমি ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো। ওযু করে মাগরিবের নামায আদায় করে নেবে৷ সেই সকাল থেকে এই কামরার চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে রয়েছে৷ ভালো লাগছে না আর। কেউ তাকে কোনো কাজের জন্যও ডাকছে না। একটু কাজের মাঝে থাকলেও তো কিছুটা ভালো লাগবে৷ নামায আদায় করে‚ চুলে বিনুনি গেঁথে নিল ভূমি। এরপর মাথায় ওড়নার ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হতেই দেখতে পেল সদর দরজা পেরিয়ে অর্পণ আসছে। হসপিটাল থেকেই ফিরছে বোধহয়। কাল তো উনার ফোন থেকেই আম্মার সঙ্গে কথা হয়েছিল৷ আজও যদি একটু কথা বলতে পারত৷ মনে মনে ভাবতে শুরু করল ভূমি। অর্পণের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ কিছুটা আমতা আমতা করেই বলল‚
“ভাইয়া আমাকে একটু আম্মার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন?”
অর্পণ অকপটেই জবাব দিল‚ “একটু অপেক্ষা করুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
ভূমি সায় জানাতেই অর্পণ সিঁড়ি ভেঙে তার ঘরে চলে গেল। ভূমি রান্নাঘরে গেল৷ তাকে রান্নাঘরে দেখেই ফিরোজা বললেন‚
“একি তুমি রান্নাঘরে আসতে গেলে কেন? তোমার পায়ে তো এখনো ব্যথা রয়েছে।”
“সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না চাচি মা৷ আমি একটু সাহায্য করি।”
গাল এলিয়ে হাসলেন ফিরোজা। প্রত্যুত্তর করলেন না তিনি। ভূমির হাতে তিনটে নুডলসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন‚
“পূর্ণতা পুষ্পিতা পড়তে বসেছে৷ দুটো বাটি ওদের দুজনের জন্য। আরেকটা তোমার। এখন আপাতত তোমার এটাই কাজ।”
ভূমি নুডলসের দিকে তাকাল। একবার মেলায় গিয়ে খেয়েছিল খেতে খুব একটা ভালো লাগেনি। এরপর অবশ্য আম্মা কয়েকবার বাজার থেকে নুডলসের প্যাকেট এনে দিয়েছিলেন৷ নিজেই রান্না করাও শিখিয়েছিলেন। খেতে বেশ সুস্বাদু ছিল। ভূমি ট্রে খানা হাত নিয়ে নিল। ফিরোজা বললেন‚
“পূর্ণ পুষ্পর ঘরটা চেন তো?”
“জি।”
“আচ্ছা যাও।”
ভূমি ধীর পায়ে যেভাবে এসেছিল আবার সেভাবেই সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল। অর্পণের পাশের ঘরটায় ওরা দুবোন থাকে। ভূমি গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল‚
“আসব।”
পড়তে বসেছিল পূর্ণতা পুষ্পিতা। ভূমির গলার স্বর পেয়েই তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিল পুষ্পিতা৷ বইয়ের দিক থেকে মুখ তুলে তাকাল পূর্ণতা। ভূমিকে পেয়ে খুশি হয়ে গেল দুটোতে৷ পুষ্পিতা বলল‚
“আরে ভাবিমণি। ঘরে এসো।”
পুষ্পিতা ট্রে টা নিজের হাতে নিয়ে নিল। ভূমি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরটা বেশ খোলামেলা। পূর্ণতা বই রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভূমিকে নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানাতে৷ ওরা দুবোনও বিছানায় বসল৷ পূর্ণতা একটা বাটি এগিয়ে দিল ভূমির দিকে। মুচকি হেসে নুডলসের বাটিটা নিল ভূমি। বাকি দুটো বাটি ওরা দুবোনও ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
গোসল করে বের হয়েছে অর্পণ। হুট করেই মনে পড়ল ভূমি তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল৷ গোসল করতে ঢুকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে। না জানি মেয়েটা কী ভাবছে৷ তাড়াতাড়ি করে ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট বের করে পড়ে ফেলল। এরপর বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিল। ঘর থেকে বেরিয়ে প্রলয়ের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে থেকেই ইরার নাম্বারের ডায়াল করল। কেউ কল তুলল না। দরজা কড়া নাড়তেও ওপাশ থেকে কারো সাড়া মিলল না৷ অর্পণ নিচে রান্নাঘরের দিকে গেল। না! এখানেও নেই। সে তার মাকে জিজ্ঞেস করল‚
“উনি কোথায় মা?”
বুঝতে পারলেন না ফিরোজা। কাজ থামিয়ে দিয়ে বললেন‚
“কী বললি— বুঝিনি আমি।”
“ভূমি কোথায়?”
“ও তো পূর্ণ পুষ্পর ঘরে৷”
আর কিছু বলল না অর্পণ। পূর্ণ পুষ্পর ঘরের দিকেই অগ্রসর হলো। এদিকে ইরা কল ব্যাক করেছে অর্পণের নাম্বারে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইরার কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো। ইরা বলছে‚
“কী ব্যাপার— আজ নিজে থেকে কল করেছেন?”
“আমার বয়েই গিয়েছে তোমার সাথে কথা বলার।”
“তাহলে কল কে’টে দিই?”
“অ্যাই না।”
“এই তো বললেন— আপনার বয়েই গিয়েছে।”
কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “মহুয়া আন্টি আছেন সামনে?”
“হ্যাঁ! আন্টি এখন রান্নাঘরে।”
“একটু দেওয়া যাবে? ভূমি কথা বলবেন।”
“হ্যাঁ দিচ্ছি।”
এতক্ষণে পূর্ণ পুষ্পর ঘরের সামনে চলেই এসেছে। বাহির থেকে ডাকতেই পূর্ণতা দরজা খুলে দাঁড়াল। অর্পণ ঘরে প্রবেশ করেই ভূমির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল‚
“মহুয়া আন্টির সঙ্গে কথা বলুন।”
ফোনটা নিয়ে নিল ভূমি। অর্পণ এতক্ষণে চলে গিয়েছে। ফোন কানে ধরে শুধাল‚
“কেমন আছ আম্মা?”
“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই ভালো আছিস তো? জামাই কেমন আছে? বাড়ির সকলে ভালো তো?”
“হ্যাঁ আম্মা সকলেই ভালো আছেন৷ আমিও ভালো আছি। আমার তোমাকে খুব মনে পড়ছে আম্মা৷ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷”
আঁচল টেনে চোখের পানি মুছে নিলেন মহুয়া৷ এদিকে অশ্রুপ্লাবিত হয়েছে ভূমির অক্ষিকোটরে। যেকোনো সময় উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে পারে৷ মেয়ে দুটোর সামনে কিছুতেই কাঁদবে না সে। আড়ালেই চোখের জল মুছে ফেলল ভূমি। ওপাশ থেকে মহুয়া বললন‚
“সময় করে জামাইকে নিয়ে ঘুরে যাবি।”
রাতে…
অমা বিদায় নিয়ে জোছনা উঁকি দিয়েছে অন্তরিক্ষে৷ হাতে গোনা কয়েকটা তারাও উঁকি দিচ্ছে। গায়ের ওড়না জড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। প্রলয়ের আসার অপেক্ষা করছে সে। সবাই হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে। তখন আম্মা পই পই করে বলেছেন কোনো কাজ দেখলে গুটিয়ে বসে না থাকতে। সকলের মন জুগিয়ে চলতে। স্বামী যতক্ষণ না বাড়ি ফিরছে ততক্ষণ জেগে থাকতে। স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। এই কথাটা শুনে কিছুটা লজ্জায় বোধ হয়েছিল তখন। সকালে তো দুজনে একসঙ্গে নাস্তা করেছিল৷ আম্মার কথা মেনে রাতের খাবার খায়নি এখনো। গ্রামে থাকলে তো এতক্ষণে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েই পড়ত৷ রাত অনেক হয়েছে। ঘুমও পাচ্ছে ভীষণ।
এক টুকরো রূপালি চাঁদ নিজের আত্মশ্লাঘা ছড়াচ্ছে। মুক্ত হস্তে দান করছে নিজস্ব কিরণ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল কালো রঙা গাড়িটা মালঞ্চ নীড়ে ফিরেছে৷ বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল ভূমি। ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলো। পায়ে ব্যথা নিয়েই সদর দরজার কাছে চলে গেল৷ হুট করে তার কী হয়েছে জানা নেই৷ সবকিছুই যেন অজানা। সদর দরজা খুলে দিতেই প্রলয় বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল৷ ভূমিকে এই সময় দরজা খুলতে দেখে অবাক হলো ভীষণ। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতেই শুধাল‚
“কী ব্যাপার আজ এখনো জেগে আছ যে?”
ভূমি হাতে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে বলল‚ “ঘুম আসছিল না।”
চোখের চশমা ঠিক করে প্রলয় আবারও বলল‚ “কিন্তু আমি যে দেখতে পাচ্ছি ঘুমে চোখ টইটুম্বুর!”
ভূমি এবার বলল‚ “আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন। আমি আপনার খাবার বাড়ছি।”
“রাতের খাবার খেয়েছ?”
এবার কথা কা’টাবে কী করে? সেটাই ভাবতে শুরু করল ভূমি। তাকে চুপ থাকতে দেখে প্রলয় বলল‚
“খাওয়া হয়নি কেন?”
অকপটে জবাব দিল‚ “তখন আমার ক্ষিধে ছিল না। আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন।”
কিছু বলল না প্রলয়। দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল৷ ভূমি রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করতে শুরু করল। সাবিনা শিখিয়ে দিয়েছে— কীভাবে গ্যাসের চুলো জ্বালাতে নেভাতে হয়। এখন বেশ ভালোই পারছে৷ রাতের জন্য রাখা খাবার গুলো গরম করে নিল৷ এরই মাঝে গোসল সেরে নিয়েছে প্রলয়। আজ ঝড়ের গতিতে গোসল করেছে সে। পড়নের টিশার্টটা ঠিক করতে করতেই নিচে নেমে এলো৷ চুলগুলো সদ্য ভেজা৷ ভূমি তখন খাবার গুলো টেবিলে রাখছিল৷ প্রলয় গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। তাকে দেখেই ভূমি বলল‚
“অসময়ে গোসল করবেন না— ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ভূমির কথার প্রত্যুত্তর করল না প্রলয়। শুধু ক্ষীণ হাসল। প্লেটে খাবার বেড়ে দিল ভূমি। নিজের জন্যও খাবার বেড়েছে। প্রলয় হাত ধুতে ধুতে বলল‚
“আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকার প্রয়োজন নেই। তোমার যখন ক্ষিধে পাবে তখনই খেয়ে নেবে। মনে থাকবে আমার কথা?”
ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। সে নিজেও খেতে বসেছে। ক্ষিধে পেয়েছিল খুব। প্রলয় ভাত মাখতে শুরু করল৷ প্রথম লোকমা ভূমির মুখের সামনে তুলে ধরল প্রলয়। ইশারায় বলল খেয়ে নিতে৷ অস্বস্তি হচ্ছে ভূমির। ভীষণ রকমের অস্বস্তি। দুদিনের মাঝে এতটা স্বাভাবিক আচরণ কী করে করতে পারে? বুঝে পেল না ভূমি। মুখের সামনে লোকমা সেভাবে তুলেই প্রলয় বলল‚
“স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে খেতে বসলে যেমন ভালোবাসা বাড়ে তেমন স্ত্রীকে খাইয়ে দেওয়াও সুন্নত।”
প্রলয়ের কথায় থতমত খেয়ে গেল ভূমি। লোকটা বুঝে গেল! ভাবতেই লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। মুখের সামনে ধরে রাখা লোকমা নিঃশব্দে খেয়ে নিল সে।
বিশাল কামরায় সবুজরঙা ঘুম বাতি জ্বলছে৷ রাতের গভীর অমা ঘুটঘুটে রূপ নিয়েছে৷ গভীর হচ্ছে যামিনী। সকলের তন্দ্রাপ্রহর নামলেও দুটো মানুষ এখনো জেগে রয়েছে৷ খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ভূমির হাত ধরে ঘরে নিয়ে এসেছে প্রলয়। বিছানার উপর ভেজা তোয়ালে পড়ে রয়েছে৷ ভূমি সেটা আলগোছে তুলে নিয়ে বারান্দায় মেলে দিয়ে এসেছে৷ এরই মাঝে ভূমির পায়ের দিকে নজর পড়ল প্রলয়ের৷ দেখা মাত্রই শুধাল‚
“পায়ের ড্রেসিং করেছিলে?”
কী বলবে ভেবে পায় না। কাল দুপুর থেকেই তো এভাবে বেন্ডেজ করা। বিয়ের পড়ানোর পরপরই যখন ভূমি জ্ঞান হারিয়েছিল তখনই মূলত আরশ বেন্ডেজ করে দিয়েছিল পায়ে। ব্যথা জায়গায় নুরিকণার আঘা’তে পুরশু রাতের ক্ষ’ত থেকে র’ক্ত বের হচ্ছিল ক্রমাগত। কাল আরশ বারবার বলে দিয়েছিল ড্রেসিং করে নিতে। এতকিছুর মাঝে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ভূমি৷ কীভাবে ড্রেসিং করতে হয় সেটাও জানা নেই। এ ঘরে কোথায় কী রাখা আছে সেটাও জানা নেই! প্রলয় যা বুঝার বুঝে নিল। ভূমিকে বলল‚
“বোসো বিছানায়৷”
প্রলয়ের কথানুযায়ী বিছানায় বসল ভূমি। একটু খানি ঝুকে বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফার্স্টএইড বক্স বের করল প্রলয়৷ বসে বসে হাই তুলছে ভূমি। ঘুম পেয়েছে ভীষণ। দুপুরে ঘুমোনোর সুযোগ পেল কোথায়? দুপুরে ঘুমোনো অভ্যেস আছে তার৷ মুখ তুলে একবার ভূমির দিকে তাকাল প্রলয়। এভাবে হাই তুলতে দেখে নিঃশব্দে হাসলও খানিকটা৷ ফার্স্টএইড বক্স বিছানার উপর রেখে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসল। কিছুটা ভড়কাল ভূমি৷ পায়ে স্পর্শ করার আগেই পিছিয়ে গেল সে৷ প্রলয় কী করতে চাইছে তা বুঝতে পারল। নিজে থেকেই বলল‚
“আপনি ব্যস্ত হবেন না৷ আমি করে নেব।”
“বাড়তি কথা শুনতে চাইছি না। পা এগিয়ে দাও।”
খুব অস্বস্তি হলো। সে বুঝতে পারল প্রলয় তার সাথে সহজ হবার চেষ্টা করছে৷ এভাবে পা তুলে দেওয়া মানে তো বেয়াদবি করা। প্রলয় তার গুরুজন। এটা তো সে কস্মিনকালেও করতে পারবে না। কেন বুঝতে পারছে না প্রলয়? সে কী এতটাই অবুঝ? ভূমি শুনল না তার কথা৷ প্রলয় নিজে থেকেই ভূমির পা নিজের হাঁটুর উপর রাখল। বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে ডান হাত দ্বারা বেন্ডেজ খুলে দিল। ক্ষ’ত শুকতে শুরু করছে। ভূমি একটি বার তাকিয়ে দেখল। এরপর সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিল। এসব কা’টাছেড়া ক্ষ’ত সে দেখতে পারে না৷ ভয় করে ভীষণ।
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সকালের নীরব শান্ত পরিবেশে হানা নিয়েছে পাখির কিচিরমিচির কলরব। জানালা ভেদ করে সোনালি রোদ আছড়ে পড়ছে৷ দিবসপতির তপ্ততা ভীষণ। রুঠো তপ্ততায় গরম অনুভূত হচ্ছে খুব। ঘুম ভেঙেছে ভূমির। আজও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে৷ দেহে বন্ধন উপলব্ধি করতেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল ভূমি। দেখতে পেল প্রলয়ের সঙ্গে নিজের বন্ধনদশা। তার স্পষ্ট মনে আছে দুজনে দু’প্রান্তে শুয়েছিল। এখন দেখে মনে হচ্ছে ভূমি নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে প্রলয়ের বক্ষঃস্থলে৷ ঘুমের ঘোরেই উষ্ণতা খুঁজে নিয়েছে যেন৷ ভাবতেই মাথা কা’টা যাচ্ছে তার। লজ্জা তখন আকাশস্পর্শী। এ মুখ কী করে দেখাবে? সে যে নিজ থেকে এগিয়ে গিয়েছে প্রলয়ের সমীপে। লোকটা ঘুমিয়ে আছে বিধায় লজ্জার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে৷ মানে মানে কে’টে পড়ার চেষ্টা করতেই রুক্ষ হাতের স্পর্শ গভীর হলো। ক্ষিপ্রবেগে প্রলয়ের দিকে তাকাল সে৷ লোকটা জেগে গিয়েছে৷ ইস! কী লজ্জা— কী লজ্জা! চোখে চোখ রাখতে পারল না ভূমি। মাথা নিচু করে চোখ বন্দ করল৷ ঘুমন্ত ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো‚
“সারাটা জীবন আমাদের একসঙ্গেই কা’টাতে হবে তাই নিজেকে আমার সঙ্গে সহজ হবার চেষ্টা কর।”
বিনিময়ে কিছু বলল না ভূমি। সহস্র অস্বস্তি নিয়ে সেভাবেই শুয়ে রইল প্রলয়ের বুকের উপর মাথা রেখে। মনে মনে ভাবল— জীবনটা কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে৷ কখনো কী ভেবেছিল‚ তার বিয়ে এভাবে হয়ে যাবে? কখনো কী ভেবেছিল‚ এরকম একটা সমৃদ্ধিশালী পরিবারের বউ হয়ে আসবে? ভাবেনি তো! তবুও জীবন কী অবলীলায় রঙ পাল্টাচ্ছে।
প্রলয়ের ঘুম ভেঙেছে সাড়ে আটটায়৷ ভূমির ঘুম তো হয়ইনি উল্টো এতটা সময় হাঁসফাঁস করছিল ছাড়া পাওয়ার জন্য। ভাগ্যিস প্রলয় উঠে পড়েছে নয়তো এতক্ষণে হয়তো অস্বস্তিতেই অক্কা পেত সে৷ এদিকে প্রলয় ওয়াশরুমে গিয়েছে সেই সুযোগে ভূমি বিছানা‚ ঘর গুছিয়ে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরের দিকে ছুটেছে। ভেবেছিল আজ আর প্রলয়ের মুখো হবে না৷ কিন্তু তা আর হবে কোথায়? খাবার খেতে গেলেও তো এমপি মশাইয়ের মুখদর্শন করতে হবে। ঘরে গেলেও তো সেখানে এমপি মশাই উপস্থিত থাকবে৷ ডান হাতের নখ খুটছে আর কী করবে সেটাই ভাবছে ভূমি। এই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির মনে হচ্ছে৷ নিজের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে৷
পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে একবার কড়া নাড়ল ভূমি। ভেতর থেকে কোনো পাল্টা জবাব এলো না৷ হয়তো ঘুমিয়ে রয়েছে৷ সেই ভেবে চলে যেতে নিলেই পূর্ণতা দরজা খুলে দিল। তার ঘুম খুবই হালকা। আওয়াজ পেয়েই উঠে পড়েছিল। পুষ্পিতা এখনো কোলবালিশ আঁকড়ে ঘুমচ্ছে। ঘুমু ঘুমু চোখে ভূমিকে দেখে পূর্ণতা শুধাল‚
“তুমি এই সকাল সকাল আমাদের ঘরে?”
“আমি কী তোমাদের কল ঘরে যেতে পারি?”
“হ্যাঁ ভাবিমণি।”
সম্মতি পেয়ে ভূমি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। হাই তুলতে তুলতে পূর্ণতা গিয়ে শুয়ে পড়ল পুষ্পিতার পাশে৷ তার ঘুম হয়নি আরও ঘুমবে। এমনিতেই কয়েকদিন ধরে দুবোন সকাল দশটার আগে ওঠে না৷ আজও তার অন্যথা হবে না নিশ্চয়ই। অন্যদিকে সকালে কাজ গুলো ফিরোজাকে একা করতে দেখে মাধুরী বললেন‚
“একা হাতে আর কত কাজ করবি৷ সকালে তো অনেক চাপ করে যায় তোর উপর। তাড়াহুড়োয় নাস্তা তৈরি করতে হয়৷ ওই মেয়েকে আজই বলতে হবে‚ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে। কাজ করলে শিকদার বাড়ির বউ হবার শখ মিটে যাবে।”
“আমার কোনো সমস্যা হয় না। আমি একাই পারব ভাবি। মেয়েটা এসেছে আজ সবে দুদিন হলো। সময় হলে নিজে থেকেই সব করবে হাতে হাতে।”
“আমি তো সবই দেখছি। মনে হচ্ছে কিছুই শেখায়নি তার মা। নয়তো কাজ রেখে এভাবে বেলা অবধি ঘুমাতে পারত না৷”
“মেয়েটা সুস্থ হলেই না হয় রান্না দায়িত্ব দিয়ো ভাবি।”
“অসুস্থতা সবই বাহানা৷ দিব্যি তো ওই মেয়ে সারা বাড়ি এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
ফিরোজা কিছু বললেন না৷ কীইবা বলবেন তিনি! এই বাড়ি বউ হয়ে আসার পর কারো মুখের উপর টু শব্দটি করেননি তিনি। আজও কী তার অন্যথা হবে? কক্ষনো না!
পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘর থেকে বেরিয়ে ভূমি নিজেদের ঘরে এলো। প্রলয় এখনো বের হয়নি। লোকটা নিশ্চয়ই গোসল করছেন। এতটা সময় ধরে গোসল করতে হয়? পুরুষ মানুষের গোসলে এত সময় লাগতে হবে কেন? তারা যত দ্রুত সম্ভব গোসল করে বের হবে। কই তার তো এত সময় লাগে না গোসল করতে! তবে যেদিন চুলে শ্যাম্পু করে সেদিন একটু আধটু দেরি হয় বৈকি। এসমস্ত ভাবতে ভাবতেই এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করে নিল ভূমি। পুরো ঘরময় একপলক চোখ বুলিয়ে নিল। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে চলে গেল৷ ভূমিকে দেখে মাত্রই মাধুরী মুখ ঝামটা দিলেন। গম্ভীর অতিশয় কর্কশ কণ্ঠে বললেন‚
“শোন মেয়ে তোমাকে একটা কথা বলি!”
চলার পথেই থেমে গেল ভূমি। মাধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল‚ “জি মা?”
“ঘটা করে আমাকে মা না বললেও চলবে৷ আসল কথায় আসি! শুধু শুয়ে বসে থাকলেই তো চলবে না— কাজও করতে হবে৷ আমি কী বলতে চাইছি‚ আশা করি বুঝেছ!”
মাথা নিচু রেখেই ভূমি বলল‚ “জি আমি বুঝতে পেরেছি।”
“এখানে সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তোমার চাচি মার সঙ্গে কাজে সাহায্য কর।”
“জি!” কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ভূমি। মাধুরী ঘরে চলে গেলেন। মোর্শেদ শিকদার অনেকক্ষণ হলো ডেকেছেন উনাকে৷ না গেলে নিশ্চয়ই এবার চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করবেন৷ বয়স বাড়ছে না কমছে— বুঝে আসে না মাধুরীর৷
সবাই খেতে বসলেও ভূমি এখনো আসেনি। প্রলয় না খেয়ে তারই জন্য অপেক্ষা করছে। সে খাচ্ছে না দেখে মাধুরী শুধালেন‚ “কী হলো বাবা খাচ্ছিস না কেন?”
“সবাই আসুক। একসঙ্গে খাব।”
উপস্থিত সকলেই বুঝলেন প্রলয় ভূমির জন্য অপেক্ষা করছে৷ মাধুরী বাদে বাকিরা মুখ টিপে হাসছে৷ এরই মাঝে উপস্থিত হলো ভূমি‚ পূর্ণিতা পুষ্পিতাকে নিয়ে খাবার টেবিলের সামনে চলে এসেছে। মুখে আঁধার নেমে এলো মাধুরীর৷ ভূমিকে সহ্য হয় না উনার। ছেলের পাশে তো একদমই না। কী করবেন— না পেরে সহ্য করতে হয়। প্রলয় দাঁড়িয়ে পড়ল। ভূমির চেয়ারটা টেনে বসার জন্য ইশারা করল৷ ভূমি বসতেই তার প্লেটে খাবার এগিয়ে দিল প্রলয়৷ উপস্থিত সকলে চুপ করে পর্যবেক্ষণ করছে সবটা৷
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ভূমি যখন নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হবে তখনই ফিরোজা ডেকে বললেন‚ “তোমার চাচ্চু ডাকছেন।”
বড়োদের কথা অবজ্ঞা করার স্পর্ধা ভূমির নেই। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবে— কখনো যে তার আম্মার শিক্ষা নিয়ে কেউ আঙুল না তুলতে পারে! ভূমিকে সঙ্গে করে নিজেদের ঘরে নিয়ে এলেন ফিরোজা। ভূমিকে দেখা মাত্রই মেহরাব শিকদার বললেন‚
“এইতো ভূমি চলে এসেছে৷”
কথাটা বলেই মেহরাব শিকদার ভূমির সামনে এসে দাঁড়ালেন। একটা লাল বক্স ভূমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন‚
“এটা তোমার জন্য আমার তরফ থেকে সামান্য উপহার মা৷”
ভূমি তাকাল ফিরোজার দিকে। উনি ইশারায় বক্সটা নিয়ে বলছেন। সৌজন্যতা বজায় রেখে মেহরাব শিকদারের হাত থেকে বক্সটা নিল সে৷ বিনিময়ে মিষ্টি হেসে বলল‚ “ধন্যবাদ চাচ্চু।”
মাথায় হাত রেখে ক্ষীণ হাসলেন মেহরাব শিকদার। এরই অর্পণ চলে এলো৷ বাবা ছেলে আজ একসঙ্গে হসপিটালে যাবে। একদম ফর্মাল ড্রেসআপে বের হয়েছে অর্পণ। ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মেহরাব শিকদার। এদিকে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে‚ মোর্শেদ শিকদারও বেরিয়ে পড়লেন। অন্যদিকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে প্রলয়। সেই কখন ভূমিকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কই মেয়েটা তো এলো না। রাগ হলো কিছুটা। ভূমি আসার পর থেকে রাগ করা বেমালুম ভুলে গিয়েছে প্রলয়। এদিকে ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল ভূমি। প্রলয় তাকে বকবে না তো? সেই কখন ঘরে আসতে বলেছিলেন।
“এই তোমার সময় হলো ঘরে আসার?”
“চাচি মা ডেকেছিলেন।”
আর কিছু বলল না প্রলয়৷ নিজের মতো তৈরি হতে লাগল৷ হাতে ঘড়ি পড়ে‚ ওয়ালেট আর চার্জে বসানো মোবাইলটা পকেটে নিয়ে নিল৷ ভূমির উপর থেকে জমা সুপ্ত রাগ নিভে গিয়েছে৷ প্রলয় ভূমির মাথায় হাত রেখে বলল‚
“আসছি৷ সাবধানে থাকবে। সময় মতো খাবার খেয়ে নেবে।”
কিছুটা লাজুক হেসে ভূমি বলল‚ “আপনিও সাবধানে যাবেন।”
ভূমির এই একটা কথায় মনপিঞ্জরে আটকে থাকা পাখিগুলো ডানা জাপ্টাতে শুরু করল যেন। ভূমির সঙ্গে সঙ্গে প্রলয়ও ক্ষীণ লাজুক হাসল।
সন্ধ্যেবেলা…
আজ তাড়াতাড়িই বাড়িতে ফিরে এসেছে প্রলয়। বাড়ি ফিরে বৈঠকখানায় ভূমিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ঘরে চলে এলো। যা ভেবেছিল তাই! ভূমি ঘরেই রয়েছে। মাথায় বড়ো ওড়না পেচিয়ে শরীর ঢেকে জায়নামাযে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা দৃঢ় মনোযোগে নামায আদায় করছে। প্রলয় নিঃশব্দে ঘরের ভেতরে গেল৷ মাথা ধরেছে ভীষণ। কড়া করে এক মগ কফি খেলে হয়তো কিছুটা মাথা ব্যথা কমবে। গা থেকে শার্ট খুলে বিছানার উপর রেখে‚ তোয়ালে নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।
গোসল করে বেরিয়ে ঘরে ভূমিকে কোথাও পেল না প্রলয়। তার মনে হলো মেয়েটা শুধু পালাই পালাই করছে। একটু যে চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে তা না— শুধু চোখের আড়াল হয়ে যায় বারবার। মিনিট পাঁচেকের মাথায় ভূমি ঘরে ফিরে এলো। এসেই প্রলয়কে দেখতে পেয়ে শুধাল‚
“আপনি কখন এলেন?”
“আমি এসেছি অনেকটা সময় হয়েছে৷ আমার খেয়াল রাখার মতো সময় কী ম্যাডামের আছে নাকি? বারবার কোথায় চলে যাও?”
প্রলয়ের কথা বোধগম্য হলো না তবু আমতা আমতা করে বলল‚ “পুষ্পিতা ডেকেছিল আমাকে।”
“এখন কোথাও যাবে না। যা কাজ আছে এখানে— ঘরে বসেই কর!”
ভূমির মনে পড়ল বারান্দা থেকে কাপড়গুলো আনা হয়নি। প্রলয়ের কথার উত্তর না দিয়ে বারান্দায় চলে গেল৷ এদিকে এই মেয়ের ছুটোছুটি বন্ধ করতে না পারায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। মাথা ধরা কমেনি। তাই ভাবল নিজেই গিয়ে কফি বানাবে। যেই ভাবা সেই কাজ৷ ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল প্রলয়।
মিনিট দশেক পর…
দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রলয়। হাতে তার কফি মগ৷ নিজেই বানিয়ে নিয়ে এসেছে সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বিছানার এক কোণে বসে কাপড় ভাজ করছে৷ সকালে প্রলয়ের জমিয়ে রাখা ভেজা টিশার্ট আর ট্রাউজার ধুয়ে দিয়েছিল। সেগুলো আর সেইসঙ্গে নিজের জামাকাপড় গুলোও ভাজ করছে ভামি। প্রলয়ের আজও মনে পড়ে সেই প্রথম সাক্ষাতের কথা। সেই অশ্রুপ্লুত মৃগনয়না বিশেষ। গৌর সুশ্রী। গাল দুটো মিষ্টি গোলাপের পাপড়ি। ঘণ দিঘল ভেজা কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ। যে-ই দেখবে তাক লেগে যাবে। এ সাক্ষাৎ নির্মলা ভূমি কন্যা। একা একাই মুচকি হাসছে প্রলয়৷ তাকে এভাবে দেখলে যে কেউই বলবে পাগল হয়ে গিয়েছে। কফি মগ নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল প্রলয়৷ গিয়ে বসল বিছানার অপর পাশে৷ ঠিক ভূমির মুখোমুখি। কফিতে চুমুক দিয়ে একটু থেমে প্রলয় বলল‚
“একটা কথা বলব?”
ভাজ করা কাপড়টা বিছানার একপাশে রেখে আরেকটা কাপড় নিয়ে ভূমি বলল‚ “জি বলুন!”
“তোমার গাল গুলো ভীষণ আদুরে।”
ব্যাস! বো’ম ফাটা হয়েই গেল! ভূমির হাত থেকে পড়ে গেল কাপড়। আর পরিস্থিতি উপলব্ধি করে প্রলয়ের মুখ থেকে কফি বেরিয়ে গেল৷ কথাটা অজান্তেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে প্রলয়। লজ্জা এসে ভর করেছে প্রাপ্তবয়স্ক সেই গম্ভীর চোখের পাতায়। না! ঘরে আর একমুহূর্ত থাকা যাবে না। ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রলয়৷ এতক্ষণের আটকে রাখা তপ্ত নিশ্বাস ফেলল ভূমি। নিশ্বাস নিতেও বেমালুম ভুলতে বসেছিল। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম বাজছে৷ শব্দ তুলছে ভীষণ করে৷ হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে হাত রাখল ভূমি। এ কেমন অনুভূতি? অনুভূতি গুলো যে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে লাজ নিবারণে নিমগ্না ভূমির ওষ্ঠজোড়া কেঁপে উঠল। তখন প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গিয়েছিল৷ প্রলয়ের সামনে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বোধহয় ভালো হয়েছে।
প্রলয় যা বো’মা ফাটিয়েছে‚ যতবার দুজনের চোখাচোখি হচ্ছে ততবারই বুক কেঁপে উঠছে ভূমি৷ আদুরে গালের কথা শুনেই সে কুপোকাত। আরও কিছু শুনলে না জানি কী হয়! বড়ো ডাইনিং টেবিলে খাবারের বিশাল আয়োজন। আজ অর্পণের পছন্দের চিকেন রান্না হয়েছে৷ প্রলয়ের পছন্দের গলদা চিংড়ি। পূর্ণতা পুষ্পিতার পছন্দসই ইলিশ ভাপা। মেয়ে দুটো কাঁটা বেছে খেতে পারে না৷ তবুও ইলিশ মাছ তাদের ভীষণ প্রিয়৷ মোর্শেদ শিকদার নিজে মেয়েদের কাঁটা বেছে দেন৷ এত সব প্রিয়র মাঝে কেউ ভূমির প্রিয় খাবারের কথা জানতেই চাইল না৷ তারও যে পছন্দের খাবার থাকতে পারে— সেটা কারো মাথাতেই এলো না৷ ভূমি শুধু অপলক চেয়ে দেখল মেয়েদের প্রতি বাবার নিখাদ ভালোবাসা৷ আজ বাবা থাকলে হয়তো তাকেও এভাবে ভালোবেসে মাছের কাঁটা বেছে দিত? অজান্তেই মন খারাপের জেঁকে বসল। খুব একটা পাত্তা দিল না ভূমি। খাওয়াতে মনোযোগী হলো। খাওয়ার এক ফাঁকে অর্পণ বলল‚
“বাবা কাল আমি হসপিটাল যাব না।”
খাওয়া থামিয়ে মেহরাব শিকদার শুধালেন‚ “কেন?”
“কাল ভাইয়ের দলীয় হতে একটা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে৷ ভাইকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।”
“প্রলয়কে থাকতে হবে৷ সেখানে তোর কাজ কী? সবে হসপিটাল জয়েন করলি। এখনই এভাবে না যাওয়াটা কী ঠিক হবে?”
“তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে না। চাচ্চু তো ঠিকই বলেছে৷”
“তোমাকে আমি একা ছাড়ব না ভাই।”
“মেয়েদের মতো চিন্তা করা বন্ধ কর অর্পণ। তুই এভাবে চিন্তা করলে তোর ভাবি লজ্জা পাবে।”
থমথমে হয়ে গেল অর্পণের মুখখানা৷ এভাবে মুখের উপর কেউ অপমান করে? এমন কাজ তার ভাই ছাড়া কেউই করতে পারে না৷ ভাগ্যিস ‘মেয়েদের মতো চিপকে থাকিস কেন?’ এটা বলেনি। আজকের মতো বেঁচে গেল অর্পণ। নয়তো এতগুলো মানুষের সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেত৷
প্লেটে খাবার নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করছে ভূমি। খাবারের গন্ধে ম-ম করছে ডাইনিং স্পেস। ফিরোজা ইলিশ মাছে বাটি নিয়ে ভূমির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইলিশ মাছ নেবে না সে৷ তখন মোর্শেদ শিকদারকে কাঁটা বাছতে দেখে মনে মনে ভাবল‚ ‘মাছের কাঁটা যে সেও বেছে খেতে পারে না৷’ গ্রামে থাকাকালীন সময় দুয়েকবার খাওয়া হয়েছিল ইলিশ মাছ৷ তখন আম্মা কাঁটা বেছে দিয়েছিল। মোড়ল বাড়ির দৈনন্দিন রান্না করা খাবার তো আসতই সেই সঙ্গে ভালোমন্দ কিছু রান্না হলে‚ দুজনের জন্যই তরকারির নেওয়ার কথা বলে দিতেন নাজমা৷ পুরোনো কথা স্মৃতিচারণ হলো। ফিরোজা শুধালেন‚
“তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না ভূমি! ইলিশ দিই তোমাকে?”
“আমি ইলিশ মাছ খাব না চাচি মা।”
“তা খাবে কী করে? এত সব খাবার কোনোদিন চোখে দেখেছ?”
মাধুরীর কথা বেশ লাগল। উপস্থিত সকলে বুঝতেও পারেনি উনি এমন একটা কথা বলে বসবেন৷ নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল গৌর কপোল জুড়ে। সকলের আড়ালেই অশ্রু মুছে নিল ভূমি। কিন্তু কারো দৃষ্টিই এড়াল না ভূমির নীরব কান্না৷ মায়ের প্রতি বিস্তর রাগ মনের ভেতর চেপে বসল৷ প্রলয়কে কিছু বলতে না দিয়ে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚
“তুমি থামবে মাধুরী? এ কোন ধরনের আচরণ? মানছি তুমি ওকে পছন্দ করো না তাই বলে এভাবে কথা বলবে?”
“আমাকে থামাচ্ছ কেন? আমি এতসব বেহায়াপনা নিতে পারছি না৷”
“কোনটাকে তোমার বেহায়াপনা মনে হয়েছে?”
মাধুরী কিছু বলতে নেবেন তার আগেই ভূমি বলল‚
“হয়তো এত বিলাসিতায় বড়ো হইনি। কিন্তু আমার আম্মা নিজের সাধ্য অনুযায়ী যতটু পেরেছেন করেছেন। ক্ষমা করবেন আমাকে।”
ভূমি আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না৷ খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না৷ মা’রের চাইতে যে অপমানের করাঘা’ত একটু বেশিই ক্ষ’ত তৈরি করে৷ বালিশের উপর রোদন বৃষ্টি হচ্ছে৷ এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে বলায় খুব কষ্ট পেয়েছে ভূমি। কিছুতেই কান্না নিবারণ করতে পারছে না। কেন তাকে সবার এত অপছন্দ? ছোটো বেলা থেকে তো কম হেলা‚ তিক্ত কথা হজম করতে হয়নি তাকে৷ তবুও কখনো ভেঙে পড়েনি সে৷ বিছানায় উপুড় হয়ে ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা৷ অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠে গিয়েছে৷ মাথাও ধরছে ভীষণ।
ভূমি তার ঘরের দিকে ছুটে যেতেই টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল প্রলয়৷ মায়ের প্রতি রাগ প্রকাশ না করলেও চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে৷ তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে মাধুরী শুধালেন‚
“একি তুই উঠে দাঁড়ালি কেন?”
মায়ের কথার উত্তর দিল না প্রলয়। ফিরোজার দিকে তাকিয়ে বলল‚ “চাচি মা একটা ট্রে তে করে ভূমির খাবারগুলো একটু গুছিয়ে দেবে? ইলিশ মাছও দেবে৷ আর হ্যাঁ আমার খাবারগুলোও দিয়ে দাও।”
ফিরোজা চোখের পাতা ঝাপ্টে বললেন‚ ”দিচ্ছি।”
ছেলের কাছ থেকে অবজ্ঞাত সহ্য হলো না মাধুরীর। গম্ভীর স্বরে তিনি আবারও শুধালেন‚
“কী হলো আমার কথা কী তোমার কানে যাচ্ছে না?”
“যে খাবার টেবিলে আমার স্ত্রীকে অপমান করা হয়— সেখানে নিশ্চয়ই আমি বসে বসে পঞ্চব্যঞ্জন গোগ্রাসে গিলব না।”
“পরের মেয়ের জন্য তুই কেন খাওয়া বন্ধ করবি?”
“তোমার মেয়ে দুটোও একদিন শ্বশুর বাড়িতে পরের বাড়ির মেয়ে হবে।”
মাধুরী খানিকটা চেঁচিয়ে বললেন‚ “নিজের মাত্রা অতিক্রম করো না প্রলয়।”
“তুমিই আমাকে বাধ্য করছ। আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তোমার এত সমস্যা কেন হচ্ছে মা?”
বিষয়টা ফিরোজারও খুব খারাপ লেগেছে৷ কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না তিনি। যার বউ তাকেই মুখ ফুটে কিছু বলা উচিত৷ প্রলয়ের কথায় সায় জানিয়ে এবার মেহরাব শিকদার বললেন‚
“প্রলয়ের সাথে আমি একমত। তুমি এই ব্যবহারটা ঠিক করলে না ভাবি।”
ত্রস্ত পায়ে ট্রে হাতে নিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল প্রলয়৷ সে জানত মেয়েটা এখন গলা ছেড়ে কাঁদবে৷ হলোও তাই৷ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিল প্রলয়। এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। হাতে থাকা ট্রে টা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে বলল‚
“ছোটো ছোটো কথায় এভাবে কান্না করতে আছে? তুমি তো দেখছি খুবই ছিঁচকাঁদুনে।”
তবুও মুখ তুলে তাকাল না ভূমি। প্রলয় কিছুটা ঝুঁকে ভূমি চুলে আলতো হাত রাখল। তবুও মেয়েটা উঠল না। কান্না বেগ বেড়েছে। শব্দ করে না কাঁদলেও প্রলয় অনুভব করল মেয়েটার শরীরের কম্পন। ভূমির মাথার কাছের বসে বলল‚
“আমার ভূমি কন্যাকে যে রণরঙ্গিণী হতে হবে। ”
মুখ তুলে সিক্ত নেত্রেই প্রলয়ের দিকে তাকাল ভূমি। কানে বারবার প্রলয়ের বলা “আমার ভূমি কন্যা” ডাকটা প্রতিধ্বনি তুলছে। ডাকটা যে ভীষণ আদুরে৷ কান্না বন্ধ হয়ে গেল ভূমির৷ হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিল প্রলয়। কান্না করে চোখমুখ ইতিমধ্যেই ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। মুখ টমেটো হয়ে আছে। ভূমিকে শান্ত করতে প্রলয় বলল‚
“আরেকটু কাঁদবে প্লিজ? মুখটা লাল টমেটোর মতো হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি।”
প্রলয়ের এহেন কথায় হেঁচকিও বন্ধ হয়ে গেল ভূমির। হতভম্ব ভূমি নাক ফোলাল। প্রলয় আবারও বলল‚
“লজ্জা পেলেও নিশ্চয়ই এমন টমেটো হয়ে যাও?”
কান গরম হলো ভূমির৷ প্রলয়ের কথা মতো সে কী লজ্জা পেতে শুরু করেছে? না এই লোকের সামনে তো লজ্জা পেলে চলবে না৷ একদম না! প্রলয় বিছানা ছাড়ল। হাত ধুয়ে খাবারের প্লেটটা হাতে নিল। ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে‚ ভূমির মুখের সামনে লোকমা তুলে বলল‚
“চুপচাপ খাবারটা মুখে নাও৷ খাবারের উপর রাগ করে থাকা যাবে না৷”
“আমি খাব না। আমার পেট ভরে গেছে৷”
“আমাকে আর রাগিয়ো না ভূমি কন্যা। আমি এমনিতেই প্রচণ্ড রেগে আছি।”
প্রলয়ের হাতে ভূমি খাবার খেয়ে নিল। এরই মাঝে প্রলয়ও নিজের খাবার খেয়ে নিয়েছে। এদিকে বিছানার উপর বসে আছেন মোর্শেদ শিকদার। ঘুমনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মাঝে ঘরে প্রবেশ করলেন মাধুরী। এসেই স্বামীকে বললেন‚
“তুমি দেখলে তোমার ছেলে আমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলল!”
চোখের চশমা ঠিক করে বিছানায় নড়েচড়ে বসলেন মোর্শেদ শিকদার। ইদানীং স্ত্রীর ব্যবহারে হতাশ তিনি। মাধুরীকে অনেক কিছুই শোনাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কিছু মুখে এলো না। কিছু শান্ত স্বরেই বললেন‚
“ভুল কিছু তো বলেনি। মেয়েটাকে এভাবে না বললেও পারতে৷ মানছি ওকে তুমি মেনে নিতে পারছ না তাই বলে এভাবে কষ্ট দিয়ে কথা বলাটা কী ঠিক?”
“এখন তো আমিই ভিলেন সবার কাছে।”
“তুমি সহজ বিষয়টাকে জটিল করে তুলছ৷”
মুখ ঝামটা দিয়ে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালেন মাধুরী। মোর্শেদ শিকদার পুনশ্চ বললেন‚
“আমার সামনে যদি কেউ তোমাকে হেয় করে কথা বলে— নিশ্চয়ই আমি তা চুপচাপ মেনে নেব না৷ তাহলে প্রলয়ের দোষটা কোথায়? এক্ষেত্রে আমি আমার ছেলেকে সম্পূর্ণ সমর্থন করব।”
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
নিশীথে ঘুম হলো না প্রলয়ের৷ শেষ প্রহরে একটু চোখটা লেগেছিল তবে রোদের তপ্ত ছটা ঘুম পালিয়েছে৷ বালিশে কনুইয়ের ভর দিয়ে বাঁ পাশে ফিরেছে প্রলয়। ঘুমের ঘোরে ভূমি তাকে জাপ্টে ধরেছে। ঘুমের ঘোরেও মেয়েটা কপালে সহসাই ভাজ পড়েছে৷ ভূমি কী খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছে? ভেবে পায় না প্রলয়। চোখ মুখের উপর বেপরোয়া চুলগুলো বিরক্ত করতে হেলে পড়েছে৷ বড্ড বেহায়া চুলগুলো৷ ডান হাত দ্বারা চুলগুলোকে সরিয়ে একদৃষ্টে ভূমিকে দেখতে লাগল প্রলয়৷ বেশ অনেকটা সময় পর‚ ঘুম থেকে জেগে প্রলয়কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেল ভূমি। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে নিলে লম্বা চুলে টান পড়ল। মুখ থেকে “আহ্!” শব্দ উচ্চারিত হলো। প্রলয়ের সেদিকে খেয়াল নেই। এখনো সে একই ভঙ্গিতে ভূমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ মুখ কাঁদোকাঁদো করে ভূমি বলল‚
“একটু হাতটা সরাবেন? চুলে ব্যথা লাগছে৷”
ভূমির কথাগুলো কানে গেল না। প্রলয়ের বাহু ঝাকিয়ে ভূমি আবারও বলল‚ “শুনছেন?”
ভাবনার ঘোর কাটতেই আধ শোয়া হতে সোজা হয়ে বসল প্রলয়। ছাড়া পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ভূমি। গায়ের ওড়না ঠিক করে‚ তড়িঘড়ি করতে করতে বিছানা ছাড়ল৷ এলোমেলো বিনুনি হাত খোপা করতে করতে বলল‚
“বেলা অনেক হয়েছে।”
কিছু বলল না প্রলয়। বিছানা ছেড়ে সেও এতক্ষণে নেমে পড়েছে৷ ভূমি ব্যস্ত হয়ে বিছানা গুছিয়ে নিল। এরপর ওয়াশরুমে গেল৷ প্রলয় ফ্যালফ্যাল করে সেদিকটাতেই চেয়ে রইল৷
সকালে খাবার টেবিলে প্রলয় কারো সঙ্গে কোনো কথা বলল না৷ এদিকে মাধুরী আর খারাপ ব্যবহার করলেন না ভূমির সঙ্গে৷ অল্পস্বল্প কথা হয়েছে ঠিকই তবে তিনি খুব শান্ত স্বরেই কথা বলেছেন আজ। উপস্থিত সকলেই অবাক মাধুরীকে দেখে। এমনিতে মাধুরী সচরাচর সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন না৷ এই জন্যই ভূমির সঙ্গে এমন ব্যবহার কেউ মেনে নিতে পারছিল না৷ ছেলের এই নিস্তব্ধতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মাধুরী। সব তো ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। তাহলে ছেলেটা কেন এত রেগে আছে? নাস্তা খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে প্রলয় যখন সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হবে তখনই মাধুরী ছেলের পথরোধ করে দাঁড়ালেন। প্রলয় তাকাল না। মাধুরী বললেন‚
“কথা কেন বলছিস না মায়ের সঙ্গে।”
“আমার মা তো এখন সেলেব্রিটি হয়ে যাবে৷ ক্রমাগত সিরিয়ালের শাশুড়ীদের মতো আচরণ করছে।”
থতমত খেয়ে গেলেন মাধুরী৷ সিরিয়াস মুহূর্তে ঠাট্টা একমাত্র প্রলয়ই করতে পারে। সরে দাঁড়ালেন মাধুরী। প্রলয় সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল৷
তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে প্রলয়। গাড়ি নিয়ে সোজা কলেজে যাবে৷ সমাবেশ তো সেখানেই আয়োজিত হবে৷ অর্পণ খুব করে আজ প্রলয়ের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু তা আর হলো কই? প্রলয় কিছুতেই রাজি হলো না৷ অগত্যা না চাওয়া সত্ত্বেও হসপিটালে ছুট লাগিয়েছে অর্পণ। নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে ভূমিকে কাছে ডাকল প্রলয়। তার কথানুযায়ী ভূমিও বোকার মতো এগিয়ে গেল। প্রলয় বলল‚
“নিজের খেয়াল রেখ। মায়ের কোনো কথায় মন খারাপ করে থেক না৷ কারো কটু কথা হয়তো আটকাতে পারবে না৷ তবে এক কান দিয়ে ঢুকাবে আরেক কান দিয়ে বের করবে৷ মনে থাকবে?”
ভূমি মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে বলল‚ “হুম!”
দুজনের মাঝে দূরত্ব ঘুচাল। প্রেয়সীর ললাটে সিক্ত উষ্ণ অধর ছোঁয়াল প্রলয়৷ অর্ধাঙ্গের পক্ষ হতে প্রথম উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে শিরা উপশিরায় র’ক্ত ছলকে উঠছে। তন্মনে মৃদু ঝাঁকুনি দিল বোধহয়। দুহাতে ওড়না চেপে ধরল ভূমি। আঁখিদ্বয় আপনাআপনিই মুদে এলো৷ প্রলয় সরে দাঁড়াল৷ দুটি শরীরের দূরত্ব বাড়ল। পুরুষ মানুষ হয়েও লাজে বিমূঢ়দশা প্রলয়ের৷ ডান হাতটা তুলে নিজের বুকের বাঁ পাশটায় রাখল৷ কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলল‚
“লাজে রাঙা হওয়া বারণ‚ কারণে অ-কারণ।”
রজনিতে…
আজকের দিনটা খুব তাড়াতাড়িই অতিবাহিত হলো যেন৷ চোখের পলকেই রাত নেমে এসেছে। অর্পণের মোবাইল ভূমির হাতে। এই তো সবে দিয়ে গিয়েছে অর্পণ। ইরার নাম্বার থেকে কল এসেছিল। মহুয়া কথা বলবেন মেয়ের সঙ্গে৷ বিছানায় দু পা ভাজ করে বসেছে ভূমি। ওপাশ থেকে আম্মার ত্রস্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো‚
“তোকে একটা খবর দেওয়ার আছে।”
মেয়ের প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশায় না থেকে একটু সময় নিয়ে মহুয়া আবারও বললেন‚ “পশ্চিমের নদীর ধারে মকবুলের লা’শ পাওয়া গেছে৷”
ভূমি অবাক হয়ে বলল‚ “বলো কী আম্মা!”
“তা আর বলতে৷ গ্রামের মানুষ তো আতঙ্কে আছে। পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু শাহাদাৎ ভাইয়ের থেকে শুনে যা বুঝলাম— ঘাতক কোনো প্রমাণ রাখেনি।”
“আমার খুব ভয় করছে আম্মা। তুমি‚ তোমরা সাবধানে থেক। তোমাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হবে।”
“ধুর বোকা মেয়ে। হয়তো মকবুলের কোনো শত্রু ছিল। হয়তো ওই বাজে লোক কারো ক্ষতি করেছিল।”
ক্ষতির কথা শুনেই মনে পড়ল‚ মকবুল তো তার সঙ্গে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস সেদিন প্রলয় সময়মতো চলে এসেছিলেন। একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ভূমির। কিন্তু আম্মার কাছেও কিছু বলতে পারছে না।
“আম্মা আমাকে চাচি মা ডাকছে। আমি এখন রাখছি।”
মহুয়া সায় জানিয়ে বললেন‚ “আচ্ছা যা৷ কাজ সাবধানে করবি। বটি‚ আগুন সাবধানে।”
“আচ্ছা আম্মা।” কথাটা বলেই ফোন কে’টে দিল ভূমি। অপেক্ষা করতে লাগল প্রলয় কখন বাড়ি ফিরবে।
রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রলয় বাড়ি ফিরেছে৷ বাকিরা আটটা বাজার আগেই ফিরে আসে৷ কখনো সখনো কাজের চাপ থাকলে দেরি হয়। সন্ধ্যের পর আর ঘর থেকে বের হয়নি ভূমি। সন্ধ্যেবেলা হালকা নাস্তা করে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিল। এশারের আযান পড়তেই নিজেদের ঘরে ফিরে এসেছে ভূমি। এরপর আর ঘর থেকে বের হয়নি। অর্পণের ফোন থেকে আম্মার সঙ্গে কথাও বলেছিল৷ তারপর বেশ কিছুক্ষণ সময় বারান্দায় একাকী সময় কাটিয়েছে সে৷ যখন দেখল প্রলয়ের গাড়ি মালঞ্চ নীড়ে প্রবেশ করছে তখনই তাড়াহুড়ো করে বারান্দার দরজা আটকে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি৷
ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধীর পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল প্রলয়। চোখমুখে ক্লান্তির আভাস৷ গায়ে জড়িয়ে রাখা পাঞ্জাবি খুলে বিছানার উপর রেখে দিল প্রলয়৷ হাতে ঘড়ি‚ মোবাইল আর ওয়ালেটও বিছানার উপর ছুড়ে ফেলেছে। কলেজে হওয়া সমাবেশ শেষে পার্টি অফিসে গিয়েছিল৷ বারান্দা থেকে ফেরার পথে তোয়ালে খানা হাতে করে নিয়ে এসেছিল ভূমি। প্রলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলল‚
“আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”
“আমি ভীষণ ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে এসে কথা বলছি।”
ভূমির হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল প্রলয়। ওয়ারড্রব থেকে টিশার্ট বের করে বিছানার উপর রাখল ভূমি। বিছানা গুছিয়ে ঘর থেকে বের হলো। উদ্দেশ্য প্রলয়ের জন্য কফি করে আনা। ফিরোজার কাছ থেকে শুনেছে‚ লোকটা কাজ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরলে কড়া করে কফি খান৷
বেশ অনেকটা সময় পর কফি মগ নিয়ে ঘরে ফিরে এলো ভূমি৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে প্রলয়। পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। কফি মগ বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে দাঁড়িয়েছে সে। কী করে কথাটা জিজ্ঞেস করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে৷ তবে জিজ্ঞেস তো করতেই হবে। আয়নায় ভূমির প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করে প্রলয় শুধাল‚
“ওহ কী যেন বলতে চাইছিলে— বল!”
প্রশ্রয় পেয়ে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “ম..মকবুল কাকাকে কী আপনি মে’রে ফেলেছেন?”
“তোমার কী মনে হয়?”
“আপনি দয়া করে বলুন।”
ভূমির কণ্ঠস্বর বড্ড অগোছালো মনে হলো। প্রলয় চোখ বন্ধ করল। ভূমির র’ক্তাক্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ কাঁচ ফুটে পায়ের বেহাল দশা৷ অতিরিক্ত র’ক্ত ঝড়ার ফলে মেয়েটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়লছিল। একটা সময় অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়েছিল ধুলোবালি জমা মেঝেতে৷ ভূমির এমন অবস্থা দেখে চোখ মুখ দিয়ে আগুন ঝড়ছিল প্রলয়ের। সেদিন নিজের চোখে প্রলয়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছিল মকবুল৷ দেখতে পারছিল নিজের বিনাশ। বুকে হাত দিয়ে মেঝেতে পড়ে ছিল৷ বেচারা ব্যথা পেয়েছে নিশ্চয়ই৷ প্রলয়ের কাছে সেদিন হাত জোর করে ভীতু গলায় বলেছিল‚
“আ..আমারে ছাইড়া দেও৷ এই ভূল আমি আর করতাম না।”
“আমার বিচারালয়ের একটাই শাস্তি। আর তা হচ্ছে মৃত্যু। মনে রাখবি— পুরুষ তার শখের নারীর জন্য জান দিতেও পারে আবার জান নিতেও পারে।”
শেষোক্তটি চেঁচিয়েই বলল প্রলয়। এরপর সঙ্গে সঙ্গে তিনটে গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল মকবুলের বুকটা। গলা কা’টা মুরগীর মতো তড়পাতে শুরু করল মকবুল। একটা সময় নিথর দেহ হতে প্রাণটা হয়ত বেরিয়েই পড়ল। এই সমস্তটা ভূমির অজানাই থেকে গেল। হয়তো কখনো জানা হবে না৷ মুহূর্তটা স্মৃতিচারণ হতেই প্রলয়ের অধর কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল ভূমির অগোচরে। অবসন্ন কৃষ্ণ আঁধার বাহ্যজগতে৷ অম্বরের একফালি রূপালি চাঁদ। যার নিজস্ব কিরণ আজ অবসর নিয়েছে। ভূমি একদৃষ্টে প্রলয়ের দিকে চেয়ে রয়েছে৷ লোকটা কী এত ভাবছে? থেকে থেকে বাঁকা হাসছেও। বুঝে এলো না ভূমির৷ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে এত ভাবারই বা কী আছে? এতক্ষণে কফি ঠান্ডা বরফ হয়ে গিয়েছ বোধহয়। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ভূমি বলল‚
“থাক আপনাকে কোনো উত্তর দিতে হবে বা৷ আপনি ঠান্ডা কফি খান!”
ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভূমি। পায়ে তার অল্পস্বল্প ব্যথা। হাঁটতে চলতে কোনো অসুবিধেই হচ্ছে না৷ আয়নায় লক্ষ্য করল ভূমির চলে যাওয়া। পেছন থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রলয় বলল‚
“ভূমি কন্যার আগমনে চিত্ত হয়েছিল অতি চাঞ্চল্য। প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের আভাস পেয়েছিলাম প্রতিনিয়ত।”
চলে যেতে নিয়েও থমকে দাঁড়াল ভূমি। প্রলয়ের বলা কথাটাকে তার প্রশ্নের উত্তর বলে মনে হলো না। লোকটা ভীষণ ত্যাঁদড় পদের। কোনো কথার সোজাসাপটা উত্তর দিতে জানেই না৷ অর্পণকে কম নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে নাকি! কাল রাতে তো ছেলেটার লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছিল৷ ভাইয়ের জন্য চিন্তা হয় বলেই তো সঙ্গে যেতে চেয়েছিল! তাই বলে এভাবে সকলের সামনে লজ্জা দেবে? পেছন থেকে আবারও সেই ভরাট কণ্ঠস্বর‚
“কোথায় চললে বউ?”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই পূর্ণ দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভূমি। প্রলয়ের অধর কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা। লোকটাকে সেই প্রথম দিনে মতো লাগছে না একটুও৷ প্রথম দেখাতে মনে হয়েছিল— লোকটা ভীষণ রাগী‚ গম্ভীর গোছের হবে হয়তো। যত দিন যাচ্ছে ততই ভূমি ধারণাও পরিবর্তন হচ্ছে৷ লোকটা ভীষণ যত্নশীল। রাগীও বটে। হুটহাট রেগে আগুন হয়ে যায়৷ যে-ই পাশ দিয়ে যাবে তাকেই ঝলসে দেবে৷ রাগী প্রলয়কে ভীষণ ভয় করে মাঝে মাঝে৷ লোকটা যখন গম্ভীর হয়ে থাকে তখন দুরুদুরু বুকে চুপ মে’রে থাকে সে।
এরই মাঝে পূর্ণতা এসে দরজার কড়া নাড়ল। বিছানার উপর ভাজ করে রাখা টিশার্ট পড়ে নিল প্রলয়। অনুমতি পেয়েই পূর্ণতা ঘরে প্রবেশ করে বলল‚ “বড়ো ভাইয়া তোমার একটা পার্সেল এসেছে৷”
“হুম যাচ্ছি।”
পূর্ণতা চলে গেল৷ প্রলয়ও ঘর থেকে বের হবার আগে ভূমিকে বলএ গেল‚ “কোথাও ছোটাছুটি করবে না— ঘরেই থাকবে। আমি এক্ষুনি আসছি।”
স্বামীর কথানুযায়ী ঘরেই রইল ভূমি। বের হলো না একটুও৷ পাছেই না লোকটা রাগ করে বসে৷ রাগ সামলানোর হিম্মত নেই তার। এমনিতেই ভীষণ ভীতু ধাঁচের সে৷ মিনিট পাঁচেকের মাঝেই প্রলয় ঘরে ফিরে এলো৷ তার হাতে একটা মাঝারি আকৃতির ব্যাগ৷ ঘরে এসেই ব্যাগটা ভূমির হাতে তুলে দিল প্রলয়। বিষয়টিতে ভূমি অবাক না হয়ে পারল না ভূমি। ব্যাগ ভেতর কী আছে জানা নেই তার৷
“হা করে থাকলে চলবে? প্যাকেট খুলে দেখ! এটা তোমার জন্যই।”
“কী আছে এটাতে?”
“আমি কেন বলব? তুমিই খুলে দেখ!”
প্যাকেট খুলল ভূমি ভেতরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন রয়েছে৷ ভূমি তাকাল প্রলয়ের দিকে।
“এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি তো ভাইয়ার ফোন থেকে আম্মার সঙ্গে কথা বলে নিতাম।”
“আমার বউ অন্যের ফোন দিয়ে কেন কথা বলবে? ফোনটা আরও আগে কিনে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল৷ তাহলে অন্তত আমি যেকোনো সময় বিরক্ত করতে পারতাম।”
“আমি তো কখনো ফোন ব্যবহার করিনি।”
“তাতে কী? আমি শিখিয়ে দেব৷”
প্রলয় একটা পারসোনাল সিম নিয়েছে ভূমির ফোনে ব্যবহার করার জন্য। বাড়ির সকলের নাম্বার স্যেভ করে দিয়েছে৷ ইরার নাম্বারও স্যেভ করে দিয়ে প্রলয়। সবার ফোন নাম্বার যার যার নামেই স্যেভ করে‚ নিজের নাম স্যেভ করেছে “এমপি মশাই” দিয়ে। সকালে পুষ্পিতার থেকে শুনেছিল— ভূমি তাকে এমপি মশাই বলে সম্বোধন করেছে। ডাকটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল৷ এর আগেও এমপি মশাই ডাক শুনেছে। তবে এতটা ভালো আগে লাগেনি।
খাবার টেবিলে সবাই বসে রয়েছে৷ প্রলয় ভূমি এখনো অনুপস্থিত। ইশারায় ডাকত্র বললেন মাধুরী। নিচে থেকেই ডাক দিলেন ফিরোজা। সিঁড়ি ভেঙে দুজনেই নেমে এলো। নিজেদের চেয়ারে বসল। ফিরোজা খাবার বেড়ে দিলেন। আজ খুব শান্ত স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন মাধুরী। উনার এহেন ব্যবহার সবাইকেই অবাক করল। কতটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছেন একদিনের মাঝে৷ একদিন বললে ভুল হবে— এক রাতের মাঝেই সব স্বাভাবিক। সকাল থেকেই তিনি ভূমির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছেন৷ ভূমি দাঁড়াল৷ তরকারির বাটি মাধুরীর দিকে এগিয়ে দিল। খাওয়া ব্যতীত টেবিলে আজ কোনো শব্দ নেই৷ সবকিছু নিস্তব্ধ। এমন পরিবেশই প্রলয়ের খুব পছন্দের৷ আজ মনে হচ্ছে সে বাড়িতে খাচ্ছে। দুদিন ধরে মনে হচ্ছিল— সে কোনো মাছের বাজারে রয়েছে৷ ভূমির গ্লাস খালি দেখে প্রলয় পানি ভরে দিল৷ সবাই দেখেও দেখল না যেন। স্ত্রীর খেয়াল রাখা স্বাভাবিক নয় কী? অবশ্যই স্বাভাবিক।
বিছানায় বসে রয়েছে ভূমি। তার কোলে মাথা রেখে শুয়েছে প্রলয়৷ মসৃণ ছোটো ছোটো চুলে কোমল হাতের বিচরণ। দুহাতে ভূমির পেট জড়িয়ে রেখেছে প্রলয়৷ পেটের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে৷ আড়ষ্টতায় বিমূঢ় ভূমি থেকে থেকে কেঁপে উঠছে৷ মুখ তুলে তাকাল প্রলয়৷ ঘুমু ঘুমু আধবোজা চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে শুধাল‚
“আমি শুনেছিলাম তুমি নাকি ভীষণ ভালো নাচতে পারো?”
হাত দুটো থেমে গেল৷ নাচ তো সে একটু আধটু করে। আম্মা শিখিয়েছিলেন৷ আম্মা খুব ভালো নাচ করেন। নাচের প্রত্যেকটা ছন্দ তো সে তার আম্মার কাছ থেকেই শিখেছে কিন্তু এমপি মশাই জানল কী করে? ভূমি আমতা আমতা করতে শুরু করল৷ প্রলয় ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে বলল‚
“হুহ্! এত আমতা আমতা করতে হবে না৷ আমি তোমাকে নাচতে বলছি না। ভয় পেতে হবে না।”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ভূমি। প্রলয় আগের ভঙ্গিতে ভূমি কোলে মাথা রাখে কোমর জড়িয়ে ধরল। ভূমি আবারও প্রলয়ের চুল টেনে দিতে শুরু করল।
রাত সাড়ে বারোটা…
বিছানায় শুয়ে রয়েছে অর্পণ। রাত হয়েছে অনেকটা৷ ঘুম আসছে না। সকালেও তাড়াতাড়ি উঠতে হবে৷ চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করল অর্পণ। এরই মাঝে ফোন বেজে উঠল৷ ইরার নাম্বার থেকে কল আসছে। তবে কী মেয়েটা ঘুমোয়নি? কল রিসিভ করার বদলে কে’টে দিল। পুনর্বার নিজে থেকে ইরার নাম্বারে ডায়াল করল। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হলো অপরপ্রান্ত থেকে। ফোন কানে নিয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“এত রাতে জেগে থাকা হচ্ছে কেন?”
“ঘুম আসছিল না।”
“কেন ঘুম আসছিল না?”
“কেউ একজন যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে চলে গেছে— সেই খবর কী কেউ রেখেছে?”
“বলো কী! ঘুম চুরি হওয়া তো ভালো লক্ষ্মণ না।”
“সেটা আপনি বুঝলেন কোথায়?”
“বুঝিনি বলতে চাইছ? ডাক্তার কিন্তু মনে খবর জানে।”
“তাহলে আমার ভাই জানে না কেন? সেও তো ডাক্তার!”
“আমি ডাক্তার বলেছি— ডাক্তাররা নয়!”
“তা কোন খবরটা জানলেন মশাই?”
“এটাই জেনেছি যে‚ দুটো অন্তরিন্দ্রিয় বিনিময় হয়েছে৷”
“ধ্যাৎ! কী যে বলেন না!”
“ঝাঁসির রানি কী লজ্জা পাচ্ছে?”
“আপনাকে বলতে বাধ্য নয় সে।”
ক্ষীণ হেসে অর্পণ শুধাল‚ “তাই?”
“হুম তাই!”
নেমে এলো অবাক নীরবতা। সেই নীরবতা কাটিয়ে অর্পণ বলল‚ ”ঘুমিয়ে পড়লে?”
কানে ফোন রেখেই ইরা বলল‚ “উঁহু! আমি তো কারো হৃৎস্পন্দন অনুভব করছিলাম।”
অকপটেই অর্পণ শুধাল‚ “কার?”
“আছে একজন বদ লোকের।”
“বাই এনি চান্স— তুমি আমাকে বদ লোক বললে?”
“বুঝলাম আপনার ব্রেন খুবই শার্প। সবকিছু খুব সহজেই বুঝতে পারেন। শুধু একটা জিনিস ছাড়া!”
“সেই জিনিসটা কী?”
“বলব না। কদাপি নহে!”
“এ বাবা না বললে বুঝব কী করে?”
“সব বুঝেও কেন অবুঝ হয়ে আছেন?”
“বলছ— আমি সব বুঝি?”
“কেন বোঝেন না বুঝি?”
“কী জানি!”
“রাখছি! আমার ঘুম পেয়েছে।”
“এই না বললে তোমার ঘুম চুরি হয়েছে?”
আর কোনো উত্তর এলো না অপরপ্রান্ত থেকে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই বুঝতে পারল কল কেটে গিয়েছে সবেই৷ গাল এলিয়ে হেসে উঠল অর্পণ। মেয়েটা বড্ড চঞ্চলা। গ্রামে যাওয়ার আগে থেকে ওদের যোগাযোগ। অথচ সামনাসামনি কেউ কাউকে সামান্য পাত্তা টুকু দেয় না৷ সেদিন মেয়েটা ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল। সেখানেও দুজন দুজনকে যেন চেনেই না এমন একটা ভান ধরেছিল। মনে পড়তেই সশব্দে হেসে উঠল অর্পণ। মনে মনে কয়েকটা কথা আওড়াল‚
“শুধু এখন না‚ প্রত্যেকটা দিন— প্রত্যেকটা মুহূর্তে তোমার জীবনে শুধুই আমার বিচরণ থাকবে৷ ভালো তুমিও বাসো আমিও বাসি৷ তোমারটা প্রকাশিত‚ আমারটা ব্যক্তিগত।
কেটে গিয়েছে আরও তিনটি দিবারাত্র। আজকের সকালটা ভীষণই কদাকার। অম্বরে দেখা মিলেছে ধূসর রঙা মেঘের গুটলি। এমন দিবস মোটেও পছন্দ নয় ভূমির। আকাশ হতে হবে নীল দরিয়া তুল্য। ধূসর মেঘের গুটলির বদলে— ঢেউয়ের শুভ্র ফেনা উড়ে বেড়াবে অখণ্ড অন্তরিক্ষে। ভূমির পায়ের বেন্ডেজ কপালে বেন্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। ঘা শুকিয়ে আসছে পুরোপুরি ভাবে৷ বারান্দায় কাপড় মেলতে এসে আবারও বিরস মুখে আশেপাশে তাকাল। বাড়ির পুরুষেরা যে যার কাজে গিয়েছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা নিজেদের ঘরে পড়ছে। নতুন টিউটর রেখে দিয়েছেন মোর্শেদ শিকদার। সাড়ে এগারোটার দিকে হয়তো পড়াতে আসবেন৷ বোর্ড পরীক্ষার তো খুব বেশি সময় বাকি নেই৷ পূর্ণতা পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও পুষ্পিতা ঠিক তার বিপরীত। মেয়েটার মাঝে গম্ভীরতার বড্ড অভাব৷ উল্টো পূর্ণতা‚ সারাক্ষণ চুপচাপ বইয়ের মাঝে মুখ গুজে রাখে৷
বারান্দা থেকেই উপলব্ধি করল একটা মহিলা অনেকক্ষণ যাবৎ ভূমির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুবই অস্বস্তি হলো তার৷ তাড়াতাড়ি করে টিশার্ট আর ট্রাউজার গুলো মেলে দিল৷ এমনিতে বারান্দায় বেশ রোদ থাকে। জামাকাপড় ছাদে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে আজ সকাল থেকে মেঘে রোদে লুকোচুরি খেলছে৷ রোদকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না৷ এরই মাঝে ঘর থেকে মাধুরীর গলার আওয়াজ ভেসে এলো৷ ঘরের বাহির থেকেই তিনি ডাকছেন৷
“তুমি কী ঘরে আছ ভূমি?”
“জি মা কিছু বলবেন?”
বারান্দা থেকেই জবাব দিল ভূমি। ঘরে প্রবেশ করলেন মাধুরী। বালতি হাতে নিয়ে বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল ভুমি। বোরকা পড়ে তৈরি হয়ে এসেছেন মাধুরী। ঘরে এসে ভূমি আবারও বলল‚
“কিছু বলবেন মা?”
“হ্যাঁ! আমি আর তোমার চাচি মা একটু শপিং এ যাচ্ছি৷ কিছুক্ষণ পরেই তো পূর্ণ পুষ্পর টিউটর চলে আসবেন৷ সাবিনাকে বোলো নাস্তা আর শরবত বানিয়ে দিতে।”
মাধুরী কথা গুলো বলে থামতেই ভূমি ঘাড় কাত করে সায় জানাল। মাধুরী এবার জিজ্ঞেস করলেন‚
“তোমার কী কিছু লাগবে?”
দু পাশে মাথা ঝাকিয়ে ভূমি বলল‚ “আমার কিছু লাগবে না মা!”
“আচ্ছা। আমরা তাহলে বের হচ্ছি৷ কোনো সমস্যা হলে আমদেরকে কল করবে।”
যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন মাধুরী৷ উনার এই মিষ্টি কথায় মোটেও অবাক হলো না ভূমি। বরঞ্চ খুশি হলো৷ তিনদিন ধরেই তার সাথে ভালো ব্যবহার করছেন মাধুরী। এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ ভূমিকে বড্ড স্নেহ করে।
রাস্তায় জ্যামের মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রলয়কে৷ জানালার কাঁচ নামিয়ে দেওয়া। হঠাৎ কেউ বলে উঠল‚ “একটা ফুল নেন স্যার। সকাল থাইকা একটাও বিক্রি হয় নাই।”
জানালার বাহিরে তাকাতেই প্রলয় দেখতে পেল ছোটো ছেলেটার হাতে অনেকগুলো ফুল। ফুলগুলো দেখে ভূমির কথা মনে পড়ল প্রলয়ের৷ ছেলেটার হাত থেকে সবগুলো ফুল নিয়ে নিল৷ লাল‚ হলুদ আর সাদা গোলাপ। পনেরোটা গোলাপ তো হবেই। সেই সঙ্গে তিনটা রজনীগন্ধার মালা আর একটা বেলীফুলের গাজরা। ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে দিল ছেলেটার দিকে। ছেলেতা অসহায় মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে প্রলয়ের দিকে৷ বুঝতে পেরেও প্রলয় শুধাল‚
“এভাবে তাকিয়ে রয়েছ কেন?”
“স্যার আমার কাছে তো খুচরা নাই।”
“খুচরা লাগবে না টাকাটা তুমি রেখে দাও৷”
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা ছেলেটার। হয়তো একটু বেশিই খুশি হয়েছে৷ ছেলেটা চলে গেল৷ গাড়ি জ্যামে আটকে ছিল মিনিট দশেক ধরে। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে আছে প্রলয়ের৷ শাহবাগ থানার দিকে যাচ্ছিল। ব্যক্তিগত একটা কাজ ছিল সেখানকার পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। ফুলগুলোকে পাশের সিটে রেখেছে সে৷ জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটা গাড়ি চলেও গিয়েছে। প্রলয় দেখতে পেল‚ রাস্তার অপরপ্রান্তে একটা গাড়ি। পেছন সিটের জানালা খোলা৷ দুটো মহিলা বসে রয়েছে৷ একজন ব্যথায় ক্রমশ তড়পাচ্ছে৷ আর আরেকজন সেই পীড়িত মহিলাকে সামলাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামল প্রলয়৷ ট্রাফিক পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলল‚
“স্টপ!”
ট্রাফিক পুলিশ পেছনে তাকিয়ে দেখল প্রলয়কে৷ দেখেই সালাম জানাল। তাকে তো ঢাকা শহরের সবাই চেনে৷ এমপিকে কে না চিনবে? এভাবে দাঁড় করানোর মানে বুঝল না ট্রাফিক পুলিশ ছেলেটা৷ প্রলয় দৌঁড়ে একটা গাড়ির সামনে গেল৷ ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটাকে ইশারায় চলে যাওয়া নির্দেশ দিচ্ছে। পেছনে একটা মহিলা ক্রমশ ব্যথা কাতরাচ্ছে৷ দেখে মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্ট। বেশ অনেকটা সময় ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল গাড়িটা৷ যাওয়ার আগে লোকটা প্রলয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল৷ বিনিময়ে মৃদু হাসল প্রলয়। চলে গেল নিজের গাড়ির দিকে।
চলবে?…..