রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-১১

0
766

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_১১
#M_Sonali

বেলা ১২.১০ মিনিট
নিজের রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত আমি। সেই সাথে মনের মাঝে রয়েছে হাজারো চিন্তার ছাপ। বাবার বাড়ি এসেছি দুদিন হয়ে গেছে। অথচ এর মধ্যে একটি বারের জন্যও মীর আমাকে কল করেনি। বা খবর নেয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি। নিজেকে বড্ড বেশি একা মনে হচ্ছে আমার। সবার মাঝে থেকেও যেন কিছু একটার শূন্যতা অনুভব করছি আমি প্রতিনিয়ত। কোন কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার মনে চাইছে মীরের কাছে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করি! সে কেন আমার সাথে এমন করছে? আমার কি এমন ভুল যে সে আমাকে বিয়ে করা সত্ত্বেও কেন এমন আচরণ করছে। ধীরে ধীরে যেনো মন থেকে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ছি আমি।

কথাগুলো মনে মনে ভাবছি আর নিরবে চোখের জল বিশর্জন দিচ্ছি। কারণ মীর আর আমি ছাড়া কেউ জানে না আমাদের মাঝের আসল সম্পর্কের কথা। সবাই জানে আমরা স্বামী স্ত্রী হিসাবে অনেক ভালো আছি। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নিয়ে পিছনে তাকালাম আমি। হায়া আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলো। তারপর আমার হাতে একমগ কফি ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–” কি রে আব্রু, এখানে একা একা দাড়িয়ে কি এত ভাবছিস। মীর ভাইয়ার কথা তা,,,,,”

এতোটুকু বলেই থেমে গেল হায়া। তারপর অবাক হয়ে আমার গালে হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে বলল,

–” কি হয়েছে আব্রু, তুই কাঁদ ছিলিস নাকি? তোর চোখ দুটো এমন লাল লাল আর ফুলা ফুলা লাগছে কেন? কি হয়েছে বোন, বল আমায়?”

হায়ার কথায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। কফির মগটা পাশের টেবিলে রেখে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম। এতক্ষণ যেন কেউ একজনের খুব প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। যার কাঁধে মাথা রেখে একটু মন ভরে কান্না করতে পারব। আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে যেন অনেক বেশি অবাক হয়ে গেল হায়া। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে লাগল,

— “কি হয়েছে আব্রু, বল আমায় প্লিজ। এভাবে কেন কাঁদছিস তুই? মীর ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে? প্লিজ বোন আমার, আমাকে সব খুলে বল। তোকে এভাবে দেখে আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমি কি আম্মু আব্বুকে ডাকবো?

এতোটুকু বলে আম্মু আব্বুকে ডাকার জন্য মুখ খুলতে নিলো হায়া। তখনই আমি ওর মুখটা আলতো ভাবে চেপে ধরে ওকে থামিয়ে বললাম,

–“প্লিজ হায়া এ কাজ করিস না। কাউকে ডাকিস না। আমি কাউকে দেখাতে চাইনা আমার কান্না। সবাই বুঝুক আমি ভালো আছি।”

–” আচ্ছা কাউকে ডাকবো না। কিন্তু আমাকে সব বল আব্রু। তুই এভাবে কেন কাঁদছিস। তুই কি ভালো নেই মীর ভাইয়ার সাথে? তোমার মাঝে কি কিছু হয়েছে?”

ওর প্রশ্নের উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমি। দুচোখের জল মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলতে শুরু করলাম,

–” আজকে আমি তোকে সব কিছু বলতে চাই হায়া। মীরের সাথে আমার সম্পর্কের কথা। আমাদের মাঝের সবকিছু তোকে আমি বলতে চাই। কিন্তু তার আগে প্রমিস কর এগুলো কাউকে বলবি না?”

–” আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আব্রু। তুই কি বলছিস এসব? তোদের মাঝে সম্পর্ক মানে? তোরা তো স্বামী-স্ত্রী, তাহলে তোদের মাঝে আবার কেমন সম্পর্ক থাকবে?”

–“আমরা নামে মাত্র স্বামী-স্ত্রী হায়া। কিন্তু মীর এখনো আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়নি। সে সব সময় আমার থেকে দূরে থাকে। আমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে তার কষ্ট হয়। সে কোনদিনও আমাকে মেনে নেবে না নিজের স্ত্রী হিসেবে। সকলের সামনে আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকলেও। মন থেকে আমরা একেবারেই আলাদা। আমরা একই ছাদের নিচে থেকেও আলাদা দুটি মানুষ। যাদের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মতো কোনো সম্পর্কই নেই।”

আমার কথায় যেন বেশ চমকে উঠলো হায়া। সে আমাকে নিয়ে বিছানার ওপর গিয়ে বসলো। তারপর আমার পাশে আর একটু এগিয়ে এসে আমাকে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,

–“এসব তুই কি বলছিস আব্রু?এতদিন আমাকে কেন বলিস নি এসব? এমনটাই যদি হয়, তাহলে তোরা সবার সামনে কেন এত স্বাভাবিকভাবে থাকিস? আমাকে সবকিছু খুলে বল। আমি সব জানতে চাই।

–” হ্যা হায়া, আমরা সবার সামনে স্বামী স্ত্রী হয়ে থাকলেও, আমাদের মাঝে স্বামী স্ত্রীর মত কোনো সম্পর্ক নেই। মীর আমাকে তার স্ত্রী হিসাবে কখনোই মেনে নিবে না।”

–” কিন্তু মীর ভাইয়া এমন কেন করবে তোর সাথে? উনি তো নিজে থেকে তোকে বিয়ে করার প্রপোজাল দিয়েছিল।”

ওর কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম আমি। কারন মীর আমাকে বলেছে যে সায়েম ভাইয়া আর বাসার সবাই জোর করার জন্য তিনি বিয়েতে রাজি হয়েছেন। তাছাড়া তার আমাকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছা ছিল না। তাই আমি কিছুটা অবাক হয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে হায়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

–” এসব তুই কি বলছিস হায়া? মীর তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। সে আমাকে কেনো বিয়ে করতে চাইবে? তাকে তোরা সবাই মিলে জোর করে রাজি করিয়েছিস এ বিয়েতে। তাহলে এখন কেন আমার মন রাখার জন্য মিথ্যা মিথ্যা বানিয়ে বলছিস?”

আমার কথা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল হায়ার। ও যেন অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেল। আমার কপালে আর বুকে একবার হাত দিয়ে বললো,

–“তোর শরীর ঠিক আছে তো আব্রু? কি বলছিস এসব আবোল-তাবোল? মীর ভাইয়া অন্য কাউকে ভালোবাসে? এটা কি মানা যায়? ওনার মত একটি মানুষ অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হবে,এটা অসম্ভব? কোনোভাবেই মানতে পারছিনা আমি। সায়েম এর কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি আর আমি নিজে যতটুকু দেখেছি, তাতে এটা বিশ্বাসের অযোগ্য। উনি তোকেই ভালোবাসেন আর তাই তোকেই বিয়ে করেছেন। তাও নিজের ইচ্ছায়, আমরা তো তাকে বাধ্য করি নি বিয়েতে!”

হায়ার কথা শুনে যেন এবার মাথা ঘুরতে শুরু করলো আমার। ওর কথা যেন কোন কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। আমি আবারো বলে উঠলাম,

–” আমি ভুল বলছি না হায়া। ভুল হচ্ছে তোর। আমি নিজে দেখেছি মীরের গার্লফ্রেন্ডকে। তোর বিয়ের দিন ছাদের উপর উনার সাথে কথা বলতে। আর যাকে সে নিজে মুখে বলেছিল বিয়ের কথা। তাছাড়া আমাদের বাসর ঘরেও সে নিজে আমাকে বলেছিলো, যে তোরা সবাই মিলে ওকে বিয়েতে রাজি করিয়েছিস। সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। কারণ তার প্রেমিকা আছে যাকে সে বিয়ে করতে চায়। আর তাই সে আমাকে স্ত্রী হিসেবে এখন অব্দি মেনে নেয়নি। আর নিবেও না।”

আমার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো হায়া। তারপর রাগে কটমট করতে করতে হাতের মুঠো শক্ত করে বললো,

–” যদি তোর কথা সত্যি হয়ে থাকে। তাহলে ওই মীর ভাইয়াকে আমি ছেড়ে দেবো না আব্রু। আমার বোনের জীবন নষ্ট করার কোনো অধিকার নাই তার।”

কথাগুলো বলে হায়া রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিল। সে সায়েম ভাই সহ সবাইকে সবকিছু বলে দিতে চায়। রাগে যেন তার শরীর জ্বলছে। আমি জানি ও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকে দুজনে একসাথে বড় হয়েছি। আমি ওর ছোটবোন। আমার প্রতি ভালবাসাটা অতিরিক্ত বেশি।তাই আমার কষ্ট সহ্য করতে পারবেনা সে কোনমতেই। আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে হাত ধরে বললাম,

–“তুই এসব কথা কাউকে বলবি না হায়া। আমি তোকে আগেই বলেছি এসব কথা তুই কাউকে বলবি না। আমি দেখতে চাই মীর শেষ অব্দি কি করে। ও যদি সত্যিই আমায় ভালবাসে থাকে, নিজের ইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করে থাকে। তাহলে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আর সেই কারণটা আমি ওর কাছ থেকে জানতে চাই। কিন্তু সেটা এভাবে জোরজবরদস্তি করে নয়। প্লিজ তুই কাউকে কিছু বলবি না। আমি ধৈর্য যখন ধরেছি তখন আরও ধৈর্য ধরব। তবে আসল কারণটা জেনেই ছাড়বো।”

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি রাখতেই দেখতে পেলাম পাখি দুটি খুব ছটফট করে পাগলের মত চেঁচাচ্ছে। কিন্তু আমি জানালার কাছে পৌঁছাতেই তারা আশ্চর্যজনক ভাবে শান্ত হয়ে গেলো। এবং নিজেদের বাসায় গিয়ে চুপ করে পাশাপাশি বসে রইলো। তাদেরকে শান্ত হতে দেখে আমি আবার ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। ওয়াশরুমের দরজার কাছে পৌঁছাতেই দেখি আবারো সেই পাখি গুলো একি ভাবে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। এবার বেশ অবাক হলাম আমি। কি এমন হয়েছে যে পাখি গুলো এমন করছে? আবারো জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম। আর আগের বারের মত এবারও আমাকে দেখে পাখি দুটি একদম শান্ত হয়ে নিজের বাসায় গিয়ে বসল। এবার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগল আমার কাছে। তবুও এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ওয়াশ রুমে ঢোকার আগ মুহূর্তে পাখি দুটির চেঁচামেচি আবার শুনতে পেলাম। বেশ অবাক লাগলেও এবার আর জানালার কাছে ফিরে গেলাম না। সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। সেখানে ঢুকে পড়ে গোসলের জন্য রেডি হতে লাগলাম। যখনই গোসলের জন্যে জামা কাপড় খুলবো বলে ভাবলাম। সেই মুহূর্তে হঠাৎ করে আমার চারিপাশে কেমন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। পুরা ওয়াশরুমটা যেন সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল। এমন অবস্থা আগে কখনো দেখিনি আমি। হঠাৎ কানের কাছে কেমন যেন একটা ফিসফিসানি শব্দ আসতে লাগল। সারা শরীরে ঠাণ্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেলো। অসম্ভব ভয় পেতে লাগলাম আমি। ধোয়ার কারণে নিজের হাতটাও দেখতে পারছি না। যখনি ভয়ে চিৎকার করতে যাবো তখনই কেউ যেনো আমার গলা শক্ত ভাবে চেপে ধরলো। তবে সেটা কে বা কি তা বুঝতে পারলাম না আমি। ধিরে ধিরে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। মৃত্যু যন্ত্রনা অনুভব করতে লাগলাম আমি। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। সেই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মীরের হিংশ্র চেহারা। একদম অন্য রকম ভয়ংকর রুপ যার। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ঢলে পরলাম হয়তো মৃত্যুর কোলে!

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,