রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-১৩

0
742

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_১৩
#M_Sonali

–“কি হলো সোনা বউ। এত আদর করে খাওয়াতে চাইলাম খাবে না আমার হাতে? এভাবে আমার থেকে পালাচ্ছো কেনো। আমি না তোমার স্বামী!”

কথাটা বলেই আমার হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলেন উনি। সাথে সাথে ওনার বুকে আছড়ে পরলাম। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি আমার ঠোঁট দুটো নিজের ঠোট দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন। কিছু মুহুর্তের জন্যে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো আমার। তারপর সব খেয়াল হতেই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ওনার থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কোনোভাবেই ওনার থেকে ছাড়া পাচ্ছি না। ওনার শক্তির কাছে যেনো আমার শক্তি কিছুই না। উনি এতটা শক্ত করে ধরেছেন যে, নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছি। দম যেনো আটকে গেছে। চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো আমার। সাথে সাথে উনি আমায় ছেড়ে দিয়ে বেশ কিছুটা দূরে সরে গেলেন। আর আমি অবশের মত বিছানার ওপর আছড়ে পরলাম। আমার চোখ দিয়ে এখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়। তার দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম সে অনুশোচনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুঝতে পারলাম না এইটুকু সময়ের মাঝে তার চেহারায় এত পরিবর্তন কিভাবে আসলো? এখন যেন আমি সেই আগের মীরকেই দেখতে পাচ্ছি সামনে। সে আমাকে কিছু না বলে সোজা রুম থেকে উঠে বাইরে চলে গেল। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর সব কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলাম। কোনো কিছুই যেন মাথায় ঢুকছেনা। কি থেকে কি হচ্ছে এসব আমার সাথে।

একটু পরেই হায়া আমার কাছে আসলো। আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে পাশে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে কমল সুরে বলল,

–“আব্রু, এখন কেমন লাগছে তোর? শরীর ভালো আছে তো? মীর ভাইয়া এভাবে চলে গেল কেন? দেখে মনে হচ্ছিল ভীষণ রেগে আছে উনি। তোদের মাঝে আবার কিছু হয়েছে নাকি?”

হায়ার কথার উত্তরে শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি। তারপর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম মীরের ব্যাপারে সবকিছু ওকে খুলে বলবো। ওয়াশরুম থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সবকিছুই হায়াকে খুলে বলবো। কারণ এসব লুকিয়ে নিয়ে চলা টা ভীষণ কষ্টকর হয়ে গেছে। আমার মাথায় কোনো কিছুই ঢুকছেনা। হায়াকে বললে হয়তো ও কোনো সলিউশন দিতে পারবে!

–” হায়া, মীরের ব্যাপারে তোর কাছে অনেক কিছু বলার আছে আমার। আমি কোন কিছুই বুঝতে পারছি না কিভাবে কি বলবো? কিছুই যেনো মাথায় ঢুকছেনা। প্লিজ কথাগুলো শুনে আমাকে একটু হেল্প কর।”

আমার কথা শুনে মুচকি হেসে আরও কাছে এগিয়ে বসলো হায়া। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–” এই পাগলি এত রিকুয়েস্ট করার কি আছে রে? আমি কি তোর পর, যে এভাবে রিকুয়েস্ট করছিস? বল কি বলতে চাস, আমি সবকিছু শুনতে রাজি আছি।”

এতোটুকু বললেই চুপ করে গেলো। ওকে চুপ করতে দেখে আমি যখনই মুখ খুলতে যাব, তখনই ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

–“এই আব্রু, এক মিনিট এক মিনিট। তোর ঠোঁটে কি হয়েছে রে? এমন কেটে গেলো কিভাবে? অনেকটা রক্তও জমে গেছে দেখছি। আমি তো এতোক্ষণ খেয়ালই করিনি। আর তোর নাক ও হাতেও এমন লাল হয়ে আছে কেন? কি হয়েছে বলত?”

হায়ার কথায় কি বলব বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম ও ঠিক কি বলতে চাইছে! কিছুটা বুঝে আসতেই দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি সত্যিই আমার নাক লাল হয়ে আছে। সাথে দুবাহুতেও বেশ কিছুটা করে জায়গা লাল হয়ে আছে। ঠোঁটের একপাশে রক্ত জমে আছে। বুঝতে পারলাম যে এটা মীরের ওই ভাবে আমাকে শক্ত করে ধরে ঠোঁটে রুডলি কিস করার জন্য হয়েছে। এবার যেন মনে মনে ভীষণ রাগ হল আমার। সে প্রথম আমাকে এভাবে স্পর্শ করেছে। কিন্তু এই স্পর্শটায় মোটেও কোন ফিলিংস তৈরি করেনি মনের মাঝে। বরং উনার প্রতি অনেক ভয় এবং ঘৃনা জন্ম নিয়েছে মনে। উনাকে যেন আমি চিনতেই পারছিলাম না সেই মূহুর্তে।

ভীষণ রাগ নিয়ে হায়ার কাছে এগিয়ে আসলাম। পাশে বসে মীরের ব্যাপারে সবকিছু বলব বলে মনস্থির করলাম। তারপর যখন’ই ওর ব্যপারে কিছু বলার জন্য মুখ খুলব, তখনোই আমি খেয়াল করলাম যে, অদৃশ্য কোনো এক শক্তি আমাকে চারিপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। কোনভাবেই মীরের নামটাও মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারছিনা। শত চেষ্টা করেও একটা কথা ও মুখ থেকে বলতে পারছিনা। শুধু উম উম শব্দ করে যাচ্ছি। আমাকে এমন করতে দেখে ভ্রু কুচকালো হায়া। অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

–” এটা কেমন ফাজলামো হচ্ছে আব্রু? তুই তখন থেকে এমন উম উম করে যাচ্ছিস কেন? কি যেনো বলতে চাইছিলি বল! আর তোর এমন অবস্থা হল কীভাবে কিছুই তো বলছিস না!”

নাহ, হায়ার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার মাঝে। শত চেষ্টা করেও মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারছি না। এবার ভীষণরকম বিরক্ত লাগছে নিজের ওপর। সেইসাথে ভয়টা যেন ক্রমশ মনের মাঝে বেড়ে চলেছে। যতটুকু বুঝতে পারছি মীর কোনো মানুষ নয়। মানুষ হতেই পারে না সে। কারণ ওকে আমি নিজের চোখে অন্য এক রুপে দেখেছি। এই মীর সেই মীর নয়, যাকে আমি ভালোবাসি। বা আমি তাকে এতদিনেও হয়তো চিনতে পারিনি। তবে মীরের আসল পরিচয়টা আমাকে জানতেই হবে। সেটা যেভাবেই হোক। আর তার জন্য অবশ্যই হায়ার সহযোগিতা দরকার আমার। তাই মনে মনে ভাবতে লাগলাম এখন কীভাবে ওকে সব বলা যায়। কিছুক্ষণ ভাবতেই মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের কাছে চলে গেলাম। তারপর একটা খাতা এবং একটা কলম হাতে তুলে নিয়ে হায়ার কাছে ফিরে এলাম।

হায়া আমার কান্ড-কারখানা দেখে বেশ বিরক্তিকর কান্ঠে বলল,

–” কি হয়েছে আব্রু বলতো আমায়? ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে কি পাগল হয়ে গেছিস? মাথার বুদ্ধি সুদ্ধি কি সব হারিয়ে ফেলছিস নাকি? কি করছিস তুই এসব। মুখে কোন কিছু বলছিস না, অথচ পাগলের মত এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিস। আর এই খাতা কলম দিয়ে কি করবি এখন? আমি কি তোকে পড়াতে এসেছি এখানে?”

হায়ার কথার কোন উত্তর না দিয়ে, দ্রুত খাতাটা খুলে ওর সামনে রেখে সেখানে লিখতে শুরু করলাম, “হায়া, ওয়াশরুমে আমার সাথে একটা অদ্ভ,,,,,,,,,,,!” এতোটুকু লিখতেই হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন মীর ছুটে এসে আমার হাত থেকে খাতা এবং কলম নিয়ে নিল। তারপর হায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

–“ভাবী আপনি একটু বাইরে যাবেন প্লিজ। আমার বউ এর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

ওনার এমন কান্ডে হারা এবং আমি দুজনেই হা করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। দুজনে যেন আকাশ থেকে পড়েছি। অসম্ভব রকমের অবাক হয়েছি দুজনেই। আমাদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এবার বেশ বিরক্তিকর কণ্ঠে আবারো বলে উঠল মীর,

–” কি হল ভাবী আপনি কি আমার কথা শুনতে পাননি? প্লিজ এখনই রুম থেকে বেরিয়ে যান। ওর সাথে আমার দরকার আছে। আর হ্যাঁ একঘণ্টার মধ্যে আমাদের ডিস্টার্ব করবেন না কেউ।”

এবার হায়া বেশ লজ্জা পেয়ে গেল ওনার কথায়। তাই দ্রুত কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ও বেরিয়ে যেতেই মীর দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর রাগি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। উনাকে এভাবে তাকাতে দেখে যেন অন্তর আত্মা শুকিয়ে গেল আমার। ভয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পিছন দিকে পেছাতে লাগলাম। রুমের মাঝে ওনার থেকে বাঁচতে কোথায় লুকাবো আশেপাশে সেই জায়গা খুঁজতে লাগলাম।কিন্তু কোথাও লুকানোর মতো জায়গা পেলাম না। এদিকে উনি আমার অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। একদম দেওয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। উনি এসে আমার দুই পাশে দুই হাত দিয়ে আমাকে আটকে ফেলল। তারপর দাঁতের সাথে দাঁত চেপে রাগি কন্ঠে বলল,

–” তোমার সাহস কি করে হয় আমার ব্যাপারে বলতে চাওয়ার?তুমি জানো এর জন্য তোমার কি অবস্থা করতে পারি আমি? তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কতটা করুন হাল হবে তোমার!”

ওনাকে এভাবে কথা বলতে দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। থরথর করে কাঁপতে শুরু করলাম। আমাকে এত ভয় পেতে দেখে সে একটু শান্ত হলো। তারপর আবারো বলে উঠল,

–“দেখো আব্রু আমি চাইনা তোমার বা তোমার আমার পরিবারের কোন ক্ষতি করতে। কিন্তু তুমি আমাকে বাধ্য করছো তোমার ক্ষতি করার। তাই নিজের ভালো যদি চাও চুপচাপ থাকো। সময় আসলে সব কিছুই জানতে পারবে। আমাকে একটু সময় দাও। আমি কোনভাবেই তোমার ক্ষতি করতে চাইনা এতোটুকু মাথায় রাখ। এখনকার মতো তোমাকে সব কিছু খুলে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যদি নিজেকে বাঁচাতে চাও তাহলে আমার কথা সবার থেকে আড়ালে রাখো। আর আমার সাথে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করো। ভুলে যেওনা আমি তোমার স্বামী।”

এতোটুকু বলে আমার থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর চুপচাপ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি চোখ খুলে ওনার দিকে এক নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম ওনার কথাগুলো। ওনাকে এখন অনেকটাই শান্ত দেখাচ্ছে। উনার মাঝে এখন একটুও হিংশ্রতা নেই। মনে মনে সাহস যুগিয়ে উনার কাছে এগিয়ে গেলাম। তারপর কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

–” স সত্যি করে বলুন তো মীর, আপনি আসলে কে? যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হয় আপনি মানুষ নন। এটা আমি শিওর। কিন্তু মানুষ যদি না হন তাহলে আপনি কে? আর কেনই বা এসব করছেন আমার সাথে?”

উনি আমার কথার উত্তর দিলেন না।শুধু একবার ফিরে তাকিয়ে জানালার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন। উনি আমার দিকে ফিরতেই বেশ অবাক হলাম। কারণ ওনার চোখে চিকচিক করছে কয়েক ফোটা অশ্রুজল। সেটা দেখে বেশ অবাক হয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই দেখলাম, সেই পাখিদুটি ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় মারা গিয়ে গাছের ডালের ওপর পরে আছে। আর ঠিক তার পাশের ডালের ওপরে মরে পরে আছে দুটো বড় বড় কাক।

পাখি দুটিকে এমন ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় দেখে ভীষণ রকমের কষ্ট লাগতে লাগল মনে। যেন এখনই কান্না করে ফেলব আমি। তাদের এমন পরিণতি কিভাবে হলো কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না।তারপর যখন”ই ভাবলাম মীরকে কিছু জিজ্ঞেস করব, তখনই হঠাৎ করে মীর আমার কানের কাছে এসে বলে উঠলো,

–” আব্রু তুমি ঠিক ধরেছো! আমি কোন মানুষ নই। আমি একজন জ্বীন। আর বাইরে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় যে পাখি দুটি কে দেখতে পাচ্ছো, তারাও কোন পাখি নয়। তারাও দুজন জ্বীন। যারা ছিল আমার সবচাইতে প্রিয় সঙ্গী এবং তোমার পাহারাদার। আপাতত এতটুকুই জেনে রাখো। এর চাইতে বেশি জানতে গিয়ে নিজের এবং পরিবারের ক্ষতি করো না।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,