রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-১৪

0
748

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_১৪
#M_Sonali

রাত ১১.৩০ মিনিট
এই তীব্র গরমের মাঝেও কম্বল গায়ে দিয়ে গুটিসুটি হয়ে চুপ করে নিজের রুমে শুয়ে আছি।সেই সাথে ভয়ে থরথর করে কেঁপে চলেছি একনাগাড়ে। মীর একজন জ্বীন! এমনকি ঐ সুন্দর পাখি দুটিও জ্বীন ছিলো। এটা জানার পর থেকেই যেনো ভয়টা প্রকট ভাবে চেপে ধরেছে আমায়। বুঝতে পারছি না এখন কি করা উচিৎ। চাইলেও কারো সাথে মীরের ব্যপারে কোনো কথা শেয়ার করতে পারছি না। কারণ নিজের ক্ষতির চাইতেও বেশি ভয় পাচ্ছি আমার পরিবারকে নিয়ে। মীর বলেছে ওর ব্যপারে কাউকে কিছু বললে, আমার পরিবারের ক্ষতি হবে। যেটা একদমই চাইনা আমি।

তবে একটা কথা ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে আমায়। মীর যদি একজন জ্বীন হয়, তাহলে ওর পরিবারের সবাইও কি জ্বীন?যদি এমনটাই হয় তাহলে ওর সাথে ওর পরিবারের কারো মিল নেই কেন? সবাই কেন ওর থেকে এতটা আলাদা? আর যদি ধরেও নিই যে সবাই জ্বীন। তাহলে তারা জ্বীন হওয়া সত্ত্বেও ওর থেকে আলাদা হলো কেনো? আর সেটা হায়া কেন বুঝতে পারল না, যে তার স্বামী একজন জ্বীন? কারণ আমার আর মীরের মত তো হায়া আর সায়েম ভাইয়ার সম্পর্ক নয়। তারা তো তাদের বিবাহিত জীবনে অনেক সুখি!

এসব ভাবছি আর মাথা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়। কোনোভাবেই যেন কোনো কিছু মেলাতে পারছি না। সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার মুখে কেমন গরম বাতাস স্পর্শ করে গেল। সাথে সাথে সজোরে কেঁপে উঠলাম। দ্রুত সামনের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই চমকে উঠে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তখন’ই মীর আমার মুখটা চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে রাগি গলায় বলল,

–” একটুতেই এত চিৎকার করো কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলবো? এভাবে চিৎকার করার কি আছে। আমাকে কি আজ প্রথম দেখছো তুমি?”

উনি কথাগুলো একদম আমার মুখের কাছে এসে বললো। সাথে আমাকে এক প্রকার জড়িয়ে ধরে আছে তিনি। তাকে এ অবস্থায় দেখে ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল। কোনোভাবেই যেন তাকে এতোটা কাছে আশা করিনি। এতদিন তাকে এতোটা ভালোবাসলেও যখন থেকে জানতে পেরেছি সে মানুষ নয় সে একজন জ্বীন! তখন থেকে যেন ভালবাসাটা ভয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ কাউকে যতই ভালোবাসুক না কেন সে যখন জানতে পারবে তার ভালোবাসার মানুষটা কোন মানুষ’ই নয়। সে একজন জ্বীন! তখন তার মনে ভয় আসাটাই স্বাভাবিক। তেমনি আমারও এসেছে ভয়। ওনাকে এত কাছে দেখে এতক্ষণ যতটা না কাপছিলাম, তার চাইতেও অনেক জোরে কাপতে শুরু করলাম। এতটা জোরে কাপছি যে, আমার কাপুনির ঠেলায় খাট কাঁপতে শুরু হয়ে গেছে। সে আমার এমন অবস্থা দেখে ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলেন। একবার মাথায় তো একবার গলার নিচে হাত দিয়ে চেক করতে লাগলেন জ্বর হয়েছে কিনা। তারপর শান্ত গলায় মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–” কি হয়েছে আব্রু? তুমি এভাবে কাপছো কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”

উনার কথার উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই আমি। সারা শরীর এতটা জোরে কাপুনি দিচ্ছে, যেন এখনই ডেকে জ্বর এসেছে গায়ে। একজন বৃদ্ধ মানুষকে খালি গায়ে যদি প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়! তাহলে তার ঠোঁট দাঁত এবং শরীর ঠিক যেভাবে কাপবে, আমারও ঠিক তেমনই অবস্থা। কেউ দেখলে মনে করবে হয়তো প্রচন্ড জ্বর হয়েছে।

আমাকে কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে দেখে হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন মীর। তাই আমার থেকে সরে গিয়ে এবার উঠে বসলেন তিনি। তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস ছাড়লেন। চুপ করে এক নজরে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি ওনার কাণ্ডকারখানা কোন কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে থর থর করে কেপে চলেছি। ভয়টা যেন যত সময় এগোচ্ছে ততবেশি ঘিরে ধরছে আমায়। এভাবে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল। এবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগলাম। কাপুনি টাও অনেকটা কমে যাচ্ছে শরীরের। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে একটু সুস্থ হতেই তিনি আবারও আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর দূর থেকেই শান্ত কণ্ঠে বললেন,

–“অল্পতেই এত হাইপার হইওনা আব্রু। তোমার সামনে ভয় পাওয়ার জন্য আরো অনেক সময় পরে আছে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করো। কারণ ছাড়াই এত হাইপার হলে তোমার’ই ক্ষতি হবে। একটা জিনিস মনে রেখো, তোমার কোন সাধারণ কারো সাথে বিয়ে হয়নি। তুমি একজন জ্বীন এর স্ত্রী। আর একটি জ্বীন যে কতটা বিপদজনক! সেটা তোমার ধারণার বাইরে। তাই নিজেকে তৈরি করতে শেখো। ভয়কে জয় করতে শেখো। নইলে বিপদ তোমার পিছু ছাড়বে না।”

ওনার একটি কথার অর্থ ও যেন আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি শুধু হা করে উনার কথাগুলো গিলে চলেছি। উনি কথাগুলো বলে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

–” আব্রু একটু সাহস যোগাও মনে। তোমাকে আমি কিছু দেখাতে চাই। আমার হাতটা ধরো আর বিছানা থেকে উঠে এসো!”

উনার কথা শুনে দুটানায় পড়ে গেলাম। মন বলছে ওনার হাতটা ধরে ওনার কাছে যাই। কিন্তু ভয়ও পাচ্ছি অসম্ভব। কোন দিকে যাব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। আমাকে চুপ করে চিন্তা করতে দেখে উনি মুচকি হাসলেন। তারপর কাছে এগিয়ে এসে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,

–” এত কেন ভয় পাচ্ছো আমায়? কই এতদিন যখন গম্ভীরমুখে তোমার কাছে থাকতাম তখনতো ভয় করতে না? বরং সুযোগ খুঁজতে কিভাবে আমার কাছে আসা যায়। তাহলে এখন কেন এত ভয় পাচ্ছ? এখন তো আমি চাইছি তোমার কাছে আসতে। তাহলে কেন পালাচ্ছো আমার থেকে? এভাবে পালিয়ে বেড়ালে আমার “রহস্যে ঘেরা ভালবাসা” বুঝবে কি করে তুমি?”

ওনার শেষের বলা কথাটুকু শুনে যেন মনের মাঝে এক ভালোলাগা দোলা দিয়ে গেলো। উনাকে দেখে যতই ভয় পাই না কেন, আমি তো ওনাকেই ভালবেসেছি। আর এখনো বাসি। চাইলেও তো সেটা অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই। তাই মনে মনে সাহস যোগালাম। মনকে বোঝালাম, সে মানুষ হোক বা জ্বীন! আমিতো তাকেই ভালোবাসি। আর তার চাইতে বড় কথা সে আমার স্বামী। যেভাবেই হোক তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আর উনার ব্যাপারে সবকিছু জানতে হলে আমাকে সাহস যুগিয়ে ওনার কাছে যেতেই হবে। এভাবে পালালে তো চলবে না। নিজেকে যতটা সম্ভব মনে মনে প্রস্তুত করে নিলাম। তখনই হঠাৎ করে আমার গালে আলতো করে চুমু এঁকে দিলেন উনি। ওনার এমন কান্ডে চোখ বড় বড় করে ওনার দিকে তাকালাম। আমাকে এভাবে তাকাতেই দেখে উনি হেসে দিলেন। তারপর উঠে বসে আমার হাত ধরে টেনে তুলে পাশে বসিয়ে আবেগি গলায় বললেন,

–” ভালবাসি আব্রু। আমিও তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আর এই ভালবাসাটা এখন থেকে নয়। বরং তোমার সেই ছোটবেলা থেকে। যখন তুমি অবুঝ শিশু ছিলে।”

ওনার কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি উনি? ছোটবেলা থেকে উনি আমায় ভালবাসেন? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? ওনাকে দেখে তো মনে হয় না উনি এতটা বড়? আমি ভয়ে ভয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

–“কিন্তু আপনি তো আমার থেকে দুই থেকে তিন বছরের বড় হবেন। তাহলে এত ছোটবেলায় আমায় ভালবেসেছেন কিভাবে? আর আমাদের প্রথম দেখাতো হয়েছে কলেজে। তাহলে আপনি এত ছোটবেলায় আমাকে কোথায় দেখলেন?”

আমার প্রশ্নে এমনভাবে হেসে দিলেন উনি। যেন মনে হচ্ছে আমি জোকারের মতো কোনো প্রশ্ন করে ফেলেছি। যে প্রশ্নের কোন মানে হয়না। ওনাকে এমন হাসতে দেখে মনে মনে বেশ রাগ হল। কিন্তু ভয়ের কারণে রাগটা দেখাতে পারলাম না। তখনই উনি আচমকাই আমাকে পিছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর গলার কাছে মুখ গুঁজে মৃদু কণ্ঠে বললেন,

–” আমার বয়স এখন কত তোমার সেটা ধারণা আছে আব্রু? আমি এখন 125 বছরের একটি জ্বীন যুবক।”

ওনার এই কথাটার জন্য যেন মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কথাটা শুনতেই চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। কানটাও যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। আমি ওনার থেকে উঠে বসে উনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। উনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। কই না তো, ওনার মধ্যে বৃদ্ধ বয়সের কোন চিহ্ন টুকুও নেই। তবে কি উনি মিথ্যে বলছেন? মজা করছেন আমার সাথে? তাই প্রশ্ন করে ফেললাম,

–” আপনি মিথ্যে কেন বলছেন? আপনাকে দেখে তো বুড়ো মনে হয় না? আপনাকে দেখে তো মনে হয় খুব বেশি হলে 25 বছর বয়স হবে। তাহলে আপনি 125 বছর কিভাবে বলছেন?”

আমার এমন বোকা বোকা প্রশ্নে আবারো হাসলেন উনি। তারপর আমাকে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমার গা ঘেষে একদম পাশে শুয়ে পরলেন। আলতো করে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,

–” আমি একজন জ্বীন। কোনো সাধারণ মানুষ নই। কেন বার বার ভুলে যাচ্ছ তুমি? আর একজন জ্বীন এক হাজার বছরেরও বেশি বেঁচে থাকে। তাই 125 বছর বয়সে আমরা যুবক। বৃদ্ধ নই বুঝলে!”

আমি ওনার কথায় এতটাই মগ্ন আর এতটাই ডুবে গেছি যে, উনি যে আমার এতটা কাছে চলে এসেছেন সেটা খেয়ালই করিনি। শুধু উনার কথাগুলো শুনছি আর সেসব নিয়েই ভেবে চলেছি। উনার কথায় আবারও আমি অবাক দৃষ্টিতে ওনার দিকে ফিরে তাকালাম। উনার মুখটা এখন আমার একদমই কাছাকাছি। সেটা খেয়াল না করেই প্রশ্ন করলাম,

–” আপনারা এতদিন বেঁচে থাকেন? এটা কিভাবে সম্ভব?”

–” আল্লার ইচ্ছায় সবই সম্ভব। আমাদের বোঝার জানার আড়ালেও এমন অনেক কিছু আছে। যা কেউ কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু আল্লাহ সেসব ঠিকই পরিকল্পনা করে রেখেছেন। এবং পরিচালনা করেন। তাই এসব নিয়ে বেশি ভেবে মাথা নষ্ট করতে হবে না। তুমি হয়তো এসব ভাবনায় এতটাই মগ্ন যে, খেয়াল করনি আমি তোমার কতটা কাছে চলে এসেছি। নইলে এভাবে কথা বলতে পারতে না আমার সাথে।”

কথাগুলো বলেই দুষ্টুমির একটা হাসি দিলেন উনি। এবার যেন আমার টনক নড়লো। আমি অবাক দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। উনাকে এত টা কাছে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর ছোট ছাগল ছানার মতো ছটফট করতে শুরু করলাম উনার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু উনি আমাকে এমনভাবে হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন যে আমি এক চুলও নড়তে পারলাম না। কিছুক্ষণ ছটফট করে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম। তখন চুপ করে ওনার বুকে মাথা দিয়ে রইলাম। উনি তখন হেসে দিয়ে বললেন,

–” শুধু শুধু ছোট বাচ্চাদের মত এত ছটফট করে নিজের শরীরের এনার্জি গুলো কেন হারাচ্ছ আব্রু? আর ছটফট করে কি লাভ হবে বলো! আমি তো তোমার কাছে চলেই এসেছি। আর আমি তোমার স্বামী অন্য কেউ তো নয়, যে এত ছটফট করতে হবে। এখন চলো উঠো, তোমাকে কিছু দেখাতে চাই আমি। যেটা ভবিষ্যতে তোমার কাজে লাগবে।”

উনার কথার উত্তরে আর কোন প্রশ্ন করলাম না। বাধ্য মেয়ের মতো ওনার সাথে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আয়নাতে আমাদের দুজনকে পাশাপাশি দেখে অনেক ভালো লাগছে। এক নজরে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখনই একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। আয়নায় আমাদের প্রতিচ্ছবি মিশে গিয়ে পানির ঢেউয়ের মতো ঢেউ উঠতে লাগলো। এটা দেখে ভীষণ রকমের ভয় পেয়ে গেলাম। মীরের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ওর বুকে মাথা লুকালাম। আমার এমন অবস্থা দেখে আলতো হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে মীর বলল,

–” ভয় পেয়ো না আব্রু। এটাই দেখাতে চাই আমি তোমাকে। এটা এখন আর কোন সাধারণ আয়না নয়। এটা জাদু আয়না। জ্বীন রাজ্যের প্রবেশ দাড়।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,