রহস্যে ঘেরা ভালবাসা পর্ব-১৫

0
737

#রহস্যে_ঘেরা_ভালবাসা
#পর্ব_১৫
#M_Sonali

–“ভয় পেয়ো না আব্রু। এটাই দেখাতে চাই আমি তোমাকে। এটা এখন আর কোন সাধারণ আয়না নয়। এটা জাদু আয়না। জ্বীন রাজ্যের প্রবেশদ্বার।”

ওনার কথা শুনে অবাক হয়ে উনার বুক থেকে মুখ তুলে নিয়ে আবারো আয়নার দিকে ফিরে তাকালাম। উনার কথার যেন কোনো কিছুই বুঝতে পারছি না!একটা আয়না কিভাবে জ্বীন রাজ্যের প্রবেশদ্বার হতে পারে? কথাটা মনে মনে ভেবে যখন’ই ভাবলাম উনাকে প্রশ্ন করব, তখন’ই উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন,

–” হ্যা তুমি ঠিকই শুনেছো। এটা কোন সাধারণ আয়না নয়। এটা জ্বীন রাজ্যের প্রবেশ দ্বার। এই আয়নার মাদ্ধমেই তুমি জ্বীন রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে।”

এতোটুকু বলে থামলেন উনি। ওনার কথা শুনে আয়নার দিকে বেশ কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে রইলাম। তারপর মনে মনে কিছু একটা ভেবে যখনই ভাবলাম মীরকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করব! তখনই হঠাৎ আয়নাটা সাদা হয়ে যেতে লাগল। পুরো আয়নাটা একদম দুধের মত ধবধবে সাদা হয়ে গেল। এমনটা হওয়ায় মীরার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

–“এমন হওয়ার কারন কি মীর? আয়নাটা হঠাৎ এমন হয়ে গেলো কেনো?”

মীর এতক্ষণ আমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল। তাই সে আয়নার ব্যপারটা খেয়াল করেনি। আমার করা প্রশ্নে সে, আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়েই ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেল। দ্রুত আমার কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়ে বলে উঠলো,

–” আব্রু, বিপদ আসতে চলেছে। ভয়ঙ্কর রকমের বিপদ। আমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি দ্রুত কোরআন নিয়ে বসে তেলাওয়াত করতে শুরু করো। আর যতক্ষণ না আমি ফিরে আসছি ততক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকবে। ভুল করেও এই রুমের দরজা জানালা খুলবে না। যে কেউ এসে ডাকুক না কেন। যদি আমি আসি তবুও না। আমি আসলে সরাসরি তোমার সামনে আসব। কথাটা মনে রেখো। জানালা দরজা খুলবে তো ভয়ংকর বিপদে পড়বে। ”

কথাগুলো বলেই মুহূর্তের মধ্যে আয়নার মধ্যে প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি। আর আয়নাটাও আগের মত স্বাভাবিক রুপে ফিরে আসলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। হঠাৎ কি হয়ে গেল কোন কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। উনি কেন এভাবে আয়নার মধ্যে প্রবেশ করে গেলেন। আর যাওয়ার আগে কি সব বলে গেলেন এগুলো? ভয় যেন শরীর কাঁপতে লাগলো। কোনভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছিনা। কি করবো না করবো মাথায় আসছে না।ভাবলাম আম্মুর কাছে তার রুমে চলে যাবো। কিন্তু উনি তো আমাকে রুম থেকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। তাহলে কি এই রুমেই থাকবো? তখনই মনে পড়ল উনি কোরআন তেলাওয়াত করতে বলেছেন। যতক্ষণ না উনি ফিরে আসেন। তাই দেরি না করে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম ওযু করার জন্য।

ওয়াশ রুমের দরজার কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন মীরের কন্ঠে আওয়াজ আসলো, “আব্রু ভুল করেও এই মুহূর্তে ওয়াশরুমে যেওনা। তাহলে এর চাইতে বড় বিপদ আর কিছুই হবে না। কোনোভাবে তোমাকে প্রটেক্ট করা সম্ভব হবে না আমার।” এতোটুকু শুনেই কেঁপে উঠলো আমার শরীর। চারিদিকে মীরকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু না সে কোথাও নেই। এবার কি করবো আমি? ওয়াশরুমে না গেলে ওযু করব কি করে? আর ওযু না করলে কিভাবেই বা কোরআন তেলাওয়াত করব?” নাহ, কোনোভাবেই কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে রুম থেকে বাইরে বের হওয়ারও কোন উপায় নেই। কারণ মীর নিষেধ করে গেছে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। তখনই মাথায় বুদ্ধি আসলো। “আমার তো কোরআনের অনেকগুলো সূরা’ই মুখস্ত আছে। আর মুখে সূরা পড়তে ওযু করতে হয়না। তাই সেগুলো একে একে পড়তে শুরু করলাম। তাতে যদি কোন কাজ হয়।

এভাবে বড় একটি সূরা অর্ধেক পর্যন্ত পড়া হতেই, পশ্চিম সাইডের জানালার উপর ভীষণ জোরে জোরে আওয়াজ হতে লাগল। এমন মনে হচ্ছে যেন এখনই কেউ জানালাটা ভেঙে ফেলবে। আমি ভয়ে যেন জমে যাচ্ছি। ভয়ের চোটে সূরাটাও ঠিক ভাবে পড়তে পারছিনা। মুখটা যেন আউরিয়ে আসছে বারবার। কি করব কোন কিছুই বুঝতে পারছি না। ভয়ে শরীর অবশ হয়ে আসছে। নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়েনিলাম বিছানার উপর। তারপর আবারো নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে জোরে জোরে সূরা পড়তে লাগলাম। কিন্তু কোনোভাবেই জানালার আওয়াজ বন্ধ হচ্ছে না। এভাবে একটা সূরা পড়া কমপ্লিট হতেই হঠাৎ করে সব শান্ত হয়ে গেলো। যেনো কোথাও কিছুই হয়নি।

কিন্তু এতে করে আমি থেমে গেলাম না। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যতক্ষণ না মীর আসে ততক্ষণ সূরা পড়তে থাকবো। তাই আরেকটি সূরা পড়া আরম্ভ করলাম। তখনই জানালার বাইরে থেকে আমার শ্বশুরের কন্ঠে কেউ একজন ডাকতে লাগল। আমার নাম ধরে বারবার বলতে লাগল জানালা খোলার জন্য। ওনার ডাক শুনতেই আমার মনে হলো গিয়ে জানালাটা খুলে দেই। কিন্তু তখনই মাথায় আসলো যে, এত রাতে আমার শ্বশুর জানালার বাইরে কিভাবে আসবে? আর তাছাড়া এটা দোতলা বাসা। আমি দোতালা তেই থাকি। জানালার বাইরে তো এখন কারো আসা অসম্ভব। কারণ সেখানেতো দাঁড়ানোর মতো কোন জায়গা নেই। আর নিচে থেকে ডাকলে এতটা জোরে কখনোই আওয়াজ শোনা যাবেনা। এবার যেন ভয়ে শিউরে উঠলাম আমি। পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। সূরা পড়া আর কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। বুঝতে পারলাম নিশ্চয়ই কোনো বিপদ আছে আমার। মীরের কথাই ঠিক। জানালা কোন ভাবে খুলবো না আমি।

কথাগুলো মনে মনে ভেবে দ্রুত পাশ থেকে কম্বল নিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব জরিয়ে নিলাম। সাথে সূরা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। যদিও কোনভাবেই আর পড়া সম্ভব হচ্ছে না। যতই সূরা পড়ার চেষ্টা করছি যতই সব গুলিয়ে ফেলছি এবং ভুলে যাচ্ছি। শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা ভয়ে। তখনই হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে আম্মুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। সে আমাকে ডেকে বলছে, “আব্রু এই আব্রু, কি হয়েছে তোর? এত জোরে জোরে কি পড়ছিস? দরজা খোল মা আমাকে ভেতরে আসতে দে।”

আম্মুর কন্ঠ শুনতেই যেন বুকে অনেকটাই সাহস ফিরে পেলাম। একবারও মনে আসলো না যে, মীর আমাকে বারবার সাবধান করে গেছে, যে কেউ এসে ডাকলে দরজা না খোলার জন্য। আমি কোন কিছু না ভেবে দ্রুত খাট থেকে নেমে গিয়ে দরজা খোলার জন্য প্রস্তুত হলাম। তখনই কেন জানি না বারবার মনে হতে লাগলো কেউ আমাকে দরজা খুলতে বাধা দিতে চাইছে। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে দরজা খুলে সামনে তাকালাম। নাহ, বাইরে কিছু নেই। শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। সবাই লাইট নিভিয়ে দিয়ে যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে। তাহলে আমাকে ডাকল কে? কথাগুলো ভেবে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে চলে আসলাম।

যখনই আম্মুকে ডাকার জন্য মুখ খুলব, তখনই মনে হলো চারিদিক থেকে আমাকে কিছু একটা ঘিরে ফেলেছে। আমি কোন কথা বলতে পারছিনা। দম নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। মুহুর্তের মধ্যে ঢলে পড়লাম ফ্লোরে। কেউ একজন খুব শক্ত করে আমার ওপর চেপে বসেছে। আমার সাথে বাজে কিছু করার চেষ্টা করছে। এমন মনে হতেই হঠাৎ করে আমি সেন্স হারিয়ে ফেললাম। আর কোন কিছু মনে নেই আমার।

——————————-

শরীরে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ বুঝতেই চোখ মেলে তাকালাম। তাকাতেই নিজেকে জনমানব শূন্য একটি মরুভূমিতে আবিষ্কার করলাম। যেদিকেই তাকাই শুধু ধুধু মরুভূমি ছাড়া আর কোন কিছুই নেই। এখানে কি ভাবে এলাম তার কিছুই বুঝতে পাড়ছি না। শুধু দূর-দূরান্তে একটা করে কি যেনো বিশাল গাছ দেখা যাচ্ছে। তবে গাছগুলোও ভীষন অদ্ভুত রকমের। কোনো ডালপালা বা পাতা নেই একদম সোজা কালো কুচকুচে রঙের গাছ। আমি অবাক দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম। এখানে কিভাবে আসলাম, বা এই জায়গাটাই বা কোথায় কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আশেপাশে কাউকে দেখতেও পারছি না যে জিজ্ঞেস করবো। ভয়ে আমার শরীর শিউরে উঠছে। এদিকে নিজের দিকে একবারও খেয়াল করেনি। বারবার মনে হচ্ছে শরীরের সাথে ঠান্ডা কিছু স্পর্শ করে যাচ্ছে। এটা ভাবতেই দ্রুত নিজের শরীরের দিকে তাকালাম। তখন’ই যেন সারা শরীরে হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল ভয়ে। আমার সারা শরীরে অসংখ্য অদ্ভুত রকমের সাপের মতো দেখতে কিছু পেচিয়ে ধরে আছে। আর তারাই বারবার সারা শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।এমন ভয়ানক কিছু এর আগে কখনো দেখিনি। যতটা সম্ভব শক্তি খাটিয়ে একটা চিৎকার দিলাম। সাথে সাথে খেয়াল করলাম দূর-দূরান্তের সেই গাছগুলো যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। শরীরের জিনিসগুলোকে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলাম। কিন্তু কোনোভাবেই সেগুলো কে ছাড়াতে পারছিনা।

এভাবে কিছুটা সময় পার হতেই খেয়াল করলাম সেই অদ্ভুত রকমের জিনিস গুলো হঠাৎ করে পোশাকে পরিণত হলো। অনেক সুন্দর একটি কালো রঙের পোশাক চলে এসেছে আমার সারা শরীরে। যেটা এতক্ষণ ছিল না। বরং সেই অদ্ভুত জিনিস গুলো ছিল শরীরে। অবাক হয়ে নিজের দিকে দেখতে লাগলাম। তখনই একটি অদ্ভুত রকমের আওয়াজ ভেসে আসলো কানে। সামনে-পিছনে চারিদিকে তাকাতেই দেখলাম, যেগুলোকে এতক্ষণ আমি গাছ বলে ভেবেছিলাম। সেগুলো কোন গাছ নয়। বরং বিশাল আকৃতির ভয়ঙ্কর দেখতে অনেকগুলো সাপ। যেগুলো আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। প্রতিটি সাপের মাথায় লম্বা লম্বা দুটো করে শিং। সাথে মুখের মাঝে অসংখ্য লম্বা সরু দাঁত। যেগুলো থেকে গড়িয়ে পরছে আঠালো লালা।

এবার যেন ভয়ের শীর্ষে পৌছে গেলাম। নিজেকে ধরে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু বুঝতে পারছি না এত কিছুর পরেও কেন সেন্সলেস হচ্ছেনা আমি। মনে বারবার সাহস আনার চেষ্টা করছি সাপগুলোর থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু সাহস যেনো ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই। এদিক-ওদিক রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু সাপগুলো আমায় এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে যে কোথাও রাস্তা পাচ্ছি না। তখনই মনে মনে কিছু একটা ভাবলাম। চোখ বন্ধ করে একমনে সূরা পড়তে লাগলাম। কারণ একমাত্র আল্লাহর কালাম’ই আমায় বাঁচাতে পারে এসব থেকে।

এভাবে বেশ কিছুক্ষন সূরা পড়তেই খেয়াল করলাম এক শীতল ঠান্ডা বাতাস আমায় স্পর্শ করে গেল। আর অসম্ভব সুন্দর একটা ঘ্রাণ এসে বারবার সেই বাতাসের সাথে নাকে আছড়ে পড়তে লাগল। এবার ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে সামনে তাকালাম। মুহূর্তেই যেন অবাক হয়ে গেলাম। এখন কোন মরুভূমিতে নয় বরং অনেক সুন্দর একটি ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি। যার চারিপাশে নানান রকম ফুলের গাছে ঘেরা। ফুলগুলো থেকে অসম্ভব সুন্দর এক সুবাস ছড়িয়ে পরছে চারিদিকে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,