#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৭
নিজের বিছানায় সুয়ে আছে নীবদ্ধ।আজ সকালেই ওরা পৌঁছিয়েছে বাসায়।আয়েশা রহমান ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে কেদেকেটে অস্থির।দু ছেলে তার বিছানায় পরা।ফারুক সাহেব গম্ভীর হয়ে আছেন।তিনি আপাততো কিছুই বলেননি।রাশেদ সাহেব আর রিনা বেগম মানে শুদ্ধতার মা তারাও এসেছেন নীবদ্ধকে দেখতে।ঈশান হুইলচেয়ারে করে নীবদ্ধ’র কাছে এসে বসে আছে।ওকে পাশেই বসে আছে ঐক্য। ঈশানও খুব কেঁদেছে।সানাম ও এসেছে।শুদ্ধতা সানামের সাথে রুমের এককোনে দাঁড়িয়ে।সবাই নীবদ্ধ’র এই অবস্থা দেখে বিষ্মত।জয়কে তাদের বাড়ি পাঠানো হয়েছে।তার বাড়ির অবস্থাও না-কি সেম।নীবদ্ধ সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,
-‘ আমি ঠিক আছি।সবাই চিন্তা করা বাদ দেও।আর মা তুমি কান্না বন্ধ করো।’
আয়েশা রহমান শাড়ির অাচঁলে চোখ মুছে বলেন,
-‘ হ্যা! তোরা দুই ভাই হাত পা ভেঙে বিছানায় পরে আছিস। আর আমি তা দেখে না কেঁদে হাসবো তাই নাহ?’
রিনা বেগম তার কাধে হাত রেখে বলেন,
-‘ চিন্তা করবেন না আপা।সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আয়েশা রহমান এইবার তাকালেন শুদ্ধতার দিকে।তারপর শুদ্ধতাকে নিজের কাছে আসার জন্যে ডাকলেন।শুদ্ধতা ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো সেখানে।আয়েশা রহমান শুদ্ধতার হাত ধরে তার কাছে বসালেন।নীবদ্ধ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ওর মায়ের দিকে।ওর মা যে এখানে বসে এখন কিছু খিচুরি পাকাবে তা ভালোভাবেই জানে।আয়েশা রহমান শুদ্ধতার হাত নিজের দুহাতের ভাঁজে নিয়ে বলেন,
-‘ তুমি আমার মেয়ে শুদ্ধতা।আমার কোন মেয়ে নেই।তোমার সাথে নীবদ্ধ’র বিয়ে ঠিক হবার পর আমি তোমাকে নিজের মেয়ে মনে করি। আমি নিজেকে তোমার মা মনে করি।আমি আমার মেয়ের মা।সেই মায়ের অধিকার থেকেই বলছি। তুমি আমার ছেলেটাকে বিয়ে করার জন্যে রাজি হয়ে যাও মা।আমার কথাটা রাখো মা।আমি জানি তুমি এই বিয়েতে রাজি না।তবু আমার কথাটা রাখো মা।’
শুদ্ধতা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।এমন একটা সময়ে যে আয়েশা রহমান এইসব কথা তুলে বসবেন ভাবেনি শুদ্ধতা।নীবদ্ধ’র দিকে আঁড়চোখে তাকালো শুদ্ধতা।লোকটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।শুদ্ধতা জলদি চোখ সরিয়ে নিলো।ওর হাতের উপর রাখা আয়েশা রহমানের হাতের উপর আরেক হাত রাখলো।লম্বা শ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
-‘ আপনারা সবাই ভালোভাবেই জানেন আমি বিয়ে কেন করতে চাইনা।এমনটা না যে আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে চাই না। আমি এই জীবনে আপনার ছেলে কেন?কাউকেই বিয়ে করতে রাজি ছিলাম নাহ।বুবু মা,রা যাওয়ার পর থেকে আমার এসব প্রেম,ভালোবাসা,বিয়ে এসব থেকে মন উঠে গিয়েছিলো।তবে আজ এই মুহূর্তে আমি আপনাদের আমার সিদ্ধান্ত জানালাম আমি এই বিয়েতে রাজি।দুনিয়াতে বেঁচে থাকলে বিয়ে নামক বন্ধনে যে আমায় আবদ্ধ হতেই হবে আমি জানি।নাহলে যে এই সমাজে মেয়েদের বেঁচে থাকা কষ্ট হয়ে যাবে। তাই বিয়ে যেহেতু করবোই।আপনার ছেলেকেই করবো।তবে হ্যা এটা সত্যি আমি আপনার ছেলেকে ভালোবাসি না।আর কখনো ভালোবাসতে পারবো কিনা তাও জানি না।তবে এটা জানি আপনাদের মতো করে আমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না।আমি এখনো আপনাদের ঘরের পূত্রবধু হয়নি তাও আপনারা আমাকে নিজেদের মেয়ের মতো ভালোবাসেন।এই ভালোবাসাকে আমি পায়ে ঠেলে কিভাবে সরিয়ে নেই বলেন?আমি এতোটাও নিষ্ঠুর নাহ।আমি এই বিয়েতে রাজি আন্টি।’
নীবদ্ধ প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুদ্ধতার দিকে।মেয়েটা এতো স্পষ্টবাদি।শুদ্ধতাকে এইজন্যেই এতো ভালোবাসে নীবদ্ধ।নীবদ্ধ মনে মনে ভাবছে,বিয়েটা শুধু একবার হতে দেও।তোমার মনে নিজের জন্যে ভালোবাসা তৈরি করেই তবেই আমি ক্ষান্ত হবো।
সবাই বেশ খুশি হলো শুদ্ধতার কথায়। আয়েশা রহমান খুশিতে কেঁদে দিলেন।শুদ্ধতার কপাঁলে পরম আদরে স্নেহপূর্ণ স্পর্শ দিলেন।ফারুক এহসান শুদ্ধতার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন।আয়েশা রহমান এইবার রাশেদ সাহেব আর রিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘ আপা,ভাইজান যদি কিছু মনে না করেন আমি একটা কথা বলবো?’
-‘ নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।’
তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আয়েশা রহমান যেন ভরসা পেলেন।তাই অকপটে নিজের মনের কথাটা সবার মাঝে ব্যক্ত করলেন,
-‘ আমি শুদ্ধতা আর নীবদ্ধ’র বিয়েটা ঘরোয়াভাবে দিয়ে দিতে চাচ্ছি।কথা দিচ্ছি শুদ্ধতার পড়ালেখায় কোন গাফিলতি আমি হতে দিবো না।তার সম্পূর্ণ দায়ভার আমার।শুদ্ধতার পরিক্ষার পর নাহয় রিসিপশনের পার্টি দিবো আমরা।প্লিজ আপনারা আমার কথাটা ফেলবেন না।এটা আমার একটা অনুরোধ আপনাদের কাছে।’
ফারুক এহসান স্ত্রীর এমন কথায় বেশ অবাক হলেন।তিনি বলেন,
-‘ কি বলছো আয়েশা পাগল হয়েছো?এতো তাড়াহুড়ো করার কি আছে?’
-‘ আপনি চুপ থাকেন।আমার মনের মধ্যে কি চলছে তা আপনি কোনদিন বুঝতে পারবেন না।আমি যা করছি খুব ভেবেচিন্তেই করছি।’
রিনা বেগম স্বামির দিকে তাকালেন।মূলত তিনি রাশেদ সাহেবের জবাবের জন্যেই অপেক্ষা করছেন।রাশেদ সাহেব হেসে মাথা নাড়ালেন।তা দেখে উনার ঠোঁটেও হাসির রেখা দেখা দিলো।রাশেদ সাহেব তো এটাই চাইছিলেন।শুদ্ধতার শুধু বিয়েতে একবার মত দেওয়া।আর তা তার মেয়ে দিয়ে দিয়েছে।এখন যতো দ্রুত বিয়েটা দিয়ে দিতে পারেন তার জন্যেই ভালো।নাহলে কখন না জানি এই মেয়ে নিজের মত বদলে ফেলে।শুদ্ধতা অবশ্য এটা করবে না।তাও তো বলা যায় না।তাই তিনি বলে উঠেন,
-‘ ভাবি আপনি যা চাইবেন তাই হবে।শুদ্ধতা আর নীবদ্ধ’র বিয়েটা আমরা ঘরোয়াভাবেই দিবো।আমরা রাজি।’
ঈশান খুশি হইহই করে উঠলো।তার পায়ে এখনো ব্যাথা নাহলে সে এতোক্ষনে সারা ঘরে খুশিতে নাচানাচি করতো।শুদ্ধতা শুধু তাকিয়ে রয়েছে সবার দিকে। তার শুধু বিয়েতে একবার হ্যা বলাতে যে তারা সাথে সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্যে এইভাবে উঠে পড়ে লেগে যাবে ভাবেনি ও।তবে আর কিছু করার নেই সবাই বেশ খুশি।আর সবার মুখে হাসি দেখে শুদ্ধতাও খুশি।
একে একে সবাই চলে গেলো রুম থেকে।বড়রা বিয়ের ব্যাপারে আরো কথা বার্তা বলবেন। ঈশানকে একজন সার্ভেন্ট ওর রুমে দিয়ে আসলো।ঐক্য গেলো সানামকে হোস্টেলে দিয়ে আসার জন্যে। শুদ্ধতাও যেতে নিবে তার আগেই নীবদ্ধ ওকে ডেকে উঠলো,
-‘ শুদ্ধতা? যাবেন না।একটু এদিকে আসুন।’
শুদ্ধতা আর যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো না।উলটো ঘুরে নীবদ্ধ’র বিছানার পাশে এসে দাড়ালো।নীবদ্ধ শুদ্ধতাকে চোখের ইশারায় ওর পাশে বসার জন্যে ইশারা দিলো।শুদ্ধতা তাই করলো।নীবদ্ধ শুদ্ধতার চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
-‘ কি সমস্যা আপনার?’
ভ্রু-কুচকালো শুদ্ধতা।বলে,
-‘ আমার আবার কি হবে?’
-‘ একদম মিথ্যে বলার চেষ্টা করবেন না।আমি জানি আপনি কিছু নিয়ে অনেক চিন্তিত।আর সেটা কি তা শুধু জানতে চাচ্ছি আমি।’
শুদ্ধতা অবাক হলো না একটুও।ও আগে থেকেই জানে এই লোকটার কাছ থেকে শুদ্ধতা কিছুই লুকাতে পারে না।মুখে না বললেও কিভাবে যেন লোকটা শুদ্ধতার মনের অবস্থা অকপটে বুঝে ফেলে।এটা আজ নতুন নয়।বিগত একবছর ধরে এটাই দেখে আসছে ও।তাই শুদ্ধতা আর মিথ্যে বলার ইচ্ছা পোষন করলো না।সরাসরি সত্যিটাই বলে দিলো,
-‘ দুদিন আগে।কিছু কারনে সানাম হোস্টেলে চলে গিয়েছিলো।আর সেটা আমায় বলেনি।ওর ফোনটাও বন্ধ ছিলো।তাই ওকে আমি ভার্সিটির সবজায়গায় খুজছিলাম।ওকে খুজতে খুজতে হঠাৎ ভার্সিটির পিছনে যেখানে ঝোপঝাড়ের মতো আছে সেখানে চলে গিয়েছিলাম।সেখানে গিয়ে যা দেখলাম।তা দেখে আমি নিজেও খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম।ওখানে আমি দুটো মেয়ের কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম।পরে যখন ধ্যান দিয়ে সবটা শুনি তখন বুঝতে পারলাম মেয়ে দুটো ড্রা,গ এডিক্টেড।টাকা না থাকায় তারা ড্রা,গস কিনতে পারছিলো না।আর তারা ড্রা,গস না সেবন করতে পেরে কান্নাকাটি করছিলো।আমি সাথে সাথে ভিডিও করে নেই সব।ওয়েট আপনাকে দেখাচ্ছি ভিডিওটা।’
শুদ্ধতা নীবদ্ধকে ভিডিওটা অন করে দেখালো।ভিডিওটা দেখতে দেখতে নীবদ্ধ’র চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।ভিডিওটা শেষ হতেই নীবদ্ধ বলল,
-‘ আপনি নিজেও জানেন না শুদ্ধতা। আপনি আমার কাজটা কতোটা সহজ করে দিলেন।মূলত আমি এই বিষয়েই তদন্ত করছিলাম।আমার কাছে এইসব বিষয়ে কমপ্লেইন এসেছিলো।আপনাদের ওখানে আমার লোকদের তথ্য জোগাড় করতে পাঠিয়েছিলাম।আর ওই কু,কুরের বাচ্চা গুলো হৃদয়কে হত্যা করে ফেলে।এইবার যাবে কোথায়? ধরা তো ওদের পরতেই হবে।আপনি এই ভিডিওটা আমাকে সেন্ড করে দিয়েন শুদ্ধতা।এটা অনেক বড় একটা হাতিয়ার ক্রি,মিনালদের কাছ পর্যন্ত পৌছানোর।’
শুদ্ধতা মনোযোগ দিয়ে শুনলো সবটা।তারপর বলে উঠলো,
-‘ তবে আমি আপনাকে আরেকটা তথ্য দিতে পারি।’
-‘ কি তথ্য?’
-‘ ভিডিওতে থাকা লোকটাকে আমি চিনি।’
নীবদ্ধ’র ধীর কন্ঠ,
-‘ কে এই লোক শুদ্ধতা?’
শুদ্ধতা চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসলো।চেহারায় ওর স্পষ্ট ঘৃনার ছাপ ভেসে উঠলো।চোখে মুখে যেন প্র,তিশোধের আগুন জ্বলছে।নীবদ্ধ শুদ্ধতার এতো রাগ দেখে অবাক হলো।কে এই ভিডিও’র লোক যার প্রতি শুদ্ধতার এতো ঘৃনা।শুদ্ধতা নীবদ্ধকে আর অপেক্ষা করালো না।দাঁতেদাঁত চেপে বলে উঠলো,
-‘ ওর নাম জাহিদ।আমার বুবুর স্বামি।আর আরেকটা পরিচয় আমার বুবুর হ,ত্যাকারি।’
#চলবে____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।