রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে পর্ব-২৬

0
589

#রাখি_আগলে_তোমায়_অনুরাগে💕
#written_by_Liza
#২৬তম_পর্ব

মায়া কাটিয়ে সরে যাবো।আপনি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো। দোয়া রইলো মিস্টার আরাশ, আপনাদের জন্য।”

ইন্সিয়া চোখ মুছে অরীনের রুমে চলে যায়, আরাশ ইন্সিয়ার পরিবর্তনে হেসে দেয় আর বলে
“নিজেই এসে এই ক্রিমিনালকে ভালোবাসি বলবেন। এর আগ পর্যন্ত ধরা দিচ্ছে না আরাশ আপনার কাছে”

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই যে যার রুমে চলে এসেছে।আকাশ বেশ ভারী হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বর্ষন নামবে জোড়ালো ভাবে। চারদিকে বাতাসে দোল খাচ্ছে সবকিছু। জানালার গ্রীল বেয়ে লতাপাতা ছুঁইয়ে পড়ছে। দেখতে অন্যরকম সুন্দর। ইন্সিয়া রুমে এসে বিছানায় বসে আছে তার মা-বাবার কথা ভাবছে

“কি করছে বাবা-মা? কেমন আছে তারা?তাদের কোনো অঘটন ঘটলো না তো?”

অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ইন্সিয়ার মনে, ঝড়ঝড় করে বর্ষন আরম্ভ হলো। বাতাসে পুরো রুম ঠান্ডা হয়ে আছে। আশেপাশে গাছগাছালির কারণে মনোরম পরিবেশে পরিণত হয়েছে। ইন্সিয়া বুঝতে পেরেছে একটু পর আবার কারেন্ট চলে যাবে,তাই ইন্সিয়া রাজুকে বলে মোমবাতি আনিয়ে রেখেছে রুমে। ঠিক যেই ভাবা সেই কাজ, কারেন্ট চলে গিয়েছে।

ইন্সিয়া জানতো এমন কিছুই হবে কারণ আশেপাশে আর কোনো বিল্ডিং নেই, সব গাছপালায় ভরা মাঠ। সুনসান বাড়ি, এখানে কারেন্টের সমস্যা করবে ইন্সিয়া ভেবেই নিয়েছে আগে। ইন্সিয়া মোমবাতি জালিয়ে টেবিলের উপর রেখে দেয়। মোমবাতি বাতাসের ঝলকানিতে নিভু নিভু করে জ্বলছে।

ইন্সিয়া জানালার কাচ আটকে দেয় যাতে পানি ঘরের ভেতরে প্রবেশ না করে, বৃষ্টির প্রতিটি কাঁচের জানালা ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে।

ঘড়ির কাটা বারোটা পেরোতেই ঢং ঢং করে বাজতে লাগলো। ভৌতিক মুহুর্ত মনে হলেও ইন্সিয়ার মনে আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে সবুজ স্বচ্ছ পরিবেশ দেখে। এ যেনো চোখের শান্তি। ইন্সিয়া ভয় কাটিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে মনোরম পরিবেশ উপভোগ করছে।

ইন্সিয়ার চোখ পড়ে আরাশের বারান্দার দিকে, আরাশ সাদা পাতলা শার্ট পড়ে বারান্দায় দাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে। আরাশের চুল গুলো ভিজে গিয়েছে প্রায়। আরাশের গলা বেয়ে চুলের পানি পরছে,
আরাশকে দেখে ইন্সিয়া ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। আরাশের প্রতি এত তীব্র ভালো লাগা মায়া জন্মাবে ইন্সিয়া কখনো ভাবতে পারে নি। আরাশকে দেখলেই ইন্সিয়ার কষ্ট হয়। ইন্সিয়া জানে আরাশ শুধু রীধীর। ইন্সিয়া চাইনা অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজে ভালো থাকতে।

ইন্সিয়া আরাশকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আরাশ যেনো ততই তার মনে ঝেঁকে বসছে। ইন্সিয়া মনে মনে বলছে
“আপনাকে ভুলে যাওয়ার রাস্তা আমার কাছে হয়তো নেই কিন্তু আপনার কাছ থেকে দুরে যাওয়ার রাস্তা আমার ঠিকই আছে। আপনাকে দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। আমি আপনাকে অন্যের হতে দেখতে পারবো না। তার জন্য আমার চলে যেতে হবে অনেক দুরে। আমি আপনার সামনে আসতে চাই না”

হঠাৎ জোরে জোরে বাজ পড়তে লাগলো। ইন্সিয়ার খুব ভয় হচ্ছে। ইন্সিয়া কোনোভাবে নিজেকে সামলে বেলকনির দরজা আটকে দেয়। ইন্সিয়া প্রায় ভিজে গিয়েছে। ইন্সিয়া চেঞ্জ করে বিছানায় বসে চুল মুছতে লাগলো। মোমবাতি প্রায় নিভে যাওয়ার উপক্রম, শেষের দিকে মোমবাতি। ইন্সিয়ার এবার অন্ধকারে কাটাতে হবে ভাবতেই ইন্সিয়া ভয়ে চুপসে যায়। ইন্সিয়া ভাবছে
“এত রাতে অরীন আপুকে ডাকা ঠিক হবে না। অরীন আপুর ঘুমের ব্যঘাত ঘটলে হেলথের ক্ষতি হবে। থাক আল্লাহ ভরসা। রুমের দরজা লক করে ঘুমিয়ে যাবো”

ইন্সিয়া চুল মুছে তোয়ালে চেয়ারের উপর বিলিয়ে দেয়, রুমের দরজা লক করতে যাবে অমনি কে যেনো দরজায় হাত দিয়ে দরজা লক করতে বাঁধা দেয়। ইন্সিয়া ভয়ে ঢোক গিলে দু পা পিছিয়ে যায়। মোমবাতি নিভে গিয়েছে। পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ইন্সিয়ার রুমে কে যেনো প্রবেশ করে টেবিলের উপর মোমবাতি জালিয়ে দেয়, ইন্সিয়া খেয়াল করে দেখে ওটা মিস্টার আরাশ।

আরাশের হাতে দুটো মগে গরম গরম ধোঁয়া উঠা কফি, আরাশ একটা কফির মগ ইন্সিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়, ইন্সিয়া নিতে না চাইলে ইশারা দিয়ে নিতে বলে আরাশ। ইন্সিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও কফির মগ হাতে নেয়, আরাশ টেবিলের পাশে চেয়ারটা টেনে বসে ইন্সিয়াকে বলে “মোমবাতি শেষ এটা বলেন নি কেন?”

এমনি, ঘুমিয়ে যাবো তাই মোমবাতির প্রয়োজন ছিলো না (ইন্সিয়া)

ওহ-হো আই সি.. আমি ভাবলাম বোর হচ্ছেন, তাই কফি বানিয়ে নিয়ে আসলাম আপনার জন্য। আমি আবার খুব ভালো কফি বানাতে পারি। (আরাশ)

হুম ধন্যবাদ। (ইন্সিয়া)

“কিছু কী হয়েছে? না মানে মনমরা হয়ে আছেন। আন্টি আংকেলের জন্য খুব খারাপ লাগছে? চিন্তা করবেন না কাল ঠিক আন্টি আংকেলের খোঁজ বের করে নিবো”, আরাশ কফিতে চুমুক দিয়ে কথাগুলো বলছে ইন্সিয়াকে। ইন্সিয়া অন্যমনস্ক হয়ে আছে। আরাশ সবটা বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান ধরে আছে। আরাশ চাই না এত সহজে ইন্সিয়াকে পেতে।

বাহিরে জোরালো বর্ষন,দু’জন নিরব হয়ে আছে। ইন্সিয়া নিরবতা ভেঙ্গে ভারী গলায় বলে উঠে ” আমি বাড়ি কবে যাবো।”

আরাশ ইন্সিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, কি বলবে বুঝতে পারছে না। আরাশ নড়েচড়ে বসে ইন্সিয়ার দিকে তাক করে আছে এক দৃষ্টিতে, ইন্সিয়ার চোখগুলো পানিতে টলমল করছে, পানি ঝড়তে গিয়েও ঝড়ছে না আটকে আছে অজানা অভিমানে।
আরাশের বড্ড খারাপ লাগছে ইন্সিয়াকে এই অবস্তায় দেখে, আরাশ মনে মনে বলছে
“কত চঞ্চল মেয়ে ছিলেন আপনি,আপনার রাগের তেজ ছিলো ঝাঁঝালো, যার প্রেমে আমি পরেছিলাম। আপনার উৎকন্ঠা আগ্রহ দেখে নিজেকে আবার সতেজ করতে পেরেছিলাম।আর আজ সেই আপনি কোথায়। এতটা নিরব কি করে হলেন ইন্সিয়া?আমি তো এই ইন্সিয়াকে চাইনি। তবে কেন এত বদলে গেলেন? কিসের এত দুঃখ যেটা আপনাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে।”

ইন্সিয়া চোখের পানি আড়াল করে মাথা নিচু করে আছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা যেনো ইন্সিয়ার হয়ে ঝড়ছে। ইন্সিয়ার বোবা কান্না প্রকৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজের মত করে। আরাশ নিরবতা ভেঙ্গে ইন্সিয়াকে জবাব দেয়
“আমি কি আপনাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ইন্সিয়া? যদি এমন কিছু হয় তবে আমি দুঃখিত।আমি কষ্ট দিতে চাই নি। জানি না কি করে কষ্ট পেলেন এতটা। তবুও আমি দুঃখিত। আমি কাল বেরোবো খুঁজতে। যদি পেয়ে যায় বাড়ি নিয়ে আসবো। গার্ডদের বলে রেখেছি,ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাবো। এরপর আপনার ছুটি।আপনি মুক্ত একেবারে। আর আমাকে সহ্য করতে হবে না”

ইন্সিয়া মাথা উঁচু করে আরাশে দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে, কিছু বলার নেয় ইন্সিয়ার। কোন অধিকারে ইন্সিয়া বলবে “আমি থাকতে চাই। আমার মুক্তি চাই না।”

এই অধিকার টুকু ইন্সিয়ার নেয়,ইন্সিয়া জানে রীধী আর আরাশ একে অপরকে ভালোবাসে, ইন্সিয়া তৃতীয় ব্যক্তি হতে চায় না কারোর লাইফে। ইন্সিয়া মৃদু হেসে আরাশকে বলে “ধন্যবাদ। আপনার উপকার আমি কখনো ভুলবো না”

আরাশের কষ্ট হচ্ছে খুব,আরাশ নিজেকে সামলে নেয়।
রাত দেড়টা মোমবাতি নিভু নিভু অবস্তা, আরাশ ইন্সিয়াকে বলে “মিস ইন্সু। ঘুমিয়ে পড়ুন। চলে যাচ্ছি। অন্ধকারে ভয় লাগবে না তো আবার?”

ইন্সিয়া মনে মনে ভয়ে চুপসে গেলেও আরাশকে বুঝতে দেয় না, এভাবে একটা রুমে এত রাত অব্দী একটা ছেলে মেয়ে একসাথে এতক্ষণ থাকাটা বেশ বেমানান। তাই ইন্সিয়া সোজা আরাশকে বলে
“না মিস্টার আরাশ, আমার কোনো ভয় লাগে না। আপনি আসতে পারেন এবার। আমি ঘুমাবো”

আরাশ ইন্সিয়াকে বিদায় দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে, ইন্সিয়া রুমের দরজা লক করে দিয়ে কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে,

আরাশ রুমে এসে শুয়ে পড়ে, আরাশের অস্বস্তি লাগছে খুব, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আরাশ মনে মনে বলছে
“আমি যদি সত্যিটা বলে দিতাম তবে ইন্সু এত কষ্ট পেতো না। আমি তো তাকেই চাই।তাকেই ভালোবাসি। ফ্যামিলির চিন্তা এদিকে আমাকে হারানোর ভয় তাকে ঘিরে ধরেছে। আমি বুঝতে পারছি সব। কিন্তু কি করবো? আমার ও যে ইন্সু আপনার সাথে গেইম খেলতে ভালো লাগছে না। এত সহজে আপনার কাছে ধরা দিলে আপনি হয়তো আমায় ছুড়ে ফেলে দিবেন।মর্ম বুঝবেন না। এটা তো আমি হতে দিতে পারিনা। আপনার বয়স অনেক কম ইন্সু এই আবেগের বয়সে ভালোবাসার খোঁজ করা নিতান্ত বোকামি। আগে ভালোবাসা কি বুঝুন। এই মোহ কে ভালোবাসা বলে না ইন্সু। আমি আপনাকে রিয়ালাইজ করাতে চাই সবটা। যেদিন বুঝবেন মোহ আর ভালোবাসা দুটোই আলাদা, সেদিন এই আরাশকে আপনার কাছে পাবেন। এর আগে আপনি কেঁদে খুন হলেও আরাশ ধরা দেবে না।”

আরাশ ইন্সিয়াকে মন থেকে কাছে চাইলেও ইন্সিয়ার কাছে সহজে ধরা দিতে ইচ্ছুক না। কারণ আরাশ জানে ইন্সিয়ার বয়সটাই আবেগের। এই আবেগের বয়সে অনেক জনকে ভালো লাগতেই পারে। এই ভালো লাগাকে ভালোবাসা ভেবে নেওয়াটা ভুল। আরাশ চায় না ইন্সিয়াকে পেয়ে আবার হারাতে৷ আরাশ অতীতের ক্ষত খুব কষ্টে সেরে উঠতে পেরেছে, সে চাই না এই আবেগের মোহতে নিজেকে জড়িয়ে আবারো কষ্ট পেতে। তাই আরাশ অনিচ্ছাস্বত্তেও ইন্সিয়াকে নিজের করছে না। আরাশ দেখতে চায় ইন্সিয়ার ভালোবাসার গভীরতা। আরাশ জানতে চায় ইন্সিয়ার অনুভূতিগুলো ভালোবাসায় আবদ্ধ নাকি মোহ। আরাশের এখনো অনেক জানা বাকি ইন্সিয়ার সম্পর্কে।

আরাশের মাথায় বিভিন্ন ছক কষে রেখেছে আরাশ। সেই ছক অনুযায়ী আরাশ এগোচ্ছে, আরাশ কপালে হাত দিয়ে শুয়ে শুয়ে মনে মনে বলছে “যেদিন আপনি আমার নেওয়া পরিক্ষায় সাক্সেস হবেন। সেদিন আমি নিজেই আপনাকে আপন করে নেবো।”

চলবে….