রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-১৭+১৮

0
5

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী জামী

আশফির কথা শুনে পুলক অস্থির চিত্তে ওর বন্ধুমহলে ফোন করতে শুরু করল। কিন্তু কোথাও নেই শাহেদ। বাধ্য হয়ে পুলক ওকে খুঁজতে বেড়িয়ে গেল।

কয়েক জায়গায় খুঁজেও শাহেদকে না পেয়ে পুলক ঘাবড়ে যায়। ও নির্জন রাস্তায় বাইক দাঁড় করায়। চিন্তা করতে থাকল কোথায় যেতে পারে শাহেদ। ওর কি কোন কারনে মন খারাপ? নানান চিন্তার মাঝে উঠে দাঁড়ায় পুলক। শাহেদ কোথায় যেতে পারে সেটা বুঝে গেছে।

পাঁচ মিনিট পর কবরস্থানের কাছে এসে বাইক থামিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে পুলক। ও জানে শাহেদ আশেপাশেই আছে। ওর কোন কারনেই মন খারাপ হলে কবরস্থানে এসে বাবা-মা’ র কবরের পাশে এসে বসে থাকে। এখন যেহেতু রাত সেহেতু কবরস্থানের গেইট বন্ধ আছে। তাই শাহেদ হয়ত ভেতরেও যায়নি। কবরস্থানের প্রাচীরের আশেপাশেই আছে। বাইক থেকে নেমে পুলক হাঁটতে শুরু করল। ফুপা-ফুপুর কবর যেদিকে আছে সেদিকেই হাঁটতে শুরু করল। মিনিট খানেক পরই শাহেদকে দেখতে পেল। ছেলেটা প্রাচির ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা-মা’ র কবরের দিকে।

পুলক ধীর পায়ে এগিয়ে যায় শাহেদের কাছে। হাত রাখল ছেলেটার কাঁধে।

” তুই এত রাতে এখানে কেন? ফুপা-ফুপুর জন্য খারাপ লাগলে দিনে আসতি, রাতে কেন? এই তোর কি ভয় লাগছেনা। ”

আচমকা পুলকের কথা শুনেও একটুও চমকায়না শাহেদ। যেন ও জানত পুলক এখানে আসবে। শাহেদ পুলকের কথা শুনেও চুপচাপ থাকল। তবে পুলকের অজান্তে চোখের পানি মুছে নিল। শাহেদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বলল পুলক।

” তোর কি কাণ্ডজ্ঞান কিছুই নেই, শাহেদ। বাসায় নতুন বউ রেখে কেউ এত রাতে কবরস্থানে এসে বসে থাকে? ওদিকে মেয়েটা চিন্তা করছে তোর জন্য। আশফিকে ফোন করে জানিয়েছে তুই বাসায় নেই। ”

” ভাই, আমি একটু পরই বাসায় যেতাম। তুমি কষ্ট করে আসতে গেলে কেন? ভাবিকে একা রেখে তুমিও এখানে এসে ঠিক করোনি। এবার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ” শাহেদ মলিন হেসে বলল।

শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে খটকা লাগলো পুলকের। ওর মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নেই। দুই দিন থেকে শাহেদ যেন একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। এই দুইদিন ও শাহেদকে হাসতে দেখেনি।

” শাহেদ, তুই আমাকে সত্যি করে বল, কি হয়েছে তোর? তুই আগেও ফুপা-ফুপু’র কাছে এসেছিস, কিন্তু সব সময়ই দিনে এসেছিস। আজকে রাতে আসলি কেন? তিয়াসা আর তোর মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তো? ”

পুলকের কথা শুনে চমকে উঠল শাহেদ। ও যে চরম বোকামি করেছে, এটা বেশ বুঝতে পারছে ও। নিজের বোকামি ঢাকতে শুকনো হাসল সে। যা-ই হয়ে যাক না কেন ওদের দাম্পত্য জীবনের গোপনীয়তা কারও সামনে উন্মোচন করা যাবেনা। তাছাড়া পুলক যদি এসব জানে তবে বিষয়টা ও সহজভাবে নিবেনা। এর প্রভাব শুধু তিয়াসার পরিবার নয় আশফির ওপরও পরতে পারে।

” ভাই, তুমি এত টেনশন করোনাতো। গত কয়েকদিন থেকেই বারবার আব্বু-আম্মুর কথা মনে হচ্ছে। কিছুতেই নিজের মনকে বুঝ দিতে পারছিনা। এই যে দেখ, বিয়ে করলাম অথচ আব্বু-আম্মুকে পাশে পেলামনা। মামীকে আম্মুর দ্বায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে । আমার সাথেই কেন এমন হলো বলতে পার ভাই? কেন অকালে আব্বু-আম্মুকে হারালাম? কেন প্রতিনিয়ত আব্বু-আম্মুকে মনে করে আমার কাঁদতে হয়? ” কথা বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে উঠল শাহেদ। আজ সত্যি ও বাবা-মা’ র জন্য কষ্ট পাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তিয়াসা ওকে মেনে নেবেনা এটা ও বুঝতে পারছে। কিন্তু এই বিষয়টা সবাইকে জানাবে কিভাবে? আর সবাই জানলে তখন কি হবে?

শাহেদের কান্না দেখে ওকে বুকে টেনে নিল পুলক। শান্তনা দিচ্ছে তার এতিম ভাইকে।

” কাঁদছিস কেন পাগল ছেলে! ফুপা-ফুপু নেইতো কি হয়েছে! আমরা আছি তো? আম্মু-আব্বু তোকে কত ভালোবাসে সেটা তুই জানিসনা? তুই যে রাত-বিরেতে বাইরে এসেছিস, এটা যদি আম্মু শোনে তাহলে কষ্ট পাবেনা বল? তোর মত এমন অনেকেই আছে যাদের বাবা-মা নেই। তাই বলে কি তাদের জীবন থমকে গেছে? তারা কি নিজেদের মত জীবনকে এগিয়ে নিচ্ছেনা? তুই তো আমার মত গবেট নয়। পড়াশোনা শেষ করেছিস, জবও হয়ে গেছে। ফরজ কাজও সেড়ে নিয়েছিস। এবার মন দিয়ে সংসার কর। মনে রাখিস, সংসারের সুখ-দুঃখের চাবিকাঠি তোর কাছে। তুই চাইলেই তিয়াসাকে সুখী করতে পারবি। এই যে এত রাতে বাহিরে এসেছিস, এটা কি তিয়াসার ভালো লাগবে? তোর ওপর ওর বিরূপ ধারণা জন্মাতে কতক্ষণ? ”

” সরি ভাই, আর এমন বোকামি করবনা। চল আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তুমিও বাসায় যাও। নয়তো দেখবে ভাবী তোমার মাথার একটা চুলও রাখবেনা। বোকা ভাবী আমার তোমার ওপর ভালোই ফাঁপর নেয়। আর আমার ভাইও কেমন চুপচাপ সহ্য করে। ” শাহেদের কথা শুনে পুলক মাথা চুলকে হাঁসল। শাহেদ মন্দ কিছু বলেনি।

শাহেদকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে পুলক নিজের বাসায় চলে যায়।

***

শাহেদ রুমে ঢুকে দেখল তিয়াসা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শাহেদকে দেখে তিয়াসা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানায় যায়। বিছানার একপাশে গিয়ে গুটুসুটি মেরে শুয়ে পরল।

শাহেদ কাবার্ড থেকে টি-শার্ট, ট্রাউজার বের করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে তিয়াসার উদ্দেশ্যে বলল,

” দরজা লাগিয়ে নিন। আমি আজ থেকে স্টাডি রুমে থাকব। ”

শাহেদের কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে বসল তিয়াসা।

” কেন? ”

” ভুল যখন করেছি, তার মাশুলতো দিতে হবে। আপনি নিশ্চিন্তে এই রুমে থাকতে পারেন। আমার দ্বারা আপনার কোন ক্ষতি হবেনা। ”

শাহেদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলে তিয়াসা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। এরপর উঠে দরজা বন্ধ করল।

বিছানায় বসে চিন্তা করছে ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে? কি হতে চলেছে দু’জনের সম্পর্কের সমীকরণ? আর কিছু ভাবতে পারছেনা তিয়াসা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

***

পুলক রুমে এসে দেখল আশফি বিছানার কিনারায় বসে ঘুমে ঢুলছে। ও দরজা বন্ধ করে পা টিপে এগিয়ে যায় আশফির কাছে। আশফির মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা বসে বসেই ঘুমাচ্ছে। ও হেসে ঘুমন্ত আশফির মুখে ফুঁ দেয়।

হঠাৎ মুখে বাতাস লাগায় চমকে উঠল আশফি।

” জানালা কে খুলল রে? বাতাস এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ” ওর খুব কাছে পুলককে ঝুঁকে থাকতে দেখে ভিষণ চমকায় আশফি। চোখের পলকে বুকে ফুঁ দিয়ে বলে উঠল,

” এভাবে ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমি ভয় পেয়েছি। বদ লোক মানুষকে ভয় পাইয়ে মজা নেয়! ”

” আমি যদি বদ হই, তাহলে দুনিয়ায় ভালো কেউ নেই বুঝলে, বউ? চোখের সামনে জলজ্যান্ত বউ হেঁটে বেড়াচ্ছে, কাপড় এলোমেলো করে ঘুমাচ্ছে, অথচ সেসব দেখেও আমি নিউট্রাল আছি। এতকিছুর পরও আমাকে বদ লোক মনে হয় তোমার! কিছু না করে বদ হওয়ার থেকে কিছু করে বদ হওয়া কি ভালো নয়? কি স্টার্ট করব বদ লোক হওয়ার প্রথম মিশন? ”

পুলকের কথা শুনে ভয় পেয়ে বিছানার একপাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরল আশফি। মাঝখানে রাখল কোলবালিশ।

” খবরদার এই বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করবেননা। ক্রস করেছেন তো দাঁত হারিয়েছেন। ”

পুলক প্রায় সাথে সাথেই কোলবালিশ ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে।

” অসুবিধা নেই। হারাকনা দুই-একটা দাঁত। মাংস চিবিয়ে খেতে পারবনা তো কি হয়েছে! তুমি নাহয় চিবিয়েই দিবে। আর আমি খাব। তবুও আমি বউকে না জড়িয়ে ঘুমাতে পারবনা। দশটা না পাঁচটা না, একটামাত্র বউ আমার। এত সাধের বউকে দূরে রাখতে যাব কোন দুঃখে! আর এখন থেকেই তোমাকে বুঝে নিতে হবে আমার সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। নয়তো পরে বলবে তোমার জামাই কিছুই করতে জানেনা। এটা মানবোনা।”

পুলক এক টানে আশফিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পরল। আশফি হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারলনা পুলকের শক্ত বাঁধন থেকে। বাধ্য হয়ে আশফি মটকা মেরে শুয়ে থাকল পুলকের বুকে। এবং এক সময় ঘুমিয়েও পরল।

***

মল্লিকা মির্জা তিয়াসাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন। তিয়াসার সাথে শাহেদের দাদুসহ ঐ বাসার মেইডরা সকলেই এসেছে। আগামীকাল ওদের রিসিপশন পার্টি এখানেই হবে। শাহেদ আসবে পরেে। ও সকাল হতেই বাহিরে চলে গেছে। নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেছে।

তিয়াসাকে দেখে দৌড়ে ওর দিকে যায় আশফি। খুশিতে চিৎকার করে উঠল। মল্লিকা মির্জা আশফির কর্মকাণ্ডে হাসলেন।

” তিয়ু রে, কেমন আছিস বইন? কতদিন পর তোকে দেখলাম! কেমন আছিস তুই? ”

” আস্তে আশফি, আস্তে। এটা আমাদের গ্রামের বাড়ি নয়। ”

” এটা তোমাদের গ্রামের বাড়ি নয় ঠিক আছে। ঐটাতো তোমাদের বাবার বাড়ি। আর এটা তোমাদের নিজের বাড়ি। তাই এখানে যখন যা করতে মন চাইবে সেটাই করবে। তিয়াসা তুমি লজ্জা পাবেনা কিন্তু। মনে রেখ, এটা শাহানারও বাবার বাড়ি। সে হিসেবে এই বাড়িতে শাহেদের পুরো অধিকার আছে। আর শাহেদের বউ হিসেবে তোমারও অধিকার আছে। ” মল্লিকা মির্জা হাসিমুখে বললেন।

পুষ্পিতা দৌড়ে এসে তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে বকবকানি শুরু করল। এরপর এই বাসায় শাহেদের নির্ধারিত রুমে নিয়ে গেল।

সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই পুলকের তিন মামা, মামী, মামাতো ভাইবোন, খালা, খালু খালাতো ভাইবোনেরা সবাই হাজির হয়েছে মির্জামহলে। এছাড়াও শাহেদর আত্নীয় স্বজনসহ আতিক মির্জার দূরের, কাছের সকল আত্নীয় স্বজনরা এসেছেন। অতিথিদের জন্য তিনি নিজেদের বন্ধ তিনটা ফ্ল্যাট খুলে পরিষ্কার করে রেখেছেন। এতগুলো মেহমানদের ঘুমানোর জায়গা এই বাসায় হবেনা। তারা সারাদিন মির্জামহলে আনন্দ করে রাতে ঘুমাবে ফ্ল্যাটে গিয়ে।

চলবে।

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী জামী

” ভাবীরা এবার বল, তোমাদের ফার্স্ট নাইট কেমন কেটেছে? সেই রাতের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? ” পুলকের কাজিন নিলাশা জিজ্ঞেস করল আশফি তিয়াসাকে। পুরো কাজিনমহল ওদের ঘিরে রেখেছে। উদগ্রীব হয়ে আছে ফার্স্ট নাইটের গল্প শোনার জন্য।

ওদের এমন আক্রমনে দিশেহারা তিয়াসা। তবে আশফির কোন হেলদোল নেই। যেন ও এমন প্রশ্নই আশা করছিল। তিয়াসা আশফির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছে, এই মেয়ে আবার কি বলতে কি বলে বসে।

” বলনা তোমরা কি করেছে ফার্স্ট নাইটের? প্লিজ, ভাবী, প্লিজ। ” অন্যরাও নিলাশার সাথে তাল মেলালো।

” কি আর করব! ঘুমিয়েছি। তোমাদের বদ ভাইয়া রুমে আসতে দেরি করছিল, সেই ফাঁকে আমি ঘুমিয়ে গেছি। ” সবার আগ্রহে এক বালতি পানি ঢেলে বলল আশফি।

” কিহ্! আর কিছুই করোনি? ভাইয়া এমনিতেই ছেড়ে দিয়েছে? ঘুম থেকে ডেকে তোলেনি? ” বিস্ময়ে হতবাক মেয়েরা আবারও একসাথে জিজ্ঞেস করল।

” হুম ডেকেছিল। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙ্গানো এত সহজ নয়। আবারও ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ” মেয়েদের আবারও নিরাশ করল আশফি।

” ভাইয়া তোমাকে কিছুই বলেনি? তুমি ঘুমিয়েছ আর ভাইয়া মেনে নিয়েছে! মানতে পারলামনা। ” নিলাশা হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” বলেনি কিন্তু বলতে চেয়েছিল। তখন তাকে বলেছি, ডিভানে শুতে। তবুও যেন আমাকে বিরক্ত না করে। ”

” এ্যাহ! তুমি সত্যি বলছ ভাবী? ভাইয়া এরপরও চুপচাপ ছিল? ” এবার পুষ্পিতা জিজ্ঞেস করল।

” তখনকার মত চুপচাপ ছিল। কিন্তু সকালে ডিভান সরিয়ে ফেলেছে। ভেবে দেখ তোমার ভাইয়া কোন লেবেলের বদ। ”

” জিও ভাইয়া, যুগ যুগ জিও। এবার বল সেকেন্ড নাইটে কি করেছ? তখনতো ডিভান ছিলনা। ” যাই হয়ে যাক না কেন নিলাশা শুনবেই।

” সিম্পল, ঘুমিয়েছি। ”

” ভাইয়া কিছুই করেনি? ” মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করল নিলাশা।

” সুযোগ পেলে আবার ছেড়ে দেয় নাকি। তোমার ভাইয়া একটা বদের হাড্ডি। ”

আশফি ওদের বোঝাতে চাইল পুলক ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। কিন্তু মেয়েরা অন্যটা বুঝেছে। ওরা হৈ হৈ করে উঠল।

” যাক, বিড়াল মে’রে’ছে তাহলে। তবুও ভালো ভাইয়া ফার্স্ট নাইটের কাজ সেকেন্ড নাইটে করেছে। ” পুষ্পিতা নিলাশার উদ্দেশ্যে চোখ টিপল।

” বিড়াল আসল কোথায় থেকে! এই বাসায় বিড়াল দেখলামনাতো এখন পর্যন্ত। আর বিড়াল থাকলেই বা মা’র’তে হবে কেন? আর আমি কখনোই তাকে বিড়াল মারতে দেবনা। ” আশফি উল্টো জিজ্ঞেস করল পুষ্পিতাকে।

আশফির এহেন কথায় কাজিন মহল একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তিয়াসা মুখ টিপে হাসছে। এদের বোকা বোকা মুখ দেখে হাসি পাচ্ছে ওর।

” এই পুষ্পিতা, এ কে রে? কিসব বলছে! এ নাকি বিড়াল দেখেনি! আর ভাইয়া যে বিড়াল মে’রে’ছে এটাও নাকি জানেনা! যে বিড়াল ফার্স্ট নাইটেই মারতে হয়, সেটা সেকেন্ড নাইটে মারার পরও ভাবী বলছে, বিড়াল মারতে হবে কেন! বইন আমাকে ধর। ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে আমার মাথায় পানি ঢাল। ” নিলাশা হতাশ হয়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরল।

” পারলে তুই আমাকে নিয়ে যা। কোথায় আমি ভাবলাম, ভাবীর কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের ফার্স্ট নাইটে কাজে লাগাব। অয়নকে বোকা বানাব, কিন্তু ভাবীই আমাদের বোকা বানিয়ে দিল! ”

” ছোট ভাবী, তুমি বল তোমরা ফার্স্ট নাইটে কি করেছ? আমার মনে হচ্ছে, তুমি অন্তত আমার চালাক ভাইয়ের বোকা বউয়ের মত নও। ” নিলাশা তিয়াসাকে জিজ্ঞেস করল।

ওর প্রশ্নে তিয়াসা হেসে বলল,

” ঘুমিয়েছি। আর ঘুমের ফাঁকে যা করার করেছি। এবার ডিটেইলস শুনতে চেওনা। তাহলে লজ্জায় পরে যাব। ” তিয়াসা ওদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করে দিল। ও এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়না। আবার ননদদেরও হতাশ করতে চায়না। তাই কিছুটা বানিয়ে বলল।

” শোনরে বইন সকল, আমাদের এই ভাবী কিছুই বলতে চায়না। তাই অভিজ্ঞতা অর্জন আমরা করতে পারলমনা। অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমাদের বাসর করতে হবে বুঝলি তোরা? আমাদের দ্বারা বিড়াল মারা হবেনা। আত্নসমর্পণের মধ্যেই মধুর রাত কাটবে আমাদের। ” ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিলাশা।

আশফি অবাক হয়ে নিলাশার কথা শুনছে। বিয়ের সাথে বিড়াল মারার সম্পর্কটা ও এখনও বুঝতে পারেনি। বিয়ে করলেই কেন বিড়াল মারতে হবে এটা ভেবে ওর মাথা ঘুরছে। মনে মনে ভাবল, পুলককে জিজ্ঞেস করতে হবে এই বিষয়ে।

***

মির্জা বাড়ি মানুষজনের পদচারণা মুখর। আতিক মির্জা ছেলের আর ভাগ্নের রিসিপশনের জমকালো আয়োজন করেছেন। কয়েক হাজার অতিথিকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। বেলা এগারোটার দিকে কয়েকজন বিউটিশিয়ান এসেছে তিয়াসা আশফিকে সাজাতে। আশফি ইতিউতি করছে। ও সাজতে অপছন্দ করে।

” আমার না সাজলে হয়না? পুষ্পিতা তুমি একটু মা’কে বলনা। ”

” কেন, ভাবী? কেন সাজতে চাচ্ছনা তুমি? ”

” আগে কখনোই সাজিনিতো তাই কেমন লজ্জা লাগছে। ”

” একবার সেজে দেখ, দেখবে লজ্জা পালিয়ে যাবে।। তাছাড়া ফটোগ্রাফার এসেছে। ফটোসেশানও হবে তুমি না সাজলে ভালো লাগবেনা, ভাবী। ”

” আরে মেয়ে, সাজুগুজু কর। তোমার চেহারাও তো দেখছি আহামরি কিছু নয়। সাজলেও তবু পুলকের পাশে দাঁড়াতে পারবে। পুলক যে কি করে এমন বউ পছন্দ করেছে সেটাই বুঝতে পারছিনা। অবশ্য শাহেদের পছন্দ আছে বলতে হবে। ফুটফুটে একটা বউ পছন্দ করেছে। শাহেদও যেমন রাজপুত্রের মত দেখতে, তেমনি বউটাও হয়েছে রানীর মত। কিন্তু পুলক এমন করল কেন? ওর পাশে বউকে দিন আর রাত মনে হচ্ছে। মল্লিকাও কেমন! ও দেখেশুনে এমন মেয়েকে কেন বউ করে আনল! ” রুম ভর্তি মানুষের সামনে মল্লিকা মির্জার চাচাতো ভাইয়ের বউ বলে উঠল।

পুলকের মামীর কথা শুনে আশফি লজ্জায় মাথা নিচু করল। কষ্ট হচ্ছেনা মোটেও। আগেও বহুবার ছোটমা ওর গায়ের রং নিয়ে কথা বলেছে। তাই এমন কথা শুনলে ওর কষ্ট হয়না। কখনো লজ্জাও পায়নি। তবে আজকে রুম ভর্তি মানুষের সামনে এই কথায় কেন যেন ওর লজ্জা লাগলো। হয়তো নতুন বউ তাই এমন লজ্জা পাচ্ছে।

” আমি আমার ছেলের জন্য সুখ কিনেছি, ভাবী। কোন মিস ইউনিভার্স কে ছেলের বউ করে আনিনি। আমার ছেলের পছন্দকে সম্মান জানিয়ে এই সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি। একজন মা হিসেবে যদি ছেলেকে সুখী করতে না পারি, তবে কিসের মা হলাম? আর কে বলেছে, আমার বউমা অসুন্দরী? আমার বউমার গায়ের রংটাই একটু চাপা, এই যা। আর তাছাড়া কিসে কম আছে সে? আশফির মত রান্না তুমিও জানোনা। ইনফ্যাক্ট সংসারের কাজকর্মে ওর ধারেকাছেও যেতে পারবেনা তুমি। গায়ের রং দিয়েই যদি গুণের বিচার হত, তবে আজও পৃথিবীতে কালো মানুষের এত মূল্য থাকতনা। দুনিয়ায় কালো মানুষের অস্তিত্ব আছে বলেই, তথাকথিত ফর্সা মানুষরা নিজেদের জাহির করে শান্তি পায়। ” মল্লিকা মির্জা হুট করে রুমে ঢুকেই কথাগুলো বললেন। আশফি ভাবতেই পারেনি ওর হয়ে কেউ প্রতিবাদ করবে। আজ নিজেকে মা হারা মেয়ে মনে হচ্ছেনা মোটেও। বরং অনেক বছর পর মা’কে ফিরে পাবার আনন্দে প্রান খুলে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আর প্রায় সাথে সাথে কেঁদেও ফেলল। মা’য়ের মুখ খুব একটা মনে পরেনা। মা’কে ভাবলে একটা ঝাপসা অবয়ব ভেসে উঠে চোখের সামনে। তাই সেই ঝাপসা মুখ হৃদয়ে সযতনে রেখে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মা’কে আজীবন শ্রদ্ধাভরে ভালোবেসে যাওয়ার পণ করল আশফি।

” এই দেখ, পাগলি মেয়ে কেমন কাঁদছে! আরে পাগলি জীবন চলার পথে এমন অনেক আঘাত, বাঁধা আসবেই। তাই বলে এত ভেঙে পরলে চলবে? সাহসের সাথে সামনে এগিয়ে যেতে হবেনা? দেখি চোখ মুছে দেই। পুষ্পিতা, তুমি তোমার ভাবীকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাও। মেয়েটা ফ্রেশ হয়ে আসুক। আর তোমরা শোন, আমার দুই বউমাকে ইউনিক সাজে সাজাবে। আমার ভাগ্য কত ভালো দেখ, এক মা’কে হারিয়ে দুই দুইটা মা পেয়েছি। আমার সেই মা’য়েরা সাজলে যেন সবাই প্রসংশার চোখে তাকিয়ে থাকে। ” আশফির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বিউটিশিয়ানদের বললেন মল্লিকা মির্জা।

তিয়াসা আবেগে কেঁদে ফেলল। সেই সাথে কাঁদল আশফিও। ওরা দু’জনেই বুঝতে পারছে এই ভদ্রমহিলা নিজেদের মা’য়ের থেকে কোন অংশেই কম নয়। ওরা দু’জনেই জড়িয়ে ধরল মল্লিকা মির্জাকে। তিনিও পরম আদরে বুকে আগলে রাখলেন তার দুই পুত্রের প্রানদের।

***

দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর সাজানো হয় দুই নববধূকে। ওদের নিয়ে বাগানে যায় নিলাশা, পুষ্পিতাসহ ওদের কাজিন মহল।

বাগানে মানুষজন ভর্তি। একপাশে বিশাল স্টেজ তৈরী করা হয়েছে। সেখানে সাজানো আছে রাজ সিংহাসন। যেখানে বসবে নব দম্পতিরা।

নববধূরা বাগানে প্রবেশ করতেই চারপাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি শুরু হলো। সবাই তাকিয়ে আছে তিয়াসা, আশফির দিকে। বন্ধুদের সাথে পুলক, শাহেদ গল্প করছিল। ওদের আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ায় দু’জন। তাকিয়ে থাকে তাদের রমনীদের দিকে। পুলক হেসে এগিয়ে যায় আশফির দিকে। শাহেদ দাঁড়িয়ে থাকলে ওকেও হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নিজের সাথে।

” বিচ্চুগন, এবার আমাদের প্রানভোমরার দ্বায়িত্ব আমাদের হাতেই দাও। আমরা সামলে নেব। ” বোনদের উদ্দেশ্যে বলল পুলক।

” বা রে, এত কষ্ট ভাবীদের এখানে নিয়ে আসলাম তোমার এক কথায় তাদের হাত ছাড়ার জন্য নাকি? দূরে যাও। ” নিলাশাও মুখ বেঁকিয়ে বলল।

” কি লাগবে বইন, তোদের? ”

” ডলার। ”

” হুররর, আমি কি ডলারের ফ্যাক্টরি নাকি? কত টাকা লাগবে বল। দেরি করিসনা। জলদি আমাদের বউদের আমাদের কাছে হস্তান্তরিত কর। ”

পুলকের কথায় হাসির রোল পরে যায়। আশফির তো লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।

” বেশি নয়, আমাদের সবাইকে দশ হাজার করে দিলেই হবে। ”

” মানে কি! নিজের বউকে নিয়ে যাব, তাতেও টাকা লাগবে! রেজিষ্ট্রি করা বউ আমাদের। তোরা ওদেরকে হ্যান্ডওভার করতে বাধ্য। আর তাছাড়া তোরা আছিস পনের জন। প্রত্যেককেই দশ হাজার করে দিলে আমি একদিনেই ফকির হয়ে যাব। আরেকটু কমিয়ে বল। ”

” শুধু তুমি দেবে কেন? শাহেদ ভাইয়াওতো আছে। নাকি ভাইয়া বউ ছাড়াই অসহায়ের মত বসে থাকবে? যতই রেজিষ্ট্রি করা বউ হোক না কেন। আজকে তোমরা আমাদের কাছে কিছুই নও। ”

” এই শাহেদ, তুই কি তোর বউকে নিবি নাকি আমিই আমারটা নিয়ে চলে যাব? বউ নিতে চাইলে কিন্তু অর্ধেক টাকা দিতে হবে। ”

শাহেদ হেসে মাথা নাড়ালো। এ সবার সামনে তিয়াসাকে অপ্রস্তুত করতে চায়না।

ওরা পুরো টাকা হাতে পেয়েই তবে আশফি, তিয়াসাকে ছাড়ল।

একে একে সবাই এসে ওদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। পুলক সবার সাথে আশফির পরিচয় করাচ্ছে।

শাহেদ জড়োসড়ো হয়ে তিয়াসার পাশে বসে আছে। কেউ কারও সাথে কথা বলছেনা। তবে কেউ অভিনন্দন জানাতে আসলে ছোট্ট করে তার সাথে তিয়াসার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।

দুই ভাইয়ের বন্ধুরা এসে ওদের সাথে আলাপ জুড়েছে। শাহেদের বন্ধুরাও এসেছে।

” ডুড, শেষ পর্যন্ত গলায় রশি পরলি ? আমি ভাবছি রুশা’র কথা। তোর বিয়ের কথা শুনলে বেচারি শুকনা স্ট্রোক করবে। আহা বেচারি। ” শাহেদের এক বন্ধু এসে শাহেদেকে খোঁচাচ্ছে।

” কি রে সিজান, তুই কি ভাবীর নতুন সংসারে আ’গু’ন জ্বা’লা’তে চাচ্ছিস? আজকের দিনে কোটিপতির লাডলির কথা না বললেই নয়? ভাবী আপনি রাগ করবেননা। আপনার হাজবেন্ডকে একটা মেয়ে পছন্দ করত। কিন্তু ও কোনদিন পাত্তা দেয়নি। ও খুব সাধারণ কাউকে চাইতো সব সময়। তাই ভার্সিটি লাইফ বিনা প্রেমেই কাটিয়েছে বেচারা। ” শাহেদের আরেক বন্ধু রাফি শাহেদের পক্ষ নিয়ে কথা বলল।

তিয়াসা চুপচাপ ওদের কথা শুনছে।

” ভাবী, আপনি লাকি। শাহেদ ছিল ভার্সিটির চকলেট বয়। ওর পিছুপিছু কত মেয়েই যে ঘুরেছে। কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দেয়নি। কত মেয়ে যে ওর ভালোবাসা পাবার আশায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে তা কেবল রাতেরাই জানে। ” সিজানের কথায় হাসির রোল পরে যায়।

” ভাইয়া, ভাবীদের বাবার বাড়ি থেকে সবাই এসেছে। একটু নিচে আসবে? ” পুষ্পিতার ডাকে সবাই হাসি থামায়।

পুলক, শাহেদ উঠে যায় তাদের সাথে দেখা করতে।

***

রিনা আক্তার মির্জা মহলের সীমানায় ঢুকেই বিস্মিত হয়ে এদিকওদিক তাকায়। সে ভাবতেই পারেনি আশফির এতবড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। মল্লিকা মির্জা আশফি, তিয়াসার পরিবারকে স্বাগত জানিয়েছেন। আতিক মির্জাও আসলেন তাদের কাছে।

” পৃথা রে, এত বড় বাড়িতে ঐ বোকার হদ্দ ছেমড়িডার বিয়া হইল! আমি শুনছি হেরা বড়লোক কিন্তু এত বড়লোক সেইটা বুঝবার পারিনাই। এরেই কয় কপাল। ” রিনা আক্তার মেয়ের কানে ফিসফিস করে বলল।

” তাইতো দেখছি, আম্মু। এলাহি কান্ডকারখানা দেখছি। ” মায়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল পৃথা।

পুলক, শাহেদ এসে পরলে ওরা কথা থামায়। ওরা দুই ভাই সবার সাথে কথা বলে তাদেরকে নিয়ে যায় আশফি, তিয়াসার কাছে।

চলবে।