#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী
” বেয়াইন, আমরা আজকেই তিয়াসা, আশফিকে বাড়িতে নিতে চাই। ওরা জামাইসহ কয়েকদিন গ্রামে গিয়ে বেড়িয়ে আসুক। ” তিয়াসার বাবা তোফাজ্জল হোসেন মল্লিকা মির্জাকে বললেন।
” আমি আপানার জামাইদের জিজ্ঞেস করে দেখি ওরা কি বলে। ওদেরতো আবার হাজারো কাজ থাকে। আমি দেখি ওরা কি বলে। আপনারা মেয়ের বাড়ি ঘুরে দেখুন। এরপর শাহেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসুন। আশফি মা, তুমি সবাইকে নিয়ে তোমার বাড়ি ঘুরে দেখাও। ” মল্লিকা মির্জা বাগানে গেলেন।
রিনা আক্তার আশফির শ্বশুর বাড়ি দেখে হা হয়ে গেছে। আফজাল হোসেন ভিষন খুশি। তিনি ভাবতেই পারছেননা তার মেয়ের এত বড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে।
” কি রে আশফি, তর তো দেখতাছি সোনায় বাঁন্ধানো কাপাল! সারাজীবন যেইগুলান পাসনি, এখনতো দেখতাছি সবই তর হাতের নাগালে আইছে! এখন তরে আর পায় কে। ” রিনা আক্তার আশফিকে বাঁকা গলায় বলল।
” কি আর করবে বল, রিনা? মা না থাকলে যা হয়। আশফির মা ছিলনা, তাই জীবনে অনেক কিছুই পায়নি, কোন শখ পূরণ করতে পারেনি। আল্লাহ এবার মুখ তুলে চেয়েছেন, অসহায় মেয়েটার এবার সুখী হবে। আল্লাহ চেয়েছেন আশফির এত বড় শ্বশুর বাড়ি হবে। মল্লিকা মির্জার মত শ্বাশুড়ি পাবে, পুলকের মত স্বামী পাবে। সেখানে কেউ বাঁধাও দিলেও কাজ হতোনা। তুমি আশফির চিন্তা না করে, তোমার ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা কর। তোমার মেয়েরও বিয়ের বয়স হচ্ছে, ওর জন্য ভালো পাত্র দেখতে শুরু কর এখন থেকেই। আর আফজাল ভাই, আজকে জামাই-মেয়েদের সাথে কাউকে নিয়ে যেতে হবে তো। যেহেতু ওদের বিয়েতে অনুষ্ঠান হয়নি, এখান থেকে কেউ যায়সি, সেহেতু কিছু দ্বায়িত্ব আমাদেরও পালন করতে হবে। ” রিনা আক্তারকে থামিয়ে দিলেন তিয়াসার আম্মু রত্না পারভীন। এরপর তিনি আফজাল হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
” আপনি ঠিকই বলেছেন, ভাবী। আমি বেয়াইনের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলব। আমরা বিয়েতে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের আপ্যায়ন করার সুযোগ পাইনি। যা করার এখনই করতে হবে। ” আফজাল হোসেনও ভাবীর কথায় সায় জানালেন।
” কি কও তুমি! এদের যত আত্মীয় দেখতেছি কারে রাইখা, কারে নিবা? কত খরচ হবে চিন্তা কইরা দেখছ? হুঁশ আছে না একবারেই গেছে? ” এবার আর সহ্য করতে পারলনা রিনা আক্তার। খেঁকিয়ে উঠল স্বামীর ওপর।
” আমি আগেই বলেছি, তোমার এতসব চিন্তা করতে হবেনা, রিনা। এখান থেকে যদি আমার মেয়েদের সাথে পঞ্চাশ জনও যায় তাদের আপ্যায়ন আমিই করব। তোমার স্বামীর এক টাকাও খরচ করতে হবেনা। তুমি বরং নিজের ছেলেমেয়ের জন্য টাকা গোছাও। সতীনের সন্তানের চিন্তা তোমার করার দরকার নেই। তাদের কথা ভেবে অযথাই নিজের শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট করোনা। ওদের কথা ভাববার জন্য আমিই আছি। ” এবারেও রত্না পারভীন প্রতিবাদ করলেন।
বড় জায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠের কথা শুনে মিইয়ে যায় রিনা আক্তার। মাঝেমধ্যেই বড় জা এভাবেই তাকে কথা শোনায়। সে কিছু বলতেও পারেনা। তার বড় জা ধনী ঘরের মেয়ে, তার বড় ভাসুরের অবস্থা তাদের থেকেও ভালো, তার ছেলেরা ভালো চাকরি করে। মোটকথা সবদিক থেকেই তারা আফজাল হোসেনের পরিবার থেকে ভালো অবস্থানে আছে। তাই সবকিছু ভেবে চুপচাপ থাকে রিনা আক্তার। আজকেও তাই থাকল।
আশফি নীরবে চোখের পানি ফেলছে। ওর বিয়ে হওয়ার পরও আম্মা এমনভাবে কথা বলবে ও সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তা-ও আবার ওর শ্বশুর বাড়িতেই এভাবে বলছে! তিয়াসার হাতের স্পর্শে ওর দিকে তাকিয়ে হাসার বৃথা চেষ্টা করল মেয়েটা। কিন্তু পারলনা। সকলের সামনেই ঝরঝর করে চোখের পানি ঝরালো।
***
মল্লিকা মির্জা পুলক, শাহেদের সাথে কথা বললেন। পুলক আম্মুর কথা শুনে শ্বশুর বাড়ি যেতে রাজি হয়। কিন্তু শাহেদ প্রথমে নিমরাজি হলেও মামীর জোড়াজুড়িতে। মল্লিকা মির্জা আফজাল হোসেনকে মেয়ে-জামাইয়দের নেয়ার কথা বললে, আফজাল হোসেন জানান, তিনি চান এখান থেকে কয়েকজনও যাক ওদের সাথে। এতেই বেঁধে গেল বিপত্তি। মল্লিকা মির্জা কাকে রেখে কাকে পাঠাবেন? তিনি যদি বড় কাউকে পাঠান, তবে কাকে পাঠাবেন কিংবা শুধু যদি পুষ্পিতাকে পাঠান তবে ওর বাকি কাজিনরা মন খারাপ করবে। অনেক চিন্তা করে তিনি কথাটা তুললেন আফজাল হোসেন ও তিয়াসার আম্মুর কাছে।
” বেয়াই, আপনারা আজ শুধু আপনাদের মেয়ে-জামাইদের সাথে করে নিয়ে যান৷ পরে আমরা সময় করে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আপনাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। ”
” এ কথা কেন বলছেন, বেয়াইন! বিয়েতে এখান থেকে কেউ যেতে পারেনি, আজ অন্তত সাথে কেউ যাক। ” আফজাল হোসেন চাইছেন সাথে কাউকে নিয়ে যেতে।
” সত্যি কথা বলতে কি, আমার ভাইদের ছেলেমেয়ে আছে। বোনদের মধ্য আমি ছাড়া কারও কোন ছেলে নেই। তাই স্বভাবতই পুলককে সবাই বেশি ভালোবাসে। তাই আমার ছেলের বিয়ের পর কাকে রেখে কাকে আপনাদের বাড়িতে পাঠাব সেটা বুঝতে পারছিনা। যদি আমার ভাইয়ের বউদের মধ্যে কোন একজনকে পাঠাই, তবে অন্যরা যদি কষ্ট পায় কিংবা ভাইয়ের বউদের রেখে বোনদের পাঠাব সেটাও খারাপ দেখায়। আবার আমার শ্বশুর বাড়ির দিকের অনেকেই আছে যাদের আমি ফেলতে পারিনা। আবার সবাইকে বাদ দিয়ে যদি শুধু পুষ্পিতাকে পাঠাই তবে ওর বাকি কাজিনরা মন খারাপ করবে। এছাড়াও শাহেদের অনেক আত্মীয়-স্বজনই আছে। এবার বুঝেছেন তো আমার সমস্যা? তারচেয়ে বরং আপনারা শুধু ওদেরকেই নিয়ে যান। আমরা পরে কোনদিন সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাব বেয়াই বাড়িতে। ”
” তা কি করে হয়? আমরা মেয়ের বাড়ি থেকে আগেই জামাইয়ের বাড়িতে আসলাম কিন্তু আপনারা এখান থেকে কেউ যাবেননা এটা ভালো দেখায়না। এক কাজ করলে কেমন হয়, আজকে পুষ্পিতাসহ ওরা সব বোনেরা আমাদের সাথে যাক। দুইদিন পর আপনারা সবাই গিয়ে ওদের নিয়ে আসবেন। ” তোফাজ্জল হোসেন মল্লিকা মির্জাকে প্রস্তাব দিলেন। তার প্রস্তাব রিনা আক্তার ছাড়া সবারই মনে ধরেছে।
” আচ্ছা, আমি তাহলে আমার ভাসুর আর পুলকের বাবার সাথে কথা বলে দেখি। তারা যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটাই হবে। ” মল্লিকা মির্জা বেরিয়ে গেলেন তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে।
” বড় ভাই, আপনে কি পাগল হইছেন? এখন এই বাড়ি থাইকা সব আত্মীয়-স্বজন গেলে কত খরচ হবে সেই চিন্তা একবার করছেন? আপনার নাহয় অনেক টাকা আছে তাই হিসাব কইরা কথা কননা, কিন্তু কিন্তু আপনের ভাইয়ের তো এত টাকা নাই। ” রিনা আক্তার খেঁকিয়ে উঠল তার ভাসুরের ওপর।
” আমি আগেই বলেছি, এসব নিয়ে তোমাকে এত চিন্তা করতে হবেনা। আমার স্বামী পাগল কি না সেটা আমি বুঝব। তোমার এত না বুঝলেও চলবে। তুমি নিজের চরকায় আজীবন তেল দিয়েছ, এবারও তাই কর। খরচের বিষয়ে আমরাই দেখব। এতদিন গ্রামের মানুষের কাছে সম্মান খুঁইয়েছ এবার কি নতুন আত্নীয়দের বাড়িতে এসে সম্মান বিলাতে চাও? অবশ্য যার কোন সম্মান নেই, তাকে সম্মানের কথা বলা মানে অরন্যে রোদন বৈ কিছুই নয়। তবুও বলব, দয়া করে নিজের মুখ বন্ধ রাখ। তোমার সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে। ” রত্না পারভীন এবার সরাসরি রিনা আক্তারকে কথা শোনালেন।
রিনা আক্তার আর কিছু বলার সাহস পেলোনা।
কিছুক্ষণ পর মল্লিকা মির্জা এসে জানালেন আজকে পুষ্পিতারা যাবে পুলকদের সাথে। কালকের পরদিন এখান থেকে কয়েকজন গিয়ে ওদের নিয়ে আসবে।
***
কাজিন মহল হৈ হৈ করতে করতে রওনা দিল।
গ্রামে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। ওরা রওনা দিয়েছিল সন্ধ্যার পর। তবে রাতে আর রত্না পারভীনের রান্নার ঝামেলা করতে হলোনা। মল্লিকা মির্জা খাবার বেঁধে দিয়েছিলেন। রত্না পারভীন নিতে না চাইলেও তিনি জোড় করেই দিয়েছেন। তবুও রত্না পারভীন বাড়িতে ফোন করে তাদের কাজের মেয়েকে রান্নার জোগাড় করতে বললেন। এবং তিনি বাড়িতে এসেই লেগে গেলেন রান্নার কাজে।
” ভাবী, তোমাদের বাড়িতো হেব্বি। কত বড় বাড়ি! শহুরে যে-কোন হাই ক্লাস বাড়িকে হারা মানাবে তোমাদের বাড়ি। কি চমৎকার পরিবেশ! ”
নিলাশা ওদের বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলল।
নিলাশার সাথে বাকি সবাি তাল মেলাল।
আশফি ভয়ে ভয়ে আছে। না জানি আম্মা কখন কোন ভুল ধরে ওকে সবার সামনে হেনস্তা করে। ও ননদদের সাথে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর ভয় কাটছেনা কিছুতেই।
রত্না পারভীন নাস্তা দিয়ে গেলেন। সবারাই পেট ভরা থাকায় কেউই তেমন কিছু খেলোনা। নাস্তার পর সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। তিয়াসা, আশফি রত্না পারভীনকে রান্নায় সাহায্য করছে। ওরা সবাই তিয়াসার রুমেই বসে আছে।
পুলক ওর কাজিন মহলের ওপর রেগে আছে। দুপুরে এদেরকেই দেড় লাখ টাকা দিতে হয়েছে মনে হলেই রাগে ফেটে পরতে মন চাইছে। নেহাৎই বউ জড়িত ছিল বিষয়টার সাথে, নয়তো এক একজনকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখত।
রাগে মাঝেমধ্যেই বোনেদের দিকে তাকাচ্ছে পুলক। বিষয়টা ওরাও বুঝতে পারছে। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি হওয়ায় পুলক যে কিছুই করতে পারবেনা এটা ওরা ভালো করেই জানে। তাই আপাতত ওর রাগকে পাত্তা দিচ্ছেনা।
ফোনের আওয়াজ পেয়ে পুলক ওদের থেকে চোখ সরিয়ে আনল। আম্মুর নম্বর দেখে রিসিভ করল ফোন।
” বল, আম্মু। কেমন আছো? মনে হচ্ছে কতদিন তোমাকে দেখিনি। তোমাকে খুব মিস করছি। ”
” ফাজিল ছেলে, শ্বশুর বাড়িতে গেছো দুই ঘন্টাও হয়নি, এরইমধ্যে আমাকে মিস করছ? অথচ বাসায় থাকলে এমনও দিন আছে তোমার সাথে বারো ঘন্টা পরও দেখা হয়। তখন কি আমাকে মিস করোনা? ”
” এটা শ্বশুর বাড়ি, আম্মু। শ্বশুর বাড়িতে থাকলে বোধহয় ছেলেমেয়েরা বাবা-মা’কে বেশি মিস করে। ”
” চুপ করো ফাজিল ছেলে। এবার আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোন। বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়িতে গেলে শ্বাশুড়িকে বাজার করে দিতে হয়। কাল সকালে তুমি আর শাহেদ মিলে বাজারে গিয়ে মাছ-মাংস, শাকসবজি ফলমূলসহ সব ধরনের বাজার করবে। বউমারা যেন সেখানে বড় মুখ করে বলতে পারে তাদের স্বামীরা দ্বায়িত্বশীল। আর সেই সাথে ঐ বাড়ির সবার জন্য শপিং করবে।
” যথাআজ্ঞা মা জননী। কিন্তু একটা কথা, আমি সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারিনা এটা তুমি জানো। দুপুরে বাজার করলে হয়না? ”
” নাহ্, সকালেই যাবে। সকাল আটটার মধ্যে তুমি বাজারে থাকবে। এবং সেই সাথে সবার জন্য শপিংও করবে। মনে থাকবে। কারও জন্য কোন কিছু কিনতে যেন ভুল না হয়। ”
” মা জননী, আমার শ্বশুরের জন্য আন্ডারওয়্যারও কিনব নাকি? শাহেদকেও কি বলব ওর শ্বশুরের জন্য আন্ডারওয়্যার কিনতে? ” পুলকের কথায় রুমে হাসির রোল পরে যায়।
শাহেদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে তিয়াসা অথবা আশফি আছে কিনা। ওরা পুলকের এমন কথা শুনলে লজ্জায় পরে যাবে।
চলবে…
#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী জামী
” ছোট মামী, বল কি বলবে? ঐদিকে সব ঠিকঠাক আছে তো? ” শাহেদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কথা বলছে মল্লিকা মির্জার সাথে।
মল্লিকা মির্জা পুলকের সাথে কথা বলার পর ফোন দিয়েছেন শাহেদকে। পুলকের কথাবার্তা শুনে তার সন্দেহ হচ্ছিল। তিনি বুঝতে পারছেন তার ছেলে সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে বাজার করতে যাবেনা। তাই তিনি শাহেদকে ফোন দিয়ে সবটা বললেন।
” বাপ, তুমি তোমার ভাইকে সাথে নিয়ে সকালে বাজারে যাবে। সে ঘুম থেকে উঠতে না চাইলেও জোর করে তুলবে। মনে রেখ, ঐ বাড়িতে তোমাদের আর আমার বউমাদের যেন কোন অসম্মান না হয়। আশফির আম্মার ভাবভঙ্গি আমার ভালো লাগেনি। আমাদের গাফিলতির জন্য যেন আমার বউমা কষ্ট না পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখ। আমার ছেলেকে এসব কথা বললে ও আশফির আম্মাকে কথা শোনাবে, এজন্যই ওকে কিছু বলিনি। তুমি বুঝতে পেরেছ, আমি কি বলতে চাচ্ছি? ”
” তুমি চিন্তা করোনা, মামী। আমি সবটা সামলে নিব। আর ভাইও কিছু জানবেনা। ” শাহেদ ফোন কেটে দিয়ে ভেতরে আসল।
খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে দশটার বেশি বেজে গেছে। রত্না পারভীন নিজে যত্ন করে সবাইকে খাওয়ালেন। তার হাতের রুই মাছ ভুনা, শিং মাছের ঝোল, পাবদামাছের দোপেঁয়াজা খেয়ে সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল। অবশ্য রত্না পারভীনের মন খুব একটা ভালো নেই। ছেলেমেয়েদের তিনি বেশি কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারলেননা বলে।
” বুঝলি শাহেদ, শ্বশুর বাড়িতে জামাইদের এর কদর জানলে আগেই দু-চারটা বিয়ে করতাম। প্রতি সপ্তাহে সিরিয়াল অনুযায়ী শ্বশুর বাড়িতে যেতাম আর শ্বাশুড়ির হাতের মজার মজার খাবার খেতাম। ” সিগারেটে টান দিয়ে নাক-মুখ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল পুলক।
” আগে ভাবীকে সামলাও তারপর আরও তিনটা বিয়ের কথা চিন্তা কর। ভাবী তোমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে এটা নিশ্চিত থাক। আর ভাবীকে ধমক দেয়ার সাহস তোমার নেই, এটা আমি ভালো করেই জানি। ”
” চুপ কর ভাবীর চামচা। কোথায় ছোট ভাই হয়ে বড় ভাইয়ের সাথ দিবি, সেটা না করে ভাবীর সাফাই গাইছিস? তুই কি ভাই নাকি বিভীষণ? ”
” বিভীষণই ধরে নাও। ”
” তারমানে তুই বলতে চাইছিস আমি রাবণ? মাই গড! এই দুইদিনে তোর এত অধঃপতন হয়েছে যে আমার মত জনদরদী ভাইকে রাবণ বানিয়ে দিলি! তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার বুঝলি, শাহেদ? তিয়াসাও কিন্তু কম যায়না। আমার বউ বোকা, তোর বউ কিন্তু দারুণ বুদ্ধিমতী। ”
পুলকের কথা শুনে শাহেদ মলিন হাসল। ওর মনে যে কি চলছে, সেটা কেবল শাহেদই জানে।
” এসব কথা বাদ দাও, ভাই। শোন, মামী যেটা বলেছে সেটা মাথায় রেখ কিন্তু। মামী চাইছেননা আমাদের কোন ভুলে ভাবী কষ্ট পাক। এবং সেটা আমিও চাইছি। বাই দ্য ওয়ে, কিছু কি নোটিশ করেছ তুমি? ” খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করল শাহেদ।
” হুম। আমরা এখানে এসেছি অনেক আগেই। কিন্তু আমার শ্বাশুড়িমা একবারও আমাদের সাথে হেসে কথা বলেনি। আমার শ্বশুর মশাই তার স্ত্রীকে ভিষণই ভয় পান। তিনি চিন্তায় আছেন স্ত্রীকে মানিয়ে কিভাবে আমাদের আপ্যায়ন করবেন। আমার শালা বাবু, শালিকা কেউই এসে আমাদের সাথে কথা বলেনি। এমনকি নাস্তা এবং ডিনার তোর শ্বশুর বাড়িতে করেছি। আমার বোকা বউটার মুখে ভয়ের ছায়া দেখেছি। এমনকি ও রাতে ঠিকমত খায়ওনি। আরও কিছু শুনবি? ” পুলকের কথা শুনে শাহেদের মাথায় হাত। একটুকু সময়ের মধ্যে এতকিছু লক্ষ্য করেছে সে! অথচ সারাটা সময় সে ফোন নিয়েই ব্যস্ত ছিল।
” তুমি এত কিছু লক্ষ্য করেছ! ভাই, তোমাকে লাল সালাম। এবার সকালে গিয়ে বাজার করে আনলেই ঝামেলা মিটবে। এতে আমাদেরও সম্মান রক্ষা হবে আর ভাবীও হাঁফ ছাড়বে। ”
” আমি সাকিবকে বলে দিয়েছি। সকাল হতেই ওরা সবকিছু নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। কাল সকালে বাজার দেখে আমার শ্বাশুড়ির যদি স্ট্রোক না হয়েছে তবে আমার নাম বদলে রাখিস। ”
” কি নাম রাখব, ভাই? তোমার একটা মাস্ত নাম ঠিক করতে বলি ভাবীকে? ”
” তুই কি থামবি নাকি ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব? ভাগ এখান থেকে। আমাকে আয়েস করে স্মোক করতে দে। ”
পুলকের ধমকে শাহেদ বাড়ির ভেতর চলে আসল। বাড়িতে এসেই সে আশফিকে বলে দিল, ওদের বাগানে বসে পুলক স্মোক করছে। শাহেদের কথা শুনে আশফি এক পা দু পা করে বাগানে যায়।
পুলক একটা সিগারেট শেষ করে সবেমাত্র আরেকটা ঠোঁটে নিয়েছে।
” চোরের মত এখানে বসে আছেন কেন? ”
পেছন থেকে আশফির আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল পুলক। সিগারেট লুকানোর বৃথা চেষ্টা করল। বুঝতে পারল শাহেদ আশফিকে বলে দিয়েছে।
” তু..তুমি এখানে কি করছ? ”
” আপনি সিগারেট খান! আর কি কি বদ অভ্যাস আছে আপনার, বদ লোক? ”
” অনেক বদ অভ্যাসই আছে। তুমি কোনটা কোনটা শুনতে চাও বল? ”
” আমি কোনটাই শুনতে চাইছিনা। শুধু আপনাকে শোনাতে চাই, মা’কে ফোন দিয়ে আমি জানিয়ে দেব আপনি সিগারেট খান। আর সেই সাথে আরও অনেক বদ অভ্যাস আপনার আছে। ” আশফি মনে সাহস এনে বলল।
” কে বলেছে আমার আরও বদ অভ্যাস আছে! তুমি আম্মুকে কিছুই বলবেনা। আম্মু এসব জানলে তোমার খবর আছে। ” পুলক আশফিকে ধমক দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারলনা।
” আপনিই তো একটু আগে আমাকে বলতে চাইলেন আপনার কি কি বদ অভ্যাস আছে। আমি মা’কে আজকেই বলব। ”
পুলক আশফির দিকে এগিয়ে এসে আচমকাই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। আশফি নিজেকে ছাড়তে চেষ্টা করেও পারলনা। ততক্ষণে পুলকের মুখে থাকা সিগারেটের ধোঁয়া ওর মুখের ভেতর চলে গেছে। যেটা পুলক ইচ্ছে করেই করেছে। অনেকক্ষণ পর আশফিকে ছেড়ে দিয়ে ওর কপালে কপাল ঠেকায়।
এদিকে আশফির দম বন্ধ হয়ে আসছে সিগারেটের গন্ধে। ও খুকখুক করে কাশছে আর জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। পুলক ওকে তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে।
” আম্মু যদি এসব কিছু জানে, তবে দিনে দিনবার চুমু থেরাপি দেব তোমাকে। আর সেটা সিগারেটের ধোঁয়া সহ। অবশ্য এটাকে চুমু থেরাপি না বলে ধোঁয়া থেরাপিও বলতে পার। তুমি আম্মুকে এসব কথা বললে, আমি ধরে নিব চুমু পাবার লোভেই বলেছ। ”
পুলকের হাত থেকে ছাড়া পেয়েই আশফি বাড়ির দিকে দৌড় দিল। এমন কিছু ঘটে যাবে ও ভাবতেই পারেনি।
***
” ভাইয়া, আজকে আমরা সারারাত সবাই মিলে আড্ডা দেব। কেউ ঘুমাবেনা বলে দিলাম। ” নিলাশা পুলকের কাছে বায়না ধরল।
” তোর জাগার ইচ্ছে থাকলে জাগতে পারিস। আমার ঘুম ধরেছে। আমি এখন ঘুমাতে যাব। ও বউ, আজকে কি তোমার রুমে ঘুমাব আমরা? ” পুলক নিলাশার বায়না গায়ে মাখালোনা। উল্টো আশফিকে কোথায় শোবে সেটা জিজ্ঞেস করল।
” এটা ঠিক নয়, ভাইয়া। ছোট বোনেরা একটা আবদার করেছে আর সেটা তুমি রাখবেনা? প্লিজ ভাইয়া, তোমরা গিয়ে ঘুমাও। আমরা ভাবীদের সাথে আড্ডা দেই। ” নিলাশা জোড়াজুড়ি করেই চলেছে।
” সরি বইনা, আমি বউকে ছাড়া ঘুমাতে পারিনা। তাই যে কোন পরিস্থিতিতেই বউকে আমার পাশে লাগবেই লাগবে। ” পুলকও নাছোড়বান্দার মতো কথা বলছে।
পুলকের এহেন কথা শুনে আশফি লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখল।
” তুমি এমন ভাব করছ যেন দশ বছর আগে বিয়ে করেছ। মোটেই দুই রাত আগে থেকে ভাবীর সাথে এক রুমে থাকছ, আর তাতেই বউ ছাড়া ঘুমাতে পারোনা! এত ঢং কোথায় থেকে শিখেছ? ”
” চুপ কর, ফাজিল মেয়ে। বড় ভাইয়ের পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গোলাচ্ছিস কেন? লাজ-লজ্জা কি সব হাটে রেখে এসেছিস? লাজলজ্জা একটু সাথে করে নিয়ে ঘুরলে কি হয়? সবাই যা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পর। আর এক মিনিটও যদি এখানে থাকিস, তবে তোদের কান ছিঁড়ে মালা বানিয়ে ছাগলের গলায় পরিয়ে দেব। তিয়াসা, তুমি ওদের রুম দেখিয়ে দাও। আর শোন, এই দুই বাঁদরকে আমার রুমের কাছাকাছি শোয়ার ব্যবস্থা করো। নয়তো এরা রাতে বাহিরে ঘুরতে যাবে। ” পুলক নিলাশা আর পুষ্পিতাকে দেখিয়ে বলল। রত্না পারভীন এসে পড়ায় পুলক আর কিছু বললনা। কিন্তু ওর বলা শেষের কথাগুলো রত্না পারভীন শুনতে পেয়েছেন।
” আশফি, তুই জামাইকে নিয়ে তোর রুমে যা। আর তোর পাশের রুম তো রিফাতের, সেখানে তোমরা ঘুমাতে পারবে, মা? রুমটা যে কোন ছেলের সেটা কিন্তু বোঝার উপায় নেই। রিফাত যাবার পর আমিই সব সময় রুমটা পরিষ্কার রাখি। ছেলেটা অপরিচ্ছন্ন কাপড়, রুম দেখতেই পারতনা। ”
আম্মুর মুখে রিফাতের নাম শুনে তিয়াসার বুকের ভেতর তোলপাড় হতে থাকে। হঠাৎই ওর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। গোপন ব্যথা প্রকাশ করতে না পেরে ছটফট করতে থাকে মেয়েটা। চাইলেও এখন রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারছেনা।
” কোন অসুবিধা নেই বড়মা, ওরা ঐ রুমেই ঘুমাতে পারবে। আপনি পাঁচজনকে ঐ রুমে শোয়ার ব্যবস্থা করুন। বাকি কয়েকজন অন্য রুমে একসাথে ঘুমাক। তবে দেখবেন ওরাও যেন বের হওয়ার সুযোগ না পায়। এরা একেকটা বিরাট ফাজিল। ”
পুলকের মুখে ‘বড়মা’ ডাক শুনে রত্না পারভীন হাসলেন। ছেলেটা যে আন্তরিক এটা তিনি বুঝতে পারছেন।
***
” পুষ্পিতা, রুমটা কিন্তু মন্দ নয়। রাত জেগে এখানেই আমরা পাঁচজন আড্ডা দেব বুঝলি? ” নিলাশা রুমের বাহিরের দিকের জানালা খুলে দিয়ে বলল।
” এটা কার ছবি রে, পুষ্পিতা? ছেলেটা কি হ্যান্ডসাম দেখেছিস? ” পুষ্পিতার আরেক কাজিন অনু দেয়ালে ঝুলানো ছবি দেখে জিজ্ঞেস করল।
” এটাই রিফাত, ভাবীর বড় ভাইয়া। ” উত্তর দিল পুষ্পিতা।
” তাকে তো দেখছিনা? কোথায় সে? ” অনু আবারও জিজ্ঞেস করল।
” রিফাত ভাইয়া জব করছে। চিটাগং আছে এখন। ভাইয়ার বিয়ের দিনও এখানে ছিলনা। কিছুদিন পর আসবে। ”
” বেয়াই গ্রামে আমাকে খবর দিস। একটু লাইন মারব। ভিষণই হ্যান্ডু পোলা। পটানোর চেষ্টা করব একে। ” অনু রিফাতের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।
নিলাশাসহ বাকি কাজিনরা অনুর অবস্থা দেখে হেসে উঠল।
***
” বউ, তোমার রুমটা কিন্তু খুব সুন্দর। মন চাচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে চিরদিনের জন্য থেকে যাই। ”
আশফি পুলকের কথার উত্তর দিলনা। চুপচাপ বিছানায় উঠে বসল।
আশফি বিছানায় বসার সাথে সাথেই পুলক ওকে জাপ্টে ধরে শুয়ে পরল। আশফি চাইলেও বাঁধা দিতে পারলনা।
ঠিক দশ মিনিট পর পুলকের ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়েই পুলক বাহিরে চলে যায়।
কয়েক মিনিট পরই আবার যখন ভেতরে আসল, তখন ওর হাতে একটা প্যাকেট দেখল আশফি।
” বউ, জলদি উঠে এস। বিরিয়ানি এখনও গরম আছে। ”
” আপনি এত রাতে বিরিয়ানি কোথায় পেলেন! এখন বিরিয়ানি দিয়ে কি হবে? ”
” রাতে পেট পুরে খেয়েছিলে? কথা না বলে উঠে এসে খেয়ে নাও। ”
পুলকের কথা শুনে আশফি স্তব্ধ হয়ে গেছে। ও আধাপেট খেয়েছে সেটাও সে লক্ষ্য করেছে! আশফি কথা না বাড়িয়ে বিছানা থেকে নামল। সত্যিই ওর ক্ষুধা পেয়েছে।
***
” আপনি আপনার রুমেই ঘুমান। আমি বাহিরে যাচ্ছি। সকালের আগেই আবার ফিরে আসব। ” তিয়াসার রুমে এসে বলল শাহেদ।
” আমাকে আপনি বলে ডাকবেননা। আর এত রাতে কোথায় যাবেন? এখানেই ঘুমান কষ্ট করে। আপনি বাহিরে গেছেন এটা যদি বাড়ির কেউ জানে, তবে বিষয়টা অন্যরকম হয়ে যাবে। ” তিয়াসা মৃদু গলায় বলল।
” যেখানে সম্পর্কটাই নাজুক সেখানে আপনি কিংবা তুমি ডাকে কোন ফারাক নেই। সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হলে ‘ তুমি ‘ ডাক মধুর লাগত। ” শাহেদ মলিন হেসে বলল।
” দীর্ঘস্থায়ী হলে মানে? এ কথা বলছেন কেন? ” তিয়াসা শাহেদের কথা শুনে সত্যিই ভয় পাচ্ছে।
” সেটা সময় হলেই বুঝবেন। এক কাজ করুন, মেঝেতে কিছু একটা বিছিয়ে দিন, আমি নিচেই শোব। ” শাহেদ কোনমতেই তিয়াসার সাথে এক বিছানায় শুতে চাইছেনা।
” নাহ্ আপনি বিছানায় আসুন। আমি বরং নিচে শুচ্ছি। ”
” আমাকে জোর করবেননা। যেটা বলছি সেটা করুন। ” শাহেদ একটু কড়া গলায় বলল।
শাহেদের গলা শুনে তিয়াসা চমকে উঠল। ও কিছু না বলে মেঝেতে একটা মাদুর বিছিয়ে তার ওপর দুইটা কাঁথা আর একটা কম্বল বিছিয়ে দিল।
শাহেদ জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। তিয়াসা ঠোঁট কামড়ে ছেলেটাকে দেখছে। মানুষটার কথা, কাজকর্ম ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। কি করতে চাইছে সে?
চলবে…