রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৪৭+৪৮

0
5

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪৭
জাওয়াদ জামী জামী

” বউমা, কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি বাহিরে এস। দেখে যাও তোমার জন্য কি এনেছি। ‘

আফজাল হোসেন বাড়িতে ঢুকেই নিলাশাকে ডাকতে শুরু করলেন। তার ডাক শুনে নিলাশা দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসল। আফজাল হোসেন ও তার সাথে থাকা ছেলেটি মিলে উঠানে বড় একটা তেরপল বিছিয়েছে। সেখানেই তারা দু’জনে মাছ রাখছে।

” আরিব্বাস! বাবা কত বড় বড় মাছ এনেছেন! ” নিলাশা মাছ দেখে অভিভূত।

” এগুলোর দ্বায়িত্ব এখন তোমার। আশফির শ্বশুর বাড়িতে কতগুলো পাঠাবে, বাড়িতে কতগুলো রাখবে, তোমার বাবার বাড়িতে কি পরিমান পাঠাবে, তুমি কোনগুলো চিটাগং নিয়ে যাবে এখন এ সবকিছুই তোমাকে করতে হবে। দেখি আমার মা কেমন ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে জানে। ” আফজাল হোসেন হাসিমুখে বললেন।

” আমার বাবার বাড়িতে পাঠাতে হবেনা, বাবা। তারা ঢাকা ফিরে গেছে। এত ঝামেলা করার দরকার নেই। তারচেয়ে বরং ভাবীর কাছে বড় মাছগুলো পাঠাই। অবশ্য ছোট মাছও এই মুহুর্তে ভাবীর ভিষণ প্রয়োজন। ” নিলাশা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল।

আফজাল হোসেনের হাঁকডাক শুনে রিনা আক্তার উঠানে এসেছে। এতগুলো মাছ দেখে তার চোখ কপালে উঠল। সেই সাথে নিলাশার কথা শুনে রাগে তার শরীরে জ্বলুনি শুরু হয়েছে।

” হ, সব মাছই তোমার ভাবীর কাছে পাঠায় দিয়া আমরা না খাইয়া থাকি। তুমি ঘরে যাইয়া, ঘুমাও। আমি এগুলা দেখতাছি। সব সময় মাতব্বরি করবার ইচ্ছা করে। ”

রিনা আক্তারের খোঁচা মারা কথা শুনে রাগে নিলাশার পুরো শরীর চিড়বিড় করছে। তবুও ও মুখ থেকে হাসি না মুছেই বলল,

” এতদিন আপনিই তো এই সংসারে মাতব্বরি করেছেন, শ্বাশুড়ি আম্মা। এতদিন যা খুশি করেছেন, কেউ বাঁধা দেয়নি। এখন আমার পালা। আবার আমার ছেলের বউ আসলে সে করবে মাতব্বরি। এটাই নিয়ম। আর আপনার হাজবেন্ড এতটাও গরীব হয়নি যে, এই মাছগুলো তার মেয়ের বাড়িতে পাঠালে সে বাজার থেকে মাছ কিনতে পারবেনা। এতদিন আপনার ভাইবোনের কাছে গেছে এসব। এখন থেকে আশফির বাড়িতে যাবে। আবার রিফাতের বউও তার ন্যায্য হিস্যা কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে নেবে। এই বাড়ির সব কিছুতে যদি আপনার মা, ভাইবোনের অধিকার থাকে, তবে আশফি রিফাত কি বানের জলে ভেসে এসেছে? তারাও পাবে সবকিছু। বুঝেছেন? সো বেশি ফটফট না করে চুপচাপ দেখে যান আমি কি করি। বাবা, আমি যদি ভুল কিছু বলে থাকি তবে আমার ভুল শুধরে দেবেন। ”

‘ তুমি ভুল কিছু বলনি, মা। ভুল আমার ছিল। আমার ভুলের কারণে ছেলেটা আমার পর হয়ে গেছে। আজ কতদিন সে আমাকে ‘ আব্বা ‘ বলে ডাকেনা। মেয়েটা ডাকে তবে অনিচ্ছায়। রিফাতের জায়গায় পিয়াস থাকলে আমাকে পদে পদে অপমানিত হতে হত সেটা আমি এখনই বুঝতে পারি। আমি আমার পূর্বের ভুলগুলো শোধরাতে চাই, মা। আমার ছেলেমেয়েকে ফিরে পেতে চাই। ওদের রাবেয়া পেটে ধরেছিল জন্যই এখনো অমানুষ হয়ে যায়নি। আজ যদি রাবেয়া থাকত তবে তুমি দেখতে আদর কাকে বলে। তেমনি জামাই বাবাও শ্বশুর বাড়িতে সম্মান পেত। আফসোস আমার জীবনে অন্ধকার ঢেলে দিয়ে রাবেয়া হারিয়ে গেছে। তুমি তোমার মনের মত করে মাছগুলো ভাগ করে যেখানে খুশি সেখানে পাঠাও। ” আফজাল হোসেন কথার মাঝেই তার চোখ মুছলেন।

আফজাল হোসেনের কথাগুলো শুনে রিনা আক্তার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ পর্যন্ত একদিনও সে আফজাল হোসেনের মুখে রিফাতের মা’য়ের কথা শোনেনি। অবশ্য রিনা আক্তারই এর জন্য দায়ী। এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সে রিফাত, আশফিসহ এই বাড়ির সবার নামে বদনাম করে তার কান ভাঙ্গিয়েছে। ফলশ্রুতিতে আফজাল হোসেন কখনোই রিনা আক্তার ব্যাতিত কারও কথা কখনোই কানে নেননি। কিন্তু আজ এসব কি বলছে সে? তবে কি রিনা আক্তারের এতদিনের সব পরিশ্রম বৃথা? না রিনা আক্তার তার পরিশ্রম বৃথা যেতে দেবেনা। সে রুখে দাঁড়াবে। করলোও তাই।

” খুব ভালো সাজতাছ তাইনা? পোলার বউয়ের সামনে কাঁইন্দা বুক ভাসাইয়াই ভালো বাপ হবার চাইতাছ? তোমার ভালো বউ আছিল রিফাতের মা, আর আমি খারাপ বউ? তোমার সংসারে আইসা আমি দাসী-বান্দির মত খাটছি সেইডা কিছু না? এখন পোলার বউ পাইয়া সব ভুইলা গেছ? বেইমানের ঘরের বেইমান। ” রিনা আক্তার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নিলাশা তাকে থামিয়ে দেয়।

‘ শ্বাশুড়ি আম্মা, এত হাইপার হবেননা। প্রেশার বেড়ে গিয়ে যদি পটল ক্ষেতে যান তবে আমার শ্বশুরের এই রাজত্ব গ্রাস করবে কে? তখনতো আপনার ভাইবোনের এই বাড়িতে ঢোকার চান্স শূন্যের কোঠায়। তাই হাইপার না হয়ে পিঁড়িতে বসে দেখুন আমি কি করি। আর হ্যাঁ, একটু ভালো বউ হতে দোষ কি? এই যে আমার শ্বাশুড়ি কবে মারা গেছেন কিন্তু আমার শ্বশুর আজও তাকে মনে করে চোখের পানি ফেলছেন। এটা অবশ্যই মন থেকে করছেন। তাই বাকি জীবনে এমন ভালো কিছু করুন যাতে ভবিষ্যতে আপনি মরলেও বাবা এভাবেই কাঁদেন। এবং সেটার সাক্ষীও যেন আমিই থাকি। ”

নিলাশার কথা শুনে উঠানে দাঁড়ানো সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। আফজাল হোসেনও হাসছেন। শুধু রিনা আক্তার মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়ে আসার পর থেকে তাকে নানানভাবে অপমান করে যাচ্ছে কিন্তু সে কিছুই করতে পারছেনা এটা তার জন্য লজ্জার।

নিলাশা মন দিয়ে তার কাজ করছে। সে আশফির জন্য সবচেয়ে বড় দুইটা মাছ রাখল। এছাড়াও ছোট-বড় মিলিয়ে আরও কিছু মাছ ওদের কাজের ছেলেকে প্যাকেট করতে বলল। একটা বড় মাছ সে রত্না পারভিনকে দিল। প্রতিবেশিদের বাড়িতে কিছু মাছ পাঠাল। এসব দেখে রিনা আক্তার ফুঁসছে।

” বড়মা, ভাবীর জন্য কিছু টাটকা সবজি পাঠাতে চাচ্ছি। আমাকে এনে দিতে পারবেন? এসময়ে ভাবীর জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ” নিলাশা কাজের ফাঁকে রত্না পারভিনকে বলল।

” এসময়ে মানে? কি হয়েছে আশফির? ” রত্না পারভিন জানতে চাইলেন।

” আপনারা নানা-নানি হচ্ছেন। ” নিলাশা এতটুকু বলে তাকিয়ে থাকল আফজাল হোসেনের দিকে।

নিলাশার মুখে কথাটা শুনে আফজাল হোসেন খুশিতে কেঁদে ফেললেন। আনন্দাশ্রু রত্না পারভিনের চোখেও।

” তুমি সত্যি বলছ, মা? আমার আশফি মা হবে? আমার বোকা, শান্ত মেয়েটা মা হবে? আমি নানা ভাই হব? ” আফজাল হোসেনের গলা আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেছে।

” সত্যি বলছি, বাবা। গতরাতে ভাইয়া আমাকে জানিয়েছে। বাবা, শুনুন এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে ভাবীর জন্য টাটকা মাছ-মাংস, সবজি পাঠিয়ে দেবেন। যদিও ফুপুদের বাসায় হরেকরকম বাজার করে। তবুও আপনি পাঠাবেন। ” নিলাশা অনুরোধ করল আফজাল হোসেনকে।

‘ পাঠাব, মা। তুমি আমাকে প্রতিদিন ফোনে বলে দেবে কি কি কিনতে হবে আমি সেগুলোই কিনব। আমার অসহায় মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকে আদর দিইনি, এবার দ্বায়িত্ব পালনের এই সুযোগ হাতছাড়া করবনা। ”

” শুধু মাছ-মাংস, শাকসবজি পাঠালেই হবেনা। আপনার নাতি-নাতনি দুনিয়ায় আসলে তার মুখ দেখেও কিছু দিতে হবে, সেটা মাথায় আছে?”

” এই যে পাকনা মেয়ে, এত দ্বায়িত্ববোধ শিখেছ কোথায় থেকে? আমরা মা হয়ে যা করতে পারিনি, তুমি এই কয়দিনেই সেগুলো করছ। ” রত্না পারভিন হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন।

” দ্বায়িতবোধ নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। পরিস্থিতিই মানুষকে দ্বায়িত্ব পালন করতে শেখায়। তেমনি পরিস্থিতি আমাকেও দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখিয়েছে। ”

” সুস্থভাবে বেঁচে থাক, মা। সারাজীবন এমনই থেক। বাবা হয়ে যে কাজ আমার করা উচিত ছিল, সেটা তুমি করে দেখিয়েছ। আমার ছেলের জীবনে সঠিক মানুষ এসেছে দেখে শান্তি পাচ্ছি। এখন আমার মৃত্যু হলেও কোন আফসোস থাকবেনা। ” আফজাল হোসেন মন থেকে দোয়া করলেন নিলাশাকে।

” এখনই মৃত্যুর চিন্তা করছেন কেন, বাবা? কেবলমাত্র মেয়ের ঘরে একটা নাতী/নাতনী আসছে। ছেলের ঘরে নাতী/নাতনী দেখতে চাননা বুঝি? এদিকে আমি কতকিছু ভেবে রেখেছি। আমার ছেলেমেয়েকে কাঁধে নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরবেন, ওদের নানান বায়না হাসিমুখে মেনে নিবেন। ওদের নিয়ে হাটে যাবেন। আরও কতকিছু। ”

নিলাশার কথা শুনে রত্না পারভিন হাসতে হাসতে পারলে উঠানে লুটিয়ে পরেন। আফজাল হোসেনও হাসছেন। এই ঠোঁটকাটা মেয়েকে নিয়ে তাকে যে ভবিষ্যতেও অপ্রস্তুত হতে হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছেন।

***

” এই যে নতুন মামা, কেমন আছেন? আচ্ছা মানুষতো আপনি! নিজ থেকে ফোন দিতেই চাননা, আবার আমি ফোন দিলে রিসিভও করেননা! বলিহারি যাই আপনার। ” রিফাত ফোন করতেই রিসিভ করে নিলাশা অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসল।

” এখন ফোন কে দিয়েছে? আমি না তুমি? প্রতিদিন সকালে তোমাকে ফোন কে দেয়? আবার তুমি ফোন দিলে আমি কেটে দিয়ে ব্যাক করি প্রতিবারই। এরপরও বলছ আমি ফোন দেইনা! ” রিফাত নিলাশার কথা শুনে যারপরনাই হতাশ।

” ফোন দেন বুঝি! তাহলে হয়তো ভুলে গেছি। আমার আবার আজকাল কিছুই মনে থাকেনা। সকালে কি খেয়েছি দুপুরে মনে করতে পারিনা। ” নিলাশা নির্বিকার ভাবে জবাব দেয়।

” শুধু ঝগড়া করতে মনে থাকে। আর আমাকে খোঁচাতে মনে থাকে। তো আজ সারাদিন কি কি অকাজ করেছ? আই মিন ছোটমা’কে কিভাবে বিরক্ত করেছ? ” রিফাত ভালো করেই জানে নিলাশা বাড়িতে কি কি করে।

” আমি কাউকে বিরক্ত করিনা। শুধু প্রতিবাদ করি আর প্রতিশোধ নেই। আমার এই প্রতিভাকে আপনি অসম্মান করতে পারেননা কিছুতেই। আপনাদের মত মানুষের জন্যই আমার মত প্রতিভাবানদের সমাজে সম্মান নেই। ”

” সরি, ভবিষ্যতে এমন ভুল হবেনা। প্রতিভাবানকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে দ্বিধা করবনা। সম্মানিতা প্রতিভাবান আপনার আজকের পরিকল্পনা জানতে পারি? ”

” উঁহু, প্রতিভাবানরা কখনোই তাদের পরিকল্পনা আগে থেকেই প্রকাশ করেনা। চাইলে সন্ধ্যায় বড়মার কাছ থেকে জানতে পারবেন। ”

” আগামী পরশু আমি বাড়ি যাচ্ছি। তার পরদিনই তোমাকে নিয়ে চিটাগং ফিরব। সে অনুযায়ী সবকিছু গুছিয়ে রেখ। আমি রাতটুকুই বাড়িতে থাকব। তোমার কোন অযুহাত আমাকে সেখানে রাখতে পারবেনা। মনে থাকবে? ”

” হুম থাকবে। সত্যিই আর দুইদিন আছি এখানে? আর কয়েকটা দিন থাকলে হতোনা? ”

নিলাশার কথা শুনে রিফাত কপাল চাপড়ায়। এই মেয়েকে কিভাবে বললে সে ওর কথা শুনবে সেটা ওর বুঝে আসেনা।

” কয়েকদিন নয় চাইলে কয়েক বছর থাকতে পার। সেক্ষেত্রে তোমাকে রেখেই আমার চিটাগং ফিরতে হবে। ”

” এই না, আমি আপনার সাথেই যাব। এত সাধ্য-সাধনা করে বরটাকে পেয়েছি, তাকে দূরে রাখার মত বোকামি করবনা কিছুতেই। ”

” তাহলে তৈরী থেক। ” রিফাত অফিসে আছে তাই কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দেয়।

নিলাশা ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফোনে পরপর কয়েকটা চুমু দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখল।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪৮
জাওয়াদ জামী জামী

” ভাই, একটা ব্যাড নিউজ আছে। বাগানবাড়িতে সাকিব আর গেইটম্যানকে অজ্ঞান করে, কেউ বন্দীকে নিয়ে পালিয়েছে। এদিকে নারায়ণগঞ্জের সেইফ হাউজ থেকে রায়হানও উধাও। কিছুক্ষণ আগেই ওর ডেড বডি পাওয়া গেছে শীতলক্ষ্যা’র পাড়ে। ”

রকি’র কথা শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল পুলক। এসব কি শুনছে? এটা কিভাবে সম্ভব! ওর সেইফ হাউজের কথা শাহেদ, সাকিব আর রিহান ব্যাতিত কেউ জানেনা। আর জানে নারায়নগঞ্জের রাকিব নামের একজন। সে-ও পুলকের বিশ্বস্ত সঙ্গী। তবে কি এদের মধ্যে কেউ বেইমানী করেছে? এ-ও কি সম্ভব!

” এসব তুই কি বলছিস, রকি ? খবরদার বলছি আমার সাথে ফাইজলামি করবিনা। তুই ভালো করেই জানিস এটা ফাজলামির বিষয়বস্তু নয়। ” পুলক ধমক দিল রকিকে।

” আমি ফাজলামি করছিনা, ভাই। সত্যিই মাহমুদকে পাওয়া যাচ্ছেনা। আর আমি সাকিব আর গেইটম্যানকে ডক্টরের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওরা এখনো অজ্ঞান। আমাকে রায়হানের খরব রাকিব ভাই দিয়েছে। সে নাকি রাতে ঘুমানোর পর ঘুম ভেঙেছে দুই’ঘন্টা আগে। ঘুম থেকে উঠে উঠার পর রায়হানকে না পেয়ে চারপাশে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে, একজনের মাধ্যমে জানতে পারে, শীতলক্ষ্যার পাড়ে একটা ডেড বডি পাওয়া গেছে। সন্দেহবশত সেখানে গিয়ে রায়হানকে সনাক্ত করেছে। রাকিব আপনাকেও ফোন দিয়েছিল৷ কিন্তু আপনার ফোন সুইচড অফ থাকায় আমাকে জানায়। ”

রকির কথায় মাথা ঘুরছে পুলকের। এসব কি হচ্ছে ওর সাথে! কে করল এতবড় বেইমানী? পুলক দেরি না করে প্রথমে শাহেদকে ফোন দেয়।

শাহেদ অফিসেই ছিল। ফোনের আওয়াজ পেয়ে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে চাইল। স্ক্রিনে পুলকের নাম দেখে ঠোঁটের কোনে সুক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা দিল। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই রিসিভ করল।

” ভাই, কি অবস্থা তোমার? আমাকে হঠাৎ মনে পরল যে? ” খোশমেজাজে জিজ্ঞেস করল শাহেদ।

” সর্বনাশ হয়ে গেছে। রায়হানের বডি পাওয়া গেছে শীতলক্ষ্যার পাড়ে। আর মাহমুদের খোঁজ নেই। ” এক নিঃশ্বাসে বলল পুলক। ও শাহেদের কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলনা।

” হোয়াট! তুমি কি মজা করছ, ভাই? এটা কি করে সম্ভব? ওরা যে আমাদের জিম্মায় আছে সে কথা বাহিরের কেউই জানেনা। ” শাহেদ ভিষণই চমকে গেছে। পুলকের কথা বিশ্বাস করতে ওর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস না করে ওর উপায় নেই। ও ভালো করেই জানে এসব নিয়ে পুলক মিথ্যা বলবেনা বা মজাও করবেনা।

” মজা করছিনা। এটাই ঘটেছে। সাকিব আমাকে জানাল। ” পুলক থমথমে গলায় বলল।

” কে করেছে এমনটা! আমরা চার-পাঁচজন ছাড়া বিষয়টা কেউই জানিনা। তবে কি আমাদের ভেতরের কেউই বেইমানী করেছে? ” শাহেদের গলার স্বর অসম্ভব গম্ভীর শোনাচ্ছে।

” আমি বুঝতে পারছিনা। তুই একটু নারায়ণগঞ্জ যেতে পারবি? ” পুলক আস্তে আস্তে বলল।

” আমি দশ মিনিটেই বেরোচ্ছি৷ তুমি চিন্তা করোনা। মাহমুদের খোঁজ লাগাও। তবে তার আগে বাগানবাড়িতে যাও। গেইটম্যানের সাথে কথা বল। সাকিবের সাথেও কথা বল। আমি এদিকটা দেখছি। ”

দু’জনের কেউই কথা বলার অবস্থায় নেই। ওরা এখন ডক্টরের কাছে। তাই অল্প কয়েকটা কথার পরই ফোন রেখে দিল। এরপর পুলক হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

***

” স্যার, পুলক মির্জা আমাকে অনেক হুমকিধামকি দিলেও আমি আপনার নাম তার কাছে প্রকাশ করিনি। তবে সে একজন ধুরন্ধর পুরুষ। আপনাকে খুঁজে বের করতে তার বেশি সময় লাগবেনা। এটা আমি বুঝতে পেরেছি। ” মাহমুদ হাসান মলিন হেসে বলল। তার সামনের চেয়ারে একজন কেতাদুরস্ত ব্যক্তি বসে আছে। যে মাহমুদের নিয়োগকর্তা। আতিক মির্জাকে তার নির্দেশেই খুণ করেছিল মাহমুদ। সে চিল চক্ষুতে তাকিয়ে আছে মাহমুদ হাসানের দিকে। তার ঠোঁটের কোনেও শোভা পাচ্ছে চতুর হাসি।

” তুমি সত্যি বলছ? পুলক মির্জাকে সত্যিই আমার বিষয়ে কিছুই জানাওনি? কোন সামান্যতম ক্লু ও দাওনিতো? ” জানতে চাইল সেই ব্যক্তি।

” না, স্যার। আমি টোটালি মুখ বন্ধ করে ছিলাম এই কয়দিন। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আপনার পরিচয় জানার সাথে সাথেই পুলক মির্জা তার শত্রুকে শেষ করতে দুইবারও ভাবতনা। স্যার, আপনি আমাকে দেশের বাহিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। আপাতত কিছুদিন আমি পুলক মির্জার চোখের আড়ালে চলে যাই। এরপর সুযোগ বুঝে আবারও দেশে আসব। আমি অকালে প্রান দিতে চাইনা, তা-ও পুলক মির্জার মত জাত খুণীর হাতে। ” মাহমুদ হাসান অনুনয় করে বলল।

” সরি, ভিক্টর। আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজের জীবন রিস্কে ফেলতে চাইনা। আমার নিজেকে বাঁচাতে হলে তোমাকে মারতে হবে। অপশন একটাই। ” ধীর ভঙ্গিতে বলল চেয়ারে বসা ব্যক্তি।

” প্লিজ স্যার, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি চিরকাল দেশের বাহিরে থাকব। আপনাকে যে চিনি সেকথা দুনিয়ায় কেউই জানবেনা। আমার পরিবার আছে, আমার অবর্তমানে তারা পথে বসবে। আমার বৃদ্ধ বাবা-মা পাগল হয়ে যাবে। আমি আপনার পরিচয় কাউকে জানাবনা, স্যার। ”

মাহমুদ হাসানের মত খুণীও হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চাইছে। কিন্তু সেই ব্যক্তির মন একবিন্দুও নরম হলোনা। সে মাহমুদ হাসানকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ দিলনা। নিমেষেই তার হাতে উদয় হল ওয়ালথার পি পি কে। সে মুহূর্তের মধ্যেই গুলি করল মাহমুদের কপাল বরাবর। এরপর পেছনে দাঁড়ানো একজনের সাথে কথা বলতে থাকল।

” জিশু, তুমি বডিটা শহরের বাহিরের একটা নালায় ফেলে এস। কেউ যেন জানতে না পারে। এরপর তোমার কাজ হবে, পুলক মির্জাকে ফাঁসানোর। পুলিশ যাতে জানতে পারে, গত বেশ কিছুদিন ধরে মাহমুদকে পুলক মির্জাই আটকে রেখেছিল। আমি পুলক মির্জার ধ্বংস দেখতে চাই। তার ধ্বংসের কারণ হতে চাই। ” খুবই হিংস্র দেখাচ্ছে কেতাদুরস্ত ব্যক্তিটিকে। তার চোখমুখে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জিশু নামের ছেলেটি তার মালিকের এই রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেছে। সে ভয়ে ভয়ে বলল,

” জ্বি, স্যার। আমি রাতের মধ্যেই ডেড বডির একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। ”

***

সারাদিন পুলক ও তার দলের কয়েকজন পুরো শহর তন্নতন্ন করে মাহমুদকে খুজে বেড়ায়। কিন্তু মাহমুদের কোনও খোঁজ পায়না। চিন্তায় পুলকের চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। ওরা রাস্তার ধারে বাইকে বসে আছে। কেউ কোনও কথা বলছেনা। এমন সময় নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে বেজে উঠল পুলকের ফোন। পুলক মলিন মুখে ফোন রিসিভ করল।

” হুম বল। ”

” ভাই, সেইফ হাউজের গেইটম্যান কিছুই বলতে পারছেনা। সে-ও রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙেছে দুপুরের দিকে। ঘুম ভাঙ্গলে তারা রায়হানকে দেখতে পায়নি। ব্যাস এতটুকুই। আমার এক সিনিয়র ফ্রেন্ড ঐ এরিয়ার এ এস পি। তাকে বলে আমি রায়হানের বডি দেখতে গিয়েছিলাম। আমার বয়সী ছেলে। তার কপালের মাঝখানে আর গলায় শ্যুট করেছে আততায়ী। এর বেশিকিছু আমি জানতে পারিনি। তবে আমার ফ্রেন্ডকে বলে রেখেছি, এই বিষয়ে সামান্য ক্লু পেলেও আমাকে জানাতে। ঐদিকের খবর কি? ”

” ওকে, তুই লেগে থাক। এদিকের কোন খবর নেই। আমি দেখছি কি করা যায়। রাখছি। ”

পুলক ফোন কেটে দিয়ে মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবছে। ওর হিসেব মিলছেনা। কে করল এতবড় বেইমানী?

” সাকিব, তুই বাসায় যা। তোর অবস্থা সুবিধার লাগছেনা। তুই গিয়ে রেস্ট নে। সুস্থ হলে আবার আসিস। ” সাকিবের দিকে না তাকিয়েই বলল পুলক।

” ভাই, আপনাকে এভাবে রেখে আমি কোথাও যাবনা। যেহেতু আমার উপস্থিতিতে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে, সেহেতু মূল দোষী আমি। তাই একটা রেজাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাচ্ছিনা। আমি একটু সচেতন থাকলেই এমন ঘটনা ঘটতনা। ” অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সাকিবকে।

” তোর কোনও দোষ নেই। আমিই শত্রুকে ছোট ভেবেছিলাম। আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তুই বাসায় যা৷ টাকাগুলো রাখ। যাওয়ার পথে কিছু ফল কিনে নিয়ে যাস। ” পুলক কিছু টাকা বাড়িয়ে দিল সাকিবের দিকে। সাকিব নিতে না চাইলেও পুলকের জোড়াজুড়িতে নিতে বাধ্য হল। এরপর সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

***

নিলাশার গোছগাছ দেখে রিফাত মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। মাছ-মাংস, সবজি থেকে শুরু করে বাড়ির গাছের ডাব-নারকেল, বাতাবি লেবু, পেয়ারা কিছুই বাদ রাখলনা।

” আমরা চিটাগং যাচ্ছি, ঢাকা নয়। এতকিছু কিভাবে নিব! ” রিফাত গোমড়ামুখে বলল।

” তো! আমরা কি চিটাগং হেঁটে যাব! আমরা যেভাবে যাব, জিনিসপত্রও সেভাবেই যাবে। ” নিলাশাও বিরক্ত হয়ে জবাব দিল।

” এতকিছু না নিলেই কি নয়? এতসব খাবার কতদিনে খাবে? ” রিফাত বিস্ময় চেপে রাখতে পারলনা।

” সে চিন্তা আপনার না করলেও চলবে। সব খাবার একা আমিই খাব। সাতদিনেই সব সাবাড় করে দেব। আপনি বসে বসে দেখবেন। ” নিলাশা মুখ বেঁকিয়ে বলল।

রিফাত কপাল চাপড়ায় নিলাশার কথা শুনে। এই মেয়েকে বোঝানোর সাধ্য ওর নেই।

চলবে…