রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৪৯+৫০

0
144

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪৯
জাওয়াদ জামী জামী

মাহমুদের বডির পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলক মির্জা ও তার দলবল। পুলক মির্জা রাগে ফুঁসছে। ওর সাথে বেইমানী করার সাহস কে করেছে এখন অব্দি সেটাই বের করতে পারেনি। আর যার বুদ্ধিতে এসব হচ্ছে, সে অবশ্যই সাধারণ কেউ নয়। ও অতি বুদ্ধিমান শত্রুর পাল্লায় পড়েছে। বুদ্ধির খেলায় শত্রুকে না হারাতে পারলে ও নিজেই শত্রুর শিকার হতে পারে। খরচ হতে পারে নিজের পৈতৃক প্রান। এখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে লোকজন সন্দেহ করতে পারে। পুলক মির্জা চোখের ইশারায় সবাইকে চলে যেতে বলে নিজেও বাইকে উঠল।

নিরাপদ দুরত্বে সরে এসে পুলক ফোন দিল শাহেদকে। একবার রিং হতেই রিসিভ করল শাহেদ। যেন সে পুলকের ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল।

” বল, ভাই। ঐদিকে কি অবস্থা? ” অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল শাহেদ।

” মাহমুদ ইজ ডেড। কে বা কারা ওকে খালাস করেছে। ” গম্ভীর গলায় উত্তর দিল পুলক।

” হোয়াট? এসব কি হচ্ছে! কে করছে এসব? আমি কি একবার আসব, ভাই? ” চিন্তিত শাহেদ অনুমতি চাইল পুলকের কাছে৷

” এখন আসার দরকার নেই। তুই বরং ঐদিকের খবর রাখ। গোপন কিছু থাকলে জানার চেষ্টা কর। এই মুহুর্তে আমার একটা ক্লু প্রয়োজন। যেটা আমাকে নিয়ে যাবে খুণীর কাছে। ”

” ওকে, ভাই। তুমি চিন্তা করোনা। আমি দেখছি কি করা যায়। আর এসব বিষয়ে বাসায় আলোচনা করোনা। মামী, ভাবী এসব শুনলে টেনশনে থাকবে৷ এই অবস্থায় ভাবীর টেনশন নেয়া ঠিক হবেনা। আমাদের প্রিন্স যাতে সুস্থ থাকে সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। ”

” হুম। রাখছি। তুই নিয়মিত ঐদিকের খবর রাখার চেষ্টা কর। ”

” আল্লাহ হাফেজ। ”

শাহেদের সাথে কথা শেষ করে পুলক ফোন দিল রকি’র কাছে। রকি’কে গোপন জায়গায় আসতে বলে ফোন রাখল। রকি’র সাথে ওর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।

***

নতুন সংসারে এসে গোছগাছ করতে শুরু করল নিলাশা। রিফাত অফিসে গেছে। একা একা বসে থাকার চাইতে কাজ করাই শ্রেয়। রিফাত এখনো নিলাশার জন্য কোন হেল্পিং হ্যান্ড খুঁজে পায়নি, তাই আপাতত ওকেই সব কাজ করতে হবে। এতে অবশ্য নিলাশার খারাপ লাগছেনা। নিজের সংসারে কাজ করার আলাদা আনন্দ আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। সারাদিন একটানা কাজ করে পুরো বাসা গুছিয়ে ফেলল। সন্ধ্যায় রান্নাঘরে ঢুকল। রিফাত বাসায় আসার আগেই ওকে রান্না শেষ করতে হবে।

রিফাত বাসায় ঢুকেই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পুরো বাসা ঝকঝকে তকতকে! ও বিয়ের আগেই বাসাটায় উঠেছে। পুরো বাসা প্রয়োজনিয় আসবাবে সাজিয়েছে। তবুও তখন বাসায় ঢোকার পর এত পবিত্র অনুভূতি হয়নি ওর। আগের আসবাবপত্র সবই আছে, শুধু একজন রমনীর কোমল হাতের ছোঁয়ায় অদ্ভুতভাবে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে বাসাটা। রিফাত মুহূর্তেই বুঝে যায়, একটা সংসার গোছাতে রমনীদের জুড়ি নেই। তারা নিমেষেই একটা সংসারের রূপ পাল্টে দিতে পারে। তাদের কোমল ছোঁয়ায় কোন প্রস্তর কঠিন হৃদয়ও গলে জল হয় সযতনে।

” একটা একটা করে সব আইটেম খেয়ে বলবেন কেমন হয়েছে। ” খাবার টেবিলে কয়েক রকম খাবার দিয়ে রিফাতকে খেতে বলল নিলাশা।

” এত খাবার আমাকে খেতে বলছ? এগুলো আমার আগামী সাতদিনের খাবার। ” রিফাত এত খাবার দেখে হা হয়ে গেছে।

” অসুবিধা নেই, আগামী সাতদিন এগুলোই আপনাকে খেতে হবে। তাই কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করুন। ”

নিলাশার কথার প্রত্তুত্যর না করে রিফাত চুপচাপ খেতে শুরু করল।

***

” আপনি এভাবে মন খারাপ করে বসে আছেন কেন? কিছু হয়েছে? ” শাহেদকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে তিয়াসা জিজ্ঞেস করল। শাহেদকে এমন চুপচাপ থাকতে দেখে ওর ভালো লাগছেনা।

শাহেদ তিয়াসাকে মিথ্যা বলতে চাইছেনা আবার মেয়েটা চিন্তা করবে দেখে সত্যটাও জানাতে পারছেনা। তাই ও ভেবেচিন্তে উত্তর দিল,

” অফিসে একটু ঝামেলা হয়েছে। সেজন্যই মন একটু খারাপ আছে। তুমি এত টেনশন করোনাতো। আমার বুকে এস, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। ”

শাহেদের এমন আবদার অগ্রাহ্য করে এমন সাধ্য নেই তিয়াসার। ও বাধ্য মেয়ের মত শাহেদের বুকে মাথা রাখল। শাহেদও ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিল তার রমনীকে।

***

বুকে ভারী কিছু অনুভব করতেই ঘুম ভাঙ্গলো রিফাতের। চোখ মেলতেই দেখল নিলাশা ওর বুকে মাথা রেখেছে। নিলাশার এই অযাচিত আচরণ রিফাতের খারাপ লাগেনা মোটেও। অথচ ও বিয়ের দিন পর্যন্ত ভেবে এসেছে, মেয়েটাকে বোধহয় আপন করতে পারবেনা কভু। হয়তো ওর সাথে দুরছাই আচরণ করবে। ভালোবেসে কখনোই ছুঁয়ে দেয়া হবেনা মেয়েটাকে। কিন্তু যখন নিলাশাই নিজ থেকে ওকে ছুঁয়ে দিয়েছে, তখন একবারের জন্যও খারাপ লাগেনি রিফাতের। এই যে মেয়েটা প্রতি রাতেই ওর বুকে মাথা রেখে ঘুমায়, সেজন্য পুরো রাত পাশ ফিরতে পারেনা ও। তবুও একটা বারের জন্যও বিরক্ত হয়না রিফাত। বরং মনে হচ্ছে, ও বোধহয় নিলাশার এমন আচরণের সাথে অভ্যস্ত হতে চলেছে। হয়তো এমনটাই চলবে রাতের পর রাত। এভাবেই কেটে যাবে অনেকগুলো বছর। এভাবে চলতে চলতে নিলাশাকে একদিন ঠিকই নিজ থেকে ছুঁয়ে দেবে রিফাত। আজকের এই অনাকাঙ্খিত ভালোবাসাই রূপ নেবে কাঙ্খিত ভালোবাসায়। যে ভালোবাসার অনলে দগ্ধ হয়ে দু’জন নারী-পুরুষ একে-অপরের কাছে নিজেকে সঁপে দেবে। রিফাত আজকাল অনেক ভেবে এটা আবিষ্কার করেছে, ভালোবাসা বড্ড সংক্রামক। পাশাপাশি দু’জন মানুষ বসবাস করতে গেলেই, একজনের ভালোবাসা সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় আরেকজনের মধ্যেও ধীরে ধীরে সংক্রামিত হয়। এই ব্যাধি থেকে মুক্তি নেই কভু কারও। মরণঘাতী ব্যাধির থেকেও ভালোবাসা নামক সংক্রামক ব্যাধি ভয়ংকরভাবে মানুষের অস্থিমজ্জায় মিশে যায়। তিলে তিলে দখল করে নেয় অপরজনের তনু-মন। তখন সেই মানুষটা পুরো দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে করে নিমেষেই।
অনেকক্ষণ থেকেই নিলাশার চুল রিফাতের মুখমন্ডলে আলিঙ্গন করতে চাইছে। সিলিংফ্যানের বাতাসে তারা অবাধে এদিক-ওদিক নাচানাচি করছে। রিফাত কয়েকবার মাথা এপাশ-ওপাশ করেছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। রিফাতের চিন্তার মাঝেই একগোছা চুলে ওর নাকে সুড়সুড়ি লাগে। উদ্রেগ হয় হাঁচির। রিফাত চেষ্টা করেও হাঁচি রুখতে পারলনা। হাঁচির সাথে সাথে নড়ে উঠল ওর পুরো শরীর। ঘুম ভেঙে গেল নিলাশার। হাঁই তুলে নিলাশা উঠে বসল। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

” এভাবে নড়াচড়া করছেন কেন? আমার ঘুম কি আপনার শরীরে এলার্জি ডেকে আনে? একটা রাতও আপনার নড়াচড়ার জন্য নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারিনা। ”

নিলাশার অভিযোগ শুনে রিফাতের চোখ কপালে উঠল। এ কি সৃষ্টিছাড়া অভিযোগ! বিনা অপরাধে মেয়েটা ওকে কাঠগড়ায় তুলছে, এটা ওর ইগোতে লাগল৷ শান্তশিষ্ট রিফাতও হঠাৎই প্রতিবাদী হয়ে উঠল৷

” আমি মোটেও নড়াচড়া করিনি। তুমিই বরং আমার বুকে হুমড়ি খেয়ে ঘুমাচ্ছিলে। আর এই সুযোগে তোমার অবাধ্য চুলগুলো আমাকে খোঁচাচ্ছিল। তাই হাঁচি এসে গিয়েছে। তোমার ঘুমে আমার এলার্জি নেই বরং তুমি ঘুমালে তোমার পক্ষ থেকে তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার সাথে পরোক্ষ যুদ্ধে নামে। রাতের এই কয় ঘন্টা তোমার মুখ বন্ধ থাকে জন্য, তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার বিপক্ষে যায়। কোন কিছুতেই তোমাকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। ”

” মিথ্যা বলবেননাতো। আমি কোন দুঃখে আপনার বুকে ঘুমাব! এত বড় বিছানা থাকতে, আপনার খটখটে বুকে যাওয়ার ইচ্ছে আমার মোটেও নেই। তবে আমার মনে হচ্ছে, আপনিই বোধহয় চাচ্ছেন আমি আপনার বুকে মাথা রাখি। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছেননা। দেখি সরুন, আমাকে ঘুমাতে দিন। ” নিলাশা ধপ করে শুয়ে পরল রিফাতের পাশে। এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়েও গেল।

নিলাশার কথা শুনে রিফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। এরপর নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করল।

গভীর রাতে আবারও নিজের বুকে নিলাশার অস্তিত্ব টের পায় রিফাত। ঘুমের মধ্যেই ও জড়িয়ে ধরল নিলাশাকে। রিফাতের স্পর্শ পেয়ে নিলাশা হেসে ঠোঁট ছোঁয়াল রিফাতের বুকে। সেকেন্ডেরও কম সময় স্থায়িত্ব হল সেই চুমুর। যেটা রিফাতের পক্ষে বোঝা কখনোই সম্ভব নয়।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫০
জাওয়াদ জামী জামী

একমাস পেরিয়ে গেলেও পুলক মাহমুদ, রায়হানের খুণির কোন সন্ধান পায়না। তবে পুলক খুণীর খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকে। যেকোন মূল্যেই খুণীকে পেতে চায় পুলক। তার সাথে হিসেবনিকেশ করতে চায় সে। খুণীকে না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেনা কিছুতেই।

” এত গভীরভাবে কি চিন্তা করছেন? সারাদিন জনসেবা করে বাসায় এসেও কিসের এত চিন্তা! জনগণের জন্য যে এত চিন্তা করেন, বাসায় আপনার একটা বউ আছে সে চিন্তা কি করেন কখনো? ”

আশফির কথা শুনে চমকে উঠল পুলক। সত্যিই এ কয়দিনে ঠিকঠাক মেয়েটার খোঁজ নেয়া হয়নি। অসুস্থ মেয়েটার পাশে একদণ্ড বসার সময় পায়নি। বড্ড অন্যায় করেছে সে মেয়েটার সাথে। নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে তার। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে হাত বাড়িয়ে আশফিকে কাছে টেনে নেয় সে। মূহুর্তেই পুলকের বাহুবন্ধনে বাঁধা পরে যায় আশফি। পুলক বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আশফির বুকে মাথা রাখল। আশফি দাঁড়ানো অবস্থাতেই পুলকের চুলে আঙুল চালায়।

” সরি, বউ। তোমার সাথে অনেক বেশিই অন্যায় করেছি। যেটা আমার উচিত হয়নি মোটেও। এই গুরু অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। যদি তুমি শাস্তি দিতে চাও। ” মিনমিন করে বলল পুলক।

” আমি আপনাকে শাস্তি দেবার কে! আপনাকে শাস্তি দেবে আপনার রাজপুত্র। আমি বাপু এসবে নেই। ” বিরক্তি নিয়ে বলল আশফি।

” কেন থাকবেনা? থাকতে তোমাকে হবেই। তোমার একটামাত্র বর গত একমাস তোমার দিকে নজর দেয়নি, এটার শান্তি তার পাওনা। বল কি শাস্তি দেবে? ” আশফির বুকে মুখ গুঁজে বলল পুলক।

অনেকদিন পর পুলকের স্পর্শ পেয়ে শিরশির করে উঠল আশফির সর্বাঙ্গ। আবেশে শরীর থমকে গেল এক লহমায়। এই মানুষটার সংস্পর্শে আসলে শরীর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা কিছুতেই। সে মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় পুলকের দ্বারা চালিত হয়। এই মানুষটাকে কষ্ট দেয়া আশফির পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

” আপনি ভালো করেই জানেন, আমি আপনাকে ফুলের টোকাটিও দিতে পারবনা। যেখানে আপনার সাথে জোর গলায় কথা বলতেই পারিনা। আমার পুরো অস্তিত্ব বিদ্রোহ করে বসে, সেখানে আপনাকে শাস্তি দেই কেমন করে বলুনতো? ”

আশফির কথা শুনে হাসল পুলক। মুহুর্মুহু চুমুতে ভরে দিল আশফির পুরো শরীর। আবেগে আশফি চোখ বুজল।

***

” ভাই, আজকের প্রোগ্রামের কথা মনে আছে? তিনটার মধ্যেই আমাদের অকুস্থলে পৌঁছাতে হবে। ”

রাকিবের ফোন পেয়ে মাথা চুলকায় পুলক সত্যিই ও আজকের প্রোগ্রামের কথা ভুলে বসেছিল। কৈফিয়তের সুরে রাকিবকে বলল,

” মনে করে দিয়ে ভালো করেছিস। আমি সত্যিই ভুলে গেছি। আজকাল এত ব্যস্ত থাকছি যে দিনদুনিয়া ভুলে যাচ্ছি। তোরা সবাই তৈরী থাকিস, আমি যথাসময়ে ক্লাবে পৌঁছে যাব। সেখান থেকেই রওনা দেব প্রোগ্রামে। ”

” ওক্কে, ভাই। ”

***

প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। পুলক একটা সেতু উদ্বোধন করে মঞ্চে এসে বসেছে। তার সাথে স্থানীয় নেতৃবৃন্দও আছে। একে একে তারা সবাই ভাষণ দিচ্ছে। জনগণ অধির আগ্রহে পুলকের ভাষণের অপেক্ষা করছে। কিন্তু পুলকের মন খুব একটা ভালো নেই। ওর বড় চাচ্চুর প্রোগ্রামে আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বর্তমানে অসুস্থতার কারনে কানাডায় অবস্থান করায় প্রোগ্রাম মিস করে গেলেন। পুলক তাকে সে কথা জানালে, তিনি বারবার পুলককে উৎসাহ দিয়েছেন প্রোগ্রামের ব্যাপারে। ইভেন কিছুক্ষণ আগেও তিনি পুলকের সাথে কথা বলেছেন৷ পুলক বড় চাচ্চুর কথায় ভরসা পেয়েছে। সে বড় চাচ্চুকে ভিডিও কলে রেখে ভাষণ দিতে চায়। কামরান মির্জাও তাতে রাজি হন। তিনিও মনেপ্রাণে চান পুলক মির্জা একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ হয়ে উঠুক। দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করুক।

পুলক মির্জা মঞ্চে উঠলে জনগন করতালির মাধ্যমে ওকে স্বাগত জানায়। আজ নিজের চোখে নিজের জনপ্রিয়তা দেখে পুলকের খুব একটা খারাপ লাগলনা। ছোটবেলা থেকেই ও এমন একটা দিনের স্বপ্ন দেখত। দাদু সব সময়ই বলত, তুমি একদিন যোগ্য নেতা হবে। দাদুর কথাই ওকে অনুপ্রেরণা দিত। ছোটবেলা থেকেই দাদুর আশেপাশে থাকতে থাকতে শিখে গিয়েছিল রাজনীতির মারপ্যাঁচ। শিখেছিল মুখোশে আঁটা মানুষকে চেনার উপায়।

পুলক মির্জা ভাষণ শুরু করতেই জনগণ শান্ত নদীর মত নিশ্চুপ হয়ে যায়। তারা আগ্রহভরে শুনতে থাকে পুলক মির্জার কথা। এমন পুরুষালী কণ্ঠস্বর যেকারো বুকে আগুন ধরাতে পারে নিমেষেই।

পুলক মির্জা কতক্ষণ ভাষণ দিচ্ছে সেটা বলতে পারেনা কেউই। ভাষণের মাঝেই সাকিবের ডাকে ওর দিকে ফিরে তাকাতেই ঝনঝন শব্দে ভেঙে পরল পুলকের পাশে থাকা কাঁচের গ্লাস। হতভম্ব পুলক বিষয়টা বুঝতে কয়েক মুহুর্ত সময় নেয়। কিন্তু সে সাবধান হওয়ার আগেই আরেকটা গুলি এসে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয় পুলকের বুকের ডানপাশের নিচের অংশ। ঘোলাটে চোখে পুলক তাকায় ক্ষতস্থানে। গলগল করে রক্ত ঝরছে। অবশ হয়ে আসছে শরীর। পা টলমল করছে। ভূপাতিত হবে যেকোন মুহূর্তে। কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে পুলক। কিন্তু ওকে হতাশ করে আরেকটা গুলি এসে বিঁধে ওর বাম কাঁধে।

পুলকের গ্যাংসহ সকল জনগণ হাহাকার করে উঠল। তারা হুড়মুড়িয়ে মঞ্চে উঠার চেষ্টা করছে। সাকিবসহ সবাই ভীড় ঠেলে মঞ্চে উঠল। ওরা প্রানের ভয় না করে এগিয়ে যায় পুলকের দিকে। পুলক নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। ওর চারপাশে গুলির বৃষ্টি হচ্ছে। একটা গুলি বিঁধল সাকিবের পায়ে। গুলি খায় রকি।

ভিডিও কলে সব দেখছেন কামরান মির্জা। তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন আর সাকিবদের ডাকছেন পুলককে সাহায্য করার জন্য। তিনি ভালো করেই জানেন তার কথা এই মুহূর্তে কেউ শুনছেনা। কিন্তু তিনি ডাকতেই থাকলেন। চোখের সামনে প্রানপ্রিয় ভাতিজাকে মেঝেতে লুটাতে দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারছেননা।

***

রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটে চলেছে এ্যাম্বুলেন্স। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল। তবে প্রথমে ওরা রাজশাহী যাবে। সেখান থেকে প্লেনে ঢাকা যাবে। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছে পুলক। যেকোনো মুহূর্তে ওর প্রানপাখি খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিতে পারে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকলেও ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পুলকের পাশে বসে আহাজারি করছে মল্লিকা মির্জা। তার পাশে আশফি নির্বাক হয়ে বসে আছে। ওর চোখে পানি নেই এক ফোঁটা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুলকের দিকে। ওর নির্বাক চোখদুটোয় যে কতশত অভিমান জমে আছে সেটা কারও ধরার সাধ্য নেই। যখন শুনল, পুলকের গুলি লেগেছে তখন ওর পুরো দুনিয়া টলে গিয়েছিল। তারপর যখন শুনল, ডক্টররা কিছু করতে পারছেনা, তখন ওর ভেতরটায় ছলকে উঠেছিল ভয়েরা। ওকে সাথে করে নিয়ে আসতে চাইছিলনা কেউ। কিন্তু ওর জেদের কাছে হার মানতে হয় সকলকেই।

***

রাকিবের ফোন পেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল শাহেদ। কিছুক্ষণ পর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর কান্না দেখে কলিগরা এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে কলিগদের সবকিছু খুলে বললে, তারা শাহেদকে নিয়ে মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তিয়াসাকে ফোন করে মেডিকেলে আসতে বলে।

***

রিফাত নিলাশাকে নিয়ে ঢাকা রওনা দিয়েছে। ওর চোখমুখ শুকনো। চিন্তায় মাথা কাজ করছেনা। নিলাশাও কাঁদছে। বারবার ফুপুর মুখখানা চোখে ভাসছে। সেই সাথে চিন্তা হচ্ছে আশফির জন্য, তার অনাগত সন্তানের জন্য।

” ভাইয়া তোমাকে সুস্থ হতেই হবে। তুমি ছাড়া ভাবী আর প্রিন্সের কি হবে? তোমাকে ছাড়া তারা অসহায়। আর ফুপু, তার প্রান তুমি। ফুপাকে হারিয়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে সে। তোমার কিছু হয়ে গেলে ফুপুও যে বাঁচবেনা ভাইয়া। পুষ্পিতাও না মরে বেঁচে থাকবে। ” নিলাশা কাঁদছে আর বিরবির করে বলছে।

নিলাশার কথা শুনতে পেয়ে রিফাত ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরল। ও কিভাবে নিলাশাকে শান্তি শান্তনা দেবে, যেখানে ওর নিজেরই শান্তনার প্রয়োজন।

” আজ পথ শেষ হচ্ছেনা কেন? পথও কি আমাদের সাথে শত্রুতা করছে? আমাদের সাথে তার কিসের শত্রুতা? ” নিলাশা অবুঝের মত জিজ্ঞেস করল।

” শান্ত হও, নিলাশা। ছোটবেলায় শুনতাম গুরুজনেরা বলত, বিপদের পথ দীর্ঘ হয়। আমাদের সাথেও বোধহয় এটাই হচ্ছে। কিন্তু দেখো একসময় এই দীর্ঘ পথও শেষ হয়ে যাবে। আমরা পৌঁছাব পুলকের কাছে। ”

” ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে তো? ”

নিলাশার প্রশ্নে কেঁপে উঠল রিফাতের বুক। কি উত্তর দেবে সে নিলাশার প্রশ্নের? যেখানে ওর নিজেরই সংশয় আছে। সেখানে সে কিভাবে নিলাশাকে শান্তনা দেবে?

চলবে…