রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৫১+৫২

0
134

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫১
জাওয়াদ জামী জামী

গত তিনদিন ধরে পুলক আইসিইউ’তে মড়া’র মত শুয়ে আছে। ডক্টর এখন পর্যন্ত পজিটিভ কিছু বলতে পারেনি। আশফি পুলকের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যেই সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। মল্লিকা মির্জা ছেলে আর পুত্রবধূর চিন্তায় দিশেহারা হয়ে গেছেন। কখনো ছেলের জন্য হাউমাউ করে কাঁদছেন তো কখনো আশফি আর তার অনাগত সন্তানের জন্য কাঁদছেন। স্বামীকে হারিয়ে তিনি যতটা না ভেঙে পড়েছিলেন, ছেলে আর ছেলের বউয়ের চিন্তায় তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি ভেঙে পড়েছেন তিনি।

শাহেদ অফিস থেকে সোজা মেডিকেলে আসে। আইসিইউ’র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ছলছল চেখে। কারও সাথে কথা বলেনা। মল্লিকা মির্জার সাথেও না। ওর প্রানপ্রিয় ভাইয়ের এমন দশা সহ্য করতে পারছেনা কিছুতেই। তিয়াসা প্রতিদিন রান্না করে মেডিকেলে সবার জন্য খাবার নিয়ে আসছে। নিলাশাও ওকে সাহায্য করছে। ও রাতে তিয়াসার বাসাতেই থাকে। শুধু রিফাত, শাহেদ আর পুলকের দু’জন গ্যাং মেম্বার মেডিকেলে থাকছে। মেয়েরা সবাই শাহেদের বাসায় থাকে।

রিফাত আশফির হাত ধরে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে আশফি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরলে রিফাত অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। রিফাত আশফির এমন অবস্থা সহ্য করতে পারছেনা। ডক্টর বলেছে, এভাবে চলতে থাকলে যেকোন মুহূর্তে আশফির মিসক্যারেজ হতে পারে। কেউ কোনভাবেই আশফিকে শান্তনা দিতে পারছেনা। মেয়েটা কারও কথাই কানে নিচ্ছেনা। বারবার শুধু পুলককে দেখতে চাচ্ছে।

” ভাইয়া, আপনি আজ বাসায় যান। গত তিনদিন আপনার ঠিকমত খাওয়াদাওয়া, গোসল কিছুই হয়নি। আমি ততক্ষণ ভাবীর কাছে আছি। ” শাহেদ এসে রিফাতকে বলল।

শাহেদকে দেখে রিফাত করুন চোখে তাকায়। ওর পুরো মুখে হতাশার ছাপ দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শাহেদ। রিফাতের ভেতরটা যেন ও পড়তে পারছে। অসহায় এক বোনের জন্য এক ভাইয়ের অন্তর্দহন ওর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ধরা পরেছে। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা বলল রিফাত।

” আমি ঠিক আছি। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। আশফি, পুলক ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়বনা। ”

” প্লিজ ভাইয়া, জিদ করবেননা। ভাই-ভাবীর জন্য চিন্তা আমাদেরও হচ্ছে। এভাবে অনিয়ম করে আপনি অসুস্থ হয়ে গেলে নিলাশাকে আমরা কি জবাব দেব বলুনতো? ভাবী সুস্থ হওয়ার পর যদি জানতে পারে, তাকে আমরা কি বলব? অন্তত ভাবীর জন্য আপনি নিজের দিকে নজর দিন। ” শাহেদ অনুনয় করল।

” আমি পারছিনা, শাহেদ। বোনটাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা। আবার পুলকের দিকে তাকালেও আমার ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। আমার বোনটা ছোটবেলা থেকেই কষ্ট পেয়েছে। বিয়ের পর পুলক ওকে অধরা সুখ এনে দিয়েছে। অনেক বছর পর বোনটার মুখে সুখের হাসি দেখেছিলাম আমি। সেই বোন আবারও নতুনভাবে কেন কষ্ট পাচ্ছে বলতে পার? ” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রিফাত।

রিফাতের চোখের পানি শাহেদের অন্তরও স্পর্শ করল। তার চোখেও জমা হল বেদনার নোনা জল। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

” কাঁদবেননা, ভাইয়া। একবার ভাই সুস্থ হয়ে উঠুক, তাকে আর রাজনীতিতে জড়াতে দেবনা। দিনের পর দিন এভাবে টেনশন নিতে পারবনা।
আর ভাবীকেও কষ্ট পেতে দেবনা কিছুতেই। চোখ মুছুন। বাসায় যান, নিলাশা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি বাসায় না গেলে ও আমার মাথার চুল একটাও রাখবেনা। ”

” তোমার সন্দেহ হয়না, শাহেদ? ”

রিফাতের প্রশ্নে চমকে ওর দিকে তাকায় শাহেদ। শাহেদের চোখে অবিশ্বাস। দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল,

” আমি সবটা জানি সেটা আপনি জানলেন কীভাবে! ”

” তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। সিনিয়র- জুনিয়রদের মধ্যে তোমার আই-কিউ হাই লেভেলের ছিল। তোমার পক্ষে জানাটা অসম্ভব নয়। ”

” তিয়াসাকে আমি ভালোবাসি, ভিষণই ভালোবাসি। ভালোবাসা যেখানে প্রকট, সেখানে সন্দেহের কোনই স্থান নেই। আমার ভালোবাসার মধ্যে কোন ফাঁক-ফোকর নেই, যেখান দিয়ে সন্দেহ প্রবেশ করতে পারে। আপনি নিঃসংকোচে বাসায় যেতে পারেন। বোনের বাড়িতে বড় ভাই যাবে, এতে সন্দেহের কোন কারন আমি দেখিনা। ”

” তুমি সবার থেকে আলাদা। তিয়াসা ঠকেনি বরং ও ভাগ্যবতী। ”

” ভালো কথা, ছোট বোনের বাড়িতে প্রথমবার যাচ্ছেন, খালি হাতে যাবেননা কিন্তু। আমার বউয়ের পছন্দের খাবার নিয়ে যাবেন, সাথে আপনার বউয়েরও। নয়তো আমার বউয়ের ভাগে কিছুই থাকবেনা। ”

শাহেদের কথা শুনে হাসল রিফাত। ধীরেসুস্থে আশফির হাত ছেড়ে কেবিনের বাহিরে পা
বাড়ায়।

***

দরজা খুলে রিফাতকে দেখে তিয়াসা অবাক হয়ে গেছে। ও ভাবতেই পারেনি রিফাত ওদের বাসায় আসবে। দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে রিফাতকে ভেতরে ঢুকতে বলল,

” ভেতরে এস। আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা তুমি এসেছ। ”

” বিশ্বাস না হলেও ক্ষতি নেই। কারন আমি সত্যিই এসেছি। এগুলো ধর। তোর পছন্দের খাবার আছে। ”

” এসবের কি দরকার ছিল, ভাইয়া? তুমি এসেছ এটাই অনেক। ”

” আমি ভিষণ টায়ার্ড, আগে গোসল করব। ওয়াশরুম দেখিয়ে দিবি? ” তিয়াসার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল রিফাত।

” আমার সাথে এস। তবে তার আগে নিলাশার সাথে দেখা কর। বেচারি সারাটাদিন তোমার নাম জপে। ও যদি জানতে পারে, ওর সাথে দেখা না করেই ওয়াশরুমে গেছ তবে আমার সাথে নির্ঘাত ঝগড়া করবে। ”

তিয়াসার কথা শেষ হওয়া মাত্রই নিলাশা ড্রইংরুমে আসল। ও রিফাতকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসল।

” বাব্বাহ, অবশেষে আসলেন। ভাবী কেমন আছে? ”

” সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। ডক্টর এসে দেখে গিয়েছিল। আমি আসার আগ পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিল। ”

” নিলাশা, তুমি ভাইয়াকে রুমে নিয়ে যাও। ভাইয়া ফ্রেশ হয়ে আসুক, ততক্ষণে আমি টেবিলে খাবার দেই। ”

তিয়াসা রান্নাঘরে গেলে রিফাত নিলাশার পিছুপিছু রুমে ঢুকল।

***

নয়দিন পর পুলকের জ্ঞান ফিরল। ডক্টর জানিয়েছে, ও এখন শংকা মুক্ত। ওকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। খরবটা শুনে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সবাই দুই রাকাআত নফল নামাজ আদায় করে পুলক আশফির জন্য দোয়া করল। পুলকের সুস্থ হওয়ার খবর শুনে আশফি ওর সাথে দেখা করার জন্য বায়না ধরল। মল্লিকা মির্জা হাসিমুখে আশফিকে পুলকের কাছে নিয়ে গেলেন।

কেবিনে ঢুকে পুলককে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল আশফি। এখনো তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে। হাতে স্যালাইন দেয়া। চোখ বন্ধ করে আছে। বোধহয় ঘুমাচ্ছে। তার মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে ক্লান্তিতে ভরপুর তার শরীর।

মল্লিকা মির্জা একটা চেয়ার টেনে বেডের পাশে আশফিকে বসিয়ে দিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু খেলেন। এরপর কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।

পুলকের স্যালাইন দেয়া হাতে আলতোভাবে হাত রাখল আশফি। উপুর হয়ে নিজের গালে পুলকের হাতের ছোঁয়া নিল। উপর্যুপরি চুমু দিল পুলকের রুগ্ন হাতে। কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরল পুলকের হাতে।

আধোঘুমে থাকা পুলক বুঝতে পারছে কেউ ওর পাশে এসে বসেছে। হয়তোবা কাঁদছেও। কিন্তু চোখ খোলার মত অবশিষ্ট শক্তি ওর শরীরে নেই। জানতে ইচ্ছে করছে মানুষটা কে। কিন্তু শরীরের সাথে পেরে উঠছেনা। অথচ সেই মানুষটার ছোঁয়া ক্রমশ ওর চোখ, কপালে অনুভব করছে। এ ছোঁয়া তার বড্ড চেনা। পুলক মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করছে, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে ওর কপাল ভিজে যাচ্ছে পানিতে।

আচমকাই চোখ খুলল পুলক। অনেক চেষ্টার পর চোখ খুলতে পেরেছে। শরীরের ক্লান্তিকে পরাজিত করে কৌতুহলের জয় হল। অতি পরিচিত মুখখানা দেখে পুলকের হৃদয় ছলকে উঠল। কতদিন পর এই মুখখানা দেখছে। শ্যামলা মুখখানায় আগের সেই লাবন্য নেই। সেখানে ঠাঁই পেয়েছে ভয়, দুঃখ আর হতাশা। চোখদুটোও ফোলা ফোলা। বোধহয় খুব কেঁদেছে।

” বোকা পাখি। ” অনেক কষ্টে এতটুকুই বলতে পারল।

যেন বহুদূর থেকে কেউ আশফিকে ডাকল। আশফির বুক ধড়ফড়িয়ে উঠল। ওর ব্যাকুল চোখদুটো তাকাল পুলকের দিকে। মানুষটা ঢুলুঢুলু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পুলকের মুখে ‘ বোকা পাখি ‘ ডাক শুনে আশফি হু হু করে কেঁদে উঠল। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,

” এত কষ্ট কেন দেন? কেন বোঝেননা আপনাকে ছাড়া আমি শূন্য? ”

পুলক কিছু না বলে হাতের ইশারায় আশফিকে ওর বুকে মাথা রাখতে বলল। আশফি পুলকের ইশারা পাওয়া মাত্রই ওর বুকে মাথা রাখল। উত্তেজনার বশে ও ভুলেই গেছে, যেখানে ও মাথা রেখেছে তার ঠিক নিচে একটা বড় ক্ষত পীড়া দিচ্ছে পুলক মির্জাকে।

একটু জোড়ে আশফির মাথা স্পর্শ করল পুলকের বুক। সাথে সাথেই চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পরল পুরো শরীরে। ব্যথায় নীল বর্ণ ধারন করল পুলকের ফর্সা মুখখানি। অস্পষ্ট স্বরে ‘ আহ্ ‘ বলে একহাতে জড়িয়ে ধরল তার বোকা পাখিকে। এই সুখের কাছে ব্যথার কোন স্থান নেই।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫২
জাওয়াদ জামী জামী

প্রায় একমাস ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা শেষে আজ বাসায় ফিরবে পুলক। এই একমাস মল্লিকা মির্জা, আশফি, পুষ্পিতা ঢাকায় আছে। তারা কেউ এক মুহূর্তের জন্য পুলককে কাছ ছাড়া করেনি। রিফাত নিলাশাকে নিয়ে চিটাগং ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে ও ঢাকা এসেছে। সাথে নিলাশাকেও নিয়ে এসেছে। নিলাশার ইচ্ছে সে-ও আশফিদের সাথে যাবে। কিন্তু রিফাত রাজি হচ্ছেনা। অবশ্য হাল ছাড়বার পাত্রীও নিলাশা নয়। সে নানানভাবে রিফাতকে বোঝাচ্ছে। রিফাতের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে। কিন্তু রিফাত ওর কথা শুনেও না শোনার ভান করে আছে।

” ও সোয়ামী, শুনছেন? কিছুতো বলুন। গতকাল পর্যন্ত আমি জেনে এসেছি, আপনার কানের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আজকে কি এমন ঘটল যে বয়রার ভূমিকা পালন করছেন! ও জামাই, কথা কন। ”

নিলাশার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে রিফাতের। যতই ও মনে করে মেয়েটাকে মাঝেমধ্যে ধমক দেবে, কিন্তু ওর কথা শোনার পর সেটা আর হয়ে ওঠেনা।

” আমার কান ঠিকই আছে। সমস্যা তোমার গলায়। কারনে-অকারনে ভাঙা টেপরেকর্ডারের মত বাজতে থাকে। ” রিফাত একটু কড়া গলায় বলার চেষ্টা করল।

” তা-ও তো ফ্রীতে একটা টেপরেকর্ডার পেয়েছেন। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়! যখনই মন চাইবে তখনই শুধু রেকর্ড বাজাতে বলবেন, ব্যাস শুরু হয়ে যাবে। ” নিলাশা রিফাতের রাগকে মোটেও পাত্তা দিলনা। সে নির্ভয়ে বলল।

” মাফ চাই। এমন টেপরেকর্ডার সময়ে-অসময়ে না বাজলেই ভালো হয়। এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ” রিফাত ব্যঙ্গ করে বলল।

” ভুল বললেন, মন্টুর বাপ। আজকে আপনার এই টেপরেকর্ডার অসহ্য লাগতেই পারে। কিন্তু এমন একদিন আসবে যেদিন আপনি এটা শোনার জন্য অস্থির হয়ে যাবেন। আপনার শারীরিক মানসিক দুটোরই প্রশান্তির জন্য এই টেপরেকর্ডারের ভিষণ প্রয়োজন পরবে। ধলা মিঞা, আমি যাই হ্যাঁ ফুপুর সাথে? ” গভীর আবেগ নিয়ে কথাগুলো বলল নিলাশা।

এক কথার মাঝে আরেক কথা বলায় প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খায় রিফাত। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারল তখন কপাল চাপড়াল।

‘ তুমি এসব কি নামে ডাকছ? মন্টুর বাপ কে? আর ধলা মিঞাই বা কে? ”

‘ মন্টুর বাপ আপনি। মানে মন্টু আপনার আর আমার প্রথম সন্তান। আমার নাড়ী ছেঁড়া আদরের ধন। ধলা মিঞা স্বয়ং আপনি। আমার মন্টু, কমলা, পঁচা, শুটকি, জরিনা, আব্বাসের বাপ। অবশ্য আপনি চাইলে পুঁটি, টেপা, ফটিক, এরাও আসবে। সিদ্ধান্ত আপনার ওদেরকে দুনিয়ায় ল্যান্ড করানোর দ্বায়িত্ব আমার। ” রিফাতকে বাম চোখ মেরে বলল নিলাশা। ওর চোখেমুখে খুশির ঝলক। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।

নিলাশার দিকে তাকিয়ে চোখমুখ লাল হয়ে যায় রিফাতের। মেয়েটা দিন দিন বেয়াড়া হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু ওকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা কিছুতেই। রিফাত চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নিলাশার কথা শুনেছে কি না। যখন দেখল ওদের দিকে কেউ তাকিয়ে নেই, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

” তুমি আমার সাথে চিটাগং যাবে, দ্যাট’স ইট। তৈরী হয়ে নাও। ”

” ও আব্বাসের বাপ, যাইনা। কতদিন গ্রামে যাইনি। বাবাকে দেখিনি, শ্বাশুড়িআম্মা’কে দেখিনি। প্রমিজ করছি, আমি সাতদিনের বেশি সেখানে থাকবনা। ”

” তুমি কোথাও যাচ্ছনা। আমার সাথেই চিটাগং যাবে। আমি আগামী দুই-তিন মাস কোনও ছুটি পাবোনা। তোমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসবে কে? দুইমাস পর তোমাকে নিয়ে বাড়িতে যাব। ”

” আমার কাছে সলিউশন আছে। আমি ফুপুর সাথে নাটোর পর্যন্ত যাব। আর ভাইয়া বাসায় গেলে বাবা অবশ্যই ভাইয়াকে দেখতে আসবে। তখন আমি বাবার সাথে বাড়িতে যাব। সেখানে কয়েকদিন কাটিয়ে পৃথা, পিয়াসকে নিয়ে চিটাগং যাব। এই সুযোগে ওরাও চিটাগং ঘুরতে পারবে আর আপনাকেও কষ্ট করে বাড়িতে যেতে হবেনা। ”

নিলাশার সলিউশন শুনে রিফাত হা করে তাকিয়ে থাকে। রিফাত লক্ষ্য করল নিলাশা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটার হাসি হাসি মুখখানায় শরতের মেঘ দেখতে চাইলনা রিফাত। বাধ্য হয়ে ওকে রাজি হতেই হল।

” ওকে, তুমি গ্রামে যাবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে চারদিনের বেশি থাকতে পারবেনা। ছোটমার সাথে কোনরূপ বিতণ্ডায় জড়াবেনা। মনে থাকবে? ”

” শুনলাম। কিন্তু কতক্ষণ মনে থাকবে সেটা বলতে পারছিনা। অবশ্য মনে থাকাটা শ্বাশুড়িআম্মার ওপরও কিছুটা নির্ভর করছে। আমি মানুষের পাওনা সাথে সাথে মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। পাওনা বাকি রাখাটা আমার কাছে ছোটলোকি মনে হয়। ”

” তার মানে তুমি ছোটমার সাথে ঝগড়া করবে? তাহলে তোমার বাড়িতে যাওয়া হবেনা। ”

” একটু আগেই আমাকে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন। আমি সেটাই মানব। আর ভদ্রলোকের এক জবান, এটা জানেননা অথচ নিজেকে ভদ্রলোক দাবী করেন! ”

” আমি চাইনা গ্রামের মানুষজনের মনে তোমার সম্পর্কে খারাপ ধারনা জন্মাক। এরা বেশিরভাগই পরচর্চায় পারদর্শী সেটা কি তুমি জানো? ”

” যে যা খুশি বলুক। আমি শুধু আমার পুঁটির বাপের অধিকারের জন্য লড়ছি, এটাই আমি মনে করি। যতদিন আপনার অধিকার আদায় করতে না পারব, ততদিন প্রতিবাদ চলবেই। ”

” তারমানে তুমি আমার কথা শুনবেনা? ”

” এই কথা বাদে অন্য সব কথা শুনব। কিন্তু আপনি শুধু এই একটা কথা নিয়েই ঘ্যানঘ্যান করেন। অন্য কিছুও তো বলতে পারেন। আমি শোনার জন্য অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি। ”

” তুমি যে বাড়িতে যাবে, সেখানে তোমার জামাকাপড় আছে? সাথে করে নিয়ে এসেছ কিছু? ”

” চিন্তা নট। সাতদিনের কাপড় নিয়েই বাসা থেকে বের হয়েছি। আমি আবার এসব বিষয়ে পারদর্শী। ”

” তারমানে তুমি আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলে! আর আমি কিছুই বুঝতে পারিনি! তুমি বুদ্ধিমতি এটা স্বীকার করতেই হবে। ”

” এত বুদ্ধি থেকে কাজের কাজ কি হল, বলুনতো? আপনিই তো আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। বুদ্ধি দিয়ে বোধহয় কারও মন জয় করা যায়না। বুদ্ধি শুধু পড়াশোনায় খরচ করতে হয়। ”

” ওরা বোধহয় তৈরী হয়ে গেছে। তুমিও তৈরী হয়ে নাও। ”

রিফাত পালিয়ে বাঁচল। নিলাশার কথার পিঠে উত্তর দেয়ার মত কোন কথা ওর জানা নেই। রিফাতকে পালাতে দেখে হাসল নিলাশা। বিরবির করে বলল,

” পালিয়ে আর কোথায় যাবেন? সেই তো আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। আপনি যত পালাবেন আমি আপনাকে ততই আঁকড়ে ধরব। আমার ভালোবাসার জালে আপনি বাজেভাবে জড়িয়ে গেছেন, মহাশয়। চাইলেও জাল কেটে বেড়োতে পারবেননা। যতই ছাড়াতে যাবেন আমার ভালোবাসার জাল আপনাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিবে। ”

***

” আম্মু, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পুষ্পিতার বিয়ে দেব। তুমি অয়নের বাবা-মা’র সাথে কথা বল। ” পুলক মল্লিকা মির্জাকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল।

” তুমি কি কোন কারনে ভয় পাচ্ছ, বেটা? ” মল্লিকা মির্জা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন।

” ঠিক ভয় নয়, আম্মু। আমি পুষ্পিতার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। বিয়ের পর অয়ন ওকে নিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলে আমি একটু স্বস্তি পাব। কাউকেই আর এখন বিশ্বাস করতে পারছিনা, আম্মু। একবার ভাগ্য আমার সাথে ছিল বলে, বারবার সাথে থাকবে এমনটাতো নয়। আব্বুর অবর্তমানে পুষ্পিতার ভালোমন্দ দেখার দ্বায়িত্ব আমার। তুমি দুই-এক দিনের মধ্যেই আংকেল-আন্টির সাথে কথা বল। আর দেরি করোনা। ”

” তুমি কি আবারও রাজনীতিতে জড়াবে, বেটা? ফিরে এস। তোমার বাবাকে হারিয়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। কিন্তু তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বলতো? একবারও কি তুমি বউমার কথা চিন্তা করেছ? তোমার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করেছ? তোমার অবর্তমানে তাদের কি হবে, সেটা কি একবারও ভেবেছ? মেয়েটা তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। ”

” আমি সবকিছুই ভেবেছি, আম্মু। রাজনীতি থেকে আমি বেরিয়ে আসব। তবে তার আগে আব্বুর মৃত্যুর বদলা নিব। আমার ওপর কে গুলি চালিয়েছে সেটা খুঁজে বের করব। আমি এর শেষ দেখতে চাই। আড়াল থেকে কে খেলছে তাকে দেখতে চাই। আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপত্তা দিতে চাই। ”

মল্লিকা মির্জা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছেন পুলক এবার সহজে থামবেনা। আর তাকে থামানোর মত কেউ নেইও। তিনি অয়নের বাবা-মা’র সাথে কথা বলার জন্য নিজের রুমে গেলেন৷

***

” শ্বাশুড়িআম্মা, কেমন আছেন? কতদিন আপনাকে দেখিনি। ”

বাড়িতে ঢুকেই নিলাশা দেখল রিনা আক্তার উঠানে বসে পৃথার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে আর কয়েকজন প্রতিবেশি মহিলার সাথে গল্প করছে। ও দৌড়ে রিনা আক্তারের কাছে গিয়ে তাকে চমকে দিল।

নিলাশাকে দেখে রিনা আক্তার কপাল কুঁচকে তাকায়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নিলাশাকে দেখে সে বিরক্ত হয়েছে। সে নিলাশার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলনা৷ নিলাশা বেশ বুঝতে পারছে, ওকে রিনা আক্তার খুশি হয়নি। হয়তো এই সময় নিলাশাকে এই বাড়িতে আশাও করেনি। কিন্তু পৃথা নিলাশাকে দেখে বেশ খুশি হয়েছে। ও তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে নিলাশাকে জড়িয়ে ধরল। নিলাশা পৃথার সাথে কথা বলে তাকাল রিনা আক্তারের দিকে।

” আমাকে দেখে বিরক্ত হলেন বুঝি, শ্বাশুড়ি আম্মা? এভাবে নিজের ক্ষতি করবেননা। অকারনে অন্যের ওপর বিরক্ত হওয়া খারাপ লক্ষণ। এতে হার্টের ওপর বাজে প্রভাব পরে, হুটহাট স্ট্রোকও হতে পারে, আবার চোখের ক্ষতি হয় ব্যাপক। সব রাগ, বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে এবার একটু হাসুন। ” নিলাশা ভুলভাল জ্ঞান দেয় রিনা আক্তারকে।

” তোমারে কেডায় কইছে আমি রাগ হইছি? হুদাই সগ্গলের সামনে আমারে অপমান কইরা শান্তি লাগে তোমার? আমি রাগ হমু কেন? আমি তোমারে দেইখা অবাক হইছি। বাড়িতে আইবা সেই খবর তো একবার দিবার পারতা। তোমার জন্য রাইন্ধা রাখতাম। তুমিতো আবার নবাবের ঝি, যেনতেন খাওন তোমার গলা দিয়া নামেনা। এখন আমারে আবার রান্ধন লাগব। ”

” শ্বাশুড়ি আম্মা, প্যারা নিয়েননা। চিল মুডে থাকেন। আমি আপনাদের জন্য বিফ বিরিয়ানি, রোষ্ট, নান নিয়ে এসেছি। আপনার যেটা মন চায় সেটাই খাবেন। আজ থেকে আপনার ছুটি। আমি যে কয়দিন এখানে থাকব, সে কয়দিন রেষ্ট নিবেন। এই কয়দিন রান্নাঘর টোটালি আমার। আপনার বড় ছেলের বউ তার শ্বাশুড়ি আম্মার জন্য এতটুকু করতেই পারে। ”

রিনা আক্তার নিলাশার কথা শুনে রাগে ফুঁসছে। নিজের রাজত্বে নিলাশার বিচরণ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা।

চলবে…