#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫৭
জাওয়াদ জামী জামী
” সাবধানে থেক, ভাইয়া। কারও সাথে ঝগড়া, মারামারি কিন্তু করবেনা। আম্মু, ভাবীর খেয়াল রেখ। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে কিন্তু। আমি চলে যাচ্ছি, ভাবীকে দেখার কেউ নেই। তুমি বাসায় না থাকলে ভাবীর কষ্ট হবে। ” কান্না জড়িত গলায় বলল পুষ্পিতা।
পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে কান্না পায় পুলকের। ওর একটামাত্র বোন আজ শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে। কাল থেকে আর পুষ্পিতা ওকে সময়ে-অসময়ে বিরক্ত করবেনা, যখন-তখন এটা-সেটা আবদার করে বসবেনা। ওর খিলখিল হাসিতে মির্জা বাড়ি মুখরিত হবেনা। পুষ্পিতাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল পুলক। এতক্ষণ অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখলেও, পুলকের কান্না দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা পুষ্পিতা। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
মল্লিকা মির্জা বিছানায় শুয়ে অনর্গল অশ্রু বিসর্জন করছেন। তার আদরের মেয়ে আজ থেকে অন্য বাড়ির বউ। মেয়েটাকে আর তিনি সুখ-দুঃখের সময় কাছে পাবেননা। হুট করেই মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে ‘ আম্মু ‘ বলে ডাকবেনা। স্বামীকে হারিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তিনি। আজ সেই মেয়েটাও অনেক দূরে চলে যাবে।
” মা, নিচে চলুন। পুষ্পিতাকে বিদায় দিতে হবে। আপনাকে সবাই ডাকছে। ” আশফির ডাকে তার দিকে ঘুরে তাকালেন মল্লিকা মির্জা। মলিন হেসে বললেন,
” আমি মেয়েটার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবনা, বউমা। মেয়েটাকে ছেড়ে আমি কিভাবে থাকব। তুমি বরং সবাইকে বল, আমি ঘুমাচ্ছি। ”
” মেয়ে চলে যাচ্ছে, আর আপনি মা হয়ে বিদায় দেবেননা, সেটা কি ভালো দেখায়, মা? আর তাছাড়া পুষ্পিতা আপনাকে না দেখলে কষ্ট পাবে। ও বারবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করছে। ”
” মামী, তাড়াতাড়ি নিচে চলুন। পুষ্পিতার শ্বশুর তাড়াহুড়ো করছে। পুষ্পিতাও আপনাকে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে গেছে। ” তিয়াসা ঝড়েরবেগে রুমে ঢুকে এক নিঃশ্বাসে বলল।
এরপর আর মল্লিকা মির্জা রুমে থাকতে পারলেননা। বউমাদের সাথে নিয়ে নিচে গেলেন।
***
” ভাবী, তোমরা নাকি ইন্ডিয়া যাচ্ছ? ইদানীং ভালোই হানিমুন করছ। আমার সাদাসিধা ভাইয়াও দেখছি তোমাকে চোখে হারায়! সারাক্ষণ তোমার পিছুপিছু ঘুরঘুর করছে। এমন ভালোবাসা দেখলেও চোখের শান্তি। ”
রাতে নিলাশা, আশফি, তিয়াসা মিলে লিভিং রুমে আড্ডা দিচ্ছে। গল্পের এক পর্যায়ে নিলাশা তিয়াসাকে ঠাট্টা করে বলল।
” কেন আমার ভাইয়া কি তোমাকে ভালোবাসেনা? সকালে দেখলাম তোমার খাবার রুমে নিয়ে গেল, আবার বাহিরে গেলে কিছুক্ষণ পরপরই ফোন দিচ্ছে। তুমি না খাওয়া পর্যন্ত ভাইয়াও কিছু খাচ্ছেনা। এগুলো কি ভালোবাসা নয়? ” তিয়াসা উত্তর দেয়ার আগেই আশফি বলল।
” আমি কি একবারও বলেছি, তোমার ভাইয়া আমাকে ভালোবাসেনা? সে-ও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তবে আমার থেকে বেশি নয়। এক্ষেত্রে আমি চ্যাম্পিয়ন, বুঝলে, ভাবী? ” নিলাশা মুচকি হেসে জবাব দিল।
তিয়াসা চুপচাপ শুনছে নিলাশার কথা। নিলাশার প্রতিটি বাক্য যেন ওর বুকের গহীনে আছড়ে পড়ছে। ভেঙে দিচ্ছে ওর এতদিনের ধৈর্য্য। একটা সময় যে মানুষটা ওর সবচেয়ে কাছের ছিল, যাকে ঘিরে ও প্রতিটা স্বপ্ন সাজিয়েছিল, প্রকৃতির নির্মম দয়াহীনতায় আজ সে বহুদূর চলে গেছে। এখন তার প্রতিটা রাত কাটে অন্য নারীর বাহুডোরে। অবশ্য সে নিজেও তার ব্যতিক্রম নয়। সে-ও মানুষটাকে কাঁদিয়ে সুখের ঘর বেঁধেছে। তবে আজ কেন সে, রিফাতের দাম্পত্য জীবনের কথা শুনে কষ্ট পাচ্ছে! কষ্ট কি একদিন রিফাতকে ও দেয়নি? আজ যখন দু’জনই সুখী হয়েছে তখন কেন এত কষ্ট হচ্ছে? তবে কি এখনো তার মনে রিফাতের অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে? কথাটা মনে হতেই কেঁপে উঠল নিলাশার বুক। শাহেদ ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। সে যদি কখনো জানতে পারে, রিফাতের কথা ভেবে আজও তিয়াসার বুক ভারি হয়ে আসে, তবে সে ভিষণ কষ্ট পাবে। আর সেটা তিয়াসা মোটেও চায়না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিয়াসা তাকায় নিলাশার দিকে। হাসিমুখে তিয়াসাকে জিজ্ঞেস বলল,
” এই যে ননদীনি, আমার ভাইকে খুব নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো হচ্ছে বুঝি? আমার বেচারা ভাইটা হাজার কষ্ট পেলেও মুখ খুলবেনা। তাকে বেশি জ্বালিওনা বুঝলে? জ্বালানোর বদলে একটু ভালোবেস। ”
” তাকে আমি ভালবাসব কি! তার ভালবাসা হজম করতে করতে দিন-রাত পেরিয়ে যায়। তার ভালবাসার ঠ্যালায় আমি অস্থির হয়ে যাই। ” কথাটা বলেই নিলাশা বুঝতে পারল কতবড় ভুল করল। এবার তিয়াসা ওকে নিশ্চয়ই এটা নিয়ে খোঁচাবে।
নিলাশার কথায় মলিন হাসল তিয়াসা। আজ ও নিশ্চিত হয়ে গেল, রিফাত নিলাশাকে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়েছে। ওর সংশয় ছিল, রিফাত হয়তো নিলাশাকে মেনে নিতে পারবেনা। আজ ওর সেই সংশয় দূর হল। ও মনে মনে রিফাতের সুখী জীবন প্রার্থনা করল।
” ছিহ্ নিলাশা, এতটুতো লজ্জা কর। ভুলে যেওনা আমরা তোমার ননদ। তা-ও ছোট ননদ। আর ছোটদের সামনে এমন লজ্জার কথা বলতে নেই। ” আশফি খোঁচা মেরে বলল।
আশফির কথা শুনে তিয়াসা হাসল। কিন্তু নিলাশা একটুও লজ্জা না পেয়ে বলল,
” হয়েছে আর জ্ঞান দিওনা, ভাবী। তুমি নিজেই যেখানে লজ্জার কাজ করে ভাইয়াকে প্রিন্স এনে দিচ্ছ, সেখানে আমাকে বলছ লজ্জা পেতে! ভাইয়া তোমাকে না ভালোবাসলে আমাদের প্রিন্স কোথায় থেকে আসত? এটা ভেবে বুঝি তুমি লজ্জা পাও? ”
নিলাশার এমন নির্লজ্জ কথা শুনে আশফি ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকে তিয়াসার দিকে। এমন গভীরভাবে আজ পর্যন্ত ও ভাবেনি। বিষয়টা সত্যিই লজ্জার। তাহলে কি সবাই ওকে দেখে এভাবেই ভাবছে? লজ্জায় আশফি মাথা নিচু করল। এদিকে তিয়াসা মিটিমিটি হাসছে।
আশফিকে লজ্জা থেকে মুক্তি দিল রিফাত। ও লিভিং রুমে এসে নিলাশাকে ডাকল। একবারও তিয়াসার দিকে তাকালোনা।
” নিলাশা, একটু ভেতরে আসবে? ”
” কেন যাবনা! আপনি ডাকবেন আর আমি যাবনা এমনটা হতেই পারেনা। আমিতো জানি আপনি আমাকে মিস করছেন।” নিলাশা আশফি, তিয়াসাকে চোখ টিপে রুমের দিকে পা বাড়াল।
নিলাশার এমন কাজে রিফাত হতভম্ব হয়ে গেছে। এই মেয়েটার লজ্জা বলতে কিছুই নেই। এভাবে ছোটদের সামনে ওকে লজ্জায় ফেলে দিল! একনজর তিয়াসার দিকে তাকাল। তিয়াসাকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে হাঁফ ছাড়ল।
আশফি মাথা নিচু করে হাসছে। তিয়াসা তাকিয়ে আছে রিফাতের দিকে। তার চেহারায় একজন সুখী মানুষের ছাপ স্পষ্ট। রিফাতের সুখী চেহারা দেখে বুকে সুখের ঢেউ ছলকে উঠল তিয়াসার। হোক না মেয়েটা অন্য কেউ, তবুও তো সে সুখী হয়েছে। একটা সময় যার সুখই ছিল তিয়াসার কাম্য।
***
” তোমার মধ্যে কি লজ্জা বলতে কোন বস্তু নেই? আমার ছোট বোনদের সামনে কিসব বলে আসলে। ” রিফাত নিলাশাকে ধমক দিল।
কিন্তু নিলাশা রিফাতের ধমক ভালোবাসা ভেবে হজম করে নিল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
” আমি ভুল কি বলেছি! আপনি স্বীকার করেন আর না-ই করেন, আপনি যে আমাকে মিস করছিলেন এটা এক হাজার পার্সেন্ট সত্যি। ”
” কে বলেছে তোমাকে? তোমাকে শুধু শুধু মিস করতে যাব কেন? ”
” তবে সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কে উঁকিঝুঁকি মেরে আমাকে দেখছিল? এক ঝলক দেখার পরেই কে মৃদু হাসছিল? ”
নিলাশার প্রশ্ন শুনে রিফাত ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। গভীর চুমু দিল মেয়েটার ঠোঁটে।
” সত্যিই তোমাকে মিস করছিলাম। গতরাতে তোমাকে কাছে পাইনি, আবার আজ সারাদিনও তাই। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। ”
” এবার ফাঁকা বুকটা পূর্ণ হয়েছে? ”
” এত তাড়াতাড়ই কি হয়। আটাশ ঘন্টার অভাব কি এতটুকুতেই মিটবে? আরেকটু আদর করলেইনা তবে আমার বুকটা শান্ত হবে। ”
” এখন আদর-টাদর হবেনা। বাসা ভর্তি মানুষ। সবার সামনে দরজা বন্ধ করে রুমে থাকলে তারা কি ভাববে বলুনতো? ”
” আজ রাতে তুমি আমার কাছে থাকবে। যদি দেখি অন্য কারও সাথে ঘুমাচ্ছ, তবে আমি তুলে নিয়ে আসব নিজের কাছে। ”
” ভেবেছিলাম আজকের রাতটা কাজিনদের সাথে কাটাব। আপনি আর সেটা হতে দিলেননা। ”
” বিয়ের আগে কাজিনদের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছ। তাই এখন সব হক আমার। তোমার পুরোটা সময়ের দাবীদার একমাত্র আমি। আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সময় পূর্ণ করতে চাই। ”
নিলাশা রিফাতের টি-শার্টের বোতাম খুলে চুমু দিল ওর লোমশ বুকে। শরীরে মাখল তার শরীরের পুরুষালী গন্ধ।
***
” আপনার কি হয়েছে? আমার মনে হচ্ছে, আপনি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন। গত কয়েকমাস যাবৎ আপনার আচরণ আমাকে ভাবাচ্ছে। আমরা আপনার জন্য চিন্তা করি সেটা আপনি বোঝেন? একটামাত্র বোনের বিয়েতেও আপনি সময় দিতে পারলেননা। এটা কি আমার জন্য লজ্জার নয়? সারাদিন বাহিরে কাটিয়ে, সন্ধ্যায় পুষ্পিতার বিদায়ের সময় আপনি বাসায় আসলেন, কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এটা করতে পারে? ”
পুলক বিছানায় মাথা রাখতেই আশফির প্রশ্নবানে জর্জরিত হল। তবে সে আশফিকে কিছুই বললনা। হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে নিজের কাছে ডেকে নিল। আশফিও পুলকের বাড়ানো হাতে নিজের হাত রাখল। তবে ওর ভেতরের রাগ প্রশমিত হয়নি
” রাগ করেছ, বোকা পাখি? তুমি জানোনা, আমি পুষ্পিতাকে কতটা ভালোবাসি? আমার আদরের বোনটার জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে, আমি থাকতে পারিনি এটা আমার জন্য কষ্টের। সেই সাথে লজ্জারও। কিন্তু আমি নিরুপায় হয়ে কাজটা করেছি। আমি জানি, আজকে পুষ্পিতাও কষ্ট পেয়েছে। ” পুলক মৃদু গলায় বলল।
” তাহলে কেন করলেন এমন? তবে কি আপনার জীবনে এখন আমাদের কারোরই অস্তিত্ব নেই? মা’য়ের স্নেহ, বোনের ভালোবাসা কিংবা স্ত্রী’র দ্বায়িত্ব সবকিছুই কি আপনি অস্বীকার করতে চাইছেন? ” আশফি রেগে গেছে।
” প্লিজ বউ, এভাবে বলোনা। আমার জীবনে তোমরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তুমি না জানলেও আমার অন্তর জানে, আমি জানি। আর রাগ করে থেকোনা। আমার প্রিন্স কষ্ট পাবে। ” পুলক আশফির রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে।
” আপনি আমাকে এক্ষুনি বলবেন আপনার কি হয়েছে। নয়তো আপনার সাথে কোন কথা আমি বলবনা। এমনকি আমি মা’য়ের রুমে থাকব আজ থেকে। যে মানুষের কাছে তার পরিবারের কোন মূল্য নেই, অসুস্থ স্ত্রী’র কোন দাম নেই, সেই মানুষের সাথে এক রুমে আমি থাকতে চাইনা। ” আশফি পুলকের কোন কথা কানে নিচ্ছেনা। চ্যাঁচামেচি করেই চলেছে।
” আমাকে রাগিয়ে দিতে চাইছ? ভুল করেও এটা করোনা। আমার হাজার রাগ হলেও তোমার ক্ষতি করতে পারবনা, ক্ষতি করব নিজের। তাই আমার রাগ হলে আখেরে তোমারই ক্ষতি। তাই কখনোই আলাদা রুমে থাকার কথা চিন্তাও করোনা। “পুলক নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
” একশোবার রাগ করব। প্রয়োজনে হাজারবার করব। মা’য়ের রুমেও ঘুমাব। দেখি কি করতে পারেন আপনি। আপনার রাগ আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই, আমাকেও শত্রুর চোখে দেখেন নাকি। ”
পুলক বুঝতে পারছে এই মেয়েটার সাথে কথা বাড়ালেই বিপদ বাড়বে। আজকে ওর বউ ঝগড়ার মুডে আছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পুলক।
” তোমাকে সব বলব, বউ। আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দাও। নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে করতে আমি ক্লান্ত। এবার একটা সমাধান দরকার। তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা। ”
পুলকের দিকে তাকিয়ে আশফি বুঝতে পারল মানুষটা বেশ চিন্তায় আছে। তার দৃষ্টি যেন ঘোলাটে। তার চেহারার সজীব ভাবটা সেই কবেই হারিয়েছে। স্বাস্থ্যও বেশ ভেঙে পড়েছে। আশফির বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সাথে সাথেই উবে গেল সকল রাগ, অভিমান। ঘাপটি মেরে পুলকের বুকে পরে থাকল। হঠাৎ করেই চিন্তারা হানা দিল। ওর মন কু গাইল। তবে কি মানুষটা কোন বিপদে জড়িয়েছে?
চলবে…
#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫৮
জাওয়াদ জামী জামী
পেরিয়ে গেছে কয়েকমাস। আশফির ডেলিভারি ডেইট নিকটে। পুলক হাজার ব্যস্ততার মাঝেও আশফিকে সময় দিচ্ছে। থেকে থেকেই মেয়েটার মুড সুইং হলে সেই ঝক্কিও পুলককেই পোহাতে হচ্ছে। দেখা গেল মাঝরাতে আশফির ইচ্ছে করছে নতুন কাপড়ের গন্ধ নিতে। ব্যাস হয়ে গেল। পুলক ঘুম জড়ানো চোখে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। আবার কোন কোনদিন আশফির ইচ্ছে হয়, তাজা রুই মাছের ঝোল খাবে। বেচারা পুলকের আর কি করার, সে চলে যায় মাছের খোঁজে। এভাবেই আশফি প্রতিনিয়ত পুলককে বিরক্ত করে যাচ্ছে। কিন্তু পুলক একটাবারও বিরক্ত হয়না। ও হাসিমুখেই আশফির আবদার পূরনের চেষ্টা করে।
” ও মা গো। ” আশফির মৃদু আর্তনাদে ঘুম ভাঙ্গলো পুলকের।
” কি হয়েছে, বউ? পেইন হচ্ছে? ” পুলক উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল।
” সব হয়েছে আপনার জন্য। আমাকে এত কষ্টের মধ্যে রেখে আবার জিজ্ঞেস করছেন, কি হয়েছে? ভালোবাসা যেন উতলে পরছিল। কি হত এত ভালো না বাসলে? এত গা ঘেঁষাঘেষি না করলে? সাড়ে আট মাসের বেশি সময় এত কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে শুধু আপনার জন্য। যখন-তখন তার আদরের প্রিন্সের লাথি গুঁতো খেতে হচ্ছে। যেন আমার পেট তার প্রিন্সের কাছে শারজাহ স্টেডিয়াম। ”
আশফির অভিযোগ শুনে পুলক হা করে তাকিয়ে আছে। এই সাড়ে আট মাসে এমন একটা দিনও বাদ ছিলনা আশফি ওকে ভালোবাসার খোঁটা দেয়নি। পুলক আগে কখনোই জানতনা ভালোবাসলেও দোষী হতে হতে হয়। প্রতিবারের মত এবারেও নিরবে খোঁচা হজম করে বলল,
” কি করব বল, বউ? তুমি ভালোবাসার মতই একজন। তোমাকে ভালোবেসে আমি পূর্ণ হয়েছি। আর যাকে জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসা যায়, তার সাথেই একটু গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে হয়। এতে দোষের কিছুই নেই। তার ওপর যদি সে বউ হয়, তবে কোন কথাই হবেনা। তখন এই গা ঘেঁষাঘেঁষি ফজর হয়ে যায়। ”
” লেকচার থামান। আসছে অশিক্ষিত লেকচারার। আমার এখন কৃষ্ণচূড়া ফুলের স্পর্শ নিতে ইচ্ছে করছে। আপনি আমাকে কৃষ্ণচূড়া এনে দিন। ”
আশফির উদ্ভট বায়না শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল পুলক। মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। এরপর করুণ গলায় বলল,
” শীতকালে আমি কৃষ্ণচূড়া কোথায় থেকে পাব, বউ? এই ইচ্ছে স্কিপ করা যায়না? তোমার অসহায় জামাই ইচ্ছেটা পূরণ করবে কিভাবে সেটা একবার ভাব। ”
” আমি কিছু জানিনা। আপনি আমাকে কৃষ্ণচূড়া এনে দেবেন ব্যাস। ফুল না পেলে আমি এখনই মা’য়ের রুমে চলে যাব। ”
পুলক করুণ চোখে কিছুক্ষণ আশফির দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর বিছানা থেকে নেমে টি-শার্ট হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
ফজরের আযানের পর পুলক বাসায় ফিরল। ওর হাত ভর্তি রক্ত রঙ্গা কৃষ্ণচূড়া। আশফি ঘুমিয়ে ছিল। পুলক ওর মাথার কাছে ফুলগুলো রেখে, আশফির কপালে চুমু দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। অজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়াল।
ঘুম ভাঙ্গলে মাথার পাশে কৃষ্ণচূড়ার থোকা দেখে আনন্দে চিৎকার দিল আশফি। কৃষ্ণচূড়ার থোকায় নাক ডুবাল। পুলক মন ভরে দেখছে তার রমনীর আনন্দে ভরপুর মুখখানি। যে মুখখানায় ও খুঁজে পায় রাজ্যের শান্তি। এই মেয়েটার জন্য স্বেচ্ছায় মৃত্যুর বুকে ঝাঁপিয়ে পরতে পারবে পুলক মির্জা। হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে পারে মৃত্যুকে। এই মেয়েটার মুখে একবিন্দু হাসি দেখতে পুরো দুনিয়ার বিপক্ষে যেতে দুইবারও ভাববেনা পুলক মির্জা। তার কাছে সব থেকে দামী আশফির মুখের হাসি।
” কোথায় পেয়েছেন এগুলো? ”
” পেয়েছি কোথাও। এবার বল তুমি খুশি হয়েছ? ”
” খুউউউব। ”
পুলক মৃদু হাসল। আশফিকে বললনা, এই ফুলগুলোর জন্য ও মাঝরাতে পুরো শহর তোলপাড় করে ফেলেছে। পরে একটা বাড়িতে পেয়েছে এগুলো। বাড়ির মালিক ভিষণই শৌখিন। তার বাগানে অল সিজনে ফোটে এই কৃষ্ণচূড়ার গাছ আছে। ভোরের দিকে ফুলের সন্ধান পেতেই তাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে পুলকের গ্যাং। ভদ্রলোক পুলকের এমন কাজে মোটেও বিরক্ত হননি। তিনি হাসিমুখেই দিয়েছেন এক গুচ্ছ ফুল।
***
” তিয়াসা, তুমি কিছুদিন গিয়ে ভাবীর কাছে থেকে এস। ভাবী গতকাল বারবার বলছিল তোমাকে পাঠিয়ে দিতে। ভাইও সেটাই চাইছে। খুব টেনশন করছে ভাবী। এই মুহূর্তে তোমাকে তার প্রয়োজন। ”
” আপনার বউ ভক্ত ভাই তার বউ যেটা বলবে সেটাই শুনবে, এটা আর নতুন কি। কপাল গুণে একটা জামাই পেয়েছে আশফি। কিন্তু কথা হল, আপনি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবেন? এছাড়াও দাদু অসুস্থ। তাকে একা রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে? ”
” শুধু কি ভাই-ই বউ ভক্ত? আমি বউ ভক্ত নই? আমি কি আমার একটামাত্র বউয়ের কথা শুনিনা? ”
” আমি কি একবারও বলেছি, আপনি বউ ভক্ত নন? দেশে বউ ভক্তদের নিয়ে প্রতিযোগিতা হলে আপনি ফার্ষ্ট হবেন। ”
” গুড। যদি বলতে আমি বউ ভক্ত নই, তবে বউ ভক্ত কাকে বলে সেটা তুমি টের পেতে। তাহলে কবে যাবে বল? দাদুকে নিয়ে চিন্তা করোনা। আন্টি আছে আরও দু’জন মেইড আছে। তোমার চিন্তা করতে হবে আমাকে নিয়ে। তোমার জামাই বউ ছাড়া একটা রাতও কাটাতে পারবেনা, এটা কেন বলছনা! ”
” আমি জানি আপনি বউ ছাড়া থাকতে পারেননা। কিন্তু সেই আপনিই বলছেন আমাকে নাটোর যেতে। আমি কি করব বলতে পারেন? ”
” কি আর করা, কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে। আমি প্রতি সপ্তাহে তোমার কাছে যাব। আর বউয়ের সব আবদার পূরণের চেষ্টা করব। ”
শাহেদের ইংগিত বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তিয়াসার। ও লজ্জায় মুখ লুকাল শাহেদের বুকে।
” অসভ্য পুরুষ, একটুও লজ্জা নেই আপনার? ”
” পুরুষদের লজ্জা থাকতে নেই, জানেমান। ঐটা নারীদেরই মানায়। আর মানায় জন্যই এখন তুমি আমার বুকে। দেখি মুখটা তোল। লজ্জা রাঙ্গা মুখটা আমাকে দেখতে দাও। আমার হৃদয় প্রশান্ত হোক তোমার স্নিগ্ধ মুখখানি দেখে। ”
শাহেদের আদরমাখা কথায় তিয়াসা মুখ তুলে চাইল। ওর ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। দু চোখ যেন স্বচ্ছ সরোবর। ওর শরীর যেন কোন শিল্পীর আঁকা ছবি। যা বারংবার সীমা লঙ্ঘন করতে বাধ্য করে শাহেদকে। যেমন এই মুহূর্তে শাহেদের আরেকবার সীমা লঙ্ঘন করতে ইচ্ছে করছে। নিজের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিতে ভালোবাসে শাহেদ। ও জানে, ওর ইচ্ছাই তিয়াসার সম্মতি। ধীরে ধীরে ও ঝুঁকল তিয়াসার দিকে। আবেশে তিয়াসা চোখ বন্ধ করল। এই মানুষটার প্রতিটা ছোঁয়া ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চায়।
***
” মাআআআআআ। ”
আশফির ডাক শুনে ছুটে আসলেন মল্লিকা মির্জা। আশফি বিছানায় গড়াগড়ি করছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো বিছানা। আশফিকে দেখে ভয় পেলেন মল্লিকা মির্জা। তিনি চিৎকার করে ডাকলেন তিয়াসাকে। তিয়াসা রান্নাঘরে আশফির জন্য স্যুপ আনতে গেছে। মল্লিকা মির্জার চিৎকার পুরো মির্জা মহলে প্রতিধ্বনিত হল। তিয়াসা কাজ ফেলে ছুটে আসল আশফির রুমে।
হসপিটালের করিডোরে অস্থির হয়ে পায়চারী করছে পুলক মির্জা। মল্লিকা মির্জা আল্লাহকে ডাকছেন। তিয়াসা অসহায় চোখে পুলক মির্জাকে দেখছে। আশফির শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কিছু জটিলতা পেয়েছেন ডক্টর। অথচ এতদিন সব ঠিকই ছিল। গত আধাঘন্টায় পুলক দুইবার অজ্ঞান হয়েছে। তাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ওর বন্ধুমহল। আফজাল হোসেন আর তিয়াসার মা এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। তারা চেষ্টা করছে পুলককে শান্ত করার। কিন্তু সে কারো কথা শুনলেতো।
আরও আধাঘন্টা পর সিস্টার এসে টাওয়েলে জড়ানো একটা পুতুল এনে দিল মল্লিকা মির্জার হাতে। পুতুলটা চোখ পিটপিট করছে। মল্লিকা মির্জা নাতীকে প্রানভরে আদর করলেন। ততক্ষণে পুলক তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
” আম্মু, এটা কিন্তু অন্যায়। তুমি দেখছ যে আমি প্রিন্সের চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। অথচ তাকে তুমি আমার কোলে না দিয়ে নিজেই আদর করছ। ”
” তুমি প্রিন্সের চিন্তায় পাগল হচ্ছনা, বেটা। তুমি পাগল হচ্ছ তোমার বউয়ের চিন্তায়। তোমার বউ সুস্থ হয়ে গেলে তোমার পাগলামিও সেড়ে যাবে। এই নাও তোমার প্রিন্সকে। ”
পুলক মির্জা কাঁপাকাঁপা হাতে কোলে নিল তার সন্তানকে। যে সন্তানের জন্য সে অপেক্ষা করেছে এতগুলো মাস। প্রিন্সকে কোলে নিয়েই বুকে ঠেকাল পুলক। সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল ওর সকল উদ্বেগ। একটা শীতল মলয় ছুঁয়ে গেল ওর হৃদয়। এই অনুভূতি কভু ভুলবার নয়।
” কনগ্রাচুলেশন, ভাইয়া। এবার মিষ্টিমুখ করান আমাদের। জুনিয়র মির্জা চলে এসেছে। এই যে জুনিয়র, এতদিন মাম্মাকে অনেক জ্বালিয়েছ, এবার থেকে গুড বয় হয়ে থাকবে বুঝলে? ” তিয়াসা বেবীকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল।
পুলক তিয়াসাকে দেখছে। দেখছে ওর খুশিতে ভরা মুখ। ছেলেটাকে কোলে নিয়েই ও কেঁদে দিল। পুলক দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। মেয়েটার জন্য ওর মায়া হয়, কষ্ট লাগে। মা হতে না পারার যন্ত্রণা ওকে আজীবন ভোগ করতে হবে। তবে পুলক চায়না মেয়েটা কষ্ট পাক। তাই ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এক বছর পেরোতেই আশফিকে বেবী নিতে বলবে। আর সেই বেবী ও তিয়াসাকে দেবে।
কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে জানায়, আশফি সুস্থ আছে। জ্ঞান ফিরলেই ওকে কেবিনে দেয়া হবে। ডক্টরের কথা শুনে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
চলবে…