রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৫৯+৬০

0
6

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫৯
জাওয়াদ জামী জামী

” এই যে আমাদের জুনিয়র মির্জা সাহেব। ভালো করে দেখে বল ও দেখতে কার মত হয়েছে? ” ছেলেকে আশফির কাছে এনেছে পুলক। কিছুক্ষণ আগেই ওর জ্ঞান ফিরেছে।

ছেলের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে আশফি। ছেলেটা একদম বাবার কার্বন কপি হয়েছে। ছেলেকে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল আশফির। দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল ওর দু’চোখ বেয়ে।

” আপনার মির্জা মাশরুর আয়াস! মাশাআল্লাহ্ পুরোই আপনার চেহারা পেয়েছে। আপনি খুশি হয়েছেন তো? ” আশফি আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে পুলকের দিকে।

” আমি খুশি হবনাতো কে পাশের বাড়ির দাদু খুশি হবে? তোমার এত কষ্টের জন্য যখন আমিই দায়ী, তখন খুশিও আমিই হব। ”

আশফি বুঝল পুলক ওর কথা ওকেই ফিরিয়ে দিল। তাই ও নীরবে খোঁচাটা হজম করল। তবে খোঁচাটা ভবিষ্যতে ফিরিয়ে দেয়ার পণ করল ঠিকই।

মল্লিকা মির্জা খুশিতে পুরো হসপিটালে মিষ্টি বিলিয়েছেন। তিনি নাতীকে এক মুহূর্তের জন্যও কোল থেকে নামাচ্ছেননা। মাঝেমধ্যেই খুশিতে কাঁদছেন। আজকে বারবার তিনি আতিক মির্জার কথা ভাবছেন। তিনি থাকলে নাতীকে দেখে কতইনা খুশি হতেন। আফসোস এই খুশির দিন তিনি দেখতে পেলেননা। নাতী কেঁদে উঠলে তিনি তাকে আশফির কাছে নিয়ে গেলেন। হয়তো ক্ষুধা লেগেছে।

” কনগ্রেচুলেশনস, ভাই। অবশেষে আমিও চাচ্চু হলাম। দেখি ওকে আমার কোলে দাও। ” শাহেদ এসে পুলকের কাছ থেকে বেবীকে নিজের কোলে নিল।

” তোর যত খুশি মিষ্টি খাস। তবে সাতদিনের আগে ঢাকা যেতে পারবিনা। এই সাতদিন তুই ভাতিজার কাছে থাকবি। ”

পুলকের কথায় শাহেদ মলিন হাসল, কিছুই বললনা।

***

” আজ অফিস থেকে আসার সময় আয়াসের জন্য খেলনা নিয়ে আসবেন। মনে থাকবে তো? ”

নিলাশার কথা বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকায় রিফাত।

” আয়াস কে? ”

নিলাশার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলনা রিফাত। নিলাশা রিফাতের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে।

” কিহ্ আপনি আয়াসকে চেনেননা! নিজের একমাত্র ভাগ্নেকে আপনি চেনেননা! কেমন মামা আপনি? লজ্জা করছেনা আপনার? আপনি মামা নামের কলংক। ”

” ওহ্, আমাদের পুচকুর নাম বুঝি আয়াস? কে রেখেছে এত সুন্দর নাম? ” রিফাত হাঁফ ছেড়ে জিজ্ঞেস করল।

” কে আবার রাখবে? ওর বাপে রেখেছে। আপনার ছেলের নাম কি অন্য কেউ রাখবে? ”

” ও মন্টুর মা, তুমি এত রিয়্যাক্ট করছ কেন? এত হ্যান্ডসাম জামাইয়ের ওপর কি কেউ রাগ করে বল? ”

রিফাতের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল নিলাশা। এই মানুষটার ওপর ও কখনোই রাগ করতে পারেনা। যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে তার ওপর কি রাগ করে থাকা যায়!

” ভাবী যদি জানতে পারে, তার রাজপুত্রের নাম আপনি জানেননা, সে কি মনে করবে বলুনতো? আর ভাইয়া শুনলে আপনার কি অবস্থা হবে সেটা বুঝতে পারছেন? ”

” তোমার ভাইয়া আমাকে কি বলবে সেটা আমার জানাই আছে। আর আমার বোন কিছুই মনে করবেনা সেটা আমি জানি। তুমি আর তোমার ভাই একই ক্যাটাগরির পাব্লিক। আমাকে খুঁচিয়ে শান্তি পাও। ”

” চিন্তা করবেননা আপনার এই কথাটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাইয়ার কাছে পৌঁছে যাবে। বোনের সামনে ভাইয়ের নামে দুর্নামের অপরাধে আপনার যে কি হবে সেটা ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছে। ”

” তুমি বোধহয় আমাদের পুচকুকে দেখতে যেতে চাওনা? সেজন্যই এমন আবোলতাবোল বকছ? লাগবেনা যাওয়া। আমিই আগামীকাল যাব পুচকুর কাছে। ”

নিলাশা বুঝল রিফাত ওকে পরোক্ষভাবে হুমকি দিল। তাই আপাতত নিজের কথাটা উইথড্র করে নিল। ব্যাপারটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আগে একবার পুচকুর কাছে যাওয়া যাক।

” ও মন্টুর বাপ, আমাদের গোপন কথাগুলো ভাইয়া কেন দুনিয়ার কেউই জানবেনা। আপনি না আমার গুল্টুমুল্টু কিউট সোয়ামী? আর কিউট সোয়ামীরা কখনোই তাদের বউকে বাসায় একা রেখে কোথাও যায়না। ”

” গুড। বউদের এমনই হওয়া উচিত। জামাইয়ের কথামত চলতে হয় বুঝলে? এবার লিষ্ট কর। কোন কিছু যেন বাদ না যায়। আমি ফোন করলেই তুমি বের হবে। ”

” আমি আবার কোথায় যাব? ”

” আমি কি একা একা সবকিছু কিনব নাকি? সেটা সম্ভব নয়। তুমিও যাবে। ”

” অগত্যা। ”

” কাছে এস। ”

রিফাতের ডাকে নিলাশা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। নিলাশা কাছে আসলে রিফাত ওকে বাহুডোরে বেঁধে নিল। নিলাশার এলোমেলো চুল সরিয়ে দিল কপাল থেকে। রিফাতের স্পর্শে কেঁপে উঠল নিলাশা। কয়েকমাস পরও রিফাতের স্পর্শ ওর শরীরে কাঁপুনি ধরায়। প্রতিবারই মনে হয় এটা তার প্রথম ছোঁয়া। এই ছোঁয়া কভু পুরোনো হবার নয়।

***

” আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে? গত রাতেও দেরিতে বাসায় এসেছিলেন। ”

আশফির প্রশ্নবাণ ছেলেকে আদরে বাঁধা সৃষ্টি করল। পুলক ঘুরে তাকায় আশফির দিকে।

” তেমন কিছুনা, বউ। তুমি চিন্তা করোনা। আমার এই কয়দিন বাসায় আসতে একটু দেরি হবে। খেয়েছ তুমি? ”

আশফির প্রশ্ন এড়িয়ে গেল পুলক। ও চাইছেনা তার সমস্যার সাথে আশফিকে জড়াতে৷

” আমি চিন্তা না করলে কে করবে? আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন সেটা কি আমি জানতে পারিনা? অধিকার নেই আমার? নাকি আমাকে জড়বস্তু মনে করেন আপনি? বিয়ের পর থেকেই আপনার কথামত চলছি জন্য আমার কোন মূল্য নেই আপনার জীবনে? ” এবার আশফি রেগে গেল৷

আশফির রাগ পুলককে বিস্মিত করল। বোকা মেয়েটা আজকাল মাঝেমধ্যেই বুদ্ধিমানের মত কথা বলছে দেখে অবাক হয় পুলক। তবে আশফির রাগের কোন প্রভাব পরলনা পুলকের ওপর। ও হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে আশফির দিকে।

” তুমি যে আমার জীবনে কি সেটা শুধু ঈশ্বর জানেন। আমি শুধু তোমাকে আমার সকল সমস্যা থেকে দূরে রাখতে চাই। আমি চাইনা কোন বিপদ, সমস্যা তোমাকে ছুঁয়ে যাক। সহ্য করতে পারবেনা তুমি। ”

” কে বলেছে সহ্য করতে পারবনা? আমাকে কি বাচ্চা মনে করেন আপনি? আপনার যদি কোন সমস্যা হয়েই থাকে তবে আমাকে বলুন। আমি সাহায্য করতে না পারলেও আপনার পাশে থাকতে পারব। আপনাকে সাহস জোগাতে পারব। আপনার চিন্তায় ছাওয়া মুখটা দেখতে আমার কতটা কষ্ট হয় সেটা আপনি বোঝেননা? ” আশফি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

পুলক তড়িঘড়ি করে ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে আশফিকে কাছে টেনে নিল। চুমু দিল ওর কপালে, ঠোঁটে, চোখের পাতায়।

” সব বলব। শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। আমি জানি তুমি শত বিপদেও আমার পাশেই থাকবে। এখন এসব ভেবে মন খারাপ করে থেকোনা। কালকে তোমার ভাই-ভাবী আসছে সেটা জানো? আমি অপেক্ষা করছি বউয়ের ভাই তার ভাগ্নের জন্য কি গিফ্ট আনে সেটা দেখার জন্য। ”

” আপনি এমন কেন বলুনতো! আপনার কি কম আছে যে ভাইয়ার গিফ্টের জন্য অপেক্ষা করছেন! ”

” এটা তুমি বুঝবেনা, বোকা পাখি। এটা যদি তুমি বুঝতে তবে বোকা থাকতেনা। ” পুলকের কথা শেষ না হতেই ওর ফোন বেজে উঠল।

স্ক্রীনে রকি’র নাম দেখে পুলক ফোন রিসিভ করল।

” কিরে ব্যাটা, আমাকে কি তোরা আমার বাপজানের সাথে সময় কাটাতে দিবিনা? তোদের জ্বালায় আমার চ্যাম্পের সাথে একটুও গল্প করতে পারিনা। ভালো হয়ে যা সময় আছে প্রচুর। ”

” সরি ভাই, বুঝতে পারিনি তুমি এখন চ্যাম্পের সাথে আছ। আমাদের চ্যাম্প কেমন আছে? তোমাকে পাপা বলে ডাকে? ”

” তোর কি আমার ছেলেকে ম্যাজিশিয়ান বলে মনে হয়? দশদিনের বাচ্চা পাপা ডেকেছে এটা কখনো শুনেছিস? ফাজিল পোলা, আমার সাথে ফাজলামি করস? থাবড়ায় কান গরম করে দেব। ”

” আবারও সরি, ভাই। কিন্তু এবার ভাতিজাকে বাই বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এস। ”

” এখনই যেতে হবে? ”

” হুম। জরুরী কথা আছে। ”

” কোথায় আছিস? ”

” আমরা সবাই টাউন হলের সামনে আছি। শাহেদ ভাইও আসছে। ”

” অপেক্ষা কর। দশ মিনিটেই আসছি। ”

পুলক ফোন কেটে আশফির দিকে তাকাতেই দেখল চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আশফি।

” আসলেন দশ মিনিট আগে। এখন আবার ডাক পরেছে? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা আপনার বউ, আমি নই। ”

” ছিহ্ এমন নাউজুবিল্লাহ কথা বলতে হয়না, বউ। ওরা যদি আমার বউ হত, তবে চ্যাম্পকে ওরা জন্ম দিত, তুমি নয়। আমি প্রতিরাতে তোমার বদলে ওদের বুকে মাথা রাখতাম। তোমার বদলে ওদেরকেই আদর করতাম। তুমিই আমার একমাত্র বউ। ”

” বদ লোক, চুপ থাকতে পারেননা? চ্যাম্পকে ওরা জন্ম দিবে কেন? অসভ্য লোক, ওদেরকে আদর করার খুব শখ তাইনা? আমি আজই আব্বাকে বলে গ্রামে চলে যাব। আপনি তখন প্রান ভরে ঐ উজবুকদের আদর কইরেন। ”

আশফি রাগে কেঁদে ফেলল।

পুলক আশফির কান্না দেখে কপাল চাপড়ায়। এই মেয়ে সব সময়ই উল্টাপাল্টা বুঝে ওকে বিপদে ফেলে।

” আমি ওদেরকে আদর করতে যাব কোন দুঃখে! ওরা কি মেয়ে? নাকি আমার বউ? আমি ছেলেদের আদর করতে পছন্দ করিনা, বউ। ” পুলক আশফির রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

” তারমানে ওরা মেয়ে হলে আপনি ওদের আদর করতেন? ”

এবার পুলক সত্যিই ভয় পাচ্ছে। ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে এটা বুঝতে ওর বাকি নেই। বউকে শান্ত করতে না পারলে ওর কপালে খারাবি আছে এটা বুঝে গেল নিমেষেই।

” ছিহ্ আমি জীবনে তুমি ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের দিকে তাকাইনি। তুমি আমার প্রথম এবং ফিনিশিং ভালবাসা। সরি শেষ ভালবাসা। আমি তোমার সাথেই হাজার জনম কাটাতে চাই। তোমাকে আর চ্যাম্পকে নিয়ে বাঁচতে চাই দুনিয়ায়। নাতি-নাতনীদের সাথে আমাদের ভালবাসার গল্প করতে চাই। দুই বুড়ো বুড়ি হাত ধরে হাঁটতে চাই মরিসাস, হাওয়াইয়ের বীচে। ডিনার করতে চাই আল বুর্জে। আরও অনেক কিছুই আছে কিন্তু এই মুহূর্তে মনে পরছেনা। মনে পরলে তোমাকে বলব। ”

আশফির মন গলাতে এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। ও পুলকের কথায় গলে জল হয়ে গেল। সুযোগ বুঝে পুলক বউ-ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৬০
জাওয়াদ জামী জামী

” ওয়েলকাম টু হেল। ”

পুলক হাত-পা ছড়িয়ে চেয়ারে বসল। ওর সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে একজন। তার চোখে ভর করেছে আতংক। সে একে একে সবার দিকে তাকায়। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র দেখে ভয়ে ঢোক গিলল।

” ভাই, এই হারামজাদাকে মেরে ফেলছিনা কেন? ওর বাঁচার অধিকার নেই। ” শাহেদ রাগে ফুঁসছে।

” হ্যাঁ ভাই, আপনি হুকুম দিলেই আমরা এই বাস্টার্ডকে মেরে পুঁতে দেব। ” রকি তেড়ে আসল।

” এত উতলা হচ্ছিস কেন তোরা? আগে এর সাথে কিছুক্ষণ খেলে নেই। তবেইনা মেরে শান্তি পাব। ” পুলক রিল্যাক্স মুডে বসে আছে।

” আগেরবার আগেরবার আপনার এমন ঢিলেমির কারনেই মাহমুদ হাতছাড়া হয়ে গেছিল। সেজন্য আপনাকে কত ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে মনে আছে? অল্পের জন্য জেলে যেতে হয়নি আপনাকে। কত দৌড়াদৌড়ি করেছি সেটা আমার মনে আছে। ” আবারও রেগে গেল রকি।

” সব মনে আছে আমার। কিচ্ছু ভুলিনি। আগেরবারের মত ভুল এবার আর করবনা। এবার বল সুজন, তোর অনুভূতি কি? আমি জানতে চাই। ”

” তুই আমাকে এখানে ধরে এনেছিস কেন, কু’ত্তা’র বাচ্চা? সাহস থাকলে আমার ডেরায় যেতিস। শা’লা ভীতু খরগোশ। ”

ছেলেটা পুলকের কথার জবাব না দিয়ে ফুঁসে উঠল। কিন্তু তার গর্জন বেশিক্ষণ টিকতে পারলনা। বুকে পুলকের লাথি খেয়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম হল।

” শা’লা মাদারবোর্ড, আমার সামনে গলা উঁচিয়ে কথা বলত শুধু আমার বাবা। এরপর থেকে আমার সাথে নিচু গলায় কথা বলবি। নইলে মৃত্যুর সাথে কোলাকুলি করতে বেশি সময় লাগবেনা। ” হিসহিসিয়ে উঠল পুলক।

পুলকের দিকে তাকিয়ে আছে শাহেদ। রাগে ও কাঁপছে। পুলকের এমন নিস্পৃহ আচরণ মেনে নিতে পারছেনা কিছুতেই। জানোয়ারটা পুলককে জানে মারতে চেয়েছিল এটা মনে হলেই ওর শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছে।

” ভাই, তুমি এখনও শান্ত আছ কিভাবে! একে মারতে ইচ্ছে করছেনা তোমার? ”

” একে নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে। মরতে একে হবেই। কিন্তু তার আগে দুনিয়াতেই আমি একে জাহান্নাম দেখাব। সাকিব, রকি তোরা বরফের চাঁই নিয়ে আয়। একে বরফ থেরাপি দিয়ে জাহান্নামের প্রথম ধাপ শুরু করব। এবার বল সুজন, কেন তুই আমার ওপর গুলি চালিয়েছিলি? তোর সাথে আমার কোন শত্রুতা ছিল? মাত্র বিশ লাখ টাকার জন্য তুই আমার বুকে গুলি চালিয়েছিলি! তোর বাপ এর বেশি টাকা তোকে দেয়নি? ”

সুজন ফুঁসছে কোন কথা বলছেনা। ওকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে পুলক আবারও কথা বলল,

” কি রে কথা বল? তুই কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস গল্প না করেই নরকে যাবি? ”

” তোকে কিছু বলতে আমি বাধ্য নই, পুলক মির্জা। আমার দুর্ভাগ্য সেদিন তোকে মারতে পারনি। তবে আর একটা সুযোগ পেলে তোর লাশ আমি কুত্তা দিয়ে খাওয়াতাম। ”

সুজনের কথা শেষ না হতেই পুলক ওকে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। থাপ্পড় খেয়ে মাথা ঘুরে উঠল সুজনের। অজান্তেই হাত চলে গেছে গালে। ব্যথার চোটে চোখে পানি এসেছে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই মুখের ভেতর নোনতা লাগলে হাত সরাতেই বুঝতে পারল মুখের ভেতরটা রক্তে ভরে গেছে। চিনচিনে ব্যথাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সেই সাথে রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখের ভেতরটা। থুথু ফেলতেই দেখতে পেল মেঝেতে রক্তের সাথে তাো দাঁতও গড়াগড়ি খাচ্ছে। হতভম্ব সুজন অবাক চোখে পুলকের দিকে তাকায়। আজ পর্যন্ত তাকে এভাবে কেউ মারেনি। আর এক থাপ্পড়ে যে কেউ কারো দাঁত ফেলতে পারে এটাও আজ-অব্দি দেখেনি। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে সুজন। এই মুহূর্তে তার হাত-পায়ের বাঁধন খোলা থাকলে নিশ্চিত পুলককে কঠিন আঘাত করত। মেরে ফেলতেও দুইবার ভাবতনা।
মোচড়ামুচড়ি করে বাঁধন খোলার বৃথা চেষ্টা করছে সুজন। সেই সাথে হিসহিসিয়ে বলল,

” আমার গায়ে হাত তুলে খুব বড় ভুল করলি, পুলক মির্জা। বস যদি জানতে পারে তুই আমাকে আটকে রেখেছিস, তবে তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। ” কথা শেষ হতে না হতেই আবারও বুকে লাথি খেল সুজন। রক্তের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

” আগেই বলেছি আমাকে তুই বলবিনা। সম্ভাষনটা আমার ভিষণই অপছন্দের। তোর বস আমার বা… ছিঁড়বে বুঝলি? কান টানলে মাথা আসে, এই প্রবাদ শুনেছিস তো? আমি তোকে জেনে-বুঝেই এখানে এনেছি। তোর বসকে আমার সামনে আনতেই এতকিছুর আয়োজন। চাইলে একমাস আগেই তোকে আমি রাস্তায় কুত্তার মত মারতে পারতাম। কিন্তু তোর বস তখন আমার হাত থেকে ফসকে যেত। ”

” তু.তুমি চেনোনা আমার বসকে। সে কি করতে পারে সেই সম্পর্কে কোনও ধারনা তোমার নেই। ” মার খেয়ে অবশেষে তুমি করেই বলল সুজন।

” খুব ভালো করেই চিনি তোর বসকে। তার সম্পর্কে ধারনাও আছে। তার নির্দেশেই মাহমুদ আমার বাবাকে মেরেছিল। তার আমলনামা আরও দীর্ঘ। যা বলে শেষ করা যাবেনা। ”

পুলকের কথায় সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায়। শাহেদ বিশ্বাসই করতে পারছেনা ভাই সেই শত্রুকে চেনে কিন্তু তাকে কিছু বলেনি। সে বিস্ময় চেপে রাখতে পারলনা।

” ভাই! তুমি? ”

” হুম, সব জানি। তবে এখন এসব কথা বলার সময় নয়। পরে তোকে বলব। আগে এর ব্যবস্থা করি। এইটা বেশি ফটফট করছে। ”

” তুমি কতজনকে মারবে, পুলক মির্জা? বস তোমার পুরো পরিবার শেষ করে ফেলবে। এতদিনে শেষ করেই ফেলত। কিন্তু তুমি বউ-বাচ্চাকে যেভাবে প্রটেকশন দিয়ে রেখেছ, সেটা অবিশ্বাস্য। সুযোগ পেলেই বস তোমার বউ-বাচ্চাকেও শেষ করবে। সেই হুকুম দেয়া হয়েছে। ”

সুজনের কথা শোনামাত্রই সকলে পুলকের দিকে তাকায়। রাগে পুলকের চোখমুখ রক্তলাল হয়েছে। চোখের নিমেষেই কোমড় থেকে ওর প্রিয় ওয়ালথার পিপিকে বের করে আনল। গুলি চালাল সুজনের কপালের মাঝখানে। সাইলেন্সার লাগানো থাকায় ‘ খুক ‘ করে শব্দ করল ওয়ালথার পিপিকে। হলদে মগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরল মেঝেতে। নিজেরই রক্তের সাগরে লুটোপুটি খায় সুজন। সুজনের নিথর শরীরে পরপর কয়েকটা গুলি করল পুলক। ওর রাগ এখনো প্রশমিত হয়নি। ফ্যাসফেসে গলায় বলল,

” আমার স্ত্রী-সন্তানের দিকে নজর দেয়ার পরিনতি এটা। তোর মরন আরও দুই-একটা দিন দেরিতে হত, যদিনা তুই আমার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কিছু বলতিস। ”

” ভাই, তুমি বাসায় যাও। এদিকটা আমরা সামলাচ্ছি । তোমার যেতে দেরি হলে ভাবী রাগ করবে। ”

পুলক কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল ওর গোপন আস্তানা থেকে৷

***

” তিয়ু রে, সত্যি করে বলতো আমার আয়াস সোনা কার মত দেখতে হয়েছে? বদ লোকটা শুধু বলে আমার মত হয়েছে। কিন্তু আমার চোখে আমার বাবুইপাখিকে তার মত লাগে। ”

আশফির কথা শুনে হেসেই খুণ তিয়াসা। এই দু’জনকে ওর কাছে টম-জেরি মনে হয়। সারাক্ষণ খুনসুটি লেগেই আছে।

” আমাদের বাবুইপাখি ওর বাবার মতই হয়েছে। তুই বুঝিসনা কেন, ভাইয়া তোকে খুব বেশি ভালবাসে তাই সবকিছুতেই তোর প্রতিচ্ছবি দেখে। তোর বুদ্ধি হবে কবে বলতো? ”

” আমার এত বুদ্ধির দরকার নেই। এই বেশ আছি। তাছাড়া ঐ বদ লোকটার যত বুদ্ধি, যদি তার সাথে বুদ্ধির খেলা খেলতে যাই তবে আমি ধরা খেয়ে যাব। ”

” খুব ভালবাসিস না তাকে? ”

” ভালবাসি কিনা জানিনা। তবে তাকে না দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে আশেপাশে থাকলে ক্ষুধা,তৃষ্ণা কিছুই লাগেনা। তার হাসি দেখলে অশান্ত মন নিমেষেই শান্ত হয়ে যায়। তার ছোঁয়ায় সকল ক্লান্তি উবে যায়। এমনকি তার নিঃশ্বাসও আমাকে মাতাল করে। ”

তিয়াসা আশফির দিকে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে। সেদিনের বোকা আশফি হুট করেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। ভালবাসা বুঝতে শিখেছে। বর্ননা করতে শিখেছে প্রিয় মানুষের ভালবাসার। আসলেই ভালবাসা মানুষকে বদলে দেয়।

” আশফি, তুই তো দেখছি ভালবাসা বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছিস! কি সুন্দর বর্নণা করলি! তুই ভাইয়ার প্রেমে পরেছিস। অথচ দুই বছর আগেও তাকে দু’চোখে দেখতে পারতিসনা। ”

” সাধে কি আর তাকে ভালবেসেছি। সে ভালবাসা আদায় করে নিয়েছে। সব কিছুতেই সে জোর করতে পছন্দ করে। ”

পুলক রুমে ঢুকলে তিয়াসা ওর সাথে কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

তিয়াসা বেরিয়ে যেতেই পুলক আশফিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আশফি আবিষ্কার করল পুলক কাঁপছে। কিন্তু সে কোন প্রশ্ন করলনা, নিজেও পুলককে জড়িয়ে ধরল।

চলবে।