রাজনীতির রংমহল পর্ব-১৯

0
810

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_১৯

রুম ভর্তি মেয়েমানুষ। কেউ কেউ পার্লার থেকে সাজাতে এসেছে আবার কেউ কেউ এ বাড়ির আত্নীয়।প্রায় এক ঘন্টা ধরে স্পর্শীকে হলুদ শাড়ি পড়াচ্ছে পার্লারের মেয়েরা।অথচ পেরেই উঠছে না।একবার এক ভাবে পড়ায় তো আবার খোলে।ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠেছে স্পর্শী।সে নিজেই তো কত্ত ভালো করে শাড়ি পড়ে।ভার্সিটির বিভিন্ন ফাংশনে হোস্টেলের মেয়েরা তার কাছে আসে শাড়ি পড়ার জন্য,সাজার জন্য।এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে সবাইকে তেড়েমেরে রুম থেকে বের করে দিতে।তারপর নেতামশাইকে শাড়ি পড়ে বলবে-

দেখুন নেতামশাই,আমি কি সুন্দর করে শাড়ি টাড়ি পড়ে ফেলেছি।আপনি এই পার্লারের মেয়েগুলোকে বিদায় করুন, ওদের ফি বাবদ টাকা গুলো আমায় দিয়ে দিন।আমি গিয়ে পেট পুরে কয়েক প্লেট ফুচকা খাই।

কিন্তু আফসোস!বলতে পারছে না।নিজের বিয়ে বলে কথা। চোখে কাজল লাগানোর আগ মুহুর্তে’ই স্পর্শীর ফোনে টোন বেজে উঠলো।রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ঝাঝালো স্বরে ভেসে এলো-

বাহ!বাহ!চমৎকার!সত্যিই তুই প্রশংসার যোগ্য স্পর্শী।আমার মুখে চুনকালি ঘষে দিয়ে নিজেই নিজের জায়গা খুজে নিলি।

থেমে ঢুকরে কেদে উঠে বললো-

তোকে তো আমি এই শিক্ষা দেইনি মা।কি করে এমন কাজ করলি তুই?সবাই আমায় দোষারোপ করছে।আমায় দোষী বানাচ্ছে।আমি তোকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারি নি।সত্যিই আজ আমারো মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি।তোকে আমার একটুও স্বাধীনতা দেওয়া উচিত হয়নি।আর কিসের স্বাধীনতা?তোকে তো আমার কাছে নেওয়াই উচিত হয়নি।জন্মের পর এখানেই রেখে যাওয়া উচিত ছিলো। পরিবার ছাড়া বড় করেছি বলে ই আজ পরিবারের মর্মতা টা বুজতে পারলি না।

কি করে সবকিছু লুকালি আমার কাছে।ছেলে তোর পছন্দ,এমনকি বিয়েও করবি এই সামান্য কথাটুকু আমাকে বললে কি আমি তোকে বাধা দিতাম
কাল রাতেও তো তুই কথা বললি আমার সাথে।তখন
ও কি বলতে পারলি না।
নাক টেনে,
আমার’ই দোষ।আমিই একটু বেশী ভাবছি।আমিতো আর তোর মা না।খালামনি হই।মা হলে নিশ্চয়ই এতো বড় কথা লুকাতে পারতি না।আমায় ছাড়া বিয়ে করতি না এমনকি জামাইয়ের হাত ধরে তার বাড়িতে গিয়ে উঠেছিস সেটাও না জানিয়ে পারতিস না।যাই হোক,তোর বাপের বাড়ি এসেছিলাম।তুই ই তো আসতে বলেছিলি।এলাম,যা অপমানিত হওয়ার হলাম।এখন আবার চলে যাচ্ছি।ভালো থাকিস।

দম বন্ধ হয়ে আসছে স্পর্শীর।ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে গলার কাছে আসছে। হঠাৎ রুম থেকে দৌড় দিয়ে বারান্দায় ছুটে গেল।ফুপিয়ে উঠে বললো-

খালামনি,তুমি আমার কথাটা শোনো,প্লিজ।রাগ করো না।আমি তোমায় বলতেই চাইছিলাম কিন্তু পরিস্থিতি তেমন ছিল না ও মনি,তুমি চেনো না আমায়।আমি তোমাকে বলিনি এমন কোনো কথা আছে বলো?ও মনি,তুমি তো আমার মা ই বলো।মা ভুল ক্ষমা করে দেয় তো।তুমিও দাও না।সরি সরি!আর কখনো এমন হবে না।

ওপাশ থেকে বিপাশার কান্নার আওয়াজ শুনে স্পর্শী আরো জোরে কেদে দিলো।মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো-

আমি ভীষণ একা খালামনি।আমার কষ্ট টা কেউ বুঝবে না।কি নেই আমার,শুধু মা ই তো নেই।বাদ বাকি সব আছে।কিন্তু সব থাকতেও কেউ নেই আমার।আমি ভীষণ একা।আমি আশেপাশে তাকালে আমার পাশে কাউকে দেখতে পাই না ।দিন শেষে কারো কাছে নিজের কষ্ট গুলো শেয়ার করবো এমন মানুষ নেই।এমন কেন হলো আমার জীবন।অন্য পাচটা মেয়ের মতো কেন নয়।সব সময় হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করি,আনন্দ -মজায় নিজেকে মাতিয়ে রাখি।সবাই ভাবে আমার মতো সুখী কেউ নাই।কিন্তু দিনশেষে আমি তো জানি,আমি কতটা একা।এই একাকীত্বের মধ্যেই হঠাৎ করে এই মানুষ টা এলো আমার জীবনে।কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি প্রশ্রয় দেই নি,একটুও দেইনি।তাও পিছু ছাড়ছিলো না আমার।পরিস্থিতি এমনভাবে আমাকে ঝাপটে ধরলো যে আর অবহেলা করতে পারলাম না। বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিয়েছিলো বলেই লুকিয়ে বিয়েটা করেছিলাম।ভেবেছিলাম,এত তাড়াতাড়ি কাউকে জানাবো না।কিন্তু পরিস্থিতি হতে দিলো না।

ও মনি,জানো?আজকে এ বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে আমার বিয়ের।অথচ, আমি ভীষণ একা।এতো এতো মানুষ অথচ একটা চেনা মানুষ নেই আমার। আমার নিজের কেউ নেই।মুরুব্বিরা বারবার জিজ্ঞেস করে “তোমার বাবার বাড়ির সবাই কই?”
জানো,খুব কষ্ট হয়।আজ মা বেচে থাকলে হয়তো কখনোই আমায় একা একটা অপরিচিত বাড়িতে ছাড়তো না।সত্যিই তোমরা ভুল করেছো,আমার ভাগ্যটাই পুরোটা ভুল।কি হতো মা মারা না গিয়ে ওইদিন আমি মরলে।

টুট টুট করে কেটে দিল পিয়াশা। স্পর্শী ফোনের দিকে তাকালো।ধীরে ধীরে কান্নাগুলো আরো বাড়ছে।হৃদয়ের ব্যাথাটা হু হু কান্নার স্বরে প্রকাশিত হচ্ছে।

*********
ভাইয়া,ভাবি তো ভীষণ কান্নাকাটি করছে।হলুদ সাজটাও এখনো কম্পিলিট হয়নি।

প্রেমার কথা শুনতেই ভ্রু কুচকে তাকালো পরশ।স্পর্শী কাদছে,কেন?নিচে বাবুর্চিদের সাথে কথা বলছিলো সে।দ্রুতপায়ে হনহন করে হেটে এলো দোতলায়।রুমের ভেতর ঢুকতেই চারদিকে তাকালো।স্পর্শী কোথাও নেই।এমপি সাহেব কে দেখে অলরেডি অনেকেই রুম ছেড়ে দিয়েছে। পরশ ত্রস্ত পায়ে হেটে বারান্দার কাছে গেল।দরজা খোলা।ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো দেয়ালে হেলান দিয়ে হাটু মুড়ে বসে অনবরত কাদছে স্পর্শী।গায়ের হলুদ শাড়ি এলোমেলো হয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।পরশ দ্রুতবেগে স্পর্শীর পাশে বসলো।দুহাত দিয়ে দুগাল আকড়ে ধরে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

স্পর্শীয়া,কি হয়েছে?এ্যাই পাগলী,কাদছো কেন?

স্পর্শী মাথা তুলে করুন চাহনি নিয়ে পরশের দিকে চাইলো।চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে গেছে।পরশের বুক চিনচিন করে উঠলো।দুহাত দিয়ে আগলে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো স্পর্শীকে।

আমি খুব খারাপ,বেহায়া,অসভ্য,বেয়াদপ একটা মেয়ে।তাই না নেতামশাই?(নাক টেনে বললো স্পর্শী)

পরশ আলতো হাসল।মাথায় হাত বুলিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো-
কি হয়েছে পাখি?

ঢুকরে কেদে উঠলো স্পর্শী। বলল-

খালামনি এসেছে ও বাড়িতে।আমার জন্য সবাই ওনাকে অপমান করেছে। আমার উপর খুব রেগে আছে মনি।আমার বিয়েতে কেউ আসলো না।

বলেই হুহু করে কেদে দিলো।পরশ উত্তেজিত হয়ে পড়লো।নিজেকে সং যত করে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো-

খালামনি আসলে খুশী হবে?

মাথা তুলে চাইলো স্পর্শী।চোখ মুখ চকচক করছে।মুখে বললো-

ভীষণ।

–নাম্বার দাও তো খালামনির।

স্পর্শী দিলো।পরশ চলে গেল সেখান থেকে।স্পর্শী সেভাবেই বসে রইলো।আদোও কি আসবে মনি?

*********

আসসালামু আলাইকুম।

–ওয়ালাইকুম আস সালাম।কে বলছেন?

–খালামনি আমি পরশ শিকদার বলছি।স্পর্শীর হাসবেন্ড।

শোনামাত্রই ধাক্কা খেল বিপাশা। তার নাম্বার জানবে কিভাবে এই ছেলে।

–স্পর্শী খুব কাদছে খালামনি।একবার আসবেন প্লিজ।ওর তো মা নেই।শুনলাম আপনিই ওকে ছোটবেলা থেকে বড় করেছেন মায়ের মতো। একবার আসুন না।আপনার দোয়া খুব প্রয়োজন আমাদের।

নিঃশব্দে কেদে দিলেন বিপাশা।মেয়েটা যে খুব কাদছে সেটা সে দূরে থাকলেও বুজতে পেরেছে।মুখে বললো-

আমি তো তোমাদের বাসা চিনি না বাবা।

পরশ আলতো হাসলো। বললো-

আপনার আসতে হবে না।সরদার বাড়িতেই আছেন তো।আমি আসছি,আপনাকে ফোন দিলে গেটের সামনে আসবেন।

–ঠিকাছে।

ক্রদ্ধ হয়ে এগিয়ে এলো সোভাম।পিছনে রাহুল ও রয়েছে।দাতে দাত চেপে বললো-

আপনি কোথাও যাবেন না খালা।ও বাড়িতে এ বাড়ির কারো পা পড়লেও তার সাথে সম্পর্ক থাকবে না আমাদের।চুপচাপ এসেছেন ভালো কথা, থাকুন নয়তো আবার ঢাকায় চলে যান।ও বাড়িতে যেন আপনাকে যেতে না দেখি।রাহুল ভাই,তোমার মাকে বোঝাও।

তুমি এতো মাতব্বরি করছো কেন?কেউ দিয়েছে তোমাকে এই অধিকার।গত ক দিন যা করেছো মুখ বুঝে সহ্য করেছি।তাই বলে ভেবো না, সামনে যা করবে তাও সহ্য করবো।তোমার ইচ্ছে নেই যেও না।বাড়ির কেউ ও যদি না যেতে চায় তাহলে যাবে না।তাই বলে বিপাশাকে আটকানোর কে তুমি।ওর ইচ্ছে হলে ও যাবে নয়তো না।এটা সম্পুর্নই ওর ব্যাপার।তুমি আমি নাক গলানোর কেউ না।

চেচিয়ে কথাগুলো বলে উঠলেন শামসুল সরদার। তারপর আবারো বললেন-
আমি চাই না এ বাড়িতে আর ওই ব্যাপারে বা শিকদার বাড়ি সম্পর্কে কোনো কথা উঠুক।যার ভবিষ্যৎ সে দেখে নিয়েছে।ব্যাস,আগেও যেমন স্পর্শীকে নিয়ে এ বাড়িতে কোনো চর্চা হয় নি,আমি এখনো চাই সেটাই হোক।মনে করবে, ও এখনো ঢাকায় পড়ছে।

বলেই নিজের রুমে চলে গেলেন।সোভাম ও রেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।রান্নাঘরে মায়ের আচলের পিছনে দাঁড়ানো আর্শি নিচু স্বরে মাকে বললো-

ও মা,আব্বুতো বললো যার ইচ্ছা সে যেতে পারে,তাহলে কি আমিও যেতে পারবো।আমার তো খুব ইচ্ছা করছে।

আতকে উঠলেন আর্শির মা।মেয়ের মুখ চেপে ধরে বললেন-

মার খাবি আর্শি।চুপচাপ ঘরে গিয়ে পড়তে বস।বড়দের ব্যাপারে নাক গলাস না।যা।

********
প্রেমার রুমে খাটের উপর বসে আছে স্পর্শী।মুখ চোখ জুড়ে মন খারাপেরা বিরাজ মান।সাজসজ্জাহীন শুধুমাত্র হলুদ শাড়িটা যেন নতুন এক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে।হঠাৎ দরজা দিয়ে বিপাশা ঢুকতেই হা হয়ে গেল স্পর্শী।বিপাশার মুখ চোখ খুশিতে চকচক করছে।স্পর্শী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে।তারপর খাটের উপর বসিয়ে বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর মাথা দিয়ে ওভাবেই পড়ে রইলো দশ মিনিট।কেউ কিচ্ছু বললো না।প্রায় অনেকক্ষণ পর বিপাশা নিজ হাতে সাজাতে বসলো স্পর্শীকে।ঢাকায় নিজস্ব পার্লার ছিলো এককালে তার।কিন্তু গত চার বছর ধরে বন্ধ করে দিয়েছে সেটা।খালামনির পার্লারের কারনেই স্পর্শী শাড়ি কিংবা সাজগোজে বেশ পটু।

চমৎকার ভাবে নিজের ভেতরের সবটুকু দিয়ে আজ স্পর্শীকে সাজিয়েছে বিপাশা।একটু পরেই গায়ে হ্লুদ।পরশ এবং স্পর্শীকে তাদের ছাদে নিয়ে একসাথে বসিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করেছে সবাই।

*********
দুপুর একটা।গোলাপী রঙের বেনারশী পড়ে রুমের ভেতর হাটছে স্পর্শী।একটু পরেই বিয়ে পড়ানো হবে তাদের।পরশকে রুমের সামনে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নিচে যেতে দেখেই স্পর্শী দাত কেলিয়ে হেসে দিল।এই মুহুর্তে সে তার নেতামশাইকে সামান্যতম জালাবে।সেটা ভেবেই নেতামশাই বলে জোরে ডাক দিলো।
দুম করে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।স্পর্শী ছুটতে ছুটতে সিড়ির কাছে এলো।হাপিয়ে উঠে বললো-

নেতামশাই,ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা ছিলো আপনার সাথে।

হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভংগিতে পরশ বললো-

হ্যা,বলো।তাড়াতাড়ি, কিছু রাজনৈতিক নেতা আসবে। ওদের রিসিভড করবো।

–আসলে আমি ভাবছিলাম।শুনছেন তো।

–আরে বাবা শুনছি।বলো।

–বলছি,বিয়ে তো তিন বার কবুল বললেই হয়।তো আমি তো অলরেডি তিনবার কবুল বলে দিয়েছি।এখন যদি আবার বিয়ে হয়,তাহলে তো আবার তিনবার কবুল বলতে হবে।তো বলছিলাম কি,তিনবারের পর আবার তিনবার বললে, এই তিনবার মাইনাস হয়ে যাবে না।মানে,তিনবার মাইনাস তিনবার সমান জিরো।তো এক্ষেত্রে তো কাটাকাটি হয়ে যায়।তাহলে তো আমাদের বিয়ে ক্যানসেল হয়ে যাবে।তাই না।

পরশ চিবুক শক্ত করে স্পর্শীর দিকে চাইলো।থমথমে মুখে বললো-

এটা তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা।

স্পর্শী না বোঝার ভান ধরে বললো-হ্যা,কেন?আপনার মনে হয় না।

পরশ হতাশ হয়ে নিচে নামতে আরম্ভ করলো।স্পর্শী ছলছল চোখে তাকালো।এই যে সে বিয়ের সাজে সেজে আছে অথচ লোকটা কিচ্ছু বললো না।সে তো সাজ দেখানোর জন্যই মজা করার অজুহাতে এসেছিলো।অথচ পরশের কাছে তার রাজনৈতিক নেতারা ই সব।নিজেকে চরম বেহায়ার লিস্টে ফেলে পুনরায় বলে উঠলো-

আমাকে কেমন লাগছে নেতামশাই?

চলবে?