রাজপুরুষ পর্ব-০১

0
642

#রাজপুরুষ
#এক
#জান্নাতুল_নাঈমা

হুমায়রা আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার কারণ জানিয়ে গেছে ছোটোবোন হানিকে। হানির বয়স চৌদ্দ বছর। গ্রামের সবচেয়ে সরলা একটি মেয়ে। তবুও বড়ো বোনের যন্ত্রণা বুঝেছে। সে বুঝতে পেরেছে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বড়ো বোন হুমায়রার। সতেরো বছর বয়সী অবিবাহিত মেয়ে গর্ভবতী হলে তার আর কী করণীয় থাকতে পারে? হুমায়রার মৃত্যুর দু’দিন পর। চৌধুরী বাড়ি থেকে মৌখিক নোটিশ এলো, হানির বাবা, মা এ গ্রামে থাকতে পারবে না। সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। অশিক্ষিত, বলহীন, দিন এনে দিন খাওয়া এই পরিবার সর্বহারা হয়ে গেল। রাতের আঁধারে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিলো। বাবা, মায়ের সঙ্গে পোঁটলাপুটলি বুকে জড়িয়ে হানিও চলল দূরান্তে কোথাও। ওরা যখন নৌকায় উঠল হঠাৎ হানি মাকে বলল,
‘ মা ও মা একটু সময় অপেক্ষা করবা? আমি একটা দরকারি জিনিস ফেইলা আইছি। ‘

মা মাথা নাড়ল। হানিও ছুটতে লাগলো, তাদের ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের উদ্দেশ্যে। বাড়ি ফিরে চমকে গেল হানি। মশাল হাতে এতগুলো লোক কারা? সরল হানি না পিছিয়ে এগিয়ে এলো।
‘ তোমরা কারা গো? ‘

মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে একজনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তার পাশে থাকা ব্যক্তিকে ইশারায় কিছু একটা বলতেই সে দ্রুত হানির দিকে এগিয়ে বাঁহাতে থাকা লাঠি দিয়ে হানির মাথায় আঘাত করল। নিমেষে জ্ঞান হারালো হানি। তার ছোট্ট শরীরটা মাটিতে ঢলে পড়তে গিয়েও পড়ল না। বলবান দুটো হাত থাবা দিয়ে ধরে ফেলল।

মাঝরাত পর্যন্ত হানির বাবা, মা অপেক্ষা করল। মেয়ে তাদের ফিরল না। এদিকে মশাল হাতে অনেক সংখ্যক লোক দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মাঝি নৌকা বাইতে শুরু করে। হানির বাবা, মা মাঝ নদীতে গিয়ে ফিরে আসতে চায়। মাঝি ভয় দেখায়। সাহসে কুলোয় না তবুও হানির মা মাঝিকে বাধ্য করে ফিরে যেতে। মাঝি নৌকা ঘাটে ফিরিয়ে আনে। হানির মা ছুটে যায় নিজেদের বাড়িতে। কিন্তু হানিকে পায় না। মুহুর্তেই মাতৃহৃদয় হুহু করে উঠে। কোথায় গেল তার ছোট্ট হানি?
…..
দীর্ঘ দুমাস পর গৌরবপুর গ্রামের গৌরব গৃহে ফিরে এলো শাহজাহান লেয়ন। ছেলের ফিরে আসার খবর শুনে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে অন্দরমহল থেকে ছুটে এলেন মল্লিকা। এসেই বাড়ির আর সবার মতো থ হয়ে গেলেন তিনি। মল্লিকা খুব দৃঢ় ব্যক্তিত্বের নারী হলেও একমাত্র পুত্রের কাছে নিছকই বাঙালি, মায়াময়ী সরল সোজা মা। মস্ত বড়ো উঠানে বাড়ির সদস্যদের ভীড়। এরমধ্যে কাজের লোকই রয়েছে, সতেরো জন৷ লেয়ন ভীষণ ক্লান্ত। এদিকটা সর্বপ্রথম যার খেয়াল দেওয়া উচিত সেই দিলো। সে হলো এ বাড়ি উহুম এ গ্রামের সবচেয়ে রূপবতী, গুণবতী রমণী তুলা। তুলার বয়স একুশ বছর। পড়াশোনা করেছে ক্লাশ সেভেন পর্যন্ত। তারপর থেকেই ঘর, সংসারে ব্যস্ত সে। লেয়নের প্রাণভোমরা তুলা ছুটে গিয়ে গ্লাসে পানি ভরে আনলো। দীর্ঘ দুমাস পর তুলা লেয়ন মুখোমুখি। লেয়ন তার ঘন পল্লব বিশিষ্ট সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া নিক্ষেপ করল তুলার সুচারু মুখে। মনে তীব্র অভিমান, প্রশ্নে জর্জরিত বুক। তবুও হৃদয় গহিনে থাকা ভালোবাসার অভিমান গুলো উপচে পড়ল তুলার। হৃদয় পুরুষটির ধারালো দৃষ্টির ভার সইতে না পেরে মস্তক নত করে লাজুক মুখে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরল৷

লেয়নের দৃষ্টি তুলাতেই আটক। বুকের গভীরে মৃদু চিৎকার, ‘ তুলারে কতদিন পর তোকে দেখি। ‘ অধৈর্য হৃদয় পরপরই শুধায়, ‘ এই তুলা, তুলারে কখন ছুঁতে দিবি? বুকে আসবি কখন প্রাণ আমার? ‘

এক নিঃশ্বাসে পানি পান করে গ্লাস ফেরত দিলো লেয়ন। সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে এলো বড়ো মামা সিরাজ ভূঁইয়ার প্রশ্নবাক্য।

‘ তোমার পাশের মেয়েটা কে লেয়ন? ‘

প্রশ্ন! লেয়ন খুব ঘৃণা করে প্রশ্নকে। শুধুমাত্র মা আর তুলা ছাড়া কারো প্রশ্নের তোয়াক্কা করে না সে। আর না কখনো উত্তর দেয়। অন্যের করা প্রশ্নবাক্যে বড্ড বিরক্ত হয় সে। ইগোতে লাগে ভীষণ। ত্যাড়ামো জাগে প্রচণ্ড। অপর ব্যক্তি প্রশ্ন করেছে মানে উনি মরে গেলেও সে উত্তর দেবে না। শাহজাহান লেয়ন অন্যের প্রশ্নের জবাব দিতে জন্মায়নি। সে শুধু নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়। আর তার নিজের মানুষ হচ্ছে মা আর তুলা। মামারা জানে তবুও বারবার কেন যে ভুল করো।

তুলার থেকে দৃষ্টি সরালো লেয়ন। প্যান্টের পকেটে এক হাত গঁজে অপরহাতে বুকের বা পাশে বুলাতে বুলাতে মায়ের দিকে তাকাল। মল্লিকা তক্ষুনি প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ মেয়েটা কে? ‘

একপেশে হেসে ভারিক্কি কণ্ঠে লেয়ন উত্তর দিলো,

‘ নাম হানি। ‘

পরপরই তুলা এগিয়ে এলো৷

‘ বাড়ি কোথায়? কোথায় থেকে এলো তোমার সঙ্গে?’

তুলার উতলা কণ্ঠ পেতেই লেয়ন গম্ভীর হয়ে গেল। তুলা তবুও শান্ত হলো না। মল্লিকাও একই প্রশ্ন করলেন,

‘ নাম যাইহোক ও তোমার সঙ্গে কেন? ‘

‘ নিয়ে এসেছি তাই। ‘

‘ কেন নিয়ে এসেছো? ‘

‘ ইচ্ছে। ‘

আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না লেয়ন। প্রচণ্ড দম্ভের সঙ্গে দৃঢ় পদক্ষেপে নিজের ঘরে দোতলায় চলে গেল। অতি আশ্চর্য হয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল বাড়ির প্রত্যেক সদস্য। শুধু তুলার চোখ, অল্পবয়সী হানির দিকে।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হানি। মস্ত বড়ো বাড়ির মস্ত বড়ো উঠানে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে। হঠাৎ তুলা খপ করে তার হাত ধরল। টেনে নিয়ে বারান্দায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ হানি তোমার বাড়ি কোথায়? ‘

হানি জবাব দিলো না। তুলা এবার মিষ্টি হেসে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করল। বলল,

‘ তোমার বাবা, মা কোথায়? ‘

হানি তাকিয়েই রইল। তুলা খুব সুন্দরী। যেমন সুন্দর, মায়াবী তার মুখ তেমনি সুগঠিত শরীর। গ্রামের যাত্রাপালায় এক নায়িকাকে দেখেছিল হানি। এমনই লম্বা ছিপছিপে গড়ন, সুন্দর মুখ, ধারালো চোখ আর ফুটফুটে হাসি ছিল তার৷ চুলগুলোও ছিল লম্বা, ঘনকালো। হানি খেয়াল করল তুলার কানে, নাকে, গলায়, হাতে সব সোনার গহনা। পরনের শাড়িটাও কত সুন্দর। দুই পায়েও নজরকাড়া রুপোর নুপুর। সে গরিব ঘরের মেয়ে। এমন গহনা দু-চোখে দেখেনি পরবে দূরে থাক। তবে তার আপার রুপোর নুপুর ছিল। মাঝে মাঝে সে নুপুর সেও পরতো।

হানি শুধু তাকিয়েই আছে। বলছে না কিছুই। মল্লিকা বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। একটু পরই লেয়নের বড়ো মামা আর ছোটো মামার ছেলে, মেয়েরা তুলা আর হানির কাছে এলো। সবাই একাধারে প্রশ্ন শুরু করল হানিকে। বেচারি হতবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই রইল। উত্তর দিতে পারলো না কিছুই। তুলা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাই ভাবলো, আস্তেধীরে সময় নিয়ে মেয়েটির সম্পর্কে জানবে। তাছাড়া লেয়ন তো আছেই। তার অতো চিন্তা কীসের। হানি কিছু না বললে লেয়নের থেকে শুনবে। কোন সময় লেয়নের থেকে শুনে নিতে পারবে তা খুব ভালো করেই জানা আছে তার। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুলা।

এদিকে লেয়নের মামাতো ভাইবোনরা হানিকে নিয়ে চর্চা করতে ব্যস্ত। মামাতো বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো সাঁঝমালতী। ছোটো মামার মেয়ে। সবাই সাঁঝ বলে ডাকে। বয়স বারো বছর। সে বলল,

‘ তুলা আপা হানি কি বোবা? ‘

বড়ো মামার ছোটো ছেলে রবিন। ক্লাস টেনে পড়ে। সাঁঝের কথা শুনে সে বলল,
‘ ঠিক ধরেছিস সাঁঝ। হানি বোবাই হবে। ‘

ওদের কথা শুনে তুলারও মনে হলো হানি বোবা। তাই কাজের মেয়ে ডেকে হানির থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলল।

রাত দশটা। লেয়ন বই পড়ছে। সেই সময় তুলার আগমন ঘটল। ঘুমানোর আগে এক গ্লাস গরম গরম দুধ খেতে ভালোবাসে লেয়ন। তুলা চপল পায়ে এসে দুধের গ্লাস রেখে চলে যেতে উদ্যত হতেই লেয়ন তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে। তুলা ফিরে তাকাতে গিয়েও ফিরে না৷ ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে তার অভিমানী অনুভূতি বোঝায়। লেয়ন হাসে। গম্ভীর প্রকারের এক অদ্ভুত হাসি৷ তারপর শাড়ির আঁচল ছেড়ে দেয়। তুলা প্রস্তুতি নেয় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার। মুহুর্তেই উচ্চারিত হয় লেয়নের আদেশ বাণী।
‘ দরজা খুলে এসেছিস যে? আঁটকে আয়। ‘

বুকের ভেতর ধক করে উঠে তুলার। এ আদেশ অগ্রাহ্য করার সাহস বা শক্তি কোনোটাই তার নেই।