রাজপুরুষ পর্ব-০২

0
1041

#রাজপুরুষ
#পর্ব_২
দরজা আঁটকে পিছ মুখী হয়েই দাঁড়িয়ে রইল তুলা। লেয়ন দুধ পান করে টেবিলের উপর গ্লাস রাখল। সীসার গ্লাসটি মৃদু শব্দ করতেই চমকে উঠল তুলা। ফিরে তাকাল তক্ষুনি। লেয়ন মুখ গম্ভীর, দৃঢ় চোয়াল, সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এক পলক তুলাকে দেখল। তারপর নিজের পরনের সাদা পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলল আচমকা। নিমেষে বলবান শরীরের পেশিবহুল হাতজোড়া দৃশ্যমান হলো। ঢোক গিলল তুলা। লেয়ন রাজবংশের ছেলে। তার বিস্ময়কর উচ্চতা, বলিষ্ঠ শরীর, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সবকিছুই যেন শাহজাহান ধীরাজের প্রতিচ্ছবি। হবে নাইবা কেন? ধীরাজ যে লেয়নের জন্মদাতা। আর তুলা? ধীরাজের একমাত্র ভাতিজি। লেয়ন যেমন রাজবংশের পুত্র। তুলাও রাজবংশীয় কন্যা। ব্যক্তিত্বের দিকে এরা কেউ কারোও থেকে কম নয়। তবে তুলা হেরে গেছে এক জায়গায়তেই। ওই যে নারীমন। ছোট্টবেলা থেকে ভালোবাসে মানুষটাকে। শিশু কন্যা থেকে কিশোরীতে পদার্পণ করতে না করতেই মা ( মল্লিকা) মানুষটার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন। এ বাঁধন আর পাঁচটা স্বাভাবিক বাঁধনের মতো নয়। এ বাঁধন পবিত্র যার নাম শুধু প্রেম, ভালোবাসাও নয়। এ বাঁধন এ সম্পর্কের নাম নাম বিয়ে। তারা স্বামী-স্ত্রী। একে অপরের সবচেয়ে আপনজন।

লেয়নের গায়ের বর্ণ খুবই কালো। তুলার মতো মেয়ের পাশে দাঁড়ালেও তাকে এক দানবীয় পুরুষ মনে হয়। মজবুত শরীরের ভারিক্কি লেয়নের মুখে দাঁড়ি নেই। তবে রাজকীয় মোটা মোচ আছে। যা তার চেহেরায় নিজের বাপ, দাদাদের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম।

তুলার বুক ধুকপুক করছে। লেয়ন ধীর পায়ে দক্ষিণ জানালার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল। তুলা গিয়ে বিছানায় বসল চুপচাপ। লেয়ন জানালা খুলে ফিরে তাকাল তুলার দিকে। বলল,

‘ বসলি যে? বাতি নিভিয়ে কাছে আয়। ‘

মুহুর্তেই তুলার দৃষ্টি টলমল হয়ে যায়। নীরবে উঠে দাঁড়ায় সে। বাতি নেভাতে মন সায় দেয় না। তবুও বাধ্যতা মেনে বাতি নেভায়। জোছনার আলোয় আলোকিত প্রকৃতি। তার এক টুকরো লেয়নের ঘরেও এসেছে। সেই আলোতে তুলা পা বাড়ায়। লেয়নের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে চট করে ঘুরে দাঁড়ায় লেয়ন। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধায়,

‘ কী কারণে এই দীর্ঘশ্বাস কাছে আসতে বলায় নাকি দুমাস দূরে থাকায়? ‘

তুলা কী বলবে? উত্তর খুঁজে না পেয়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। লেয়ন উত্তর খুঁজতে ঘাড় নিচু করে। তুলার মুখোমুখি হয়ে জোছনার আলোয় তাকিয়ে রয়। চোখ গলে অশ্রু ঝরে তুলার। লেয়ন সে অশ্রু দেখে এক কদম সরে যায়। এরপর দু-হাত দুদিকে মেলে ধরে তুলাকে ডাকে,

‘ কাঁদিস না তুলা, বুকে আয়। ‘

গলে যায় তুলার মন। ঝরের বেগে লেয়নের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। দখিনা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় দুটি দেহের এক মনকে। দীর্ঘ দুমাস পর তুলাকে কাছে পেয়ে উন্মাদ হয়ে পড়ে লেয়ন। সারারাত ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখে। তুলা কাঁদে, সুখে বিমোহিত সে কান্নায় লেয়নের ভালোবাসা বাড়ে, গভীর হয় সকল আদর।

ফজরের আজান ধ্বনি কানে বাজতেই লেয়নকে সরিয়ে দেয় তুলা। আশপাশ হাতড়ে পরনের শাড়িটা খুঁজে পায়। বাতি জ্বালানো নিষেধ। বাতি জ্বালালেই মানুষটার কাঁচা ঘুম ভেঙে যাবে। তারপর আগুন চোখে তাকিয়ে বলবে,

‘ কতদিন বলেছি এ সময় বাতি জ্বালিয়ে আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিবি না তুলা। ‘

তাই অন্ধকারেই কষ্ট করে শাড়ি পরে নেয় তুলা। তারপর পা টিপে টিপে লেয়নের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। দীর্ঘ সময় গোসল করে শরীরের ব্যথা কমায়। এরপর ভেজা কাপড় পাল্টে খুব সুখী রমণী হয়ে গোসলঘর থেকে বেরোয়।

গৌরব গৃহ নামের বাড়িটা বিশাল বড়ো। এ বাড়িতে সদস্য সংখ্যাও অনেক। বাড়ির এক ভাগে, নিচতলায় থাকে কাজের লোকেরা। সেই ভাগেই জায়গা হয়েছে হানির। ভানুমতি এ বাড়ির অনেক পুরোনো কাজের মহিলা। সবাই তাকে ভানু খালা বলে ডাকে। ভানু খালার ঘরেই জায়গা হয়েছে হানির। রাতে হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছে হানি। সকালবেলা ভানু খালার ডাকে ঘুম ভাঙলো। হানি কারো সাথে এখন পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি। সবার ধারণা হানি বোবা। সকালের নাস্তায় গুড় মুড়ি দেওয়া হলো হানিকে। ভানু খালা আর হানি দুজন মিলে গুড় মুড়ি খেলো। এরপর ভানু খালা চলে গেল কাজে। হানি একাকী বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত বোধ করল। বিরক্তি কাটাতে সে পা বাড়ালো দরজার বাইরে। প্রথমে নজরে পড়ল বাড়ির সকল কাজের মানুষদের। সবাই ছুটোছুটি করে কাজ করছে। হানির গুটিগুটি পায়ে এগুতে থাকে। তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে। মন খুঁজে কাউকে। দেখা হয় সাঁঝের সঙ্গে। সে স্কুল ব্যাগ কাঁধে বেরুচ্ছে। তার হাত ধরে আছে সুনাম মামা। এ বাড়ির আরেকজন কাজের মানুষ। এনার দায়িত্ব সাঁঝকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা। এর আগে মামাদের ছেলে সজল, রবিন এদেরও স্কুলে নিয়ে গেছে, নিয়ে এসেছে। এখন তারা বড়ো হয়েছে। সুনাম মামাকে আর প্রয়োজন নেই। সাঁঝ এখনো বেশ ছোটো তাই সুনাম মামা দায়িত্ব পালনে সর্বদা সোচ্চার। হানি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে। হঠাৎ দোতলার সিঁড়ির দিকে নজর পড়ল। প্রচণ্ড তাড়া নিয়ে তুলা নামছে। তুলার সৌন্দর্য দেখে হানির চোখ দুটো ঘনঘন পলক ফেলে। আজ কালো রঙের জামদানী পরেছে তুলা। তার ফর্সা ত্বকে কালো রঙের জামদানী চকচক করছে। কানে সোনার ঝুমকো। নাকে বড়োসড় সোনার নাকফুল। গলায় মোটা চেইন। দুহাতে চুড়ি। পায়ের নুপুর শব্দ তুলছে ঝুনঝুনাঝুন। হানির চোখে বিস্ময়। এমন ধারালো সুন্দর মেয়ে মানুষ সে এর আগে কখনো দেখেনি। তুলা ছুটছে রান্নাঘরে। হানি ঘোরের মাথায় তার পিছু নিল। তুলা রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় গরম পানি দিলো। লেয়নের উঠার সময় হয়েছে। ঘুম ভাঙার পর ধোঁয়া উঠা গরম চা পান করে মাথা পরিষ্কার করে লেয়ন। অন্যদিনের তুলনায় আজ তুলা খুব স্বতঃস্ফূর্ত। তুলাকে এই রূপে দেখে বাড়ির সবার মনও ফুরফুরে হয়ে গেল। তুলা খুশি মানেই লেয়ন ঠিক আছে, মাথা ঠান্ডা লেয়নের। লেয়নকে আপাদমস্তক বুঝতে তুলার চোখ আর মুখই যথেষ্ট। চা বানানো শেষ। তুলা ছুটল সিঁড়ির দিকে। মুখে ডাকল, ‘ এমদাদ ভাই? ‘

উঠান পেরিয়ে দৌড়ে এলো এমদাদ ভাই। এক প্যাকেট সিগারেট চায়ের কাপের পাশে ট্রেতে রেখে ফিরে গেল সে। তুলা হাসলো। নিশ্চিত মনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল লেয়নের ঘরে।

ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে নিয়েছে লেয়ন। তুলা তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করল। চোখ দুটি জুড়িয়ে গেল লেয়নের। মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে বিড়বিড় করে বলল,

‘ তুলা তুলারে দিনদিন তোর সৌন্দর্য সীমা ছাড়াচ্ছে।’

লেয়নের দৃষ্টিতেই সবটা বুঝে নিলো তুলা। একরাশ লাজুকতা এসে ভর করল ওর চোখেমুখে। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে হাত কাঁপল একটু। লেয়ন চায়ের কাপটা সরিয়ে টেবিলে রাখল। তুলার চোখে প্রশ্ন,
‘ চা খাবেন না? ‘

উত্তরে একপেশে হেসে খুব কৌশলে তাকে কোলে বসালো লেয়ন। ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিলো তুলতুলে নরম শরীরের। তুলা ফিসফিস করে বলল,

‘ দরজা খুলে এসেছি। ‘

পরপরই লেয়নের ভারিক্কি কণ্ঠ,

‘ এ ঘরের আশপাশে তুই ছাড়া কেউ আসে না তুলা। ‘

লেয়নের স্পর্শ আরো গভীর হয়। তুলা বলে,

‘ চা ঠান্ডা হলো। ‘

লেয়ন উন্মাদ। তুলাতে বিভোর। তবুও কীভাবে যেন ওর দৃষ্টি হঠাৎ দরজার দিকে চলে যায়। অমনি চোখ, মুখ কঠিন হয়ে উঠে। ‘ কে! ‘

চমকে উঠে দাঁড়ায় তুলা। পড়ে যাওয়া ঘোমটা তুলে দ্রুত। এরপর দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় হানিকে। মুহুর্তেই তুলার মুখ শক্ত হয়। এত বড়ো স্পর্ধা হানির। তার আর লেয়নের ঘনিষ্ঠ সময়ে ঘরে উঁকি দেয়! তুলার পেছন পেছন লেয়নও এগিয়ে আসে। দেখতে পায় সদ্য কিশোরে পা দেওয়া এক নারীকে। নাম তার হানি। মাঝামাঝি উচ্চতায় ছিপছিপে গড়ন। গায়ের বর্ণ সোনালি। চোখ দুটো সরল, মায়া মেশানো। তরতরা নাক, পাতলা, মসৃণ ঠোঁট। গলার হাড়গুলো বেরিয়ে এসেছে। পরনে পুরোনো, ছেঁড়া একটা সূতি শাড়ি। চুলগুলোয় কতদিনের জট লেগেছে কে জানে! পা দুটোতে ময়লা লেগে আছে। কেউ কি হানিকে হাত, পা ধোয়ার সুযোগ করে দেয়নি? কেউ কি ওকে একটা কাপড় হাতে ধরিয়ে বলেনি, ‘ এটা পরে নাও মেয়ে। এ বাড়িতে কাজের মেয়েরাও ছেঁড়া কাপড় পরে না৷ ‘

মুহুর্তেই লেয়ন অনুভব করে ভুলটা তারই।

‘ তুমি এখানে কী করছো? ‘

তুলার কণ্ঠে রাগ। লেয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে তুলার দিকে তাকাল। হানি ভয়ে কাঁপছে। তুলার কণ্ঠ আরোও উঁচু হলো।

‘ কোন সাহসে এ ঘরে উঁকি দিচ্ছিলে? ‘

হানির কাঁপন বাড়ে। মুহুর্তেই ছুটে যায় লেয়নের কাছে। একদম লেয়নের পেছনে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। থরথর করে কাঁপছে ওর পুরো শরীর।
আকস্মিক হানির কাণ্ড দেখে তুলার চোখে বিস্ময় ফুটে৷ বিস্মিত হয়ে লেয়নও ঘুরে দাঁড়ায় হানির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে হানি মাথা তুলে। বিস্ময়কর উচ্চতার মানুষটার চোখে চোখ মেলায়। হানির সরল দৃষ্টিতে লেয়নের প্রতি তীব্র বিশ্বাস। এই বিশ্বাস কিসের ভিত্তিতে?
®জান্নাতুল নাঈমা

ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।