রিক্ত শহরে আমার তুমি পর্ব-০১

0
149

#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০১

এতো দেরিতে এসেছেন কেন ম্যাডাম? আপনারা কি কোনো খবর পাননি এখনো?
কলেজের গেইটে প্রবেশ করার সাথে সাথে কলেজের দারোয়ানের এমন প্রশ্নে থমকে দাঁড়ায় অরুনিমা।কি হয়েছে সেই প্রশ্ন করার সাহস হয়নি তার। দারোয়ানের ভয়ার্ত মুখ তাকে অনেক কিছুর জানান দিচ্ছে।যদিও সে চাই না তার ভাবনা সত্যি হোক তবু কেন যেন মনে হচ্ছে তার ভাবনা সত্যি হবে। কিঞ্চিত ভেবে দারোয়ানকে প্রশ্ন করতে যাবে এমন সময় তার বান্ধবী তরী ঝাঁঝালো কন্ঠে থামিয়ে দিয়ে বলে:চল তো এবার।এসব থার্ড ক্লাসের দারোয়ানের সাথে কথা বলে মূল্যবান সময় কেন নষ্ট করবি। ভেতরে গেলে সব তো জানতে পারবো।তাই না?

তরীর ঝাঁঝালো কন্ঠ আর অরুনিমাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিলো না। পাশাপাশি দারোয়ান সাহেব‌ও মাথা নিচু করে রইলেন। কোনো জবাব দিলেন না।না চাওয়া সত্ত্বে ও অরুনিমা তরীর সাথে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো।

অরুনিমা আর তরী এ‌ই কলেজের লেকচারার। অরুনিমা জয়েন করেছে মাস তিনেক হলো।তারা দুজন দুই ডিপার্টমেন্টে হলেও এক বাসায় থাকায় একসাথে কলেজে যাওয়া আসা করে।গত এক সপ্তাহের মধ্যে কলেজ হোস্টেলের দু’জন মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।এরপর থেকে কলেজটাকে অরুনিমার ভূতের বাড়ি মনে হয়। ভীষণ ভীতু হ‌ওয়ায় এই কদিনে সে অনেকটা ডিপ্রেস্ট।মন চায় এই ক্যাম্পাসে আর না আসুক। কিন্তু না আসার সেই সুযোগ এখন আর নেই। দুটি ঘটনার তদন্ত করছে একজন দক্ষ ও চৌকস পুলিশ অফিসার আরদিদ আয়ান।তার কড়া নজর আছে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে।পুরো ক্যাম্পাস এখন পুলিশ প্রশাসনের হাতে বললেই চলে।এতো কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আর এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি হবে না তা সবার বিশ্বাস আছে।অরুনিমার‌ও সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দারোয়ান তাকে কোন ঘটনার কথা বললো তা সে এখনো বুঝতে পারছে না। বারবার মাথায় আসছে আর কেউ আত্মহত্যা করলো না তো? কিন্তু কেন এমন মনে হচ্ছে তার জানা নেই।

বিশাল ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এসব ভাবছে অরুনিমা। কিন্তু তরীর কোনো চিন্তা ভাবনা নেই এসব বিষয়ে।সে কানে হেডফোন দিয়ে অবলীলায় হাঁটছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

রাস্তা পেরিয়ে বাম দিকে কলা ভবন।তার পাশে প্রশাসনিক ভবন। ভবনের পাশে প্রশস্ত রাস্তা পাড়ি দিলেই ছাত্রী হোস্টেল।প্রশাসনিক ভবন পেরিয়ে রাস্তার ধারে যেতেই হট্টগোল শুনে থেমে গেল অরুনিমা।তরী এখনো কানে হেডফোন লাগিয়ে দিব্বি হাঁটছে বলে কোনো আওয়াজ শুনতে পায়নি। অরুনিমা তরীর হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো।তরী ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালে সে হাতের ইশারায় দেখালো ছাত্রী হোস্টেলের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ আর মানুষের ভীড় দেখে বোঝা যাচ্ছে কোনো ঘটনা ঘটেছে। ভয়ে তার গাঁ কাঁপছে।মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তবু ধীর গতিতে এগিয়ে গেল প্রশস্ত ছাত্রী হোস্টেলের গেইটে।

গেইটে প্রবেশ করেই সে বুঝলো এতো সিকিউরিটির মাঝেও সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কলেজের আরো এক ছাত্রী আত্মহত্যা করলো।এই নিয়ে তিনজন আত্মহত্যা করেছে।এএসপি আরদিদ আয়ান সকল প্রচেষ্টা করেও আগের দুই মেয়ের আত্মহত্যার কারণ উন্মোচন করতে পারলেন না।তার মধ্যে আরো একজন আজ চলে গেল। অধ্যক্ষ সাহেব গেইটের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন।তার পাশেই কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে এএসপি আরদিদ আয়ান।তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি অনেক হতাশ। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে।এই রক্তিম চোখ দুটো দেখে অরুনিমা ঢোক গিললো। এএসপি আয়ানকে দেখলে নির্দোষ মানুষেরাও ভয় পায় তার মধ্যে দোষীরা কি করে বারবার মেয়েদের এভাবে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিচ্ছে বা হত্যা করছে তা অরুনিমার জানা নেই।

তরী খুব চঞ্চল মেয়ে।সে এতো ভীড় উপেক্ষা করে অরুনিমাকে রেখে সোজা অধ্যক্ষ সাহেব আর এএসপি আয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো: হাই স্যার।

এএসপি আয়ান আড়চোখে দেখলো কিন্তু কোনো জবাব দিলো না।তিনি জবাব না দেওয়ায় অধ্যক্ষ সাহেব‌ও কিছু বললেন না।তরী তবু দমে যাওয়ার মেয়ে নয়।একটু থেমে আবার এএসপি আরদিদ আয়ানকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো:কি হয়েছে স্যার?

এএসপি আয়ান শুনেও না শোনার মতো করে দাঁড়িয়ে আছে।তিনি খুব কঠোর আর চুপচাপ আর এক কথার মানুষ। কোনো কথা যদি বলতে হয় তা সারমর্ম আকারে বলেন।এই এক সপ্তাহে অরুনিমা তাকে অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। কিন্তু সে এএসপি আয়ানের ব্যাখ্যা সহযোগে কথা গুনতে ব্যর্থ। এএসপি আয়ান উত্তর না দেওয়ায় অধ্যক্ষ স্যার ছোট স্বরে বললেন: দ্বাদশ শ্রেণির ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের রিস্তা নামের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে।দ্বিতীয় তলার রুম নম্বর ২০৩ এ এই ঘটনা ঘটেছে।

তার কথা শুনে অরুনিমা একটু অবাক হয়।ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের রিস্তা নামের এক ছাত্রীকে সে চিনে। খুব প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল সে।সে আত্মহত্যা করতেই পারে না।অন্যরা বিশ্বাস করলেও সে বিশ্বাস করবে না।তার সাথে খুব সখ্যতা ছিল রিস্তার।কোনো পড়া না বুঝলে সে নির্দ্বিধায় অরুনিমার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতো। পড়াশোনার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল রিস্তার। কিন্তু এমন করলো কেন সে! গতকালও অরুনিমার সাথে দেখা হয়েছিল।তখনো মনে হয়নি এই মেয়ে রাতে আত্মহত্যা করতে পারে। অরুনিমা ভাবছে , এটা কি হত্যা নাকি আত্মহত্যা।

অরুনিমার ভাবনার মাঝেই তরী অনেকটা চিল্লিয়ে বলে বসলো:স্যার, গতকাল সন্ধ্যায় আমি অরুনিমা ম্যাডামকে রিস্তার সাথে কথা বলতে দেখেছিলাম।
এএসপি আয়ানের মস্তিষ্কে তরীর অন্য কথা প্রবেশ না করলেও এই কথাটা খুব দ্রুত প্রবেশ করেছে।তিনি ভ্রু কুঁচকে অরুনিমার দিকে তাকালেন আর হাঁক ছাড়লেন তার দিকে আসার জন্য।

অরুনিমা তরীর এমন আচরণে অবাক হলো।সে কেন আচমকা এএসপি আয়ানকে তার নাম বললো অরুনিমা জানে না। এমন খুনের মামলায় তাকে জড়ানো কি খুব বেশি দরকার ছিল তরীর সেই প্রশ্নের উত্তর অরুনিমার জানা নেই। খুব ধীর পায়ে সে এএসপি আয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। এএসপি আয়ানের সাথে চোখাচোখি হতেই তার চোখ দুটি নিচে নেমে গেল। তার একটা অভ্যাস খুব খারাপ আর সেটি হলো কারো সাথে কথা বলার সময় সে চোখ নিচু করে কথা বলে।ফলে সবাই তাকে সন্দেহ করে।কথায় আছে চোখ মানুষের হৃদয়ের আয়না।কিন্তু তার চোখ দুটি তাকে উল্টোভাবে উপস্থাপন করে সবার সামনে। মনে প্রাণে সে খুব সৎ হলেও মাথা নিচু থাকায় সবাই তাকে দোষী মনে করে।সে চোখ নামিয়ে নিলেও এএসপি আয়ান তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু ভেবে খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো: আপনার সাথে কি মেয়েটার কাল কথা হয়েছিল?
অরুনিমা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সত্যি বলবে নাকি মিথ্যা বলবে। সত্যি বললে যদি তাকে সন্দেহ করে সবাই। তাছাড়া আশেপাশের সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে।সবাই তার উত্তর শোনার জন্য আগ্রহী সেটা তাদের নিরবতা দেখে সে বুঝতে পারছে।যদি বলে সে কাল রিস্তার সাথে কথা বলেছে তাহলে সবাই তাকে সন্দেহ করবে। কিন্তু মিথ্যা মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়। তাছাড়া সে মিথ্যা কথা বলতে গেলে আটকে যায়।তাই মিথ্যা বলা যাবে না যে যায় ভাবুক। ছোট গলায় জবাব দিলো:জি স্যার।

তার জবাব এএসপি আয়ানের কান পর্যন্ত পৌঁছালেও অন্যরা তা শুনতে পায়নি। কারণ তার গলার স্বর খুব ছোট। খুব কাছ থেকে শুনলে তবে শোনা যায় তার আওয়াজ। এএসপি আয়ান আর কোনো প্রশ্ন করলেন না।এর মাঝেই রিস্তার লাশ নামিয়ে আনা হলো পোস্টমর্টেমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

অরুনিমা এএসপি আয়ানের পাশে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে।লাশ নিয়ে যাওয়ার পর এএসপি আয়ান থানায় যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসলেন। অরুনিমা যেন এই যাত্রায় বেঁচে গেল।আর কোনো ঝামেলায় তাকে পড়তে হয়নি এই ভেবে মনে মনে একটু সান্ত্বনা পেল। কিন্তু কিছু মানুষের কপালে শান্তি খুব কম আসে। অথবা শান্তি আসলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।তার ক্ষেত্রেও এমন।তরী অন্য টিচারদের সাথে অন্য পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অরুনিমা সেদিকে যাবে এমন সময় পেছন থেকে ডাক পড়লো। এএসপি আয়ানের সোর্স ডাক দিলো:ম্যাডাম আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।স্যার গাড়িতে উঠতে বললেন আপনাকে।

অরুনিমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল।সে কি কোনো এক অজানা শিকড়ে আটকে গেলো?

চলবে….