রিক্ত শহরে আমার তুমি পর্ব-১১

0
92

#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ১১

“আমি তোমাকে কখনো এই বিয়ে করতে দিবো না।”অরুনিমার এই কথায় তামিমা একটু অবাক হলো।সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ অরুনিমা এভাবে বলছে কেন? অরুনিমা বেশ শান্ত -শিষ্ট। সবসময় চুপচাপ থাকে।কোনো বিষয় সে খুব একটা মাথায় নেই না।আজ সকালেও সে তার আপুর বিয়ে নিয়ে অনেক উৎফুল্ল ছিল।এছাড়া আদনানকেও তার পছন্দ ছিল।এমনকি বিয়েটাতে বাবা-মাকে রাজি করিয়েছিল অরুনিমা নিজে। কিন্তু হঠাৎ তার মত ভিন্ন হয়ে গেল। তাই শান্ত গলায় অরুনিমাকে জিজ্ঞেস করলো:”কি হয়েছে? এমন বলছিস কেন?”
_দেখো আপু, আমার মনে হয় আদনান ভাইয়ের ফ্যামিলি খুব একটা পারফেক্ট নয়।সবাই কেমন জানি অহংকারী আর মানুষকে তুচ্ছ করে কথা বলে। আমি আদনান ভাইয়াকে খারাপ বলছি না। কিন্তু বিয়ে নামক বিষয়টা দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।দুটো পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। তাহলে আদনান ভাই ভালো হলেও তার পরিবারের সদস্যরা তোমার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তখন দেখবে আস্তে আস্তে তোমার ভালোবাসা উড়ে গেছে।”
অরুনিমার কথায় তামিমা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো:তোর কাকে খারাপ মনে হয়েছে তাদের পরিবারের?
_কেন? তোমার দেবর, মিষ্টি। কোনো কারণ ছাড়া মিষ্টি আমার সাথে মিসবিহেভ করলো।
_দেখ বিয়ের আগের দিন এসব বলে লাভ কি? তাছাড়া আয়ান কি করলো?
_আরে,ওই তো আমাকে এতো ঝামেলায় ফেলে এতো অপমানিত করলো ক্যাম্পাসে সবার সামনে।

তামিমা অরুনিমার কথায় বেশ অবাক হলো। এখন সে কারণটা বুঝতে পেরেছে।বিগত চারদিনে অরুনিমার মনে শুধু এএসপি আয়ানের উপর রাগ আর ক্ষোভ ছাড়া অন্য কিছু সে দেখতে পায়নি। কিন্তু সে তো জানতো না আয়ান আদনানের ভাই। এখানে আদনানের দোষটা কোথায়?তামিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে অরুনিমা বলা শুরু করলো: “এএসপি আয়ান মানুষের সাথে খুব মিসবিহেভ করে। প্রচণ্ড বদমেজাজি। জানো আপু, সেদিন হাসপাতালে তরীকে যা অবস্থা করলো। আবার তাকে ছেড়ে তার সোর্সদের সাথে শুরু করলো। মানে চিল্লাচিল্লি ছাড়া সে থাকতেই পারে না।”

তামিমা অরুনিমার কোনো কথার জবাব না দিয়ে রুমে চলে গেল।সে বুঝতে পারছে না কি করবে? অরুনিমার কথাগুলো শুনে তার ভয় কাজ করছে। এমনেও দুই ফ্যামিলি খুব একটা রাজি নেই তাদের বিয়েতে। তাদের অনুরোধে বাধ্য হয়ে বিয়েটা দিতে রাজি হয়েছে।পরে যদি কোনো গণ্ডগোল হয় তাহলে সবাই সব দোষ তার দিবে।তামিমার মা তো এক বাক্যে নারাজ এখনো।কি সিদ্ধান্ত নিবে তা সে বুঝতে পারছে না। বসে বসে এসব ভাবছে তখনি কেউ রুমে আসলো। তাদের ছোট বোন মহিমা এসেছে।”বড় আপু তোমাকে আব্বু ডাকছে।” এই বলেই সে চলে গেল।

তামিমা মহিমার কথায় তার বাবার রুমে গেল। সেখানে তার মা-বাবা, অরুনিমা আর মহিমা আছে। তাকে দেখে তার মা বললো: এদিকে আয়। তামিমা তার কথামতো সেদিকে গিয়ে এক পাশে বসলো।তার বাবা বলছে:দেখ মা, এখনো বিয়েটা হয়নি। আমাদের এখনো সময় আছে।বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নে।আমার কাছেও আদনানের ছোট ভাইটাকে ভালো মনে হয়নি। তাছাড়া আমি আগেও জেনেছিলাম ওদের ফ্যামিলির সবাই মাস্তান টাইপের। তাদের দাদা একজন এমপি।বিভিন্ন অসৎ, অসামাজিক কাজের সাথে জড়িত তিনি। বাবাকে দেখে ভালো মনে হয়েছে। কিন্তু ভাইটাও খারাপ মনে হলো।যদি আদনান‌ও তার মতো হয় তাহলে সুখ পাবি কিনা তুই ভেবে দেখ।
তামিমা চুপচাপ তার বাবার কথা শুনছে। কোন শব্দ করছে না সে।তার নিরবতা দেখে তার বাবা বললো:”আজ রাতটা ভেবে দেখ। সকালে আমাকে জানাস কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। এখন তাহলে রুমে যা।”
তামিমা চুপচাপ রুমে গেল।তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিভাবে সে আদনানকে ভুলবে? আদনান খুব ভদ্র-নম্র। তাদের ছয় বছরের রিলেশনে কখনো তার সাথে একটু রাগ দেখাইনি। সবসময় সাপোর্ট দিয়েছে।তার একটু অসুখ হলেই আদনান পাগল হয়ে যায়। সে কখনো ঝগড়া করে কথা না বললেও আদনান পাগল হয়ে যায়।এখন বিয়েটা ভাঙলে আদনান অনেকটা ভেঙে পড়বে।এসব ভেবে সে বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করছে। একটু পরে হঠাৎ ফোনের আওয়াজে সে উঠে বসলো। স্ক্রিনের উপর আদনান নামটা ভেসে উঠেছে। আদনান ফোন দিয়েছে কিন্তু তামিমা রিসিভ করলো না। আদনানের ফোন পেয়ে তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। ফোন রিং হতে হতে আবার কেটে গেল।একবার কেটে গেলে আদনান আবার ফোন দেয়। সে বাধ্য হয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। আদনান উচ্ছাসিত কন্ঠে বলছে:তামিমা ফোন রিসিভ করছো না কেন?কি হয়েছে?
তামিমা কোনো উত্তর দিলো না।তার উত্তর না পেয়ে আদনান কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।”কি হয়েছে তামিমা?কথা বলছো না কেন?কথা বলো।কোনো সমস্যা হয়েছে?কথা না বললে বুঝবো কি করে আমি।”একনাগাড়ে কথাগুলো বললো সে।
তামিমা এবার জবাব দিলো:”আদনান, আমার মনে হয় আমাদের আর না এগোনো ভালো।পরে আরো সমস্যা হবে।”
_মানে?
_মানে আমি চাই বিয়েটা না হোক।
কথাটা শুনে আদনান আকাশ থেকে পড়লো মনে হলো। একটু নিরব থেকে জিজ্ঞেস করলো:কি কারণে বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইছো? দুইদিন আগে বিয়ে ভেঙে গেলে কি হবে তুমি জানো?
_হ্যাঁ জানি।সবাই আমাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করবে। তবু কিছু করার নেই। বাসায় কেউ বিয়েটা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।আগে অরুনিমা আর আব্বু একটু সাপোর্ট করেছিল। এখন তারাও না বলছে।
_বিয়ের দুইদিন আগে তোমার বাবা না বলছে কেন?

তামিমার কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই।সে কী বলবে তোমার ভাই খারাপ তাই তুমিও খারাপ ভেবে বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছে।এটা বললে তার বাবা সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা আসবে আদনানের মনে।
_আদনান প্লিজ এসব বাদ দাও। আমার আর ভালো লাগছে না।
আদনান সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিলো। তামিমা ফোনটা সুইচ অফ করে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো।কারণ সে জানে আদনান এখন কেটে দিলেও একটু পর আবার ফোন দিবে। কান্না করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছে তার জানা নেই।

এদিকে আদনান বসে বসে কান্না করছে।কতো কষ্টে সে সম্পর্কটা এতটুকু এনেছে।আর বিয়ের দু’দিন আগে বলছে বিয়ে হবে না।সে তার পরিবারকে কি জবাব দিবে?তার জানা নেই। ইচ্ছে করছে সুইসাইড করতে কিন্তু সুইসাইড করা কি কোনো সমাধান? বিভিন্ন প্রশ্ন তার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে।সেও রুমে এসে লাইটটা অফ করে দিয়ে শুয়ে শুয়ে কান্না করছে। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। আঘাত পেলেও শক্ত থাকে। কিন্তু সহ্যের বাইরে চলে গেলে চোখের জল অনায়াসে চলে আসে। আদনানের ক্ষেত্রেও তাই। বেচারা আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। এদিকে নিচে সবাই আদনানকে খুঁজছে। আয়ানকে তার মা বললো একবার রুমে গিয়ে দেখে আসতে।সেও তার মায়ের কথামতো রুমে গেল। সেখানে আদনানের অবস্থা দেখে সে অবাক হয়ে গেল। তার চোখ-মুখ ফুলে আছে।চেঁচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলো: ভাইয়া কি হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেন?
আদনান ভাঙা গলায় বললো:তামিমাকে ফোন দিয়েছিলাম।সে বলেছে বিয়েটা ভেঙে দিতে।তার বাবা-মা বোন কেউ রাজি নেই এই বিয়েতে।
এদিকে আয়ানের পেছন পেছন তার মাও এসেছে আদনানের রুমে।তিনি একথা শুনে রাগারাগি শুরু করে দিলেন।”কি বলছিস এসব? বিয়েতে রাজি না থাকলে আয়োজন করলো কেন? সব আয়োজন শেষ।কাল গায়ে হলুদ আর এখন বলছে বিয়ে ভেঙে দিতে।তার বাবা-মা রাজি না থাকলে আগে বলতো আমাদের।আমরা কি তাদের মেয়েকে বরণ করে নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছি নাকি। ছেলের পাগলামিতে বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছি মেয়েটাকে আনার জন্য।”আয়ান তার মাকে থামিয়ে বললো:”এতো চিল্লাচিল্লি করিও না।আমি দেখছি বিষয়টা।”
_তুই আবার কি করবি? দাঁড়া তোর আব্বুকে কে গিয়ে বলে আসি।
_আরে আরে আব্বুকে এখন বলতে হবে না । আগে দেখি বিষয়টা। তুমি চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।_আমি ঘুমাবো?যদি বিয়েটা না হয় তাহলে মানুষকে মুখ দেখাবো কিভাবে? সবাইকে দাওয়াত দেওয়া শেষ।এমনকি আত্মীয়-স্বজনরা অনেকে চলে এসেছে।
_বিয়েটা হবে মানে হবে। দরকার হলে ব‌উকে তুলে নিয়ে আসবো।যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।টেনশন করতে হবে না।
আয়ান তার মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলো। আদনানকেও সান্ত্বনা দিয়ে বললো বিয়েটা হবেই হবে। আদনান তবু অসহায়ের মতো বসে আছে।

আয়ানের বারবার অরুনিমার উপর সন্দেহ হচ্ছে।সে নিশ্চয়ই আয়ানকে দেখে তার বোনকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে। তাই সে বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছে।এই অরুনিমাই সব সমস্যার মূল।সেই সব ঝামেলা পাকালো।একটু ভাবলো সে। তারপর দ্রুত ছুটে গেল শ্রেয়ার কাছে। তাকে গিয়ে অরুনিমার সাথে যা যা হয়েছে শুরু থেকে সব খুলে বললো।শ্রেয়া সব শুনে হাসছে।এই কারণেই অরুনিমা আয়ানকে দেখে তাকিয়ে ছিল আর মিষ্টি তাকে শাসিয়ে নিলো। দুজনেই ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো অরুনিমার সাথে কথা বললে সব সমস্যার সমাধান হবে। তারপর সে ছুটে গেল ইমনের কাছে। রুমে গিয়ে দেখলো ইমন ঘুমিয়ে গেছে। তাকে ডাকাডাকি শুরু করলে সে ঘুম ঘুম চোখে বলে,”কি হয়েছে স্যার?শান্তিমতো ঘুমাতে তো দিন।”
_আরে পরে ঘুমাতে পারবে ‌।এখন আমাকে অরুনিমার ফোন নম্বরটা দাও।
একথা শুনে ইমন লাফিয়ে উঠলো।”স্যার আপনি কি অরুনিমা ম্যামকে প্রপোজ করবেন এখন?”
ইমনের কথায় আয়ানের রাগ ওঠে গেল। চিল্লিয়ে বললো:তুমি কি পাগল? ফোন নম্বর চাইছি নম্বর দাও।এতো কথা বলার দরকার নেই।
ইমন আয়ানের চিল্লানিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। চুপচাপ অরুনিমার ফোন নম্বরটা দিলো আয়ানকে।

আয়ান নম্বরটা নিয়ে ফোন দিতে যাবে তখনি দেখলো রাত দুইটা বাজে।এতো রাতে ফোন দেওয়াটা কি যৌক্তিক হবে? কিন্তু কথা না বলে উপায় নেই।তার রাতের মধ্যে কিছু একটা করতে হবে। ফোন দিয়ে অরুনিমাকে কি বলবে সে? দুজনেই একটু ভাবলো। তারপর নম্বরটা ডায়াল করলো। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না তাই কেটে গেল। শ্রেয়া বলছে,”মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে।”
_কি করবো এখন?
তখনি অরুনিমা ব্যাক করলো। আয়ান সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করলো:হ্যালো।
_আস্সালামু আলাইকুম।কে বলছেন?

চলবে….