রিক্ত শহরে আমার তুমি পর্ব-০২

0
98

#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০২

অরুনিমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল।সে কি কোনো এক অজানা শিকড়ে আটকে গেলো? অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাড়িতে গিয়ে বসলো।

গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে থানার দিকে। অরুনিমা বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হতে যাচ্ছে?তরীর সামান্য একটা কথা এএসপি আয়ান বিশ্বাস করে ফেললো খুব সহজে।এভাবে কারো কথায় কি একজন শিক্ষককে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যৌক্তিক? এএসপি আরদিদ আয়ান তো এতোটা বুদ্ধিহীন মানুষ নয়। খুব সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি কাজ সমাধান করেন তিনি। এই বিষয়ে অরুনিমা আরো আগে থেকেই জানে।এসব ভেবে মনকে সান্তনা দিচ্ছে সে। তবু হিসাব মিলাতে পারছে না।

থানায় পৌঁছার পর দুজন মহিলা পুলিশ এএসপি আয়ানের কক্ষে নিয়ে গেল অরুনিমাকে। এএসপি আয়ান তার আসনে বসে আছেন। সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলো অরুনিমা। দূরত্ব প্রায় কয়েক হাত।মাথা নিচু করে বসে আছে সে।শুনশান নীরবতা পুরো রুম জুড়ে।নিরবতা ভেঙ্গে এএসপি আয়ান প্রশ্ন করলেন
_আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?
অরুনিমা ছোট গলায় জবাব দিলো: ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে আছি।
তার ছোট গলার স্বর এএসপি আয়ানের কান পর্যন্ত অন্য সময় পৌঁছালেও এখন পৌঁছায়নি। তিনি খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন: আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?
_ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট।
_শিক্ষক এতো ছোট গলা নিয়ে ক্লাস করালে তো স্টুডেন্ট ক্লাসরুম থেকে মাঠে গিয়ে ঘাস কাটবে।ক্লাস কি করে করান এতো ছোট ভয়েস দিয়ে?নাকি আমার সামনে ছোট স্বরে কথা বলছেন নিজেকে শালীন প্রমাণ করতে?
অরুনিমার ছোট জবাব: ক্লাসে স্পিকার থাকে।
_তাহলে একটা স্পিকার নিয়ে আসি?

এএসপি আরদিদ আয়ান অনেকটা ঠাট্টার ছলে কথাটা বললো। অরুনিমার অপমান বোধ হলো কিন্তু কিছুই করার নেই।সে এখন এএসপি আয়ানের কব্জায়।তার জীবন মরণ এখন এই মাথামোটার হাতে সেটা অরুনিমা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। এছাড়াও অরুনিমা খুব একটা প্রতিবাদী মেয়ে নয়।এই প্রশ্নের জবাব কি দিবে বুঝতে পারছে না সে।তাই নিরব থাকলো।তার নিরবতা দেখে এএসপি আয়ান বললেন:যাই হোক।বড় করে কথা বলার চেষ্টা করুন।আর হ্যাঁ এএসপি আরদিদ আয়ানের সামনে মিথ্যা কথা বললে এমনভাবে ফেঁসে যাবেন সেটা নিজেও অনুমান করতে পারবেন না। বুঝলেন?
অরুনিমা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
_আপনি এই কলেজে জয়েন করেছেন কতো বছর হলো?
_তিন মাস হয়েছে স্যার।
_কোথায় থাকেন?ফ্যামিলি সহ নাকি একা থাকেন?
_রুপলালে ম্যাচে থাকি।
_বাড়ি কোথায়? বাসায় কে কে আছে আপনার?
_বাড়ি করিমনগর।বাবা,মা আর আমরা তিন বোন।আমি মেঝো।
_রিস্তার সাথে পরিচয় কতো দিনের?
_মাস দুয়েক হলো।
_কাল কি কথা হয়েছে ওর সাথে আপনার?
_একটা পড়ার টপিক নিয়ে কথা বলেছিলাম কলেজ থেকে ফেরার পথে।
_আপনার কাছে কি প্রাইভেট পড়তো?
_না স্যার।আমি প্রাইভেট পড়ায় না। তাছাড়া ওর পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়।তাই সে কোনো পড়া না বুঝলে আমার কাছে আসতো।আমি বুঝিয়ে দিতাম।
_আপনার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ তা দিয়ে তো এতো মহৎ মহিলা মনে হয় না।ফ্রিতে পড়িয়ে লাভ কি?_স্যার সবকিছুর জন্য তো টাকা নিতে হয় না। ভালো স্টুডেন্ট বলে একটু এক্সট্রা কেয়ার করেছি।তাতে এভাবে ফেঁসে যাবো বুঝতে পারিনি।
_আপনাকে কি তার এমন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কিছু বলেছে বা ইঙ্গিত দিয়েছে কখনো?
_না স্যার। আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না। তবে কাল তাকে দেখে মনে হয়নি সে আত্মহত্যা করতে পারে।
_কেন এমন মনে হলো?
_ আত্মহত্যা করার আগে একজন মানুষ অনেকটা নার্ভাস থাকে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা থাকে।এসব ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা যখন শেষ হয় তখন এমন পথ বেছে নেয়। কিন্তু রিস্তা তো এখনো সবে জীবনের গল্পটা সাজানো শুরু করেছে। তাহলে এতো তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়ার ভাবনা মাথায় আসতেই পারে না।
_আপনার এসব কথা তো আদালতে উপস্থাপন করার মতো প্রমাণ স্বরূপ নয়।
_স্যার যদি অনুমতি দেন একটা কথা বলতে চাই।
_এতো ফর্মালিটির দরকার নেই।বলে ফেলুন।
_আমার এগেইনস্টে আপনার হাতে কোনো প্রমাণ নেই। তরী ম্যাডামের সামান্য কথায় আপনি আমাকে থানায় নিয়ে এলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করলেন আর আমিও সব সত্যি কথা বললাম আপনাকে। আমার যদি সম্পৃক্ততা থাকে আমি আপনাকে সত্যিই সব বলে দিতাম। আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন স্যার। আমার মনে হয় আমাকে সন্দেহ না করে বিষয়টি আবার শুরু থেকে ভেবে দেখুন। তাহলে আপনি কেসটা দ্রুত সমাধান করতে পারবেন আর আমাদের ক্যাম্পাসটা অপরাধীমুক্ত ক্যাম্পাস হবে।

অরুনিমার কথাগুলো খুব স্বচ্ছ আর স্বাভাবিক।যেন সব কথা সে মন থেকে দৃঢ়তার সাথে বলছে। যেখানে কোনো মিথ্যা বা ভেজাল নেই। এএসপি আরদিদ আয়ান মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো শুধু।কোনো প্রশ্ন করলো না।তার কোনো প্রশ্ন না পেয়ে অরুনিমাও নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে এএসপি আয়ান বললেন: আপনার আর আপনার বাবা-মায়ের সকল ডকুমেন্ট জমা দিবেন আমার সোর্স ইমনকে। সাথে সবার ফোন নম্বর দিবেন।যতোদিন কেস সলভ হচ্ছে না ততোদিন এই শহরে থাকবেন। বুঝলেন?
_জী স্যার।
_আপনি এখন আসতে পারেন।

অরুনিমা দ্রুত বসা থেকে উঠে সালাম দিয়ে হাঁটা দিলো। এএসপি আয়ান সালামের জবাব দিলো কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও মুখের স্পষ্ট চাপা হাসিটা অরুনিমা আবিষ্কার করতে পেরেছিল। হয়তো তার দ্রুত রুম থেকে বের হ‌ওয়ার চেষ্টাটা এএসপি আরদিদ আয়ানের মুখে হাসির ছাপ ফেলতে পেরেছে।

অরুনিমা থানা থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতে গেইটে দাঁড়ালো। রিকশা না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে হাঁটা শুরু করতে যেতে হঠাৎ পেছন থেকে কারো ডাক পড়লো। অরুনিমা নাকি?
কারো ডাকার শব্দ শুনে সে পেছন তাকালো। মুচকি হাসি দিয়ে বললো: আরে ভাইয়া, আপনি?
_হ্যাঁ আমি। কেমন আছো?
_ভালো আছি ভাইয়া। আপনি এই থানায় কখন এলেন?
_মাস ছয়েক হলো। তুমি থানায় এলে কেন?

অরুনিমা তার প্রশ্নে থেমে গেল।ইনি হলেন অরুনিমার বাবার ছাত্র রাফিদ সালমান। পুলিশের ইন্সপেক্টর। এই থানায় আছে সে।বাসা তাদের কাছাকাছি। অরুনিমা ভাবলো: উনাকে যদি একবার বলে সে একটা খুনের মামলার সাথে সম্পৃক্ত আর তাকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে তাহলে তার বাবার মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। এলাকার বাবার অনেক সম্মান। এভাবে সম্মান ক্ষুন্ন হবে সেটা সে কিভাবে মেনে নিবে।হুট করেই মিথ্যা বলে বসলো: আসলে ভাইয়া একটু এইদিকে ঘুরতে আসছিলাম।একা একা বোর হচ্ছিলাম তাই।
_তাহলে আমাকে বললেই পারতে। তোমাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতাম। তাছাড়া এদিকের পরিবেশটা অনেক সুন্দর। তুমি চাইলে আমরা ওদিকটায় যেতে পারি এখন। আমিও ডিউটি শেষ করে বাসায় যাচ্ছি।সো সমস্যা হবে না।
_না ভাইয়া। ধন্যবাদ আপনাকে।আমি এখন বাসায় যাবো।
কথাটা বলে অরুনিমা ফিরতে যাবে তখনি দেখতে পেলো এএসপি আয়ান দাঁড়িয়ে আছে তাদের পাশে।তার দৃষ্টি তাদের দুজনের দিকে। হয়তো কিছু আমল করতে চাইছে সে। এমনভাবে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তাতে অরুনিমার মিথ্যা কথা বলাটা খুব সহজে তার কাছে ধরা পড়েছে। অরুনিমা তাকে দেখেই বোকার মতো তাকিয়ে আছে।কি ঝামেলায় সে পড়েছে তা বুঝতে পারছে না।তার বোকা বনে যাওয়া দেখে ইন্সপেক্টর রাফিদ পেছনে ফিরে। হঠাৎ চমকে উঠে স্যালুট জানাই। এএসপি আরদিদ আয়ান এখনো অরুনিমাকে পর্যবেক্ষণ করছে।রাফিদের দিকে না তাকিয়ে বললো: আপনার ডিউটি কি শেষ নাকি সবে শুরু? ঘুরতে যাচ্ছেন ভালো কথা কাজ সেরে যাবেন। এভাবে অফিসের গেইটে এসে ডিউটি শেষ বলে চলে যাবেন তা কি করে হয়।

ইন্সপেক্টর রাফিদ লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। অরুনিমাকে সে মিথ্যা বলে একটু ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু উল্টো মিথ্যা কথাটা প্রমাণ হয়ে গেল। এএসপি আয়ান রাফিদের শোচনীয় অবস্থা বুঝতে পেরে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। তবু না হেঁসে গম্ভীর কণ্ঠে হাঁক ছাড়লো:মিস অরুনিমা আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দুই ঘণ্টার মধ্যে আপনার সকল ডকুমেন্ট জমা দিবেন। অন্যথায় আপনাকে এরেস্ট করতে বাধ্য হবো।

একথা শুনে রাফিদ জিজ্ঞেস করলো:স্যার কি বলছেন এসব?ও কি করেছে?
_সকাল সাতটার ডিউটি যদি অপরাহ্নে করতে আসেন তাহলে খবর পাবেন কি করে? কলেজের একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমরা অনুমান করছি এতে উনার সম্পৃক্ততা আছে।দ্যাটস ইট।
_স্যার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।এটা হতেই পারে না।ও খুব ভালো একটা মেয়ে। আমার স্যারের মেয়ে।
_আমার কাছে যথেষ্ট এভিডেন্স আছে উনার বিরুদ্ধে। আমি এসব দেখেই খোঁজ নিবো উনি ভালো নাকি খারাপ।

চলবে….