রিক্ত শহরে আমার তুমি পর্ব-০৬

0
111

#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৬

আয়ান লোকটাকে দেখে একটু অবাক হলো।কোথায় যেন তাকে দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারছে না সে।
_আসুন
ইশারা করে বসতে বললো তাদের।
রাফিদ বলা শুরু করলো:স্যার, উনি সাঈদ আহমেদ। করিমগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।আমি উনার ছাত্র।রুপলাল কলেজের প্রভাষক অরুনিমা আহমেদের বাবা।
এএসপি আয়ান কি মনে করে হেঁসে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং উনাকে সালাম দিয়ে আবার বসে পড়লো।তিনিও সুন্দর করে সালামের জবাব দিলেন। ইন্সপেক্টর রাফিদ কিছুটা অবাক হলো এএসপি আয়ানের কর্মকান্ডে।যেই মানুষকে সে কখনো হাসতে দেখেনি, সবসময় বড় হোক বা ছোট হোক মানুষের সাথে ভাব দেখাতে দেখেছে সে কি না অরুনিমার বাবাকে এতো সাদরে গ্রহন করলো! অরুনিমার বাবা তখনি বলে বসলো:বাবা আমার মেয়েটা কোথায়? গতকাল থেকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। অধ্যক্ষ সাহেবকে ফোন দিলাম।উনি প্রথমে বললেন থানায় আছে।পরে আবার ফোন দিলাম।হয়তো ব্যস্ত ছিলেন তাই রিসিভ করেনি।আমি আর টেনশনে থাকতে পারিনি।তাই রাতেই চলে এসেছি।
_আংকেল আপনাকে টেনশন করতে হবে না। অরুনিমা সুস্থ আছে এখন।
_কি হয়েছে যদি বলতে আমাকে? আমাকে অধ্যক্ষ সাহেব এবং অরুনিমা কেউ কিছুই বলেনি।
_আসলে অরুনিমার কলেজের তিনজন মেয়ে পরপর আত্মহত্যা করেছে আর একজন খুন হয়েছে।আমরা সেই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আমরা অরুনিমার সম্পৃক্ততা পেয়েছি।তাই তাকে থানায় এনেছিলাম। কিন্তু সে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে আছে এখন।

কথাটা শুনে অরুনিমার বাবার মন খারাপ হলো সেই সাথে এএসপি আয়ানের উপর এক প্রকার ঘৃণা আর সন্দেহ কাজ করছে। সেটা তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে।তার ভাবনা তার মেয়েটাকে মেরে নিশ্চয়ই অসুস্থ করে ফেলেছে। তবু নিজেকে সংযত করে বললেন:দেখো বাবা, আমি আমার মেয়েটাকে ছোট থেকেই চিনি।সে এমন কাজ কখনো করতে পারে না। আমি জানি তোমার মনে হবে বাবা বলে এমন কথা বলছি কিন্তু না। তবু তোমার যেহেতু সন্দেহ হয়েছে নিশ্চয় সন্দেহভাজন কিছু পেয়েছো।আর যদি তোমার সন্দেহ সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমি নিজেই আমার মেয়ের বিচার চাইবো।
তিনি খুব শান্ত গলায় বললেন কথাগুলো কিন্তু কথার মাঝে একটা জোর আছে।একজন উচ্চ শিক্ষিত এবং সৎ মানুষ তা তার কথায় প্রকাশ পাচ্ছে। এএসপি আয়ান আর কিছু বললো না।তিনি একটু পর আবার বললেন:আমি কি একবার ওর সাথে দেখা করতে পারি?
_জি অবশ্যই। রাফিদ, তুমি আংকেলকে নিয়ে হাসপাতালে যেও।
_ধন্যবাদ বাবা। এবার তাহলে আমি আসি।
_ওকে আংকেল।

রাফিদ আর অরুনিমার বাবা উঠে দাঁড়ালেন রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। এমন সময় আয়ানের মনে পড়ে অরুনিমার ব্যাগ আর ফোন তার কাছে।
_একটু দাঁড়ান। রাফিদ, ওখান থেকে মিস অরুনিমার ব্যাগ আর ফোন নিয়ে যাও।

রাফিদ এসে এসব নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাফিদ বেরিয়ে যাওয়ার পর এএসপি আয়ান ভাবছে অরুনিমার বাবাকে সে আগে কোথাও দেখেছে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না সে। একটু ভাবলো কিন্তু পরে মাথায় আসলো হয়তো ফেসবুকে দেখেছে কখনো।এই ভেবে বিষয়টা সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো।

ইমন হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ পাঠিয়েছিল তাকে কিন্তু অরুনিমার বাবার সাথে কথা বলতে বলতে আর চেক করা হয়নি। তার ডেক্স থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে সে ভিডিওটি অন করলো। খুব সুক্ষ্মভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে।পুরো ভিডিও ভালোভাবে দেখা শেষ। কিন্তু ইমনের কথামতো ডাক্তার আর নার্স ছাড়া কেউ রুমে প্রবেশ করেনি। তাহলে কি হাসপাতালের রুমে আরেকটা দরজা আছে?তা তো কখনো হতে পারে না। এএসপি আয়ান আবার রি-ওপেন করলো ভিডিওটা। এইবারও সেইম আছে। এখন তার মাথায় কাজ করছে না। অরুনিমার অক্সিজেন মাস্ক খুললো কে?যদি কেউ রুমে প্রবেশ না করে তাহলে এমন হবে কি করে?সে তো আর নিজে নিজে খুলতে পারবে না। হঠাৎ মাথায় আসলো ডাক্তার বা নার্সদের মধ্যে কেউ সম্পৃক্ত নয় তো? কিন্তু কলেজের শিক্ষকদের সাথে হাসপাতালের লোকদের সম্পর্ক হয় কি করে একটা মামলা নিয়ে?নাকি কেউ টাকা দিয়ে ডাক্তার বা নার্সদের কিনে নিয়েছে। আপাতত তিনটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আয়ানের মাথায়।সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে এই ডাক্তার এবং নার্সেরা।তাই সে আবার ভিডিওটা দেখে নিলো।মোট একজন ডাক্তার আর দুজন নার্স অরুনিমার কেবিনে গিয়েছিল।সে ল্যাপটপটা রেখে দ্রুত রুম থেকে বের হলো। একজন কর্মীকে দিয়ে তরীর ফোন রেকর্ডটা আনলো। ফোন লিস্টটা একবার চেক করলো কিন্তু সন্দেহ হয় এমন কিছু পায়নি সে। শুধু তিনজনকে ফোন করেছে তরী। ইমন, তরীর মা আর একজন কলেজের প্রভাষকের সাথে কথা বলেছে তরী।লিস্টটা পকেটে নিয়ে সে বেরিয়ে গেল।

গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে হুকুম দিলো সে হাসপাতালে চলুন। সকাল থেকে তার কিছুই খাওয়া হয়নি। অনেকটা ক্ষিধাও পেয়েছে।তাই হাসপাতাল যাওয়ার পথে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাতে বললো। ড্রাইভার আর সে দুজনে নেমে সেখানে গেল।হালকা নাশতা করে আবার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গেলো।

এএসপি আয়ান হাসপাতালে পৌঁছে রিসিপশনে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজটা দেখিয়ে বললেন: উনাদের দ্রুত ডাকুন। কিছু কথা আছে উনাদের সাথে।
_স্যার নার্সদের এখন ডিউটি শেষ। তাই এখন হাসপাতালে নেই।
_নেই তো কি হয়েছে? আসতে বলুন। তবে আমি ডেকেছি সেটা বলবেন না। বলবেন একটা ইমারজেন্সি কাজ আছে।তাই দ্রুত আসতে হবে।আর ডাক্তারকে ডাকুন।
_স্যার ডক্টর অপারেশন রুমে আছেন।
_এতো অজুহাত কেন আপনাদের? বেশি কথা বলবেন আপনাকে নিয়েই জেলে ভরে দিবো।
তার গমগমে গলায় কথাটা শুনে রিসিপশনের লোকটা চুপসে গেল।শান্ত গলায় বললো: ওকে স্যার ডাকছি সবাইকে।
_আমি এখানে অপেক্ষা করছি। দ্রুত আসতে বলুন।
_ওকে স্যার।

এএসপি আয়ান ভাবছে বসে বসে অপেক্ষা না করে এই সুযোগে সে একবার অরুনিমাকে দেখে আসুক। তাহলে আর অপেক্ষাও করতে হবে। একসাথে দুটো কাজ হয়ে যাবে।যেই ভাবনা সেই কাজ।তার সাথে থাকা কর্মীদের বললো: চলুন অরুনিমার কেবিনে।দেখে আসি উনাকে।
একজন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো:স্যার দেখতে যাবেন নাকি জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাবেন?
তার কথা শুনে এএসপি আয়ান একটু ইতস্তত করে বললো: দেখতে যাবো। উনার কাজ থেকে সব জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে গেছে।
_ওকে স্যার চলুন।

অরুনিমার কেবিনের সামনে ইন্সপেক্টর রাফিদ দাঁড়িয়ে আছে।সে অরুনিমার বাবাকে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন ভেতরে না গিয়ে? এএসপি আয়ান সেই প্রশ্নের উত্তর পেলো না। পেছন থেকে এসে রাফিদের কাঁধে হাত রাখলো সে। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে রাফিদ চমকে উঠলো।
তার চমকে যাওয়া দেখে আয়ান বললো:আরে আমি। এতো চমকাতে হবে না।
রাফিদ আয়ানের কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে হাসলো তারপর স্যালুট করে বললো:স্যার হুট করে আসায় অবাক হয়েছি। কেন এসেছেন স্যার?কোনো কাজ থাকলে আমাকে বলতেন।
_তোমার উপর বিশ্বাস নেই। তাছাড়া আমার নিজের কাজ তুমি কি করবে বলো?
_মানে স্যার?
_মানে হলো আমি অরুনিমাকে দেখতে এসেছি। আমার পরিবর্তে তুমি দেখলে তো হয় না। সেটা বলছি।
_স্যার হবে না কেন? আমাদের কাজ ভিকটিমকে খেয়াল রাখা। সেটা আপনি রাখুন আর আমি রাখি সেইম কথা যেহেতু আমরা দুজনে পুলিশের লোক।
_আরে বোঝো না কেন? আমার ক্ষিধা লাগলে তুমি খাবার খেলে কি হবে? আমার খাবার আমাকেই তো খেতে হবে তাই না।

রাফিদ এবার বোকা বনে গেল। সে কিছুতেই এই মানুষটার ভাষা বোঝে না। কেমন জানি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে সে। কখনো সোজা কথা তার কাছ থেকে আশা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।তাই সে হাল ছেড়ে দিয়ে বললো: স্যার তাহলে দেখে আসুন।
এএসপি আয়ান রাফিদের চেহারা দেখে বুঝলো সে তার কথার মানে বুঝতে পারেনি। বাঁকা হেসে বললো: কথার মানে কিছু বুঝলে?
_না স্যার বুঝতে পারিনি।
_বুঝতে পারবেও না। আমি নিজেই তো সিউর হয়ে বুঝতে পারছি না আমার মনের অবস্থা। তুমি আর কি বুঝবে আমার কথার মানে।

এই কথাটাও রাফিদের মাথার উপর দিয়ে গেলো। এখানে মনের অবস্থা আসলো কোথা থেকে? কথা হচ্ছে অরুনিমাকে দেখতে আসা নিয়ে। তবে এএসপি আয়ানের ভাবসাব রাফিদের চোখে ভালো লাগছে না। কেমন জানি হিংসা হচ্ছে?অরুনিমার প্রতি এএসপি আয়ান একটু সিরিয়াস যা অন্য আসামি বা সন্দেহভাজন কারো উপর কখনো দেখায়নি সে। সবসময় আসামীদের কটু কথা বলে এমনকি অফিসের সবার সাথে কটু কথা বলে সে। অনেকটা ভাব নিয়ে থাকে। কিন্তু অরুনিমার সাথে এতো দিন কটু কথা বললেও এখন কেমন অন্যরকম ভাব নিয়ে কথা বলে।যেটা রাফিদের একদম পছন্দ নয় ।সে চায় অরুনিমা শুধু তার থাকুক। এএসপি আয়ানকে তাই সহ্য করতে পারছে না সে।তার ভাবনা শুধু এখন একটাই এএসপি আয়ান কি অরুনিমার প্রতি দূর্বল?সে কি অরুনিমাকে পছন্দ করে? আবার ভাবে এই এএসপির মনে প্রেম-ভালোবাসা কিছুই নেই।যা আছে সব তেজ আর রাগ। হয়তো শিক্ষিত মেয়ে ভেবে একটু সেক্রিফাইস করছে।সে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে এএসপি আয়ান অরুনিমার কেবিনে ঢুকে গেছে তা রাফিদের জানাই নেই।

এএসপি আয়ান কেবিনে ঢুকতেই অরুনিমার সাথে চোখাচোখি হলো। তাকে দেখে অরুনিমা অনেকটা অগোছালো হয়ে গেল।এমনেও সে বেশ গুছিয়ে কথা বলতে বা কাজ করতে পারে না।তার মধ্যে এই এএসপিকে দেখলে তার ভীষণ ভয় লাগে।কখন কি প্রশ্ন করে, কখন কোথায় ফাঁসিয়ে দেয় আবার কখন একটা চড় বসিয়ে দেয় তা নিয়ে সে আশংকায় থাকে। অরুনিমার এমন ভীতু চেহারা তার বাবা চোখে পড়ে।তিনি মেয়ের একহাত নিজের হাতে নিয়ে মেয়েকে সান্ত্বনা আর সাহস দেওয়ার চেষ্টা করছেন।যা এএসপি আয়ানের চোখ এড়ায়নি।সে কিছুটা অবাক হলো অরুনিমার এমন আচরণে।এতো ভীতু মেয়েও হয়?বয়স তো কম হয়নি কিন্তু সাহসের কাছে ছোট বাচ্চাও তাকে হারিয়ে দিবে।এই ভেবে সে মনে মনে হাসলো।
_মিস অরুনিমা আপনার এখন কি অবস্থা?
_ভালো আছি স্যার।
_হাঁটতে পারছেন?
_জি পারছি।
_আপনার অফিস রুমের ডেস্কের চাবিটা আমাদের দিবেন।
_স্যার সেটা ব্যাগে আছে।
_ওকে রেস্ট নিন।

এএসপি আয়ান অরুনিমাকে দেখতে আসলেও সে তা বুঝতে দেয়নি। এমন ভাব করে আসলো যেন সে চাবির খোঁজে এসেছে। চাবির খবর নিয়েই সে বেরিয়ে গেল।রিসিপশনে আবার গেলো সে।নার্স দুজন ততোক্ষণে এসে অপেক্ষা করছিল তার জন্য।
তাকে দেখেই দুজনেই উঠে দাঁড়ালো।
_আপনারাই কি গতকাল রাতে অরুনিমার রুমে গিয়েছিলেন?
দুজনেই একসাথে বললো:জি স্যার।
_কি করতে গিয়েছিলেন?
_স্যার ঔষুধ দিতে গিয়েছিলাম।
_তাহলে অক্সিজেন মাস্ক খুললেন কে?
তার প্রশ্নে দুজনেই অবাক হয়ে গেল।

চলবে….