রিক্ত শহরে আমার তুমি পর্ব-০৭

0
91

#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ৭[কেস সলভ পর্ব]

_তাহলে অক্সিজেন মাস্ক খুললেন কে?
তার প্রশ্নে দুজনেই অবাক হয়ে গেল। একজন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো:স্যার কার অক্সিজেন মাস্ক খুলেছি আমরা?
_মিস অরুনিমার।
তখনি অন্যজন বলে উঠলো:স্যার আমরা কেন উনার অক্সিজেন মাস্ক খুলবো?এতে আমাদের লাভ কি?
_সেটাই তো আমিও জানতে চাচ্ছি। এতে আপনাদের লাভ কি এবং কেন মাস্কটা খুলেছেন?
_স্যার বিশ্বাস করুন আমরা এমন কাজ করিনি। সত্যি বলছি।
_তাহলে কে করলো?
_স্যার আমরা জানি না এসব।
_সত্যি করে বলুন।তা না হলে সোজা জেলে দিবো।
_না স্যার। আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস করুন।আমরা তো সামান্য নার্স।এতে আমাদের লাভ কি?
_দেখুন সত্যি করে বলবেন তো ফাঁসবেন না। মিথ্যা বললে রেহাই পাবেন না।
_স্যার সত্যি বলছি এসবে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই।

এএসপি আয়ান নার্সদের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে তাদের নিয়ে অরুনিমার কেবিনে গেল। যাতে অরুনিমার কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে তাদের সম্পর্কে।আর রিসিপশনিস্টকে বললো ডাক্তার অপারেশন রুম থেকে বের হলে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেয়।সে অরুনিমার কেবিনে আছে।

অরুনিমার কেবিনে এসে দেখলো সে শুয়ে আছে আর তার পাশে তার বাবা বসে আছেন। এএসপি আয়ানকে দেখে তিনি অরুনিমার পাশ থেকে উঠে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এএসপি আয়ান অরুনিমাকে প্রশ্ন করলো: গতকাল এরাই কি আপনার ট্রিটমেন্ট করেছিল?
সে ভাঙা গলায় জবাব দিলো:জি স্যার।
_আপনার অক্সিজেন মাস্ক কে খুলেছিল এদের মধ্যে?
_স্যার তখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আমার খারাপ লাগলে ঘুম ভাঙে। তখন লাইট অফ ছিল।তাই আমি দেখতে পায়নি কাউকে।
_আচ্ছা সমস্যা নাই।
তখনি ডাক্তার অরুনিমার কেবিনে আসলেন।
_স্যার আমাকে ডেকেছিলেন ?
_হ্যাঁ আপনাকে ডেকেছিলাম। গতকাল রাতে আপনার ডিউটি ছিল।তাই না?
_জি স্যার।
_অরুনিমার অক্সিজেন মাস্ক খুলেছিলেন কার আদেশে?
_না মানে স্যার আমি এসব করিনি।
ডাক্তার অনেকটা কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বললো।তখনি এএসপি আয়ান বুঝতে পারলো সে মিথ্যা কথা বলছে। সাথে সাথে একটা ঘুষি লাগিয়ে দিলো ডাক্তারের মুখে।সবাই চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুনিমা ভয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে ফেললো। ডাক্তারের মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। ডাক্তারের কলার ধরে আরেকটা দিতে যাবে তখনি সে বলে বসলো:স্যার আর মারবেন না।আমি বলছি সব।
_বল তাড়াতাড়ি।
_স্যার আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল অরুনিমার কেবিনে গিয়ে ওর অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিতে। যাতে সে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা যায়।
_তোর স্ত্রী কেন অরুনিমাকে মারতে যাবে? মিথ্যা বলে স্ত্রীকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিস?
_স্যার আমার স্ত্রী অরুনিমার কলিগ।রুপলাল কলেজের প্রভাষক মিনা রহমান।

এএসপি আয়ান অরুনিমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন: আপনি মিসেস মিনা রহমানকে চিনেন?
অরুনিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। এএসপি আয়ান আবার জিজ্ঞেস করে:উনার হাসব্যান্ডকে চিনতেন না?
অরুনিমা এবার না সূচক মাথা নাড়লো।
এএসপি আয়ান ইমনকে উদ্দেশ্য করে বললো:এই ইমন। ওকে এক্ষুনি থানায় নিয়ে যাও।আর দ্রুত রুপলাল কলেজে গিয়ে মিনা রহমানকে গ্রেফতার করো।
ইমন সাথে সাথে ওকে স্যার বলে ডাক্তারকে নিয়ে প্রস্থান করলো।

অরুনিমা এখনো ঘাবড়ে আছে। অনেকটা ঘেমে গেছে সে।তার বাবার হাত চেপে ধরে আছে এখনো। একেবারে ছোট মেয়ের মতো করে বাবাকে ধরে বসে আছে সে। ডাক্তার সাহেব নিজেও মাইর খেয়ে এতোটা ভয় পায়নি যতোটা অরুনিমা পেয়েছে মাইর দেওয়া দেখে। এএসপি আয়ান একবার অরুনিমার দিকে আড়চোখে তাকালো। অরুনিমার অবস্থা দেখে খুব হাঁসি আসছিল তার তবু নিজেকে কন্ট্রোল করে সে অরুনিমার বাবার উদ্দেশ্যে বললো: আংকেল আমি এবার আসি। আশা করছি দ্রুত কেসটা সলভ হবে। আপনারা ঘাবড়াবেন না। এখানে আমার ফোর্স আছে।তাই অরুনিমার সিকিউরিটি এবং ট্রিটমেন্ট নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।

কথাগুলো বলে সে বের হয়ে গেল। থানায় যেতে হবে তাকে।এই মামলার শেষ দেখে ছাড়বে আজকে সে। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে হুকুম দিলো: থানায় চলুন। ড্রাইভার সাহেব তার কথামতো গাড়ি স্টার্ট দিলো।গাড়ি চলছে আপন গতিতে। এএসপি আয়ান খুব শান্ত দৃষ্টিতে বাইরের ভিউটা দেখছে। মৃদু বাতাসে তার চুলগুলো একটু উড়ছে।বেশ ভালোই লাগছে তার।আজ মনটা অনেক খুশি। কেন এতো খুশি তা সে নিজেও জানে না। জানলেও নিজেকে বুঝতে দিতে চাইছে না।

গাড়ি থানায় এসে পৌঁছালো। এএসপি আয়ান গাড়ি থেকে নেমে রুমে গিয়ে বসলো। তাকে দেখে ইমন দৌঁড়ে আসলো:স্যার মিনা রহমানকে থানায় এনেছি।
_আমার রুমে পাঠিয়ে দাও। সাথে দুজন লেডি পুলিশ পাঠাও।
_ওকে স্যার বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে মিনা রহমানকে নিয়ে ইমন ফিরে আসলো। সাথে এএসপি আয়ানের কথামতো দুজন মহিলা পুলিশ এসেছে।তারা রুমে প্রবেশ করতেই এএসপি আয়ান বললো: আসুন মিসেস মিনা রহমান। আপনার জন্যেই এতো অপেক্ষা করছি আমি।
মিনা রহমান অনেকটা ঘাবড়ে আছেন। এএসপি আয়ান ইশারায় তার সামনে বসতে বললো।সেও কথামতো এএসপি আয়ানের সামনে গিয়ে বসলো। চোখে মুখে তার আশঙ্কায় ঘেরা।কি করতে গিয়ে কি হয়ে গেল সে বুঝতে পারছে না।তার অবস্থা দেখে এএসপি আয়ান শান্ত গলায় বললো: আপনি বলবেন শুরু থেকেই নাকি আমার জেরা করতে হবে?
মিনা রহমান কাঁপা কাঁপা গলায় বললো: স্যার আমি কিছুই করিনি।
_সেটা আপনার হাসবেন্ড আমাদের বলে দিয়েছেন। তিনি এখন আমাদের হেফাজতে। এখন আপনিও বলে ফেলুন।তা না হলে একজন শিক্ষক হয়ে যতটুকু মানসম্মান পেতেন তার চেয়ে দ্বিগুণ অপমানিত হবেন।
_স্যার আমি জানি না কিছু।
_আমাকে চার্জ করতে বাধ্য করবেন না। বলুন দ্রুত চার্জ করলে এতো নিতে পারবেন না।ভালোই ভালোই বলছি।
_স্যার আমি মিনা রহমান।রুপলাল কলেজের অধ্যাপক।
_এসব আমি জানি। আপনাকে বলতে হবে না।যা জানি না তাই বলুন।
_আমি গার্লস হোস্টেলের সহকারী হোস্টেল সুপার হিসেবে দায়িত্বরত আছি।
কথাটা শুনে এএসপি আয়ান চমকে গিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আর বললো:তারপর
_স্যার আমাদের আগের হোস্টেল সুপার ছিলেন আবুল হোসেন। তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন আমি সদ্য যুক্ত হয়েছিলাম কলেজের সহকারী হোস্টেল সুপার হিসেবে।তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ড্রাগস সাপ্লাই করতেন।আমি তা প্রথম প্রথম জানতাম না।মাস তিনেক পর আমাকে একজন শিক্ষার্থী এই বিষয়ে জানায়।আমি জানতে পেরে কিছুটা অবাক হয়ে তার সাথে কথা বলি। কিন্তু তিনি আমাকে উল্টো হুমকি দেওয়া শুরু করলেন।

কথাগুলো বলে মিনা রহমান থামলেন।তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এএসপি আয়ান তার অবস্থা দেখে একজন লেডি পুলিশকে হুকুম দিলেন এক গ্লাস জল নিয়ে আসুন।সে দ্রুত পায়ে গিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে আসলেন।মিনা রহমান পুরোটা এক চুমুকে শেষ করলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন:স্যার আমার মেয়ের বয়স তখন মাত্র দুই বছর।তিনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন।তিনি আমাকে বলেন হয় আপনিও আমার সাথে ড্রাগসের ব্যবসা করবেন না হয় আপনি লাশ হবেন।আমি প্রথমে ঘাবড়ে গেলাম। কয়েকদিন ভাবলাম। প্রথমে মাথায় আসলো অধ্যক্ষ সাহেবকে বলি তারপর ভয় পেলাম আবার।যদি আমার কিছু হয় তাহলে আমার মেয়ের কি হবে?তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি উনার সাথে ড্রাগসের ব্যবসা শুরু করবো। তার সাথে যুক্ত হ‌ওয়ার সর জানতে পারলাম আমাদের সাথে আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষক এবং কর্মচারী জড়িত আছেন।পরে আমিও বেশ আসক্ত হয়ে গেলাম এই ব্যবসাতে। রোজ টাকা পেতাম। টাকার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লাম। কিছু মাস ভালোই চলছিল কিন্তু কয়েক মাস পর অধ্যক্ষ এসব বিষয়ে জানতে পারেন আবুল হোসেন স্যার সম্পর্কে।তিনি স্যারকে ট্রান্সফার করে দিলেন। কিন্তু অধ্যক্ষ স্যার জানতেন না এতে আমরা আরো কয়েকজন সম্পৃক্ত আছি।
_কে কে সম্পৃক্ত আছেন?
_স্যার আমি, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক বিমুখ ধর, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রহিম মিয়া,ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক অরুণ দাশ আর ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক গোলাম আজম।
_মিস তরী?
_ও আমাদের সাথে যুক্ত ছিল না।
_আবুল হোসেন স্যার চলে যাওয়ার পর আমরা ভালোই চালাচ্ছিলাম ব্যবসাটা। বয়েজ হোস্টেলেও ড্রাগস সাপ্লাই দিতাম।কিন্তু এক মেয়ে সব শেষ করে দিলো।সে ড্রাগসের টাকা জোগাড় করতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসলো। মেয়েটার আত্মহত্যার পর তার এক বান্ধবী আত্মহত্যার কারণ জানতে চেষ্টা করছিল।সে অনেকটা জেনেও গিয়েছিল।তাই আমাদের বাধ্য হয়ে খুন করতে হয় মেয়েটিকে।ঠিক তখনই অরুনিমা আহমেদ সদ্য জয়েন করেন কলেজে।আমরা তার সম্পর্কে খোঁজ নিলাম। জানতে পারি তিনি এই শহরে নতুন।কোনো আত্মীয় বা পরিচিত কেউ নেই।ভাবি তাকে ফাঁসিয়ে আমরা বেঁচে যাবো। আর সে খুব সহজ-সরল ছিল।সেই সুযোগটা তাকে ফাঁসাতে বেশ কাজে লেগেছিল।

এএসপি আয়ান বেশ মনোযোগ দিয়ে মিনা রহমানের স্টেটমেন্ট শুনছে।সেই সাথে কথাগুলো রেকর্ড হচ্ছে ক্যামেরায়।মাঝে প্রশ্ন করে বসলেন: মেয়েটাকে কিভাবে মারলেন?
_স্যার আমরা ওর খাবারে জেনিয়াম নামক এক ধরনের ক্যামিক্যাল দিই।যেটা ওর হার্টবিট আর শ্বাস বন্ধ করে দেয়।সে মারা গেলে আমরা তাকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিই।
_তারপর
_মেয়েটা মারা যাওয়ার আগে তার আরেক ফ্রেন্ডকে বলেছিল আমাদের বিষয়ে।তার কাছেও কিছু প্রমাণ ছিল।সে এসব অধ্যক্ষ স্যারের কাছে পাঠানোর চেষ্টা করছিল একজন পিয়ন রশিদের মাধ্যমে।তাই তাকেও একই ভাবে মেরে দিলাম।সবাই এক‌ইভাবে আত্মহত্যা ভেবে নিলো। সেই সাথে আমার হাসবেন্ডকে দিয়ে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাল্টিয়ে দিলাম আর ঘটনাটা ধামাচাপা দিয়ে দিলাম।কিন্তু মেয়েটা মারা যাওয়ার পর রশিদ রিস্তা নামের মেয়েটাকে খুঁজে নিলো।কারণ তার সাথে অরুনিমা ম্যাডামের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল।আর রশিদ অরুনিমার সততা আর সরলতা দেখে তাকেই উপযুক্ত মনে করছিল।যা রশিদ পারছে না তা অরুনিমাকে দিয়ে করাবে তাই তার উদ্দেশ্য ছিল।
_মানে বুঝলাম না।কি রশিদ পারছে না যেটা অরুনিমাকে দিয়ে করাবে?
_স্যার রশিদ একজন পিয়ন কিন্তু অরুনিমা একজন প্রভাষক।সে সহজেই অধ্যক্ষ স্যারকে এসব বলতে পারবে। রশিদ রিস্তাকে সব বলে আর রিস্তাকে শিখিয়ে দেয় অরুনিমার সাহায্য চাইতে।রিস্তা তার কথামতো সেদিন অরুনিমাকে তাকে সাহায্য করতে বলতে গিয়েছিল।যেটা তরী দেখতে পায়।তাই পরেরদিন রিস্তা মারা গেলে তরী অরুনিমাকে সন্দেহ করে।আর সে খুব চঞ্চল আর বোকা।তাই অরুনিমার সাথে থেকেও তাকে বুঝতে পারেনি। পাশাপাশি তার আপনার প্রতি দূর্বলতা ছিল। তাই সে আপনার চোখে পড়তে অরুনিমার দিকে বারবার তীর ছুঁড়ছিল। আমরাও সেই সুযোগটা নিলাম। অরুনিমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে আমরা তরীকে ফোন দিয়ে সে বিষয়ে জানতে চাই।সে ইমনকে ফোন দিয়ে অরুনিমা সম্পর্কে সব জেনে আমাদের বলে।
_রিস্তাকে কিভাবে মারলেন?
_রিস্তাকে গলা টিপে মেরেছি।কারণ আমরা চাইছিলাম তার বিষয়টা মানুষ আত্মহত্যা নয় হত্যা ভাবুক। যাতে অরুনিমাকে ফাঁসাতে পারি।তাই রিস্তাকে মেরে রিস্তার রুমে অরুনিমার ঘড়ি রেখে আসি।
_অরুনিমার ঘড়ি আপনারা কোথায় পেয়েছেন?
_অরুনিমা ঘড়িটা পড়ে কলেজে আসে।আমি তার হাত ধরার মতো করে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা মারি তার হাতটা।তখন ঘড়িটা ভেঙে যায় আর সে হাতে ব্যথা পায়।সে সেখানেই ঘড়িটা খুলে ফেলে দেয় আর আমরা সেটা তুলে নিই।

চলবে…..