রিক্ত শহরে আমার তুমি পর্ব-০৮

0
93

#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৮

তখন ঘড়িটা ভেঙে যায় আর সে হাতে ব্যথা পায়।সে সেখানেই ঘড়িটা খুলে ফেলে দেয়।আর আমরা সেটা তুলে নিই।
এএসপি আয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকায় মিনা রহমানের দিকে। মানুষ কতো প্ল্যান করতে পারে একটা অপরাধকে ঢাকার জন্য। একটু ভেবে সে মিনা রহমানকে প্রশ্ন করে:”আপনি আপনার হাসবেন্ডকে মিস অরুনিমার কেবিনে পাঠিয়েছিলেন কেন?
_স্যার রিস্তা সেদিন অরুনিমাকে একটা ব‌ই গিফট করেছিল। যার ভেতরে আমাদের সকল ডকুমেন্ট সে রেখেছিল। সেটা অরুনিমা জানে না। আমরা ভেবেছিলাম সেই ব‌ইটা আমরা যেকোনো প্রক্রিয়াই নিয়ে নিবো অরুনিমার কাছ থেকে। কিন্তু তার আগেই আপনি অরুনিমাকে সন্দেহ করে আপনার ফোর্সকে তল্লাশি করতে পাঠাচ্ছিলেন অরুনিমার বাসায়।আর আপনি তাকে তল্লাশি করলেই সেই ব‌ইটা পেতেন।আর আমরা ধরা খেয়ে যেতাম।তাই বাধ্য হয়েই এমন করেছি যাতে আপনারা ব‌ইটা না পান।
_বেশ তো প্ল্যান করলেন। কিন্তু একটা বিষয় কি জানেন?আসামীরা কোনো একটা ভুল করেই ফেলে আর আমরা সেটা ধরে ফেলতে পারি। যেমনটি আপনারা করেছেন।এখন একবার ভাবুন আপনার মেয়ের কি হবে আপনি জেলে গেলে।

মিনা রহমান অঝোরে কাঁদছে কিন্তু তাতে এএসপি আয়ানের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।সে অনেক খুশি মনে মনে।অরুনিমার মতো নিরীহ মানুষকে সে বাঁচাতে পেরেছে।এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে। কিন্তু তখনি মিনা রহমান বললেন:”স্যার আমাকে ক্ষমা করুন।আমি আর কখনো এসব কাজ করবো না। প্লিজ স্যার”
_এটা কখনো সম্ভব নয়। আপনার জন্য কতোজন নিরীহ ছাত্রী মারা গেলো। আপনার তো লজ্জা হ‌ওয়ার কথা। শিক্ষক পেশার মতো এতো সম্মানের একটা পেশাকে আপনি কলঙ্কিত করলেন আজ। আপনাকে এক্ষুনি জেলে দিবো।তার আগে আপনার টিমের অন্য সদস্যদের গ্রেফতার করে আনি।

এই বলে এএসপি আয়ান উঠে দাঁড়ালেন। মিসেস মিনা রহমান এখনো কাঁদছেন। মহিলা পুলিশ দুজন তাকে নিয়ে গেল। এএসপি আয়ান ইমনকে বললেন: “ফোর্স নিয়ে কলেজে চলো।”
_ওকে স্যার।

কলেজ ক্যাম্পাসে আগে থেকেই পুলিশের একটা টিম ছিল। তারা সকল শিক্ষকদের অফিস লকার চেক করতে গিয়েছিলেন।অধ্যক্ষ সাহেবও তাদের সাথে আছেন। হঠাৎ এএসপি আয়ানকে দেখে অধ্যক্ষ স্যার ছুটে আসলেন। অনেকটা আন্তবিশ্বাসের সাথে বললেন: স্যার আমাদের কলেজের অধ্যাপক মিনা রহমানকে গ্রেফতার করেছেন নাকি? কিন্তু তিনি নির্দোষ।
_নির্দোষ নাকি দোষী তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তার স্বীকারোক্তিতে। তার সাথে কারা জড়িত আছেন তাদের নাম‌ও বলেছেন।আর আপনি খুব দম দেখিয়ে বলছেন সে নির্দোষ। বাহ্!সবার আগে আপনাকে গ্রেফতার করা উচিত।
_আমি কি করেছি স্যার?
_আপনি আপনার দায়িত্বের অবহেলা করেছেন। আপনি কলেজের অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় আপনার চোখে ধুলো দিয়ে তারা এতো জঘন্য কাজ করলো।আর আপনি তা বুঝতেই পারলেন না। তাহলে বুঝুন আপনি কতো দ্বায়িত্ব-জ্ঞানহীন।

অধ্যক্ষ সাহেব এএসপি আয়ানের কথায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনি তরী আসলো সেখানে।সে একটু আগ বাড়িয়ে মাস্টারি করে বললো:”স্যার মামলার ইনভেস্টিগেশন কতটুকু এগোচ্ছে?অরুনিমাকে কখন গ্রেফতার করবেন?”
_মামলার ইনভেস্টিগেশন শেষ। আমরা আসামি গ্রেফতার করতে এসেছি।
_কি বলছেন স্যার?আসামি মানে অরুনিমা তো হাসপাতালে। তাহলে এখানে কাকে গ্রেফতার করবেন?
_সেটা গ্রেফতার করলেই দেখতে পাবেন।

তরী আরো কিছু বলতে যাবে তখনি এএসপি আয়ান দ্রুত পায়ে তার সামনে থেকে প্রস্থান করলো।সে খুব ভালো করে জেনে এই তরী মেয়েটা কথা বলতেই থাকবে।কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান তার একদম পছন্দ নয়।তাই নিজে থেকেই সরে যাওয়া ভালো। ইমন ততোক্ষণে সকল শিক্ষকদের ডেকে পাঠালেন কিন্তু তার আগেই ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রহিম মিয়া পালিয়ে গেছেন। বাকিদের তারা গ্রেফতার করতে সক্ষম হলো।

আসামিদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর এবার পালা রহিম মিয়াকে খোঁজার। রহিম মিয়াকে খুঁজে এনে গ্রেফতার করা খুব বেশি কঠিন কাজ নেয়। শনাক্ত করতে পেরেছে তাতেই এএসপি আয়ান অনেক খুশি। তার মাথায় বসে থাকা এতো বড় ঝামেলার পাহাড় আজ নেমে গেছে। তার জীবনে প্রথম কোনো মামলা নিয়ে সে এতোটা হিমসিম খেয়েছে।অরুনিমাকে প্রথমে সন্দেহ করাটা তার জন্য বড় ভুল ছিল। শুরু থেকে প্রপার ইনভেস্টিগেশন করলে হয়তো এতো কষ্ট হতো না তার।আর অরুনিমাও তার সাথে সাথে বেশ হিমসিম খেয়েছে।এখনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সে। মাথার আঘাতটা ঠিক হতে একটু সময় লাগবে।
তাকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত। এই ভেবে এএসপি আয়ান ইমনকে ডাক দিলো। ইমন তার খুব কাছের একজন বলা চলে। পুলিশের চাকরিতে জয়েনের পর থেকে ইমন তার আরেকটা হাত। ইমন সাথে সাথে এসে স্যালুট দিলো।
_আমাদের একবার মিস অরুনিমাকে দেখতে যাওয়া উচিত।তাই না?
_জি স্যার। তাকে মামলার সমাধান হয়েছে সেটাও বলা উচিত স্যার। নিশ্চয় বেচারি অনেক টেনশন করছে।
_রাইট।চলো তাহলে যাওয়া যাক।

ইমন আর এএসপি আয়ান থানা থেকে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।আজ ড্রাইভারকে সাথে নেইনি।ইমন গাড়ি চালাচ্ছে। মাঝপথে এসে কিছু ফলমূল নিলো এএসপি আয়ান।গাড়ি চলছে আপন গতিতে। এএসপি আয়ান হঠাৎ কি যেন ভাবলো। ভেবে ইমনকে বললো:”হাসপাতালের বিলটা আমার পে করা উচিত।
এএসপি আয়ানের কথা শুনে ইমন হেঁসে উঠে বললো: স্যার সে নাকি অনেক বড়লোকের মেয়ে।এসব বিল আমাদের পে করার কি দরকার।
_কে বলেছে তোমাকে এসব?
_রাফিদ স্যার। স্যারের এলাকার মেয়ে অরুনিমা ম্যাম।স্যার নাকি ছোট থেকেই অরুনিমা ম্যামকে অনেক পছন্দ করে। কয়েকবার প্রপোজ করেছিল কিন্তু অরুনিমা ম্যাম রিজেক্ট করেছে।

কথাটা শুনে এএসপি আয়ানের খুব রাগ হচ্ছে রাফিদের উপর। কেন রাগ হচ্ছে তা সে জানে না। মানুষের তো পছন্দ থাকতে পারে।রাফিদের ক্ষেত্রেও তাই কিন্তু এএসপি আয়ানের তা মানতে কষ্ট হচ্ছে।
নিজেকে সামলিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো:আর কি কি বলেছে রাফিদ?
_রাফিদ স্যার চাকরি পাওয়ার পর বাসা থেকে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অরুনিমা ম্যামের বাবা রাজি হননি।
_কেন?
_রাফিদ পুলিশের চাকরি করে বলে।

ইমনের কথায় তার আরেক দফা রাগ হলো। কপাল কুঁচকে আছে তার। আবার সে ইমনকে প্রশ্ন করলো: পুলিশের চাকরিতে সমস্যা কোথায়?
_অরুনিমার বাবার পুলিশের চাকরি পছন্দ নয়।
এএসপি আয়ান বিড়বিড় করে বললো: “স্বপ্ন দেখা শুরু করার আগেই এই ইমনের বাচ্চা সব শেষ করে দিলো।”
ইমন অবাক চোখে জিজ্ঞাসা করলো:”কি বললেন স্যার? শুনতে পায়নি।”
_তোমার এসব শুনতে হবে না। মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাও।গাড়ি চালানোর সময় কথা বলা বিপজ্জনক।
ইমন মনে মনে বলছে,”এই ব্যাটার মাথায় কি চলে আল্লাহ আর সে ছাড়া কেউ জানেনা।নিজেই তো প্রথমে তার সাথে কথা বলা শুরু করলো। এখন নিজেই উপদেশ দিচ্ছে। আসলেই পুলিশ খারাপ জিনিস।”

গাড়ি হাসপাতালে এসে পৌঁছালো। ইমন আর আয়ান দুজনেই নামলো।অরুনিমার কেবিনে যেতেই দেখলো রাফিদ আর তরী দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। এএসপি আয়ানকে দেখে তরী অনেকটা উচ্ছাসিত হয়ে দৌড়ে আসলো।এসেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিলো।
_স্যার আপনি এখানে?
_জি।
_কেন এসেছেন স্যার?
_আপনি কেন এসেছেন?
_আমি অরুনিমাকে দেখতে এসেছি।বেচারি কখন থেকে হাসপাতালে পড়ে আছে।
_বাহ্!এতোদিন কোথায় ছিলেন?
_তা তো আপনার দোষ। আপনি অযথা অরুনিমাকে দোষী বানিয়ে দিলেন।আমি তাই ওকে ঘৃণা করে আসিনি।

তরীর কথায় এএসপি আয়ান অনেকটা বোকা বনে গেলো।এই মেয়ে বলে কি?এই তরী নিজেই তো অরুনিমার নামে উল্টা পাল্টা কথা বলে তার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল। এখন নাকি সব দোষ তার।ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ সে তরীর দিকে তাকিয়ে থাকলো।তরী তো তার তাকিয়ে থাকা দেখে খুশিতে আত্মহারা।তরীর অবস্থা দেখে সে চোখ নামিয়ে রাফিদকে বললো:”তা তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
_স্যর কেবিনে ডাক্তার গেছেন।

এএসপি আয়ান রাফিদের কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো।তরী তো দমে যাওয়ার মেয়ে নয়।সে কথা বলতেই আছে তখন থেকে। এএসপি আয়ান এসবে কান না দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ডাক্তার বেরিয়ে আসলো। এএসপি আয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলেন: ডক্টর প্যাশেন্টের কি অবস্থা এখন?
_স্যার সুস্থ আছে। মাথার ব্যান্ডেজ খুলতে একটু সময় লাগবে। আমরা আজ ডিসচার্জ করে দিবো।
_ওকে ডক্টর। ধন্যবাদ আপনাকে।
ডাক্তারের সাথে কথা বলে সে ইমনকে নিয়ে রুমে যায়।তরীও তাদের পেছন পেছন যায়।অরুনিমা শুয়ে ছিল। এএসপি আয়ানকে দেখে সে উঠে বসার চেষ্টা করে।তা দেখে এএসপি আয়ান বলে বসলো:”আরে উঠতে হবে না। আপনি শুয়ে থাকুন। এখন কেমন লাগছে?”
অরুনিমা ছোট গলায় জবাব দিলো:”ভালো লাগছে।”
_রেস্ট নিন।এই কদিন কলেজে যেতে হবে না আপনার।
অরুনিমা মাথা নাড়লো এএসপি আয়ানের কথা শুনে। এএসপি আয়ান আবার নিজ থেকে বললো: “আপনার জন্য খুশির খবর আছে।”
তার কথা শেষ হ‌ওয়ার আগেই তরী বললো:”স্যার আমি আগেই বলে দিয়েছি এসব।”
আয়ানের এবার মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেল।এই মেয়ে এতো আগ বাড়িয়ে কথা কি করে বলতে পারে?অরুনিমাকে আর বলার মতো কিছু সে রাখলো না। একবার রাগান্বিত চোখে তরীর দিকে তাকালো সে।তরী তার তাকানো দেখে একটু ঢোক গিললো। এএসপি আয়ান মনে মনে ভাবছে আর কি কথা বলা যায় অরুনিমার সাথে।বলার মতো কিছু পাচ্ছে না সে।অরুনিমাও চুপচাপ শুয়ে আছে। এদিকে তরী বকবক করেই চলেছে।মুখ বন্ধ করার নিশানা তার নেই। এএসপি আয়ান বারবার বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে তরীর দিকে। একটু একান্তে অরুনিমার সাথে কথা বলতে এসেছিল সে। কিন্তু তরী মেয়েটা সব ভেস্তে দিলো।আর কি সে কখনো অরুনিমার সাথে কথা বলার সুযোগ পাবে?তার জানা নেই। মনে মনে খুব রাগ হচ্ছে আবার কষ্ট‌ও হচ্ছে।সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তার।আর কখনো অরুনিমার সাথে কথা বলা হয়তো হয়ে উঠবে না। হাসপাতালে থাকলে হয়তো বাহানা দিয়ে আবার আসতো কিন্তু সেটাও হবে না। একটু অপেক্ষা করলো সে। তারপর অরুনিমাকে উদ্দেশ্য করে বললো:”আমরা এবার আসি তাহলে। আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন।কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।”
অরুনিমা এবারো মাথা নাড়লো। মুখে কোনো কথা বললো না সে। তার দিকে একপলক তাকিয়ে এএসপি আয়ান ইমনকে আর রাফিদকে উদ্দেশ্য করে বললো:”চলো এবার যাওয়া যাক।”
তারা দুজনেই ওকে স্যার বলে আয়ানের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আয়ান দরজায় গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। পেছনে ফিরে আবার দুকদম সামনে আসে।এসেই অরুনিমাকে বলে….

চলবে