রিক্ত শহরে আমার তুমি পর্ব-০৯

0
87

#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৯

আয়ান দরজায় গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। পেছনে ফিরে আবার দুকদম সামনে আসে।এসেই অরুনিমাকে বলে:” যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতে চাই।”
অরুনিমা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে:”কি হয়েছে স্যার? বলুন।
_আরে ঘাবড়ানোর কিছু নেই ‌। আপনার ফোন নম্বরটা দিতে পারেন?
_হুম সিউর।
এই বলে অরুনিমা তার ফোন নম্বর বলবে কিন্তু এর মাঝে বাঁধ সাধলো তরী। সে এএসপি আয়ানকে অনেকটা ঠাট্টা করে বললো:”আপনার ফোন নম্বরটা কি আমাকে দিতে পারেন?”
এএসপি আয়ান বুঝতে পারলো তাকে তরী বুঝে শুনে অপমান করেছে অরুনিমার ফোন নম্বর চাইছে তাই। ইচ্ছে করছে কষিয়ে একটা চড় দিতে। শুধু মহিলা মানুষ বলে ছেড়ে দিলো। তবে কথায় সেও কম কিসে তরীর চেয়ে। গম্ভীর গলায় বললো:”মিস তরী , ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। আমার ফোন নম্বর দিয়ে আপনি কি করবেন?”
তরী একটু কেঁশে বললো:”আপনি অরুনিমার নম্বর দিয়ে কি করবেন?”
_সেটা আপনার লাগবে? আপনি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছেন মিস অরুনিমা অসুস্থ।তার সুস্থতা বা অসুস্থতার বিষয়ে খবর নেওয়া আমার দায়িত্ব।তাই আমার ফোন দিয়ে উনার কাছ থেকে জানতে হবে।
_স্যার দায়িত্ব আপনার হয়ে আমি পালন করবো।
_কেন ? আমি কি দায়িত্ব পালনে অক্ষম? আপনি আমাকে কি বোঝাতে চাচ্ছেন?এতো কথা বলতে কি আপনার লজ্জা করে না? শুধু শুধু আঠার মতো পেছনে পড়ে থাকেন কেন?নেক্সট টাইম আমার সাথে কথা বলতে আসলে আপনার অবস্থা খারাপ করে দিবো। মাইন্ড ইট।
তরী আয়ানের তিক্ত কথাগুলো শুনে চুপসে গেল।আর আয়ান রাগের বশে রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল। ফোন নম্বর আর নেওয়া হলো না। ইমন, অরুনিমা আর রাফিদ দুজনেই অবাক চোখে তামাশা দেখছে। আয়ান রুম থেকে বেরিয়ে আসার পরেও ইমন আর রাফিদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে।সে আবার রুমে ফিরে আসলো। এসে রাফিদকে আর ইমনকে আরেক দফা শাসিয়ে গেল। আয়ানের বকা শুনে তারা দূত রুম থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।সেও আবার পেছন পেছন এসে গাড়িতে বসলো। অরুনিমা তার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। একটা মানুষের এতো তেজ থাকে কি করে তা অরুনিমার জানা নেই।তরীকে অপমান করাটা অরুনিমার খারাপ না লাগলেও ইমন আর রাফিদের সাথে মিসবিহেভ করাটা অরুনিমার খুব খারাপ লেগেছে।তারা দুজনের তো কোনো দোষ নেই। সবসময় অধস্তনদের কর্তৃত্বের শিখলে বেঁধে রাখতে চাই এএসপি আয়ান।সবসময় রাগী আর গম্ভীর হয়ে থাকা মানুষটার কি কাছের মানুষ বা আপন মানুষ বলতে কেউ নেই যারা তাকে একটু শান্ত-শিষ্ট আর মিলেমিশে থাকতে শেখাবে। বুঝতে পারে না সে এসব। ভাবতে ভাবতে ঘুম চলে আসলো তার।তরী আজ অরুনিমার সাথেই ছিল কারণ অরুনিমার বাবা চলে গেছেন বাড়িতে।তার অনেক কাজের চাপ।বড় মেয়ের বিয়ে সামনে।সব একা হাতে সামলাতে অনেক হিমসিম খেতে হচ্ছে।তার মধ্যে উপরি পাওনা হিসেবে অরুনিমার ঝামেলা মাথায় আসলো।

ঘন্টাখানেক পর একজন নার্স এসে অরুনিমার ডিসচার্জ পেপারটা তরীকে দিলো।সে পেপারে সাইন করে অরুনিমাকে ঘুম থেকে ডাকলো।
_এই অরুনিমা,ওঠো। এবার বাড়ি যেতে হবে।
অরুনিমা তরীর ডাকে ঘুম ঘুম চোখে সাড়া দিলো।আস্তে আস্তে উঠে বসলো। সে হাঁটতে পারছে না খুব একটা।তরী তাকে ধরে ধরে আনছে। দুজনে একটা টমটম নিয়ে বাসায় আসলো।

এদিকে এএসপি আয়ান বাসায় আসার পর চুপচাপ বসে আছে।আজ তার মন খুব খারাপ। একটা মেয়ের কাছ থেকে প্রথম ফোন নম্বর চাইতে গেল।তাও আবার অজুহাত দেখিয়ে।তবু নাকানিচুবানি খেতে হলো তাকে।এতো লজ্জা রাখে কোথায় সে।যাই হোক কেউ বুঝতে পারেনি সে অরুনিমার ফোন নম্বর চাইছে কেন।সবাই মনে করেছে দায়িত্বের খাতিরে খবর নেওয়ার জন্য ফোন নম্বর চাইছে। কিন্তু চোরের উপর বাটপার থাকে।কেউ না বুঝলেও ইমন ঠিকই আয়ানের মনের অবস্থা বুঝেছে।

মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা, ঘন্টা পেরিয়ে দিন। এভাবে কেটে গেল চার দিন। আয়ান আর অরুনিমার কোনো কথা হয়নি এর মাঝে। তবে ইমনকে দিয়ে আয়ান খোঁজ নিয়েছিল বেশ কয়েক বার। হাসপাতাল থেকে আসার পরদিন অরুনিমা বাড়ি চলে গেছিল। এএসপি আয়ানের তাকে খুব দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু অরুনিমা বাড়ি চলে যাওয়ায় সে সুযোগ আর হয়ে উঠেনি।অরুনিমা এখন অনেকটা সুস্থ।নিজে নিজে হাঁটতে পারছে,কাজ করতে পারছে। অনেকটা বিন্দাস আছে সে।বাড়িতে সবাই তার দেখভাল করছে।বোনের বিয়ে বলে মজা আরো বেড়ে গেল। ছোটরা সবাই প্ল্যান করছে বিয়েতে কি করবে সেটা নিয়ে। কিন্তু বড়রা খুব একটা এই বিয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। অরুনিমার বড় বোন তামিমা।পেশায় একজন জাস্টিস সে। ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে একটা ছেলের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়‌। ছেলেটিও পেশায় জাস্টিস।কিন্তু দুই পরিবার মেনে না নেওয়ায় বিয়েটা করতে তাদের অনেক হিমসিম খেতে হয়েছে। ফাইনালি বাধ্য হয়ে দুই পরিবার মেনে নিলো। দুদিন পর তাদের বিয়ে। ভালোবাসার পরীক্ষায় জয় হয়ে যাবে তারা।

এএসপি আয়ানের মন আজ অনেক খুশি।সে আজ বাড়ি যাবে।প্রায় দুই মাস ধরে ছুটি নেয়নি সে একসাথে সব কাটাবে বলে। টানা এক সপ্তাহ ছুটি আছে তার। সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে গেল।তার সাথে ইমন যাবে।দুজনে ব্যাগপত্র নিয়ে বের হয়ে গেল।তার বাবা আগে থেকেই গাড়ি পাঠিয়েছিল। সেই গাড়ি করেই যাবে তারা।

দীর্ঘ দুই ঘণ্টা ধরে গাড়ি চলছে। গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু ইমনের আর সহ্য হচ্ছে না। এতোক্ষণ ধরে বেচারা বসে আছে।সে বরাবরের মতো দীর্ঘ জার্নি করতে পারে না।তাই না আসতে চেয়েছিল কিন্তু এই এএসপি নাছোড়বান্দা। বেচারারও মনে মনে দেখার ইচ্ছা ছিল এএসপি আয়ানের পরিবারকে। তার খুব জানার ইচ্ছা বাড়ির সবাই কি ঘাড়ত্যাড়া নাকি শুধু এএসপি আয়ান একা ঘাড়ত্যাড়া।সব মিলিয়ে এইবার বাধ্য হয়ে চলে এসেছে সে। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ইমন বললো:স্যার আর কতটুকু?আমি আর পারছি না।
_এইতো দশ মিনিট। অপেক্ষা করো।
ইমনের মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল।

প্রায় পনের-বিশ মিনিট পর তারা এএসপি আয়ানদের বাসায় আসলো। বাড়িটা দুতলা। চারপাশে বাহারি রকমের গাছ লাগানো। পুরো বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো।যেন কোনো বিয়ের আয়োজন চলছে। ইমন চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো:স্যার এটা তো বিয়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।
আয়ানের ছোট উত্তর: হ্যাঁ।
ইমন চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো:কার বিয়ে স্যার? আপনার বিয়ে?
আয়ান একটু হেসে বললো:আরে আমার বিয়ে হবে কেন? আমার কি এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে?
ইমন আয়ানের উত্তরে হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর আয়ানের কানের কাছে গিয়ে বললো:স্যার সঠিক সময়ে বিয়ে করলে আপনার ছেলে এখন বৌ চিনতো। আর আপনি বলছেন আপনার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।
ইমনের কথায় আয়ান তার দিকে রাগী চোখে তাকালো। তারপর মুচকি হাসি দিয়ে বললো: মেয়ে তো পাচ্ছি না।
ইমন মনে মনে বলছে:”মেয়ে পাচ্ছেন না নাকি পটাতে পারছেন না তা আমি ভালো করে জানি।”
_ওকে চলো ভেতরে যায়।এই বলে আয়ান ইমনকে নিয়ে ভেতরে গেলো। বাইরের চেয়ে ভেতরে আরো বেশি সুন্দর।ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে তাদের বাড়িটা‌।সেই সাথে বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন। ইমন আয়ানের কানে কানে বললো:স্যর আমি অনেক টায়ার্ড। একটু ঘুমাতে চাই।
আয়ান বললো: চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি রুমে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।ভাবিকে দেখতে যাবো। আমার জন্য আমার কাজিনরা অপেক্ষা করছে।সবাই মিলে যাবো আজ।
আয়ানের কথায় ইমনের বেশ রাগ হলো। তবু অর্ডার তো মানতে হবে।তাই বাধ্য হয়ে সে আয়ানের ফ্রেশ হতে যাচ্ছে। হঠাৎ আয়ান ইমনকে টান দিয়ে তার জায়গায় নিয়ে আসলো। তখনি ইমন কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে “ও মাগো ” বলে চিল্লিয়ে উঠলো।মেয়েটাও দমে যাওয়ার মেয়ে নয়।সে ইমনকে দেখে আরো চিল্লিয়ে বললো:”হো আর ইউ রাবিশ?”
ইমন সাথে সাথে জবাব দিলো:” আমি রাবিশ হলে আপনি খবিশ।” মেয়েটা একথা শুনে বাঁধিয়ে ফেললো ঝগড়া। আয়ান একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের তামাশা দেখছে আর মুখ টিপে টিপে হাসছে। দারুন লাগছে দুজনের ঝগড়া।কেউ কাউকে ছাড়ছে না। ইমন ছেলেটা খুব পারফেক্ট সব দিকে। হোক সেটা ঝগড়া বা অন্য কিছু। অবস্থা বেগতিক দেখে এএসপি আয়ান ইমনকে ডাক দিলো।তার ডাকে ইমন চুপ হয়ে গেলো আর মেয়েটা পেছনে তাকালো।”আরে ভাইয়া তুমি?” এই বলে মেয়েটা কাছে আসতে যাবে তখনি আয়ান ভো দৌড় দিলো।তার দৌড় দেখে ইমন‌ও পেছন পেছন দৌড় দিলো।দৌড়ে গিয়ে আয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো:স্যার আপনি পালিয়ে আসছেন কেন?
_আরে আর বলো না। পালিয়ে না আসলে আমার গায়ে উঠে যেতো।তাই পালিয়ে আসলাম।
আয়ানের কথাটা বলার স্টাইল দেখে ইমন আরেক দফা হাসি দিলো।তার হঠাৎ মনে পড়লো আয়ান তাকে মেয়েটার গায়ে ধাক্কা দিয়েছিল। একটু রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো:স্যার আপনি আমাকে মেয়েটার গায়ে ধাক্কা দিলেন কেন?
আয়ান একটু ইতস্তত করে বললো: আমাকে বাঁচানোর জন্য।রাগ করিও না। ওকে?ও খুব ভালো মেয়ে। তোমার সাথে মানাবে।
_ভালো মেয়ে বলেই তো পালিয়ে আসছেন।তা মেয়েটা কে?
_আমার খালাতো বোন মিষ্টি ।এটাই তো সমস্যা।অন্য কেউ হলে এতোদিনে দুই গালে চার থাপ্পড় বসিয়ে দিতাম।যাই হোক ফ্রেশ হয়ে আসো।
_ওকে আসছি।

দুজনেই ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করলো। তারপর সবাই মিলে বের হলো। মিষ্টি আয়ানের পেছন পেছন আছে তখন থেকে। ইমন এখন বুঝতে পারছে আয়ানের পালিয়ে যাওয়ার কারণ। বেচারা সহ্য‌ও করতে পারছে না আবার কিছু বলতেও পারছে না।মহা মুশকিলে পড়েছে।তাই বারবার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রায় ছেলে-মেয়ে মিলে সাত-আটজন হলো। আয়ান গাড়ি ড্রাইভ করছে। গন্তব্য তার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি। ভাবির গায়ে হলুদের সামগ্রী নিয়ে তারা যাচ্ছে।

প্রায় এক ঘন্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছে এএসপি আয়ান।সে কখনো এই দিকে আসেনি।তার এক কাজিন শ্রেয়া তাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে আর সে চালাচ্ছে। দীর্ঘ সময় পর তারা গাড়ি থামালো এক বিশাল বিল্ডিংয়ের সামনে।এটা তার ভাবিদের বাড়ি।ভাবির দাদার তৈরি বাড়িটা।তাই এক এক তলায় এক এক ভাই থাকে।তার ভাবিরা ছয় তলায় থাকে।

গাড়ি পার্ক করে তারা নামলো।দুজন ছেলে এসেছে তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য।তারা ছেলেগুলোর পেছন পেছন হাঁটছে। লিফটে উঠতে যাবে তখনি আয়ানের চোখ কারো দিকে পড়লো।সে হঠাৎ থমকে গেলো। মেয়েটা বেশ হেসে হেসে কারো সাথে কথা বলছে তাই সে আয়ানকে দেখছে না। কিন্তু এএসপি আয়ান তার দিকে তাকিয়ে আছে।তার দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে ইমন সামনে থেকে আসলো। এসে জিজ্ঞেস করলো:স্যার আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
_দেখো, অরুনিমা এখানে।

চলবে