রিটেক পর্ব-১৬+১৭

0
135

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৬

নদীর শান্ত স্রোতের ন্যায় বয়ে চলেছে ফাহাদের জীবন। তবে একই রুটিনে আবর্তিত হওয়া জীবনের খেলাঘরে নতুন এক অনুভূতির সন্ধান পেয়েছে ফাহাদ। দীপ্তির প্রস্থানের পর থেকেই নিজেকে বড় একা লাগতো তার। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে পুরো ঘরে যখন নিজেকে একা পেত তখন প্রকৃতই মনে হতো তার কেউ নেই। কামরুন্নাহার যদিও ছেলের কষ্ট বুঝছিলেন, কিন্তু অনুভূতির অঙ্কুরে এমন একটা ধাক্কা যে ফাহাদের জন্য বড় ভারী হয়ে গেছে সেই ভার হালকা করার মত শক্তি তার ছিলো না। সন্তানের কল্যাণের কথা ভেবে মাতৃ মনে একটা ভাবনার উদয় হলেও তিনি সেটা চাপা দিয়ে রাখেন। ছেলেটা একটু গুছিয়ে নিক। নিজেকে, পরিস্থিতিকে। ফাহাদ ততদিনে খোঁজ পেয়েছ নতুন একজনের। মাঝরাতে অন্ধকারের কপাট ভেঙে যখন সে মিটিমিটি জ্ব-ল-তে থাকা তারা দেখতো তখন মনে হতো কেউ যেনো তাকে ডাকছে। আঁধারের বুক চিড়ে যখন নিজের কথাগুলো আকাশে পাঠিয়ে দিতো একবারও মনে হতো না ওগুলো গন্তব্যহীন। বিশ্বাস নিয়ে সেদিকে তাকাতো। যেনো কথাদের গন্তব্য তাদের জানা। কি অবলীলায় ফাহাদের বুকের ভার কমিয়ে তারা রওনা দিতো! হঠাৎ একদিন বিষয়টা তাকে ধাক্কা দিলো। কথার চিঠি সে কার কাছে পাঠায়? বাতাসের থলেতে কথা ভরে দিলে তার কেনই বা এতো প্রশান্তি আসে? কে আছে ওদিকে? উত্তরটা নিজ মনেই হাতড়াতে শুরু করলো সে। বেশিদিন লাগলো না তাকে খুঁজে পেতে। সে যে ওখানেই ছিলো, ফাহাদের মনের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গায়। কিন্তু অবহেলায়। অনাদরের ধুলো সরিয়ে যখন ফাহাদ তাকে খুঁজে পেলো তখন বাতাসের আর্দ্রতা তাকে উদাস করলো না, অন্ধকারের জাল তাকে বললো না “তুমি একা”। বরং সে খুঁজে পেলো এক নতুন জগৎ। অন্ধকারের বুক চিড়েই যার জন্ম। আজকাল ফাহাদের আর নিজেকে একা লাগে না। মনে হয় না সে সঙ্গীহীন। কথা শোনার কেউ নেই এই কথাটাই যেনো তার ভাবনার জগৎ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। আজকাল জমিন তার বার্তাবাহক। বুকে কথা জমলেই এখন সে কপাল রাখে মাটিতে। ফিসফিসিয়ে বলে মনের সব কথা। অনুভূতিগুলো যখন অশ্রু হয়ে ঝড়ে, ফাহাদের নিজেকে হালকা লাগে। পাখির পালকের মত। সে বুঝতে পারে গাফিলতির আবরণে মুড়ে থাকা তার জীবন আলোর সন্ধান পেয়েছে। যে আলো কখনও নেভে না, নিভতে জানে না।

• • • •

কফির কাপ রাখতেই ফোন ভাইব্রেট করলো। সন্তর্পনে সেটা বন্ধ করে দিলো নীরব। ফাহাদ দেখলেও কিছু বলল না। মিনিট খানেকের নীরবতা। ফের ফোন বাজলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও ফোন কাঁটতে উদ্যত হতেই তাকে থামালো ফাহাদ।

– সমস্যা কি? আন্টির ফোন ধরছিস না কেনো?
– এমনি।
– এটা কোন ধরনের কাজ? বেয়াদবি করার জায়গা পাচ্ছিস না?
– আহ! তুই রাগছিস কেনো?
– তোর মা তোকে ফোন দিচ্ছে। মুখের উপর বারবার ফোন কেটে দিচ্ছিস। এটা কি বেয়াদবি না?
– মার মাথায় নতুন জিনিস ঢুকেছে। যতক্ষণ না করতে পারছে ততক্ষণ থামবে না। আমি অনেক বুঝিয়েছি। না বুঝলে আমার আর কিছু করার নেই।
– কি করেছে আন্টি?
ফাহাদের চোখে সন্দেহ। নীরব চোখ নামালো। কাঁচের দেয়ালের বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকালো। এই গাছটার জন্যই এই রেস্টুরেন্টে আসতে এতো ভালো লাগে।
– দেখ ফুলগুলো কি সুন্দর লাগছে?
– কথা ঘুরাবি না নীরব। আমি কি জিজ্ঞেস করলাম?
– মা এখন আমাকে বিয়ে করাবে।
হাল ছাড়ার ভঙ্গিতে বলল নীরব। ফাহাদ বলল,
– তো কর। নাকি চিরকুমার সঙ্ঘে নাম লিখিয়েছিস?
বন্ধুর দিকে তাকালো নীরব। দীপ্তি মা-রা যাওয়ার পর সে ভেবেছিলো ফাহাদ হয়তো ততোটা ভেঙে পড়বে না। কারণ দীপ্তির সাথে তার মানসিক বন্ধন মজবুত ছিল না। কিন্তু তেমনটা হয়নি। দীপ্তির করুন মৃ-ত্যু তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ছাপ ফেলেছে মস্তিষ্কে, চেহারায়। সে প্রায়ই দীপ্তির কবরে যায়। অঝোরে কাঁদে। নীরব অবাক হয়। দীপ্তিকে যদি সে এতটাই ভালোবাসে তাহলে ডিভোর্সের কথা মাথায় এনেছিলো কেনো? তবে জিজ্ঞেস করে না। সেসব এখন অতীত। কি দরকার খুঁচিয়ে পুরোনো জখম বের করার?
– কি হলো? কথা বলছিস না কেনো?
বন্ধুকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল ফাহাদ। নিজের মাঝে ফিরে এলো নীরব। এক পলক ফাহাদকে দেখে বলল,
– আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।
– কেনো?
নীরবের মুখ দেখেই উত্তরটা বুঝলো ফাহাদ। দম ছেড়ে বলল,
– আমার জন্য যদি তুই নিজেকে বঞ্চিত করিস তাহলে সেটা আমার খারাপ লাগবে। নিজেকে দোষী মনে হবে।
– তুই বেশি বুঝিস। আমি কিছু বলেছি?
– বেশি বুঝলেও ঠিকই বুঝেছি। দেখ নীরব, দীপ্তির মৃ-ত্যু আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। তবে যতোটা না দীপ্তির চলে যাওয়াতে তার চেয়ে বেশি মৃ-ত্যু জিনিসটাকে এভাবে সামনে থেকে ফেস করাতে। বাবার মা-রা যাওয়ার কথা সেভাবে কিছু মনে নেই। নিজের চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষকে একভাবে নেই হয়ে যেতে দেখা সত্যিই ভয়ানক। কিন্তু আমি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। চেষ্টা করছি। তুই এগিয়ে যা প্লিজ। আমিও একটা বিয়ে খাই। এনজয় করি।
ফাহাদের মুচকি হাসির দিকে তাকালো নীরব। ছেলেটা কি সুন্দর করে কথা বলে! কামরুন্নাহারের ফোন আবার আসতেই ফাহাদ ধরল।
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ফাহাদ বলছি।
– জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– আচ্ছা আন্টি। আজকে নাকি? আচ্ছা আমি ওকে নিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ্। জি বিকেলেই নিয়ে যাব। আচ্ছা রাখুন।
ফোন রেখে নীরবের দিকে তাকালো ফাহাদ। রহস্যময় হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
– ব্যাচেলর জীবন সাঙ্গ করার জন্য প্রস্তুত হও বন্ধু!
নীরব তাকিয়ে রইলো বিস্মিত হয়ে।

•• •• •• ••

রূপাকে কিছু বখাটে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। খবরটা এভাবেই প্রচার হলো। পাড়া প্রতিবেশী থেকে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই জানলো রূপাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তবে তার অক্ষত হয়ে বাড়ি ফেরার কথা চাপা পড়ে গেলো বিস্তর গবেষণার আড়ালে। সবাই ফোন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো। কেউ কেউ বলল, “আহারে রূপার সব গেলো! এখন তো ওর বিয়েও হবে না।” আনোয়ারা বেগম শোকে বিছানা নিলেন। রিমন দিশেহারা বোধ করলো। ঘরবন্দী রূপাকে নিয়ে তার ভয় হতে লাগলো। তমা পরামর্শ দিলো তাকে কলেজে পাঠাতে। পড়াশোনার মাঝে থাকলে এসব কথা গায়ে লাগবে না। রিমন তাই করলো। জোরাজুরি করে রূপাকে কলেজে নিয়ে গেলো। তবে ঘটনার মোড় অন্য প্রান্তে ঘুরলো কলেজ গেটে পা রাখতেই। কিছু মেয়ে রূপাকে হিংসা করতে শুরু করেছিল। হিমেলের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখলেও সম্পর্কের কথা ছিল প্রচারিত, প্রকাশিত। রূপার বয়ফ্রেন্ড ডাক্তার। সাথে সুদর্শন। অনেক মেয়ের পছন্দের তালিকায় উপরে ছিলো হিমেল।। সেই মেয়েদের দলে তারাও ছিল। তাই রূপার সাথে অঘোষিত শত্রুতা শুরু করেছিল তারা। তাদেরই একজন মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে রূপার সামনে দাঁড়ালো।
– কি ব্যাপার রূপা? কেমন আছো বলো তো।
রূপার মুখ আঁধার। ঘটনার দশদিন পেরিয়েছে। এর মাঝে তাকে কত রকম নাম দিয়েছে আশপাশের মানুষ! কেয়া,অর্পি গিয়েছিলো। রূপা তাদের সাথে কথা বলেনি। আসমা ছুটেছিল সাথে সাথেই। তবে রূপা দূরত্ব বজায় রেখেছে সকলের সাথেই। এমনকি আসমার রোজ করা ফোনও আর সে ধরে না। কিন্তু হিমেল ফোন করেনি একদিনও। ভুল করেও না। মুখ তুলে তাদের দিকে তাকালো রূপা। সামনের মেয়েটার নাম সাবা। সাবাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই মেয়েটা তার হাত ধরলো।
– আরে আরে যাও কই? একটু দাঁড়াও গল্প টল্প করি। এমন করে চলে গেলে কেমনে হয় রে ভাই?
রূপা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। তবে তার হাতকে উল্টো আরো শক্ত করে ধরে সাবা। মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
– দেমাগ দেখাও সুন্দরী? তোমার এই দেমাগের চার পয়সা দাম নেই। সবাই এখন তোমাকে কি হলে জানো? ধর্ষিতা! ভালোই সিম্প্যাথি পাবা আশা করে যায়। কিন্তু কি জানো? তোমার প্রাণের বয়ফ্রেন্ড! সে তো পগার পার!
হাসতে লাগলো তারা। সাবার দিকে তাকালো রূপা। তার পাশে হাসতে থাকা মেয়েগুলোর দিকেও। এবারই মুখ খুলল সে,
– কি বলতে চাচ্ছো?
– ও মা! জানো না? আহারে! থাক আমরাই বলি। কষ্ট পেও না হ্যাঁ? তোমার বয়ফ্রেন্ড, হিমেল আশরাফ, এখন আরেকজনের বর। বিয়ে করেছে আজ এক সপ্তাহ।

চলমান।

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৭

হিমেল যেনো জানতো রূপা আসবে। ঠিক এভাবেই। তৈরি থাকা সৈনিকের মতো সে উঠে দাঁড়ালো। রূপার শ্বাস প্রশ্বাস তখনও স্বাভাবিক হয়নি। তবে প্রশ্নের উত্তর পেতে সে উদগ্রীব। হিমেলকে নিশ্চুপ দেখে সে আবারও বলল,
– বলো হিমেল। সবাই কেনো বলছে তুমি বিয়ে করেছ?
– আমার সাথে এসো।
রূপা যেনো নিজের মাঝে নেই। অজানা আশঙ্কা তাকে ভয় দেখাচ্ছে। সেই ভয়ের বশবর্তী হয়ে সে হিমলকে অনুসরণ করল। আরো একবার। শেষবার কি?

কলেজ সংলগ্ন এক রেস্টুরেন্টে তাকে নিয়ে গেলো হিমেল। আসার সময় চেনা জানা প্রতিটা মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের চোখে কি ছিল? রূপা পড়ার চেষ্টা করেছে। তবে উত্তরগুলো তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিতেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। থাক, সব প্রশ্নের উত্তর নাহয় নাই পাওয়া গেলো।
হিমেলকে দেখাচ্ছে খুব শান্ত। রূপা জানেনা এই শান্ত, নীরব অবস্থা কিসের পূর্বাভাস। উৎকণ্ঠায় তার হাত, পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো সে। পারলো না।
– শোনো রূপা। জীবন সবসময় একরকম যায় না। আমরা ভাবি এক হয় আরেক..
– তুমি বিয়ে করেছ হিমেল?
– আমাকে শেষ করতে দাও।
– ভণিতা বাদ দাও। সোজাসুজি বলো কি বলতে চাচ্ছো।
– বেশ! তোমার যখন তেমনি ইচ্ছে। কিন্তু আমার কথা শুনলে তোমার ক্ষতি হতো না।
– তুমি কি বিয়ে করেছো?
টেবিলে জোরে চাপড় দিলো রূপা। তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। হিমেলকে সে চিনতে পারছে না। এই হিমেল তার চেনা নয়, এই চোখের ভাষা তার জানা নেই।
– হ্যাঁ।
বিশ ফুট উচ্চতায় ওঠা ঢেউ সশব্দে আছড়ে পড়ল কিনারায়। তারপর? সব নীরব।
– আমি কি দোষ করেছিলাম?
খুব কষ্ট উচ্চারণ করলো রূপা। তার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সে জানেনা পরের কদম সে কোথায় ফেলবে।
– আসলে রূপা পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে গিয়েছিল যে..
– একদম নাটক করবে না। কিসের পরিস্থিতি? তুমি বিয়ে করেছ আজ দুই সপ্তাহ। চৌদ্দদিন ধরে তোমার পরিস্থিতি শেষ হয় না?
– চিৎকার করবে না রূপা। এটা পাবলিক প্লেস।
– পাবলিক প্লেস তো আমি কি করবো?
– তোমার মান সম্মান নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। আর আমি সেটা ঠিক রাখতে চাই।
– মান সম্মান! তোমার আবার কিসে মান সম্মান? ফ্ল্যাটে থাকো একজনকে নিয়ে বিয়ে করো আরেকজনকে।
– মাইন্ড ইওর ল্যাংগুয়েজ রূপা!
– তুমি তোমার চরিত্র ঠিক করো তারপর আমার ভাষা ঠিক করতে এসো।
– ব্যস! অনেক বলেছো। কিসের চরিত্র? নিজের দিকে তাকাও। মানুষ তোমাকে কি বলে জানো? ধর্ষিতা! বোঝো এই শব্দের মানে? নাকি ভেঙে বলতে হবে? তোমাকে বিয়ে করলে মানুষকে মুখ দেখাতে পারবো আমি?
– তুমি বিয়ে করেছ চৌদ্দদিন আগে। আর আমার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে সাতদিন।
– করেছি। তো কি হয়েছে? আরে তোমাকে বিয়ে করলে কি পেতাম আমি? যেই মেয়ে মা ভাইয়ের কথা চিন্তা না করে বিয়ে করে ফেলতে পারে তার থেকে আর কি আশা করা যায়? প্রতারক কোথাকার! তোমার মতো ধর্ষিতাকে বউ বানানোর চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেছি। আমার ওয়াইফের গ্রিন কার্ড আছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপ উড়াল দিবো। তারপর ওখানেই সেট।

রূপা একদম চুপ হয়ে গেছে। হিমেলের প্রত্যেকটা কথা খুব সময় নিয়ে তার মাথায় ঢুকছে। ধর্ষিতা, প্রতারক, আমার ওয়াইফ, গ্রিন কার্ড। সেই রাতে সে হিমেলকে ফোন দিয়েছিল। সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছিলো। তারপর হিমেল খুব যত্ন করে তার কল কেটে দিয়েছে। এখন বাকি সকলের মতোই তাকে ধর্ষিতা হিসেবে দেখছে। কি অদ্ভুত! মা ভাইয়ের সাথে সে প্রতারণা করেছে কার জন্য? এই হিমেলের জন্যই তো। রূপাকে তো সে কোনোদিন বলেনি, “আমার ওয়াইফ”। অথচ বিয়ের এই খেলাটা তাকে নিয়েই খেলেছে।
– আমার কি হবে হিমেল?
– কিছুই হবে না। ডাক্তারী পড়ছো। আজ নয়তো কাল ডাক্তার হয়েই যাবা। তারপর টাকা কামাবা, এনজয় করবা।
– আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়ে এখন তুমি হেয়ালি করছো? তোমার লজ্জা লাগছে না?
রূপার চোখ লালাভ হয়েছে। কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে না। হিমেলের উপর রাগ, নিজে করা কাজের আফসোস তাকে স্থির হতে দিচ্ছে না। সামনে তাকালে সে শুধু অন্ধকার দেখছে। এখন সে কি করবে?
– আসলে লজ্জা লাগছে না। শোনো। একটা কাজ বাকি আছে। আমি তোমাকে তালাক দিচ্ছি। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক। আর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো। চুপচাপ সই করে দিবা। হাঙ্গামা করতে চাইলে আমার কিছুই হবে না। কারণ ততদিনে আমি সাত সমুদ্র তের নদী ওপারে।
কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে চলে গেলো হিমেল। নিজের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির দিকে তাকালো রূপা। সে আসলে কিছুই দেখতে পারছে না। অশ্রুর আন্দোলনে তার দৃষ্টির পথ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কি অবলীলায় সবটা বলে গেলো হিমেল। কি অবলীলায়! কোনো সংকোচ নেই, অনুতাপ নেই। ভালোবাসা? সে তো আজ চাদের গাঁয়ের কলঙ্ক। কিচ্ছু না। দূর থেকেই সুন্দর। রূপা ভাবতে পারলো না তার সামনের দিনগুলো কেমন হবে। নিজের অবস্থান যাচাই করতে যেয়ে দেখলো সে সমাজের চোখে একজন ধর্ষিতা, নিজের কাছে একজন প্রতারক এবং ডিভোর্সী। বুকে চাপ বাড়ল রূপার। সামনের চেয়ারের দিকে তাকালো, যেখানে হিমেল বসে ছিল। সেটা এখন ফাঁকা। ঠিক তার জীবনের মত। নিজ উদ্যোগে এসে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদকে, অনুভূতিকে ঐ কফির মত নিঃশেষ করে দিয়ে মসৃণভাবে বিদায় নিল হিমেল। রূপাকে রেখে গেলো কংকর ঘেরা পথে। বিবেকের আয়নায় দাঁড়িয়ে আজ রূপা শুধু কলঙ্ক দেখলো। রূপা নামের মেয়েটার সেখানে কোনো অস্তিত্ব নেই। আছে শুধু কলঙ্কের পাহাড়।

চলমান।