#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২০
বাগানের মাঝে খুরপি হাতে বসে আছে ফাহাদ। পাশে রাখা বোতল থেকে তিন ঢোক পানি খেয়ে সেটাকে আবার আগের জায়গায় রেখে কাজ শুরু করলো। এই কাজটা বিগত কয়েকদিন ধরেই করছে সে। বাসাটা পাল্টানোর পর যখন এখানে বিশাল এক বাগানের মালিকানা তার হাতে এলো, মনটা সেদিন ছোট্ট নাবালকের মতোই খুশি হয়েছিল। বাড়িটা দোতলা। এক বৃদ্ধ দম্পতি উপরের তলায় থাকে, এ বাড়ির মালিক। তাদের ছেলেমেয়েরা এখন একেকজন একেক জায়গায়। মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ছেলে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বুড়ো বুড়ি এই পুরোনো বাড়ি, শ্যাওলা ওঠা মাঠের বাগান, ট্রাফিক জ্যামে ভরা রাস্তা ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তাদের কুচকানো চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে রাস্তার ধারের ঐ কৃষ্ণচূড়ার প্রতি মুগ্ধতা দেখা যায়। হাজার ঘটনার সাক্ষী ঐ চেহারা খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে গ্রীষ্মের দাবানলের মাঝে প্রথম বৃষ্টি দেখলে। এই নিটোল ভালোবাসা দেখে ফাহাদ অবাক হয়। কি গভীর ভালোবাসা হৃদয়ে লালন করে বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি ছেড়ে তারা এখানে থেকে গেছে। সেই ভালোবাসার সৌন্দর্য ঐ কৃষ্ণচূড়ার র-ক্তা-ভ থোকার চেয়েও সুন্দর, রাধাচূড়ার হলদে ফুলের চেয়েও অমলিন।
– কি ব্যাপার হে ফাহাদ? আছো কেমন?
পেছন ঘুরে বৃদ্ধ আমজাদ আলীকে দেখলো ফাহাদ। চমৎকার ব্যক্তিত্বের এক মানুষ। যার উপস্থিতিই পরিবেশ পাল্টে দিতে সক্ষম। বৃদ্ধের ঝলমলে হাসি ছোঁয়াচে হয়ে ফাহাদের ঠোঁটেও ধরা দিল। খুরপি রেখে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল,
– ভালো আছি দাদা। আলহামদুলিল্লাহ।
– কি সুন্দর করে যে তুমি আলহামদুলিল্লাহ বলো দাদাভাই! আমার মনটাই ভরে যায়।
সুন্দর করে হাসলো ফাহাদ। হাতের মাটি ঝেড়ে বলল,
– আপনার ফিটনেসের সিক্রেট টিপসটা আমাকে দিন দাদা। আপনার পাশে দাঁড়ালে নিজেকেই বুড়ো বুড়ো লাগে।
হো হো করে হেসে উঠলেন আমজাদ আলী। বয়স আশি ছুলেও তাকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। চোখে চশমা নেই, হাতে লাঠি নেই। সাদা পাঞ্জাবি যেনো তার চেহারায় পবিত্রতা ছড়ায়। বোঝাই যায় না এই মানুষটা কতোগুলো যুগ এই পৃথিবীতে কাটিয়েছে। সয়েছে কতো জঞ্জাল।
– সবই তোমার দাদীর হাতের কামাল। ভাগ্য করে একটা বউ পেয়েছি গো ভাই। এমন বউ পেতে কপাল লাগে।
ফাহাদ সায় জানালো। বৃদ্ধ আরো যোগ করলেন,
– এই পৃথিবীতে সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ কি বলো তো?
– সোনা। উম..না এখন তো প্লাটিনাম।
বৃদ্ধ আবারো হাসলো। ফাহাদের কাছে খুব ভালো লাগে যখন আমজাদ আলী এমন মন খুলে হাসেন। সচরাচর বয়স্ক ব্যক্তিদের দেখা যায় তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। কিন্তু আমজাদ আলী তার ব্যতিক্রম। বৃদ্ধের জীবনে যেনো দুঃখ বলতে কিছু নেই।
– ভুল জানো বোকা ছেলে। পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো একজন নেককার স্ত্রী। কে বলেছেন জানো? আমাদের নবীজী। কেনো বলেছেন বলো তো। দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি!
ফাহাদকে ভাবতে দেখা গেলো। কিছুক্ষণ পর সে বলল,
– ঠিক জানিনা দাদা। বলতে পারছি না।
– তোমার তো দেখি বুদ্ধি নাই। শোনো আমিই বলি।
বাগানের একপাশের আগাছা ছাঁটাই করছে ফাহাদ। সেখানেই বসে পড়লেন আমজাদ আলী। ফাহাদ নিজেও বসলো।
– নবীজী তো বলতে পারতেন সবচেয়ে মূল্যবান একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। কারণ তার শাসনে পুরো একটা দেশ ঠিক থাকবে। অথবা বলতে পারতেন একজন শিক্ষক যার মাধ্যমে একটা শিক্ষিত জাতি তৈরি হবে। কিন্তু তিনি বললেন নেককার স্ত্রী। আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। একজন স্ত্রী হলো একটা ঘর। সে নিজেই একটা আশ্রয়স্থল। স্ত্রীর স্বভাব যেমন হবে সেই ঘরের পরিবেশটাও তেমনই হবে। এখন ভাবো, একজন নেককার মহিলা যে কি না আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় সে নিশ্চয়ই একজন বদকার মহিলা থেকে ভিন্ন হবে। ভিন্ন হবে তার তৈরি করা আবহ। যার মাঝে প্রবেশ করলেই তুমি শান্তি পাবে। সেই শান্তিমাখা ঘর হবে একটা ইউনিট। একেকটা ইউনিট থেকে রত্ন তৈরি হবে। পুরো পৃথিবীটাই তখন রত্নে ছেয়ে যাবে।
বৃদ্ধ থামলেন। ফাহাদ মনোযোগী ছাত্রের মত তার কথা শুনছিল। না শুনেও উপায় নেই। আমজাদ আলী এক জীবনে হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। যে কাউকে ছাত্র বানিয়ে ফেলার দুর্লভ গুণ তার মাঝে বিদ্যমান। একটু পর তিনি আবারও বললেন,
– আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভেবে চিন্তে কাজ করে না। ভালোবাসা ভালোবাসা করে লাফায়। কেনো যে লাফায় সেটা আমি আজও বুঝলাম না। আমার দুইজন ছাত্র ছাত্রীর কথা তোমাকে বলি। তারা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে। পরিবারের কাছে বলেছে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। বাবা মাও আর বাধা দেয়নি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের মধ্যে অশান্তি দেখা দিলো। ভালোবাসা কোথায় থাকলো সেটা না জানলেও এটুকু জেনেছি যে তাদের মধ্যে শান্তির বড়ো অভাব। নিজেদের ভেতরে কোনো সম্মান নেই। সম্মান ছাড়া ভালোবাসা আর শান্তি ছাড়া সম্পর্ক দুটোই মাকাল ফল। দেখতে চকচক করলেও আসলে অন্তঃসারশূন্য।
ফাহাদ গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো। মনে পড়ল এক বন্ধুর কথা। নিজের সহপাঠী বান্ধবীকে বিয়ে করেছে সে। কি দারুন বোঝাপড়া ছিলো তাদের! কিন্তু হঠাৎ করেই কি হলো! একজন আরেকজনকে দেখতে পারে না। কেউ কাউকে শুনতে চায় না। সকলের সামনে কি ভাষায় কথা বলত! ফাহাদের মনে পড়ল, সেসব বাক্যে সম্মানের লেশ পর্যন্ত ছিলো না। সম্মানের হাত ধরে শান্তিও পালিয়েছে। সাথে নিয়ে গেছে সম্পর্কের শামিয়ানা। ফলে মানুষের সামনে তাদের ভেতরকার অবস্থা নগ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিলো। আমজাদ আলীর কথায় তার ভাবনার সুর কাটলো।
– বিয়ে থা নিশ্চয়ই করবে? যাকেই করো না কেনো সে তোমার জীবনে একটা শান্তির ঘর হতে পারে কি না এটা নিশ্চিত করে নিও। আর…
কথা শেষ করতে পারলেন না বৃদ্ধ। ভেতর থেকে স্ত্রীর ডাক শুনলেন। হাসিমুখে বললেন,
– আমার শান্তি আমাকে ডাকছে। এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আসি।
ফাহাদ তাকিয়ে দেখলো এক জীবন পার করে দেওয়া এক বৃদ্ধের দিকে। যে ছুটে চলেছে তার শান্তির আবাসে।
•• •• •• ••
হাতের পোড় খাওয়া জায়গাটা ভালো করে ব্যান্ডেজ করে গুছিয়ে নিলো রূপা। জামা বের করতে যেতে দেখলো আলমারিটা আজকে বেশ হালকা লাগছে। সাথে তার মনটাও। আলমারি থেকে জীবনে, সব জায়গায়, আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিমেলের স্মৃতিগুলো এক করে পু-ড়ি-য়ে দিয়েছে সে। কাজটা করেছে খুব ভোরে। তখনও অন্ধকারের চাদরে আলোর ছোঁয়া লাগেনি। সেই অন্ধকারেই আ-গু-ন নিয়ে নাড়াচাড়ার সময় হাত পুড়ে গেছে। নিজের হাতের দিকে তাকালো রূপা। এটা তার নিজের কাজের ফল। এমন অন্ধকারেই অন্ধ হয়ে আ-গু-ন নিয়ে খেলছিল সে। নিজের যৌবনকে তুলে দিয়েছিল জ্বলজ্বল করতে থাকা অগ্নির গণ্ডিতে। ফলস্বরূপ যৌবনসহ গোটা জীবনকে জ্বা-লি-য়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে সেই আ-গু-ন। তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দেখা গেলো তার মুখে। আ-গু-ন নিয়ে খেলবে অথচ পোড় খাবে না, নর্দমায় নামবে অথচ গায়ে কাদা লাগবে না এমনটা তো হয় না। উহু.. হয়ও নি। পাপের নদীতে সাঁতার কাটতে যেয়ে তার সর্বাঙ্গ কালি মাখা হয়ে গেছে। ডুবতে যেয়েও বেঁচে গেছে সে। এটাই সুযোগ। শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েই নিজেকে শুদ্ধ করতে উঠে পরে লেগেছে রূপা। পাপের কালিমা দুর করতে আশ্রয় নিয়েছে তওবার স্বচ্ছ জলের। কি অসাধারণ সেই পদ্ধতি!
রাস্তায় নামতেই মনে হলো মেঘ মাখা এই সকালটা উপভোগ করতে হেঁটে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। হুটহাট দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লেও ছাতাটাকে ব্যাগের এক কোণে ফেলে হাঁটতে শুরু করলো সে। হালকা ভেজা ফুটপাত জানান দিচ্ছে রাতে তার কাছে বৃষ্টিরা ধরা দিয়েছে। নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে তারা প্রকৃতি সাজিয়ে গেছে। নীরবে। কোনো আবেদন নেই, প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা নেই। গাছের জীবনের কষ্টদের ধুয়ে মুছে সেখানে সুখের ফুল ফোঁটায় তারা। কি অদ্ভুত! তার জীবনে কি তওবা এমন বৃষ্টি হতে পারে না? যে ফুল না ফোঁটাক অন্তত পাপগুলো ধুয়ে দিয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতেই এক পথশিশু তার সামনে আসে। খুব আকুতি নিয়ে পাঁচটা টাকা চায়। এক বেলা খেতে চাওয়ার কি অসহায় ইচ্ছে। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে টাকা দেয় রূপা। দেওয়ার সময় খেয়াল করে না কত টাকা দিয়েছে। তবে দেখতে পারে মেয়েটার বিস্মিত চাহনি। বিস্ময়ের সাথে সেখানে আনন্দের কি অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে! সেদিকে তাকিয়ে রূপার আর মন চায় না মেয়েটার হাতে রাখা নোটের দিকে তাকাতে। তবে মেয়েটা চলে যেতেই তার মাথায় টং করে শব্দ হয়ে ওঠে। যেই রব তাকে এক বেলা না খাইয়ে রাখে না, যেই রব না চাইতেও আসমার মত বন্ধু তাকে দিয়েছে, হিমেলের নাগপাশ থেকে বের করে দিয়েছে সেই রবের কাছে চাইলেও কি তিনি ক্ষমা ভিক্ষা দেবেন না? মনের গভীর থেকেই যেনো রূপাকে কেউ চিৎকার করে বলল, “কেনো দেবেন না? কি অদ্ভুত!”
চলমান।
#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২১
সবাই সাবলীল গতিতে এগিয়ে গেলেও রূপা সেটা পারছে না। বিগত দুয়েক মাসের পড়া জমে পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে সবাই একটা আইটেম দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচছে সেখানে তাকে মিস দেওয়া আইটেম, অ্যাসাইনমেন্ট, বর্তমান পড়া সবটাই চালু রাখতে হচ্ছে। রূপার হিমশিম খেয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। ফোস করে দম ছেড়ে বইয়ের উপর মাথাটা এলিয়ে দিল সে। লাইব্রেরীর পরিবেশটা বরাবরই নীরব থাকে। চারপাশে সারি সারি বইয়ের আবাস। রূপার ভালো লাগে নীরবে এই জায়গাটায় বসে থাকতে। রাজ্যের চিন্তাকে চৌকাঠের ওপাশে রেখে যখন বইয়ের সমাহারের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তখন রূপার সত্যিই ভালো লাগে। তবে এই ভালো লাগাটাও সে ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল নিজেকে। সব ভুলে যাকে পেতে চেয়েছে সে আজ তাকে ভুলে গিয়েছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে জলের একটা সরু ধারা পুরোনো নিউজ প্রিন্ট স্পর্শ করলো। আজ সকালেও কিছু মেয়ে তাকে টিজ করেছে। অবশ্য এটা এখন ডাল-ভাতের মত হয়ে গেছে। যারা তার আর হিমেলের সম্পর্ক সম্বন্ধে অবগত ছিলো তাদের মাঝের বেশিরভাগ মেয়েরা তাকে খোঁচা দিতে ছাড়ে না। নির্বিরোধী মানুষের মতো সেগুলো গলাধঃকরণ করে রূপা। এছাড়া আর সে কিই বা করতে পারে? কিন্তু ভয়ে ছিলো হিমেলের সাথে তার বিয়ের কথাটা যদি পাঁচকান হয় তাহলে তার আর বেঁচে থাকার উপায় থাকবে না। তবে সেটা হয়নি বলে স্বস্তি পেয়েছে। সম্ভবত বন্ধুর ভবিষ্যত মসৃণ করতে অতীতের উটকো ঝামেলা সামনে আনতে চায়না হিমেলের বন্ধুরা। যাক সেও বেশ। কিন্তু রূপার সাথেই এসব কেনো? কেনো এই ভালবাসার বিনিময়ে সে প্রতারণা পেলো? একইরকম ভালোবাসা কি সে পেতে পারতো না? কেনো তার সাথেই এমন হলো? ভাবনাগুলো একটু আগের ঔষধি বর্ণনার জায়গা সদর্পে দখল করে নিলো। মস্তিষ্কে এখন অ্যানেসথেসিয়ার কাজের বদলে হিমেলের কাজ ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবনার সুতো কখন জাল বুনে বিশাল হয়ে গেছে রূপা টেরটিও পায়নি। আসমা তখন এসে হাল ধরলো। লাইব্রেরীতে আর কেউ নেই। সবাই দুপুরের খাবার খেতে ক্যান্টিনের দিকে ছুটেছে। রূপাকে সেখানে না পেয়েই খুঁজতে এলো আসমা। বইয়ের উপর রাখা আসমার অশ্রুমাখা মুখ দেখে কিছু বুঝতে অসুবিধা হলো না। সন্তর্পনে তাকে ডাক দিলো।
– রূপা!
ফুঁপিয়ে উঠলো রূপা। আঁকড়ে ধরলো বান্ধবীকে। আসমা চারপাশে দেখলো। কেউ নেই। নিজেও রূপার পাশের চেয়ারে বসে পড়ল।
– পড়া কতদূর?
কান্নার কারণ তার জানা। বারবার শোনার দরকার নেই। সে চাইলো প্রসঙ্গ পাল্টাতে। কিন্তু রূপা চাইলো না।
– আমার সাথেই কেনো এমন হলো আসমা? আমি তো হিমেলকে সত্যি ভালোবেসেছিলাম, আমার মনটা ওকে দিয়েছিলাম। তাহলে কেনো আমার সাথেই এই প্রতারণা?
শান্ত চোখে রূপাকে দেখলো আসমা। এই পর্যন্ত সে রূপার কাজ নিয়ে কখনো খোঁচা দেয়নি। এমন কিছুই বলেনি যাতে রূপা কষ্ট পায়। কিন্তু মনে হচ্ছে এখন এই কথাগুলো বলে রূপা কষ্ট পাবে। পাক। অন্তত বুঝুক সে কি করেছে।
– মন নিয়ে নাড়াচাড়া করার আগে মন সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলি?
– মানে?
রূপার লালাভ মুখের দিকে তাকিয়ে আসমা বলল,
– মন সম্পর্কে জানিস? এটাকে কখন কিভাবে নাড়তে হবে, কাকে দিতে হবে? কখন মন ভাঙ্গে এসব সম্পর্কে মনের স্রষ্টার গাইডলাইন মেনেছিস?
– কি বলছিস এসব?
রূপার কান্নার গতি স্তিমিত হয়েছে। আসমা এটাই চাচ্ছিল। রূপা ঠান্ডা মাথায় তার কথাগুলো শুনুক।
– মন যে কাউকে দিয়েছিস দেওয়ার আগে ভেবেছিস এখানে মনের কারিগরের সম্মতি আছে নাকি?
– মনের উপর কি কারো হাত আছে? ভালোবাসা কি আয়োজন করে হয়?
– উহু! আয়োজন করে তো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। মনের উপর কারো হাত না থাকলেও উস্কানি আছে। এক দেখায় তুই হিমেলকে জান প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিস এটা আমি বিশ্বাস করি না।
– না। প্রথমে তো ওকে শুধু ভালো লেগেছিল।
– কাউকে ভালো লাগা অবশ্যই দোষের কিছু না। কিন্তু ভালো লাগা তখনই পরের ধাপে যাবে যখন মন উস্কানি পাবে। তুই মনের লাগাম টেনে ধরিসনি। তাকে বোঝাসনি এভাবে এদিক সেদিক যেতে নেই। যার ফলে মন মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে গেছে। তখন তুই এটাও ভাবিসনি মনের স্রষ্টার কাছে এটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য।
রূপা কোনো কথা বলল না। সম্ভবত বলার মত কিছু পেলো না। আসমা আবারো বলল,
– তুই একজনের কাছে নালিশ নিয়ে গেছিস কিন্তু তার দেওয়া কোনো নিয়ম তুই নালিশ করা কাজে মানিসনি তাহলে সে কি তোর নালিশ গ্রহণ করবে? বল।
– না।
– আল্লাহ পরপুরুষকে এভাবে মনে ঠাই দিতে বলেছেন? তাকে নিয়ে ভাবনার দুর রাজ্যে পাড়ি জমাতে অনুমতি দিয়েছেন?
– কিন্তু কাউকে ভালো লাগা কি অন্যায়?
– আগেই বললাম। অন্যায় হবে কেনো? কিন্তু যখন কাউকে ভালো লাগবে তাকে নিয়ে সিস্টেমেটিক ওয়েতে চিন্তা করতে হবে। তার সাথে তোর পরিবার জুড়বে কি না, সে একজন জীবনসঙ্গী হিসেবে কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক ভাবনা ভাবতে হবে। ঠাস করে কাউকে ভালো লাগবে আর ঠুস করে সম্পর্কে চলে যাবি এটা তো হলো না। ওহ্ বলা উচিত অবৈধ সম্পর্ক।
– আসমা!
রূপার আহত স্বর। আসমা গা করলো না।
– আমি কি কিছু ভুল বলেছি?
রূপা এ কথার উত্তর দিতে পারল না। বলল,
– কিন্তু হিমেল যেটা করেছে সেটা কি অন্যায় না?
– একশো ভাগ।
– এর বিচার হবে না?
– অবশ্যই। আল্লাহ আছেন কি জন্যে? কিন্তু তার সাথে মনে রাখ তুই নিজেও অন্যায় করেছিস। স্রষ্টার বিধান অমান্য করে কি তাঁর সিম্প্যাথি পাবি?
রূপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার অশ্রুর দাগ ততক্ষণে মুছে গেছে। আসমা নরম কণ্ঠে বলল,
– যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন আশ। আল্লাহ বলেছেন মুমিন ব্যক্তি কখনও আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। যে মানুষটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভোগে, তার রবের কাছে ফিরে যেতে চায় সে আল্লাহর কাছে কতোটা দামী তুই জানিস? কেনো এটা হলো না, ওটা হলো না এসব বাদ দে। নিজের গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চা। ক্ষমা চা। নিজের দিক থেকে ক্লিয়ার হয়ে যা। ইনশাআল্লাহ্ ঐ রবই তোর জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।
রূপা স্মিত হাসলো। মন এখন তার করে কাজের ফিরিস্তি বসিয়েছে। নিজেকে নিয়ে সেখানে গবেষণা চলছে। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার সময় কই?
•• •• •• ••
– আম্মা তো জব্বর ধরা ধরেছে ফাহাদ। কি করি বল তো?
– কি আর করবি? বিয়ে করে নে।
নীরব কিছু বলল না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে ফাহাদ বলল,
– মেয়েটাকে যে তোর পছন্দ হয়েছে এটা কিন্তু আমি জানি।
চমকালো না নীরব। তার মন পড়ার অভ্যাস এই ছেলের আছে।
– বিয়েটা করে নে। আর কতদিন ব্যাচেলর থাকবি?
– তুই বিয়ে করবি কবে?
হকচকিয়ে গেলো ফাহাদ।
– ধুর ধুর! আমার আবার কিসের বিয়ে?
– কেনো? জীবনে আর বিয়ে করার ইচ্ছা নেই?
– আহা! আমার কথা আসছে কেনো এখানে? তুই আন্টিকে বল ডেট ফাইনাল করতে।
– মজা করছি না ফাহাদ। দীপ্তি মা-রা গেছে কম দিন তো হয়নি। নিজেকে নিয়ে কি তোর এবার ভাবা উচিত না? এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে আর কতদিন?
– বিয়ে না করলেই মনে হচ্ছে মানুষ ছন্নছাড়া হয়ে যায়? মা তোকে ফোন দিয়ে এসব বলেছে না?
– আন্টি না বললেও আমি বলতাম। কি ভাবছিস আমাকে একটু খুলে বল তো।
পার্কের বেঞ্চিতে বসলো নীরব। ফাহাদকেও বসতে হলো। আশপাশে তাকালো ফাহাদ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। মুখে চিন্তাহীন নির্মল হাসি।
– কথা বল ফাহাদ।
– আমি আসলে এই সম্পর্কে কিছু চিন্তা করিনি।
– তো কর।
– করবো। আমার একটু সময় দরকার। তুই বিয়েটা করে নে নীরব।
ভাবনায় মজলো ফাহাদ। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে আমজাদ আলীর একটা কথা, “আমার শান্তি আমাকে ডাকছে। এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।”
চলমান।