রিটেক পর্ব-২৪+২৫

0
163

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৪

রেস্টুরেন্টের পরিবেশ উত্তেজিত। না এটা বিপদের উত্তেজনা নয়। আনন্দের উত্তেজনা। নীরবের চাচা এবং আসমার বাবা বিশাল গল্প ফেঁদে বসেছেন। আলিমা বেগম চোখে বিতৃষ্ণা নিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। স্ত্রীর দিকে তাকালে লোকটা বুঝতে পারতেন তার গল্পে মহিলা কিছুমাত্র খুশি হতে পারছেন না যদিও হবু বিয়াই হেসে রেস্টুরেন্টের ছাদ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। আসমা প্রচণ্ড লজ্জাবোধ করছে। নিয়মানুযায়ী তার লজ্জা পাওয়ারই কথা। তবে নিয়মের বাইরে যেয়ে যে নীরব নিজেও লজ্জা পাচ্ছে সেটা শুধু ফাহাদ বুঝলো। বন্ধুর চেহারা দেখে মিটিমিটি হাসলো সে। নীরব চোখ রাঙিয়ে তাকায়। চাপা গলায় বলে,
– হাসছিস কেনো?
– তুই রাগছিস কেনো?
– ফাজলামি করবি না ফাহাদ!
– রাগ করবি না নীরব!
রাগতে যেয়েও হেসে ফেলল নীরব। অনেক অনেকদিন পর ফাহাদকে আগের মত দেখে বুকে ভালো লাগার বাতাস বয়ে গেলো। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– কাহিনী কি মামা! বিয়ে আমার আর হাসতেছিস তুই।
– তেমন কিছু না। মনটা ভালো।
– কোনো বিশেষ কারণ?
– বলা যায়।
– বল শুনি কি সেই কারণ।
সামনের দিকে তাকালো ফাহাদ। রূপা তখন আসমার সাথে গুট গুট করে গল্প করছে। ফাহাদের দৃষ্টি অনুসরণ করলো নীরবও তাকালো। লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রূপাকে দেখে তার দুই ভ্রু-ই এবার উঁচু হলো। ফাহাদের দিকে তাকালো উত্তরের আশায়।
– চোখের সামনে ভালো কিছু হতে দেখলে তো ভালো লাগবেই।
– ভালো কিছু বলতে তো আমার বিয়েটাই হচ্ছে। আর কি দেখলি তুই?
– দুনিয়ায় তোর বিয়ে ছাড়াও আরো অনেক কিছুই হচ্ছে।
– শালা হেয়ালি করছিস ক্যান?
ফাহাদ বাইরের পুরো ঘটনা শোনালো। নীরব অদ্ভুত শব্দ করলো। প্রশ্রয়ের হাসি মুখে নিয়ে বলল,
– উমমম হুমমম! তলে তলে কি চলে মামা?
– ধুর কিছুই না!
ফাহাদ হাসিমুখে রূপার দিকে তাকালো। সেই মুহূর্তে তাকালো রূপা নিজেও। দৃষ্টি মিলতেই অস্বস্তিতে গাট হয়ে মেয়েটা চোখ সরিয়ে নিলো। আসমাকে বলল,
– এই আসমা! নীরব ভাইয়ের বন্ধুকে আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
রূপার ভাবুক মুখের দিকে তাকিয়ে আসমা হাসলো।
– চেনা মানুষকে তো চেনাই লাগবে।
– আমি কি তাকে চিনি নাকি?
– ভেবে দেখ।
– উফফ তুই বল না রে!
– কয়েকমাস আগে কক্সবাজার থেকে আমাদের হাসপাতালে একজন পেশেন্ট নিয়ে এসেছিলি মনে আছে?
– হ্যাঁ।
রূপার চোখে বিস্ময়।
– ফাহাদ ভাই তার হাজবেন্ড।
– উনি না মা-রা গেছেন?
– হ্যাঁ।
রূপার মুখটা কালো হয়ে গেলো। সেদিনের ঘটনাগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। স্ত্রীকে মৃ-ত ঘোষণা করার পর লোকটার চেহারা দেখে রূপার সত্যি অনেক খারাপ লেগেছিল। চোখে মায়া নিয়ে ফাহাদের দিকে তাকালো রূপা। মানুষের জীবনে কতরকম কষ্ট হতে পারে! সেই মুহূর্তে ফাহাদের সাথে চোখাচোখি হলেও দৃষ্টি সরালো না। স্মিত হাসির সাথে দৃষ্টির লেনদেনকে উস্কে দিল। কিন্তু মেয়েটা খেয়ালই করলো না কক্সবাজারের পুরো ঘটনা মনে পড়লেও হিমেলের স্মৃতি আর তার স্মরণে এলো না। যেনো হিমেলকে সে ভুলে গেছে। বেমালুম।

রেস্টুরেন্ট থেকে সকলে বিদায় নিলেও রূপার ব্যক্তিত্ব ফাহাদের মন থেকে বিদায় নিল না। ফাহাদের দুঃখমাখা মুখটাও গেঁথে রইলো রূপার নতুন স্মৃতিতে।

• • • • •

কলেজের লাইব্রেরীতে বসে ওরা কয়েকজন মিলে গ্রুপ স্টাডি করছিলো। আসমা,রূপা,কেয়া,অর্পি আর দুইজন। সকলে যখন একটা জটিল কেসের পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত সে সময় লাইব্রেরির দরোজায় কেউ রূপার নাম ধরে ডাকলো। সকলেই তাকালো সেদিকে। আসমা চট করে রূপার দিকে তাকালো। এই ছেলেটা সবসময় হিমেলের বার্তাবাহকের কাজ করেছে। তবে আজ এখানে কেনো? রূপা উঠে গেলে কথা না বাড়িয়ে সেও উঠলো। কেয়া এবং অর্পি কথার মোড় ঘোরালো যেনো বিষয়টা নিয়ে কেউ ঘাটানোর সুযোগ না পায়।

– বলুন।
– হিমেল স্যার এটা আপনাকে দিতে বলেছেন।
ছেলেটা ইতস্তত করে বলল। ডাক পিয়নের কাজ যেহেতু করেছে পোস্ট অফিসের খবরও তার জানা। এদিকের হালচাল যে খুব সুবিধার না সেটা বুঝতে হলে এমবিবিএস পাশ করতে হবে না। তার অস্বস্তির কারণ এটাই। কেনো যে হিমেল আবার তাকে এদিকে পাঠালো সে বুঝতে পারলো না। লোকটার তো বিয়ে হয়ে গেছে। তাহলে?
বাঁশপাতা রঙের খামটা খুললো রূপা। ছেলেটার চোখের আড়ালে ভেতরের কাগজের ভাঁজ খুললো। যেটা আশঙ্কা করছিলো সেটাই। হিমেল ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। আসমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় সেটা বোঝালে আসমা তাকে খালি একটা টেবিলে নিয়ে যায়। পেছন থেকে ছেলেটা বলে,
– ইয়ে.. স্যার এটা এখনই ফেরত দিতে বলেছেন।
শীতল কণ্ঠে রূপা বলল,
– দিচ্ছি।
টেবিলে কাগজ রাখলো রূপা। পুরোটাতে চোখ বুলিয়ে দেখলো নিচে হিমেলের সই করা। আজ কোনো দীর্ঘশ্বাস ফেললো না রূপা। যে সম্পর্ক কখনও গড়েই ওঠেনি সেটা ভাঙ্গা বিলাসিতা। তবুও সেই বিলাসিতাটুকুই আজ করবে রূপা। আগের টেবিলের দিকে তাকালে দেখলো অর্পি উৎসুক চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে ইশারায় কলম চাইলে ছুঁড়ে মারল অর্পি। খপ করে সেটা মুঠোয় ভরে নিলো রূপা। চোখ গরম করে অর্পির দিকে তাকালো কেয়া। মুখ খোলা কলমটা যেয়ে যদি চোখে লাগতো! অর্পি বিব্রত হলো। এতটা সে ভাবেনি। ততক্ষণে বিচ্ছেদনামায় নিজ নামের স্বাক্ষর করে ফেলেছে রূপা। কাগজটা পূর্বের মতোই ভাঁজ করে ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলো। আসমা নীরবে শুধু রূপাকে দেখে গেলো। বুঝতে চেষ্টা করলো তার মনের হাল।

• • • • •

টিউশনির টাকা পেয়েই শপিংয়ে চলে এসেছে রূপা। টিউশনিটা শুরু করেছে বেশিদিন হয়নি। নিজ ক্ষতের উপর অবুঝ মলম হিসেবে কাজ করছে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা মেয়েটা। সাথে বোনাস হিসেবে কিছু পয়সা। খারাপ না। আসমার বিয়ে ঠিক হয়েছে আগামী সপ্তাহে। বান্ধবীকে বিশেষ কিছু দিয়ে চমকে দিতে চায় রূপা। সেজন্য টাকাটা হাতে পেয়ে আর দেরি করেনি। খরচ হয়ে গেলে তখন আরেক ঝামেলা। লিফটের দরজা বন্ধ হতে দেখে চটপট ঢুকে পড়ল রূপা। ভেতরে আরো চার পাঁচজন আছে। হঠাৎই যেনো পাশে থাকা কয়েকজন লোক সরে যেয়ে জায়গা করে দিলো। হাঁফ ছাড়লো রূপা। লিফটে ঢুকে বুঝতে পেরেছিল এখানে ঢোকাটা উচিৎ হয়নি। ভিড় একটু বেশি। গায়ের সাথে গা লেগে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে জায়গা পেয়ে যাবে ভাবতে পারেনি সে। অবশ্য কিছু লোক আছে যারা মেয়েদের দেখলে স্বেচ্ছায় জায়গা ছেড়ে দেয়। তবে এমন লোকের সংখ্যা দিনকে দিন কমছে। বাড়ছে কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষ যারা সুযোগ পেলে রেহাই দেয় না দুই বছরের বাচ্চা মেয়েকেও। কিন্তু বোরখা পড়ার পর থেকেই একটা বিষয় তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মূল্যবান সম্পদ ঢেকে রাখাই বাঞ্ছনীয় সেখানে চোরের ভয় থাকুক অথবা না থাকুক।
পাঁচ তলায় উঠতেই লিফট থেকে বের হলো রূপা। কেউ যে পেছন থেকে তাকে লক্ষ্য করছে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না সে।
রূপা ভেবে এসেছে হালকা কাজ করা একটা শাড়ি নিবে আসমার জন্য। সাথে দিবে ছোট্ট একটা চিঠি। তবে শাড়ি বাছাই করতে যেয়ে বেশ বিপাকে পড়লো সে। সাদা, গোলাপী এবং হালকা সবুজ রঙের তিনটা শাড়ি তার পছন্দ হয়েছে। কোনটা যে নিবে বুঝতে পারল না রূপা। তখন নাটকীয়ভাবে ফাহাদের উপস্থিতি ঘটলো সেখানে। রূপা বেশ অনেকটাই চমকে গেলো।
– আরে! আপনি এখানে?
– বন্ধুর বিয়ে কি আপনার একারই নাকি? আমারও বন্ধুর বিয়ে। আমিও উপহার কিনতে এসেছি।
– ওহ আচ্ছা।
হালকা হাসলো রূপা। তবে নিজের দ্বিধা কিভাবে দূর করবে বুঝতে পারল না সে। ফাহাদ হয়তো রূপার হাতের দিকে তাকিয়ে সেটা বুঝলো।
– আপনি চাইলে আমি হেল্প করতে পারি।
– কি বিষয়ে?
রূপার কপালে ভাঁজ পড়ল।
– এই যে! শাড়ি সিলেকশনে।
এ যাবৎকালে শুনে এসেছে মেয়েরা এসব বিষয়ে ছেলেদের সাহায্য করে। তবে নিজের ক্ষেত্রে এর উল্টো হতে দেখে লজ্জা পেলো রূপা। সে কি মেয়েদের স্বভাবজাত গুণ হারিয়ে ফেলছে?
– আমি নীরবের জন্য একটা পাঞ্জাবি নিয়েছি। আপনার হাতের সাদা শাড়িটার সাথে বেশ মিল আছে।
হাতে থাকা সাদা পাঞ্জাবীটা খুলে দেখালো ফাহাদ। রূপা দেখলো সাদা রঙের পাঞ্জাবীর গলার কাছে গাঢ় নীল রঙের সুতার কাজ করা। হালকা কাজের মাঝে বেশ চমৎকার লাগছে। এবার নিজের হাতের শাড়িটার দিকে তাকালো। গাঢ় নীল পারের সাদা শাড়ি। মেয়েটা বেশ চমকেই গেলো। রূপার মুখ ভঙ্গি দেখে ফাহাদ বলল,
– দেখে কাপল সেট মনে হচ্ছে তাই না?
সবেগে মাথা উপর নিচ করলো রূপা। সত্যিই তাই। হাতের বাকি দুটো শাড়ি রেখে সাদা শাড়িটা নিয়ে রিসিপশনে চলে গেলো সে। তার পিছু পিছু ফাহাদ। রিসিপশনের মেয়েটা ভেবেছে তারা দুইজন বোধহয় একসাথে। দুটো জিনিস একসাথে নেওয়ার জন্য কিছু ছাড় পাওয়া গেলো। রূপা কিছু বলতে গেলেও ফাহাদ ইশারায় নিষেধ করলো। বের হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ফাহাদ বলল,
– যদি কিছু মনে না করেন, আরেকটা প্যাকেট দেয়া যাবে?
– অবশ্যই স্যার!
হাসিমুখে মেয়েটা শপিং মলের লোগো বসানো আরেকটা প্যাকেট দিলো। মলের এরিয়া থেকে বের হয়ে বাড়তি প্যাকেটে শাড়িটা ভরে রূপার দিকে বাড়িয়ে দিলো ফাহাদ। তবে রূপা টাকা দিতে গেলেই নাকচ করল সে। রূপা বলল,
– আজব! টাকা নেবেন না কেনো? তখন মেয়েটার সামনে তাই কিছু বলতে পারিনি। পুরো টাকা আপনিই দিলেন।
– পরে কোনো এক সময় দিয়েন।
– দেখুন! বিষয়টা আমার একদমই ভালো লাগছে না। আপনি সৌজন্যতা বোধ থেকে বলেছেন। কিন্তু আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার বান্ধবীর জন্য আমি উপহার কিনতে এসেছি সেখানে আপনি টাকা দেবেন কেনো? হয় টাকা আপনি নিন নাহলে শাড়ি রাখুন। পুরো সেট ধরেই আপনি দিয়ে দিয়েন।
বক্তব্যের পুরোটা সময় ফাহাদ চুপ ছিল। কাজটা সে ইচ্ছে করে করেছে। কেনো করেছে তার ব্যাখ্যা নিজের কাছেও পরিষ্কার না। তবে মেয়েটার স্পষ্ট কথা শুনে তার ভালো লাগলো। মুচকি হেসে টাকাটা নিয়ে বলল,
– বেশ নিলাম। এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই।
রূপা থতমত খেলো। আসলেই তো! এই লোকের সাথে যখনই দেখা হচ্ছে তখনই সে মেজাজ বিগড়ে ফেলছে। কেনো কে জানে। রূপা আর অপেক্ষা করল না। ফাহাদের থেকে বিদায় নিয়ে প্রস্থান নিলো।
ফাহাদ মেয়েটাকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিল। টাকার অফারে বর্তে যায় কি না সেটা দেখাই ছিলো উদ্দেশ্য। কিন্তু এই মেয়ে যে এমন শক্ত হবে সেটা তার সেদিনের ঘটনা থেকেই বোঝা উচিত ছিল। তবে কেনো সে রূপাকে পরীক্ষা করতে চাইলো সেটা নিজেও বুঝতে পারল না।

চলমান।

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৫

প্রতিবেশী এক মহিলা এসেছে কামরুন্নাহারের কাছে। অনেকক্ষণ ধরে খোশগল্প করে চলেছে। কামরুন্নাহার নিশ্চিত মহিলা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। দুইদিন পরপর এসে খোঁজ নেয়া মহিলা তিনি না। কামরুন্নাহারের বিরক্ত লাগছে। কি বলবি বলে যা না ভাই! এতো বানানো গল্পের কি দরকার?
– আমার বোনের মেয়ের বিয়ে হলো তো দুই মাস আগে। শুনেছেন না?
– জি শুনেছি।
– ওর এক চাচাত ভাসুর আছে বুঝলেন। অনেক টাকা পয়সা। কিন্তু বউটা টিকলো না। সমস্যা তেমন কিছু না। পুরুষ মানুষ তো মহিলা দেখলে একটু ছুকছুক করে। এইই। তা আমি ওদের আমাদের রূপার কথা বললাম। মেয়ের জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছে তো কি হয়েছে? ওখানে বিয়ে হলে একদম রাজরানী হয়ে থাকবে। আমার কাছে ছেলের ছবি আছে দেখবেন? দাঁড়ান দেখাই।
কামরুন্নাহার পাথর হয়ে বসে আছেন। রূপার জন্য কখনও এমন ছেলের প্রস্তাব আসবে তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। তার ডুবন্ত নৌকার হাল ধরলো রিমন। ঘর থেকে বের হতে হতে বলল,
– আমার বাবা ছিলো চরিত্রবান মানুষ। আমিও তার ছেলে হিসেবে আশেপাশেই আছি। আমার মা কখনো চরিত্রহীন মানুষের সংস্পর্শে যায়নি। ওসব মানুষের ছবি দেখানোর দরকার নেই আন্টি। মা! তমা কি বলে একটু শোনো তো।
কামরুন্নাহার ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। কান্নারা তার গলায় দলা পাকিয়ে আছে।
মহিলার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। সূক্ষ্ম খোঁচাটা হজম হতেই বললেন,
– তোমার এই বোনকে তুমি কোথায় বিয়ে দেবে?
– ভাগ্যে যেখানে আছে সেখানেই দেবো। তবে এটুকু জেনে রাখুন জেনেশুনে কোনো চরিত্রহীনের গলায় ঝোলাবো না। আসলে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা সাজে না।
– এমন পয়সাওয়ালা জামাই কই পাও আমি দেখব।
– এতোই যখন পছন্দ তাহলে আপনার মেয়েটাকে দিয়ে দিন না।
– বাজে কথা বলবে না। আমার মেয়ে কি ফেলনা নাকি যে এই ছেলের সাথে দেবো?
– সেলুকাস! আপনার মেয়ে রাজকন্যা আর আমার বোন কি? ঘুঁটেকুড়ুনি? দয়া করে এমন কাজ দ্বিতীয়বার করে সম্পর্ক নষ্ট করবেন না। আজকের মত আসুন।
দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলো রিমন। অপমানে লালচে মুখ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মহিলা।
দাঁতে দাঁত পিষলো রিমন। কয়েকটা খিস্তি আওড়ে ফেললো অজান্তেই।
পর্দার আড়াল থেকে সবটুকুই শুনলো রূপা। জল টলমল চোখে তার মনে পড়ল আজ সকালে পড়া একটা আয়াত,

“ব্যভিচারিনীকে ব্যভিচারী অথবা মুশরিক ব্যতীত কেউ বিয়ে করেনা।”

উঠে আসা কান্নটুকু সন্তর্পনে গিলে নিলো রূপা। নিজের পায়ে কু-ড়া-ল যেহেতু মে-রে-ছে আঘাতটুকু তো সইতেই হবে।

ক্লাস শেষ করে রাস্তায় নেমেছে রূপা। আজ সে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটবে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই যাবে। তবে সেই উদ্যম বেশিক্ষণ সজীব রইলো না। আধা ঘণ্টা একাধারে হাঁটার পরই ক্লান্ত বোধ করলো সে। গতকালের ঘটনা তখনও মাথায় গেঁথে রয়েছে পোকার কা-ম-ড়ের মতো। বিশাল বড় বটগাছের নিচে একটা বেঞ্চ পেয়ে চটপট সেখানে বসে পড়ল রূপা। একটু বিশ্রাম নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে তার বিশ্রাম নিস্তরঙ্গ হলো না। শান্ত নদীতে ঢিল দিলো এক শিশু। চোখ খুলে ছয় বছরের বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে বিরক্তই হলো রূপা। এদের জ্বা-লা-য় কোথাও শান্তিতে বসার উপায় নেই!
– আপা পাঁচটা ট্যাকা দ্যান। দুইদিন ধইরা কিছু খাইনা।
– হবে না।
শান্ত কণ্ঠে বলল রূপা। ভেবে পেলো না এরা সবসময় দুই দিনের কথাই কেনো বলে। আরো বেশিদিন নিশ্চয়ই না খেয়ে থাকে।
– দ্যান না আপা।
– বললাম তো হবে না।
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। রূপা চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে থাকলেও মেয়েটার উপস্থিতি বুঝতে পারছিল। চোখ খুলে গলায় যথাসম্ভব বিরক্তি ঢেলে বলল,
– যাচ্ছিস না কেনো?
– আপা দুইটা ট্যাকাই দ্যান..
কোনো এক কারণে হাত বাড়িয়েছিল মেয়েটা। রূপা ঝট করে সেই হাত ঝামটা দিয়ে ফেলে দিলো। গলারকন্ঠটা স্বর চড়িয়ে বলল,
– বলছি যে হবে না হবে না। কথা কানে যায় না?
মেয়েটা চুপ করে রইলো। এসব তার নিত্যদিনের ঘটনা। হতাশ হলে চলবে কেনো? আশপাশে তাকালো নতুন কোনো মানুষের আশায়। রূপা ততক্ষণে উঠে চলে গেছে। সামনে পাওয়া রিকশায় উঠে বসলো সে। তার বিরক্তি সীমা ছাড়িয়েছে। তবে কিছুদূর যেতেই হালকা বাতাসে মেজাজ ঠান্ডা হলো। বিরক্তিগুলো কর্পূরের মত উবে যেতেই বিড়বিড় করলো রূপা,
– কি চাড়ালের মত ব্যবহার করেছি! ছিহ!
হঠাৎ করেই রিকশাওয়ালাকে বলল,
– মামা গাড়িটা একটু ঘোরান। যেখান থেকে উঠলাম সেখানে একটু নামিয়ে দিয়ে আসুন প্লিজ।
যাত্রীর অনুরোধে রিকশা ঘোরালো লোকটা। বলল,
– কিছু রাইখা আসছেন নাকি আপা?
রূপা এ কথার উত্তর দিলো না। বেশিদূর এগোতে পারেনি সে। তাই ফেরত আসতেও সময় লাগলো না। নেমে পুরো ভাড়া মিটিয়ে দিলো। আশপাশে তাকালো মেয়েটার আশায়। কিন্তু সে কি আর বসে আছে! চারপাশে ছোট ছোট গলি আছে অনেকগুলো। রূপা বুঝলো না মেয়েটা কোনদিকে যেতে পারে। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বড় রাস্তা দিয়েই হাঁটতে থাকলো। মনে মনে দুয়া করলো,
– আল্লাহ মেয়েটারে পাওয়ায় দাও আল্লাহ। প্লিজ প্লিজ!
দুয়া কবুল হলো। কিছুদূর যেতেই দেখলো মেয়েটা বসে আছে। হাতে একটা বল। সম্ভবত এইমাত্র কুড়িয়ে পেয়েছে। সেটা নিয়ে খেলতে খেলতেই ক্ষুধা ভুলে গেছে। মেয়েটার কাছে যেয়ে তার হাত ধরলো রূপা। চমকে তাকালো বাচ্চাটা। তাকে আরো চমকে দিয়ে রূপা বলল,
– নাম কি?
– শেলী।
– শেলী! বিরিয়ানি খাবি?
শেলী উত্তর দেওয়ার আগেই তার হাত ধরে টেনে পাশের রেস্টুরেন্টে ঢুকলো রূপা। শেলী অবাক চোখে সবটা দেখছে। মোটামুটি স্বপ্নই লাগছে তার কাছে। কোনার দিকের টেবিলে বসে হাফ প্লেট বিরিয়ানি অর্ডার দিল রূপা। চটক ভাঙতেই শেলী বলল,
– ইয়ে আপা.. বাইত নিয়া যাই? একটা ছোট বইন আছে তো। ওরে রাইখা খাইতে মন চায় না।
ছোট্ট সরল আবদার। কিন্তু কথাটুকু শুনে রূপার মন চাইলো গলা ছেড়ে কাঁদতে। চোখের কোণে জমা সূক্ষ্ম অশ্রুবিন্দু মুছে সে বলল,
– আচ্ছা প্যাকেট করে দিতে বলছি।
ওয়েটারকে ফুল প্লেট প্যাকেট করে দিতে বলল রূপা। মেয়েটা দিকে ধ্যান দিলো সে। পড়নে লাল একটা ফ্রক। পায়জামার রংটা কোনো একদিন সাদা ছিলো। এখন সেটা ছাই রং হয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো। স্নেহের স্পর্শে কপাল থেকে চুল সরিয়ে রূপা বলল,
– কিসে পড়িস?
– ভিক্ষা কইরা সুময় পাই না। পড়ুম ক্যামনে?
ফিক করে হেসে ফেললো রূপা।
– বাড়িতে কে কে আছে?
– বাপ নাই। মা আছে। আর ছুটু বইন।
– মা কি করে?
– মায়ও ভিক্ষা করে।
– কাজ করবি শেলী?
– কি কাম?
– তা তো জানিনা। রাস্তার ধারে কি কাজ করা যায়?
ভাবুক দেখালো রূপাকে। শেলী বলল,
– ফুল, পানি, চা এডি বেচন যায়। কিন্তু ট্যাকার কাম। ট্যাকা তো নাই।
– আমি যদি তোকে এক হাজার টাকা দিই তাহলে কি তুই শুরু করতে পারবি?
– পাশশো দিলেই পারুম। আপনে দিবেন? সত্য?
বিরিয়ানি চলে এলে সেটা শেলীর হাতে দিলো রূপা। একটা আইস্ক্রিম আনতে বলে বিল মিটিয়ে দিলো।
– তুই যদি কথা দিস কাজ করবি তাহলে দিবো।
– আল্লাহর কসম কাম করুম। কাম থুইয়া মাইনষের লাত্থি খাইতে চায় কে?
শেলীর চোখ চকচক করছে। এমন লোভ কেউ তাকে দেখায়নি। কাজ করার লোভ, সম্মান বাঁচানোর লোভ। বাচ্চা মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য ম্লান মনে হলো রূপার কাছে। ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে বলল,
– তুই এই রাস্তায় কাজ করবি কেমন? আমি কিন্তু হঠাৎ একদিন চলে আসবো। এসে দেখবো কেমন কাজ করছিস। সুন্দর হলে আরো পাঁচশো পাবি। আচ্ছা?
– আইচ্ছা।
আইসক্রিম খেতে খেতে ঘাড় কাত করলো শেলী। তার ঠোঁটের উপর আইসক্রিম লেগে আছে। রূপার চোখে কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে!
– আপা! আপনের নাম কি?
– রূপা।
– আপনের নাম তো সুনা হওনের কাম আছিলো।
খিলখিল করে হেসে উঠলো রূপা।
শেলীকে বিদায় দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে গেলেই বাঁধার সম্মুখীন হলো সে।
– আপনি কি এভাবেই মানুষকে সরি বলেন নাকি? টেকনিকটা কিন্তু ইউনিক।
পেছন ঘুরে ফাহাদকে দেখে অবাক হলো রূপা।
– আপনি এখানে?
– ঐ যে আমার অফিস। আমার নিশ্চয়ই এখানে থাকার কথা। বাই দা ওয়ে! বললেন না তো?
– কি?
– এভাবেই সবাইকে সরি বলেন আপনি?
– কিভাবে?
– আমি কিন্তু পুরোটা দেখেছি। শেলীর হাত ঝাড়া দেওয়া থেকে বিজনেস আইডিয়া দেওয়া পর্যন্ত। এবং আপনার পেছনের সিটে বসে সবটা শুনেছিও।
কফি খেতে এসেছিল ফাহাদ। রেস্টুরেন্টের কাঁচের পর্দার আড়াল থেকে সবটাই দেখেছে সে। লজ্জা পেলো রূপা।
– না আসলে তেমন কিছু না।
কি বলা উচিত রূপা বুঝতে পারল না। তবে ফাহাদ বুঝলো। দেওয়াই যাদের প্রধান উদ্দেশ্য প্রচার তাদের কাছে বিব্রতকর। তাই সে রূপাকে বিব্রত করতে চাইলো না।
– এদিকে এসেছিলেন কি কোনো কাজে?
– না তেমন কোনো কাজ না। এমনিই। আচ্ছা আমি যাই তাহলে।
ফাহাদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ছুটে গেল রূপা। ফাহাদ তাকিয়ে রইলো বাতাসে দোল খেতে থাকা দরজার দিকে।

চলমান।