রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-২৪+২৫

0
2

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

২৪
সকাল ৬ঃ ৩৩। সাদাসিধা কলেজ ড্রেসে সকাল সকাল রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মায়া। বসন্তের হাল্কা উষ্ণ কুয়াশার আবির্ভাব কাটিয়ে পূর্ব আকাশের সূর্যের লাল ছ’টায় আলোয় আলোকিত পরিবেশ। চট্টগ্রাম মুরাদপুর আবাসিক এলাকা হওয়ায় সকালের পরিবেশটা বেশ শান্ত থাকে এখানকার। কোনো রুপ যান্ত্রিক বা মানুষের কোলাহল তেমন থাকে না সাতসকালে। ব্যস্ততা দেখা যায় একটু বেলা গড়ালে। যান্ত্রিক, পথযাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র- ছাত্রীদের যাতায়াত দেখা যায় আটটার মধ্যে। মায়া বাসা থেকে বের হয়েছিল আরও ভোরে। বলতে গেলে ছয়টার দিকে। বাসা থেকে এই পুরো রাস্তা হেঁটে আসতে মায়ার পনেরো মিনিট লাগল। বাকি সতেরো মিনিট ধরে সে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া হাতের ফাইলটা চেপে আশেপাশে তাকাল সচ্ছ চোখে। রাস্তার দু’পাশে দোকান পার্ট গুলো অনেক আগেই খুলে বসে আছে দোকানদারা। সকালের বেচা-কেনা চলছে সেখানে। রাস্তায় যান্ত্রিক গাড়ির চলাচলও ভালোই দেখা যাচ্ছে। এমন মধ্যে মায়া পশ্চিম পাশের রাস্তাটা ধরে ফুটপাতের কিনারায় দাঁড়িয়ে ঠিক রিদের বাবার অফিসের বিল্ডিংয়ের নিচে। কাল মায়া এই অফিসটায় রিদের সঙ্গে দেখা করেছিল। আর আজ সেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে মায়া, গোটা সতেরো মিনিট পার হয়ে আঠারো মিনিটে ঠেকল ওর অপেক্ষা প্রহর। রিদ কাল মায়াকে সকাল সকাল আসতে বলেছিল কিন্তু কখনো বলেছিল সেই সময়টা দেয়নি। সেজন্য মায়া সারারাত ছটফটে রাতের ঘুম হারাম করে, কাক ডাকা ভোরে উঠেই কলেজের জন্য একেবারে রেডি হয়ে চলে এসেছে এখানে। রিদের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে আবার সোজা কলেজের চলে যাবে এমনটা মনোস্থির করা। আজ মায়া শেষ পরীক্ষা। প্রযুক্তি পরীক্ষাটা দিলেই এই যাত্রায় শেষ হবে। বিগত দুই দিন ধরে মায়ার পরীক্ষা গুলো খারাপ যাচ্ছে নিখোঁজ স্বামীর চিন্তা। আজ স্বামীর খোঁজটা নিয়েই পরীক্ষাটা ভালো দিবে মায়া। এতো এতো চিন্তার মাঝে মায়া জুইকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই বেড়িয়েছে বাসা থেকে। আরিফও ঘুমে ছিল। দুজনের কাউকেই বলে আসেনি মায়া। এখন মায়াকে ওরা সকাল সকাল খোঁজলে কি হবে কি জানি? মায়া খোঁজে না পেলে নিশ্চয়ই টেনশন করবে? কিন্তু মায়া কাউকে বলে আসতে পারেনি। যদি বলে বের হতে চাইতো তাহলে জুই হাজারটা প্রশ্ন করতো মায়াকে। যার একটা উত্তরও আপাতত মায়ার কাছে নেই। আবার জুইয়ের সামনে মিথ্যা বলেও মায়া পার পায়না। জুই চট করে ধরে ফেলে মায়ার মিথ্যাটা। সেজন্য মায়া ইচ্ছা করেই জুইকে কিছু না জানিয়ে বেড়িয়েছে বাসা থেকে। তবে কলেজে গিয়ে না-হয় জুইকে কিছু একটা বলে বুঝিয়ে বলবে। আপাতত মায়া না-হয় চুপিসারে নিজের কাজটা শেষ করুক! তারপর না-হয় জুই বকা দিলেও শুনে নিবে ওহ। কিন্তু তারপরও কাজটা হোক। তাছাড়া মায়া ওদের বিল্ডিংয়ের পাহারাদার চাচাকে বলে এসেছে সে শ্রেয়াদের বাসায় যাচ্ছে। সেখান থেকে সোজা কলেজে চলে যাবে এমনটা আরিফ বা জুইকে বলতে যদি তাঁরা মায়ার খোঁজে আসে তো? মায়া মনে খানিকটা ভয় কাজ করলো নিজের দুঃসাহসিকতা নিয়ে। আশেপাশে জড়তায় মিইয়ে আবারও তাকাল। রাস্তার পথচারী অনেকই মায়া দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো মায়া এই অসময়ে কলেজে ড্রেসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকায় জন্য পথযাত্রীদের দৃষ্টির ভিড়ে সে। মায়া হাসফাস করলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে পরিচিত কাউকে দেখতে পায় কিনা তাই খোঁজল। যার কাছ থেকে রিদ বা আসিফের খোঁজ করবে এমন কাউকে খোঁজল। মায়া মনে হলো সে বোকামি করে ফেলেছে ভিতরকার অস্থিরতা চেপে রাখতে না পেরে এতো সকাল সকাল চলে আসাতে। মায়া ভাবলো সে কি করবে? চলে যাবে নাকি আরও কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? চলে গেলে তো আর বের হতে পারবে না, একেবারে কলেজের টাইম ছাড়া। তখন তো জুই, আরিফ ওরা দুজন মায়ার পাশে থাকবে। তখন আর রিদ খানের সঙ্গে মায়ার আলাদা দেখা হবে না। আর না ওর নিখোঁজ স্বামীর তথ্য নিতে পারবে! মায়া ভাবলো আপাতত যায় হোক না কেন? সে দাঁড়িয়েই থাকবে। যাবে না কোথাও। এবার মায়াকে যতো বাজে দেখায় তো দেখাক। অন্তত আসিফের সঙ্গে দেখা না করে যাবে না ওহ। মায়ার অযাচিত সময় আরও পাঁচ মিনিট কাটল দাঁড়িয়ে থেকে তারপর হুট করেই একই বিল্ডিং থেকে তাড়াহুড়ো নামল আসিফ। ফর্মাল গেইপে সে। কানে ফোন চেপে। হয়তো জরুরি আলাপ সারছে সে। তবে সিঁড়ি গোড়ায় আসতেই পাহারাদার একজন লোক বিল্ডিংয়ের গেইট টেনে
ধরতেই আসিফকে বের হতে দেখল মায়া। মূলত গেইটের শব্দে পিছনে ঘুরেছিল মায়া। যার জন্য আসিফের দৃষ্টি পরলো এদিকটায়। সকাল সকাল মায়াকে বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আসিফ দ্রুত কল কেটে এগোল সেদিকে। কয়েক কদমের দূরত্ব গুছিয়ে মায়াকে ডেকে বলল…

‘ আরে ভাবি আপনি এইখানে কি করেছেন? তাও এতো সকালে?

আসিফকে দেখে মায়া চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো খুশিতে। কিন্তু আসিফের মুখে ‘ভাবি’ ডাক শুনলো এমনটা মনে হলো মায়ার। প্রথমে অন্যমনস্ক হওয়ায় মায়া ‘ভাবি শব্দটা তেমন লক্ষ হয়নি। আবার হয়তো করেছে। কিন্তু আসিফের মতোন একজন লোক মায়াকে হুটহাট অবুঝের মতোন ভাবি ডাকবে এমনটা শুভা পায়না তাঁকে। আসিফ লোকটা ভালো। তাই মায়ার মনে হলো সে অযাচিত ভুল ডাক শুনেছে হয়তো। কিন্তু তারপরও মায়ার নিজের মনের সংশয় কাটাতে আসিফের করা প্রশ্নের উত্তরে সুন্দর হেঁসে শুধালো…

‘ আপনাদের কাছেই এসেছিলাম ভাইয়া। কাল রিদ ভাইয়া বলেছিল উনার সাথে সকালে দেখা করতে, সেজন্য আসলাম। আপনি তাড়াহুড়ো কোথায় যাচ্ছে ভাইয়া? কোনো কাজে?

ততক্ষণে আসিফ মায়ার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। ব্যস্ত গলায় বলল…

‘ জ্বি আপু! আমি আপনাদের কাজেই বাহিরে যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো আপনি চলে এসেছেন। রিদ ভাইকে আপনি তিন তলায় পাবেন। আপনি সিঁড়ি ধরে সোজা তিন তলায় চলে যান। এই বিল্ডিংয়টা ভাইদেরই। আপনি বরং উপরে যান।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে পিছনে ঘুরে আসিফ ততক্ষণে গেইটের পাহারাদারকে ডেকে উঁচু গলায় মায়াকে সিঁড়ি পথে এগিয়ে দেওয়ার জন্য আদেশ করল। মায়া দিকে ঘুরে মুখোমুখি হয়ে আসিফ বলল..

‘ আপনি যান আপু। দারোয়ান চাচা এগিয়ে দিবে।

মায়া একটু আমতাআমতা করে নিজের মনের অযাচিত প্রশ্নটা করেই ফেলল আসিফকে…

‘ আসলে ভাইয়া! আপনি কি আমায় একটু আগে ভাবি’ ডেকেছেন?

মায়ার কথার আমতা আমতা করে বোকা হাসল আসিফ। তখন তাড়াহুড়ো কি বলতে কি বলে ফেলেছিল লক্ষ করেনি আসিফ। মায়ার এখন প্রশ্ন করাতে টনক নড়লো। কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ না করে বরং অস্বীকার করল মায়ার কথার…

‘ না আপু। আপনি হয়তো ভুল শুনছেন।

আসিফের কথায় মায়া খানিকটা লজ্জা পরল। ওর অযাচিত প্রশ্নটা এইভাবে করা ঠিক হয়নি। সেজন্য সরি বলল আসিফকে….

‘ সরি ভাইয়া! আসলে আমার…

মায়ার কথা শেষ করতে দিল না আসিফ। এর মাঝেই কথা কেটে অধৈর্য গলা বলল আসিফ…

‘ ইট’স ওকে আপু। আমি কিছু মনে করেনি। আপনি উপরে যান।

কথাটা বলে আসিফ আর দাঁড়াল না মায়ার সামনে। পিছন ঘুরে উল্টো পথে চলল তাড়াহুড়ো। বলা যায় না বেফাঁস ভাবে আবারও না ভাবি ডেকে ফেললে মায়াকে। তখন রিদ ভাই ওকে আস্ত রাখবে না। মায়া বেশ কয়েক বার আসিফের পিছন ডাকল কিন্তু সে শুনলো না। বরং দ্রুত পা চালিয়ে বিল্ডিংয়ের অপর পাশের থাকা গ্যারেজ দিকে গেল। আপাতত গাড়ি নিয়ে রিদের বলা কাজ গুলো দ্রুত সারতে হবে নয়তো দেরি হলে রিদ ভাই আরও ক্ষেপে যাবে। তাছাড়া মায়া ও চলে এসেছে এতক্ষণে। এবার যদি আসিফ কাজ গুলো করতে দেরি করে তাহলে অবশ্যই শনি নাচবে ওর কপালে। মায়া হতাশায় আসিফের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরাল বিল্ডিংয়ের দিকে। পুরো মাথা উঁচু করে দেখল নাক উঁচু বিল্ডিংয়টা। এই বিল্ডিংয়টা কয় তলা হবে? মায়া গুণে দেখতে? বোকার মতো মায়া গুনে গুনে সাত তলায় গিয়ে ঠেকল। মায়া বুঝতে পারল পুরো বিল্ডিংটা সাত তলা। রিদ খান থাকেন তিন তলায়। মায়ার কি একা যাওয়া ঠিক হবে কোনো ছেলের বাসায় হুট করে? তাও এতো সাতসকালে? মায়া ভাবল রিদ খান কি আর একা থাকবে এই বাসায়? অবশ্যই তার পরিবারের কেউ না কেউ থাকতে পারে। রিদ খানের পরিবারকে তো মায়াকে চিনে। নতুন আত্মীয় হয় ওদের। মায়াকে এতো সকালে নিজেদের ফ্ল্যাটে দেখলে নিশ্চয়ই অবাক হবেন তাঁরা? মায়াকে প্রশ্ন করলে সে কি উত্তর দিবে তাদের? কি জন্য মায়া এগো সকালে এখানে এসেছে? সত্যিটা তো বলতে পারবে না। মিথ্যাই কিছু একটা বলতে হবে। ইতস্তত মায়া হাসফাস করলো। কি এক বিপদে পরলো মায়া নিজের নিখোঁজ স্বামীর খোঁজ করতে গিয়ে। জীবন যে কাজ করার ছিল না সেই কাজ গুলো আজকাল করে বেড়াচ্ছে মায়া। বুকের চাপা শ্বাস ছেড়ে মায়া দ্বিধায় নিয়েই বিল্ডিংয়ের ভিতরের দিকে হাঁটল। দারোয়ানের দেখানো সিঁড়ি ধরে সোজা তিন তলায় গিয়ে দাঁড়াল। বেশ হাসফাস করে জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট বেজাল। জড়তার হাতে বেশ সময় নিয়ে পরপর করিংবেল চাপলো। একবার! দুইবার! তিনবার! পরপর বেশ কয়েকবার করিংবেল চাপল একটু রয়েসয়ে। কিন্তু তারপরও কাউকে দরজা খুলতে না দেখে, মায়া এবার দ্বি-মনা করলো এতোবার করিংবেল চাপাতে। মায়ার মনে হলো সকাল বেলা হওয়ায় বাসার সবাই হয়তো এখনো ঘুমে। আর মায়া এই মূহুর্তে তাদের ঘুমের ডিস্টার্ব করছে এতোবার করিংবেল বাজিয়ে। মায়া মনোস্থির করে আর করিংবেল বাজাবে না। সেজন্য সুইচ বোর্ড হতে নিজের হাতটা গুটিয়ে নিতেই খট করে দরজা খুললো কেউ। তবে ওর সামনে দরজা নয় বরং পিছনের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রাশিভারি গলায় বলল…

‘ এদিকে আসো!

মায়া চমকে পিছনে তাকাল। দেখল রিদ দরজা ধরে ঘুমন্ত চেহারায়, এলোমেলো চুলে দাঁড়িয়ে। দেখে বুঝায় যাচ্ছে করিংবেলের চাপে সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে সে। মায়াকে এই মূহুর্তে দেখে রিদ আবাক হয়েছে কিনা তার চেহারা দেখে মায়া ঠাহর করতে পারল না। তাঁকে স্বাভাবিক মনে হলো মায়ার। তবে মায়া বেশ চমকিত রিদের এলোমেলো চুল আর ঘুম জড়ানো চেহারায়। মায়ার মনে হয় এই প্রথম সে রিদ খানকে দেখল সে গুছালো নয়, পরিপাটিও নয় বরং এলোমেলো এক সুন্দর পুরুষকে দেখল। যে দেখতে শুধু আকর্ষণী নয়। বরং বিপদ জনক মোহিত। মায়া বিবাহিত না হলে, বা স্বামী জন্য মায়ার মনটা না কাঁদলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই রিদ খানের এই রুপে গলে পরতো সে? তবে মায়া মানতে বাধ্য লোকটা আসলেই মাত্রাতিক সুন্দর আর নজরকারা সুদর্শন। রিদ মায়াকে ড্যাবড্যাব করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে দরজা ধরেই হাল্কা কপাল কুঁচকায়। মায়ার অপলক দৃষ্টি, ওর মনোভাব বুঝতে দেরি হলো না রিদের। স্বাভাবিক নেয় রিদ দরজা ছেড়ে ভিতরে দিকে যেতে যেতে মায়ার উদ্দেশ্য বলল…

‘ ভিতর থেকে দরজাটা লক করে দাও।

রিদ চলে যেতেই মায়ার টনক নড়লো। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলো রিদকে বেহায়া নজরে দেখায়। ছিঃ জীবনে সুন্দর ছেলে দেখেনি মায়া? এইভাবে কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়? লোকটা নিশ্চয়ই মায়াকে খারাপ ভাবছে? এমনই এই লোক মায়াকে খারাপ খারাপ প্রস্তাব দেয়। পরকীয়া করতে চাই। এখন মায়ার বেহায়া দৃষ্টিতে লোকটা নিশ্চয়ই মনে করবে মায়া তার রুপে গলে গিয়ে পরকীয়া সম্পর্কে রাজি হয়েছে? মায়া বেশ অসহায় মনে করলো নিজের ভাবনায়। আজকাল ওর নিজের সাথে কি হচ্ছে সেটাই ঠাহর করতে পারছে না সে। মায়ার মনে হচ্ছে ওহ অদৃশ্য কোথাও আটকে গেছে। কেউ ওর ফিলিংস নিয়ে খেলছে। কিন্তু কে? তা জানে না মায়া। আর এখানেই মায়া অসহায় হয়ে পরে। চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মায়া রিদের পিছন পিছন ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকল। রিদের কথা মতো দরজা লাগিয়ে পিছনে ঘুরতে চোখে পরলো ভিতরকার সাজানো গুছানো সুন্দর একটি ফ্ল্যাট। মায়া আবাক নেত্রে চারপাশে তাকাল। পুরো তিনতলা সমন্বয়ে এই ফ্ল্যাটটি তৈরি। এপাশ ওপাশ দুপাশ মিলিয়ে একটা ফ্ল্যাট এটা। যার জন্য মায়া তখন দুটো ফ্ল্যাট ভেবে বিপরীত পাশের দরজাটাতে করিংবেল চাপছিল। কিন্তু রিদ অপরদিকে দরজা খুলেছিল। প্রথমত বাহির থেকে কেউই বুঝতে পারবে না এখানে দুটো ফ্ল্যাট নয় বরং একটাতে গড়া। মায়া ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে চোখ ঘুরাল বিলাসিতায় ভরপিন্ড ফ্ল্যাটটি সৌন্দর্য্যের দিকে। এতো সাজানো গুছানো সুন্দর ফ্ল্যাটটিতে রিদকে ছাড়া আশেপাশে আর কাউকে চোখে পরলো না মায়া। মায়া চোখ যখন ফ্ল্যাটের আবিজাত্য মাপতে ব্যস্ত তখন রিদ মায়ার ধ্যান ভেঙ্গে পুনরায় বলল…

‘ এতো সকালে আসলে যে?

মায়া অল্প চমকে রিদের দিকে তাৎপর করে তাকাল জড়তার চোখে। জামাই খোঁজে দিশেহারা হয়ে থাকতে না পেরে সকাল সকাল আপনার কাছে চলে এসেছি তাঁর তথ্য নিতে এটা বলবে মায়া? এটা বললে নিশ্চয়ই রিদ খান মায়াকে পাগল-ছাগল মহিলা ভাববে। আবার জামাই পাগলও বলতে পারে ওকে। তখন বিষয়টা ভালো দেখাবে না বলে মায়া মিথ্যা বলে মিনমিন স্বরে বলল…

‘ কাল আপনি আমায় সকালে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু কয়টা আসবো সেটা বলেন নি। সেজন্য আন্দাজে এখন চলে আসসাম। আসলে একটু পর আমার তাড়া আছে তো তাই। আটটায় আমার পরীক্ষা আছে, সেজন্য এখন না আসলে পরে আর সময় পেতাম না।

দৃঢ় কন্ঠে বলল…
‘ কিন্তু আমার জানা মতে তোমার পরীক্ষার খাতা দেয় নয়টা পয়তাল্লিশে, আর শুরু হয় দশটায়। রাইট?

মিথ্যা বলে ধরা পরে যাওয়ার মায়া এবারও মিনমিন করলো। তারপর নিজের হয়ে গাই গুই করে ফের মিথ্যা বলে বলল…

‘ আমার আটটায় কলেজে একটা কাজ আছে। দ্রুত যেতে হবে বলেই এতো সকালে আসলাম।

রিদ নিজের এলোমেলো চুলে দু’হাতে ব্রাশ করে পিছনে ঠেলে দিতে দিতে চোখ উঁচিয়ে তাকাল দেয়াল ঘড়ির দিকে। ৬ঃ ৪২ বাজে! রিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে মায়াও সেদিকে তাকাল। রিদ জানে মায়া মিথ্যা বলছে। স্বামীর খোঁজে যে সকাল সকাল তার কাছে চলে এসেছে সেটাও বুঝল। তবে সে ধরা দিল না। এই মূহুর্তে ধরা দিলেই সমস্যা। এই মহিলা তখন রিদের সুন্দর একটা মূহুর্তে, দারুণ একটা প্ল্যানিংটা নষ্ট করে দিবে। রিদ ঘড়ির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফের মায়ার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। মায়াও তখন সবে দেয়াল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রিদের দিকে তাকিয়েছিল। দুজনের দৃষ্টি মিলাতে মায়া ইতস্ততায় নত মস্তিষ্কের হলো। জড়তার গলায় বলল…

‘ বাসায় আর কেউ নেই?

‘ আপাতত নেই।

মায়া চমকে রিদের দিকে তাকাল। সেকি মায়া কি ভুল করে একা একটি ছেলের ফ্ল্যাটে ঢুকে পরেছে? এখন কেউ ওদেরকে একত্রে দেখে নিলে কি হবে? নিশ্চয়ই মায়ার নামে বদনাম উঠবে দুই ছেলে-মেয়ে একা এক বাসায় থাকায়। তাছাড়া রিদ খান কেমন না কেমন চরিত্রের মায়াও ঠিকঠাক জানে না। যদি কোনো মেয়ে ঘটিত বিষয় আজ পযন্ত মায়ার জানাশুনা বা চোখের মধ্যে পরেনি কিছু। তারপর মায়া রিদ খানকে ভালো বলতে পারছে না। তার কারণ অন্যসব মেয়েদের সাথে রিদ খান কেমন তা জানা নেই, তবে মায়ার সাথে এই লোক ভিষণ খারাপ। মায়াকে উল্টাপাল্টা কথা বলে, পরকীয়া প্রস্তাব দেয়। হুটহাট কাছে চলে আসে, আবার বাজে ইঙ্গিতও দেয়। আবার গা ঘেঁষে বসেও পরে। এমন লোকের চরিত্র কি ভালো হবে? মায়ার জন্য রিস্ক না? মায়া ভাবলো দ্রুত সে রিদ থেকে তথ্য গুলো নিয়ে চলে যাবে। সেজন্য সোজা কথায় বলল…

‘ লোকটার খোঁজ পেয়েছেন?

‘ ব্ল্যাক কফি! চিনি ছাড়া। কিচেন ঐদিকে।

মায়ার কথার বিপরীতে রিদ কথাটা বলেই আঙ্গুল তুলে ফ্ল্যাটের কিচেনটা দেখাল। মায়া থেকে অনুমতি নয় বরং আদেশ করলো তাঁকে কফি করে দেওয়ার। রিদের কথার মাঝে মায়া তীব্র অধিকার বোধ মনে করলো। কিন্তু কিসের এতো অধিকার রিদের? সম্পর্কে বিয়াইন হয় বলে? হয়তো! তাছাড়া নতুন মেহমান বাসায় আসলে তাকে দিয়ে কেউ কাজ করায়? উল্টো রিদ খানের উচিত মেহমান হিসাবে মায়াকে চা-নাস্তা করে খাওয়ানো। সেই জায়গায় মায়া এই লোকের জন্য কফি করবে? মায়া আবাক হওয়া সুরে জানতে চাইল…

‘ আমি?

‘ প্রায় পনে সাতটা। এতো সকালে নিশ্চয়ই খেয়ে আসোনি? আপাতত দুজনের জন্য নাস্তা বানাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

আবাকে মায়ার চোয়াল ঝুল পরলো। একটা পর একটা অর্ডার? সেকি এই লোকে কাজের মহিলা হয় নাকি তার বউ যে এতো অধিকার দেখিয়ে অর্ডার করলো? মায়া হতবুদ্ধি হয়ে আওড়াল…

‘ এ্যাঁ?

‘ তৈলাক্ত খাবার পছন্দ না আমার। সাদামাটা কিছু বানাবে। !

নিজের কথা শেষ করেই রিদ ড্রয়িংরুম পার হয়ে নিজের রুমের দিকে গেল। রিদকে চলে যেতে দেখে মায়া তাড়াহুড়ো পিছন ডাকল রিদকে….

‘ আরে এই যে কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আমার কথাটা তো শুনুন? ঐ লোকটার খোঁজ পেয়েছেন আপনি?

রিদ মায়ার কথার উত্তর করলো না। বরং চলে যেতে যেতে নিজ বাক্যে বলল…

‘ কিচেনে সব রাখা আছে। চেক ইট!

মায়া রিদের চলে যাওয়ার দিকে বিস্ময়ে তাকাল। ভারি অদ্ভুত লোক। সাতসকালে ডেকে কাজের মহিলা বানিয়ে দিল? একবার মায়াকে পযন্ত করলো না সে আদৌও রান্না-টান্না পারে কিনা? মায়া রিদের চলে যাওয়ার দিকে আরও একবার তাকিয়ে হাতের পরীক্ষার সাদা ফাইলটা সোফা টেবিলের উপর রাখল। রিদের দেখনো কিচেনে ঢুকতে দৃষ্টি বিস্মিত হলো। বেশ বড়সড় আর সুন্দর গোছানো কিচেন। দেয়ালের ওয়াল-কেবিনেটের উপরে জায়গায় জায়গায় ছোট কাগজের টুকরো নাম লেখা কোথায় কোন জিনিস আছে। মায়া ভ্রু উঁচাল। বড়োলোকি কারবার সারবার। এই রিদ খানের আরও কয়টা বাড়ি আছে কে জানে? ঢাকা টু চট্টগ্রাম এই নিয়ে মায়া তিনটা বাড়িতে গেল মায়া। বজ্জাত লোক চট্টগ্রামে এসেও পরিবারের সাথে না থেকে এই খালি বাড়িতে পরে আছে। মায়া শুনেছে রিদ খান নাকি ঢাকার খান বাড়িতেও থাকেন না। আলাদা নিজের বাড়িতে থাকে। এই আলোকে কি এমন দুঃখ থাকতে পারে যে পরিবারের সাথে না থেকে আলাদা বাড়িতে থাকেন। হিংসুটে লোক। আসলে বেশি মানুষ পছন্দ করে না বলেই এমনই সমাজ-ছাড়া ছন্নছাড়া আলাদা থাকেন। এই লোকে বিয়ে করলেও হয়তো এমন বগুরে মেয়ে দেখে বিয়ে করবেন। যার মাথার তার ছিঁড়া হবে। সহজ ভাষা উল্টো বুঝবে। আল্লাহ জানা কোন মেয়ের কপাল ফাটাবে যার রিদ খানের মতোন ঘাড় ত্যাড়া মানুষ স্বামী হিসাবে জুটবে। মায়া তো এখনই রিদ খানের বউয়ের জন্য মায়া হচ্ছে।আহারে বেচারী!

সেল্ফ খুজে খুঁজে নুডলসের আয়োজন বের করল। অল্প ঝালে হাতে হাতে কাজ চালিয়ে নুডলস বানাল। মায়া জানা রিদ ঝাল খেতে পারে না একবার শুনেছিল। সেজন্য কম ঝালের আয়োজন করলো। আপাতত নুডলসের থেকে বেশি কিছু মায়া বানাতে পারবে না। কারণ অন্যের বাসায় এসে যা খুশি রান্না করা যায় না। বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাছাড়া কিছু রান্না করতে গেলে বেশ সময়ে প্রয়োজন দরকার যেটা আপাতত মায়ার হাতে কম। তাছাড়া মায়ার জলদি জলদি রিদের সঙ্গে কথা বলে বেড়িয়ে পরতে হবে বলেই। এতো সময় নিয়ে দুটো মানুষ একই ফ্ল্যাট দরজা লাগিয়ে থাকাটা ভালো দেখায় না। মায়া রান্না শেষ করে বড়ো বাটিতে নুডলস ঢেলে ডাইনিংয়ে রাখতে রাখতে রিদের রুমের দিকে উঁকি মারলো। দরজা এখনো বন্ধ। ছেলে মানুষ এতো কি আয়োজন করে ফ্রেশ হয় আল্লাহ জানে? মায়া নুডলস বাটি রেখে ফের কিচেনে গেল। রিদের জন্য ব্ল্যাককফি বানিয়ে ডাইনিংয়ে আসতে আসতে রিদের মুখোমুখি হলো। ততক্ষণে রিদ গোসল সেড়ে সাদা পাঞ্জাবি পরে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসল। একদম গোছানো আর পরিপাটি রিদ খান। সকালে ঘুম থেকে উঠা এলোমেলো রিদ খান নেই আর। মায়া রিদের দিকে তাকাতে তাকাতে হাতের কফিটা রিদের দিকে এগিয়ে দিল। রিদ কফিটা হাতে নিয়েই মায়ার দিকে তাকিয়ে চুমুক বসাল।

‘ এতো সকালে নুডলস খাব? নুডলস ছাড়া আর কিছু বানাতে পারো না

রিদের কথায় মায়া চেয়ারের পিছনে দাড়িয়ে মিনমিন করে বলল…

‘ পারি।
‘ তাহলে বানালে না কেন?
‘ অন্য কিছু বানাতে সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু আমাকে তো এখন চলে যেতে হবে। সেজন্য নুডলস ছাড়া আর কিছু দ্রুত বানাতে পারিনি।

রিদ কিছু বলল না মায়াকে। আপাতত কিছু বলার ইচ্ছা নেই তাঁর। মায়ার অন্য চিন্তা। কাজ সুন্দর ভাবে শেষ হলেই হয়। রিদ হাতের কফিটাতে চুমুক বসাতে বসাতে মায়ার উদ্দেশ্য বলল…

‘ প্লেটে সার্ভ করো!

মায়া চমকে গোল গোল চোখে তাকাল রিদের দিকে। আশ্চর্য মায়া এই লোকে বেড়ে খাওয়াবে কেন? এই লোকের কে হয় মায়া? কিছুই তো না! অথচ এমন অধিকার দেখাচ্ছে যেন মায়ার উপর সবথেকে বেশি অধিকার এই লোকের। আজব সামনে রাখা আছে অথচ মায়াকে বলছে বেড়ে খাওয়াতে। মায়া মনে মনে চাইলো রিদের মুখের উপর মানা করে দিবে। সে বলবে আমি আপনাকে বেড়ে-টেরে খাওয়াতে পারবো না। রেঁধে এনেছি এবার নিজের হাতে খেলে খান নয়তো খাওয়া লাগবে না। অথচ মনের কথা গুলো মায়া মনে বলতে পারলো না রিদের কাছে সাহায্য চেয়েছে বলে। মায়া যদি সামান্য বেড়ে খাওয়াতে মানা করে তাহলে রিদও মায়াকে ওর নিখোঁজ স্বামী তথ্য দিবে না বলে। মায়া বাধ্য হয়ে রিদকে প্লেটের নুডলস তুলে দিয়ে চামচ এগিয়ে দিল। রিদ নুডলসের প্লেটে চামচ দিতে দিতে মায়ার উদ্দেশ্য বলল…

‘ দ্রুত খাওয়া শেষ করো। মানুষ আসবে।
‘ কিসের মানুষ?

রিদের কথায় চমকে মায়া কথাটা বলল। রিদ তখনো মায়ার দিকে তাকাল না। সে ততক্ষণে নুডলস চামচে মুখে তুলে ফেলেছে। রিদের অল্প অল্প কথা মায়াকে মাঝেমধ্যে ভিষণ রাগ দেয়। মায়া উত্তেজনায় রিদকে ফের প্রশ্ন করবে তখনই দরজার করিংবেল বেজে উঠে আচানক। মায়া চমকে ভয়ার্ত মুখে দরজার দিকে তাকিয়ে রিদের দিকে তাকাল। লোকটার কোনো ভাবান্তর নেই। সে চুপচাপ খেয়েই যাচ্ছে। বাসা কে আসল? ওদের দুজনকে একত্রে দেখলে কি হবে সেটার টেনশনে মায়া ভয়ে অস্থির হলো। দরজার দিকে তাকিয়ে মায়া অস্থির চিত্তের বলল…

‘ কে জানি এসেছে? আমাদের দুজন দেখে যদি খারাপ ভাবে?

মায়ার কথায় রিদ বেশ বিরুক্ত হলেও মায়ার দিকে তাকাল না। বরং খেতে খেতে ভারি গলায় বলল…

‘ আসিফ হবে।
‘ সত্যি?

রিদ আর উত্তর করলো না। সে আপাতত খাবারটা শেষ করতে চাচ্ছে। পরপর করিংবেল বাজাতে মায়া ইতস্তততা করে দরজা খোলে দিল। চোখে পরলো কালকের সেই রাহাত ছেলেটি যে মায়াকে রাকিবের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। মায়া এই ছেলেকে সকাল সকাল রিদের ফ্ল্যাটের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়া ভয় পেল। যদি মায়াকে খারাপ মেয়ে ভেবে রাহাত রাকিবকে বলে দেয় তাহলে রাকিব ভাই নিশ্চয়ই আরিফকেও বলে দিবে। মায়া ভয়ার্ত মুখে রাহাতের হাসিহাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে ভীতু গলায় বলল…

‘ ভাইয়া আপনি?

রাহাতের ছটফট উত্তর আসলো তক্ষুনি। হাতের প্যাকেট গুলো মায়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ জ্বি ভাবি আমি। আসিফ ভাইয়া আপনাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। নিন।

মায়া ভয়ে ভয়ে খাবারের প্যাকেট গুলো হাতে নিতেই রাহাত তাড়া দেখিয়ে চলে যেতে যেতে বলল…

‘ আসি ভাবি। কিছু প্রয়োজন হলে ডাকবেন। আমি নিচেই আছি। আসসালামু আলাইকুম।

গমগমে পায়ে দ্রুত সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল রাহাত। মায়া সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক ছেলেটা মায়াকে খারাপ চোখে দেখেনি। ভয় কাটলো। মায়া দরজা লাগিয়ে ফের ডাইনিংয়ের আসল। হাতের প্যাকেট গুলো টেবিলে উপর রাখতে রাখতে বলল….

‘ আসিফ ভাই খাবার পাঠিয়েছেন আপনার জন্য। নিন।

কথা গুলো বলতে বলতে প্যাকেটের ভিতর হতে খাবার বক্স গুলো খুলে রিদের সামনে রাখল।

‘ আমার অলরেডি ডান। তুমি শেষ করো।

‘ সমস্যা নেই আমি ঠিক আছি। খাওয়া লাগবে না। আমি কলেজ গিয়ে কিছু খেয়ে নিব।

‘ ওকে।

রিদ বিরক্তি কন্ঠে কথাটা বলল। মায়া বেশ লজ্জিত হলো রিদকে এইভাবে বলতে দেখে। আরে মানুষতো দুই একবার এমনিতে সাধে খাওয়ার জন্য। অথচ এই লোক মায়াকে একবারও সাধলো না মায়ার না করাতে? মায়ার তো সত্যি ক্ষিদে পেয়েছে। মায়া লজ্জিত হয়ে যেতে নিতে রিদ পিছন ডেকে বলে…

‘ আমার কথা আছে বসো এখানে।

মায়া ভাবলো ওর স্বামীর বিষয়ে কিছু বলবে সেজন্য চেয়ার টেনে সঙ্গে সঙ্গে বসে পরলো রিদের পাশে। তীব্র আগ্রহ নিয়ে রিদের মুখের দিকে তাকাতেই রিদ একটা প্লেটে মায়ার জন্য আসিফের আনা খাবার বক্স গুলো থেকে খাবার তুলে বেড়ে মায়ার সামনে প্লেট রাখতে রাখতে বলল…

‘ নিসেন! আমি ফ্রীতে কিছু করি না। করা ইচ্ছাও নেই। মানবদরদী কিন্তু আমার বাবা আমি নয়। সেক্ষেত্রে বিনিময় ছাড়া কোনো কাজ আমার হাতে উঠে না। তোমার ক্ষেত্রেও তাই। আমার কাছে সাহায্য চেয়েছ আমি অবশ্যই করবো। কিন্তু তার বিনিময়ে আমাকে দিতে হবে। সোজা কথা বলতে গেলে একহাতে নিন, অন্যহাতে দিন। মানে হাতে হাতে সম্পর্কের বিষয়টা। কিন্তু তুমি আমার চাহিদা অনুযায়ী পারিশ্রমিক দিতে পারবে না কারণ তোমার কাছে এতো টাকা নেই। নাই থাকতে পারে। ছোট মানুষ তুমি। এতো টাকা থাকার কথাও না। সেজন্য আমি অফার করেছিলাম তোমার দুটো কিডনির থেকে একটা কিডনি আমাকে নিয়ে দিতে। আমি তা বিক্রি করে দু’লাখ এমনই পেতাম। কিন্তু তুমি তাতে রাজি নও কারণ তোমার ধারণা তুমি মরে গেলে তোমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে। আসলে এমনটা আমিও ধারণা বউ মারা গেলে স্বামী আরেকটা বিয়ে করায় উচিত। আচ্ছা যায় হোক! তুমি যখন তোমার একটা কিডনি দিতে না ইচ্ছুক নয় সেজন্য আমি ভাবলাম তোমার না-হয় তোমার স্বামীর একটা কিডনি ঢিল ডান করি। আমি তাঁকে খুঁজে পেলে তাঁর একটা কিডনি আমি রেখে দিব আমার পাওনাদার দু’লাখ টাকা দায়ে। এতে তুমিও মরবে না, তোমার সংসারে দ্বিতীয় নারী আসবে না। আমাদেরও পরকীয়া সম্পর্কটা থাকল। তবে ভয় নেই একটা কিডনি দিয়েও কিন্তু মানুষ বাঁচে অনেক বছর মরে না।

রিদের মুখে আবারও পরকীয়া প্রস্তাবটা পেয়ে মায়া নাক মুখ কুঁচকাল। দুনিয়াতে এতো সম্পর্কে থাকতে মায়া কেন এমন বাজে একটা প্রস্তাব দেয় মায়া বুঝে না। তারপর মায়া এখন গলা উঁচিয়ে রিদের সাথে তর্ক করতে চাইল না। যেহেতু রিদ এখন মায়াকে ডেকে নিশ্চয়ই কিছু বলবে। তাছাড়া কিডনি মায়ার যাক বা ওর স্বামীর একইতো কথা। লোকটাকে খোঁজে পেলেই তো হলো। মায়া রিদের কথা ঘাড় বেঁকে সম্মতি দিলো। মায়া সম্মতি দিতে দেখে রিদ একটা ভ্রু উঁচাল। নারী আসলে সব পারে। স্বামীর কিডনি তার অগোচরে পযন্ত বিক্রি করে দিতে পারবে তারপরও নিজের সংসারে পরনারী চায় না। রিদ মায়াকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে দেখতে পাশ থেকে টিস্যু তুলে মুখ মুছল। মায়ার উদ্দেশ্য একই ভঙ্গিতে বলল….

‘ আপনি ঘাড় বাঁকালে তো হবে না। ঢিল ইজ ঢিল! প্রসঙ্গটা আমার দু’লাখ টাকার বুঝলেন? টাকার লেনদেন নিয়ে আমি কাউকে বিশ্বাস করিনা। সেজন্য একটু পর আসিফ উকিল নিয়ে আসবে। কিছু কাগজপত্র আপনাকে দিবে সেগুলো সুন্দর করে সাইন করে দিবেন। কাগজগুলো হলো আমাদের মধ্যকার ঢিল হয়েছে সেটার প্রমাণ পত্র বুঝলেন। কাজ হওয়ার পরে আপনি যেন অস্বীকার করতে না পারেন সেজন্য কাগজ কলমে স্বাক্ষী আরকি। আরেকটা কথা উকিলের সাথে মনে হয় একজন কাজিও আসবে। আ…

রিদের কথার মাঝে অস্থির গলায় ফোঁড়ন কাটল মায়া….
‘ সেকি কাজি কেন?

‘ আগে আমাকে বলতে দেন। তারপর আপনি নিজে মুখ খুলবেন।
‘ সরি!
‘ আপনি বলেছিলেন আপনাদের বিয়ের কোনো সাক্ষী, বা প্রমাণ-টমান নেই। এমনকি কাবিননামা নেই। সব আগুন পুরে ছাই। আসলে আগুনে পুরে ছাই হলে কিন্তু বিয়েটা হয়েছিল সেটা কিন্তু আপনি নিজের মনে অস্বীকার করতে পারবেন না। যদিও মুখে অস্বীকার করেন তাহলে সেটা কিন্তু মহাপাপ হবে। সমাজ সত্যি মিথ্যা যাচাই পরে করবে। কিন্তু এক স্বামী রেখে অন্য স্বামীঘর করা কিন্তু ইসলামের নিষেধ। মহাপাপ বলে গণ্য। সেজন্য আমি আপনাকে মহাপাপ থেকে বাঁচাতে চাই বুঝলেন। শতহোক আপনি আমার সম্পর্কে আত্মীয় হোন। তারপর আপনি একজন ছোট মানুষ সেজন্য ভাবলাম আপাতত আমি না-হয় আপনার গার্ডিয়ান হয়ে কিছু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলাম। কি বলেন আমার দায়িত্ব নেওয়াতে আপনার সমস্যা আছে? আপনার ভালো জন্য বলছিলাম।

রিদের কথায় মায়া অসম্মতি জানায়। যাঁর অর্থ ওর কোনো সমস্যা নেই রিদ আপাতত ওর হয়ে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে। রিদের কুটনৈতিক বুদ্ধি জোর দেখা গেল তক্ষুনি। মায়াকে ফের নিজের কথা জ্বালে ফাঁসাতে ফাঁসাতে বলল…

‘ তো কাজির ব্যাপারে যেটা বলছিলাম। আসিফকে পাঠানো হয়েছে উকিল আর কাজি সাহেবকে আনতে। উকিল আমার জন্য আর কাজি সাহেব আপনার জন্য ডাকা হচ্ছে। উকিলের বিষয়টা হয়তো এতক্ষণ আপনি বুঝে গেছেন। আমার মধ্যকার ঢিলের জন্য কাগজপত্র নিয়ে আসবে। আর কাজি সাহেবকে আপনার জন্য ডাকা হয়েছে কারণ একটু পর আপনার বিয়ে হবে। সেটা রেকর্ড করা হবে। তবে বিয়েটা কিন্তু সত্যি না। মিথ্যা মিথ্যা একটা বিয়ের কাহিনী করতে হবে আরকি।

‘ বিয়ে? বিয়ে কেন?

‘ শুনেছি আপনার স্বামী নাকি অনেক ধূত ক্রিমিনাল মাইটের। খারাপ প্রকৃতির লোক। খালি নিজের স্বার্থ বুঝে। এমন ব্যক্তি কাছে আপনাদের বিয়ের মিথ্যা প্রমাণ যোগাড় করা কিন্তু কোনো ব্যাপার না। চাইলেই টাকা দিয়ে হাজারটা মিথ্যা প্রমাণ যোগাড় করতে পারবে। তবে আমার মনে হয়না সে এমন করবে। আমার মনে হয় সে আপনাদের বিয়েটা সমাজের সামনে অস্বীকার করে আপনাকে সারাজীবন ডিভোর্স না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখবে। তখন আপনি কিন্তু স্বামীকে ডিভোর্স না দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবেন না। আমাদের ধর্ম কিন্তু সেই স্বীকৃতি নেই। যদি সে আপনাকে মেনে নেই তাহলে তো সমস্যা নেই আমাদের এই রেকর্ডের বিয়েটার দরকার হবে না আর। কিন্তু যদি অস্বীকার করে তাহলে অন্তত আজকের বিয়ের রেকর্ডটা কোর্টে শুনিয়ে আপনার পরিবার ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করতে পারবে। তখন আপনার স্বামীর কিছু করার থাকবে না। কাজি যখন বিয়ে পড়াবে তখন সম্পূর্ণটা রেকর্ড করা হবে।

‘ কিন্তু বর ছাড়া একা একা কবুল বললে হবে? রেকর্ডে তো ছেলেমেয়ে দুজনের থাকতে হবে। আমি একা একা কবুল বললে ধরা পরে যাবো না?

‘ ভারি চিন্তা বিষয় তো? এই বিষয়টা আমার মাথায় আসেনি। আপনি একা কবুল বললে তো হবে না তাই না? যেহেতু প্রমাণে জন্য মিথ্যা বিয়েটা হচ্ছে সেহেতু ছেলে-মেয়ে দুজনের গলার আওয়াজ প্রয়োজন পরবে। কিন্তু এই মূহুর্তে ছেলে পাব কোথায়?

রিদ ভাবুক হওয়ার ভান করলো। মায়া খানিকটা ভেবে বলল…

‘ আসিফ ভাইয়াকে না-হয় বলুন আমাট সাথে মিথ্যা মিথ্যা কবুল বলতে।

মায়ার কথায় রিদ খানিকটা নড়েচড়ে বসল। তার সাজানো গুছানো সুন্দর প্ল্যানিংটাতে কিভাবে জল ঢেল দিতে চাইছে এই মহিলা। রিদ অসন্তুষ্ট গলায় বলল…

‘ আরে না আসিফকে দিয়ে হবে না। আসিফ থাক! আচ্ছা আমাকে দিয়ে হবে না? আপনার এই উপকারটা বরং আমিই করি। দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছি এতটুকু উপকার তো করায় যায়।

‘ আচ্ছা লোকটার তথ্য তো আমি জানি না তেমন। এখন বিয়েতে যদি উনার পরিচয় দরকার পরে তাহলে দিবো??

‘আপাতত আমার পরিচয় দিয়ে আপনার মিথ্যা বিয়েটা কমপ্লিট হবে। তারপর আপনার স্বামীর পরিচয় পেলে নতুন করে ভয়েস এডিটিং করে আমার নাম কেটে না-হয় আপনার স্বামী নাম ঠিকনা বসাবো হবে।

মায়া ঘাড় বাঁকা করে সম্মতি দিল। এই মূহুর্তে রিদকে মায়ার খারাপ মনে হচ্ছে না, বরং ভালোই মনে হচ্ছে। লোকটা মায়ার কতো বড়ো উপকার করতে চাইছে। মায়া বেশ ফুরফুরে মেজাজ নাস্তাটা শেষ করতেই আসিফ কাজি আর উকিল নিয়ে হাজির হলো। পিছন পিছন রাহাতের সঙ্গে রাফিন, সোহান নামক আরও দুটো ছেলে আসল রিদ ভাইয়ের বিয়েতে উপস্থিত থাকবে বলে। আবার দেখা যায় তাদের দুজনকে মায়ার পক্ষের সাক্ষী হতে। মায়া রিদের কুটনৈতিক বুদ্ধির খতিয়ান বুঝতে পারলো না। বরং রিদ মায়াকে ভুলবাল বুঝিয়ে সোফায় গিয়ে বসল দুজন। তাও দূরত্ব নিয়ে। উকিল সাহেব মায়ার দিকে বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দিতেই মায়া সুন্দর করে সাইন করে দিল, ওহ মনে করলো কাগজ গুলো ওদের চুক্তিপত্রের। মায়ার মুখোমুখি কাজি সাহেব বসা। তিনি মায়ার রেজিস্ট্রি পেপার সাইন করা পরপরই রিদ-মায়ার কাবিননামা এগিয়ে দিল। মায়া তাতেও সাইন করলো। কিন্তু বরের জায়গাটা খালি দেখে রিদের দিকে তাকাল এক পলক। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো দুজনের। রিদ পূর্ব থেকেই মায়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। মূলত মায়ার দিকে উপস্থিত সবাই তাকিয়ে। মায়া জড়তার জন্য সবার সামনে রিদকে প্রশ্ন করতে পারলো না যে কাবিননামায় বরের জায়গাটায় কে সাইন করবে সেটা? মায়া কাবিননামা সাইন করে কলমটা রাখল। কাজি সাহেব রিদের দিকে একই কাবিননামা এগিয়ে দিতে চাইলে রিদ হাতের ইশারা থামতে বলে উনাকে। রিদ পরে সাইন করবে এমনটা হাতের ইশারায় বুঝাতেই কাজি সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। কাজির সাহেব রিদের নাম, তার বাবার নাম নিয়ে বিয়েটা পুড়ানোর শুরু করলে আসিফ রিদের ফোনের রেকর্ড অন করে টেবিলে সামনে রাখল। পুরো বিয়েটা রেকর্ড করার মধ্যে দিয়েই সম্পূর্ণ হলো। মায়া বুঝলই না কোনো মিথ্যা বিয়ে-টিয়ে নয় বরং সত্যিকার শক্তপোক্ত ভাবে আবারও একবার বিয়ে হলো দুজনের। মায়া মনে করলো রিদ ওকে উপকার করেছে। বিশাল বড় উপকার। কিন্তু মায়া ঘুণাক্ষণে টের পেল না সেই উপকারী মানুষটা আবারও একবার ওর স্বামী হয়ে বসে আছে। দুজনের বিয়ে শেষ হতেই রিদ আসিফকে দিয়ে মায়াকে কলেজ পাঠাল। তারপর সে কাবিননামা সাইন করে সবাইকে বিদায় জানাল। বিয়ের ডকুমেন্ট হিসাবে প্রত্যেকের কাগজ তার কাছে একটা করে কপি রাখল। রিদ তীক্ষ্ণ নজরে সেগুলো পরখ করতে লাগল কফিতে চুমুক দিতে দিতে। তার হাতের এই কফিটা মায়াই বানিয়েছিল যাওয়ার আগে। সে বলেছিল মায়াকে চলে যাওয়ার আগে রিদকে আরও একটা কফি করে দিতে। মায়া বিনা কথা করেও দিয়েছে। রিদ সূক্ষ্ম নজরে বিয়ে রেজিস্ট্রি পেপার গুলো দেখতে লাগলো বারবার। কাল মায়া কথা গুলো রিদকে ঐভাবে না বললে আজ হয়তো রিদ কখনোই বিয়েটা করতো না। কাল মায়া রিদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে ছিল তার কাছে কোনো স্বাক্ষ প্রমাণ নেই দুজনার বিয়ের। আসলেই ছিল না। রিদ কোনো ভাবেই বিয়েটা হয়েছিল বলে এমনটা প্রমাণ করতে পারতো। সেজন্য তোরজোড় করে আজকে বিয়েটা করে নিল রিদ। এখন রিদের কাছে প্রমাণ আর প্রমাণ। রিদ সূক্ষ্ম চোখে আরও একবার কাগজ গুলোয় বুলাল। তার বউ বোকা হলেও মাঝেমধ্যে কাজের কথা বলে বেড়ায়। তাঁকে বিয়ের আইডিয়া দেওয়াটা জোস ছিল।

#চলিত….

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

২৫
[ কপি করা নিষেধ ]
কলেজে ঢুকতে ঢুকতে মায়ার নয়টা বেজে গেল। আসিফ রিদের গাড়ি করে মায়াকে এইটুকু পথ দিয়ে গেল। এতক্ষণে কলেজে বেশ ভালোই আনাগোনা হয়েছে স্টুডেন্টের। জুই এখনো কলেজে আসেনি হয়তো একটু পর আসবে। তবে শ্রেয়াকে দেখা গেল কলেজে চত্বরেই। আবাক চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে ছিল সে। হয়তো বুঝার চেষ্টা করছিল মায়া রিদের গাড়িতে কিভাবে আসল? মায়া প্রথমে বুঝল না শ্রেয়ার দৃষ্টির কারণ কিন্তু তারপরে ঠিকই বুঝল যখন শ্রেয়া মায়াকে এই নিয়ে প্রশ্ন করলো সে কিভাবে রিদের গাড়িতে আসল? মায়া খুব স্বাভাবিক নেয় জানালো সে রিদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সেজন্য রিদের গাড়িতে করে আসা। তবে মায়া বিস্তারিত ভেঙ্গে না বললে শ্রেয়াও বিস্তারিত জানার আগ্রহ দেখাল না। বরং শ্রেয়া যেটা জানার আগ্রহ দেখাল সেটা হলো…

‘ তোর রিদ ভাইকে কেমন লাগে মায়া??

দুই বান্ধবী কলেজ ভবনের দ্বি-তলায় করিডোরে দাঁড়িয়ে। পরীক্ষা দশটায়। জলদি আসায় তাই আপাতত ক্লাসে সামনে দাঁড়িয়ে। শ্রেয়ার কথায় মায়া করিডোরের রেলিঙের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শ্রেয়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। লহাময় গলায় শ্রেয়ার প্রশ্নটা শুধরিয়ে জানতে চাইল….

‘ কেমন লাগে মানে কি? কি বুঝাতে চাইছিস ঠিকঠাক প্রশ্ন কর। তারপর না-হয় উত্তরটা আশা করিস।

মায়া কথায় কিঞ্চিৎ বিরক্তি হলো শ্রেয়া। তারপরও মায়ার বুঝাতে চেয়ে বলল….

‘ ঠিকঠাক প্রশ্নই তো করলাম। ছেলে হিসাবে রিদ ভাইকে তোর কেমন লাগে?

শ্রেয়ার প্রশ্নে মায়ার কুঞ্জিত কপালের ভাঁজ শীতল হয়। বেশ অবজ্ঞা করেই বলল…

‘ কেমন আবার লাগবে? আট-দশটা ঠিকঠাক মানুষের মতোন লাগে। তবে উনার রাগ, অহংকার, সাথে সাথে লোকটা একটু বেশি সুন্দর। এতো সুন্দর মানুষের বউ গুলোর কপাল খারাপ হয় বুঝলি। সুন্দর পুরুষ গুলা বউকে ভালোবাসতে চাই না। কারণ তাদের নিজের রুপের অহংকারই শেষ হয়না, সেখানে বউদের রুপ তো ডাল ভাত বুঝলি? এই সুন্দর পুরুষ গুলার বাহিরে নজর বেশি থাকে। বিয়ের পর পরকীয়া সম্পর্ক কিন্তু এদের দিয়েই হয়। যদি সবটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। তবে এই কারণে আমার সুন্দর পুরুষে এলার্জি! সহ্য হয়না। আমি-তো নিজের জন্য পারফেক্ট কালো পুরুষই নির্বাচন করবো। যে আমার রুপে প্রশংসা করতে করতে পঞ্চমুখ থাকবে। সারাজীবন আমার আঁচল ধরে ঘুরবে আর বলবে ‘বউ আমাকে একটু ভালোবাসতো। দেখো তোমার ভালোবাসায় আমি কাঙ্গাল হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। ভালোবাসায় এতো কৃপণতা করলে চলে বলো? তারপর যেদিন আমি একটু রাগ-টাগ দেখাব, সেদিন সে এসে বলল, ‘বউ ধরো-তো এই পড়া পানিটা খাও! পীরবাবা থেকে এনেছি তোমার জন্য। এই পড়াপানিটা খেলেই তুমি আর রাগ-টাগ করবে না, বরং আমাকে বেশি বেশি ভালোবাসাবে! এটা ভালোবাসা-বাসির পড়াপানি। তুমি বরং খাও খাও!

মায়ার ব্যক্তিগত মতামত আর স্বামীকে নিয়ে অদ্ভুত সব কথা-বার্তায় হতভম্ব হয়ে শ্রেয়া বলে…

‘ ভালোবাসা জন্যও বুঝি কেউ পড়া পানি খাওয়ায়? এটাও সম্ভব বুঝি?

মায়ার দৃঢ় গলার উত্তর আসল তক্ষুনি…

‘ অবশ্যই সম্ভব! সৌলমেট বুঝিস? বিবাহিত জীবনের যারা সৌলমেট পায় তাদের দেখবি এমন ছোটবড় সব পাগলামোই করে বেড়ায় পার্টনাদের জন্য। তাই আমিও আল্লাহ কাছে নিজের জন্য একটা সৌলমেট চায়। সে যেমনই হোক কিন্তু আমার সৌলমেট হোক। আমার বিশ্বাস আমি পাবো। আর সেজন্য সৌলমেট হিসাবে নিজের জন্য একটা কালো ছেলেকে চায়। নয়তো দেখা যাবে, রিদ খানের মতোন সুন্দর কোনো পুরুষ যদি স্বামী হিসাবে কপালে জুটে তখন জামাই আমার পিছনে পিছনে নয় বরং আমি জামাইর পিছনে পিছনে পীরবাবার পড়া পানি নিয়ে ঘুরতে হবে তার ভালোবাসা বাড়ানোর আশায় বুঝলি।

মায়ার চিন্তা ভাবনার ধরণ সবসময় সবার থেকে অদ্ভুত হয়। যেখানে সবাই নিজের জন্য পারফেক্ট রিদ খানের মতোন জামাই চায় সেখানে মায়া এমন ভাবে রিদকে অবজ্ঞা করছে যেন রিদ সুন্দর হয়ে পাপ করে ফেলেছে। মায়ার মতে রিদের মতোন তুচ্ছ জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। শ্রেয়া আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল…

‘ আচ্ছা ধর! যদি তোর নিখোঁজ জামাই কোনো ভাবে রিদ ভাইয়ের মতোন সুন্দর কোনো পুরুষ হয় তাহলে কি করবি?

শ্রেয়ার কথায় মায়া আবারও দৃঢ়তা দেখিয়ে বলল…

‘ উহুম হবে না! আমার জামাই রিদ খানের মতোন এতো সুন্দর হবে না। লোকটাকে আমি সেদিন রাতের আধারে যদিও এতো দেখিনি, তবে আমি গ্যারান্টি, ওয়ারেন্টিসহ দিয়ে বলতে পারি সে এতো সুন্দর হবে না। আমার জামাই লম্বা-সম্বা বলিষ্ঠবান কালো কোনো পুরুষ মানুষ হবে দেখিস। একদম আমার মন মতোন।

মায়া কথায় খানিকটা অসন্তুষ্টি গলা ঝাললো শ্রেয়া। বিরক্তি নিয়ে বলল…

‘ না দেখে এমন গ্যারান্টি ওয়ারেন্টি দিচ্ছিস কিভাবে তুই? যদি সত্যি সত্যি সে রিদের মতোন সুন্দর কোনো পুরুষ হয় তাহলে কি করবি? জামাই সুন্দর বলে ছেড়ে দিবি হ্যাঁ?

এবার মায়ার গলার দৃঢ়তা নুইয়ে আসল। কণ্ঠ খাদে এনে বলল…

‘ এমন ছোটখাটো বিষয়ে জামাই ছাড়লে হবে বল? শত হলেও বউ হয় আমি তাঁর। দায়িত্ব নিয়ে বেশি বেশি পীরবাবা পড়া পানি খাওয়াব আমি এই আরকি।

স্বামীর প্রসঙ্গ আসতে মায়া কেমন গলে গিয়ে পল্টি নিল কথায় কথায়। মায়া কথায় একটা অন্ধ লোকও বলে দিতে পারবে মায়া ওর স্বামীকে কতোটা চায়। আচ্ছা যদি কখনো এমন হয় যে মায়ার ভালোবাসা স্বামী, মায়ারই কোনো অপছন্দের মানুষ বের হলো তখন কি একই ভালোবাসা থাকবে মায়া? যেমনটা এখন দেখাচ্ছে স্বামী জন্য? শ্রেয়ার মনে বেশ কৌতূহল জাগল। আচ্ছা মায়া তো রিদ ভাইকে অপছন্দ করে তাহলে শ্রেয়া কি রিদ ভাইকে দিয়ে একটা উদাহরণ দিবে মায়াকে? মায়া কি উত্তর দেয় অন্তত জানতে পারবে শ্রেয়া…

‘ আচ্ছা মায়া এমনই ধর! জাস্ট কথার কথা জিগ্যেস করছি হ্যাঁ? যদি এমন হয় তোর নিখোঁজ স্বামী কোনো ভাবে তোর অপছন্দের রিদ খান বের হলো, তাহলে তুই কি করবি এটা জানার পর?

মায়া ভাবল না এক মূহুর্ত। চট করে উত্তর দিয়ে বলল…

‘ প্রথমত সে হবে না, নো চান্স! তারপরও যদি মনে করতে বলিস তাহলে যেটা স্বাভাবিক সেটাই করবো বিচ্ছেদ।

‘ মানে তালাক?
‘ হ্যাঁ।
‘ তুই যে এখন এতো ভালোবাসিস সেটা?
‘ ভুলে যাব।
‘ যদি ভাই ছাড়তে না চায়?
‘ ছাড়িয়ে নিব।
‘ তারপর ভাইয়ের সাথে থাকবি না?
‘ না!

মায়া দৃঢ় গলা কথায় শ্রেয়া বুঝতে পারে মায়ার আসলেই রিদকে পছন্দ না। কোনো ভাবেই না। এজন্য অযৌক্তিক ভাবে রিদ ভাইয়ের উদাহরণটা দেওয়াটা হয়তো শ্রেয়ার ঠিক হয়নি। শ্রেয়া বলল…

‘ তোর এতো অপছন্দ কেন রিদ ভাইকে?

‘ তাঁকে অপছন্দ করার অনেক গুলো কারণ আছে। তারমধ্যে একটা হলো রিদ খান কখনো আমার ব্যক্তিগত ঐ মানুষটা হিসাবে আমার কল্পনাতে আসেনি।

শ্রেয়া বেশ হেঁসেই উড়িয়ে দেওয়ার মতোন করে মায়ার পাশ ঘেঁষে করিডোরে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল…

‘ তোর রিদ ভাইকে পছন্দ না। অথচ আমি তার কার্জিন হয়। আমার চোখের দেখা কতো মেয়ে যে, রিদ ভাইয়ের জন্য মুখিয়ে থাকে। আমি স্কুলে গেলে সিনিয়র আপুরা পযন্ত রিদ ভাইকে চিঠি দিতো আমাকে দিয়ে। আমি কখনো ঐ চিঠি গুলো রিদ ভাইকে দিতাম না থাপ্পড় খাওয়ার ভয়ে। রাস্তায় ডাস্টবিনে ফেলে দিতাম আর আপুদের গিয়ে বলতাম রিদ ভাই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তাছাড়া তুই এখন রিদ ভাইদের নতুন আত্মীয় হয়েছিস। একটু আশেপাশে চোখ ঘুরালেই অবশ্যই দেখবি কতো মেয়ে ভাইকে চাই। এমনকি আমার কার্জিন রিদ ভাইয়ের খালাতো বোন শশী আপুর ক্রেইজ তো তুই এখনো দেখিসনি। বাপরে দেখলে তুই অবশ্যই শকট হবি। আমি এখন বললো না। তুই অবশ্য নিজের চোখেই দেখতে পারবি দ্রুত। তাছাড়া আমি যতটুকু জানি রিদ ভাই আর শশী আপুর মধ্যে নাকি প্রেম-টেম সম্পর্ক আছে। পারিবারিক ভাবে বিয়েও ঠিক। হয়তো সামনে হয়েও যাবে। অথচ তুই বলছিস তোর রিদ ভাইকে পছন্দ না। তোর জায়গায় আমি হলে তো এমন সুন্দর বিয়াই উপর ক্রাশ খেয়ে তার প্রেমে উস্টা খেয়ে পরতাম সেই কখন। কিন্তু তুইতো ইন্টারেস্টই দেখাচ্ছিস না।

রিদের প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে কথা শুনেও মায়ার তেমন ভাবান্তর হলো না। বিষয়টা পাত্তায় দিল না।যেহেতু রিদকে ওর পছন্দ না তাই রিদের প্রেম- বা বিয়ে নিয়ে ওর মাথা ব্যথা নেই। মায়া রিদের প্রেমের সম্পর্কটা স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিয়ে বলল…

‘ বিষয়টা আসলে ইন্টারেস্টের নয়! বিষয়টা ভালোবাসার। রিদ খান আমার জীবনে আসার আগে থেকেই আমি বিবাহিত ছিলাম। এবং ততদিনে নিখোঁজ স্বামীকে মন দিয়ে ও বসে আছি। সেজন্য আমার কখনো ঐ প্রেম প্রেম চোখে রিদ খানকে বা অন্য কোনো ছেলেকে দেখা হয়নি। আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতোই রিদ খানকে দেখে এসেছি। যদি আমি বিবাহিত না হতাম তখন হয়তো সুন্দর বিয়াই হিসাবে রিদ খানের রুপে গলে পানি পানি হতাম। কিন্তু আফসোস! আমি অলরেডি একজনের প্রেমে গলে বসে আছি। সেখানে অন্য কেউ ঢোকা নো চান্স বেবি!
~~

মায়ার পরীক্ষা শুরু হয় দশটায়। স্বাভাবিক নেয় জুইয়ের হাতে বকাঝকা শুনতে হয়েছিল মায়াকে। কিন্তু শ্রেয়ার সাথে মায়া সকালে বের হয়েছিল এমনটা শ্রেয়া বলায় এই যাত্রায় বেঁচে যায় মায়া। নয়তো আজ জুই মায়ার নামে বিচার তুলতো আরিফের কানে। দিন দিন মায়া কেমন বেপরোয়া আচরণ করছে স্বামী খোঁজে। যেটা মায়ার জন্য মোটেও ঠিক নয়। এইতো এখনো মায়া এক অপত্যাশিত কাজ করে বসল। পরীক্ষা চলাকালীন কি মনে হওয়াতে তাড়াহুড়ো মায়া খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে গেল সবার আগে আগে। অথচ পরীক্ষা তখনো ঘন্টা খানিকটা সময় বাকি আছে। ক্লাসের সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে আর মায়া তাড়াহুড়ো করে স্যারকে খাতা জমা দিয়ে ফাইল নিয়ে বের হয়ে গেল অসুস্থতার দোহাই দিয়ে। অথচ জুই জানালা দিয়ে ঠিক দেখেছে মায়া দৌড়ে কলেজের গেইট দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। জুইয়ের রাগে দাঁতে দাঁত পিষল। কাল কোচিং থেকে আর আজ পরীক্ষা হল থেকে মায়া বেড়িয়ে গেল অসুস্থতা বাহানা দিয়ে। নিশ্চয়ই মায়া কোথাও কিছু ঝামেলা পাকাচ্ছে নয়তো এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করবে? জুইয়ের সন্দেহ বাড়ে। পরীক্ষা শেষ করেই যে জুই মায়াকে ধরে বেঁধে সবকিছুর প্রশ্ন করবে। জানতে চাইবে মায়া কেন দু’দিন ধরে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। কেন পরীক্ষা গুলো খারাপ করছে ইচ্ছাকৃত ভাবে।

মায়া হন্তদন্ত হয়ে রিকশা চড়ে বসল রিদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। মায়া অস্থির নেয় ছটফট করছে রিকশায় বসে। মায়া এতো বড় কুৎসিত কাজটা কিভাবে করল? নিজের স্বার্থের জন্য স্বামীকে খোঁজতে গিয়ে তারই একটা কিডনি বিক্রি করার অনুমতি দিয়ে আসল রিদ খানকে। এটা অন্যায় থেকেও জঘন্য পাপ হয়েছে মায়ার। কাউকে ভালোবাসলে তার ক্ষতি করা যায় না। শুধু ভালো রাখার দোয়া করা যায়। মায়া-তো ওর স্বামীকে ভিষণ ভালোবাসে তাহলে লোকটার এতো বড় ক্ষতি কিভাবে করলো মায়া? ওর বুক কাপলো না? মায়া কি আদৌ ওর স্বামীকে ভালোবেসেছে? যদি ভালোবাসতো তাহলে এমনটা মায়া কখনো করতে পারতো না ওর স্বামীর অগোচরে। তীব্র অপরাধ বোধে মায়া রিকশার মধ্যেই বসে ঝরঝর করে কেঁদে উঠল। যে লোকটাকে ওহ এখনো দেখেনি পযন্ত সেই লোকটাকে কতো বড় বিপদে ফেলে দিলো মায়া। সোজা কিডনি বিক্রি করে দিন তার অগোচরে। মায়া কি আদৌ ভালো বউ? ওর মতোন জঘন্য বউ কেউ হতে পারে না এই দুনিয়াতে। মায়া সর্বোচ্চ নিকৃষ্ট বউ হলো ওর স্বামীর। মায়ার হঠাৎ কান্নায় রিকশা চালাক চমকে পিছনে তাকাল। গাড়ি গতি কমিয়ে মায়াকে তিনি কিছু জিগ্যেসা করতে চাইলে মায়া চোখ মুছতে মুছতে রিকশা ওয়ালার উদ্দেশ্য বলল

‘ চাচা একটু দ্রুত চালাবেন গাড়িটা?

রিকশা চালাক আর প্রশ্ন করলো না মায়াকে বরং তিনি মায়ার কথায় স্বাভাবিক নেয় থেকে দ্রুত গাড়িটা টানল মায়ার দেওয়া ঠিকানায়। মায়া রাস্তা পথের দিকে তাকাল রিদকে আশেপাশে দেখা যায় কিনা তা দেখতে। মায়াকে আজ সকালে আসিফ কলেজে ড্রপ করার সময় বলেছিল ওরা আজ ঢাকা ব্রেক করবে। এবার ফিরতে মাস দুয়েক সময় নিবে। রিদ দেশের বাহিরে যাওয়ার কথা। এমনত অবস্থায় যদি মায়া এখন রিদের কাছে পৌঁছানোর আগে রিদ চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যায় তাহলে মায়ার আর নিষেধ করা হবে যে, ওর স্বামীর কিডনি দিয়ে কোনো ডিল-টিল করতে চাই না ওহ। মায়াকে যেন রিদ সকালের উকিলের দেওয়া ডিলের কাগজ গুলো ফের দেয় এটাও বলবে। মায়া এখন আর ওর স্বামীকে খোঁজবে না। যেদিন মায়া দু’লাখ টাকা যোগাড় করতে পারে সেদিন খোঁজবে নয়তো থাক। মায়া এবার নিজেই খোজে নিবে ওর স্বামীকে তারপরও রিদের সাথে স্বামীর কিডনি দিয়ে কোনো রুপ ডিল করবে না। করবে না মানে না-ইই। এই যাত্রায় মায়ার ভাগ্য ভালো হওয়ায় রিকশা থেকে থেমেই রিদের বিল্ডিংয়ের নিচে আসিফকে দেখল গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো অল্পক্ষণে চলে যাবে। আসিফের সঙ্গে ড্রাইভারসহ আরও দশ-বারোটা মতোন ছেলেপেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মায়া। মায়া সেদিকে এগিয়ে যেতেই রাহাত সালাম দিল। আসিফ মায়াকে এই অসময়ে দেখেও কিছু বলল না। বরং মায়া কিছু বলার আগেই আসিফ স্বাভাবিক নেয় জানাল ‘ রিদ নিজের উপরে আছে। এবং রেডি হচ্ছে!

মায়া সিঁড়ি ভেঙ্গে দ্রুত উপরে উঠলো। দরজা নক করতে দেখলো ভিতর থেকে দরজাটা খোলা। হয়তো রিদ বেড়িয়ে যাবে বলে লাগানি। মায়া চাপানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে দেখল রিদ সোফায় বসে সুজ পরছে। কারও উপস্থিতি টের পেতেই রিদ বেখেয়ালি ভাবে চোখ তুললেই দৃষ্টি মিলল মায়ার সাথে। মায়াকে এই অসময়ে দেখে খানিকটা কপাল কুঁচকাল। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে তড়াক করে তাকাল দেয়াল ঘড়ির দিকে। এক পলক সময়টাও দেখে নিল। মাত্র দুপুর বারোটা পাঁচ মিনিট। তারমানে মায়ার পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি, রানিং। তাহলে এই মেয়ে, এই অসময়ে পরীক্ষা রেখে রিদের বাসায় কি করছে?
রিদ পুনরায় নিজের সুজ পরায় স্থির হলো….

‘ কি চাই?

‘ আমি সকালে আমাদের মধ্যকার ডিলের কাগজ পত্রগুলো ফেরত চাই ভাইয়া। আমার স্বামীর ক্ষতি করে কোনো কিছু করবো না আমি। আপনি আমাকে সকালের কাগজ গুলো ফিরত দিন প্লিজ। আপাতত কোনো চুক্তিতে যেতে চাই না আমি। যেদিন আপনার চাওয়া টাকা যোগাড় করতে পারব সেদিন ঐ লোকটাকে খুঁজবো নয়তো না। তারপরও আমি আমার স্বামীর কিডনি দিয়ে কোনো রকম চুক্তিতে জড়াব না।

মায়া রিদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে দৃঢ়তা দেখিয়ে কথা গুলো বলল। রিদ সুজ পরতে পরতে মায়ার কথা গুলোর যথাযথ অর্থ বুঝতে চাইল। ডিলের নামে করে রিদ যে, সকালে মায়ার থেকে কায়দা করে কাগজ গুলোতে সাইন নিয়েছিল? তার সবগুলোই তো ছিল তাদের বিয়ের রেজিস্টি পেপার আর কিছু বিয়ের সত্যায়িত প্রমাণ পত্র। কোনো কিছুই তো চুক্তিপত্র ছিল না। এখন এই বোকা মেয়েকে কে বুঝাবে সেই কথা? এই নারী বুঝবে? রিদ কি এখন নিজের কিডনি বিক্রি করবে নাকি আজব? রিদ মায়ার কথায় তেমন পাত্তা দিল না। শুনতে না পাওয়ার মতো করে সুজ পরে উঠে দাঁড়াল। মায়াকে আদেশ করে বলল…

‘ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো।

রিদের হুটহাট আদেশে মায়া বিরক্তি সাথে সাথে উপচে পরা রাগও হলো। মায়ার সিরিয়াস মোমেন্টে রিদের হেয়ালি আদেশ ওর গা জ্বলে উঠল রাগে, তারপরও সেটা চেপে গেল, প্রকাশ করলো না। কারণ এই মূহুর্তে মায়া রিদের কাছে ধরা। ডিলের কাগজ গুলো নিতে হলে অবশ্যই মায়ার রিদের আদেশ গুলো শুনতে হবে। মায়া তাড়াহুড়ো রিদের দিকে না এগিয়ে উল্টো হাঁটল কিচেনে দিকে। মায়াকে কিচেনে দিকে যেতে দেখে রিদ পকেটে হাত গুজাল। ছোটখাটো একটা নীল ডায়মন্ডের বক্স বের হয়ে আসল তাতে। সকালে দুজনের বিয়ে হয়েছে অথচ রিদের এখনো মায়াকে তেমন কিছুই দেওয়া হয়নি। কাবিননামার মূল্য যদিও উশুল করে বিয়েটা করেছিল রিদ। কিন্তু এতো কিছু আপাতত বউকে বলা যাবে না। দেখা যাক এই লুকোচুরি খেলাটা আর কতোদিন এইভাবে চলে। এই হাইডেন্সি খেলার শুরু তার বউ করেছিল এবার শেষটাও তার বউকেই করতে হবে। রিদ এই ব্যাপারে কোনো সাহায্য করবে না বউকে। যেভাবে হারিয়ে গিয়েছিল রিদকে না বলে ঠিক সেভাবে বউ তাকে খোঁজে বের করতে হবে। ততদিন রিদ শুধু তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা পালন করবে এই বিষয়ে। রিদ হাতের বক্সটার দিকে এক পলক তাকাল। বউকে দেখার জন্য আপাতত দুটো জিনিস আছে রিদের কাছে। তারমধ্যে একটা হলো তার হাতের এই বক্সটা। কিন্তু সেটাও এই মূহুর্তে দিলে গেলে তার বউ বেশ উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করবে তাঁকে। যার উত্তর এই মূহুর্তে রিদের কাছে নেই। হাতের মুঠোয় বক্সটা চেপে রিদ সামনে তাকাল। মায়াকে দেখল রিদের জন্য পানি নিয়ে এগিয়ে আসতে। দুজন মুখোমুখি হতেই মায়া রিদের দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে আওড়াল…

‘ নিন’
‘ খাও!

রিদের আদেশ মায়া চমকে উঠে অবুঝ গলায় শুধালো…

‘ আমি? আমি কেন? এটা তো আপনার। আপনি খান। নিন!

‘ কুইক!

মায়া একটু আমতা আমতা করল। তারপর
রিদের আদেশ অনুযায়ী তরতর করে সবটা গ্লাসের পানি এক চুমুকে শেষ করে হাতে নিল গ্লাসটা। ঠান্ডা পানিটা গলা দিয়ে নামার সময় মায়ার মনে হয়েছিল এই মূহুর্তে, এই পানিটুকু সত্যিই মায়ার বড্ড দরকার ছিল। তৃষ্ণায় কেমন গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। টেনশনে, দুশ্চিন্তা, আর অস্থিরতার জন্য মায়া এতক্ষণ যাবত ঠাহর করতে পারেনি। কিন্তু রিদ কিভাবে টের পেল মায়ার তৃষ্ণা গুকিয়ে যাওয়া গলাটা সম্পর্কে? মায়ার জানা নেই। আর না জানতে চাই। তবে এই মূহুর্তে রিদকে একটা ধন্যবাদ দিতে দরকার বলেই মায়া ছোট করে বলল….

‘ ধন্যবাদ!

রিদ হাল্কা ঝুঁকে সোফা টেবিলে উপর থেকে ফ্ল্যাটে চাবির রিংটা হতে নিতে নিতে মায়া মুখে ‘ধন্যবাদ শব্দটা শুনল। তাতে হ্যাঁ বা না তেমন কিছুই বলল না সে। কেবল চাবির রিং হতে একটা এক্সট্রা চাবি খুলে হাতে নিল। আর সেটা মায়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ এটা তোমার। টেইক দিস!

বিষন্নে মায়া চমকিত চোখে রিদের হাতের দিকে তাকিয়ে, নিজের হাতের পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে চাবিটা নিল। বড় সাইজের একটা চাবিকাঠি সেটা উল্টে পাল্টে দেখে রিদের উদ্দেশ্য বলল….

‘এটা কিসের চাবি?
‘ এই ফ্ল্যাটের!
‘ তো এটা আমাকে দিচ্ছেন কেন? এটা দিয়ে আমি কি করবো?

‘ এই চাবির গুরুত্ব ও মূল্যায়ন দু’টোই ভবিষ্যতে বুঝতে পারবে তুমি। প্রয়োজন পরবে তোমার।

রিদের সিরিয়াল কথাটাও মায়ার নিকট কেমন হেয়ালি ঠেকল। সে বুঝল না বিষয়টা। ভবিষ্যতে মায়ার রিদের ফ্ল্যাটের কি এমন প্রয়োজন পরবে আশ্চর্য। অনিচ্ছায় শর্তেও মায়া নিজের পরীক্ষার ফাইলের ভিতরে চাবিটা ঢুকিয়ে রাখল। আপাতত এই একটা চাবি নিয়ে রিদের সঙ্গে কথা বাড়াতে চাই না মায়া। একটা চাবিই তো। সেটা আর কি এমন জিনিস। লোহার একটা ছোট পদার্থ ফেলে দিলেই শেষ। রিদের হাতে মায়ার জন্য আনা দ্বিতীয় উপহারের বক্সটা সেটা আর দিল না। বরং অতি সর্তপণে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। হঠাৎ মনে হওয়ার মতোন করে তাড়াহুড়ো মায়া বলল…

‘ ভাইয়া প্লিজ আমাকে ডিলের কাগজ গুলো ফিরত দিয়ে দিন। আমি কোনো ডিলে যেতে চাই না।

মায়া কথায় রিদ বাম হাতে সময়টা দেখে নিয়ে পকেটে দুহাত গুজাতে গুজাতে বলল…

‘ তুমি কিছু বললেই যে আমাকে সেটা শুনতে হবে এমনটা তো ডিল হয়নি। কাগজ পত্র গুলো অলরেডি কোর্টে সাবমিট করা হয়ে গেছে। ডিল ক্যানসেল করা যাবে না। তুমি এখন আসতে পারো। আমি বেরোব।

রিদ মায়াকে কৌশলে এড়াতে চেয়েছিল তাড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু মায়া বের হলো না। স্বামীর জন্য মায়ার ছটফট, অস্থিরতা রিদের চোখে পড়ার মতোন ছিল। বউয়ের এতো ভালোবাসা, এতো অস্থিরতা সব-তো রিদের জন্যই তাইনা? রিদের ভিতরটা হঠাৎ পৈশাচিক আনন্দে শীতল হলো। অনাঙ্ক্ষিত ভাবে কারও দিশেহারা, ছটফটে কারণ হতে পেরে রিদ ভিতরে অদ্ভুত আনন্দ বোধ করল। খুব কাছ থেকে মায়ার ছটফট দেখতে পারছে রিদ। আর সেটাই যেন রিদের পৈশাচিক আনন্দের কারণ হলো। কিন্তু রিদের পৈশাচিক আনন্দ বেশিক্ষণ ঠিকল না মায়ার পরবর্তী আচরণে। রিদ ডিল ক্যানসেল করতে অস্বীকার করাতে দিশেহারা হলো মায়া। ঝরঝর করে কেঁদে উঠে তৎক্ষনাৎ রিদের পায়ে উপর পরলো। দু’হাতে রিদের দু’পা চেপে ধরে আকুতি মিনতি করে বলল…

‘ ভাইয়া প্লিজ প্লিজ আপনার পায়ে পরছি আমি। প্লিজ আমাকে কাগজ গুলো ফিরত দিয়ে দেন। লোকটা এসবের কিছু জানে না। আমি লোকটার ক্ষতি করতে কোনো ডিল করেনি। আমার দ্বারা উনার কোনো ক্ষতি হলে সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। মরে যাব। ভাইয়া প্লিজ আপনি লোকটার কোনো ক্ষতি করবে না। লোকটার কিডনিও নিবেন না। প্লিজ আমাকে ডিলের কাগজ গুলো ফেরত দিয়ে দিন। প্লিজ প্লিজ।

রিদ হতভম্ব! ভিষণ হতবাক! স্তব্ধতা নেয় হতবুদ্ধি হয়ে ঠায় জায়গায় দাঁড়িয়ে। মায়া হুট করে রিদের পায়ে পরে যাবে এমনটা রিদের ঘুনাক্ষরে ধারণাতে ছিল না। মায়া কান্না, আহাজারিতে রিদের মনটা হুট করেই কেমন নরম আর শীতল হয়ে গেল। বউয়ের ভালোবাসায় ভিতরটা ঠান্ডা অনুভব করলো। রিদ ভাবল সে হয়তো একটু বেশিই করে ফেলেছে বউয়ের অনুভূতি নিয়ে খেলা ঠিক হয়নি। সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত ছিল। রিদ কোমল হাতে মায়ার বাহু চেপে দাঁড় করাল। মায়া তখনো রিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত জোর করে আকুতি মিনতি করে কাঁদছে ওর স্বামীর কোনো ক্ষতি না করতে। ডিলের কাগজ গুলো মায়াকে ফেরত দিয়ে দিতে। রিদ ঠোঁট গোল করে ভিতরকার অস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ল। কপালের একপাশ চুলকে মায়ার ক্রন্দনরত মুখটার দিকে তাকাল। স্বামী হিসাবে রিদ নিজের পরিচয় এই মূহুর্তে দিলে মায়া সেটা কিভাবে গ্রহণ করবে তাও খানিকটা ভাবল। রিদ নিজের সংশয় দূর করে মায়ার হিজাবের উপর দিয়ে মাথায় নিজের ডানহাতটা রাখল। স্বামী হিসাবে অধিকার খাঁটিয়ে এই প্রথম রিদ মায়াকে স্পর্শ করলো। যত্ন নিয়ে একটু মায়ার মাথায় আদুরে হাতটা বুলিয়ে দিল। রিদ আবারও একই অস্থিরতার চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল…

‘ যাকে তুমি খোঁজছ, তাঁকে খোঁজা বাদ দিয়ে আমাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করলে চলবে না তোমার?

রিদ কথাটা শেষ করতে যতটুকু দেরি হলো ব্যস এতটুকুই কিন্তু মায়ার রিয়াকশন দেখা গেল তৎক্ষনাৎ। মূহুর্তে মাঝে রিদের হাতটা ঝাড়া দিয়ে মাথার উপর থেকে ফেলে দিল তীব্র রাগে। তেতে উঠে বলে মায়া…

‘ আমি আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। উপদেশ নয়। তৃতীয় পক্ষ হয়ে একদম আমার ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকার চেষ্টা করবেন না। আমি কাকে খোঁজব? কাকে খোঁজব না। সেটা আমার ব্যক্তিগত মতামত হবে, আপনার না। আমাকে দূর্বল ভেবে একদম সুযোগ নেওয়া চেষ্টা করবেন না। আমি ঐ টাইপের মেয়ে নয়, যারা আপনার রুপ আর টাকা-পয়সা দেখে আপনার পিছনে ঘুরে বেড়াব। আর না আমার ভালোবাসা এতো ঠুকনো যে কারও কথায় নিজের স্বামীকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে গ্রহণ করবো। একদম নিজের লিমিটে থাকবেন। আমার আপনাকে পছন্দ না।

মায়া রাগ, মায়া দৃঢ়তা রিদকে মুগ্ধ করার কথা ছিল কিন্তু রিদ মুগ্ধ হতে গিয়েও নড়ে উঠল। রিদ যে মায়াকে বুঝাতে চেয়েছিল সে মায়া স্বামী হয়। এই কথাটা তো মায়া মানতেই নারাজ। বিশ্বাস করবে কখন? রিদের মস্তিষ্ক হঠাৎ করে জ্বলে উঠল কিছু একটা আপত্তি জানিয়ে। মায়া নিজের স্বামীকে যতোটা পাগল পাগল হয়ে ভালোবাসে ঠিক ততটাই রিদকে অপছন্দ করে। এতটাই অপছন্দ করে যে রিদ মায়ার স্বামী হতে পারে এটা এই মেয়ে কল্পনাতেও রাখেনি। রিদ তো শুধু প্রাথমিক অবস্থায় এই মেয়েকে একটু করে বুঝাতে চেয়েছিল ‘রিদ মায়ার স্বামী হতেও পরে। পুরপুরি রিদ সত্যটা বলেনি। অথচ মায়া অল্প কথা শুনেই রিয়েক্ট করলো। রিদের কথাটা বিশ্বাস করা তো দূর উল্টো ভুল বুঝে বসল। এইভেবে রিদ তার বউয়ের সুযোগ নিচ্ছে। আজব সে সুযোগ কেন নিবে? মেয়েটি তার বউ হয়। যদি রিদের কখনো মনে হয় তার বউকে দরকার তাহলে সে সোজা বেড রুমে নিয়ে ফেলবে এই মেয়েকে তারপরও বাউতা বাজি করে বউকে ছুবে না সুযোগ নেওয়া উদ্দেশ্য। এমনটা করা রিদের দরকারও নেই। রিদের মনে তীব্র প্রশ্ন জাগল! আচ্ছা এই মেয়ে যখন জানতে পারবে রিদ মায়ার স্বামী হয় তখন কি করবে? এতো এতো ভালোবাসা থাকবে তো এই নারী তার প্রতি? নাকি রিদ এই নারীর স্বামী হয় বলে সে এতো ভালোবাসাকে মূহুর্তে ঘৃণায় রুপান্তর করবে? দূরে সরে যেতে চাইবে রিদ থেকে? অসম্ভব! রিদ এতো সহজে ছেড়ে দিবে বউকে? তাঁকে এতো আগ্রহ নিয়ে পাগল বানিয়ে শেষে কিনা ছেড়ে যেতে দিবে এই নারীকে? অসম্ভব! জানে মেরে ফেলবে না সে এই নারীকে। তারপর ছাড়বে না। এতক্ষণের ভালো লাগাটুকু হুট করেই কেমন বিতৃষ্ণা ঠিকল রিদের নিকট। মায়ার শক্ত অনলের দিকে তাকিয়ে রিদ তেতু গলায় বলল…

‘ নিজের লিমিটেই আছি আমি। এমনটা যাতে না-হয় তুমি নিজের লিমিট ক্রস করে একটা অপছন্দের মানুষের সাথে নিজের সারাটা জীবন শেয়ার করতে হলো।

‘ আপনার সাথে আমার একটা চকলেট পযন্ত শেয়ার করবে। সারাজীবন তো দূর।

‘ শুধু চকলেট না, নিজের সবকিছুই আমার সাথে শেয়ার করবে তুমি তাও সেচ্ছায়। আই প্রমিস!

‘ অসম্ভব!

‘ অসম্ভব বলতে কিছু নেই। তোমার বাসরেও আমাকে পাবে। তোমার বাচ্চাদের বাপও আমি হবো। এবার আউট।

‘ আপনার মতোন নোংরা মানসিকতার মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। আমাকে চুক্তিপত্র কাগজ গুলা ফেরত দিন। আমি চলে যাব।

মায়ার উল্টা পাল্টা কথায় রিদের রাগ বাড়ছে। রিদ দাঁতে দাঁত চেপে মায়াকে শুধালো…

‘ এই যাবে তুমি এখানে থেকে? ভালো লাগছে না আমার। কোনো ডিলের কাগজ টাগজ দিব না আমি। যাও! তারপরও যদি স্বামীর প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে দিয়ে কাজ চালাও। ফুল সার্ভিস দিব। তারপরও এখন বের হও। ভিষণ রাগ লাগছে আমার। কন্ট্রোল হারালে খুব হবে তোমার। যাও।

রিদের কথায় মায়া রাগান্বিত চোখে জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রিদের মতোন এতো খারাপ ভাষায় কেউ আমাকে কুপ্রস্তাবে দেয়নি। মায়া রাগটা যে কোথায় হচ্ছে বলা দায়। রিদ মায়াকে যেতে না দেখে তেতে উঠে। রিদ বেশ বুঝতে পারছে মায়া রিদকে ভালোবাসে না। এমনকি ভবিষ্যতে স্বামী হিসাবে রিদের পরিচয় পেলেও যে মায়ার এই ভালোবাসা থাকবে না। সেটাও রিদ বেশ বুঝতে পারছে। তাহলে এখন এতো আগ্রহ নিয়ে যে এই নারী তাকে পাগল বানাচ্ছে সেটা কে দেখবে? রিদ জাস্ট পাগল হয়ে যাচ্ছে এই নারীর জন্য। এই নারী আর কিছুক্ষণ রিদের সামনে থাকলে নিশ্চিত সে রাগে কন্ট্রোল হারাবে।

‘ কি হলো শুনতে পাওনি? দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও! তোমার এই নাটক দেখানো ভালোবাসার আমি অলরেডি বুঝেছি? আর কাহিনি করতে হবে না। যাও! আর হ্যাঁ স্বামীর দেখা তুমি এহ জীবনে আর পাবে না। মনে করো তোমার স্বামী মৃত। তাঁকে আমি মেরে ফেলেছি এবার আমাকে গ্রহণ কর….

রিদের বাকি কথাটা শেষ করার আগেই মায়ার অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণের শিকার হলো রিদ। টেবিলের উপর রাখা সেই পানির গ্লাসটা তুলে মায়া হঠাৎ ছুড়ে মারল রিদের দিকে। রিদের অপরাধ সে মায়ার স্বামীকে মৃত বলেছে। আকস্মিক ঘটনায় রিদ নিজেকে সরানোর সুযোগ পায়নি। সে কেবল নিজেকে বাঁচাতে মুখের উপর আড়াআড়ি হাত বাঁধল রক্ষা করতে। যার দারুণ মায়ার ছুড়ে দেওয়া ভারি গ্লাসটা রিদের হাতের কব্জায় আর কপালে লাগল। এতে করে রিদের হাত ঘড়ির কাঁচ ভেঙ্গে মূহুর্তে হাত কেটে রক্ত বেড়িয়ে কব্জাতে চড়াল। কপালটাও গ্লাসের কাঁচে লেগে আংশিক রক্ত গড়াল। রিদ মুখের উপর হাত বেঁধে ঝুকে রইল কয়েক সেকেন্ড। মূলত পুরো বিষয়টা রিদের বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। যখন বুঝতে পারল বিষয়টি কি হয়েছে তার সাথে, ঠিক তক্ষুনি দপদপ করে তীব্র রাগে জ্বলে উঠলো রিদের মস্তিষ্ক। তাঁকে কেউ আঘাত করলে সেটা সহ্য করতে পারে না সে। কন্ট্রোলের বাহিরে চলে যায় তখন সবকিছু। মায়া না চাইতে সেই কাজটা করে ফেলে, রিদের চেপে রাখা রাগটা আর বাড়িয়ে দিল নিজের অজান্তে। কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধ পরিবেশটা হুট করে কেমন অশান্ত তান্ডবে পরিণত হলো। সুন্দর ফকফকা ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে পরলো অসংখ্য কাচের টুকরো। রিদ রাগের বশে মূহুর্তে মাঝে সোফা টেবিল মাথার উপর তুলে আচাড় মারলো স্বজোড়ো। তীব্র শব্দে অসংখ্য কাঁচ ভাঙ্গা ছড়িয়ে পরলো চারপাশে। মায়ার পায়েও গিয়ে বিঁধল সেই কাঁচের টুকরো কিছু। এবার রক্ত মায়ার পা থেকেও বেরুলো। ভয়ে মায়া মৃদু চেচিয়ে উঠলো। রিদের এতো রাগের শিকার হয়নি কখনো। আতঙ্কিত মায়া কেঁদে উঠে ছিটকে দূরে সরতে চাইলে রিদের ভয়ে। কিন্তু তার আগেই রিদের শক্ত থাবার পিষ্ট হয় সে। মূহুর্তে মাঝে রিদের শক্ত হাত চালান হয় মায়ার গলায়। চোখের পলকে সেই হাত মায়াকে ছিটকে ফেলল সোফার উপর। ছটফট করা মায়া দু’হাতে রিদের হাতটা গলা থেকে ছাড়তে চাইলে রিদের হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় হয়। মায়ার উরু পাশে সোফায় রিদ এক পা তুলে তাতে হাতের ভর দিয়ে মায়ার উপর ঝুকে পরে রাগে রি রি করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল….

‘ নাটক করিস? কাকে তেজ দেখাস তুই? এতো আগ্রহ দেখিয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে এখন আঘাত করিস? আমাকে চিনিস তুই? কি মনে হয়? একটু নরম-সরম হয়ে কথা বলেছি দেখে, এমনই আমি ভালো মানুষ হয়ে গেলাম? আর তুই সেই সুযোগে আমাকে আঘাত করবি? তোর বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠিকে নখের উপর তুলে মেরে ফেললেও কারও বাপের ক্ষমতা নাই ঠাহর পাওয়ার। সোজা গায়েব করে দিব। আজকেই শেষবার! নেক্সট টাইম এই একই ভুল করবি, তো তোর এই সুন্দর শরীরটা আগে ছিঁড়ে খাব, তারপর তোর পরিবারের কাছে তোকে পার্সেল পাঠাব, তাদের জানাতে যে আমি কতোটা খারাপ। মনে রাখিস।

#চলিত….