#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
২৬
[ কপি করা নিষেদ্ধ ]
রিদের কালো মার্সিডিজ গাড়িটা খান বাড়ির গেইট ধরে ঢুকতে বাগানে চত্বর থেকে আরাফ খান তাকাল সেদিকে। বাড়ির মালিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছিলেন তিনি। অসময়ে রিদের গাড়িটা বাড়ির গেইট ধরে ঢুকতে দেখে তিনি সেদিকে আগায় হাতের লাঠিটা ভর করে। আজকাল রিদের মতিগতি ভালো ঠেকছে না উনার কাছে। যেই ছেলেকে ধরে বেঁধে চট্টগ্রামে আনা যেত না সেই ছেলে আজকাল ঘনঘন পারা পরছে চট্টগ্রামের মাটিতে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। ভিষণ রকমের সন্দেহজনক। তিনি আরও দুইদিন আগে শুনেছিল এই ছেলে চট্টগ্রামে এসেছে। উনারদের সাথে দেখা না করে মুরাদপুর ফ্ল্যাটে পরেছিল দুইদিন। কিন্তু কেন পরেছিল জানা নেই? সেই কারণটা আপাতত তিনি জানেন না। শুনেছে এর মধ্যে বাবা নিহালের সঙ্গে দেখা করেছে রিদ কিন্তু উনাদের কাছে আসেনি। দেখাও করেনি। এমনটাও তো না যে রিদ চট্টগ্রামে তার বাবা কাজে এসেছে। তিনি বেশ বুঝতে পারেন রিদ তার মতলবে আজকাল হুটহাট চট্টগ্রামে চলে আসে। তাছাড়া রিদ যদি তার বাবার কাজে চট্টগ্রামে আসায় হতো তাহলে মুরাদপুর না থেকে বাড়িতে আসতো। উনাদের সাথেই থাকতো। কিন্তু রিদের মুরাদপুর থাকার পিছনে নিশ্চয়ই সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার আছে উনার মনে হয়। নয়তো এই ঘাড় ঠ্যাডা রিদ খান এমনই এমনই কোথাও পরে থাকা মানুষ না। যেখানে এই ছেলে বাবা-মা বিচ্ছেদ পর নিজের বাড়িতে না থেকে নিজের আলাদা বাড়িতে উঠেছে সেই ছেলে আর যায় হোক অন্তত মতলব ছাড়া মুরাদপুরে পরে থাকবে না। বিচক্ষণ আরাফ খান হাতে লাঠিটা ভর করে সামনে এগোল। রিদকে দেখাল গাড়ি থেকে নেমে কেমন গুমোট গম্ভীর মুখে হনহন করে চলে যেতে বাড়ির ভিতরে পথে। কিন্তু মাঝে পথে পথ আটকে দাঁড়াল আরাফ খান। যাওয়ার পথে বাঁধা পাওয়ায় বিরক্তি কপাল গুটাল রিদ। আরাফ খানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি কন্ঠে বলল।
‘ কি সমস্যা? কি চাই?
‘ চাই তো অনেক কিছু। কিন্তু তুই তো দিতে অক্ষম। তুইতো আর আমার বউ না। নাতি হোস। দিবি কেমনে?
আরাফ খানের রসিকতা কথায় রিদের বিরক্তি বাড়ে। এমনই মন মেজাজ ভালো নাই। বউয়ের সাথে রাগারাগি করে এসেছে সে। রিদ বিরক্তি নিয়ে পাশ কাটাতে চাইল আরাফ খানের কিন্তু আবারও একই ভাবে পথ আটকে দাঁড়াল তিনি। জহরী দৃষ্টিতে রিদের পা থেকে মাথা অবধি পরখ করল একবার। রিদের বামহাতের কব্জিতে বেশ বড়সড় একটা ব্যান্ডেজ চোখে পরলো উনার। সাথে কপালেও দেখলো একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ করা। এই অল্প সময়ে তিনি ভাবলেন রিদ হয়তো মারামারি করে নিজের মাথা আর হাত ফাটিয়ে এসেছেন। তাই তিনি তীক্ষ্ণ গলায় রিদকে প্রশ্ন করে বলল…
‘ তোর এই অবস্থা কেন হুম? কি করে এসেছিস তুই?
রিদের সোজাসাপ্টা উত্তর…
‘ বিয়ে করে এসেছি।
আরাফ খান বলতে দেরি কিন্তু রিদের তৎক্ষনাৎ উত্তর আসতে দেরি হলো না। চট করে নিলিপ্ত গলায় বলে ফেলল কথাটি। রিদ স্পষ্টভাষী। সে কখনো কোনো কথা মিথ্যা বা লুকোচুরি করে না। আর না কাউকে পরোয়া করে। স্থান, কাল, মানুষ বেঁধ করেও সে সর্বদা স্পষ্টভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। বলেও। আরাফ খান জানেন রিদ স্পষ্টভাষী। সর্বদা সত্য কথা বলে। তারপরও তিনি রিদের এই ‘বিয়ের করে এসেছি’ এই কথাটা বিশ্বাস করলেন না। বিশ্বাস না করার পিছনে অবশ্য কারণ আছে। বিগত কয়েক বছর ধরে রিদকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন উনারা। কিন্তু সে রাজি নয়। এমনকি রিদ বিয়ে করবে না বলে এই নিয়ে বাসায়ও তুমুল হুলুস্থুল পাকিয়ে ছিল। কতো কাহিনি করলো রিদ বিয়ে করবে না বলে। সেজন্য তো বাধ্য হয়ে রিদ থেকে তিন বছরের ছোট সাতাইশ বছরের ফাহাদকে বিয়ে করাল। নয়তো রিদকেই আগে বিয়ে করাতেন উনারা। এখন এতো কাহিনি পর যদি হঠাৎ করে রিদ এসে বলে সে বিয়ে করে এসেছে তাহলে উনারা বিশ্বাস করবে না এটাই স্বাভাবিক। হলোও তাই। আরাফ খান রিদের বিয়ের কথাটা এক রত্তিও বিশ্বাস করেন নি, উল্টো তিনি ভাবলেন রিদ উনার সাথে হেয়ালি করছে। সেজন্য তিনিও রিদের সাথে হেয়ালিপনা করেই বলে…
‘ বিয়ে করে এসেছিস ভালো কথা। কিন্তু তোর এই অবস্থা কেন? বিয়ে করতে কি আর যুদ্ধ করা লাগে নাকি? আঘাত পেয়েছিস কিভাবে?
আবারও রিদের দায়সারা উত্তর আসল…
‘ বউ মেরেছে।
‘ বউ মেরেছে? আরেহ সাব্বাশ! বউয়ের হাতের মার খেয়ে এসেছিস অবশেষে। আমার তো গর্ববোধ হচ্ছে তোর বউয়ের উপর রিদ। বাপরে কি সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার রিদ খানকেও কেউ পিঠায়? তোর বউকে তো আমার একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার রিদ। বাঘিনীর বাচ্চা সে। তোকে মারার মতো দুঃসাহসিক কাজটা সে করে ফেলল।
আরাফ খানের কৌতুক কথায় দাঁতে দাঁত চাপল রিদ। রাগ বাড়ছে সেজন্য চোয়াল শক্ত হচ্ছে জেদে।
‘ সামনে থেকে সরো দাদাভাই। ভালো লাগছে না।
রিদ আবারও পাশ কাটাতে চাইলে ফের বাঁধা দিল আরাফ খান। তিনি যেন আজ শপথ করেছে রিদকে সর্বোচ্চ বিরক্ত করবে। তিনি রিদের পথ আটকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে একই ভাবে খোঁচা মেরে বলল…
‘ আমাকে তোর ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক। আমি কি আর তোর বউ লাগি যে আমাকে তোর ভালো লাগবে? ভালো লাগার মানুষের কাছে তো মাইর খেয়েই এসেছিস। আর কি চাই বল? এমন বউ সোহাগা স্বামী কতোজন হতে পারে। তুই তো সাংঘাতিক কপাল নিয়ে জম্ম নিয়েছিস রিদ। সোজা স্বামী পেঠা বউ পেয়েছিস। তোর ভাগ্যটা ভালো বুঝলি। আমাদের বউতো খালি আদর করে। মারে না।
আরাফ খানের খোঁচা মারা হেয়ালি কথায় রিদ দাঁতে দাঁত পিষে জোরপূর্বক আরাফ খানকে পাশ কাটিয়ে হনহন চলে গেল বাড়ির ভিতরে। রিদকে চলে যেতে দেখে বৃদ্ধ বয়সের ঝুলন্ত চামড়ায় সুন্দর হাসলেন তিনি। রিদের চলে যাওয়ার দিকে হাসতে হাসতে ঘুরে সামনে তাকাতে তক্ষুনি চোখে পরলো আসিফকে। রিদের গাড়ি পাকিং করে এদিকটায় আসছে। কিন্তু আসিফের ভাবভঙ্গিমা এমন যেন সে চুরি করে ধরা পরে যাওয়ার নেয় অবস্থা। আরাফ খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে আসিফের চোরের মতোন মতিগতিটা চট করে ধরে ফেললো। আসিফ যে উনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এমন চোরের মতোন পালায়ন করতে চাইছিল সেটা বুঝতে পেরেই তিনি আসিফের ভয়টা আরও বাড়িয়ে দিয়ে তক্ষুনি হাক ছেড়ে ডাকল আসিফকে।
‘ এই রিদ ভাইয়ের বলদ এদিকে আয়।
আসিফ থমথমে মুখে আরাফ খানের দিকে এগিয়ে আসল। পালাতে গিয়েও আরাফ খানে চোখে ধরা পরে যাওয়ার আসিফ বোকা হাসল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে আরাফ খানের সামনে দাঁড়াতে তিনি সন্দেহ ভাজক দৃষ্টিতে আসিফকে পরখ করে বলল…
‘ কি ব্যাপার? কাহিনি কি বলতো? আজকাল ঘনঘন কি করিস তোরা চট্টগ্রামে? কি চলে তোদের?
আসিফ বোকা হেঁসে উত্তর করে বলল…
‘ কিছু চলে না দাদাভাই। এমনই এমনই কাজে এসেছিলাম আমরা।
‘ কি কাজে আসলি শুনি? তোর রিদ ভাই যে বলে গেল সে বিয়ে করেছে ঘটনা কি সত্য?
আসিফ একই ভাবে বোকার মতো বলল..
‘ রিদ ভাই বলেছে এমনটা? যদি বলে থাকে তাহলে হবে হয়তো সত্য। আমি কিছু জানি না।
‘ সারাদিন তো থাকিস রিদের সাথে বলদের মতোন। আবার বলছিস জানিস না কিছু। সত্যি করে বলতো তোদের মধ্যে কি চলে হুম? আমার তো তোদের দুজনকে কেমন সন্দেহ সন্দেহ লাগে। কোনো সম্পর্কে-টম্পর্কে জড়িয়ে পরিসনি তো তোরা আবার?
ছিটকে দূরে সরে যাওয়ার মতোন পিছু হাটলো আসিফ। নাক মুখ কুঁচকে আহাজারি করার মতোন করে বলল…
‘ আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! কি বলেন এসব দাদাভাই? রিদ ভাই আমার বস হয়। আমার কাজই রিদ ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকা। নয়তো আমি মেয়েতে ইন্টারেস্ট!
‘ তোদের ইন্টারেস্ট বুঝবো কেমনে হ্যাঁ? কোনো দিনতো দেখলাম না দুই বলদের এক বলদও একটা মেয়ে পটাইতে। খালি বলদের মতোন সাদাদিন একজন আরেক জনের নাম ডাকিস। তুই ঝপিস রিদ ভাই, রিদ ভাই করে, আর তোর রিদ ভাই মরে আসিফ আসিফ করে। এখন আমরা তোদের প্রেমিক-প্রেমিকা মনে করতেই পারি।
‘ নাউজুবিল্লাহর কথা বার্তা বইলেন না দাদাভাই। রিদ ভাইয়ের ভাবি আছে। ভাই শুনলে আমাকে ঝাড়বেন।
‘ রিদ ভাইয়ের ভাবি আছে মানে? রিদ কি ভাবিতে ইন্টারেস্ট নাকি?
আমতা আমতা করে আসিফ বলল…
‘ না মানে রিদ ভাইয়ের ভাবির সাথে সম্পর্ক আছে।
আরাফ খান আবাক হওয়ার মতোন করে বলে।
‘ কি বলিস এসব? রিদ শেষমেশ কোন ভাবি সাথে সম্পর্কে জড়াল আসিফ? বউটা কার? কার বউয়ের সাথে পরকীয়া করছে রিদ?
ভয়ে ভয়ে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আসিফের। কথায় কথায় সে অনেক কিছু বলে ফেলেছে আরাফ খানকে। যদি এসব কথা রিদের কানে যায় তো আসিফকে আস্ত রাখবে না। রিদ পছন্দ করে না ওর পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে কাউকে শেয়ার করা। আসিফ আরাফ খানের কথার ফ্যাসাদে পরে কিভাবে কিভাবে যে মুখ ফস্কে কথা গুলো বেড়িয়ে গেছে। এখন আসিফ যদি আর কিছুক্ষণ আরাফ খানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তিনি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাকি কথা গুলোও আসিফের পেট থেকে বের করবেন নিশ্চিত। আসিফ নিজেকে বাঁচাতে হঠাৎ করে দৌড় লাগাল বাড়ির ভিতর দিকে। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায় আরাফ খান। তিনি যখন বুঝতে পারেন আসিফ উনার থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছে ঠিক তক্ষুনি আসিফের যাওয়ার পথে খানিকটা চেচিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন….
‘ আরে আরে বলদ বলে-তো যাহ। রিদ কার বউয়ের সাথে পরকীয়া করে বেড়াচ্ছে? মেয়েটা কে?
আসিফ দৌড়ে পালাতে পালাতে খানিকটা চেচিয়ে জানাল…
‘ মেয়েটা আপনাদের আত্মীয় হই দাদাভাই।
আত্মীয় কথাটা মাথা আসতেই আরাফ খানের মাথায় প্রথমেই শশীর’ নামটা ঢুকলো। মেয়েটার সাথে রিদের সম্পর্কে কথা শুনেছিল উনারা আরও কয়েক বছর আগে। দুজনকে বিয়েও দিতে চেয়েছিল উনারা কিন্তু শশীর বয়স কম হওয়ায় বা শশীর পড়াশোনা শেষ হয়নি বলে বিয়ের আর হয়নি। তারপর কি হলো কি জানি। রিদ বিয়ে করবে না বলে একেবারে বেঁকে বসল। আরাফ খানের মনে হলো রিদ আবারও হয়তো শশীর সাথে প্রেমে সম্পর্কে মজেছে। যদি তাই হয়। তাহলে এবার দুটোকে ধরে হাতে হাতে বিয়েটা সেরে ফেলবেন উনারা।
~~
বহমান নদীর স্রোতের মতোই সময় তার নিজস্ব গতিতে যাচ্ছে। রিদ মায়ার উপর রাগ নিয়ে চট্টগ্রাম শহর ছাড়লো আজ গোটা পয়ত্রিশ দিন হলো। এতে মায়ার অবশ্য ভাবান্তর নেই। সে রিদের জন্য মোটেও চিন্তিত নয়। বরং সে সেদিনের পর নিখোঁজ স্বামীকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। রিদ চুক্তিপত্রের কাগজ গুলো মায়াকে ফিরত দেয়নি। উল্টো মায়াকে হুমকি ধামকি দিয়ে শাসিয়ে গেল। এখন মায়ার ভয় হয় যদি রিদ কোনো ভাবে মায়ার নিখোঁজ স্বামীর ক্ষতি-টতি করে বসে তো? মায়ার নিজের স্বামীর জন্য অস্থির, উম্মাদনা হয়ে সেদিন রিদের হাতে মার খেয়ে বসায় এসে প্রথমে নিজের স্বামীকে ফোন দিয়েছিল খোঁজ নিতে। রিদ মায়ার স্বামীর ক্ষতি করার আগেই সাবধান করতে চেয়েছিল লোকটাকে। কিন্তু আফসোস! মায়ার ফোন কলই সেদিন হতে আজ পযন্ত লোকটা রিসিভ করেনি আর না কল ব্যাক করেছে। মায়া জানে না কেন লোকটা মায়ার কল রিসিভ করে না। মায়া মনে করলো সেই প্রথম রাতে ওহ লোকটার সাথে রাগারাগি করে অনেক কিছু বলে ফেলেছিল বিদায় এখন মায়ার স্বামী অপমানিত হয়ে ওর কল রিসিভ করছে না। আসলে দোষটা মায়াই। মায়া বাড়াবাড়ি করে অনেক কথা বলে ফেলেছিল সেদিন। প্রথম ফোন আলাপে এতো বাজে ব্যবহার করা ঠিক হয়নি মায়ার। মায়া কষ্ট বাড়ে। সেই সাথে সঙ্গী হয় কান্না। দিশেহারা মায়া হঠাৎ করেই কেমন যেন উদাসীন হয়ে পরলো সবকিছু উপর। কিশোরী মনটাকে বুঝাতে না পেরে প্রায় প্রতিদিন নিখোঁজ স্বামীর খোঁজ নিতে কল দেয় রিদকে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলে হয়তো রিদ মায়ার কল রিসিভ করতো। স্বাভাবিক ভাবে অপরিচিত থেকেই বউয়ের সাথে ফোন আলাপ চালাত। কিন্তু বিষয়টা রিদের কাছে স্বাভাবিক ঠেকল না। যবে থেকে বুঝতে পারলো মায়া রিদকে নিয়ে পজিটিভ কিছু চিন্তা করছে না তবে থেকে সে অস্থির হলো। রিদ মায়ার স্বামী হয় এই সত্যিটা যদি মায়া কখনো জানতেও পারে তাহলে সে রিদকে স্বামী হিসাবে মানতে নারাজ হবে, তার থেকে তালাক চাইবে। এই কথাটা রিদের মাথায় আসতে রিদের শরীর রাগে টগবগিয়ে উঠে তিরতির করে। এই রাগে, জিদে রিদ মায়ার কোনো ফোন কল রিসিভ করে না। আর না কল ব্যাক করে। বরং রিদ ইচ্ছা করেই মায়াকে ইগনোর করে। রিদ শুরু থেকে মায়ার সাথে সম্পর্কে ছড়াতে চায়নি। বরং তার অজানা বউ সম্পর্কে প্রথমে জানার কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে মায়াকে প্রথম দেখে সে সন্দেহের বশে অজানা বউয়ের খোঁজ করল। তারপর বউয়ের হদিশ না পাওয়ায় রিদ এক প্রকার জেদ নিয়েই বউকে খোঁজে বেড়ায়। খোঁজে খোঁজে যখন রিদ দিশেহারা হয়ে উঠছিল বউকে না পেয়ে তখন রিদের মনে অজানা অচেনা বউয়ের প্রতি অস্থির টান আর প্রচুর ইন্টারেস্ট জম্ম নিলো। তারপর সেই ইন্টারেস্ট থেকেই আজ এই পযন্ত এসে দাঁড়াল। অবশেষে বউকে খোঁজে পেল। কোনো এক অজানা অধিকার নিয়েই বউকে খোঁজে পাওয়ার প্রথম দিনই থাপ্পড় মেরে বসল রাগে। তারপর রিদ কেমন কেমন করে যেন বউয়ের প্রতি নজর রাখতে শুরু করলো। বউয়ের চারপাশটা তাঁর হাতের মুঠোয় রাখল। তবে তখনো রিদ বউকে নিয়ে শিওর ছিল না তাঁরা ভবিষ্যতে একত্রে হবে কিনা। বা আদৌও সে এই লুকায়িত সম্পর্কটা সাথে জড়াতে চায় কিনা। কিন্তু যবে থেকে বুঝতে পারলো বউ তার জন্য দিশেহারা অস্থির পাগল হয়ে আছে তারই খোঁজে। তবে থেকে রিদের দৃষ্টি বদলায়। বউ তাকে না দেখে, না জেনেই ভালোবাসে! সে খারাপ কোনো মানুষ হতে পারতো, এমনটা জেনেও তার সাথে সংসার করতে চাওয়া মনোভাবটা রিদকে খুবই আকৃষ্ট করেছে। এই যে তার বউ তাঁকে খোঁজে পাওয়ার জন্য দিশেহারা হয়ে আছে এটা রিদকে প্রচুর মানসিক শান্তি দেয়। ভাবে তার বউ তাঁকে ভালোবাসে। আর বউয়ের এই ভালোবাসাটা অনুভব করতে গিয়েই কিভাবে যেন রিদ বউয়ের মায়ায় পা পিছলে পরে যায় একেবারে নাম মুখ ডুবিয়ে। সেই মায়া কাটিয়ে উঠার সাধ্য আর রিদের নেয়। রিদ অনুভব করতে পারে তার বউয়ের প্রতি টানটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তার মনে হচ্ছে সে খুব শীঘ্রই এই বউয়ের জন্য পাগল টাগল হয়ে যাবে। এখন তার এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে তার বউ যায়ই করুক না কেন, সবই তার ভালো লাগে। মনে হয় তার সাথে এমন আধা পাগল বউটাকেই মানায়। জীবনে এন্টারটেইনমেন্ট জন্য হলেও এমন একটা আধা পাগল বউ থাকা জরুরি। এই যে তার বউ তাঁকে এতো আগ্রহ নিয়ে দিনে দিনে অবসেশন জেদ্দি
পাগল বানাচ্ছে। আর সে দূর্বল হার্টে পরিণত হয়ে পাগল হচ্ছে। এখন যদি শুনতে হয় তাঁর বউয়ের ভালোবাসা মূলত তার জন্য নয়। তাহলে কেমনডা লাগে? কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি কি স্বাভাবিক থাকতে পারবে? অস্বাভাবিক নেয় মাথা গরম হয়ে যাবে না? রিদের অবস্থাও সেইম। সে পারছে বউকে থাপ্পড়িয়ে লাল লাল করে দিতে। বেয়াদব বউ একটা কপালে জুটেছে তার। এই বউয়ের জন সারাক্ষণ রিদের মন মেজাজ গরম হয়ে থাকে। সে এমনই রাগী রগচটা মানুষ। অল্পতেই রেগে যাওয়ার ব্যামো আছে। সেখানে বউটার জন্য মাথাটা তার আরও গরম হয়ে থাকে আজকাল। মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনায় রিদ ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল। অফিস কক্ষে থাই গ্লাস বেঁধ করে তাকাল ব্যস্ত শহরে দিকে। বউটার জন্য কেমন মন পুরছে তার। কিন্তু তারপরও সে নিরুপায়। সে বউকে নিজ থেকে ধরা দিবে না বলে জিদ ধরে বসে আছে। আর সেই জেদি এখন মন পুরছে। রিদ হাতে হাতে ল্যাপটপের শাটার টেনে বন্ধ করলো। কিছুই ভালো লাগছে না বলে রিদ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলে উপর রাখা অবহেলিত আধুনিক ফোনটা তক্ষুনি ভাইব্রেটস করে উঠলো। রিদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সেদিকে তাকাল। চোখে ভাসমান হলো ‘ বেয়াদব বউ’ নামটি। রিদ কলটি রিসিভ করলো না। বরং অবহেলিত ভাবেই ফোনটা জায়গায় পরে থাকল। সে আপাতত বউয়ের ফোন রিসিভ করবে না বলে জেদ করে আছে। যেভাবে রিদের মনটা পুরছে ঠিক সেভাবে বউকেও তার দহনে পুরাবে বলে স্থির করলো।
রিদ ফোন রিসিভ না করায় মায়া উদাস মনে কান থেকে ফোন নামিয়ে টেবিলে উপর রাখল। হাতাশার ভারি নিশ্বাস ফেলে আবারও কল দিতে চাইলে পাশ থেকে বাঁধা দিল জুই। রাগান্বিত গলায় বলল।
‘ তুই এতো আত্মসম্মানবোধ ছাড়া কিভাবে হলি রিতু? একটা মানুষ তোর ফোন রিসিভ করে না তারপরও বেয়ামি করে রোজ রোজ কেন কল দিস তুই? তোর লজ্জা থাকা উচিত।
কলেজ ক্যানটিনে দ্বি-তলায় কোণার টেবিলে গোল হয়ে বসে চার বান্ধবী। মায়া মুখোমুখি জুই বসে কপাট রাগ দেখিয়ে কথা গুলো বলল মায়াকে। মায়া জুইয়ে কথার উত্তর দিয়ে দৃঢ় মনে বলল।
‘ লজ্জা, আত্মসম্মানবোধ দুটোই আছে আমার জুই। কিন্তু তাই বলে সব জায়গায় আত্মসম্মানবোধ দেখাতে নেই। বিশেষ করে একটা সম্পর্ক সুস্থ রাখতে গেলে মাঝেমধ্যে নিজের আত্মসম্মানবোধ ও খুঁয়াতে হয়। সব জায়গায় সবকিছু চলে না। আমার সম্পর্কটাও ঠিক তাই। ভিষণ নড়বড়ে একটা সম্পর্ক। তাই আমার অসুস্থ সম্পর্কটাকে আগে সুস্থ করি তার না-হয় আত্মসম্মান বোধটা দেখানো যাবে। শ্রম না করে ভালো ফসলের চিন্তা করা যেমন বোকামি, ঠিক তেমনই একটা সম্পর্কে ভালোবাসা তৈরি না করে তার উপর অভিমান করে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বসে থাকলে ওপাশের মানুষটা কখনো আমার কদর বুঝবে না। আমার কদর বা গুরুত্ব সামনের মানুষটাকে বুঝাতে গেলে আমাকে অবশ্যই সেই মানুষটাকে স্পেশাল ফিল করাতে হবে। তবেই না সে আমার জন্য পাগল হবে। এখন দুনিয়াটায় গিভ এন্ড টেকের নিয়মে চলছে জুই। একহাতে দাও, তো অন্য হাতে নাও। তাই আমাকে কিছু পেতে হলে অবশ্যই কিছু দিতে হবে। আজ আমি তাঁকে পাত্তা দিচ্ছি কাল সে আমাকে গুরুত্ব দিবে। এটাই তো নিয়ম তাই না?
মায়ার জ্ঞানী জ্ঞানী কথায় বেশ অসন্তুষ্ট হলো জুই। তারপরও রাগ রাগ নিয়ে বলল জুই।
‘ তুই এতো পাত্তা দেওয়ার পরও যদি, ঐ লোকটা থেকে গুরুত্ব না পাস তাহলে কি করবি তুই তখন?
মায়া উত্তর আসল একই ভাবে। দৃঢ়তা দেখিয়ে বলল…
‘ সে আমাকে গুরুত্ব দেয় জুই। আর দেয় বলেই সে আজ পযন্ত আমার কলটা কখনো কেটে দেয়নি আর না আমার নাম্বারটা দেখে ব্লক লিস্টে ফেলেছে। আমার কি মনে হয় জানিস জুই? লোকটা কোনো কারণে হয়তো আমার উপর রাগ করে আছে। আর সেই রাগ নিয়ে হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না। হতে পারে আমার প্রথম দিনের ব্যবহারে লোকটা অসন্তুষ্ট। আমার উচিত হয়নি তার সাথে ঐভাবে রেগে কথা বলার।
মায়ার কথায় এবারও জুই অসন্তোষ্ট গলা ঝেড়ে বলল।
‘ তোর কাছে আদৌ তোর জামাইর কোনো দোষ পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না। তোর জামাই তো নিষ্পাপ মানুষ।
মায়া ফোন চালাতে চালাতে ছোট করে সম্মতি দিল…
‘ হুম।
জুই নাক মুখ কুঁচকে বলল…
‘ জামাই পাগলী।
জুইয়ের অসন্তোষ্ট গলা কথাটা বলল। মায়া শুনেও না শুনার মতো বসে রইল ফোনে চোখ দিয়ে। হাতের টাচে আবারও কল লাগাল রিদকে। কিন্তু এর মাঝেই ফোড়ন কেটে শ্রেয়া মায়ার কল কেটে দিয়ে হড়বড় করে বলতে লাগল।
‘ মায়া একটা কাজ করলে কি হয়? তোর জামাই কেমন লোক, তার চরিত্রের একটা পরীক্ষা করে দেখ আগে। তুই তো তাঁকে ভালোবাসিস তাই না? তোর জানা উচিত লোকটা কেমন চরিত্রে। তাছাড়া লোকটা তোর কল রিসিভ করে না হয়তো পরিচিত নাম্বার দেখে। তুই একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে লোকটাকে কল দিয়ে দেখ রিসিভ করে কিনা। বা অপরিচিত মেয়েদের সাথে সে কেমন স্বভাব রেখে কথা বলে, এই নিয়ে একটা পরীক্ষা তো করাই যায় তাই না?
মায়া সরল চোখে তাকাল শ্রেয়ার দিকে। কথাটা মন্দ বলেনও শ্রেয়া। একটা পরীক্ষা তো মায়া করতেই পারে জামাই চরিত্র পরীক্ষা করতে তাই না। মায়ার নাম্বারটা দিয়ে তো একবার কথা বলেছিল ওরা, সেজন্য হয়তো লোকটা মায়ার নাম্বার চিনতে পেরে এখন রিসিভ করে না। তাই মায়ার শ্রেয়ার কথাটা এই মূহুর্তে বেশ যুক্তি সংগত মনে হলো। কিন্তু কথা হলো কার ফোন দিয়ে কল করবে। এই কথাটা জানাতেই নাদিয়া তক্ষুনি নিজের ব্যাগ থেকে মোটামুটি দামী একটা ফোন বের করে দিল মায়াকে। মায়া সেটা সহজ ভাবেই গ্রহণ করলো। নাদিয়া বেশ ভালো পরিবারের মেয়ে। অনেক টাকা পয়সা আছে নাদিয়ার বাবার। সেক্ষেত্রে নাদিয়ার হাতে একটা দামী ফোন থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। মায়ার রিদের মুখস্থ নাম্বারটা হাতে হাতে নাদিয়ার ফোনে টাইপিং করে রিদকে কল লাগাল। মায়া বেশ দৃঢ় ছিল রিদ এই অপরিচিত নাম্বারটা দেখে কলটা রিসিভ করবে না। কিন্তু রিদ মায়ার দৃঢ়তাব্যঞ্জক করে কয়েক সেকেন্ড মধ্যে কলটা রিসিভ করে ফেললো। এতে মায়া হতাশ হলো। মায়া ভারি হতাশায় ডুবে গিয়ে বলল…
‘ হ্যালো বাবু!
‘ কে?
‘ আমি তোমার বাচ্চার মা!
মায়াকে ফের হতশায় ডুবিয়ে দিয়ে রিদ উৎফুল্লতা দেখিয়ে কথা মিলিয়ে বলল।
‘ হ্যাঁ বাবু বলো!
‘ আই মিস ইউ।
‘ আই মিস ইউ টু বাবু।
মায়া উদাস গলায় বলল…
‘ আমার বাবু কি করে?
‘ তোমার বাবু তার বাবুর আম্মুকে বসে বসে মিস করে জান।
‘ তাহলে আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি চলে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।
‘ হ্যা বাবু আর একটু পরই চলে আসবো। আমার বাবু ডেকেছে আর আমি না এসে পারি বলো? আজকে রাতে খেলা হবে জান। তুমি আর আমি।
মায়া লজ্জা থমথমে খেয়ে বসল। লোকটা এমন উলোটপালোট কথা বলবে সেটা ধারণাতে ছিল না মায়ার। মায়া থমথমে খেয়ে চোখ তুলে তাকাল মুখোমুখি বসা জুই, শ্রেয়া আর নাদিয়া দিকে। সবাই উৎসুক হয়ে ওদের কথা শুনছে আগ্রহ নিয়ে। ফোনটা লাউডস্পিকার দেওয়া। মায়া এক পলক জুই, নাদিয়া, শ্রেয়াকে দেখে নিয়ে থমথমে গলায় বলল…
‘ বাবু?
‘ হ্যাঁ বাবু!
মায়া আমতাআমতা করে বলল..
‘ আই লাভ ইউ!
‘ আই লাভ ইউ টু বাবু।
রিদের কথা বলার সময় আসিফ তাড়াহুড়ো করে ঢুকেছিল কক্ষে হাতে কিছু ডকুমেন্টস নিয়ে। রিদকে ‘ভাই ‘ ডাকতে রিদ আসিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল…
‘ এই ডিস্টার্ব করিস নাতো। দেখিস না আমার বাবুর আম্মু ফোন করছে। ব্যস্ত আমি। তুই বাহিরে যাহ।
আসিফ হতবুদ্ধি হয়ে ড্যাবড্যাব করে রিদের দিকে তাকিয়ে থেকে বেড়িয়ে গেল আস্তে করে। মূলত আসিফের মাথায় রিদের কথার আগামাথা কিছুই ঢুকলো না। এই বাবুর আম্মুটা আবার কে? রিদ কখন বাবু জম্ম দিল তাও বুঝল না। আসিফ বেড়িয়ে যেতেই রিদ একই উৎফুল্লতা দেখিয়ে বলল..
‘ হ্যাঁ বাবু বলো! বাচ্চারা কি খেয়ে ঘুমাইছে?
‘ হ্যাঁ!
‘ তা কি খাওয়ালে? মার্কেটের দুধ তো শেষ। আমিতো এখনো আনি নাই। তা তুমি কোত্থেকে দুধ খাওয়ালে?
রিদের বেগতিক কথায় মায়া হড়বড় করে কলটা মিউট করল। লজ্জা সিঁটিয়ে জুইয়ের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল।
‘ আমি আর কথা বলবো না। তুই কথা বল জুঁই। লোকটা কেমন কেমন করে যেন কথা বলে। আমার লজ্জা লাগে।
মায়ার কথায় নাক মুখ কুঁচকে জুই বলল…
‘ আমি কেন কথা বলতে যাব? তোর জামাই তুই কথা বল। তাছাড়া এসব বেফাঁস কথা তুই আগে শুরু করেছিস। তুই কেন আগে আগে বলতে গেলি তুই তাঁর বাচ্চার মা হুস। এখন তো সে এসব বলবেই। বাচ্চাদের খোঁজ নিবে না?
পাশ থেকে শ্রেয়াও জুইয়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল।
‘ ঠিক ঠিক জুই ঠিক বলছে! মায়া তুই আগে কথা শেষ কর। কলটা বেশিক্ষণ মিউট করে রাখলে লোকটা বুঝে যাবে আমাদের ফন্দি।
শ্রেয়ার কথায় মায়া তক্ষুনি কল আনমিউট করে ফের কলটা লাউডস্পিকার রেখে বলল।
‘ জান?
‘ হ্যাঁ জান। কল মিউট করে কোথায় গিয়েছিলে? বাচ্চারা কি কান্নাকাটি করে তোমাকে বেশি জালাচ্ছে? তুমি কি তাদের দুধ খাওয়াচ্ছ?
রিদের এমন ভয়ংকর ঠোঁট কাটা কথায় মায়া ভারী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসল। সাথে এটা ভাবলো মায়ার জামাই রয়েল না। সে ভিন্ন নারীর সাথে এমনই ফ্লাটিং করে বেড়ায়। মায়ার চোখে মুখে লজ্জা চেয়ে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হলো। ভারী হতাশ গলায় বলল..
‘ আপনার বাচ্চারা দুষ্টু! আপনার মতোই।
‘ না জান। এই ক্রেট তুমি নাও। আমার বাচ্চারা মা মতোই ন’টি হয়েছে।
মায়া যখন রিদের সাথে কথায় পেরে উঠছিল না, তাই অবশেষে হার মেনে বলল…
‘ আপনি আমাকে চিনেন?
‘ কেন চিনব না? তুমি মাত্রই আমার জম্ম নেওয়া বাবুদের আম্মু। তোমাকে না চিনলে হবে বলো?
মায়া হতাশার মুখ ভার করে চুপ করে রইল। মনটা খারাপ। মায়ার স্বামী অপরিচিত নাম্বারেও মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করে বেড়ায় এই কষ্ট মায়া কোথায় রাখবে? মায়ার কলিজাটা ভিষণ পুরছে। সে আর কথায় বলবে না। মায়াকে হুট করে চুপ হয়ে যেতে দেখে রিদ বলল।
‘ কি ম্যাডাম কথা শেষ? স্টক খালি?
‘ হুম।
‘ তো এরকম ফাজলামো কি আমার সাথেই প্রথম নাকি লিস্টে আরও আছে?
‘ আপনি প্রথম।
‘ আর আমিই যেন শেষ হয়। মনে রাখবেন।
মায়া চমকে উঠলো। তারমানে লোকটা ওকে চিনে এতক্ষণ কথা বলছিল? কিন্তু কিভাবে চিনলো? মায়াতো পরিচয় দেয়নি। তাহলে? মায়া অধৈর্য্যের গলায় তক্ষুনি জানতে চেয়ে বলল।
‘ আপনি আমাকে কিভাবে চিনলেন? আমিতো পরিচয় দেয়নি?
‘ আপনাকে চিনা আমার জন্য কঠিন কিছু নয় ম্যাডাম। বরং সহজ ভাবেই চিনে কথা বলছি। তবে ওয়ার্নিং দিচ্ছি! এই রকম ফাজলামো যেন অন্য কোনো ছেলে সাথে না হয়, নয়তো থাপড়িয়ে গাল ফাটিয়ে ফেলব স্টুপিড।
মায়া মিনমিন করে বলল…
‘ আপনি খালি বকা দেয়। গুরুত্ব দেন না।
‘ গুরুত্ব আগে অর্জন করো, তারপর!
‘ কল রিসিভ না করলে অর্জন করবো কিভাবে?
‘ জানি না।
রিদ একই ভাবে উদাস গলায় বলল কথাটা। মায়া রিদের কথায় কষ্ট পেয়ে বলল।
‘ আমার মন পুরে আপনার জন্য।
মায়া যেন হুট করেই রিদের মনে কথাটা বলে ফেলল। মন তো তারও পুরে বউয়ের জন্য। রিদ ভোঁতা মুখে কতক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে স্বভাবগত ভাবেই ত্যাড়ামি করে বলল…
‘ এসব মিথ্যা নাটকের ভাষা আমি বুঝি না। রাখছি।
রিদ কল কাটতেই মায়া ঠোঁট উল্টায়। লোকটা যে ত্যাড়া স্বভাবে হবে মায়া এতো দিনে বেশ কয়েকবার বুঝতে পেরেছে। আজকে আবার প্রমাণ হলো লোকটা আসলেই ত্যাড়া মানুষ। এই লোককে সোজা বানাতে বানাতে মায়া না আবার বাঁকা হয়ে যায় আল্লাহ জানে। তক্ষুনি নাদিয়া ব্যস্ত গলায় মায়াকে বলল…
‘ মায়ু তোর স্বামীতো অনেক ধুরন্ধর লোক। অপরিচিত নাম্বার থেকেও তোকে কেমন চট করে চিনে ফেলল।
‘ হুম।
কেমন হতাশা ভারি নিশ্বাস ফেলল মায়া। এই জামাইর খোঁজ সে ইহজীবনে আর পাবে কিনা আল্লাহ জানে।
~~
তারপর? তারপর দিন গুলো একই ভাবে কাটছে। নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজ না পাওয়ার উদাসীনতা যেন মায়ার দিনদিন বাড়ছেই। রিদ মায়ার সাথে ফোনে কথা বলে না। ঐ একদিনের অপরিচিত ভেবে ফোন আলাপ হয়েছিল ব্যস এতটুকুই। তারপর আরও একটা মাস কিভাবে কিভাবে যেন কাটলো। মায়া, জুই আরিফের সঙ্গে বাড়িতে এসেছে বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে। ফাহাদ বাবাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ফিরেছে গোটা এক সাপ্তাহ হলো। ফাহাদের বাবা এখন পুরপুরি সুস্থ না হলেও মোটামুটি ঠিকঠাক তিনি। উনার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশের ডাক্তারদের আওতায় আছে। ঔষধ চলছে আরকি। মায়ার পরিবারের সবারই গিয়েছিল ফাহাদের বাবকে দেখতে। মুক্তা যায়নি। আরও যায়নি মায়া আর জুই। ওদের না যাওয়ার পিছনে কারণ ছিল অবশ্য। দুই পরিবারের মানুষজন বসে আলাপ আলোচনা করে মুক্তা আর ফাহাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ের ডেট ফিক্সড করল সেজন্য। সামনে শুক্রবার বাদ রেখে এর পরের শুক্রবারের বিয়ে। মায়াদের বাড়ির মধ্যে হৈচৈ কান্ড। মায়া জুই কত্তো খুশি বোনের বিয়ে বলে কথা। খুশিতে আত্মহারা হয়ে লম্বা লিস্ট বানিয়েছে বিয়েতে কি কি কেনা কাটা করবে তা নিয়ে। মায়া বাবা খানিকটা চিন্তিত মুখে ছোট মেয়ে মায়ার উল্লাস দেখলেন। তিনি বেশ কয়েকদিন ধরেই একটা বিষয় নিয়ে চিন্তত। উনার ছোট ভাই জামাল সাহেবের সঙ্গেও এই বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। তিনি বড় ভাই শফিকুল ইসলামের উপর দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছে যাহ ভালো হয় তাই করতে। আপাতত শফিকুল ইসলাম তিনি দ্বিধায় ভুগছেন বলে, উনার বড় ছেলে আরিফকে ডেকে পাঠালেন জরুরি তলবে। খাবার টেবিলে সবাই বসে। মায়া, জুই খেয়েদেয়ে আগে আগে চলে গেল রুমে বোনের বিয়ে কেনাকাটা বাজারজাত তালিকা করতে। সেই ফাঁকে খাবার টেবিল খালি পেয়ে মনের কথা গুলো পরিবারের সামনে রাখতে চাইলেন শফিকুল ইসলাম। প্রথমে তিনি ছেলের মনোযোগ আর্কষণ করতে চেয়ে গলা ঝেড়ে বললেন।
‘ আরিফ তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা ছিল।
বাবা কথায় খাওয়া থেকে মুখ উঠাল না আরিফ। বরং খেতে একই ভাবে বলল।
‘ আমি শুনতে পারছি বাবা। বলো।
শফিকুল ইসলাম এক পলক উপস্থিত সকলের দৃষ্টি পরখ করে নিল। ছোট ভাই জামাল ব্যতীত কেউ উনার দিকে আপাতত তেমন মনোযোগ নেই। উনার স্ত্রী ছেলে মেয়েদের বেড়ে খাওয়াচ্ছে। ছোট ভাইয়ের বউ আরিফের পাতে তরকারি তুলে দিচ্ছে এমতাবস্থায় উনার কথা গুলো বলা অনুচিত হবে কিনা জানা নেই। তারপরও তিনি গম্ভীর গলায় ভারী আওয়াজে বলেন।
‘ মায়ার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলের বিয়ে প্রস্তাব এসেছে। আমি তাতে মত দিয়েছি।
অমনোযোগী চোখ গুলো হঠাৎ করেই চমকে উঠে শফিকুল ইসলামের দিকে তাকাল একত্রে সবাই। প্রত্যেকের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সবাই বেশ চমকিয়েছে উনার কথায়। উনি একত্রে এতো গুলো মানুষের দৃষ্টিতে পরে খানিকটা অপ্রস্তক হলো। এর মধ্যে আরিফ অসন্তুষ্ট গলা আওড়াল।
‘ মায়া এখানো এসব কিছুর জন্য ছোট বাবা। মাত্রই আমরা মুক্তার বিয়েটা দিচ্ছি। এর মধ্যে মায়ার বিয়ের কথা আসলো কোথায় থেকে? তাছাড়া তুমি এসব বিষয়ে মত দাও কিভাবে? মায়া সবার ছোট। ওর বড়ো জুইয়ের বিয়ে নিয়েই আমরা এখনো চিন্তা করিনি। সেখানে মায়ার বিয়ের কথা কিভাবে চিন্তা করো তুমি?
ছেলের রাগান্বিত মুখটার দিকে তাকিয়ে শফিকুল ইসলাম ভারী গলায় বলল…
‘ চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলেকে তোমার অচেনা নয় আরিফ। দেখাশোনা, লেখাপড়ায় বেশ দারুণ ছেলেটা। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট! আচার-ব্যবহারেও বেশ অমায়িক। ছেলেটা স্টুডেন্ট ভিসা পেয়ে অ্যামেরিকা যাচ্ছে। ঐখানে পড়াশোনা শেষ করে গ্রীন কার্ড পেয়ে বাংলাদেশে আসতে আরও পাঁচ বছর লাগবে। সেজন্য ওরা চাচ্ছিল ছেলেকে বিয়ে করিয়ে রাখতে মায়ার সঙ্গে, যাতে ঐখানে কাবিননামা দেখিয়ে বউয়ের জন্য ভিসা পাওয়া যায়।
আরিফ তাতেও তীব্র অমত পোষণ করে বলল…
‘ সামান্য একটা ভিসার জন্য তুমি মায়ার বিয়ে এক্ষুনি দিতে চাও বাবা? মায়া এখনো বেশ ছোট মানুষ, আঠারো হয়নি। এসব বিয়ের ঝামেলায় ওকে এই মূহুর্তে টানলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক, ততদিনে না-হয় ছেলেও পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকা থেকে ফিরুক। তারপর না-হয় বুঝ পরামর্শ করে দুজনের সম্মতিতে বিয়েটা দেওয়া যাবে বাবা।
আরিফের কথার অনিহা পোষণ করলো জামাল সাহেব ও শফিকুল ইসলাম। শফিকুল ইসলাম কিছু বলবে তার আগেই জামাল সাহেব আরিফের উদ্দেশ্য বলে…
‘ এই রকম ভালো সম্বন্ধ হাতে কাছে পেয়ে ফেরানোটা উচিত হবে না আরিফ। তাছাড়া আমরা এক্ষুনি মায়াকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছি না। চেয়ারম্যান সাহেবের বংশ ভালো। ছেলেটাও ভালো। আমাদের হাতের কাছের ছেলে। কতো নম্র ভদ্র। তাছাড়া ওরা শুধু চাচ্ছে দুই পরিবারের মধ্যে আকদ করে রাখতে। মায়া এক্ষুনি সংসার শুরু করবে না, ছেলে দেশে ফিরার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দেওয়া হবে মায়াকে। আমরা কেউ মায়ার খারাপ চাইব না আসিফ। বাপ-চাচার কথা একে বারে ফেলে না দিয়ে তুমি কিছু দিন সময় নাও। চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলো। ছেলেটাও পরখ করো। তোমার যদি কোনো কিছুতে খারাপ মনে হয় তখন না-হয় আমরা সম্বন্ধটা ফিরিয়ে দিব। কিন্তু কোনো যাচাই-বাছাই না করে হুট করে বিয়েটা ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আমি আর ভাই এই বিয়েটা নিয়ে বেশ কয়েক ধরে যাচাই করেছি খারাপ কিছু চোখে পরেনি। তুমি এই বাড়ির বড়ো ছেলে এবার দায়িত্ব তোমার। তুমি বিয়েটা নিয়ে যাচাই-বাছাই করো। মুক্তার বিয়েটা পযন্ত অন্তত সময় নাও। মুক্তা বিয়েটা পর না-হয় আমাদেরকে জানাও তোমার মতামত কি। তবে আমরা আশা করবো তুমি ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না। মায়া আমাদেরও মেয়ে হয়। ওর চিন্তা আমাদেরও আছে।
জামাল সাহেবের কথায় আরিফ হ্যাঁ বা না তেমন কিছুই বলেনি। শুধু ধীরস্থির ভাবে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ হলো। আরিফকে চুপ করে যেতে দেখে জামাল সাহেব বুঝলেন আরিফ ওদের কথায় সম্মতি জানিয়ে। সে এই বিয়েটা নিয়ে ভাববে। উপস্থিত সবাই খাবার টেবিলে নিশ্চুপ হয়ে খেতে লাগল। কেউ আর আগ-বাড়িয়ে কোনো কথা বলল না। শফিকুল ইসলাম খেতে খেতে নিরবতা ভেঙ্গে আবারও গম্ভীর গলায় বলল।
‘ তুমি চট্টগ্রামে ফিরে যাচ্ছে কবে?
‘ কাল রাতের ট্রেনে ফিরবো বাবা।
‘ আবার কবে আসবে?
‘ এক সাপ্তাহ পরই ফিরে আসব। হাতে কাজ গুলো শেষ করেই চলে আসব।
‘ মায়া আর জুই যাবে না তোমার সাথে?
‘ না বাবা। ওদের নিব না। এখন গিয়ে আবার এক সাপ্তাহ পর ফিরে আসাটা ঝামেলা হয়ে যাবে। ওরা থাক। বিয়ের শপিং টপিং করুক। আমি খুব জলদি ফিরে আসব।
‘ হুম!
খাবার টেবিলে খাওয়ার দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই যার যার মতো করে চলে গেল। অথচ মায়া জানলই না ওর অগোচরে ওর বিয়ের তোরজোর চলছে বড়দের মধ্যে। আরিফ বাপ-চাচার কথা মতো সে চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলে নাদিমের সঙ্গে দেখা করলো। নাদিমকে আরিফের বেশ ভালোই লাগল। বেশ আন্তরিকতা ছেলে। তেমন খারাপ কিছু চোখে পরেনি। তারপরও আরিফ এই মূহুর্তে তার মতামত দিতে পারলো না। ভাবল আগে মুক্তার বিয়েটা শেষ করুক তারপর না-হয় সে এই বিয়েটা নিয়ে চিন্তা করবে।
#চলিত….
#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
২৭
[ কপি করা নিষেদ্ধ ]
গ্রীষ্মকালীন তপ্ত রোদে গা জ্বলা ভাব। অল্পতে গায়ে আগুন লাগার মতোন তাপমাত্রা। যান্ত্রিক শহরের কর্মজীবি মানুষজন এতটাই ব্যস্ত যে তপ্ত রোদের প্রখরতা বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি তাদের ব্যস্ততায়। বরং চাকরিজীবী শুরু করে রিকশাওয়ালা পযন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদের রোজকার কর্মে ব্যস্ত। এমন একটা কাঠফাটা তপ্ত রোদ মাথায় নিয়েই ঢাকা বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স শপিং মহলে সামনে উপস্থিত হলো আরিফ। সঙ্গ তার তিন-বোন। মুক্তা, মায়া, জুই। মূলত আজ মুক্তার বিয়ের শপিং। আর তার জন্য ফাহাদের পরিবার থেকে ডাক পরেছে ওদের। বিয়ের মাত্র আর পাঁচদিন বাকি। অথচ এখনো বিয়ের শপিং করা হয়নি বলে জরুরি তলবে মুক্তাকে নিয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে আরিফকে। প্রথমে ফাহাদ যেতে চেয়েছিল আশুগঞ্জ থেকে মুক্তাকে নিয়ে আসতে কিন্তু আরিফ বড়ভাই হিসাবে ফাহাদকে আসতে মানা করল সে নিয়ে যাবে বলে। আসল কথা বিয়ের কেনাকাটা কনে পক্ষের বাকি। এবার হাতে হাতে তারাও বিয়ের কেনাকাটা করে ফেলতে চাই আজ। আরিফ মলের বাহিরে পার্কিং এরিয়াতে আসতে দেখা পেল খান পরিবারের মানুষদের। ফাহাদের পরিবার হতে শুরু করে হেনা খান, আরাফ খান সকলেই উপস্থিত। তোড়জোড় করে যে সবাই চলে এসেছে শপিংয়ে সেটা বুঝতে বাকি নেই আরিফের। আরিফ হেনা খানদের উদ্দেশ্য এগিয়ে যেতে যেতে এক পলক তাকাল উপস্থিত সকল সদস্যের দিকে। খান বাড়ির মহিলা সদস্যদের মধ্যে সবাই উপস্থিত আছে কেউ বাদ পরেনি। শুধু ছেলেদের সংখ্যা কম দেখল গুটি কয়েক বডিগার্ড আর পাঁচজনের মতোন পুরুষ মানুষকে চোখে পরলো শুধু। তাদের মধ্যে আরাফ খান, বর হিসাবে ফাহাদ, বাকি তিনজন তাগড়া ছেলেদেরকেও আরিফ চেনে। চোখের দেখা দেখেছিল কয়েকবার ছেলেগুলোকে। এক দুইবার কথাও হয়েছিল। সোহাগ, সৌরভ আরাফ খানের বড় মেয়ের দুই ছেলে। তাঁরা জমজ আরিফের পাশাপাশি বয়স। বাকি একজন ফাহাদের ছোট ভাই সুমন। এবার অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার্সে পড়ছে। আরিফের দুই বছরের জুনিয়র। এছাড়া আরিফের আর কাউকে চোখে পরলো না। এমনকি রিদ, রিদের বাবা, মা, ভাইকেও না। আরিফ জানে রিদ খানের মতোন মানুষ কক্ষুনো এসব মেয়েলি শপিংয়ে আসবে না। কিন্তু রিদের মা আর ছোট ভাই রাদিফের অনুপস্থিতি কারণটা বুঝল না সে। তাঁরা তো আসতেই পারে নাকি? তাছাড়া আয়ন ভাইকে আশেপাশে কোথাও চোখে পরলো না আরিফের। কিন্তু আয়নের মা-বোনকে ঠিকই দেখা যাচ্ছে হেনা খানের পাশে। আরিফ খান পরিবারের সাথে মিলিত হতেই নম্রতা নিয়ে সকলের সঙ্গে কৌশল বিনিময় করল। মুক্তা পা ছুঁয়ে শশুর বাড়ির গুরুজনদের সালাম করলো এর মাঝেই। অন্তত খুশি মনে মুক্তাকে গ্রহণ করলো হেনা খান। মায়া জুইকেও বেশ আদুরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। সবার যখন ভালো মন্দ কুশলাদি পর্ব শেষ হলো তখন সবাই একত্রে ঢুকলো মলের ভিতরে। হেনা খান, নিজের মেয়েদের নিয়ে মুক্তার জন্য একেকটা সেকশন থেকে একেকটা জিনিস কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পরলে আরিফ আরাফ খানকে জানিয়ে মায়া আর জুইকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেল নিজেদের কেনাকাটা করতে। পরিবারে মা,বাবা ভাই, বোন, চাচা, চাচি, সঙ্গে আত্মীয়ধর মেয়েদের হলুদের শাড়ি গহনাপত্র সবকিছু আরিফ মায়া আর জুইয়ের পছন্দের কেনাকাটা করছিল ঠিক তক্ষুনি আরিফের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে করতে কোথা থেকে শপিং মলে হাজির হয় চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলে নাদিম। আরিফ আগে থেকে জানতো নাদিম আসবে। নাদিম নিজের স্কলারশিপের ভিসার দৌড়াদৌড়ি জন্য ঢাকা থাকছে নিজেদের ফ্ল্যাটে। সেজন্য আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই মূহুর্তে চলে আসল শপিংমলে। চলে আসল বলতে নাদিমকে আলাদা ভাবে দাওয়াত করা হয়েছে আরিফদের পরিবার থেকে। মূলত মুক্তার বিয়ের জন্য মায়ার পরিবার থেকে বিশেষ ভাবে চেয়ারম্যান সাহেবের পরিবারকে দাওয়াত করা হয়েছে। আর সেজন্য চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির মানুষজনের টুকটাক যাতায়াত বেড়েছে মায়াদের বাড়িতে। মায়া-জুই এসবের কিছু জানে না। আর না কেউ তাদের এসব বিষয়ে অবগত করেছে। নাদিমের সঙ্গে আরিফের মলের ভিতরে দেখা হতে নম্রতায় হাত মিলিয়ে সালাম দিতে দিতে নাদিম বলল…
‘ ভাইয়া ভালো আছেন?
‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ তুমি?
‘ জ্বি ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ আছি। আব্বু পাঠাল আমাকে। বলল আপনারা এখানে এসেছেন, আপনাদের খেয়াল রাখতে। আসতে রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো ভাইয়া? আঙ্কেল আন্টি, বাসার সবাই ভালো আছেন?
সৌজন্য বজায়ে আরিফও হাসলো। নাদিম আরিফের চেয়ে বছর দুইয়েকের ছোট হবে। অথচ ব্যবহারের সে বরাবরই মুগ্ধ হয়। তবে আজ এখানে নাদিমকে আসতে অনুমতি দেওয়ার কারণ হলো সে ক্ষুতিয়ে দেখতে চাই নাদিম মায়ার জন্য কতটুকু ভালো হবে। তাছাড়া বিয়ে ঠিক হওয়া পর পাত্র হিসাবে আজকাল ছেলেমেয়েদের মতোন অশালীন হয়ে পরবে মায়ার সাথে নাকি সত্যি ভদ্রতা বজায় রেখে চলবে সেটার জন্যই আরিফ আজ সারাদিন নাদিমকে নিজেদের সঙ্গে রাখবে বলে ঠিক করলো। তাছাড়া আজকাল লোক দেখানো ভদ্রতা সবাই দেখায়। তবে চোখের দেখা ভদ্রতা যে সবসময় সঠিক হবে এমনটাও না। সে তার আদুরে বোনকে এভাবে কারও হাতে তুলে দিব না যতক্ষণ না পর্যন্ত আরিফের মনের খচখচ দূর হচ্ছে ততক্ষণ পযন্ত।
‘ আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। তবে আমাদের আসতে রাস্তায় তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তুমি এসেছো ভালো হয়েছে। চলো সামনে যায়। ওরা সবাই সামনের দোকানে আছে।
‘ জ্বি চলুন।
আরিফ নাদিমের সঙ্গে সামনে হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইল..
‘ তোমার পরিবার কেমন আছে নাদিম।
‘ জ্বি ভাইয়া,আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।
‘ তোমার স্কলারশিপের কি হয়েছে?
‘ ভিসা প্রসেসিং কাজ শেষ। আশা করছি সামনে মাসের দশ তারিখে ভিতরে ফ্লাইট পরবে।
আরিফ ঘাড় বেঁকে তাকাল নাদিমের দিকে। তীক্ষ্ণ গলা বলল…
‘ আজকে তো ষোলো তারিখ মনে হয়?
‘ জ্বি।
‘ তাহলে তুমি দেশে আর চব্বিশ দিনের মতো আছো?
‘ জ্বি আরও কম হবে।
আরিফ আর কথা বাড়াল না। হাঁটতে হাঁটতে ভাসা ভাসা চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল দোকানে ভিতর মায়া আর জুই এক রকম দেখতে ড্রেস নিজেদের জন্য পছন্দ করছে। মায়া মুখের মুক্ত হাসিটা চোখে বিঁধল আরিফের। সবার ছোট বোন মায়া। ওকে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আরিফের ছিল না। কিন্তু যদি সবকিছু ঠিকঠাক হয়। বা নাদিমের মধ্যে তেমন খারাপ কিছু চোখে না পরে, তাহলে হয়তো মুক্তার বিয়ের পর সাপ্তাহেই মায়ার বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় করবে চেয়ারম্যান সাহেব। ইতিমধ্যে আরিফকে রোজ কয়েকবার করে চেয়ারম্যান সাহেব কল দিয়ে সৌজন্যতা যোগাযোগ করে। খোঁজ খবর নেয়। আরিফ বেশ বুঝতে পারে মায়াকে ছেলের বউ হিসাবে উনাদের অনেক পছন্দ হয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা করিয়ে রাখতে চান। শুধু যে চেয়ারম্যান সাহেবের পরিবারের মায়াকে পছন্দ হয়েছে এমনটা না। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারে নাদিমও আসিফকে আশ্বস্ত করে সে মায়াকে ভালো রাখবে। তার নিজেরও মায়াকে পছন্দ হয়েছে বেশ। সারাদিন পার করে রাত আটটা বাজল ফাহাদের বিয়ের শপিংয়ে ইতি টানতে টানতে। তবে মায়াদের শপিং বিকাল দিকেই শেষ হয়েছিল কিন্তু খান পরিবারের জন্য তাঁরা বসে ছিল ততক্ষণ। নাদিম নিজের সঙ্গে আনা গাড়িতে মায়াদের শপিং ব্যাগ গুলো গুছিয়ে রাখল হাতে হাতে। তারপর আরিফকে সঙ্গে নিয়ে মলের ভিতরে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো মায়াদের দিয়ে। ওরা চারজন খাওয়ার দাওয়া করে নিবে সেটা দৃষ্টিকটুর দেখায় বলে, খান পরিবারের সকলের জন্য খাবার প্যাক করলো নাদিম যারা শপিং রেখে খেতে আসতে নারাজ ছিল তাদের জন্য। বাকি ছেলেরা সবাই ঠিক আসল খেতে। আরাফ খান, ফাহাদ, সৌরভ, সোহাগ, সুমন, সেঁজুতি তারা সবাই আরিফের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসল। সখ্যতা বজায়ে দুই টেবিল নিয়ে সবাই একত্রে বসে খেল। চমৎকার বিষয় হলো নাদিমের প্রাণচাঞ্চল্যতার কারণ খান বাড়ির সকলেই অতি অল্প সময়ে মিশে গেল তার সাথে। আরাফ খানের তো সেই ভাব হলো নাদিমের সঙ্গে। ছেলেটাকে উনার বেশ মনে ধরেছে। বৃদ্ধ বয়সে তিনি মানুষ চিন্তে ভুল করে না। ছেলেটা আসলেই দারুণ। ফাহাদ সঙ্গেও জমিয়ে সখ্যতা দেখা গেল নাদিমের। আন্তরিকতা নিয়ে এটা সেটা সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে সে। যেহেতু মায়া, জুই সেঁজুতি মেয়ে মানুষ সেজন্য ওদের আলাদা টেবিলে বসানো হলো। নাদিম খাবার ফাঁকে ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন তাকাল। মায়াদের টেবিলে খাওয়ার দাওয়া হচ্ছে কিনা সেটাও খেয়াল করলো। আরিফ সবটা তীক্ষ্ণ নজর পরখ করলো। নাদিম খাওয়ার এক পযার্য়ের ওয়েটারকে ডেকে পাঠাল। আস্ত করে কিজানি বলল। কিন্তু তারপরই ওয়াটার তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে চলে গেল। তার একটু পরই ট্রে-তে আলাদা খাবার নিয়ে ফিরলো। অথচ সবার খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষের দিকে, এখন আবার নতুন খাবার কে খাবে? আরিফের মনে প্রশ্ন জাগতে দেখল ওয়েটার মায়ার দিকে এগুচ্ছে। আরিফ তীক্ষ্ণ নজরে মায়ার প্লেটের দিকে তাকাল। তাদের সবার খাওয়াতে দাওয়া প্রায় শেষ দিকে কিন্তু মায়া তখনো বসে বসে খাচ্ছে। প্লেটের ভরপুর খাবার দেখে যেকেউ বলবে মায়ার আরও ঘণ্টা খানিক সময় লাগবে এই খাবার শেষ করতে। এর মাঝেই ওয়েটার ট্রে-তে করে মায়ার জন্য আলাদা খাবারটা নিয়ে এগিয়ে গেল। মায়ার মাংস ভাতের প্লেটটা হাত থেকে টেনে নিতে মায়া চোখ উঁচিয়ে তাকাল ওয়েটারের দিকে। বিনা শব্দে মায়া খাবার প্লেট ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে নিল। বেশ বুঝায় যাচ্ছে সে মাংস ভাত খেতে পারছে না। তবে নাদিমের পাঠানো আলাদা ট্রে-তে করে বাকি খাবার গুলো মায়াকে বেশ সাচ্ছন্দ্যে খেতে দেখা গেল। মায়ার সেই সাচ্ছন্দ্যবোধটুকু নজর কাটলো আরিফের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়াকে এক পলক দেখে আরিফ খেতে খেতে তাকাল নাদিমের দিকে। খাবার পাঠিয়ে ছেলেটা আর মায়ার দিকে তাকায়নি। বরং এটা সেটা নিয়ে আরাফ খান ও ফাহাদের সঙ্গে হাস্যজ্জল মুখে কথা বলছে। মায়ার প্রতি নাদিমের নিশ্চুপ খেয়াল রাখাটা বেশ নজরে লাগল আরিফের। নাহ নাদিমকে ছেলেটা খারাপ না। খাওয়া দাওয়া পার্ট চুকিয়ে গেল সবাই। খাবার বিল দেওয়ার সময়ও নাদিমকে দেখা গেল। সে আরিফ বা ফাহাদ কাউকে বিল দিতে দেয়নি বরং নিজ দায়িত্বে সব বিলের ঝামেলা সে মিটিয়ে নিল। এই আন্তরিকতাটুকু আরিফের ভালো লাগল। বিয়ে হবে কিনা ঠিক নেই। অথচ সে তার আন্তরিকতা দেখিয়েই যাচ্ছে। দীর্ঘ আট ঘন্টা টানা শপিংয়ে পর খান পরিবার সকলের শপিং শেষ করেই ক্লান্তিতে সবাই গাড়িতে চড়ে বসল। মায়াও বেশ ক্লান্ত। আরিফ এই রাতে আশুগঞ্জ ফিরে যেতে চাইলে, হেনা খান বগল থাবা করে ওদের সবাইকে নিয়ে আসল খান বাড়িতে। নতুন আত্মীয় বলে কথা। রাতে খাবারের আগে অন্তত তিনি যেতে দিতে নারাজ। খান বাড়ির সঙ্গে আনা চারটি গাড়িতে সবাই যার মতো করে উঠে গেল। মুক্তাকে বসানো হলো ফাহাদের গাড়িতে শাশুড়ী সঙ্গে। মায়া, জুই, সেঁজুতি বসলো নাদিমের গাড়ির পিছনে সিটে। নাদিম ড্রাইভিংয়ে। আরিফ পাশের সিটে বসতে গাড়ি ছুটলো খান বাড়ির গাড়ির পিছন পিছন। যেহেতু নাদিম আরিফের সঙ্গে এসেছে তাই তারও দাওয়াত পরলো খান বাড়িতে রাতের ডিনারের। ডিনার শেষে সবাই একত্রে আবারও নাদিমের গাড়িতে করে আশুগঞ্জ ফিরে যাবে এমনটাই সিদ্ধান্ত। ক্লান্তিতে হৈচৈ করে সবাই বসে পরলো খান বাড়ির ড্রয়িংরুমে। ছোট বড় পঁচিশ সদস্যে ভরপুর ড্রয়িংরুম। গাড়ি থেকে নেমে মায়া জুই আর সেঁজুতি একত্রে খান বাড়ির ভিতরে পথে হাঁটছিল। মায়া বেশ অস্থির। বারবার ভয়ার্ত চোখ জোড়া এদিক সেদিক ছুটে যাচ্ছে রিদের ভয়ে। মায়া সাহস করে তো খান বাড়িতে ঢুকে পরলো এখন পাছে না আবারও রিদের মুখোমুখি হয়ে যায় সেই ভয় পেল। লাস্টবার দুজনের সাক্ষাৎকারটা খুবই ভয়ংকর ছিল। রিদের রাগের স্বীকার হতে হয়েছিল মায়াকে। এখন যদি পুনরায় এসব কিছু আবারও এখানে ঘটে তাহলে মায়ার আর সম্মান থাকবে না। ভয়ে ধুরধুর বুকে মায়া জড়সড় হয়ে হাঁটল জুইয়ের সাথে। ওদের সঙ্গ দিয়ে পিছু পিছু আরিফ আর নাদিমকেও হাঁটতে দেখা গেল। খান বাড়ির ড্রয়িংরুমে পৌঁছাতে মায়া অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মুখোমুখি হলো শশীর সঙ্গে। হেনা খানের সঙ্গে ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে সবাই জন্য শরবতের গ্রাস ট্রেতে তুলে রাখছে। ঠোঁটে কোণে মিষ্টি হাসি। আরাফ খানের সঙ্গে মুক্তাকেও দেখা গেল ডাইনিংয়ের একটা চেয়ারে বসা। বাকিরা সবাই শরবত পান করেই যার যার রুমে অবস্থা করছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। হেনা খান মায়াদের ডাকল ডাইনিংয়ের বসতে। গুটি গুটি পায়ে সবাই সেদিকে গেল। একে একে চেয়ার টেনে বসে শরবতের গ্লাস গ্রহণ করলো। মায়া শরবতে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বেশ কয়েকবার শশীকে দেখে নিলো। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শশীকে দেখা মায়ার। প্রথমবার যদিও মায়া এতো লক্ষ করেনি বিয়ের ঝামেলায়। কিন্তু শ্রেয়ার মুখে শশী নামটা শুনে মায়া এখন মনোযোগ দিয়ে শশীকে বেশ কয়েকবার পরখ করলো আড়চোখে। শশী মেয়েটা দেখতে দারুণ। যেমন লম্বা তেমন সুন্দর, ব্যবহারে ঠিক তেমনই ভদ্রতা। কাপড়-চোপড়েও বেশ শালীনতা রয়েছে। অশালীন কিছুই চোখে পরলো না। একটা টু-পিসের জামা পরে ওড়নাটা কাঁধের দু’পাশে দেওয়া। কথাবার্তায় বেশ স্মার্ট। কার কি লাগবে নাকি সেটাও সে নিজ দায়িত্ব দিচ্ছে। মায়া আরও একবার অকারণেই শশীকে দেখলো। মেয়েটিকে বেশ মনে ধরেছে মায়ার। রিদ খানের সঙ্গে মানাবেও ভালো। মায়া শ্রেয়ার মুখে শুনেছিল রিদ খান এই শশী মেয়েটির সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে রিলেশনে আছে। সামনে হয়তো বিয়ে করবে। মায়ার মনে হলো এই দুজনের বিয়ে হলে মন্দ হবে না বরং ভালোই হবে। দুজনকে মানাবে ভালো। তবে এতো সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড রেখে কেন যে রিদ খান মায়াকে পরকীয়ার মতোন এতো বাজে প্রস্তাব দেয় আল্লাহ জানে। এই লোকের আসলেই চরিত্রে সমস্যা আছে নয়তো সবসময় মায়ার সাথে কেন ঘেঁষাঘেঁষি করতে চাইবে এই লোক? ডাইনিংয়ে বসে সকলের হাল্কা পাতলা নাস্তা করার মধ্যে কোথা থেকে হুট করে আয়ন এসে ধুপ করে মায়ার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে পরলো ক্লান্তিতে। সকলে চমকে উঠে আয়নকে কিছু বলবে তার আগেই আয়ন শশীর হাত থেকে একটা শরবতের গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে শেষ করল। ঠাস করে টেবিলের উপর গ্লাসটা রাখতে রাখতে সরকারি চোখ গেল মায়া আর জুইয়ের দিকে। চোখের পলকে আরিফ, নাদিমকেও দেখে নিল এক পলক। কিন্তু মায়া মুখোমুখি বসায় আয়ন হাতের গ্লাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল…
‘ আরের ছোট বিয়াইন যে। তা ভালো আছো?
মায়া বেশ উৎফুল্লতায় বলল…
‘ জ্বি ভাইয়া ভালো! আপনি কেমন আছেন?
‘ এইতো ঠিকঠাক! বোনের বিয়ের শপিং করা শেষ?
‘ জ্বি ভাইয়া শেষ।
‘ তাহলে তো বেশ বড়সড় ঝামেলা চুকিয়ে ফেলছ তোমরা! মেয়েদের শপিং, বাপরে সাংঘাতিক ঝামেলা।
আয়নের কথায় মায়া ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। আয়নের চোখে লাগার মতো বিঁধল সেই হাসিটা। তারপরও সে কৌশলে চোখ সরিয়ে তাকাল মায়ার পাশে বসা জুইয়ের দিকে। মনোযোগ সহকারে ফল খাচ্ছে সে। আয়ন একে একে আরিফ নাদিমের সঙ্গেও কুশলাদি বিনিময় করলো। যদিও সে নাদিমকে চিনে না কিন্তু তারপরও যেহেতু আরিফের সঙ্গে বসা তারমানে মায়াদের কোনো আত্মীয় হবে ভেবেই সৌজন্য বজায় রেখে কথা চালাল আয়ন নিজের মধ্যে। আয়নের কথার ফাঁকে হেনা খান জানতে চেয়ে বলল…
‘ তুই এই সময়ে এই বাড়িতে? তোর না ডিউটি আছে রাতে?
‘ আছে নানু! কিন্তু তিনঘন্টার নিভ নিয়েছি।
‘ তুই কি একা এসেছিস? রাদিফ আসেনি?
‘ না রাফিস দেশে নেই। রিদকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
হেনা খানের আর কিছু বলার আগেই শশী পাশ থেকে উৎফুল্লতা দেখিয়ে জানতে চাইল…
‘ রিদ ভাই এসেছে বুঝি?
আয়ন এক পলক মায়াকে দেখল। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই খাচ্ছে। শশী যে রিদের কথা জানতে চাইছে আয়নের কাছে সেটা নিয়ে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না মায়ার মধ্যে। আয়ন বুঝতে পারলো মায়া এখনো রিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের অবগত নয়। আয়ন মায়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শশীর লাজুক মুখটার দিকে এক পলক তাকিয়ে উত্তর দিতে দিতে বলল…
‘ হ্যাঁ এসেছে তোর রিদ ভাই। গিয়ে দেখ বাহিরে পেয়ে যাবি।
আয়নের কথায় শশী এক গ্লাস শরবত তুলে দ্রততায় ছুটল বাহিরের দিকে রিদের উদ্দেশ্য। হেনা খান, আরাফ খান শশীর লাজুকলতার মুখটা দেখে হাসলো। আয়ন এতক্ষণে জুইয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। আয়ন এসেছে পর থেকে এই নিয়ে বেশ কয়েকবার জুইকে সে আড়চোখে পরখ করেছে। কিন্তু মেয়েটা সেই কখন থেকে মনোযোগ দিয়ে নাস্তা খেয়েই যাচ্ছে। আয়নকে চোখের দেখা পযন্ত দেখছে না। আশ্চর্য আয়ন যে এসেছে মেয়েটার ভাবান্তর নেই কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা না। আয়ন যে আজ আসবে এই মেয়ে তো জানতো? আয়নের জন্য জুইয়ের অপেক্ষা করে বসে থাকার কথা ছিল তাহলে? আয়ন জুইয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…
‘ জুই আমাকে তরমুজ কাটা প্লেটটা দেনতো।
জুই চোখ তুলে সরকারি তাকাল আয়নের দিকে। লোকটার উপস্থিত সে দেখেছিল। কিন্তু তেমন পাত্তা দেওয়ার মতোন কিছু হয়নি বলে নিজের নাস্তা শেষ করছি। হঠাৎ আয়নের ডাকে সরাসরি তাকানোতে চোখাচোখি হলো দুজনের। আয়ন তখনো তাকিয়ে। জুই চোখ ঘুরিয়ে দেখল আয়নের হাতের কাছেই আরও একটা প্লেটে তরমুজ কাটা আছে। সেটা আয়ন চাইলেই নিয়ে খেতে পারে। অথচ আয়ন জুইকে দেওয়ার তরমুজের প্লেটটা চাচ্ছি। সৌজন্য বজায়ে জুই আস্তে করে নিজের ফল কাটা প্লেটটা এগিয়ে দিতে আয়ন সেটা নিজের কাছে টেনে নিলো। কাটা চামুচ লাগিয়ে মুখে তুলতে তুলতে আবারও জুইকে বলল…
‘ জুই আমাকে আমের প্লেটটাও দেন।
জুই এইবারও হাতে হাতে আয়নকে আমের প্লেট এগিয়ে দিল। আয়ন সেটা নিতে আবারও বলল…
‘ পানি গ্লাসটা দেন।
জুই এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়নের দিকে তাকিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল। লোকটার সাথে জুইয়ের যতবার দেখা হয় ততবারই জুইকে দিয়ে সে নিজের কাজ করায়। কিন্তু কেন? সেটা জানে না জুই। বাড়িতে আসা মেহমানকে দিয়ে যে কাজ করানো যায় সেটা আয়নকে না দেখলে হয়তো জুই জানতো না। আয়ন জুইয়ের থেকে পানি গ্লাসটা নিতে নিতে সবার অগোচরে জুইকে একটা চোখ মারলো। আয়নের হঠাৎ কান্ড হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল জুই। এই লোক হঠাৎ জুইকে চোখ মারলো কেন? জানা নেই জুইয়ের। শুধু স্তব্ধ নির্বাক হয়ে বসা রইল। তবে জুইয়ের মনটা বেশ পুড়ছে রাদিফের জন্য। ঢাকা আসার আগেই রাদিফের সঙ্গে জুইয়ের কথা হয়েছিল। রাদিফ বলেছিল আজ খান বাড়িতে আসবে জুইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। জুই যেন অপেক্ষা করে বসে থাকে তার জন্য। আর সেই থেকে জুই রাদিফের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে তাহলে এখন রাদিফ দেশের বাহিরের থাকে কিভাবে? কিছুক্ষণ আগেও তো দুজনের কথা হয়েছিল রাদিফ জুইকে বলেছিল সে রাস্তার জ্যামে বসে আছে। তবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। এখন জুইকে অপেক্ষা করিয়ে রাদিফ আসল না। উল্টো আয়নের মুখে শুনতে হচ্ছে রাদিফ দেশে নেই।
~
সকলের খাওয়াদাওয়া মধ্যে রিদ মেইন দরজা দিয়ে খান বাড়ির ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতে করতে বেখেয়ালি চোখ পরলো ডাইনিংয়ে। সেখান থেকে বেশ কথাবার্তা আর হাসাহাসি শব্দ আসছে। রিদ প্রথমে গম্ভীর আর স্বাভাবিক নেয় তাকালেও কয়েক সেকেন্ড মধ্যে ভ্রুর কুঁচকে গেল মায়ার পাশে অপরিচিত ছেলে নাদিমকে বসে থাকতে দেখে। যদিও নাদিম বা মায়ার মধ্যে তেমন কোনো কথাবার্তা হচ্ছিল না। তারপরও মায়ার পাশে নাদিমের বসার বিষয়টি পছন্দ হয়নি তাঁর। ডাইনিংয়ের স্পেস বড়। মায়া অন্য কোনো একটা খালি চেয়ারে বসলেই হতো। কিন্তু তা না করে অপরিচিত ছেলে পাশাপাশি বসাটা রিদের অপছন্দের কারণ হলো।
রিদ সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই ডাইনিং থেকে হেনা খান রিদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে ডাকল রিদকে। রিদ সরু চোখে তাকাল হেনা খানের ব্যস্ত পথ চলার দিকে। তারপর চোখ ঘুরাল পুনরায় মায়ার দিকে। হেনা খানের ডাকে উপস্থিত ডাইনিং টেবিলের সকলে ঘাড় ঘুরিয়ে ততক্ষণে রিদের দিকে তাকিয়েছে। মায়াও হেনা খানের ডাকে চমকে উঠে তৎক্ষনাৎ পিছনে ঘুরে তাকাতেই চোখাচোখি হলো রিদের সাথে। মায়া ভয়ার্ত দৃষ্টি রিদ থেকে নামিয়ে নিতে গিয়ে চোখ পরলো রিদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা শশীর দিকে। তারপর তাকাল শশীর হাতে থাকা খালি শরবতের গ্লাসটার দিকে। রিদ শশীর দেওয়া শরবতটুকু পান করেছে সেটা বুঝতে পেরে, মায়া কি মনে করে আবারও রিদের দিকে তাকালে পুনরায় চোখাচোখি হলো দুজনের। রিদ তখন থেকেই ভ্রুঁ কুঁচকে চেয়ে আছে মায়ার দিকে। আর রিদের চেয়ে থাকার কারও হলো মায়ার পাশে বসে থাকা নাদিম। নাদিম মায়ার দিকে আম কাটা ফলের প্লেটটা এগিয়ে দিচ্ছে মায়ার অগোচরে খাওয়ার জন্য। কিন্তু মায়ার পিছন মুড়ে রিদের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য হয়তো সেটা লক্ষ করেনি। কিন্তু রিদের বাজপাখি নজরে সেটা মূহুর্তে ধরা পরলো। মায়া হঠাৎ করেই কেন জানি আরও একবার পরখ করলো রিদকে তাও মনোযোগ দিয়ে। রিদকে বড্ড ক্লান্ত দেখাল। চোখে মুখে বেশ ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু তারপরও মুডি রিদ খানের এটিটিউড কমলো না। গায়ের কোর্ট বামহাতের ভাজে ফেলে ডানহাতটা ডান পকেটে গুঁজে মায়ার দিকে চেয়ে আছে বাজপাখির দৃষ্টিতে। যেন চোখ দিয়ে গুলি করবে মায়াকে। মায়া জড়সড় হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে আবারও তাকাল রিদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শশীর দিকে। রিদ আর শশীকে পাশাপাশি সুন্দর লাগছে। দুজনের হাইটে হাইটে মিলে যাচ্ছে। যদিও শশী রিদের মতোন অতো লম্বা নয় তারপর বেশ দারুণ লাগল মায়ার চোখে। লম্বা ছেলেদের লম্বা প্রেমিকায় মানায়। আচ্ছা শশীর হাইট কতো হবে? ৫’৬ নাকি ৫’৭? রিদকে দেখে হেনা খানের পাশাপাশি আরিফও নাস্তার টেবিল ছেড়ে এগিয়ে আসল রিদের সাথে কথা বলার জন্য। এর মধ্যেই শশী রিদকে উদ্দেশ্য করে রিন রিনিয়ে বলল…
‘ তোমাকে কফি করে দিব?
‘ দে!
‘ রুমে দিয়ে আসব নাকি এখানে…
‘ রুমে দে!
শশীর কথার মাঝে রিদ অল্প কথায় উত্তর করলো। শশী হেনা খানকে পাশ কাটিয়ে বিনা বাক্যে হাঁটল কিচেনের দিকে। মায়া শুধু দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ নিশ্চুপ চোখে। রিদ শশীর কথাবার্তা আচার-আচরণে মায়ার মনে হলো দুজনের মধ্যে বেশ গভীর সম্পর্ক। এমনকি দুজন দুজনার সঙ্গেও অনেক ফ্রী। হয়তো রোজকার রুটিনমাফিক শশী এমন করেই রিদের হেয়াল রাখে। অন্তত রিদের স্বাভাবিক আচারের মায়ার তেমনই ঠেকল। রিদের ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকা মায়া মন হঠাৎ করেই যেন মন খারাপ হলো। উদাস মনে রিদ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে ঘুরে বসল। নাদিমের বাড়িয়ে দেওয়া আমের প্লেট থেকে আম তুলে কামড় বসাতে বসাতে ভাবল, আজ মায়ার নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পেলে হয়তো মায়াও এমন খেয়াল রাখতো নিজের স্বামীর। সকাল বিকাল সেও শশীর মতোন করে নিজের ভালোবাসার মানুষকে কফি আর শরবত করে খাওয়াত। আসলে মায়ার কপালটায় খারাপ নয়তো স্বামীকে খোঁজে পেয়েও পাচ্ছে না কেন? কোথায় যে আছে মায়ার স্বামীটা আল্লাহ জানে।
~~রাত তখন দশটার ঘরে। আরিফ নাদিমকে নিয়ে আরাফ খানের সঙ্গে আড্ডা জমিয়েছে ড্রয়িংরুমে। মায়া এতক্ষণ সেখানে ছিল কিন্তু হঠাৎ করে মনে হলো মায়ার স্বামীকে একটা ফোন করা দরকার সেজন্য হাতের ফোনটা নিয়ে আস্তে করে উঠে এসে বসল খান বাড়ির বাগানে থাকা খোলা বাংলোতে। বাগানের ভিতর থাকা জায়গা জায়গায় কর্ডা লাইটিংয়ে কারণে রাতের অন্ধকার ভাবটা তেমন বুঝা যায় না। বেশ উজ্জ্বল আলোয় দিনের মতোই লাগছে পরিবেশটা। চারপাশে বেশ বডিগার্ডের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মায়া বন্দুক হাতে। মায়া উদাস মনে খোঁজে খোঁজে স্বামীর নাম্বারে কল লাগাল। যদিও মায়া জানে লোকটা ওর ফোন রিসিভ করবে না তারপরও মায়া রোজ করে লোকটাকে কল দেয়। মান অভিমান কতো দিন করে থাকবে লোকটা মায়ার উপর? একদিন না একদিন ঠিকই ভেঙ্গে যাবে। মায়ার চেয়ারে বসে ফোনটা টেবিলের উপর রাখল। একগালে হাত রেখে ফোনের উপর ঝুকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের ডায়েলকৃত নাম্বারের দিকে। সেখানে রিদের নাম্বারে রিং হচ্ছে কিন্তু কোনো রেস্পন্স নেই। মায়ার মনোযোগে হঠাৎ বিঘ্ন ঘটে কারও উপস্থিতিতে টের পেয়ে। চোখ তুলে উপরে তাকাতে তাকাতে সেই ব্যক্তিটা ধুপ করে মায়ার মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে পরলো। আচানক কারও উপস্থিতিতে মায়া চমকে উঠতে চোখে পরলো আয়নকে। বেশ হাসিহাসি মুখে মায়ার ফোনের দিকে তাকিয়ে রিদের নাম্বার দেখে চিনতে পেরেও অপরিচিত মতোন করে বলল…
‘ তুমি কাকে ফোন করছো?
মায়া হড়ভর করে কল কেটে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে লুকাতে লুকাতে বলল…
‘ কাউকে না ভাইয়া।
‘ আমি কিন্তু জানি তুমি কাকে কল করছিলে। তবে তুমি চাইলে এই বিষয়ে আমার হেল্প নিতো পারো। আমি কিন্তু তোমার কলের ওপাশের মানুষটাকে খোঁজে দিতে পারি। আমি কিন্তু জানি সবকিছু।
মায়া চমকে উঠার মতোন করে অস্থির চিত্তের হড়ভর করে বলল…
‘ আপনি জানেন? আপনি কিভাবে জানেন? সেদিন রাতে কি তাহলে আপনি ছিলেন আমার সাথে? ঐ লোকটা কি তাহলে আপনি?
মায়া এই কথায় আয়নের চোখে মুখে হঠাৎই আফসোসের গ্লানি দেখা গেল। আয়নের কণ্ঠের তেজ কমে আসল ধীরেই। চাপা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মোলায়েম গলায় শুধালো…
‘ সেদিন রাতে তোমার সাথে না থাকার আফসোস আমার ইহজীবনে শেষ হবে না মায়ু। কিছু আফসোস কখনো শেষ হয়না। সারাজীবন থেকে যায়। তারমধ্যে তুমি একটা।
মায়ার আয়নের গভীর কথার অর্থ বুঝল না। মায়ার মস্তিষ্ক এই মূহুর্তে উত্তেজিত। তাই অস্থির নেয় আয়নকে শুধালো মায়া। বলল।
‘ মানে? ঐ লোকটা আপনি না?
‘ যদি অপশন থাকতো তাহলে অবশ্যই হতাম।
‘ মানে?
আয়ন দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিজের কথা ঘুরিয়ে বলল।
‘ মানে কিছু না। তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি তোমার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে খোঁজে পাওয়ার। রিদ-তো তোমাকে হেল্প করলো না। তবে আমি তোমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিব না। ভয় নেই আমি তোমার থেকে কোনো টাকা-পয়সা বা কিডনি চাইব না রিদের মতোন। বিয়াই হিসাবে তো এতটুকু সাহায্য তো করতে পারি তোমার তাই না? এবার বলো কি লাগবে আমার হেল্প?
মায়া অস্থির চিত্তে আমতা আমতা করলো। ওর ছোট মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আয়নের কথায়। মায়ার কেন জানি মনে আয়ন সাথে মায়ার নিখোঁজ স্বামীর কোনো সম্পর্ক আছে, আর নয়তো আয়নই হবে মায়ার সেই নিখোঁজ স্বামী। মায়ার সম্পর্কে এতো কিছু কিভাবে জানা সম্ভব? মায়াতো আয়নকে বা অন্যকাউকে বলেনি, শুধু ওর বান্ধবীদের ছাড়া। শ্রেয়া, নাদিয়া বা জুই কেউ আয়নকে এসব বলতে যাবে না। তাহলে কে বলবে আয়নকে? রিদ খান? অসম্ভব! রিদ খান যে মুডি মানুষ অবশ্যই মায়ার কথা মনে রেখে আয়নকে এসব বলে বেড়াবে না। তাছাড়া রিদ খান মায়াকে কথা দিয়েছিল সে মায়ার পার্সোনাল কথা গুলো কাউকে বলবে না। রিদ খান রাগি, জেদি, বেপরোয়া আর যায় হোক না কেন সে অন্তত নিজের কথার খেলাপ করার মতোন মানুষ নয় এতটুকু মায়ার বিশ্বাস আছে। তাহলে আয়ন কিভাবে জানতে পারে সেই চিন্তায় মায়ার মাথায় এলো আয়নই হয়তো মায়ার সেই মানুষটা হতে পারে। যাকে মায়ার চায়। এমনটাও তো হতে পারে আয়ন নিজেকে লুকাতে চেয়ে মায়াকে এখন মিথ্যা বুঝাতে চাইছে। আয়ন মায়ার নিখোঁজ স্বামী হতে পারে এই ভাবনা মায়ার মাথায় আসতেই, মায়ার মন ছটফটে উঠলো অস্থির চিত্তের। নিজের ভাবনা সত্যি করতে চেয়ে মায়া সরাসরি তাকাল আয়নের চোখে চোখে। মূহুর্তে দুজনের চোখাচোখি হলো। আয়নের হাসিহাসি মুখটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে মায়ার অবিশ্বাস্য নজর দেখে। মায়া যে আয়নকে নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটা মনে করছে সেটা আয়ন মায়ার দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারলো। তারপরও আয়ন মায়াকে বাঁধা দিল না। বরং নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। মায়া এই প্রথম সরাসরি আয়নের দিকে তাকিয়ে বেশ করে পরখ করলো আয়নকে। আর পরখ করতেই যেন চমকে উঠলো। আয়ন বেশ লম্বা আর বলিষ্ঠবান একজন পুরুষ ঠিক সেদিন রাতের ঐ অচেনা লোকটার মতোন। মায়ার হঠাৎ তীব্র ভয়ে ওর কলিজা শুকিয়ে গেল মনে হলো৷ অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে পেয়ে যাওয়ায় কপালে ঘামের বিন্দুকণা দেখা গেল তক্ষুনি। মায়া জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। দু’হাতে চেপে ধরা নিজের ফোনটাকে কচলে অল্প হা করে নিশ্বাস ফেলল ভিতরকার অস্থিরতা বের করতে। আয়নের দৈহিক ঘটন আর শ্যামবর্ণ দেখে এবার মায়ার নিশ্চিত মনে হলো আয়ন হয়তো মায়ার সেই অচেনা লোকটা। যাকে মায়া নিজের স্বামী হিসাবে খোঁজে চলছে। মায়ার তীব্র অস্থিরতায় আছড়ে কম্পিত গলায় বলল…
‘ আমি পানি খাব।
আয়ন মূহুর্তে হেঁসে মায়ার দিকে টেবিলের উপর রাখা পানির বোতলটা এগিয়ে দিতে দিতে মায়ার ডানে দাঁড়িয়ে থাকা রিদের দিকে এক পলক তাকাল। রিদ শুধু থেকেই বাংলো ঘরে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। মায়া লক্ষ না করলেও আয়ন করেছিল। সে মায়া আর আয়নের সব কথোপকথন শুনেছে এতক্ষণ। মায়ার মনোভাবও তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করছে। আয়ন ইচ্ছা করে রিদকে শুনিয়ে শুনিয়ে মায়ার হেল্প করতে চাইছে। কিন্তু আয়নের মায়াকে নিয়ে আফসোস করা, বা মায়ার আয়নের প্রতি ওরকম দৃষ্টি, আয়নকে নিজের নিখোঁজ স্বামী মনে করা, এসব কিছু রিদকে রাগ দিল। রিদ চোয়াল শক্ত করে হাতের মুঠোয় চেপে থাকা ফোনটাকে পিষল। আয়ন রিদের হাতের দিকে তাকিয়ে রিদের রাগের ঠাহর করলো। তারপরও সেটা দেখেও না দেখার মতোন করে মায়ার সাথে কথা চালিয়ে বলল…
‘ কি বললে নাতো আমার হেল্প লাগবে কিনা? লাগলে বলে ফেলো চট করে, আমি এই মূহুর্তে তোমার খোঁজা ঐ লোকটাকে বের করে দিব।
মায়া ঢকঢক করে ছোট পানির বোতল থেকে অর্ধেকটা পানি খেয়ে টেবিলে উপর বোতলটা রাখতে রাখতে আয়নের কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে জানাল যে ওর হেল্প লাগবে। আয়ন দারুণ হেঁসে গা এলিয়ে বসল চেয়ারে। মায়া উদ্দেশ্য করে বলল….
‘ তা লোকটা দেখতে কেমন ছিল কিছু আইডি দাও তো শুনি।
আয়নের কথায় মায়া হাতের মুঠোয় ফোনটাকে কচলাতে কচলাতে মিহি স্বরে বলল…
‘ লোকটা অনেক লম্বা আর বলিষ্ঠবার ছিল।
‘ লম্বা তো অনেকই হয়। কিন্তু এক্সাক্টলি কতটুকু লম্বা ছিল সেটার একটা সঠিক ধারণা দিতে হবে। তুমি লম্বা মানুষ দেখে বলতে পারবে কতটুকু লম্বা ছিল ঐ লোকটা?
মায়া আবারও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। সে মানুষ দেখে বলতে পারবে ঐ লোকটা কতটুকু লম্বা ছিল। মায়া জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আয়নকে বলতে চাইল’ আপনার মতোই লম্বা ছিল ঐ লোকটা। কিন্তু মায়ার কিছু বলার আগেই আয়ন ডান তাকিয়ে রিদকে ডাকল খাক ছেড়ে…
‘ এই রিদ! এইদিকে আয়-তো ভাই।
আয়নের ডাকে মায়া চমকালো, ভড়কালো, হকচকিয়ে দ্রুত তাকাল পাশে, দেখল রিদ ওর থেকে কয়েক কদম দূরে বাংলোর ঘরের দরজাতে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে মায়ার দিকে। মায়া রিদের ভয়ে দ্রুত লাফিয়ে উঠতে চাইলে আয়ন বাঁধা দিয়ে বলল ‘ মায়াকে জায়গা ছেড়ে না উঠতে। মায়া ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইল। কিন্তু রিদ তখনো ঠ্যাটামি করে দাঁড়িয়ে। আয়ন বুঝল রিদ স্বভাবে ত্যাড়ামি করে দাঁড়িয়ে আছে। না জায়গা ছেড়ে নড়বে আর না এগিয়ে আসবে আয়নদের দিকে। তাই বাঁধ্য হয়ে আয়ন উঠে গিয়ে রিদের হাত টেনে মায়ার চেয়ারের পাশে দাঁড় করাতে করাতে বলল…
‘ কিরে ভাই? সব জায়গাতে ঠ্যাটামি করস কেন? একটু আধটু অন্যের কথা শুনলেও তো পারিস। দেখছিস না আমরা গুরুত্বপূর্ণ একটা আলোচনা করছি। তুই একটু এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমাদের হেল্প লাগবে তোর।
রিদকে মায়ার চেয়ারের পাশে দাঁড় করিয়ে আয়ন আবারও গিয়ে বসল নিজের জায়গা। চেয়ার টেনে বসতে বসতে রিদের উদ্দেশ্য আয়ন আবারও বলল…
‘ শুন রিদ! তোরে যে জন্য ডেকেছি। আসলে আমি মায়ার ভন্ড, প্রতারক, বেঈমান, লুকায়িত স্বামীর ইন ডিটেইলস সম্পর্কে জানতে চাই সেজন্য তোর একটু হেল্প লাগবে। তুই এখানে হাম্বার মতোন দাঁড়িয়ে থাক। মায়া তোর উদাহরণ দেখিয়ে আমাকে জানবে মায়া ভন্ড প্রতারক, বেঈমান স্বামীটা দেখতে কেমন ছিল।
রিদ রাগে কটমট করে আয়নের দিকে তাকাল। তার এসব ধরনের মন্তব্য কোনো কালেই পছন্দ না। এতে মেজাজ খারাপ হয়। আর সেজন্য আয়ন ইচ্ছা করেই রিদকে রাগাবার জন্য বারবার মায়ার স্বামীকে তুলে খুঁচা মেরে ভন্ড, প্রতারক, বেঈমান বলে গালি দিচ্ছে। আয়ন জানে রিদ-মায়ার বৈবাহিক সম্পর্কে। আর জেনে বুঝে সে মায়াকে হেল্প করার নাম করে রিদকে এই মূহুর্তে রাগ দিচ্ছে। মায়া রিদের ভয়ে জড়সড় হয়ে আয়নকে বলল…
‘ উনাকে লাগবে না। আমি এমনই বলতে পারবো।
‘ আরেহ তুমি এমনই বললে তো হবে না। মুখের কথায় আমি ঠিকঠাক কিছু বুঝবো না। তুমি একটা কাজ করো, দ্রুত উঠে রিদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলতো তোমার নিখোঁজ স্বামী আসলে কতটুকু লম্বা ছিল। আমাদের রিদ-তো অনেক লম্বা। দেখতো ওর মতোন লম্বা ছিল কিনা একটু দেখতো? যাও যাও উঠে গিয়ে দাঁড়াও ওর পাশে।
মায়া ভয়ে আমতা আমতা করল যাবে কিনা সেটা নিয়ে। লাস্টবার রিদ মায়াকে আঘাত করেছিল যেটা মায়া ভুলেনি। কিন্তু আয়নতো আর সেসব জানে না। মায়াকে উঠতে না দেখে আয়ন আবারও তাড়া দিল। মায়া হাতের ফোনটা টেবিলে রেখে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়া। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে মায়া রিদকে নিজের খুব কাছে অনুভব করলো। মায়ার আর নড়াচড়া করল না। নত মস্তিষ্কের রিদের পায়ের দিকে তাকিয়ে হাত কুচলাল। মায়াকে নড়তে না দেখে আয়ন অসন্তোষ্ট গলায় আবারও বলল..
‘ এইভাবে না মায়া। তুমি রিদের মুখোমুখি না বরং পাশাপাশি গিয়ে চেপে দাঁড়া। দুজনকে একত্রে দাঁড়াতে দেখলে তবেই না আমি বুঝব কে কতটুকু লম্বা ছিল।
আয়নের কথায় অস্তিত্ববোধ করে মায়া ঘুরে রিদের পাশাপাশি চেপে দাঁড়াল। মায়ার বাহু রিদের কুইনের সাথে হাল্কা পাতলা স্পর্শ লাগলো মনে হয়। এর মাঝে আয়ন দুজনকে একত্রে দাঁড়াতে দেখে বেশ সিরিয়াস মুড নেওয়ার মতোন করে বলল..
‘ এবার ঠিক আছে। এখন রিদকে দেখে বলো তোমার স্বামী লম্বায় কতটুকু ছিল?
মায়া হাসফাস করে হাত কচলাতে কচলাতে ঘাড় উঁচিয়ে রিদের দিকে তাকাতে চোখাচোখি হলো রিদের শান্ত শীতল দৃষ্টির সাথে। মায়ার দিকে কেমন শান্ত মেজাজে তাকিয়ে রিদ। অদ্ভুত ভাবে মায়াও শিহরিত হলো রিদের শান্ত দৃষ্টির অতলে। মায়া দুই-তিন সেকেন্ডে বেশি পারলো রিদের শীতল দৃষ্টি মাঝে চেয়ে থাকতে। জড়তার দৃষ্টি নামিয়ে তাকাল রিদের বলিষ্ঠ শক্ত কাঁধে দিকে। মায়ার মাথা আপাতত রিদের কাঁধে একটু নিচে। মানে রিদের বুক বরাবর মায়ার হাইট। মায়া একটু চমকালো। সেদিন রাতের অচেনা লোকটাও রিদের মতোন ঠিক এতটাই লম্বা ছিল। মায়া রিদ খানের মতোন করে সেদিন রাতে ঐ লোকটারওনবুক বরাবরই হয়েছিল, মায়া এখনো স্পষ্ট মনে আছে। রিদ খান যে এতো লম্বা মায়া আগে কখনো এতোটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করেনি। কিন্তু আজ লক্ষ করেই যেন বিস্ময় হচ্ছে। বাপরে রিদ খান এতো লম্বা। মায়া রিদের কাঁধ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রিদকে দেখিয়ে আয়নকে বলল…
‘ উনার মতোন লম্বা ছিল লোকটা।
আয়ন বলল..
‘ তুমি শিওর তো?
‘ হুম।
‘ আর?
রিদকে আবারও দেখিয়ে বলল।
‘ আর উনার মতোই বলিষ্ঠবান ছিল।
‘ তুমি বুঝলে কিভাবে?
‘ সেদিন রাতে লোকটা বেহুশ অবস্থায় আমার কাঁধে ঢলে পরেছিল। আমি উনার ওজন সামলাতে হিমসিম খেয়েছিলাম। লম্বা, চওড়া অনেক ছিল সেজন্য বলতে পারছি।
আয়ন বেশ সিরিয়াস হওয়ার মতোন করে বলল।
‘ আচ্ছা, সেদিন কিভাবে কাঁধে ভর দিয়েছিল দেখাতে পারবে?
‘ হ্যাঁ পারব।
আয়নের কথায় তালে মায়া খৈ হারাল। রিদের সাথে শত্রুতার কথা এক মূহুর্তের জন্য ভুলে গিয়ে চট করে রিদের শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ হাত নিজের কাঁধে তুলে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল রিদের সাথে। মায়া যখন সেদিন রাতের কথা মনে করে নিজের পজিশন ঠিক করছিল, তখন রিদ মায়াকে সাহায্য করে নিজের মায়ার কাঁধ জড়িয়ে তাঁর বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো। আর বেখেয়ালি মায়া চোখ উঁচিয়ে রিদের মনোভাব ঠাহর করলো না, যদিও করতো তাহলে ঠিক বুঝতো রিদের গভীর দৃষ্টির মানে। ব্যস্ত মায়া সেদিন রাতের ঘটনা মনে করে রিদের পিঠ গুলিয়ে কোমরের শার্ট আঁকড়ে ধরলো। আর অপর হাতটা রাখল ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরা রিদের হাতের উপর। তারপর আয়নকে নিজেদের পজিশন দেখাতে দেখাতে উৎফুল্ল গলায় বলল…
‘ আমরা এইভাবে ছিলাম ভাইয়া।
‘ আচ্ছা আর?
‘ আর! আর!
মায়া আর! আর! ভাবতে ভাবতে চট করে কাঁধে উপর রিদের হাতটা টেনে ধরলো নিজের উপর রিদকে ঝুকে পরতে। মায়ার আচানক কান্ডে রিদ খৈ হারিয়ে অল্প একটু মায়ার দিকে ঝুকে পরতে মায়া আবারও একই ভাবে রিদকে টানলো নিজের দিকে। এবার মায়া বেশ জড়সড়ে টেনে ধরায় রিদ নিজের খৈ হারিয়ে দুহাতে মায়াকে জড়িয়ে ধরে এলিয়ে পরলো মায়ার গায়ে। তাজ্জব মায়াও রিদকে টেনে নিজেও বোকা বনে গেল। মূলত মায়াও বুঝতে পারেনি রিদ মায়াকে এইভাবে জড়িয়ে ধরবে। আকস্মিক ঘটনায় মায়া রিদের দেহের ভার সইতে না পেরে দু’হাতে রিদের পেট জড়িয়ে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে ঝুকে পরে বলল…
‘ বাপরে আপনি-তো অনেক ওজন। শরীর এতো শক্ত কেন? কি খান হ্যাঁ? উঠুন! আমি বাঁকা হয়ে যাচ্ছি।
দীর্ঘ সময়ের নিরবচ্ছিন্ন করে রিদ প্রথম কথাটায় বলল মায়াকে ধমক দিয়ে দাঁত পিষে…
‘ সেটআপ ইডিয়েট!
রিদ মায়া ছেড়ে দাঁড়াতে মায়া হড়ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কাঁধে একহাত রেখে ঘষতে ঘষতে ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল রিদের দিকে। রিদকে বেশ ভারি বরগুনের মানুষ মনে হলো মায়ার। আর একটুর জন্য মায়ার ঘাড় ভাঙ্গেনি। আল্লাহ জানে এই লোকের বউ এই লোককে কেমনে সামলাবে। মায়ার তো এখনই চিন্তা হচ্ছে এই লোকের বউয়ের জন্য। মায়া আড়চোখে রিদের কটমট করা দৃষ্টি মারিয়ে তাকাল আয়নের দুষ্টু হাসির দিকে। আয়ন বেশ দুষ্টু হেঁসে দুজনের দিকে তাকিয়ে। মায়া বুঝল না সেই হাসির মানে। তাই মায়া আমতা আমতা করে রিদকে এক আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে আয়নকে বলল…
‘ একটু আগে উনি(রিদ) যেমন করে আমার গায়ে ঢলে পরেছিল সেদিন রাতে ঐ লোকটাও তেমন করেই ঢলে ছিল। এরপর আর কিছু বলতে পারবো না। লোকটার চেহেরাটা আমার মনে নেই।
মায়ার কথায় আয়ন ঠাস করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল…
‘ এসব নিঃশক্তি ঢলে পরা মানুষদের তুমিই সামলাও মায়া। আমি গেলাম! আমার কাজ শেষ। শুনো ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা পিছনে তাকালে পেয়ে যাবে তোমার ভন্ড, প্রতারক মানুষটাকে।
বলে আয়ন শিস বাজাতে বাজাতে বাংলোর ঘরটা ছাড়লো। মায়া হতবুদ্ধি হয়ে আয়নের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মূলত মায়াও মাথায় আয়নের কোনো কথায় ঢুকলো না। এতক্ষণ মায়াকে জোর দিল মায়ার স্বামী দেখতে কেমন সেটা বলতে। আর এখন যখন মায়া দেখানো শেষ করলো ওমনি চলে গেল মায়াকে উল্টাপাল্টা কথা বলে। মায়া কাকে সামলাবে? এখানে কে নিঃশক্তি ঢলে পরা মানুষ? আর কে-ই বা মায়ার পিছনে থাকবে? মায়ার স্বামী কি আর মায়া পিছন বসে আছে নাকি যে মায়া পিছনে তাকালেই তাঁকে পেয়ে যাবে। পিছনে তো শুধু রিদ খান দাঁড়িয়ে আছে। যার সারা শরীরে অহংকার আর রাগ, জেদে ভরপুর। মায়া আবারও হতাশার শ্বাস ফেলল। টেবিলে উপর ফোনটা নিতে নিতে ঘাড় বেঁকে তাকাল পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রিদের দিকে। সে মূলত তখন থেকেই মায়ার দিকে চেয়ে। কি যে এতো দেখে মায়াকে আল্লাহ জানে। এই রাগ, তো এই শান্ত দৃষ্টি। একটু আগে কেমন শান্ত আর শীতল ছিল, আর এখন অকারণে রেগে কটমট করছে মায়ার উপর। এই লোক কেন যে অকারণে মায়ার উপর রেগে যায় তাও মায়া বুঝেনা। এই লোককে মায়া বুঝতে গেলে আরও সমস্যা। মায়ার এই লোকের সাথে কোনো লেনদেন নেই। যার লেনদেন আছে সেই বুঝুক এই ঘাড় ত্যাড়া লোককে। মায়া নিজের ফোন উঠিয়ে চলে গেল খান বাড়ির ভিতরে দিকে। কিন্তু রিদ তখনো রাগে দু’হাত মুষ্টি পিষে মায়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। মূলত মায়া বুঝতেই পারলো না আয়ন মায়ার চোখে আঙ্গুল দিয়ে রিদকে দেখাল নিজের স্বামী স্বরুপ। কথায় কথায় আয়ন যে রিদকে ইঙ্গিত করেছে ঢলে পরা মানুষটা হিসাবে সেটাও বুঝল না। এমন না যে মায়া আয়নের কথা গুরুত্ব দেয়নি। দিয়েছে! কিন্তু মায়া আয়নের কথা অনাগ্রহ করেছে। মূলত মায়ার বিশ্বাস নেই যে, রিদ খানও কোনো ভাবে মায়ার স্বামী হতে পারে এটা নিয়ে। মায়া প্রাণপূর্ণ বিশ্বাস দুনিয়া যেকেউ মায়ার স্বামী হতে পারে কিন্তু রিদ খান কখনো হবে না। কোনো ভাবে না।
~
রাত প্রায় বারোটার শেষের দিকে! সবার ডিনার আরও কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। এখন ওরা ফিরে যাবে। কিন্তু মুক্তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো সেঁজুতির সাথে সেঁজুতি ঘরেই হবে। মায়া এতক্ষণ ঘুমে ড্রয়িংরুমের বসে ঝিমচ্ছিল। আরিফ ডেকে দেওয়ায় মুক্তার জন্য সে সিঁড়ি ধরে উপর উঠছে। সেঁজুতির ঘরে যাবে। মুক্তাকে ডাকতে। মায়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলার করিডোর ধরে সামনে এগোতে হঠাৎ পিছন ডাকল কেউ…
‘ স্টপ!
মায়া চমকে উঠার মতোন লাফিয়ে পিছন ঘুরলো মূহুর্তে। রিদকে বাড়ির পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠল হড়ভর করে। এই অসময়ে রিদের মুখোমুখি হওয়া মানে বিপদ সংকেত। আতঙ্কিত মায়া হড়ভর করে দৌড়ে পালাতে চাইলে, তার আগেই রিদ মায়ার মতিগতি বুঝে শক্ত গলায় দাঁতে পিষে আবারও বলল…
‘ ডোন্ট গো! আই সেড স্টপ দেয়ার!
রিদের শক্ত গলায় শুনেও মায়া থামলো না। রিদ ভয়ে দৌড় মারলো তৎক্ষনাৎ। পিছন পিছন রিদ ছুটলো। চোখের পলকে মায়ার হাত চেপে সামনে ঘুরাল। মায়া ভয়ে রিদকে ধাক্কা মেরে পুনরায় পালাতে চাইলে রিদ এক ধাবায় মায়ার বুকের কাছের কাপড়াটা শার্টের কলারের মতোন চেপে ধরে মায়াকে উঁচিয়ে মুখোমুখি করে রাগে হিসহিসিয়ে বলল…
‘ ডাকছি কথা কানে যায়না? দাঁড়াস না কেন তুই? বেয়াদব হয়েছিস?
রিদের ভয়ে মায়া এমনই সিঁটিয়ে ছিল। এখন আরও সিটিয়ে গেল। রিদ হুটহাট কেন রেগে যায় মায়া জানে না। রিদ রেগে গেলে মায়ার সাথেই বা কেন খারাপ আচরণ করে তাও বুঝে না। একটু আগে কতো ভালো দেখাল রিদকে। অথচ এখন হুট করে রেগেমেগে কেন অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করলো তাও জানে না মায়া। আসলে মায়া কিছুই জানতে চাই না। রিদের হুটহাট চেপে ধরা, মায়াকে আঘাত করা, অকারণে ছুঁয়ে দেওয়া, কোনো কিছুই মায়া চায় না। মায়া শুধু নিজেকে নিরাপদ আর আতঙ্ক মুক্ত রাখতে চায় রিদ থেকে। এই মূহুর্তে রিদের রাগের কারণটাও মায়া জানে না। তবে রিদ মায়ার কলার চেপে ধরার কারণে ফ্লোরে পা রাখতে হিমসিম খাচ্ছে মায়া। পায়ে বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়েও খৈ হারিয়ে ফেলছে। কারণ রিদ মায়া বুকের কাছের কাপড় চেপে মায়াকে উঁচিয়ে ধরে রেখেছে। এখন রিদ ছেড়ে দিলেই মায়া যেকোনো সময় মুখ থুবড়ে পরবে ফ্লোরে। মায়া নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে রিদের পেটে কাছে টি-শার্টের কিছু অংশ শক্ত করে চেপে ধরে নিজেকে ছাড়াতে চেয়ে।
‘ আমাকে ছাড়ুন ভাইয়া। পায়ে ব্যথা পাচ্ছি আমি।
মায়া মুখে ভাইয়া ডাক শুনে রিদ আরও তেতে উঠলো। তার রাগে যেন মায়া ঘি ঢালার মতোন কাজ করলো। তাই রিদ মায়ার কলার চেপে আরও কাছে টানলো। মায়াকে মুখোমুখি ধরে রাগে রি রি করে বলল…
‘ বারবার ভাইয়া ডাকিস কেন? তোর বাপের সম্পত্তির ভাগ দিবি আমায়? যে ভাইয়া ডেকে বেড়াস? নিষেধ করেছিলাম না ভাইয়া ডাকতে? তাহলে কথা শুনিস না কেন? অবাধ্য হুস আমার? কথা না শুনলে ট্রিগার পয়েন্ট রেখে গুলি করে মেরে দিব। বিশ্বাস কর একটুও বুক কাঁপবে না আমার।
রিদের শক্ত ধাঁচে কথায় আতঙ্কিত হলো মায়া। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে ভয়ে চোখে পানি দেখা গেল। এই মূহুর্তে রিদকে দুনিয়ার নিষ্ঠুর আর নিকৃষ্ট দয়া-মায়াহীন মানুষ মনে হতেই মায়া ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে উঠে বলে…
‘ আপনি এমন করছেন কেন? কি করেছি আমি? সবসময় আমার সাথেই কেন বাজে ব্যবহার করেন? আঘাত করেন? কি চাই আপনার?
রিদ মায়াকে আরও কাছে টেনে চোখে চোখ রেখে রাগে তিরতির করে দাঁত পিষে বলল…
‘ নিজেকে এতো সস্তা বানাচ্ছিস কেন? আমার সস্তা জিনিস পছন্দ না।
‘ আমি সস্তাই! আরও সস্তা হবো। আপনার কি?
‘ চুপ! একদম চুপ! মুখেমুখে তর্ক করবি না। আমার পছন্দ না। বেয়াদব হয়েছিস! মেজাজ আমার এমনিতেই চটে আছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোর নাগরকে জানে মেরে দিব।
রিদের হিংস্রত্ব রাগে মায়া দমে যায়। রিদের রক্তিম চোখ আর ভয়ানক দৃষ্টিতে মায়া কাবু হয়ে যায়। ভয়ার্ত মুখে মায়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠতে রিদ আবারও আগের নেয় দাঁতে দাঁত পিষে বলে…
‘ ছেলে কে?
মায়াকে উত্তর না দিয়ে কাঁদতে দেখে রিদ আরও চটে যায়। আগে নেয় দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচাল…
‘ উত্তর দে!
রিদের ধমকে মায়া কেঁপে উঠে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল..
‘ কোন ছেলে?
‘ যার সাথে তোর ভাব চলছিল এতক্ষণ সে কে?
মায়া কাঁদতে কাঁদতে জানাল।
‘ আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান চাচার বড় ছেলে নাদিম ভাইয়া উনি।
‘ এখানে কি করছে?
‘ আরিফ ভাইয়া ডেকেছে মনে হয়। আমি জানি না কিছু।
‘ তোর সাথে কি চলে এই ছেলের? এতো কিসের ভাব তোদের?
‘ কিছু চলে না। কোনো ভাব নেই।
‘ নাটক করস? কাহিনি বুঝাস আমাকে? আমি চোখে দেখি না কিছু? তোর আমাকে অন্ধ মনে হয়? তোদের নষ্টামি আর গলায় গলায় ভাব আমার চোখে পরবে না মনে করিস? ওয়ার্নিং দিচ্ছি না রিত! বলে রাখছি, আমার অবাধ্য হবি সোজা ট্রিগার পয়েন্টে রেখে তোর নাগরের বুক ঝাঁঝড়া করে দিব গুলিতে আমি। যে বুকে আমার নারীর জন্য ভালোবাসা থাকবে সেই বুক আমি জ্বালিয়ে দিব। বিশ্বাস কর রিত, এসব কিছু করতে মোটেও আমার হাত কাঁপবে না।
রিদের উগ্রতা, বেপরোয়া আচরণে মায়া প্রচন্ড ভয়ভীত হলো। মায়ার জীবনে কখনো কেউ এতোটা বাজে আচরণ করেনি ওর সাথে। আর না এই ভাবে মায়াকে কেউ হুমকিধামকি দিয়েছে। মায়াকে আজ পযন্ত কোনো পুরুষ কারণে অকারণে হোক ছুঁয়ে দেয়নি অথচ রিদ খান অবাধ্যে মধ্যে মায়াকে ছুঁয়ে দেয় যেখানে সেখানে। এতে মায়ার ভিষণ কষ্ট হয়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মায়ার মনে হয় সে নিজের স্বামীকে ঠকাচ্ছে। একটা পুরুষ মানুষ অকারণে মায়াকে ছুঁয়ে দেওয়া সেটা নিশ্চয় পাপ। মায়া না চাইতেও সেই পাপের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে ওকে তাও শুধু মাত্র রিদের জন্য। মায়া বুঝল রিদের সাথে শক্তি, সামর্থ্য বা তর্কে জড়িয়ে কখনো পেরে উঠবে না। রিদ বেপরোয়া মানুষ! আজ পযন্ত কারও পরোয়ানা করেছে বলে সে দেখেনি, আর না কারও থেকে শুনেছে এমনটা। এমন বেপরোয়া মানুষকে মায়ার বুঝাতে হবে কৌশলে। রিদ যা চাইছে মায়ার থেকে সেটা মায়ার দেওয়া সম্ভব নয়। মায়া বিবাহিত। সবচেয়ে বড় কথা মায়া নিজের স্বামীকে ভালোবাসে। তাই রিদকে মায়ার মিথ্যা বুঝাতে হবে যে মায়া ওর স্বামীর সাথে সুখী আছে। আর ওদের মাঝে দেখা সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে এতোদিনে সবকিছু হয়ে গেছে। যদিও রিদ একটু আগের আয়নের ঐ কথাবার্তা মনে করে জানে মায়া এখনো ওর স্বামীকে খোঁজে পায়নি। তো কি হয়েছে? মায়া না-হয় তখনকার ঘটনাটা মিথ্যা বলে চালিয়ে দিবে রিদকে। রিদ কি আর বুঝতে পারবে নাকি কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। রিদতো আর মায়ার স্বামীকে চিনে না, তাহলে বুঝতেও পারবে না যে মায়া মিথ্যা বলছে সেটা। মায়া নাহয় রিদকে মিথ্যা বুঝিয়ে বলবে মায়া ওর স্বামীকে খোঁজে পেয়ে গেছে। ওরা এখন সুখে শান্তিতে ঘর-সংসারও করছে। মায়াকে যেন রিদ আর ডিস্টার্ব না করে। মায়া নিজের কান্না আটকে, ফুঁপানো বন্ধ করতে চেয়েও পারলো না। তীব্র অপমানে, আর রিদের ভয়ে চোখ থেকে এমনই পানি পরছে। তারপরও মায়া নিজের কান্না আটকাতে চেয়ে ঠোঁট কামড়াল। কিন্তু সফল হতে না পেরে পুনরায় একই ভাবে ফুপিয়ে কেঁদে রিদের উদ্দেশ্য বলল…
‘ আপনি আমার সাথে এমন করবেন না প্লিজ। আমার আপনাকে ভয় লাগে। সহ্য হয়না আপনাকে। আমার যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে মিশব আপনার কি? প্লিজ আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন। আপনি জানেন আমি বিবাহিত। তারপরও কেন বারবার আমাকে ডিস্টার্ব করেন, অকারণে ছুঁয়ে দেন। এসব আমার পছন্দ না। আপনি আমার কাছ থেকে যা চাইছেন তা আমি কক্ষুনো দিতে পারব না। আমি ঐ টাইপের মেয়ে নয়। আর না আপনার বাজে প্রস্তাবে ইন্টারেস্ট। আমার স্বামী আছে। আমরা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসি। আমাদের সম্পর্কটা অনেক গভীর আর ঘনিষ্ঠ একটা নরমাল ম্যারিড কাপলদের মতো। আমরা দেখা করেছি, কথা বলেছি, পাশাপাশি আরও অনেক কিছু করেছি। আমার স্বামী পছন্দ না কেউ উনার বউয়ের আশেপাশে ঘুরুক। আপনি প্লিজ আমার থেকে দূরে থাকুন।
বিস্ফোরণে রিদের মস্তিষ্ক ধপধপ করে উঠলো। জ্বলে উঠা রাগ দপ করে নিভে গিয়ে মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে জানান দিল, সে কখন ঘনিষ্ঠ হলো বউয়ের সাথে? কখন ভালোবাসার লেনদেন করলো তাঁরা? এতো কিছু কবে করলো রিদ? বিস্ফোরণে মায়ার কর্লার চেপে ধরা রিদের হাতটা হাল্কা ঢিলে হয়ে আসলেও একেবারে ছেড়ে দিল না। বিষন্নে রিদ নিস্ক্রিয় মস্তিষ্কে চেঁচিয়ে উঠল…
‘ কিহহ? এতো কিছু কবে হলো?
মায়া মনে করলো রিদ মায়ার মিথ্যা কথা বিশ্বাস করেছে। মায়া নিজের স্বামীর সাথে জড়িয়ে পরেছে এমনটা শুনলে হয়তো রিদ আর মায়ার পিছনে ছুটবে না। আর না মায়াকে ডিস্টার্ব করতে চাইবে। মায়া নিজের কান্না থামাল। রিদকে নিজের থেকে দূরে করতে চেয়ে আরও কিছু মিথ্যা কথা গুছিয়ে নিল মনে মনে। নাক টেনে নিজের ফুঁপানো আটকে বলল…
‘ হয়েছে মাস খানিক হবে। উনিই নিজ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। কথা বলেছে। দেখা করেছে। তারপর আরও অনেক কিছু হয়েছে আমাদের। উনি বলেছে আপু আর ফাহাদ ভাইয়ার বিয়েটা শেষ হলেই আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে আব্বু কাছে। আসলে উনি চিন্তিত যদি আমাদের দুজনের পরিবার আমাদের সম্পর্কের কথা জানার আগেই আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখা…
মায়ার কথার মাঝেই বিস্ফোরণে রিদ স্তব্ধতায় চেঁচিয়ে বলল…
‘ প্রেগন্যান্ট? কে প্রেগন্যান্ট?
‘ আমি।
‘ কিহ?
‘ হুম!
রাগে দুঃখে রিদ মায়ার কলার ছেড়ে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দিতে দিতে মেজাজ দেখিয়ে বলল..
‘ ধরলাম না, ছুঁলাম না, খেলাম না, কিচ্ছু করলাম না, এরমধ্যে বাবা হচ্ছি! সেই! সেই! সেই!
রিদ রাগে একিই শব্দ বারবার উচ্চারণ করছে। মায়া
রিদের আচানক ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সঙ্গে গিয়ে পিঠ ঠেকল। অল্প ব্যথাও পেয়েছে পিঠে তবে সেটা সহনীয়। মায়া দেয়াল ধরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রিদের কথা গুলো কানে আসল। মায়া রিদকে শুধিয়ে বলল…
‘ আপনি না আমার স্বামী বাবা হবে।
রিদ রাগে দুঃখে বলে…
‘ একটা ভারি দাও আমার মাথায়। স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে।
মায়া দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে বলল…
‘ আমি পারব না।
‘ ছেহ শালার জিন্দিগি! কিছু করার আগে বদনাম হয়ে গেলাম।
মায়া গোল গোল চোখে রিদের দিকে তাকিয়ে রইল। রিদ যে রাগে তোড়ে এসেছিল ঠিক সেই ধাঁচে হনহনিয়ে আবারও চলেও গেল। মায়া রিদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল শুধু। রিদ যখন বিকট শব্দ তুলে দরজাটা ঠাস করে লাগাল তখন মায়ার সাথে সাথে দেয়াল গুলো যেন কেঁপে উঠেছে সেই তোপে। মায়া রিদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে পেরে বুকের উপর একটা হাত রেখে প্রশান্তি নিশ্বাস ফেলল। যাক অবশেষে ওহ রিদকে মিথ্যা বুঝাতে পেরে তাহলে। এবার মায়ার পিছনে না আসলেই হয়।
#চলিত….