রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৩২+৩৩

0
3

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৩২
সকাল পাঁচটা পেরিয়ে পনে ছয়টা ঘরে। কাক ডাকা ভোরে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে অদূরে লিচু গাছটা থেকে। মায়া বাড়ির সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে সেদিকে বিষন্নয়ে তাকিয়ে। ছোট লিচু গাছের ডালশাখা নুইয়ে পড়ছে কাঁচা পাকা অসংখ্য লিচুর ভারে। লিচু গুলো দেখতে লোভনীয় মনে হলেও মায়া সেদিকে এগিয়ে গেল পেরে খেতে। কার না কার বাড়ি কে জানে! রাতের অন্ধকারে মায়াকে ওর স্বামী কার বাড়িতে নিয়ে এসেছে মায়া এখনো জানে না। বাড়ির মালিক বা আশেপাশে অন্য কাউকেও দেখেনি এখনো। সেজন্য মায়া তখন সিঁড়ি থেকে থেমে নিচের ড্রয়িংরুমটা পার হয়ে বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে মায়া বুঝতে পারছে এটা ফাহাদের বাড়ি নয়। কারণ মায়ার বোনের শশুর বাড়ি ওর চেনা। কিন্তু এই অপরিচিত বাড়িটি মায়া চিনে না বলেই বের হয়েছে দেখতে এই সুন্দর ডুপ্লেক্স বাড়িটা। ছোটখাটো দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়িটির সামনে একটা সুন্দর বাগানও আছে। তবে সেই বাগানে ফুলের চারা নেই। আছে শুধু অসংখ্য ফলের গাছে। বেশ কিছু ফলের গাছ মায়া চিনতে পারলেও অনেক গাছই সে চিনতে পারলো না। নামবিহীন বিদেশি ফলের চারা হবে বলে মায়ার মনে হলে। মায়া মাথার ঘোমটা আরও একটু টেনে নুইয়ে পড়া লিচু গাছের নিচে দাঁড়াল। ওর গায়ে এখনো কালকের পড়া সেই সাদা পাকিস্তানী জামাটি জড়ানো। ফর্সা পায়ে রিদের বড়ো বড়ো সেন্ডেল জোড়া মায়ার পাকে বেশ ছোট দেখাল। হয়তো তখন রিদের রুম থেকে পালাতে গিয়ে তাড়াহুড়ো মায়া নিজের জুতা খোঁজে পাইনি। চোখের সামনে তখন যা পেয়েছিল তাই পরে রিদের রুম থেকে পালিয়ে ছিল সে। মায়া ঘুরঘুর করে বাগানটা দেখতে লাগল। অসংখ্য ফল গাছের ভিতরে এক মূহুর্তে জন্য ভুলে গেল রিদের কথা। হাত বাড়িয়ে ফলসহ চারাগাছ গুলো ছুঁয়ে দেখার মধ্যে আসিফের গলা পেয়ে মায়া চমকে উঠার মতোন পিছন ফিরলো। তক্ষুনি চোখে পড়লো আসিফকে বাসার কাপড়ে দাঁড়িয়ে একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। মায়া অদূরে বাগান থেকে দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখে বুঝতে পারলো মহিলাটি হয়তো এই বাড়ির সার্ভেন্ট হবে। আর আসিফ তাকে তাঁর কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে।

মায়া হঠাৎই মনে হলো রিদের কথা। লোকটা হয়তো এখনো ঘুমিয়ে আছে। সেজন্য মায়ার খোঁজ জানে না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে মায়ার খোঁজ করলে মায়া এই লোকের সামনে দাঁড়াবে কি করে? মায়াতো লজ্জায় মরে যাবে। কাল রাতের ঐসব ঘটনার পর মায়া আর সাহস নেই লোকটার সামনে দাঁড়ানো। ভাগ্যিস মায়া কাল রাতে বেহুশ হয়েছিল। নয়তো সে হার্ট অ্যাটাক করতো। এই লোক মায়ার উপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল। মায়ার তো এখন এই লোকের সামনে যাওয়াই রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার থেকে সবচেয়ে বড়ো কথা হলো মায়ার স্বামী ওর মতিগতি বুঝতে পেরে গেছে। হয়তো জেনে গেছে মায়া যে তাদের দুজনের স্বামী- স্ত্রীর হওয়া সম্পর্কটা নিয়ে অবগত। তার জন্য তো লোক আজকাল মায়ার সাথে কেমন আপোষে মিশে যেতে চাই। মায়ার মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই সে একজোড়া সাদা পা গাসের উপর দেখলো। মায়ার বেখেয়ালি দৃষ্টি মাটি থেকে তুলে সামনে থাকাতেই চমকে উঠলো রিদের উপস্থিতি দেখে। থতমত খেয়ে তাড়াহুড়ো পালিয়ে যেতে চাইলে রিদ তৎক্ষনাৎ মায়ার বাহু টেনে আটকায়। মায়া রাতের কথা ভেবে লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলে রিদ মায়ার বাহু টেনে কাছে আনে। মায়ার থুঁতি ধরে মুখটা উপরে তুলতে দুজনের চোখাচোখি হলো। মায়া লজ্জায় মুখ ঘুরে নিতে চাইলে রিদ মায়ার মুখটা আটকে রেখে বলে…

‘ কি ম্যাডাম? কি সমস্যা? পালাতে চাচ্ছেন কেন?

মায়া উত্তর করলো না। বরং জোর করে মুখটা নামিয়ে নিল রিদের হাত থেকে। এইভাবে মায়ার ভিষণ লজ্জা লাগছে। লজ্জায় সিঁটিয়ে মায়া হাসফাস করে দৃষ্টি লুকাতে চাইল এদিক সেদিক তাকিয়ে। রিদ মায়ার লজ্জা মিশ্রিত মুখটা দেখে দুষ্টু হেসে মায়ার নাক টানলে, মায়া উফফ! শব্দ করে। রিদ মায়ার নাক ছেড়ে কপালে ঠুকা মারতে মারতে বলল…

‘ বারবার কাছে আসছেন। ধরা দিচ্ছেন। তর্ক করছেন না। কাহিনী কি? আমার প্রেমে-ট্রেমে পড়লেন নাকি ম্যাডাম?

রিদের দুষ্টু মুখভঙ্গিমা এই প্রথম দেখল মায়া। লোকটা মজা করে মিটমিট হাসতে পারে সেটা জানা ছিল না মায়ার। মায়া বিষন্নয়ে রিদের মুখের দিকে তাকাল। রিদের ঠোঁটের কোণের অল্প হাসিটা দেখতে দেখতে মূহুর্তে গায়েব হয়ে গেল। রিদ মুখটা স্বাভাবিক করে নিতে মায়া মুখ ভার করে বলল….

‘ প্রেমে পড়ার জন্য আপনার ফিয়ন্সে শশী আপু আছে না? আমি কেন প্রেমে পড়তে যাব! আমি প্রেমে পড়ব না।

রিদের স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার মুখটা আবারও উজ্জ্বল হলো। ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে দ্বিতীয়বারের মতোন মায়ার নাক টেনে বলল।

‘ জ্বলে?

মায়া গাল ফুলিয়ে রিদের দিকে তাকাল। কষ্ট পেয়ে রিদকে পিছন ফেলে পিঠ মুড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল।

‘ না।

রিদ মায়ার অবুঝ কান্ড দেখে ঠোঁট কামড়িয়ে হাসলো। বউ তার জ্বলছে সেটা সে জানে। রিদ জেনে শুনেই নিজের বউকে জ্বালাচ্ছে। মূলত তার ভালো লাগছে এটা করতে। রিদ মায়ার বাহু টেনে নিজের দিকে ফেরাল। মায়ার গাল টেনে বলল…

‘ পুড়া পুড়া গন্ধ পাচ্ছি ম্যাডাম। কার কলিজা যেন পুড়ছে তাই না ?

মায়া একহাতে নাক ঘষতে ঘষতে রিদের দুষ্টু দৃষ্টির দিকে তাকাল। রিদ যে ইচ্ছা করে মায়াকে হেনস্ত করছে সেটা বুঝে মায়া কথা ঘুরাতে চাইল। আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মিহি স্বরে বলল…

‘ এই বাড়িটা কার?
‘ তোমার।

রিদের সোজাসাপ্টা উত্তরে বিস্মিত হলো মায়া। রিদকে শুধিয়ে বলল…
‘ আমার?
‘ হুম
রিদের উত্তরে মায়া মনে করলো রিদ মায়ার সাথে মজা করছে। মায়া পুনরায় একই ভঙ্গিতে বলল…

‘ প্লিজ বলুন না বাড়িটা কার? আর এই লিচু গাছটা। এটা কার?

রিদ মায়ার আঙ্গুলের অনুসারে ঝুলন্ত লিচু গাছটার দিকে তাকাল। সে উপর থেকে দেখেছিল মায়াকে এই লিচু গাছের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। রিদ মায়া হাত ধরে লিচু গাছের সামনে দাঁড়াল। ঝুলে থাকা লিচুর থেকে একটা লিচু নিয়ে সেটা খোসা ছাড়াল। বিজ ছাড়িয়ে সাদা অংশটুকু মায়ার মুখে তুলে দিতে দিতে বলল…

‘ এই বাড়ি, এই-ঘর, আর এখানকার সবই তোমার। আমি তো ভাড়াটিয়া তোমার।

‘ আপনি ভাড়াটিয়া আমার?
মায়া অবাক গলায় শুধাল রিদকে। রিদ একইভাবে দ্বিতীয় লিচুটা গাছ থেকে পেরে খোসা ছাড়িয়ে মায়ার মুখে তুলে দিতে দিতে সম্মতি দিয়ে বলল…

‘ হুম।

মায়া মূহুর্তে খুশি হয়ে গেল। কারণ সে রিদের ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছে তাই। রিদ যে এই বাড়ির মালিক সেটা বুঝতে বাকি নেই মায়ার ? মায়ার স্বামী এই বাড়ির মালিক হলে মায়াতো তার বউ তাহলে সে মালকিন হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এজন্য হয়তো রিদ মায়াকে এই বাড়ির মালিক বলে সম্মোধন করছে। মায়া লজ্জা মিশ্রিত মুখে খুশি হয়ে গেল। রিদ মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আরও একটা লিচু মায়ার মুখে তুলে দিল। দুজনের কেউ কাউকে এই পযন্ত ভালোবাসি বলেনি। আর না কেউ কাউকে জানিয়েছে তাঁরা একে অপরের স্বামী- স্ত্রী হওয়া সম্পর্কে অবগত। ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করেনি কেউ অথচ এই দুজনকে একত্রে দেখলে যেকেউ বলে দিতে পারবে তাদের দুজনের মধ্যে কতোটা গভীর প্রেম চলছে। রিদর নিশ্চুপ ভালোবাসা আর মায়ার অস্থির মনোভাব দুজনকে একে অপরের ডুবিয়ে রাখে সারাক্ষণ। মায়ার মুখে যখন রিদ শেষ লিচুটা তুলে দেয় তখন মায়া মুখ ফিরিয়ে নেয় আর খাবে না বলে। রিদ তারপরও মায়ার মুখে শেষ লিচুটা দেওয়ার সময় হতভম্ব হয়ে গেইট দিয়ে ডুকতে দেখা গেল রাদিফকে। রাদিফকে দেখেই মায়া ভয় পেল। রাদিফ যদি মায়াকে এখানে দেখে উল্টা পাল্টা কিছু মনে করে বড়দের সবাইকে সবটা জানিয়ে দেয় তাহলে বিপদে পরবে ওরা দুজন। মায়া সেই ভয়ে রিদকে না বলে হঠাৎ দৌড়ে পালিয়ে গেল বাড়ির ভিতরের দিকে। মায়ার হঠাৎ কান্ডে রিদ খানিকটা চমকাল। মায়ার দৌড়ে যাওয়া দিকে তাকিয়ে খানিকটা উঁচু গলায় খাক ছেড়ে মায়ার উদ্দেশ্যে ডেকে বলল…

‘ রাতের ব্যাপারটা ভুলিনি কিন্তু রিত। আমার অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত চাই।

~~

ডাইনিং টেবিলের রাদিফের মুখোমুখি মায়া জড়তায় বসে। পাশেই রিদ টানটান হয়ে নাস্তা প্লেট উঠিয়ে বসল। তাতে নাস্তা তুলে খাবে সে তাই। সামনে নানান রকমের খাবার। সার্ভেন্ট পাশেই দাঁড়িয়ে। অথচ কেউ প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে না। এমন থমথমে পরিবেশে মায়া উঠতেও পারছে না জড়তায়। রিদ একা থাকলে একটা কথা ছিল। কিন্তু রাদিফ মুখোমুখি বসে থাকার কারণে মায়া ভদ্রতা দেখিয়ে এই মূহুর্তে উঠে যেতে পারছে না। যদি বেয়াদবি হয় সেজন্য। অথচ রাদিফের মনোভাব এমন যেন এই মূহুর্তে মায়া ছাড়া টেবিলের আশেপাশে আর কেউ নেই। সেই তখন থেকে রাদিফ ড্যাবড্যাব করে মায়াকে দেখেই যাচ্ছে। এতে করে মায়া ভিষণ নার্ভাস হচ্ছে। অস্বস্তিতে আছড়ে পড়ছে। এইভাবে কেউ মুখের উপর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে অস্বাভাবিক লাগে না বিষয়টা ? রিদ, মায়া আর রাদিফ দুজনের মনোভাব দেখল। রাদিফকে আপাতত কিছু বলে লাভ নেই। সে বড় ভাইয়ের বউকে গবেষণা করতে বসছে এই মূহুর্তে। যতক্ষণ না পযন্ত রাদিফের গবেষণা শেষ হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মায়ার দিকে এই ভাবেই তাকিয়ে থাকবে। রিদ রাদিফকে অপেক্ষা করে মায়া বলল তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে। মায়া আমতাআমতা করে আরও সিঁটিয়ে বসল চেয়ারে। রাদিফের দৃষ্টি আর মতিগতি কোনোটায় পরিবর্তন হলো না। মায়াকে চেয়ার ছেড়ে উঠতে না দেখে এবার রিদ বিরক্ত হলো। ধমক দিতেই মায়া হাসফাস করে উঠে দাঁড়াল। অস্বস্তিতে পরে থমথত খেয়ে রিদের ঠিক করে রাখা প্লেটটা উল্টিয়ে দিল। মায়ার এমন কাজে রিদ কপাল কুঁচকাল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল…

‘ কফি দাও!

রিদ মায়াকে কফির জন্য আদেশ করে মায়ার উল্টে দেওয়া প্লেটটা নিজেই আবার ঠিক করে রাখল। মায়া রিদকে কফি দিতে চেয়ে চায়ের কেটলিতে ধরলে রাদিফ বলল…

‘ ভাবি আমার প্লেটটাও উল্টিয়ে দাও ভাইয়ের মতো করে। সোজা প্লেটে নাস্তা করতে মজা পায় না। স্বাদ আসে না। উল্টো প্লেটে নাস্তা করলে নিশ্চয়ই মজা পাবো তাই না।

রাদিফের মুখে ভাবি ডাকটা শুনে মায়ার মনে অস্থিরতার ঝড় তুললো। অস্থির ভঙ্গিতে মায়া রিদের দিকে তাকাতে দেখল রিদ মায়ার দিকে পূর্ব থেকে তাকিয়েই আছে। দুই ভাই এমন করে মায়াকে কি দেখছে আল্লাহ জানে। কিন্তু মায়া সাংঘাতিক অস্বস্তিতে ভুগছে এই মূহুর্তে। তাছাড়া রাদিফ যে সরাসরি মায়াকে ভাবি ভাবি ডাকছে তাতে রিদ বাঁধাও দিচ্ছে না বরং চুপ থেকে নিরভ সম্মতি জানাচ্ছে। রিদের নিশ্চুপ সম্মতি আর রাদিফের সরাসরি ভাবি ডাকায় মায়া ভিতর থেকে অস্থির হয়ে উঠলো। সবকিছু গুলিয়ে ফেলে এলোমেলো কাজ করতে লাগল। খালি চায়ের কাপটা রিদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ আপনার রুটি।

রিদ মায়ার হাতের খালি চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে সেটা নিজের হাতে নিয়ে বিষন্নে বলল।
‘ এটা রুটি?

মায়া রিদের হাতের দিকে তাকিয়ে অস্হির ভঙ্গিতে লজ্জিত হলো। কি করবে ভেবে না পেয়ে তাড়াহুড়ো রিদের হাত থেকে খালি কাপটা ছিনিয়ে নিতেই সামনে থেকে রাদিফ সিরিয়াস গলায় বলল…
‘ ভাবি আমাকেও ভাইয়ের মতোন এমন রুটি দিন।

লজ্জা, ভয়, অস্থিরতা একত্রে ঘিরে ধরলো মায়াকে। রাদিফ যেন সেসব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বারবার ভাবি ডেকে আবদার করে। মায়া অনিচ্ছাকৃত ভুল গুলো আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাদিফ পুনরায় রুটি চাইলে মায়া হাতের কাছে একটা আপেল রাদিফের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ভয়ে আমতাআমতা করে বলল…

‘ আপনার চা।

রাদিফ মায়ার হাত থেকে আপেলটা নিয়ে গোল গোল চোখে সেটা কয়েক পলক দেখে টুপ করে সেটাতে কামড় বসাতে বসাতে বলল…

‘ আহা ভাবির হাতের চা হলো অমৃত। চা তো নয় যেন আপেলের স্বাদ পাচ্ছি খেতে।

মায়া রিদের দিকে একটা কলা এগিয়ে দিতে দিতে একই ভঙ্গিতে বলল…

‘ আপনার কফি।

রিদ মায়ার হাত থেকে কলাটা নেওয়ার আগেই রাদিফ সেটা ছু মেরে ছিনিয়ে নিতে বলল…

‘ ভাবি ভাইয়ের তোমার কফি খাওয়ার দাঁত নাই। আমার দাঁত আছে চৌত্রিশটা এই যে দেখো। এজন্য আমি তোমার কলা ফেভারের কফিটা খাই কেমন?

#চলিত….

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৩
সকাল ৯ঃ৪৫ মিনিট। তপ্ত রোদে উজ্জ্বল ধরনী। এই সাতসকালে রিদের কাজে থাকার কথা। অথচ সে কাজ ফেলে এই সাতসকালে ড্রাইভিং সিটে বসে। পাশেই রাদিফ চকচক মুখে বসে। মায়া দুই ভাইয়ের মাঝে পিছনের সিটে কাচুমাচু করে বসে। আপাতত সে হলো একজন আসামির নেয়। ওকে রিদ যেতাই নিয়ে যাচ্ছে মায়াও সেথায় সেথায় যাচ্ছে। এই সকালের নাস্তা টেবিলে কতো কিছুই না হলো। মায়া লজ্জা আর অস্থিরতায় ভুলবাল কাজ পযন্ত করলো। অথচ এখন মায়ার ফাহাদদের বাসায় মুক্তা আর জুইয়ের সাথে থাকার কথা। কাল রাত থেকে মায়া ঐ বাড়ি থেকে নিখোঁজ, নিশ্চয়ই সবাই টেনশন করছে মায়ার জন্য। কিন্তু রিদ মায়াকে না ঐ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে, আর না ঐ বাড়ি সম্পর্কে কিছু বলছে। মায়া টেনশনে নিজের বোনের শশুর বাড়িতে যাবে বলে এই নিয়ে বেশ কয়েকবার আরজি জানিয়ে ছিল রিদকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। রিদ মায়ার কথা কানে তো তুললোই না উল্টো মায়াকে বগলথাবা করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে এই সকাল বেলা। মায়া রিদকে কিছু বলতে পারছে না বলে চোখ ফেটে কান্না আসছে ওর টেনশনে। মন চাচ্ছে হাউমাউ করে কাঁদতে। কিন্তু মায়া তাও করতে পারছে না রাদিফের জন্য। সকাল থেকে অলরেডি মায়া অদ্ভুত সব কাজ কান্ড করে ফেলেছে। এখন নতুন করে আর কিছু ঘটাতে চাই না। নয়তো দেখা গেল রাদিফ মায়ার হাউমাউ চিৎকারের কান্না দেখে বলে বসল ‘ভাবি কষ্ট আমার কষ্ট। আমিও তোমার মতোন কান্না করতে চাই। তখন বিষয়টা আরও লজ্জাজনক হয়ে যাবে মায়ার জন্য। এমনিতে রাদিফ সকাল থেকে শুধু মায়াকে দেখে যাচ্ছে। রাদিফের ড্যাবড্যাব করে তাকানোতে মনে হচ্ছে মায়া কোনো মানুষ হতেই পারে না। মায়া হলো দুনিয়ার অষ্টম কোনো আশ্চর্য পদার্থ। যেটা রাদিফ খান জীবনের প্রথম দেখে ভিষণ বিস্মিত হয়ে আছে। তার থেকে সবচেয়ে ইতস্তত ব্যাপার হলো মায়া কালরাত থেকে একই ড্রেস পড়ে আছে। গায়ের জামাটাও এখন নোংরা নোংরা লাগছে মায়া কাছে। অথচ এই দুই ভাই কেমন টিপটাপ সেজেগুজে আছে। যেন নতুন জামাই সেজে মায়াকে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে তাঁরা। আল্লাহ জানে মায়াকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তারা। এদিকে মায়ার বাড়ির জন্য টেনশন হচ্ছে। মায়াকে ফাহাদদের বাড়িতে না পেয়ে নিশ্চয়ই ঐ বাড়িতে হাঙ্গামা লেগে গেছে। রিদের সাথে মায়ার অবাধে চলাফেরাটা যদি কারও কানে যায় তাহলে বিশ্রী একটা কান্ড ঘটে যাবে বোনের শশুর বাড়িতে। মায়ার মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা মধ্যেই রাদিফ সামনের সিট থেকে পিছন ঘুরে মায়াকে দেখলো টেনশন করতে। দুষ্টু রাদিফ মায়ার ভয় আরও বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ ভাবি তুমি আমাদের আম্মুকে চিনো? দেখছো কখনো সরাসরি?

রাদিফের কথায় মায়া ভয়ে কাচুমাচু মুখটা তুলে তাকাল রাদিফের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো দুজনের। মায়া ভয়ে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাল রাদিফকে। যে সে কখনো সরাসরি দেখেনি। মায়ার কথায় বেশ সিরিয়াস হলো রাদিফ। যেন সে মায়ার এই উত্তরটা পাওয়ার আশায় ছিল। মায়া রাদিফের হঠাৎ পরবর্তীত মনোভাব দেখেই বুঝলো যে রাদিফ মায়াকে এই মূহুর্তে বেশ সিরিয়াস কিছু বলতে চাই। রিদ সামনের ড্রাইভিং সিটে থেকে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুলে রাদিফকে এক পলক দেখে তাকাল মিররে দিকে। সেদিকে মায়ার ভয়ার্ত মুখটা দেখা গেল। রাদিফ তক্ষুনি সিরিয়াস গলায় বলল…

‘ ভাবি শুনো আমাদের আম্মু কিন্তু অনেক রাগি মানুষ বুঝলে। রিদ ভাইয়ের থেকেও রাগি। এতোটা রাগী যে আমাদের আম্মু যখন রেগেমেগে আগুন হয়ে যায় তখন আম্মুর কপাল দিয়ে দুটো আগুন শিং বের হয়। তুমি সাবধান থেকো ভাবি! আমাদের আম্মু নতুন মানুষ দেখলেই শিং দিয়ে গুতো মারে। তবে তুমি তো তার বড়ো ছেলের বউ সেই সুবাদে তোমাকে ছাড় দিলেও দিতে পারে আই ডোন্ট নো। আসলে আমার তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা হচ্ছে বুঝলে। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমার তোমাকে অনেক মনে ধরেছে, তোমাকে বড়ো ভাবির চোখে দেখি। এখন তুমি যদি আম্মুর শিংয়ের গুতো খেয়ে হসপিটালের পড়ে থাকো তাহলে আমি ভিষণ দুঃখ পাবো। এজন্য আমি তোমাকে সাবধান করতে চাইছিলাম ভাবি, তুমি আম্মুকে রাগ দিয়ে কোনো কাজ করো না কেমন। আম্মু সাথে দেখা হলেই তুমি সোজা আম্মুর পা ধরে শুয়ে পরবে। আসলে আমাদের আম্মুর লম্বা লম্বা সালাম পছন্দ তো তাই। ছোট ছোট সালাম করলেই আম্মু কেমন রেগে যায়। আমি আর রিদ ভাই তো আম্মুকে সবসময় লম্বা লম্বা সালাম করেই আসছি। তুমি এখন নতুন মানুষ তাই তুমিও আমাদের মতোন লম্বা লম্বা সালাম করবে কেমন?

রাদিফের কথায় ভয়ে মায়ার চোখ মুখ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এতক্ষণ মায়া জানতো রিদ ওকে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন রাদিফের কথায় সিউর হলো আসলে রিদ মায়াকে ওদের মা সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছে। মায়া ভয়, জড়তা, আতঙ্কে, গাড়ির এসির মধ্যেও ঘামতে লাগলো। রিদ আয়না দিয়ে মায়াকে দেখলো খুব অসহায় মুখে বসে থাকতে। হয়তো যেকোনো সময় অতিরিক্ত ভয়ে কেঁদেও ফেলবে। রিদ স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে রাদিফকে ধমক দিতে চাইলো মায়াকে উল্টা-পাল্টা না বুঝাতে। কিন্তু রিদের ধমকের আগেই রাদিফ মায়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতোন করে বলল…

‘ আহা, ভয় পেওনা ভাবি। আমি আছি তো তোমার সাথে। তোমার ভয়, আমার কষ্ট। আমি তোমাকে এক্ষুনি একটা সুবুদ্ধি দিচ্ছি, শাশুড়ী পটানোর রেসিপি। আমার কথা শুনলে তোমার সব ভয় সুমন্ত্রার সু হয়ে যাবে দেখো।

‘ সেটআপ ইডিয়ট। ভয় পাচ্ছে ওহ।

রিদের হঠাৎ ধমকে মায়া ভয়ার্ত মুখে চমকে উঠলো। রাদিফ মায়াকে ভয় পেতে দেখে বিরক্ত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে রিদের দিকে তাকিয়ে বলল…

‘ দিলে তো ভাবিকে ভয় পাইয়ে ভাই। এমনই ভাবি আম্মুকে নিয়ে টেনশনে আছে। কই তুমি ভাবিকে একটু সাহস দিবে তা না করে উল্টো ধমকে দিচ্ছো। ভাবি যদি এখন ভয়ে কাঁদে তাহলে দোষটা কার হবে বলো? তুমি জানো না আম্মু কাউকে কাঁদতে দেখলে রেগে যায়। ভাবিতো তোমার জন্য এখন আম্মুর শিংয়ের গুতো খাবে ভাই।

রাদিফের কথায় রিদ বিরক্তি চোখে তাকাল। মিরর দিয়ে মায়াকে আবারও এক পলক দেখে ডাইভিংয়ে মনোযোগ হলো। রাদিফ রিদকে চুপ করে যেতে দেখে পুনরায় মায়ার দিকে ফিরলো। মায়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার নাম করে আরও উল্টা পাল্টা বুঝাতে লাগলো। রিদ গাড়ি চালাতে চালাতে গম্ভীর মুখে দুজনকেই দেখল। স্বভাবে রাদিফ রিদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। রিদ যতোটা গম্ভীর স্বভাবের রাদিফ ততটাই প্রাণচাঞ্চল্য আর উৎফুল্লর ছেলে। স্বভাবে দুই ভাই ভিন্ন হলেও কেউ কাউকে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়না। রিদ কখনো রাদিফের স্বভাবের জন্য ওকে কোনো কিছুতে বাধ্য করেনি। বরং ছাড় দিয়ে চলে এসেছে এতদিন, আগামীতেও এমনটা করবে। রাদিফের বকবক আর মায়ার ভয়ের মধ্যে রিদের গাড়িটা থামে বারো তলা ভবনের সামনে। দারোয়ান রিদের গাড়িটা দেখেই সালাম দিয়ে গেইট টেনে ধরতেই রিদ গাড়িটা ঢুকলো ভিতরে। মায়া তখনো ভয়ে কাচুমাচুম করে বসে। রিদ গাড়িটা পাকিং করে সিট বেল খোলে নামতে নামতে ততক্ষণে রাদিফ গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে মায়ার পাশের দরজা খোলে দেয় মায়াকে নামতে। অপরিচিত পরিবেশে মায়া বেশ ভয়ার্ত মুখে গাড়ি থেকে নামলো। আশেপাশে তাকাতে দেখলো বিশাল বড়ো বড়ো দালানকোঠা মাথা উপর দাঁড়িয়ে থাকতে। ঢাকা শহরের অলিগলি সম্পর্কে মায়ার তেমন ধারণা না থাকায় বুঝতে পারলো না সে এই মূহুর্তে কোথায় আছে। রিদ ওকে কোথায় নিয়ে এসেছে। তবে আগ বাড়িয়ে রিদ বা রাদিফকে যে জিগ্যেসা করবে সেই সাহসটা পযন্ত পাচ্ছে না ওহ। ভয়ে মায়ার কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে। রিদ মায়াকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নিজের হাতের কোটটা মায়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ আমরা এখন গুলশান একে আছি। এই বিল্ডিংয়ের সিক্স ফ্লোরে আমার মা থাকেন। তোমাকে উনার সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসলাম চলো।

রিদের গায়ের কালো কোটটা মায়া নিজের হাতে নিলো ভয়ে কাচুমাচুম করতে করতে। রিদ মায়া ভয় বুঝেও না বুঝার মতোন করে সামনে হাটলো। রাদিফ মায়ার পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ফিসফিস গলায় বলল…

‘ ভাবি সাবধানে থেকো আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে তোমাকে নিয়ে।

মায়া এবার সত্যি সত্যি ভয়ে কলিজা কাঁপছে। রাদিফ সেই কখন থেকে নিজের মায়ের নামে উল্টা পাল্টা মায়াকে বুঝাতে বুঝাতে আনলো। ভয়ে যখন মায়ার পা চললো না তক্ষুনি রাদিফ মায়াকে তাড়া দিয়ে বলল..

‘ আরে ভাবি চলো চলো। আমাদের দেরি হলে আবার আম্মু রেগে যেতে পারেন। চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো।

তাড়া দেখিয়েই রাদিফ সাইটে দাঁড়াল মায়াকে সামনে যেতে বলে। মায়া ভয়ার্ত মুখে রাদিফকে এক পলক দেখে শুকনো ঢুক গিলে রিদের কোটটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটল রিদকে অনুসরণ করে। নিচ তলায় লিফ্টের সামনে আসতে রিদকে লিফ্টে ঢুকতে দেখে মায়াও সেদিকে এগোল। মায়া পিছন পিছন রাদিফও লিফ্টে ঢুকতেই রিদ টপ বাটন চেপে সিক্স ফ্লোরে চাপলো। ভয়ার্ত মায়া যখন কাচুমাচুম করে কাঁপছিল তক্ষুনি রিদ পাশ থেকে মায়ার একটা হাত চেপে নিজের পাশে দাঁড় করাল। মায়ার ছোট হাতটি তার শক্তপোক্ত পুরুষালি হাতের ভাজে নিতেই মায়া চোখ তুলে তাকাল রিদের দিকে। রিদ যেন মায়াকে গম্ভীরে সাহস দিল ভয় না পেতে। কিন্তু মায়ার তাকানোতেও রিদ তাকাল না মায়ার দিকে। বরং রিদ অপর হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে স্টংলি দাঁড়িয়ে রইল লিফ্টে। সিক্স ফ্লোরে আসতেই মায়ার হাতটা সেইভাবেই চেপে ধরে এগিয়ে গেল নিদিষ্ট ফ্ল্যাটের দিকে। রিদের কলিংবেল চাপার আগেই রাদিফ ফটাফট অধৈর্য্যের হাতে কলিংবেল বাজাল। মিনিটে মাথা দরজা খোলে দাঁড়াল বাইশ-তেইশ বছরের যৌবতী কাজের মেয়ে তনি। কালো গঠনের মেয়েটা দেখতে চমৎকার। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রিদ আর রাদিফের সঙ্গে মায়াকে দেখেই তৎক্ষনাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ছুটলো ফ্ল্যাটের ভিতরের দিকে….

‘ ম্যাডাম গো বড়ো ভাইজান ভাবিরে লইয়া আইছে দেইখা যান।

তনির চিৎকারে রাদিফ মজা পেলেও রিদ চরম বিরক্ত হলো। সেইভাবেই মায়ার ভয়ার্ত মুখটার দিকে এক পলক তাকিয়ে ঢুকলো ভিতরে। রাদিফ রিদ মায়ার আগেই দরজা ঠেলে ড্রয়িংরুমে সোফায় গা এগিয়ে চিৎ করে শুয়ে পড়লো ক্লান্তিতে। মায়া ভয়ে কাচুমাচুম করে রিদের পাশে দাঁড়িয়ে সুন্দর ফ্ল্যাটের বিলাসিতা দেখতে লাগলো আড়েআড়ে। ফ্ল্যাটের চারপাশের পরিবেশটা বেশ সুন্দর আর পরিপাটি গুছানো টাইপ। যেকেউ দেখলে বলবে এখানে রুচিশীল মানুষের বসবাস আছে। তবে মায়া বুঝতে পারছে না হুট করেই কেন রিদ মায়াকে ধরে বেঁধে নিজের মা সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসলো। মায়া রিদের স্বামী হওয়া সত্যিটা জানতে পেরেছে আজ মাত্র দুইদিন হলো এর মধ্যে রিদ নিজের পরিবারকে জানিয়ে দিল মায়ার সম্পর্কে? আচ্ছা এই লোক কি মায়ার সবকিছু জানার অপেক্ষাতে ছিল এতদিন? কখন মায়া নিজের স্বামীকে চিনতে পারবে আর কখন সে নিজের পরিবারকে জানাবে মায়ার সম্পর্কে এমন কিছু? মায়ার তো এখন তাই মনে হচ্ছে। মায়া নিজের স্বামীকে চিনলো না দুদিন হলো এর মাঝেই রিদ নিজের অধিকার খাটাচ্ছে মায়ার উপর। এমনকি রিদ দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে নিজের মায়ের সাথে মায়াকে বউ হিসাবে পরিচয় পযন্ত করিয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা মায়া কি দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী না?
অবশ্যই সে ভাগ্যবতী নারী। মায়া না চাইতেও সবকিছু পেয়ে যাচ্ছে। লোকটা কখনো মায়াকে মুখে বলেনি সে মায়াকে পছন্দ করে বা ভালোবাসে। অথচ তার কাজ কর্মে মনে হয় মানুষটার ভালোবাসার দুনিয়ার বলতে শুধু মায়া একাই আছে। মায়ার আজ নিজেকে সত্যি ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। মায়ার মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই কারও পায়ের শব্দ পেতেই মায়ার ধ্যান ভাঙ্গে। চোখ তুলে উপরে তাকাতে চোখে পড়লো চমৎকার সুন্দরী এক নারীকে৷ যার রুপ লাবণ্য চোখে লাগার মতোন সুন্দর। মায়া কিছুক্ষণের জন্য নিজের ভয় ভুলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো সেই মধ্য বয়স্কর সুন্দরী নারীর দিকে। সাদা ধবধবে গায়ে কালো মসলিন শাড়ি জড়িয়ে। চোখ দুটো রিদের মতোই তীক্ষ আর গাঢ় বাদামি। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো মহিলাটির হাইট আর ওয়েট দেখে। মায়া মনে হলো ওর শাশুড়ী হাইট রাদিফের প্রায় সমান সমান হবে। কম হলেও লম্বায়ে মহিলাটি ৫’৭ কি ৮ হবেই। তাছাড়া এই যৌবতী মহিলাকে দেখলে প্রথম দেখায় কেউ বলতে পারবে না এই মহিলার দুটো দামড়া দামড়া ছেলে আছে। বাপরে কি ভয়ংকর ব্যাপার বাপরে। মায়াকে হা হয়ে রিদের মা মিসেস সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলো সুফিয়া বেগম। গুছানো শাড়ির সাথে বামহাত ঘড়ি পড়া উনার। ডানহাতে চিকন একটা ডায়মন্ডের চুড়ি। বামহাতের ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে সুফিয়া বেগম তীক্ষ্ণ গলায় বলল…

‘ তোদের আসার কথা নয়টায়। এখন বাজে দশটা। একঘন্টা লেট হওয়ার কারণ?

শক্ত গলায়, শক্ত পারসোনালিটি দেখে মায়ার মনো হলো সে যেন রিদের কার্বন কপি দেখছে শাশুড়ীকে। বাপরে! কথা আর দৃষ্টি দুটোই কি তেজ তাদের। রিদ কিছু বলবে তার আগেই সোফায় শুয়ে থাকা রাদিফ উঠে বসতে বসতে বলল…

‘ ভাবির হাতের ইউনিক নাস্তা খেতে খেতেই আমাদের একঘন্টা দেরি হয়ে গেল মা। কি মজার মজার নাস্তা ছিল সেই গুলো আহা। আপেল ফ্লেভারের চা। কলা ফ্লেভারের কফি। কাপ ফ্লেভারের রুটি। আরও কতো কি ছিল।

রাদিফের কথায় সুফিয়া বেগম দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল রিদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট মায়ার দিকে। রাদিফের মুখে ভাবি ডাক শুনে উনার মনে হলো ছেলের বউয়ের কথা। সুফিয়া বেগম বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়ার পা থেকে মাথা অবধি পরখ করলো একবার। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা বজায় রেখে সেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল আবার রিদের দিকে। আগের নেয় গম্ভীর গলায় বলল…

‘ খেয়ে এসেছিস কেন? না করেছিলাম না? বলেছিলাম না সকালের নাস্তা এখানে এসে করবি। আমি যে সকাল থেকে না খেয়ে অপেক্ষা করবো সেটা মনে ছিল না?

সুফিয়া বেগমের গম্ভীর গলার কথায় মায়া কেঁপে ওঠে রিদের দিকে আরও চেপে গেল। রিদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পিছনে লুকাতে চাইলে রিদ মায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল…

‘ টেবিলে নাস্তা দিতে বলো মা। আমরা তেমন কিছু খেয়ে আসিনি। শুধু একটু কফি খেয়ে এসেছিলাম।

রিদের বলা শেষ করতে না করতেই তনি দৌড়ে কিচেনে গেল টেবিলে নাস্তা দিতে। সুফিয়া বেগমের কিছু বলার অপেক্ষা করলো না। কারণ সুফিয়া বেগম অনেক শক্ত ধাঁচের মানুষ। কথা কম বলে কাজ বেশি চাই উনার। অথযা ভারতি কিছুই পছন্দ না উনার। সুফিয়া বেগম রিদ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সম্পূর্ণ রুপে তাকাল ভয়ার্ত মায়ার দিকে। সে আপাতত রিদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বারবার আঁড়চোখে সুফিয়া বেগমকে দেখার চেষ্টা করছে। সুফিয়া বেগম মায়ার মনোভাব বুঝতে পেরেই গম্ভীর গলায় ডাকল মায়াকে নিজের কাছে…

‘ এই মেয়ে এদিকে আসো।

সুফিয়া বেগমের গম্ভীর ডাকে মায়া সারা শরীর শিহরিত হলো ভয়ে। আতঙ্কের নেয় খামচে ধরলো রিদের কোমরের পাশে শার্টের কিছু অংশ। রিদ দৃষ্টি নত করে মায়ার দিকে তাকাল। মায়াকে ভিষণ অসহায় আর ভয়ার্ত দেখাল। অতিরিক্ত নার্ভাসনেসে মায়াকে ঘামতে দেখে মনে হলো যেকোনো সময় কেঁদে ফেলবে মায়া ভয়ে। রিদ ছোট করে বলল…

‘ যাও।

মায়া নড়লো না। বরং রিদের পিছনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করলো। সুফিয়া বেগম হঠাৎ মায়ার ভয় পাওয়ার কারণটা বুঝতে না পেরে অনেক ধমক সুরে ডাকল মায়াকে নিজের কাছে….

‘ এই মেয়ে শুনতে পারছো না ডাকছি তোমায়? এদিকে আসো। কাম।

সুফিয়া বেগমের ধমকের মায়া কেঁপে উঠে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললো। রিদের শার্ট আঁকড়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই সুফিয়া বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রিদের দিকে। বলল…

‘ কি হয়েছে? কাঁদছে কেন ওহ?

রিদ রাদিফের দিকে বিরক্তি চোখে তাকাল। মায়াকে কাঁদতে দেখে রাদিফ দুষ্টু হাসছে নিজের কাজে সফল হতে পেরে। রিদ সেদিকে তাকিয়ে মিসেস সুফিয়া বেগমকে বলল….

‘ তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেসা করো মা। রাদিফ ওকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে তোমার নামে। সেজন্য তোমাকে ভয় পাচ্ছে ওহ।

রিদের কথায় শক্ত চোখে তাকাল সুফিয়া বেগম রাদিফের দিকে। রাদিফকে চোখ রাঙ্গিয়ে এগিয়ে আসলো রিদের দিকে। রিদের পিছন থেকে মায়ার হাত টেনে নিয়ে বসাল সোফার উপর। টি-টেবিলে উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ পানিটা খাও। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নাও।

মায়া ভয়ে ভয়ে পানিটা নিলো। ফুপাতে ফুপাতে গ্লাসে চুমুক দিতেই রিদ এসে রাদিফের পাশে বসলো। মায়া গ্লাসের পানিটুকু শেষ করতেই সুফিয়া বেগম হাত বাড়িয়ে মায়ার থেকে গ্লাসটা নিয়ে পুনরায় জায়গায় রাখতে রাখতে বলল…

‘ আমার ছেলেকে কি দেখে পছন্দ করলে তুমি? ঐ চেহারাটা ছাড়া আর কিছুই তো নেই ওর পছন্দ করার মতোন। তাহলে তুমি কি দেখে বিয়ে করলে ওকে? আমার ছেলের সুন্দর চেহারার প্রেমে পড়লে নাকি?

সুফিয়া বেগমের সরাসরি সোজাসাপ্টা কথায় মায়া ভয় আরও বাড়লো। মা ছেলের দুটোই এক। কথার তেজ আর আরচণের মানুষকে ঘায়েল করতে সক্ষম। মায়া কোনো রকমের মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দিতে দিতে বলল…

‘ না।

‘ চেহারার প্রেমে পড়োনি বলছো?
‘ হুমম।
‘ তাহলে কিসের জন্য বিয়ে করলে আমার ছেলেকে? ওহ তো সুবিধার মানুষ নয়।

#চলিত…