#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৩৪
সুফিয়া বেগমের সোজাসাপ্টা কথায় মায়া ভয় আরও বাড়লো। মা ছেলের দুটোই এক। কথার তেজ আর আরচণের মানুষকে ঘায়েল করতে সক্ষম। মায়া কোনো রকমের মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দিতে দিতে বলল…
‘ না।
‘ চেহারার প্রেমে পড়োনি বলছো?
‘ হুমম।
‘ তাহলে কিসের জন্য বিয়ে করলে আমার ছেলেকে? ওহ তো সুবিধার মানুষ নয়।
সুফিয়া বেগমের গম্ভীর কন্ঠ আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়ার গলায় শুকিয়ে এলো। তৃষ্ণার্ত গলায় আর ভয়ার্ত চোখে মুখে তুলে তাকাল সুফিয়া বেগমের দিকে। শক্ত শাশুড়ী কঠিন প্রশ্নের উত্তর, মায়াকে কি দিতে হবে এই মূহুর্তে জানা নেই। মহিলাটি এমনই ভিষণ লম্বা। মায়া সোফায় বসে মুখ তুলে উপরে তাকাতে তাকাতে ওর ঘাড় বেঁকে যাচ্ছে। চতুর সুফিয়া বেগম মায়ার নিরব অসুবিধাটা বুঝে চট করে বসে গেল মায়ার সামনে। মায়া চমকালো, ভড়কাল, ভয়ে আরও সিটিয়ে গেল সোফয়। সুফিয়া বেগম মায়ার পাশাপাশি সোফায় না বসে বরং মায়ার মুখোমুখি টি-টেবিলের উপর বসল তাও কিছুক্ষণ আগে মায়ার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া পানির গ্লাসটা সরিয়ে। সুফিয়া বেগমের হঠাৎ বসার ধরণে মায়ার কলিজা ধড়াস করে উঠলো আতঙ্কে। শুধু কথায় নয় মা-ছেলে বসাবসিতে যেন একই রকম ধার্চ রাখে। ভয়ার্ত মায়া খালি মস্তিষ্কে ভাবতে বসলো মা- ছেলের মধ্যে কে কাকে কপি করে আসলো? রিদ খান নিজের মাকে কপি করে নাকি মা নিজের ছেলেকে কপি করে বেড়ায় কোনটা? দুটো মানুষের কথা তেজ, আচরণ কিভাবে একই হয়। মায়াতো এতোদিন শুধু নিজের স্বামীকে সামলানো নিয়ে টেনশন করতো। কিন্তু এখন তো দেখছে কাহিনি উল্টো। শুধু ছেলেকে নয় শাশুড়ীকেও টেনশনের পাল্লায় তুলতে হবে। বাপরে! মায়া এমন আধা পাগল মানুষ দুটোকে কিভাবে সামলাবে ওহ? পান থেকে চুন খসতেই স্বামী নাকের ডগায় দম নিয়ে আসে মায়ার। এখন আবার কঠিন শাশুড়ী পাল্লায় পরলো ওহ। শেষ..! মায়ার জীবন ফ্রীতে শেষ হয়ে গেল। এই মা-ছেলে মিলে মায়াকে কথার বানে পিষে পিষে মেরে ফেলবে রোজ। মায়া ওহ কঠিন শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে অসহায়ত্ব বোধ করলো। বুক ফাটা আর্তনাদের কান্নাটা গলায় আটকে ভয়ার্ত মুখে তাকাল কিছু দূরে বসে থাকা রাদিফের পাশে রিদের দিকে। দুষ্টু রাদিফ দুষ্টু হেঁসেই মায়ার দিকে তাকিয়ে, কিন্তু কঠিন রিদ খান যেন বাজ পাখির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। যেন মায়া একটা উল্টা পাল্টা উত্তর দিলেই চোখ দিয়ে গুলি করে মারবে যেকোনো সময়। মায়া এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ফেঁসে যাবে ভাবেনি। পাশে ছেলের শুঁকুনের দৃষ্টি আর সামনে মায়ের আতঙ্ক। উফফ! এখন যদি মায়া শাশুড়ীকে ভয় পেয়ে বা সম্মান দেখিয়ে মিথ্যা বলে যে, উনার ছেলের প্রেমে পড়েনি তাহলে নিশ্চয়ই মায়াকে ওর স্বামী মাথার উপর তুলে আছাড় মারবে। আবার যদি সত্যি বলে, স্বামীর প্রেমে পড়েছে, তাহলে ওর শাশুড়ী যদি মনে করে মায়া উনার ছেলেকে বড়োলোক দেখে ফাঁসাতে চাইছে তাহলে সেটা মায়ার আত্মসম্মানে লাগবে প্রচুর? মায়া এখন কি করবে? এই মূহুর্তে কি বলা উচিত ওর? মায়া যখন দ্বিধাহীনতায় ভোগলো তখনই মায়ার ধ্যান ভাঙ্গে আবারও সুফিয়া বেগমের তীক্ষ্ণ কন্ঠে কথায়। তিনি মায়ার উদ্দেশ্যে আবারও বললেন…
‘ কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি। উত্তর দাও!
সুফিয়া বেগমের গম্ভীর কন্ঠে মায়া ভয়ার্ত মুখে মিনমিন করে বলল…
‘ আমি কিছু জানি না। আমাদের এমনই এমনই বিয়ে হয়ে গেছে।
মায়ার উত্তরটা পছন্দ হলো না চতুর সুফিয়া বেগমের। পেশায় উনি একজন এডভোকেট! দীর্ঘদিনের পেশাদারীতে উনি মানুষকে পাল্লায় তুলে পরখ করার অভিজ্ঞতা আছে উনার। ছেলের বউ হিসাবে অল্প বয়সী মেয়েটাকে উনার দারমাপা হয়ে গেছে এতক্ষণে। কিন্তু তারপরও ছেলের পছন্দ বলে মেয়েটিকে উনার প্রশ্নের মুখাপেক্ষীত হতে হবে। উনার জানা দরকার মেয়েটি আসলে উনার ছেলের জন্য কতোটুকু পারফেক্ট। উনার ছেলে এই মেয়ের জন্য পাগল সেটা উনি এতদিন শুনে এসেছে। কিন্তু উনার মতে এই মেয়েকেও অবশ্যই সমান পাগল হতে হবে উনার ছেলের জন্য। নয়তো যেকোনো পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে এই মেয়ে পিছিয়ে যেতে পারে। অল্প বয়সী মেয়েরা এমনই হয়। পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে না পারলে পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। এতে কষ্ট উনার ছেলে পাবে। তীক্ষ্ণতায় সুফিয়া বেগম মায়া কথার উত্তর সাপেক্ষে বলল…
‘ এমনই এমনই আবার বিয়ে হয় কিভাবে? আমার ছেলেকে কতোটুকু চিনো তুমি? ওর ক্রিমিনাল মাইন্ডের প্রখরতার সম্পর্কে তোমার এক রত্তিও জানা নেই। এখন তুমি যদি আমাকে বলো আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়েটা এমনই এমনই হয়ে গেছে তাহলে সেটা আমি কিভাবে বিশ্বাস করব বলো? ছেলে জম্ম দিয়েছি আমি। আমার জানা আছে আমার পেটের সন্তান কেমন? আমি যতটুকু জানি আমার ছেলের জীবনে কোনো কিছু এমনই হয় না। যেমন ধরো! গায়ের পোষাকটা যদি প্রোপার সিলেক্ট করে সে পড়ে, তাহলে জীবন সঙ্গীকে কি কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়ায় এমনই এমনই এন্ট্রি দিয়ে দিবে ওর জীবনে? শুনো মেয়ে আমার ছেলের জীবনের কোনো কিছু এমনই হয়না। তুমিও যে ওর জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ নয় সেটাও নিশ্চিত থাকো। তোমাকে ওর জীবনের জড়ানো পিছনে নিশ্চয়ই আমার ছেলের সলিড কোনো কারণ পাবে। সেটা হয়তো তুমি জানো না। কিন্তু আমি আমার ছেলেকে চিনি। এখন তুমি তোমার কথা শুনাও। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়েটা সম্পূর্ণ তোমার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, আমার ছেলের জন্য নয়। এখন তুমি যদি চাও তাহলে আমার ছেলে সাথে সেপারেশন করতে পারো। আমি তোমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আই এম অ্যা লয়ার। বুঝতে পারছো আমি একজন উকিল মানুষ। আমার মাত্র এক ঘন্টা লাগবে তোমাদের ডিভোর্সের বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে। সো আমার ছেলেকে ভয় না পেয়ে নির্ভয়ে বলো কি চাই তোমার? আমি সাপোর্ট করবো তোমাকে। কি সেপারেশন চাই তোমার?
সুফিয়া বেগমের সোজাসাপ্টা কথায় মায়ার মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। মায়া মুখে তৎক্ষনাৎ ঘুরে গেল রিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো দুজনের। রিদ পূর্বের নেয় দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে। মনে হলো সেও যেন মায়ের মতো করে মায়ার উত্তর গুলো চাই। ডরে ভয়ে মায়ার সিঁটিয়ে বসল। তক্ষুনি আবারও শুনা গেল সুফিয়া বেগমের গম্ভীর কন্ঠ…
‘ ওর দিকে না তাকিয়ে আমাকে দেখো। লুক এট মি! কি চাই তোমার বলো।
সুফিয়া বেগমের কথায় দুষ্টু রাদিফও হেঁসে তাল মিলিয়ে বলল…
‘ আরে ভাবি ভাইকে ভয় পেওনা। আমরা সবাই তোমার দলে বুঝলে। তুমি নির্ভয়ে বলো তোমার কি চাই? আমার উকিল মা কিন্তু একঘন্টার ভিতরে চট করে তোমাদের সেপারেশনের ব্যাপারটা রফাদফা করে দিতে পারবে। তারপর আমি নাহয় তোমাকে তোমার দুলাভাইয়ের বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসব। রিদ ভাই তোমাকে কিছু বলার সুযোগই পাবে না। তুমি বলো তোমার কি চাই?
মায়া কোলের উপরে রিদের কোটটাকে দু’হাতে দুমড়ে মুচড়ে কলিজা চেপে ধরা মতো করে সিঁটিয়ে বসল। মায়া মনে হলো সে কঠিন কোনো পরীক্ষা দিতে বসেছে এই মূহুর্তে। যে প্রশ্নপত্রের একটা উত্তরও জানা নেই মায়ার। ভয়ার্ত মায়া এসির মধ্যেও কপালের ঘাম কানিশ বেয়ে পড়ছে। দু’হাতে মুঠোয় রিদের কোটটা মুচড়ে ধরে কম্পিত গলায় বললো…
‘ আমার কিছুই চাই না।
‘ কি চাই না ঠিক করো বলো। আমার ছেলেকে চাই না বলছো?
সুফিয়া বেগমের কথায় তাল হারিয়ে মায়া তাড়াহুড়ো বলল….
‘ না না!
‘ না মানে চাই না?
‘ না চাই। আমার এই বিয়েটা চাই। আপনার ছেলেকেও চাই। মা হিসাবে আপনাকেও চাই। ভাই হিসাবে রাদিফ ভাইকেও চাই। দাদা-দাদি, সবাইকে চাই আমার এক পরিবারের।
মায়ার কথা শুনে রিদের কঠিন দৃষ্টি নরম হলো। যেন এতক্ষণ দম ধরে বসে ছিল মায়া কখন উল্টা পাল্টা উত্তর দিবে আর সে চট করে মায়াকে মাথার উপর তুলে আছাড় মারবে। রিদ গা এলিয়ে সোফায় বসতেই সুফিয়া বেগমে রিদের নমনীয়তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে মায়ার নত মস্তিষ্কের দিকে তাকিয়ে বললো…
‘ আর একবার ভাবো। চাইলে সময় নিতে পারো। রিদকে ভয় পেলে আমাকে আলাদা ভাবে বলতে পারো। আমার ছেলের সাথে থাকতে হবে এমন কোনো জোড়াজুড়ি নেই। চয়েস ইজ ইউর। থাকতে না চাইলে…
সুফিয়া বেগমের কথা মাঝে মায়া মিহির গলা শুধালো…
‘ আমার সময় লাগবে না ম্যাম। আমি উনার সাথে সেচ্ছায় থাকতে চাই।
মায়ার নিজেকে কেমন নিমজ্জিত মেয়ে মনে হলো। নিজের স্বামী, সংসার সে কেমন একা একাই ঠিকঠাক করে ফেলছে পরিবার ছাড়া। নিশ্চয়ই মায়াকে ওর শাশুড়ী লোভী মেয়ে ভাবছে। কিন্তু মায়াও বা কি করবে? মায়ার তো সত্যি ডিভোর্স চাই না। আমার সত্যি ওর স্বামীকে ভিষণ পছন্দ। মায়া তো এই লোকটার সম্পর্কে না জেনে না চিনেই ভালোবেসে ছিল এতোদিন। তাহলে এখন কিভাবে বলবে মায়ার ওর স্বামীকে চাই না? আদৌ এটা বলা মায়ার পক্ষে সম্ভব? অবশ্যই না। মায়ার কথায় সুফিয়া বেগম যেন বেশ সুষ্ঠি হলো। দৃষ্টিতে প্রখরতা বজায় রেখে আবারও গম্ভীর রিদের মুখটা দেখলো এক পলক। রিদ নিজের জীবন সঙ্গী বাচাই করতে ভুল করেনি। উনার কানে আগেই এসেছিল রিদ কোথাও একটা জমে আছে। নারী জাতীয় ব্যাপার হবে সেটা বুঝেও উনি এতোদিন চুপ ছিল। কারণ উনি জানেন উনার ছেলে যা করে সেটা অবশ্যই ভেবে চিন্তেই করবে। মা হিসাবে শুধু উনি অপেক্ষাতে ছিল কবে রিদ নিজের পছন্দের মানুষটিকে উনার সামনে হাজির করবে। রাদিফ কাল রাতে রিদের বিয়ের বিষয়টা উনাকে জানালেও তিনি আরও আগে থেকে জানতো রিদ ফাহাদের ছোট শালীকে বিয়ে করে নিয়েছে সেটা। আসিফ নিজেই জানিয়েছিল উনাকে। হয়তো রিদ বলেছিল উনাকে জানিয়ে রাখতে। সেজন্য তিনি এতক্ষণ ছেলের বউকে বাজিয়ে দেখছিল কতোটুকু লয়েল বা সামলাতে পারবে উনার ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকে। মেয়েটার ধৈর্য্য ভালো। উনার রগচটা ছেলের জন্য পারফেক্ট। সুফিয়া বেগম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাতের ঘড়িটায় সময় দেখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো…
‘ ওয়েলকাম মাই হোম অ্যান্ড আওয়ার লাইফ। এসেছো সেচ্ছায়। তাই নো মেটার! কোন পরিস্থিতিতে তুমি আছো বা ইন ফিউচারে কোন পরিস্থিতিতে পড়তে পারো। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য ইউ ক্যান ফাইট বাট কখনো কোনো পরিস্থিতির জন্য আমার ছেলেকে ছেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেওয়া যাবে না মনে রেখো। আর তোমাদের বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে তাই আমার ছেলের সাথে তুমি ঢাকায় শিফ্ট হয়ে যাও। তোমার পরিবারের সাথে আমি কথা বলবো এই নিয়ে৷ তোমার বয়স কম বা সংসার সামলানোর জন্য তুমি সুইটেবল নয় এসব অজুহাত দেওয়া যাবে না। বাকি রইল তোমার পড়াশোনা ব্যাপারটা। তাহলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় পড়াশোনা মান ভালো। তাছাড়া আমাদের পরিবারের সবাই হাইলি এডুকেটেড। তোমার পড়াশোনায় আমাদের সাপোর্ট শত% পাবে। বলতে পারো তোমার হাতে ধরে আমরা তোমাকে শিক্ষিত বানাব। এখন বলো আছে কোনো অসম্মতি?
সুফিয়া বেগমের কথায় মায়া কোনো কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই নত মস্তিষ্কে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। যার অর্থ ওর কোনো অসম্মতি নেই কোনো কিছুতে। সুফিয়া বেগম মায়া সম্মতি পেয়ে আবারও বলল…
‘ ভেরি গুড! এখন চলো খাবে। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে। রাদিফ তোর ভাবিকে নিয়ে টেবিলে যা আমার রিদের সাথে কথা আছে। গো।
‘ জ্বি মা!
মায়ের আদেশে রাদিফ বাধ্য ছেলের মতোন উঠে দাঁড়াল। শাশুড়ী আদেশ পেয়ে মায়াও জড়তার পায়ে উঠে দাঁড়াল। রাদিফের পিছন পিছন ডাইনিং পযন্ত এগোতে এগোতে ভাবলো। সে ছাতার মাথা খাবে এমন চাপ সৃষ্টিকারী পরিবেশে বসে। ক্ষুধায় মায়ার পেট চুচু করলেও শাশুড়ী নামক আতঙ্কে ওর পেট থেকে গলা পযন্ত শুকিয়ে কাট। মায়ার মনে হচ্ছে সে এই মূহুর্তে পানি পযন্ত খেতে পারবে না শাশুড়ীর সামনে বসে। সবকিছু কেমন উল্টি করে বেড়িয়ে আসবে। মায়ার মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা মাঝেই ডাইনিংয়ের সামনে দাঁড়াতে রাদিফ হেঁসে একটা চেয়ার টেনে দিল মায়াকে বসতে। মায়া অস্বস্তির দৃষ্টিতে রাদিফকে দেখে বসতে গেল তৎক্ষনাৎ বাঁধা দিল রাদিফ। মায়ার হাত থেকে রিদের কোটটা নিতে নিতে পুনরায় মায়াকে চেয়ারে বসতে আশ্বস্ত করলো। মায়া চেয়ারে বসতে রাদিফ পুনরায় ড্রয়িংরুমে দিকে গেল রিদের কোটটা রাখতে। সেই সুযোগে তনি মায়াকে একা পেয়ে মুখ খুলল। সে এতক্ষণ যাবত সুফিয়া বেগমের কান্ডখানা নিরব দর্শকে মতো দেখেছে। শুধু অপেক্ষা ছিল ওহ কবে মায়াকে একা পেয়ে মনে কথা গুলো বলবে। তাই রাদিফ যেতেই সুযোগ পেয়ে তনি বলল…
‘ ভাবি গো আইজকা আফনে বড়ো বাঁচা বাঁচ্ছেন। বাপরে! আমার তো আফনার লাইগা ডরে কইলজাডা ঠকঠক করতাছিল। মনে করছিলাম আফনে বড়ো ম্যাডামের প্রশ্নের ভুলবাল উত্তর দিবাইন আর বড়ো ম্যাডামের হাতের বিশাল ঝাড়ি খাইবান। আইজকা যদি আফনে বড়ো ম্যাডামের প্রশ্নের একডাও ভুলবাল উত্তর দিতাইন, বা কইতেন, আফনে রিদ স্যাররে ডির্ফোস দিতে চাইন তাইলে দেখতাইন, হগ্গলতের সুন্দর সুন্দর চেহারার রহস্য। বড়ো ম্যাডাম মেলা চালাক মানুষ ভাবি। বড়ো ম্যাডাম আফনারে হের কথার জ্বালে ফাঁসাইয়া আফনার পেট থেইক্কা কথা বাড় করতাছিল। আফনে রিদ ভাইরে কতোটুকু ভালোবাসুইন হেইডা জানতে। এইসব ডির্ফোস টির্ফোস কিচ্ছু পাইতেন না আফনে। বড়ো ম্যাডাম কইছে আফনে রিদ ভাইয়ের পছন্দের মানুষ। আফনে এই জীবনেও ছাড় পাইবেন না রিদ ভাইয়ের থেইক্কা লেইখা লন। রিদ ভাই যে রগচটা আর বদমেজাজী ব্যাডা মানুষ, সোজা মুখে তো কথাই কইনা কেউ লগে, আফনে ছোডো মানুষ হইয়া কেমনে ফাঁসলেন রিদ ভাইয়ের লগে? রিদ ভাই কি আফনারেও ডর দেখাইয়া রাখে ভাবি?
তনি কথায় মায়া মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাল। যার অর্থ এমন কিছুই না। তনি মায়ার অসম্মতিতে সন্তুষ্টি হলো কিনা জানা নেই। তবে অনেকটা আফসোস সুরেই বলল….
‘ ভাবি শুনেন! আফনারে একটা কথা কই। আপনার শশুর বাড়ির মানুষ সবাই রাজনীতির মানুষ বুঝছেন। হেরারে আফনে টক্কর দিইয়া কহনো পার পাইবেন না। এর থেইক্কা আফনার জন্য ভালো হইবো আফনি যদি রিদ ভাইয়ের কথা শুইয়া লক্ষী বউয়ের মতোন চলেন হের। কারণ সংসার আফনে কিন্তু রিদ ভাইয়ের লগেই করবেন ভাবি। আফনার শশুর, শাশুড়ী, দাদা-দাদি, সবাই আলাদা আলাদা বাড়িতে থাহে। রাদিফ ভাই থাহে বিদেশ। হেতের কথা বাদ দিন। আফনার শশুর- শাশুড়ী মধ্যে কঠিন কেঁচাল আছে বুঝলেন ভাবি! জামাই -বউ মনে হয় আজ পনেরোডা বছর ধইরা এক লগে থাহে না। কেউ কারও মুখও দেখাদেখি করে না। পারিবারিক অনুষ্ঠানে দুজনের একজনেরেও আফনে উপস্থিত পাইতেন না। দুইজনের এতো মনকষাকষি তারপরও একজন অন্যজনরে ডিফোর্স দেয় না। মূল কথা অইল আপনার শশুর- শাশুড়ী জন্য আপনার শশুর বাড়ির সবাই বিছিন্ন আর আলাদা আলাদা বাড়িতে থাহে। আমি এইখানে কাম করি নয় বছর ধইরা কিন্তু আইজ পযন্ত জানতে পারলাম না কি নিইয়া ঝামেলা বড়ো ম্যাডামের উনার জামাইর লগে। এই বিষয়ে কেউর অনুমতি নাই কোনো প্রশ্ন করার। আফনে রিদ ভাইয়ের বউ হয়তো রিদ ভাই আফনারে কিছু না কিছু কইতে পারে ভবিষ্যতে। তবে আমার কথা মানেন ভাবি, জীবনের আর যাই করেন কোনো বেলা রিদ ভাইরে কষ্ট দিইয়েন না কিন্তু। তাইলে আফনে বা আফনার পরিবারের কেউ আস্তা থাকবো না ভাবি। রিদ ভাই হইলো বড়ো ম্যাডামের জান। রিদ ভাই যদি কোনো কিচ্ছু লইয়া কষ্ট পাই তাইলে বড়ো ম্যাডাম হের শশুর বাড়ির মানুষরে ছাড় দেয় না আমি দেখছি। এজন্য আফনারে এতো ঝেরা-প্রশ্ন করতাছিল বাজাইয়া দেখার লাইগা। আফনার উত্তরে সবাই সন্তুষ্ট, এইলাইগা পরিবেশ এহনো ঠান্ডা দেখতাছেন। নয়তো একডা ভুলবাল উত্তর করতেন তাইলে দেখতেন এই মূহুর্তে আফনার উপর দিইয়া ঝড়-তুফান টনেটো সব চইলা যাইতো। আমিতো পারি না এই চাকরিডা ছাইড়া ছইলা যাইতাম। কিন্তু এতো ভালো টাহার চাকরি আমি এই ঢাহা শহরে আর পামু না দেইখা এই লাইগা চাকরিডা আমি ছাড়তে পারি না। সারাদিনে শুধু বড়ো ম্যাডামের লাইগা দুই বেলা রান্না করতে হইয়। সকালের নাস্তা আর রাতের খাওন। দুপুরে ম্যাডাম কোটের ভিতরেই বইয়া খায়। সারাদিন আমি অবসরে বইসা বইসা টিভি দেখি আর মাস শেষে মোটা অংকের টাহা গুনি। নয়তো বড়ো ম্যাডামের মতো কঠিন রাগী মহিলা বাড়িতে কে কাম করতো? আমি তনি তো মইরা গেলেও করতাম না। বাপরে আফনার শাশুড়ী চাহন দেখলে আমার কইলজা কাপে। বুঝি না আফনার শশুর এই মহিলারে কি দেইখা বিইয়াডা করছিল। নিশ্চয়ই বড়ো ম্যাডামের রুপ দেইয়া আফনার শশুর পাগল হইছে নয়তো এমন কঠিন মানুষরে আবার কেউ বিইয়া করে নাহি? আমিতো জীবনেও করতাম না।
তনি দীর্ঘ কথায় মায়া গালে হাত রেখে তনি কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। তনি সব কথায় মায়ার মাথায় ঢুকেছে। কিন্তু মায়া বুঝলো না তনি মায়ার কাছে ওর শশুর বাড়ির নামে বদনাম করছে নাকি সুনাম। মায়া তনির আফসোসরত মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ আপনি কি সবার নামে সুনাম করছেন নাকি বদলাম? যদি একটু বলতেন আপু?
মায়ার কথায় তনি আরও হতাশ হলো। হাতের প্লেট গুলো চেয়ারের সামনে সাজাতে সাজাতে ফের আফসোস করে বলল…
‘ আমিতো বদনামই করতে চাইছিলাম ভাবি। কিন্তু এদের ব্যক্তিত্ব খালি আমারে কনফিউজড করে। না আমি ভালা কইয়া এদের চালাইতে পারি আর না মন্দ বইলা দোষ দেখাইতে পারি। কেমন শক্ত কঠিন মানুষ এরা। এদের দোষ বের করতে গেলেও নিজেই কেমন কইরা যানি সুনাম বের কইরা ফেলি । এদের মায়াই ফাঁসলে জীবন রফাদফা ভাবি। একদম শেষ! জীবনে হাইসা দুইডা কথা কইতো না এরা। আর না নরম ব্যবহার করবো কহনো। হেরপরও এরা মানুষরে কেমনে কইরা জানি নিজেদের মায়ার জ্বালে আটকায় রাহে ভাবি, আল্লাহ জানে। আমারে দেহেন ভাবি! হেই প্রথম থেইক্কা এই চাকরি করুম না, চইলা যামু, চইলা যামু কইরা কইরা আইজ নয়টা বছর পার করলাম। এহন আমি নিজেই বড়ো ম্যাডামরে ফালাইয়া দুইদিনের লাইগা গ্রামের বাড়িতে যাইতে মন চাইনা। আমি চইলা গেলে যদি ম্যাডামের অসুবিধা হয় হেই লাইগা। অথচ বড়ো ম্যাডাম আমারে আজও আপন কইরা লইতে পারলো না। কেমন রোবট মতোন চলাফেরা করে। আমার লগেও ঠিক কইরা কথা কইনা।
মায়া তনি সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলো। তনি মুখে নিজের শশুর বাড়ির সম্পর্কে বদনাম শুনেও কেমন জানি শান্তি লাগছে মায়ার। মায়া ঘাড় বেঁকে তাকাল পিছনে। দেখা গেল মা ছেলে তিনজনই কিছু নিয়ে মনোযোগ সহকারে আলোচনা করছে। রাদিফকেও বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো এই প্রথম। মায়ার মনে হলো এই মানুষ গুলো ভিতর বাহিরে শক্ত কঠিন ব্যক্তিত্ব ধরে রাখলেও এদের সবার মাঝে ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখার দারুণ একটা মন আছে। এই যেমন মায়া নিজের স্বামীর পরিচয় জানার পরপরই রিদ কেমন নিজ দায়িত্বে পরিবারের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে আসলো মায়াকে। মানুষ ভালোবাসলেও পরিবারের সামনে ভালোবাসার মানুষকে হাজির করতে চাই না। কিছু দিন অন্তত গোপনে রাখতে চাই। অথচ মায়ার ক্ষেত্রে হয়েছে ভিন্ন মায়ার কিছু জানার আগেই রিদ নিজের পরিবারকে মায়ার পরিচয় সম্পর্কে জানিয়ে রেখেছে। এতে দুজনের পবিত্র সম্পর্কটার সম্মান রেখেছে রিদ। তারপর দেখা গেল মায়ার কঠিন শাশুড়ীও ছেলের পছন্দের বাহিরে টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। ছেলে নিজের পছন্দের বউকে হাজির করলো, আর মা হয়ে তিনি এতেই সম্মতি দিয়ে মায়াকে বুঝালো উনার ছেলেকে কখনো ছেড়ে না যেতে। অথচ উনারা এতো অর্থ সম্পদশালী, ক্ষমতা সম্পূর্ণ মানুষ, তাঁরা চাইলে মায়ার মতোন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে হাতের তুরিতে টিস্যুর মতোন ফেলে দিয়ে, রিদের জন্য যোগ্যতা সম্পূর্ণ কাউকে জীবন সঙ্গী হিসাবে বাঁচাই করতে পারে। রিদ একজন প্রতিষ্ঠিত, সফল ও হাইলি এডুকেটেড ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ মানুষ। যেকোনো নারীই রিদ খানের বউ হতে চাইবে। সেখানে মায়ার মতোন অদক্ষ, অযোগ্যতা আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ একটা মেয়েকে বেঁছে নেওয়াটায় বুঝায় এদের কঠিন ব্যক্তিত্বের বাহিরেও তাদের সবার সুন্দর একটা ভালোবাসার মন আছে। মানুষ বলে কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ গুলা নাকি প্রিয়জনকে আগলে রাখার ব্যাপারটা দারুণ থাকে। আজ মায়া চোখের সামনে দেখতে পারলো এতো গুলা মানুষকে।
~~
সকাল ১১ঃ১৭। রিদ ডাইভিংয়ে মায়া পাশের সিটে গা এলিয়ে বসে। রিদের দৃষ্টি আর মনোযোগ ডাইভিংয়ে থাকলেও মায়া মনোযোগ রিদকে দেখার উপর। রিদ বেশ কয়েক বার ভ্রুর কুঁচকে মায়াকে দেখেছে এভাবে তাকিয়ে থাকা নিয়ে। কিন্তু মায়ার কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। মায়া সিটে কাত হয়ে রিদের দিকে ঘুরে বসে। রিদ ডাইভিংয়ের মধ্যে মায়ার মনোযোগ ভাঙ্গতে মায়ার দিকে ভ্রুর কুঁচকে তাকিয়ে বলল…
‘ কি সমস্যা? কি দেখো?
মায়া সেইভাবেই বসে থেকে উত্তর করে বলল…
‘ আপনাকে দেখি। জানেন আমি কখনো ভাবিনি আপনাকে এতো নরম ব্যক্তিত্বে দেখব কখনো।
রিদ মায়ার তাকিয়ে থাকার মানে বুঝতে পেরে সে চুপ রইল। মায়া রিদকে কিছু বলতে না দেখে সাহস পেয়ে আবারও বলল…
‘ আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। বলি?
রিদ স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে সম্মতি দিল…
‘ হুম।
মায়া সিট ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। সিরিয়াস হওয়ার ভঙ্গিতে মিনমিন করে বলল…
‘ আমাদের কলেজে থেকে রাঙ্গামাটি যাওয়ার ট্যুরের প্লানিং করছে সবাই। আমিও সবার সাথে যেতে চাচ্ছিলাম। আমাকে…
রিদ মায়ার কথায় মাঝে ওর দিকে না তাকিয়েই ড্রাইভিং করতে করতে বলল…
‘ নো ট্যুর! নো প্ল্যানিং! কোথাও যাওয়া যাবে না তোমার। সব ক্যান্সেল।
মায়া হতাশার গলায় বলল…
‘ এমন করছেন কেন? সবাই তো যাচ্ছে আমি একা না। এই ট্যুরে আরিফ ভাইয়াও যাবে আমাদের সাথে। এখন আমি না গেলে ভাইয়া নিশ্চয়ই জিগ্যেসা করবে কেন যেতে চাচ্ছি না।
‘ পাকামো করবে না রিত। আমার এসব পছন্দ না। আরিফের সাথে আমি কথা বলে নিব।
রিদর মুখে আরিফের নামটা শুনতেই মায়া আতঙ্কিত গলায় তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো…
‘ আরে না না! আরিফ ভাইয়ার সাথে কথা বলতে হবে না আপনার। সামান্য একটা ট্যুরে জন্য আরিফ ভাইকে এখনই আমাদের সম্পর্কে বলার দরকার নেই। আমি কোথাও যাব না। প্রমিস!
মায়া তাড়াহুড়ো ব্যাপারটায় রিদের সন্দেহ হলো। মায়া যে নিজের পরিবারকে ওদের সম্পর্কে জানাতে চাচ্ছে না সেটা ভালোই বুঝলো রিদ। রিদ ডাইভিং করতে করতে মায়ার দিকে ভ্রুর কুঁচকে তাকিয়ে বলল….
‘ তুমি কি কোনো ভাবে এই সম্পর্কটা তোমার পরিবারের কাছে হাইড করতে চাচ্ছো রিত?
রিদের কথায় মায়া ভয়ে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালেও মনে মনে সে জানে সত্যিটা এটাই। মায়া সত্যি রিদকে নিজের পরিবারের সামনে এখন উপস্থিত করতে চাচ্ছে না। তাহলে সবাই মায়াকে দোষ দিবে যে মায়া নিজের বোনের ভাসুরকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। এজন্য মায়া চাচ্ছে আরও কয়েকটা দিন যাক তারপর না-হয় আস্তে ধীরে নিজের পরিবারকে জানানো যাবে রিদকে নিয়ে। মায়া রিদকে মিথ্যা বলে বলল…
‘ হাইড করবো কেন? আসলে বড়ো আপু বিয়েটা মাত্র শেষ হলো। আর কয়েকটা দিন যাক তারপর না-হয় আমাদের ব্যাপারটা জানলো।
মায়ার কথা গুলো রিদের যুক্তিসঙ্গত মনে না হলেও সে আপাতত চুপ রইল। তাড়াহুড়ো করে মায়াকে চাপে ফেলতে চাই না রিদ। বরং বউকে কিছুদিন সময় দেওয়া উত্তম ভেবেই সে চুপ রইল। কিন্তু মায়া রিদকে নিয়ে কি ভাবছে সেটা মায়ারও জানে না। সুফিয়া বেগমের প্রতি কথার সম্মতি তখন শুধু মায়া চাপে পরে দিয়ে এসেছিল ওহ। মন থেকে কিছুই দেয়নি। বরং মায়া রিদের সাথে বিয়েটা পরিবারকে জানানো নিয়ে এই মূহুর্তে ভিষণ ভয়ে আছে। কিভাবে কি করবে? বা মায়ার পরিবার আদৌও ওদের সম্পর্কটা মানবে কিনা তাও জানে না মায়া। মূলত মায়া ভয় থেকেই রিদের সাথে সম্পর্কটা লুকাতে চাইছে। তীক্ষ্ণ সুফিয়া বেগমের তখনকার কথাটায় সত্যি হলো। অল্প বয়সী মেয়েরা বুঝে কম। তারা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে জানে না। বরং ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। মায়ার ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে। রিদকে যতোটা সাহসীকতার সাথে ভালোবেসে ছিল ঠিক ততটাই দূর্বল মন মানসিকতা পরিচয় দিচ্ছে পরিবারের সামনে রিদকে তুলে ধরতে। মায়ার এই দূর্বল মন মানসিকতা জন্য ভবিষ্যতে কতোটা প্রভাব ফেলবে রিদ-মায়ার সম্পর্কে তাও ধারণা নেই মায়ার। তবে খুবই ভয়ংকর কিছুর মুখামুখি হতে হবে মায়া দূর্বল মানসিকতার জন্য।
#চলিত….
#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৩৫
বসার ঘরে বিশাল বৈঠক। পাত্র পাত্রী দেখাদেখির পাঠ চুকিয়ে উপস্থিত মেহমাদের খাওয়া দাওয়া পূর্ব ইতিমধ্যে শেষ করে আলোচনা বসলো দুই পরিবার। উপস্থিত সদস্যদের গমগমে পরিবেশে মায়া অবস্থা দেখার মতো। লম্বা ঘোমটায় লাল শাড়ী পরিহিত মায়া থমথমে আর হৃদয় ভাঙ্গুনে সিটিয়ে বসে। ঘোমটার আড়ালে থেমে থেমে নাক টানার শব্দ আসছে হয়তো কান্না আটকে রাখার চেষ্টায় নাক টানছে। তবে কিছুক্ষণ পরপর হাতের টিস্যুটা চোখে লাগাতেও দেখা যাচ্ছে। মায়াকে ঘিরে বসার ঘরে চেয়ারম্যান পরিবারের সবাই রয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের দুই ভাই, দুইবোন, উনাদের ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, তাদের বাচ্চাকাচ্চা, আবার চেয়ারম্যান সাহেবের নিজের তিন মেয়ে, তাদের জামাতা, নাতিনাতনি, সবমিলিয়ে প্রায় বিশের ঊর্ধ্বে
সদস্য উপস্থিত মায়াকে পাত্রী হিসাবে দেখতে। মুক্তা ফাহাদের বিয়েটা শেষ হয়েছে আজ প্রায় পাঁচদিন হলো। ফি-যাত্রীতে মুক্তা ফাহাদকে নিয়ে নিজ বাড়িতে এসে চলে গেল আজ দুদিন হলো। সে এখন নিজের শশুর বাড়িতেই আছে ফাহাদের সাথে। আজ মায়াকে দেখতে আসার ব্যাপারটাও হুট করেই ছিল। মায়ার পরিবার যদিও এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবে উনারা জানতো মুক্তার বিয়ের পরপরই মায়ার বিয়ের আলোচনা চলবে চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের সাথে। পূর্ব কথা অনুযায়ী মুক্তা বিয়ের সাপ্তাহ খানিক পরই মায়ার বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হবার কথা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাকও ছিল। কিন্তু হুট করে নাদিমের স্কলারশিপের কাগজপত্রে কমপ্লিকেশন দেখা দেওয়ায় সে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসছে না টেনশনে। বরং দৌড়াদৌড়ি করে কাগজ পত্রের ঝামেলা মিটিয়ে নিচ্ছে। সেজন্য নাদিম মায়াকে দেখতে আজ ওর পরিবারের সাথে উপস্থিত হতে পারেনি। বরং এম্বাসিতে বসে ভিডিও কলে জয়েন হয়েছে নিজের এনগেজমেন্টের রিং বদলে। এই আলোচনায় যতদিন পযন্ত নাদিমের ভিসার প্রসেসিংয়ে ঝামেলা শেষ না হচ্ছে ততদিন পযন্ত আপাতত মায়া- নাদিমের বিয়েটা পিছিয়ে যাবে। নাদিমের কাগজের ঝামেলাটা মিটিয়ে গেলেই পারিবারিক ভাবে দুজনের বিয়েটা দেওয়া হবে। তবে আজ দুই পরিবারের সম্মতিতে নাদিমের সাথে মায়ার পারিবারিক ভাবে আংটি বদল হয়ে থাকবে। আলোচনা অনুযায়ী তাই হলো। মায়ার বিয়েটা সৌভাগ্য ক্রমে পিছিয়ে গেলেও নাদিমের বাবা চেয়ারম্যান সাহেব তিনি নিজের হাতে মায়াকে গোল্ডের মধ্যে চকচকে একটা ডায়মন্ড রিং পরিয়ে দিলেন। মায়া হাতে রিং পড়ানোর সময় মায়া কান্না আটকাতে না পেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল কষ্টে। এতে চেয়ারম্যান সাহেবসহ উপস্থিত সবাই মনে করলো মায়া ছোট মানুষ বলে ইমোশনে ভয়ে কান্না করছে। চেয়ারম্যান সাহেব অল্প হেঁসে মায়াকে আশ্বস্ত করে একটা ভরসার হাত মায়ার মাথায় বুলিয়ে দেয় কান্না না করতে। নাদিমের সপরিবারেও মায়াকে সাদরে গ্রহণ করে ভরসা দেয় কান্না না করতে। সবার এতো এতো আন্তরিকতায় মায়া আরও ফুপিয়ে উঠে অপরাধবোধে। মায়া এই বিয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানতো না। হুট করে আজ সকালের জানতে পারলো মায়ার বিয়ে তাও চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে নাদিমের সঙ্গে। এটা নাকি আগে ঠিক করা ছিল নাকি। কই মায়াতো এই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানতো না। কিন্তু যখন মায়া এই সম্পর্কে জানতে পারে তখন ঘোর আপত্তি জানিয়ে ছিল এই বিয়েটা করবে না বলে কিন্তু কেউ মায়ার কথা বিশেষ একটা গুরুত্ব বা পাত্তা দেয়নি। কারণ বিয়েটা পূর্ব থেকে ঠিক করা ছিল বলে। তাছাড়া মায়ার কথা গুরুত্ব দেওয়ার মতোন কেউ মায়াকে তেমন সিরিয়াস নেয়ও নি। মোট কথা মায়া পরিস্থিতির এমন একটা ফ্যাসাদে পরেছে যে এই মূহুর্তে নিজের পরিবার বা রিদকে বলতে পারছে না একে অপরের সম্পর্কের কথা। মায়া বিবাহিত সেটা কখনোই মায়া নিজের পরিবারকে বলতে পারবে না। তার কারণ মায়া বড়ো বোন। মুক্তা বিয়েটা মাত্র হলো ঐ বাড়ির ছেলের সাথে। এখন যদি মায়া নিজের বিয়ের বিষয়টা জানাজানি করে তাহলে মুক্তার শশুর বাড়িতে মায়াকে নিয়ে অশান্তি হতে পারে। এমনিই সেদিন মায়াকে রিদ ফাহাদের বাসায় ড্রপ করার সময় সেটা ঐ বাড়ির কেউ সেটা ভালো চোখে দেখেনি। এই বিষয়টা মায়া বেশ বুঝতে পেরেছিল ফাহাদের মা মনোভাবে। যদিও আসিফ সবাইকে আগেই বলে রেখেছিল রিদের মা সুফিয়া বেগম মায়াকে দেখতে চেয়েছিল সেজন্য আসিফ মায়াকে পরদিন সকালে সবার ঘুম থেকে উঠার আগে নিয়ে গিয়েছিল সুফিয়া বেগমের সাথে দেখা করাতে। কিন্তু তারপরও ঐ পরিবারের অনেকেই মায়ার উপর অসন্তুষ্ট ছিল মায়াকে রিদের সঙ্গে গাড়ি করে ফিরতে দেখে। জোর মুখে অনেক প্রশ্নও তুলেছিল রিদের মা সুফিয়া বেগমের মতোন শক্ত মানুষ কেন মায়াকে দেখতে চাইবে? এর কি কারণ হতে পারে? সবার মতে সুফিয়া বেগম তো ফাহাদের শালীকে চিনার কথা না। যেখানে তিনি ফাহাদের বউকেই চিনেন না সেখানে আসিফকে বলে মায়াকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিল সবার দৃষ্টিকুটুরের কারণ। হেনা খান অবশ্য মায়াকে কৌতূহল নিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে প্রশ্ন করছিল, সুফিয়া বেগম মায়াকে ডেকে নিয়ে কি বলেছিল সেটা জানতে চেয়েছিলেন? মায়া তখন উত্তরে তেমন কিছুই বলেনি। শুধু বলেছিল মায়াকে সকালে নাস্তাতে দাওয়াত দিয়েছিল তিনি ব্যস এতটুকুই। মায়া সহজ সরল উত্তরটা যদিও তেমন কেউ বিশ্বাস করেনি তারপরও সবাই সুফিয়া বেগমের হঠাৎ তলবে মায়াকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল। ঐ বাড়ি থেকে মায়ারা ফিরে এসেছে আজ গোটা ছয়দিন হলো। এখন যদি মায়া কোনো ভাবে রিদের সাথে মায়ার বিয়ের কথাটা কোনো ভাবে প্রকাশ করে তাহলে এই মূহুর্তে তান্ডবের ঝড় বয়ে যাবে মায়ার উপর দিয়ে। আবার এই বিয়েটা নিয়ে যদি মায়া এখন রিদকেও কিছু বলতে যায় তাহলেও একই তান্ডবের ঝড় দ্বিগুণ হবে মায়ার উপর। মায়া পরিবার কিছু দয়া মায়া দেখালেও রিদ নিশ্চয়ই মায়াকে আস্ত রাখবে না কেন সে সেজেগুজে অন্যের নামের রিং পড়লো তার বউ হয়ে। মায়া অনেক রিকুয়েষ্ট করে রিদ থেকে সময় চেয়েছিল নিজের জন্য। এখন সেই রিদের অগোচরে মায়া অন্যের পাত্রী হয়ে আংটি পযন্ত পরে নিয়েছে, এটা শুনলে অবশ্যই মায়াকে আস্ত রাখার কথা না? এই লোক এমনই যে ভয়ংকর। তারপর মায়া এনগেজমেন্টের কথাটা শুনলে কি হবে সেই ভয়েও মায়া জড়সড়। ভয় আর ভিষণ অপরাধ বোধে ঠোঁট কামড়িয়ে কান্না আটকাতে চেয়ে আস্তে আস্তে ফুপাতে লাগলো মায়া। নাদিমের বড় বোন শেহনাজ নিজের হাতের ফোনটা মায়ার হাতে ধরিয়ে দিল। ভিডিও কলে নাদিমকে দেখা যাচ্ছে ক্লান্তিতে বসে। গলার ট্রাইটা ঢিলে করে ফোনের দিকে তাকিয়ে। নাদিম দেখতে সুন্দর পুরুষ বটে, পাত্র হিসাবে চমৎকার। খারাপ নয়। তবে মায়ার দিকটা ভিন্ন। সে বিবাহিত! আর এই বিষয়টি ভয়ে মায়া কাউকে বলতে পারছে না আর না সহ্য করতে পারছে। পরিস্থিতির দায়ে পরে মায়া ভিষণ আতঙ্কিত। কোলের উপর মায়ার কম্পনরত দু’হাতে ভাঁজে নাদিমের ফোনটি চেপে। অতি কষ্টে চেপে মায়া ফোনের স্ক্রিনে দিকে তাকাচ্ছে না পযন্ত, শুধু মাথা নিচু করে ধীরে ফুপাচ্ছে। নাদিম মায়া কান্না মিশ্রিত মুখটা দেখে সুন্দর হাসলো। তার এই ক্লান্তির মুখের হাসিটা বলে দিচ্ছে তার প্রাপ্তির সুখ কতোটা। নাদিম হাতের ফাইলটা পাশের চেয়ারে রেখে মায়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বামহাতে নিজের চুল গুলো পিছন টেলে দিতে দিতে বলল…
‘ টেক এ ব্রেথ রিতু। আমার মনে হয় তোমার একটু পানি খাওয়া উচিত।
মায়া নাদিমের কথা অনাগ্রহ করে সেইভাবেই মাথা নিচু করে বসে রইল। চোখে জল কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। নাদিম মায়ার কান্নায় মনোযোগ হতে হতে আবেগ ঢেলে সাজানো কথায় বলল…
‘ তোমার কান্নাটা ব্যাখ্যা করছে রিতু আমার প্রাপ্তি সুখ কতোটা। আমার অনেক বছরের নিশ্চুপ অপেক্ষার ফল তুমি। তোমাকে এতো সহজে পেয়ে যাব ভাবিনি। দুঃখের শেষ কান্নাটা করে নাও রিতু। এরপর থেকে তোমার সুখের দায়িত্ব আমার প্রিয়।
নাদিমের ভালোবাসা আবেগময় কথায় মায়ার অপরাধ বোধ আরও বাড়িয়ে দিল। সহ্য করতে না তক্ষুনি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। নাদিমকে ভিডিও কলে দেখা গেল সেই এক দৃষ্টিতে মায়ার কান্না মিশ্রিত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। সবার খাওয়া দাওয়া কথাবার্তা শেষে চেয়ারম্যান পরিবার বিদায় নিতেই মায়া ছুটে নিজ ঘরে। রাগে তেজে মাথার ঘোমটা ফেলে হাতের চুড়ি গুলো এলোপাতাড়ি ফেলল কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বামহাতের উল্টো পিঠে তেজে ঠোঁটের লিপস্টিক ঘষেমেজে লেপ্টে দিল চারপাশে। গোছানো চুল গুলো টেনে এলোমেলো করতে করতে ধুপ করে বসে পরলো ফ্লোরে। বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙে পরে ফুপিয়ে চিৎকার করে উঠলো বিছানার চাদর মুখে চেপে। দু’পা ভেঙ্গে কাতর হয়ে ফ্লোরে বসে বিছানায় মুখ গুঁজে হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলো বুক ফাটা আর্তনাদে। মায়ার কান্না দেয়াল বেঁধ করে বাহিরে গেলেও নিচ তলায় পৌঁছাল না আপনজনদের কানে। আপাতত মায়ার পরিবারের সবাই ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হবার খুশিতে নিচ তলায় বৈঠক ঘরে বসে। যার জন্য হৃদয় ভঙ্গুর মায়ার আর্তনাদের চিৎকার কারও কান বেঁধ করতে পারছে না। এমনকি জুইয়েরও না। সবার ধারণা মায়া ছোট মানুষ হওয়াতে এই বিয়েটাকে সে স্বাভাবিক নেয় মেনে নিতে পারছে না তবে দুইদিন গেলে এমনই ঠিক হয়ে যাবে। মায়াও বিয়েটা হাসিখুশি মেনে নিবে। এমনটা জুইয়েরও ধারণা ছিল। সেজন্য উদাস জুই মায়ার মনের খবর রাখে না প্রায় বেশ কয়েকদিন হলো। যেখানে জুইয়ের নিজের মন মানসিকতায় ঠিক নেই সেখানে অন্যের মনের খবর কিভাবে রাখবে সে? সেদিন রাতে আয়নের সাথে ঝামেলা হওয়ার পর থেকেই জুই আর আয়নের সাথে যোগাযোগ করে না। যদিও আয়ন ফোন দেয় তাহলে জুই সেটা রিসিভ করে না। মেসেজ পাঠালে না পড়েই ডিলিট করে দেয়। মূল কথা জুই কোনো ভাবে আয়নের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছে না। আয়নকে জুইয়ের বেঈমান প্রতারক মনে হয়। তাছাড়া জুইয়ের ভালো লাগা আয়নের প্রতি নয় রাদিফের প্রতি ছিল। যেখানে মানুষটায় ভুল, সেখানে জুই কেন আয়নের সঙ্গে কথা বলে ভুল বুঝাবুঝি ভাঙবে? কিসের জন্য? আয়নের সাথে তো জুই যোজন-বিয়োজ কোনো কিছুই চাই না তাহলে? মন ভাঙ্গুনে উদাস জুই নিজের পরিবারের হৈচৈ দেখলো মায়ার বিয়েটা নিয়ে। তারপর কয়েক সেকেন্ড সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটল সিঁড়িঘরে দিকে। উদ্দেশ্য দোতলায় নিজেদের ঘরে যাবে। সিঁড়ি বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে উদাস জুইয়ের চোখ একবার নিজের গায়ের নতুন জামাটার দিকে পরলো। মা -চাচার কর্ডা আদেশে জুইকেও আজ নতুন জামা পরে সেজেগুজে মেহমানদের সামনে থাকতে হয়েছিল। মায়ার হঠাৎ এনগেজমেন্টের বিষয়টা সকালে দিকে শুনে জুইও কম অবাক হয়নি। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতোন জুইও শকট হয়েছিল। কিন্তু মেহমান বাড়িতে আসবে বলে কাজে চাপে আর মানুষের হৈচৈ জুই মায়ার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি। মায়ার তো বিবাহিত। যদিও স্বামীর সন্ধান এখনো পাইনি মায়া। কিন্তু তারপরও মায়া বিবাহিত। বিবাহিত মেয়ের তালাক না হওয়া পযন্ত আরেকটা বিয়ে করা জায়েজ না। এই অবস্থায় অবশ্য ওদের পরিবারের বড়দের সঙ্গে কথা বলা উচিত। কিন্তু তার আগে জুই মায়ার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই। জুই মায়াকে বুঝাবে অজানা স্বামীর পিছনে পরে না থেকে এই বিয়েটাকে মেনে নিতে। নাদিম ভালো ছেলে। দেখতে শুনতেও কতো সুন্দর। মায়ার সাথে মানাবে ভালো। জুইয়ের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা ভাবনার মাঝেই ফ্ল্যাটের দরজা খোলে ভিতরে প্রবেশ করতেই কারও তীব্র চিৎকারের ফুঁপানি শুনতে পেয়ে মূহুর্তে চমকে উঠে জুই। বুদ্ধিমতি জুই তীব্র ফুঁপানির শব্দে বুঝে গেল মায়ার হৃদয় ভাঙ্গুনের শব্দটা। তৎক্ষনাৎ ভিতর থেকে ফ্ল্যাটের দরজা আঁটকে দিল যাতে বাড়ির অন্যরা কেউ আসতে না পারে বা তাদের কানে মায়ার কান্নার শব্দ না পৌঁছায়। দরজা আটকে দৌড়ে গেল নিজেদের রুমে দিকে। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই আঁতকে উঠল মায়াকে বিধস্ত অবস্থায় দেখে। এলোমেলো শাড়ি, চুলে ফ্লোরে বসে বিছানায় চাদর খামচে ধরে মুখে চেপে কাঁদছে। জুই মায়া অবস্থা দেখে মায়ার দিকে ছুটে যেতে যেতে ব্যস্ত গলায় ডাকল….
‘ মায়া! এই মায়া! কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?
জুইয়ের কন্ঠে তৎক্ষনাৎ মুখ তুলে তাকাল মায়া। জুই মায়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসার আগেই ঝাপিয়ে পড়লো মায়া। আকস্মিক ঘটনায় জুই তাল সামলাতে না পেরে মায়াকে নিয়ে পরে গেল ফ্লোরে। জুইয়ের পিঠ ঠেকল খাটের কোণায়। কিন্তু তারপরও জুই একহাতে মায়ার পিঠ আঁকড়ে অন্য হাত ফ্লোরে রাখল নিজের শরীরে ব্যালেন্স বজায় রাখতে। মায়া জুইকে দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ চিৎকার করতে করতে বলল…
‘ জুই! জুই! আমি ভুল করেছি! আমি উনার সাথে বেঈমানী করতে চাইনি। তারপরও করে ফেললাম। উনি আমাকে কক্ষুনো ক্ষমা করবে না জুই। আমি কি করবো জুই? আমি কি করবো?
মায়ার হাউমাউ চিৎকারে ভয় পেয়ে যায় জুই। মায়া চিৎকারের শব্দ নিশ্চয়ই নিচে বসার ঘর অবধি চলে যেতে পারে। ভয়ার্ত জুই তৎক্ষনাৎ মায়াকে নিজের বুক থেকে উঠিয়ে মায়ার মুখটা একহাতে আঁকড়ে ধরে তাড়াহুড়োয় আশ্বস্ত দিতে দিতে বলল…
‘ শিশশশ! এইভাবে চিৎকার করিস না মায়ু। বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। কেউ শুনলে আস্ত রাখবে না আমাদের। কান্না থামা বোন। কি হয়েছে বল আমাকে। এইভাবে কাঁদছিস কেন তুই? কার সাথে বেঈমানী করেছিস? কি হয়েছে?
জুইয়ের কথায় সত্যি সত্যি মায়ার কান্নার আওয়াজ কিছুটা কমে আসলো। তবে কান্নার বেগ কমেনি। বরং একই ভাবে হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মায়া বলল…
‘ জুই! জুই! আমি সত্যি বুঝিনি পরিস্থিতি এমন হয়ে যাবে। হুট করে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। আমিতো উনার কাছে সময় চেয়েছিলাম সবকিছুর জন্য। এখন আমি কি করবো জুই? কিভাবে সবটা সামলাবো? উনি আমাকে বিশ্বাস করবে না জুই। বলবে আমি প্রতারণা করেছি।
মায়ার কোনো কথার অর্থ বোধগম্য হলো না জুইয়ের। মূলত জুই বুঝতেই পারছে মায়া কার জন্য কিসের সময় চেয়েছিল? জুই বলল..
‘ কার কথা বলছিস তুই? কিসের প্রতারণা হবে?
‘ আমি উনার কথা বলছি!
‘ উনি কে আবার?
মায়া বউ হয়ে রিদের নামটা সরাসরি নিতে চাইছে না বলে জুইকে বুঝানোর জন্য ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল…
‘ আপুর ভাসুর।
‘ কোন আপুর ভাসুরের কথা বলছিস তুই?
‘ মুক্তা আপুর!
মায়ার কথায় কপাল কুঁচকে আসে জুইয়ের। ওর জানা মতে ফাহাদের নিজের কোনো বড় ভাই নেই। সে নিজেই বাড়ির বড় ছেলে। তাহলে মায়া ফাহাদের কোনো ভাইয়ের কথা বলছে? জুই পুনরায় জানতে চেয়ে একই ভাবে বলল…
‘ তুই কার কথা বলছিস একটু খোলে বলবি মায়ু?
হৃদয় ভাঙ্গুর মায়া এটা মাথায় নেই যে সে নিখোঁজ স্বামী রিদকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টা এখনো পযন্ত জুইকে বলা হয়নি। তাই স্বাভাবিক নেয় জুই এখনো পযন্ত জানে না মায়ার নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টি। সেজন্য জুইয়ের পরপর প্রশ্ন গুলো খুবই ধারাবাহিক ভাবেই আসছিল। যেহেতু সে অক্ষত মায়ার নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পাওয়া নিয়ে তাই মায়ার উনি সম্পর্কে প্রশ্ন গুলোও স্বাভাবিক নেয় ছিল জুইয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু মায়ার জুইয়ের পরপর প্রশ্ন গুলো অহেতুক মনে হওয়ায় অনেকটা বিরক্ত হয়েই জুইকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে দিতে বলল…
‘ তুই যাতো জুই। আমার কষ্ট আর বাড়াস না। ভালো লাগছে না।
মায়া জুইকে দূরে ঠেলে দিতে চাইলেও জুই মায়ার হাত ধরে থামিয়ে কাছে টেনে একই ভাবে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে বলতে চেয়ে বলল…
‘ এমন করছিস কেন জান? তুই তো আমার কলিজা। তুই আমাকে বুঝিয়ে না বললে আমি বুঝবো কিভাবে তুই কার কথা বলছিস? বল?
জুইয়ের কথায় মাথায় নরম হলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো…
‘ আপুর ভাসুর রিদ খানের কথা বলছি আমি।
মায়ার কথা শেষ হতে হতে তৎক্ষনাৎ পরবর্তী প্রশ্ন আসলো জুইয়ের হতে স্বাভাবিক নেয়…
‘ আপুর ভাসুর রিদ খানের সাথে তোর কি সম্পর্ক বইন? তুই উনার কথা কেন বলছিস? কি করেছে উনি? আবারও বাজে ব্যবহার করেছে তোর সাথে? এজন্য কাঁদছিস?
জুইয়ের পরপর প্রশ্নে মায়ার মনে পড়লো মায়া ওর নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টা এখনো জুইকে জানানো হয়নি। একদিকে মায়া মন ভালো নেই। কতো ঝড়-ঝাপটা যাচ্ছে ওর উপর দিয়ে। এই পরিস্থিতিতে মায়ার মোটেও ইচ্ছা করছে না জুইকে সবকিছু খোলে বলতে। কিন্তু এই মূহুর্তে জুইকে কিছু না বললে মায়া সমাধান পাবে না। সেজন্য মায়া রিদকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টি সংক্ষিপ্তে জানিয়ে বলল…
‘ আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল সে রিদ খান ছিল জুই। মানে আমার নিখোঁজ স্বামী ঐলোকটা রিদ খান ছিল।
মায়ার কথায় আকাশ সমান শকট হলো জুই। অতি শকটে বোবা বনে জুই মায়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক। জুইয়ের মস্তিষ্ক মায়ার কথাটা টনক নড়তে জুই শংসিত গলায় মায়াকে শুধিয়ে আবারও জানতে চেয়ে বলল।
‘ মানে কে তোর স্বামী?
‘ রিদ খান!
আতঙ্কিত জুই হতভম্ব হয়ে তাড়াহুড়োয় মায়াকে পুনরায় শুধিয়ে জানতে চাইল…
‘ রিদ খান? মানে খান বাড়ির বড়ো ছেলে রিদ খান? ফাহাদ জিজুর কাজিন বড়ভাই রিদ খানের কথা বলছিস তুই?
জুইয়ের হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে মায়া মাথা কাত করে সম্মতি দিল। যার অর্থ হ্যাঁ এই রিদ খানই।
মায়ার সম্মতি পেতেই জুই তব্দা খেয়ে বসল।
‘ এই লোকের সাথে তোর বিয়ে হয়েছিল জান?
মায়া আবারও ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয় জুইকে।জুই একই ভঙ্গিতে আবারও বলল…
‘ জান তুই জানলি কিভাবে রিদ খান তোর নিখোঁজ স্বামী হয়। রিদ খান নিজে বলেছে তোকে?
মায়া মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাতে জানতে বলল…
‘ উনি বলেনি। আমি নিজে নিজে জেনেছি আপুর গায়ের হলুদের রাতে। যেদিন আমরা ফাহাদ ভাইয়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম হলুদ নিয়ে সেদিন আমি বুঝতে পারি রিদ খানই ঐ লোকটা ছিল।
সংক্ষিপ্তে মায়া জুইকে অল্প সল্প বিস্তারিত বলে ফেলল রিদকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। সব শুনে জুই তব্দা খেয়ে বসে রইল। এবার মায়ার মতো জুইয়েরও মনে হচ্ছে রিদ পূর্ব থেকেই মায়ার সম্পর্কে জানতো। আর সবকিছু জেনেশুনেই সে মায়াকে এতোদিন নাকে দড়ি দিয়ে তার চারপাশে ঘুরাত। কিন্তু এখন বড় কথা হলো, মায়া নিজের স্বামীকে চিনার চেয়ে বড়ো বিপদ হলো রিদ খান মায়ার স্বামী হয় সেটা। সেদিন মায়া সুফিয়া বেগমের ডাকে উনার বাসায় গিয়েছিল সেই বিষয়টা ফাহাদের বাসার কেউ পছন্দ করেনি। এমনকি এটা নিয়ে মায়ার অগোচরে কথাও হয়েছিল বেশ। বড়বোন হিসাবে মুক্তাকেও এই নিয়ে টুকটাক বেশ কিছু কথা শুনতে হয়েছিল ঐ বাড়ির আত্মীয়দের থেকে। এখন যদি সবাই জানাজানি হয় মায়া-রিদের সম্পর্কে কথা তাহলে সবচেয়ে বেশি ইফেক্ট পড়বে মুক্তা- ফাহাদের সম্পর্কের উপর। মায়ার জন্য মুক্তার বিয়েটা ভাঙতে বসে তাহলে? জুই সেসব কথা ভেবেই আতঙ্কে মায়াকে প্রশ্ন করে বলল…
‘ এজন্য সেদিন রিদ খানের মা তোকে ডেকে পাঠিয়েছিল দেখা করতে? উনি জানেন তোদের সম্পর্কের কথা?
মায়া ঘাড় কাত করে সম্মতি দিতে দিতে নাক টেনে বলল…
‘ হুমম!
‘ উনি মেনে নিয়েছেন তোকে?
‘ হুম!
‘ এতো সহজে মেনে নিলো? ঝামেলা করেনি?
‘ না!
মায়া কথায় জুই টেনশনে চিন্তিত গলায় বলল…
‘ মায়া আমার অনেক টেনশন হচ্ছে সবকিছু নিয়ে। তোর সামান্য রিদ ভাইয়ের আম্মুর সাথে দেখা করাটা নিয়ে ঐ বাড়ির সবাই কেমন বাঁকা চোখে তোকে দেখলো। তারপর মুক্তা আপুকেও আকারে-ইঙ্গিতে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল তোকে নিয়ে। তোকে খোলামেলা একা কোথাও না ছাড়তে। যুগ ভালো না হেনতেন। এখন যদি জানাজানি হয় তোর সাথে রিদ ভাইয়ের বৈবাহিক সম্পর্ক আছে তাহলে কেউ সেটা ভালো ভাবে মানবে না মায়া। এমনকি তোর বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি সাফার মুক্তা আপুকেই করতে হবে। আমি দেখেছি মায়া ঐ বাড়ির মানুষজন সুবিধার নয়। তাছাড়া আমি যতটুকু জানি রিদ খানের সাথে ঐবাড়ির মেয়ে শশী আপুর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে সবাই। এই অবস্থায় তোকে কেউ গ্রহণ করতে চাইবে না মায়া। তার চেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো তোর বিয়ে ইতিমধ্যে ঠিক হয়ে গেছে। তুই অলরেডি এঙ্গেস্ট। এখন যদি তোর আর রিদ খানের সম্পর্কের কথা পরিবারের জানাস তাহলে কিয়ামত নেমে আসবে মায়ু। আমার বাবা, তোর বাবা মিলে কিয়ামতের আলামত দেখাই দিবে সবাইকে। এতে মুক্তা আপু শশুর বাড়ি, চেয়ারম্যানের পরিবার, আমাদের পরিবার, এই তিনটা পরিবারের মধ্যে সবসম্পর্ক একেবারে শেষ হয়ে যেতে পারে মায়া। এমন একটা পরিস্থিতিতে তুই দাঁড়িয়ে আছিস যেদিকে যাবি সেইদিকে তুই মরবি। আমিতো কোনো পথ খোলা দেখছি না মায়ু। কি করবি তুই?
জুইয়ের সাথে বার্তাচালনে মায়ার কান্না অনেকটা কমে এসেছিল। কিন্তু জুইয়ের লাস্ট কথা গুলোই মায়ার হিচকি তুলা কান্নাটা আবারও দ্বিগুণ হয়। জুই সত্যি বলছে মায়ার আসলেই কিছু করার নেই। সত্যিটা এই মূহুর্তে নিজের পরিবারকে জানালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। মাত্র মুক্তার বিয়েটা হয়েছে ঐ পরিবারের সাথে। মায়া চাই না ওর জন্য কোনো ঝামেলা হোক। আবার রিদকেও সত্যিটা বলতে পারবে না। রিদকে সত্যিটা বলা মানে দুই পরিবারের ওদের বৈবাহিক সম্পর্কটা এমনই জেনে যাওয়া। মায়ার ছোট মস্তিষ্ক বুদ্ধি খেলিয়ে বুঝতে পারলো না আসলে এমন পরিস্থিতিতে ওর কি করা উচিত। জুই মায়াকে পুনরায় ডুকরে কেঁদে উঠতে দেখে মায়ার দু’হাত চেপে আশ্বস্ত দিয়ে বলল…
‘ রিদ ভাই তোকে বউ হিসাবে গ্রহণ করেছে মায়ু?
মায়া কাঁদতে কাঁদতে সম্মতি দিতেই জুই পুনরায় বলল…
‘ কি বলে গ্রহণ করেছে? তোকে নিয়ে সংসার করতে চাই এমন কিছু বলেছেন উনি?
মায়া কাঁদতে কাঁদতে নাতে মাথা নাড়িয়ে বলল…
‘ এমনটা বলেনি। তবে আমি বুঝি উনি আমাকে পছন্দ করে।
মায়ার কথায় জুই অসন্তুষ্ট গলা ঝেড়ে বলল…
‘ বেশি বুঝিস তুই। অল্প বয়সে পেঁকে গেছিস। পুরুষ মানুষ মুখে বলে ওয়াদা করেও একটা সময়ে সেই ওয়াদা রক্ষা করে না ক্ষেলাপ হয়ে যায়। আর রিদ খান তোকে পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে কিছু বলেনি অথচ তুই দুই লাইন বেশি বুঝে বসে আছিস। উনি তোকে পছন্দ করলে অবশ্যই মুখে বলতো মায়া।
জুইয়ের কথায় মায়া রিদের হয়ে সাফাই দিতে দিতে বলল….
‘ উনিতো উনার মার সাথে আমাকে বউয়ের পরিচয় দিয়ে দেখা করিয়ে দিয়েছে জুই। উনার মা চাচ্ছিল আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা আমার পরিবারের জানাতে কিন্তু আমিই উনাদের থেকে সময় চেয়ে, অন্য ছেলের সাথে এঙ্গেস্ট হয়ে গেছি। তাহলে বেঈমানীটা তো আমিই করছি জুই তাইনা?
মায়ার কথায় জুই আপাতত আর কিছুই ভাবতে পারলো না। পরিস্থিতি এখন অনেক গরম। এই অবস্থায় কিছুতেই মায়ার বিয়ের সম্পর্কে পরিবারের জানানো যাবে না। বরং আর কয়েকদিন গেলে পরিস্থিতি বুঝে না-হয় এই বিষয় নিয়ে আরিফের সাথে কথা বলবে ওরা দুজন। আপাতত ওরা দুজন এখান থেকে ভালোই ভালোই চট্টগ্রাম পৌছাতে পারলেও হলো। তখন না-হয় বুঝে শুনে সবাইকে জানানো যাবে এই বিষয়ে। মায়াও না-হয় তখন রিদকে এসব বিষয়ে বলবে, আপাতত এখন কিছু না বলে। জুইয়ের যুক্তিটা মায়ারও পছন্দ হলো। মায়া ভাবলো পরিবারের মাঝে থেকে যদি এখন কিছু বলে তাহলে সবাই মায়াকে ঘরবন্দি করে ফেলতে পারে। তখন মায়া চাইলেও রিদের সাথে আর যোগাযোগ করতে পারবে না। তারচেয়ে বরং মায়া সুযোগের সন্ধানে থেকে সবকিছু আপাতত গোপন করে গেলে শেষটা ভালোই হবে। আর মায়ার এমন চিন্তাটায় ছিল মায়ার পক্ষের বিপরিত। পরিস্থিতি যেমনই হোক সেটা মানিয়ে বা লড়াই করে হলেও সামনে বাড়তে হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে চুপ থাকা মানে তুমি ভীতু। আর মায়ার এই চুপ থাকাটা যেটা অল্পতে শেষ হতে পারতো সেটা আরও বড়ো হওয়ার সুযোগ করে দিল নিজের অজান্তেই। মায়া নিজেই নিজের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আর দুষ্কর করে তুললো। অদেখা ভবিষ্যত কার কি হবে কারও জানা নেই। তবে বর্তমানের কর্মফল মানুষকে ভবিষ্যতেই দিতে হয়। আর এটাই প্রকৃতিক নিয়ম। মানুষ সেই নিয়মের বর্তীময়ী। এতো কিছুর মাঝে মায়া আরও একটা নতুন ভুল করলো রিদের সাথে হুট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। মায়া মূলত নিজের অপরাধ বোধ থেকে এমনটা করেছে। মায়া ধারণা সে একেবার চট্টগ্রামে গিয়েই রিদের সাথে নাহয় যোগাযোগ করবে। আজকাল মায়ার অতিরিক্ত ধারণাই মায়ার বিপদের কারণ হয়েছে।
~~
সকাল ৪ঃ০০! কলেজের জন্য রেডি হয়েও মায়া রুমে ভিতরে তন্ন তন্ন করে কিছু একটা খোঁজে চলছে। একবার কাঠের আলমিরা খোলে সেটা ভিতর উলট পালট করছে তো আবার খাটের নিচে উঁকি মেরে দেখছে মায়ার হারিয়ে যাওয়া জিনিসটা কোথায়। ক্লান্ত মায়ার অবিরাম নিজের জিনিসটা খোঁজায় ব্যস্ত। মায়ার বিচিলিত ভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে হারিয়ে যাওয়া জিনিস কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওর জন্য। জুই টিফিন বক্স রেডি করে রুমে ঢুকতে দেখলো মায়াকে পুরো রুম এলোমেলো করে খাটের নিচে উঁকি মেরে কিছু একটা খুজতে। জুই বিরক্ত হয়ে দেয়াল ঘড়িটা দেখল। অলরেডি আটটা বাজে দশ মিনিট হয়ে গেছে। নয়টা থেকে ওদের কলেজের ক্লাস। অথচ মায়া কলেজ ড্রেস পড়ে যতটুকু রেডি হয়েছিল ওর খোজাখুজিতে এখন সেটাও নষ্ট করে ফেলেছে। মাথায় এখনো হিজাব করেনি। লম্বা চুলের বেনিটা এলো হয়ে পিঠ বেয়ে ফ্লোরে পরে আছে মায়া খাটের নিচে উঁকি দেওয়ার ফলে। শরীরে ক্রসিং বেল্ড দুটো খসে আছে। জুইয়ের মেজাজ খারাপ হলো। এমনই আজ ওরা দুজন লেট। তারপর আবার মায়ার এমন তালবাহানা ওদের আরও লেট করবে। জুই এগিয়ে এসে মায়ার চুলের বেনি টেনে মায়াকে খাটের নিচে উঁকি মারা থেকে বের করলো। চুলে টান পড়ায় মায়ার একটা হাত অটু নিজের ঘাড়ের চুল আঁকড়ে ধরে আহাজারি করে খাটের তলায় থেকে বের হতে হতে বলল…
‘ জুই চুল ছাড়! ব্যথা পাচ্ছি আমি।
‘ খাটের নিচে কি করছিস তুই? কি খুঁজিস?
মায়া উঠে বসতে বসতে বিরক্তি নিয়ে বলল…
‘ একটা চাবি খুঁজি। তুই দেখেছিস কোথাও কোনো চাবি-টাবি?
জুই মায়ার চুল ছেড়ে পড়ার টেবিলে দিকে এগোল। মায়ার ব্যাগে প্রয়োজনীয় বই খাতা নিতে নিতে বলল…
‘ হুম দেখেছি! কিন্তু তোর কিসের চাবি দরকার সেটা বল?
জুইয়ের কথায় মায়া এক লাফে উঠে দাঁড়াল। গায়ের সাদা কলেজ ড্রেসটা ঝাড়তে ঝাড়তে জুইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খুশি মনে বলল…
‘ একটা ফ্ল্যাটের চাবি দরকার আমার। বলনা কোথায় দেখেছিস?
‘ চুড়ির বক্সের ভিতরে চেক দেখ। ঐটা কিনা।
জুইয়ের কথায় মায়া এক দৌড়ে ড্রেসিংটেবিল উপর থেকে চুড়ি বক্সটা খোলে নিজের নিখোঁজ চাবিটার খোঁজ করলো। অল্প সময়ে পেয়েও গেল। রিদের ফ্ল্যাটের চাবি এটা। সেদিন রিদ দিয়েছিল মায়াকে। এই চাবিটা দেওয়ার সময় রিদ মায়াকে বলেছিল ‘ এই চাবিটার গুরুত্ব বা দেওয়ার কারণ মায়া একদিন বুঝবে। সত্যি মায়া আজ বুঝতে পারছে রিদ কেন সেদিন মায়াকে নিজের বাসার এই চাবিটা দিয়েছিল। মায়া সেদিন এই চাবিটা অবহেলা অযত্ন করে ফেলে দিয়েছিল গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু জুই সেটা যত্ন করে সামলিয়ে রাখাতে আজ মায়া অল্পতে ওর মূল্যবান জিনিসটা খোঁজে পেয়ে গেল। চাবিটা হাতে নিয়ে মায়াকে খুশিতে চকচক করতে দেখে জুই সেদিকে তাকিয়ে মায়ার ব্যাগের চেইনটা লাগাতে লাগাতে বলল…
‘ কিসের চাবি এটা?
‘ উনার ফ্ল্যাটের চাবি। আমাকে গিফট করেছিল অনেক আগে। আমি তখন এরমানে বুঝিনি এজন্য ফেলে দিয়েছিলাম।
‘ তাহলে আজ খোঁজ করছিস কেন?
‘ আমাকে দেওয়া প্রথম উপহার উনার যত্ন করে রাখব না আমি আজব।
মায়ার খুশি মুখটার দিকে তাকিয়ে জুই বলল…
‘ মায়া তোর মনে হয় এখন রিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত। আমরা তো চট্টগ্রামে এসেছি আজ এক সাপ্তাহ হলো।
জুইয়ের কথায় মায়ার মন খারাপ হলো তীব্র অপরাধ বোধে। কিভাবে রিদকে সত্যি বলবে জানা নেই মায়ার। তারউপর আজ থেকে পনেরো দিন ধরে রিদের সাথে মায়ার কথা হয়না। সেই সুফিয়া বেগমের বাসা থেকে আসার পথে দুজনের কথা হয়েছিল এরপর আর হয়নি। মূলত মায়াই যোগাযোগ করেনি রিদের ভয়ে আর অপরাধ বোধে। রিদ যে কল করবে সেই উপায় নেই। মায়া ওদের হাতের ফোনটার সিম খোলে রেখেছে যাতে রিদ কল দিতে না পারে। বাসায় আপাতত ওরা আরিফের ফোন থেকে কথা বলে। জুইয়ের ও ফোনের প্রয়োজন হয়না আজকাল। কারণ ওর ও কথা হয় না আয়নের সাথে। জুইয়ের কথায় মায়ার ভয়টা আরও বাড়লো। হাতের চাবিটা মুঠোয় চেপে নিতে নিতে মিনমিন গলায় বলল…
‘ পরশু তো আমাদের কলেজ ট্যুর আছে। সেখান থেকে ফিরে না-হয় কথা বলবো উনার সাথে।
মায়ার কথা জুই আপোষে সম্মতি দিতে দিতে বলল…
‘ তোর ইচ্ছা। এবার চল আমাদের দেরি হচ্ছে।
জুই মায়ার ব্যাগটা ছেড়ে নিজের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিতে মায়া মাথায় সাদা হিজাব বেঁধে নিলো। জুই টিফিনবক্স হাতে নিতে মায়াও নিজের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জুইয়ের পিছনে এগোতে এগোতে বলল…
‘ তুই তো পরে আর কিছুই বললি না জুই।
‘ কোন বিষয়ে?
‘ আয়ন ভাইয়া ব্যাপারে।
‘ বলার মতো কিছু থাকলে অবশ্যই বলতাম।
‘ কিন্তু আমিতো জানি তুই আয়ন ভাইকে পছন্দ করতি।
জুই নিজের ফ্ল্যাটের দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে মায়ার কথার উত্তরে বলল…
‘ আয়ন ভাইয়া কখনোই আমার পছন্দের লিস্টে ছিল না মায়ু। রাদিফ ভাইকে মনে করে আয়ন ভাইয়ার সাথে এতোদিন কথা হতো। এটা জাস্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি ছিল। এখন দুজনের ভুল বুঝাবুঝি ভেঙ্গে গেছে তাই কেউ কারও সাথে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না।
জুইয়ের কথায় মায়া অসন্তুষ্টি হয়ে বলল…
‘ ভুল বুঝাবুঝি শুধু তোর তরফ থেকে ছিল জুই। আয়ন ভাইয়া শুরু থেকে জানতো ফোনের ওপাশের মেয়েটা তুই ছিলি। তোকে জেনেশুনেই কথা বলে গেছেন তিনি। এখানে উনার অপরাধ নেই। তুই অন্তত একবার উনার সাথে কথা বলে দেখতে পারিস কি বলে উনি। আর নয়তো উনার করা মেসেজ গুলো অন্তত একবার পড়ে ডিলিট করিস তাহলে বুঝতে পারবি দোষটা কার।
‘ আমি আদালত নয় যে ন্যায় অন্যায় দেখতে যাব। যেটা চলে গেছে সেটা চলে গেছে। আমি এখন কারও দোষগুণ দেখতে চাইনা। তুই চল!
‘ কিন্তু জুই আয়ন ভাইতো তোকে।
জুই অনেকটা ধমক স্বরেই মায়াকে থামিয়ে দিতে দিতে বলল…
‘ মায়া আমাদের দেরি হচ্ছে। চলো।
#চলিত….