রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৩৬+৩৭

0
2

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৬
ভোর ৫ঃ০৫। একটা সুন্দর স্নিগ্ধ সকালের সূচনা হলো ধরুনী জোরে। পশ্চিম আকাশে লাল সূর্যের চটার আবির্ভাব এখনো ঘটেনি। তবে উজ্জ্বল আকাশে, উজ্জ্বল পৃথিবী। প্রকৃতি জোরে শীতল হাওয়ার উত্তাপ। এমন একটা সুন্দর সকালে সকলে যাচ্ছে কলেজ ট্যুরে রাঙ্গামাটিতে। এই ট্যুর যাত্রীতে মায়াও আছে। প্রথম সারি, দ্বিতীয় সারি মিলিয়ে মোট চারটা বাসের ট্যুর যাত্রা এটি। মায়াদের সিট পরেছে চতুর্থ বাসে। সকল শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়েদের আলাদা আলাদা বাসে বসার ব্যবস্থা করা হলেও সিনিয়র ছেলে-মেয়েরা প্রায় সকল বাসেই উপস্থিত আছে ভলেন্টিয়াররা হিসাবে। শিক্ষক- শিক্ষিকাদের পাশাপাশি এই ট্যুরে একদল সিনিয়র ছেলে-মেয়েদেরকেও নেওয়া হচ্ছে জুনিয়র স্টুডেন্টদের সুষ্ঠু শিক্ষা সফর নিশ্চিত করার লক্ষে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আর নজরদারিতে এই ট্যুরের যাত্রা শুরু হলেও বাসের ছেলে-মেয়েরা ডিজে গানে তালে হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠলো একটা সময় পর। কিন্তু মায়া সবার দলে নেই। সে মূলত মন খারাপে নিশ্চুপ বসে আছে। কি জন্য মায়ার মন খারাপ জানা নেই। শুধু উদাস আর অস্থির মনে ভিতর জ্বলছে ওর।

উদাস মায়া জ্বানালা ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টি ঐ দূর সীমান্তে পাহাড়ের চৌড়ায়। সকালের মিষ্টি ফুরফুরে বাতাসের তেজে মায়ার মুখ ছুঁয়ে মাথার হিজাব উড়ছে সাঁ সাঁ শব্দে। জুই মায়ার পাশেই বসে। শ্রেয়া, নাদিয়া বসেছে পিছনের দুই সিট পরে। কিন্তু বাকি সবার মতো শ্রেয়া, নাদিয়াও ডিজে গানে তালে খৈ হারিয়ে নিজেদের সিট ছেড়ে সামনে মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে মেতে আছে নাচ গানে। জুই সেটা ভিডিও করছে আর হাসছে। মোট কথা সবাই এনজয় মুডেই আছে। কিন্তু মায়া এসব নাচ গানে নেই। মায়ার স্বামী এসব পছন্দ করে না বলে মায়া ভদ্রতা বজায় রাখল। সিট ছেড়ে উঠলো না পযন্ত। এমনই মায়া রিদকে না বলে চুরি করে এই ট্যুরে যাচ্ছে। সেজন্য মায়ার ভিতরটা হাসফাস করছে অপরাধ বোধে। রিদ মায়ার ট্যুরে যাওয়ার বিষয়টা জানলে কি হবে মায়া জানে না। হয়তো রিদের অবাধ্য হওয়ায় সে মায়ার উপর রেগে যেতে পারে। কিন্তু কতটুকু রাগ করতে পারে তার ধারণা মায়ার আপাতত নেই। সেজন্য মায়া মন খারাপে সেই তখন থেকেই বাসে চুপ করে বসে। মায়ার মনে হচ্ছে এই ট্যুরে সে রিদের অবাধ্য হয়ে না গেলেও পারতো। মায়া উচিত হয়নি রিদের কথা অমান্য করে এই ট্যুরে যাওয়ার। মায়াদের একই বাসে আরিফকে দেখা যায় রাকিবের সাথে পিছনের সিটে ভলেন্টিয়ার হয়ে বসে আছে সিনিয়র হিসাবে। মাঝে মধ্যে এদিকটায় তাকিয়ে নিজের বোনদের খেয়ালও রাখছে সে। সবার হৈচৈ মাঝে জুই হঠাৎ মায়ার হাত টেনে নিজের দিকে ফেরাল। অতি গানের শব্দের একহাতে কান চেপে মায়ার দিকে ঝুকে চিল্লিয়ে বলল…

‘ কি হয়েছে তোর? সকাল থেকে দেখছি কেমন জানি ভয়ে সিটিয়ে আছিস। কোনো সমস্যা?

জুইয়ের কথায় মায়া মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দিতে দিতে একই গলায় চিল্লিয়ে বলল…

‘ জুই আমার কেমন জানি অস্থির আর ভয় করছে। মনে হচ্ছে এই ট্যুরে উনার অনুমতি ছাড়া আমার আসাটা ঠিক হয়নি।

মায়ার মন খারাপের কারণ রিদ সেটা বুঝতে পেরে জুই খানিকটা অসন্তুষ্ট গলায় একই ভাবে বলল…

‘ তাহলে আসলি কেন স্বামীর কথা অমান্য করে? তোকে কে বলেছিল আসতে? নিজেই তো লাফিয়ে লাফিয়ে আসলি। এখন আবার ঢং করিস। এতোই যদি জামাই ভক্ত হতি তাহলে তাঁকে অমান্য করে লুকিয়ে এই ট্যুরে যেতি না বেয়াদব।

জুইয়ের কথায় মায়ার গলার স্বর খানিকটা কমে আসল অপরাধ বোধে…

‘ তোরা সবাই যাচ্ছিস বলে আমি নিজের মনকে বুঝাতে পারিনি। এজন্য উনাকে না বলেই চুপিচুপি তোদের সাথে যাচ্ছি। কিন্তু এখন কেমন জানি অস্থির আর ভয় করছে ভিতর ভিতর। মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। সত্যি আমি ভুল করেছি জুই? কি করবো বলনা তুই?

মায়া অপরাধ বোধের বিষয়টা বুঝে জুই মায়াকে আশ্বস্ত দিয়ে বলল…

‘ এখন আর কিছু করার নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে। অলরেডি বাস ছেড়ে দিয়েছে। তাই এই সফরটা এনজয় কর। একটা দিনেরই ব্যাপার মাত্র। রাতে বাসায় ফিরে ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করে নিস। তাহলে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন আর মন খারাপ করিস না কেমন।

মায়া হাসফাস করতে করতে বলল…

‘ জুই আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি এই ট্যুর শেষ করে হয়তো আর ফিরতে পারব না।

মায়ার কথায় জুই তেমন গুরুত্ব দিল না। বরং বিরক্ত হয়ে মায়ার কপালে গুঁতো দিয়ে শাসন করে বলল…

‘ বাজে চিন্তা না করে ট্যুর এনজয় কর বলদ। আরিফ ভাইয়া আছে আমাদের সাথে। কিচ্ছু হবে না কারও।

জুইয়ের কথায় মায়া খানিকটা আশ্বস্ত হলো। আরিফ যে ওদের সাথে ট্যুরে যাচ্ছে সেটা মায়া ভুলে বসেছিল এতক্ষণে। কিন্তু জুইয়ের কথায় সেটা পুনরায় মনে পরতেই মায়ার মনের ভয়, সংশয়, অস্থিরতা খানিকটা কমে গেল। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকাল আরিফের খোঁজে। দেখলো আরিফ রাকিবের সাথে বসে খুবই আস্তে ধীরে কথা বলছে কিছু নিয়ে। মায়ার পিছনে তাকাতে আরিফও হঠাৎ এইদিকটায় তাকাল। বোনকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আরিফ নিজের সিট ছেড়ে এগিয়ে আসতেই রাকিবও আরিফের পিছন পিছন এইদিকটায় এগিয়ে আসল। চলন্ত বাসে আরিফ মায়াদের সিটের কাছাকাছি আসতেই জিগ্যেসা করলো, ওদের কিছু প্রয়োজন কিনা? জুই মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাতেই মায়া আরিফের দিকে তাকিয়ে হাসফাস করে বলল…

‘ ভাই আমার ভয় করছে।

‘ কিসের ভয় বোকা? ভাই আছি না।

‘ তারপরও ভাই আমার কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে।

মায়ার কথায় আরিফ এগিয়ে এসে জুইয়ের উপর দিয়ে মায়ার কপালে একটা হাত ছুঁয়ে দেখল মায়ার কোনো অসুস্থতা আছে কিনা। মায়ার শরীরে তাপমাত্রা ঠিক দেখে আরিফ মায়াকে আশ্বস্ত করতে করতে বলল…

‘ কখনো লং বাস জার্নি করিসনি তো তাই হয়তো এমন অস্থির অস্থির লাগছে। আর কিছুক্ষণ পর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। তোরও ভালো লাগবে। আচ্ছা তোদের ব্যাগে দেখ খাবার রাখা আছে, ঐগুলো খেয়ে নে। আর কিছু দরকার পড়লে ভাইকে ডাকিস কেমন। ভাই পিছনেই আছি।

মায়া ঘাড় কাত করে সম্মতি দিতেই আরিফ, রাকিব দুজনই জায়গা ছেড়ে নিজেদের সিটে গিয়ে বসল। মন খারাপের কারণে মায়া ব্যাগে খোলে খাবার পেতেই নিজের মন খারাপের কারণও ভুলে বসল। পুরো ট্যুর যাত্রায় হৈচৈ আর আনন্দে কাটালো সবার সাথে। শিক্ষক, সিনিয়রদের কঠোর নজরদারি আর গাইডলাইনে পুরো ট্যুর যাত্রায় কোনো স্টুডেন্টের কারও কোনো সমস্যা হলো না বিন্দুমাত্র। মূলত শিক্ষার সফর ট্যুরটি ছিল রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রিজ, রাজবন বিহার, আর শুভলং ঝর্ণা পরিদর্শনে।
দর্শনীয় তিনটি স্থান পরিদর্শনের ট্যুর যাত্রা শেষ করে সন্ধ্যা ৭ঃ০০ নাগাদ পুনরায় চারটি বাস ছাড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ছাত্র-ছাত্রীরা সারাদিনের ঘুরাঘুরি আর ক্লান্তিতে সিটে ঝিমিয়ে বসে রইল। মায়া জুই সিটে হেলিয়ে ঘুমিয়ে। শ্রেয়া, নাদিয়ার অবস্থাও সেইম। বাসের মধ্যে যে-সকল ছাত্র- ছাত্রীরা জেগে আছে, তাঁরা মূলত ফোনে ব্যস্ত হয়ে আছে তাদের সারাদিনের তুলা ছবিগুলো দেখায় । রাত তখন ৪ঃ৪৫ ঘরে। বাস চারটে পুনরায় থামে একটা পাহাড়ি খাবার হোটেলের সামনে। রাতের খাবারটা সবাই এখানেই সারতে চাই। কারণ রাঙ্গামাটি পাহাড়িয়ান এলাকায় এরথেকে সামনে গেলে হয়তো ভালো মানের খাবার হোটেল পাওয়া যাবে না বলেই দলবল বেঁধে সকল স্টুডেন্টদের নিয়ে শিক্ষকরা এই রেস্তোরাঁয় নামলো খেতে। খুবই সর্তক আর গাইডলাইনের সাথে স্টুডেন্টের রেস্তোরাঁয় ভিতরে বসাল। দেড়শো স্টুডেন্টদের খাওয়া-দাওয়া আর ফ্রেশ হতে হতে প্রায় দেড় ঘন্টার উপর সময় লাগলো। রাত তখন ৪ঃ৪৫ থেকে প্রায় ১০ঃ২০ ঘড়ির কাঁটায় গিয়ে ঠেকেছে। এই খাওয়া দাওয়া পুরো সময়টাতে মায়া, জুই, নাদিয়া, শ্রেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল। এরমাঝে চারজনে ওয়াশরুমের কাজ সেড়ে পুনরায় আরিফের নির্দেশ অনুযায়ী বাসে গিয়েও বসেও পড়লো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস গুলো ছেড়ে দিবে। ইতিমধ্যে সকল স্টুডেন্টের বাসে উঠা শেষ। ক্লান্ত মায়া পুনরায় জ্বালানা দিয়ে তাকিয়ে বাকি স্টুডেন্টদের দলবেঁধে গাড়ি উঠতে দেখার মধ্যে বেখেয়ালি হঠাৎ চোখ যায় রেস্তোরাঁ অদূরে কিছু ঝাপসা দৃশ্যের দিকে। কৌতূহল মায়া মাথা বের করে সেইদিকে উঁকি মেরে তাকাতেই আরও ঝাপসা কিছু দৃশ্য দেখলো সে। অতো দূর থেকে মায়া সেই দৃশ্য গুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারলো না। তবে এতোটা বুঝতে পারলো সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। মায়া সেইদিকে তাকিয়ে থেকে পাশের বসা জুইকে ডাকল উঁচু গলায়, মায়ার দেখা অদূরের সেই ঝাপসা দৃশ্যটা কি সেটা দেখানোর জন্য জুইকে ডেকে মায়া বলল..

‘ জুই! জুই! দেখতো রেস্তোরাঁর পিছনে কি? ঐখানে কি কিছু হচ্ছে নাকি? আচ্ছা ঐখানে আমাদের ক্লাসমেট রাফা না ওটা? কিন্তু ওহ ঐখানে কি করছে দেখতো?

অমনোযোগী জুই ফোন চালানোতে ব্যস্ত ছিল বলে, মূলত ওহ মায়ার কথায় তেমন মনোযোগ দিতে পারলো না। ওদের সারাদিনের তুলা ছবি গুলো দেখছিল জুই। তাই মায়ার কথায় অমনোযোগী ভাবে হালকা উঁকি দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অদেখার মতোন করে পুনরায় জায়গায় বসে ফোন চালাতে চালাতে বলল…

‘ কই কিছুই তো নেই। যদিও কিছু থাকে তাহলে তোর এতো কিছু দেখা লাগবে কেন? চুপচাপ বসে থাক।

জুইয়ের কথায় মায়া তেমন পাত্তা না দিয়ে পুনরায় সেইদিকে তাকিয়ে রইল। মায়ার মন খসখস করছে রেস্তোরাঁর পিছনে ঘোর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় রেস্তোরাঁটাও পাহাড়ের সীমান্তে অবস্থিত। মায়া রেস্তোরাঁর পিছনে পাহাড়ি জঙ্গলের দিকটায় তাকিয়ে রইল। আবছায়া অন্ধকারে মায়ার মনে হচ্ছে সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। কারা যেন রাফার সাথে জোরাজোরি করছে। মায়া অতো দূরে থেকে বেশ একটা বুঝতে পারছে না কিন্তু এতো দূর থেকে দেখে মায়ার কেন জানি তাই মনে হলো। যদিও মায়া সিউর না। কিন্তু তারপরও মায়া চোখের সামনের দৃশ্য গুলো হেলাফেলা করতে পারলো না। বরং মায়া পুনরায় জুইকে ডেকে সেই দৃশ্য দেখাতে চেয়ে একই ভাবে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল…

‘ জুই একটু ভালো করে দেখেনা প্লিজ। রাফাকে মনে হয় কারা যেন তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি অন্ধকারে ঠিকঠাক বুঝে উঠে উঠতে পারছি না। আমার মনের ভুলও হতে পারে তাই তুই একটু দেখে বলনা আমি যা দেখছি তুই কি তাই দেখছিস নাকি? জুই!

মায়া পরপর কথায় উত্তর না আসার মায়া বিরক্ত নিয়ে পাশ ফিরে তাকাতে দেখলো জুই পাশের সিটে নেই। শ্রেয়া, নাদিয়ার সঙ্গে পিছনের সিটে বসে ফোনে কিছু একটা দেখছে তিনজন মিলে। অস্থির মায়া জুইকে না পেয়ে পুনরায় গাড়ির জ্বানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল, দেখলো এবার আর রাফা নামক মেয়েটাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মায়ার মন খসখসে গাড়ির সিট থেকে উঠে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য একবার হোটেলের পিছনে গিয়ে রাফা মেয়েটার খোঁজ করে আসবে বাহিরে আছে কিনা সে, যদি রাফাকে না পায় তাহলে ভাববে মেয়েটা অবশ্যই কোনো না কোনো বিপদে আছে। তখন মায়া নাহয় কলেজের স্যারদের বিষয়টা জানাতে পারবে। কিন্তু মায়া আগে নিশ্চিত না হয়ে হুট করে যদি রাফা মেয়েটা বিপদে আছে এমন কথা রটায় তাহলে দেখা গেল পরে রাফা মেয়েটাকে সুস্থসবল দেখে মায়া লজ্জা পরে যাবে সবার সামনে বিভ্রান্তকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার দায়ে। মায়া কোলের ব্যাগটা সিটের উপর রাখতে রাখতে কয়েক সিট পিছনে জুইকে উদ্দেশ্য করে পুনরায় ডেকে বলল….

‘ জুই আমি একটু নিচে যাচ্ছি আরিফ ভাইয়ার কাছে। এক্ষুনি চলে আসব।

মায়া কথায় জুই,শ্রেয়া, নাদিয়া তিনজনই এইদিকে তাকাল। মায়ার মুখে আরিফের নামটা শুনে জুই বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দিল না বরং অল্প আপত্তি জানিয়ে বলল…

‘ ভাইতো আসবেই! তুই এখন নিচে নেমে কি করবি? গাড়ি তো এক্ষুনি ছেড়ে দিবে।

‘ গাড়ি ছাড়ার আগেই চলে আসব! একটু কাজ আছে নিচে।

‘ আচ্ছা যাহ। তাড়াতাড়ি আসিস।
‘ আচ্ছা!

মায়া ব্যাগ-ট্যাগ ফেলে খালি হাতে বাস থেকে নামল। আরিফ, রাকিব টিচার্সদের সাথে সামনের বাস গুলোতে স্টুডেন্টদের উঠানো কাজে ব্যস্ত। মায়া বসেছিল লাস্ট বাসটিতে। ওদের বাসে সবার কাজ শেষ বলে এই দিকে তেমন কারও হেয়াল নেই। মায়া বাস থেকে নেমে একবার ভাবল আরিফের কাছে যাবে। আরিফকে জানাবে মায়া ঐদিকে হোটেলের পিছনে রাফাকে দেখেছিল ওর সাথে কারা যেন ছিল। পর মূহুর্তে মায়া ভাবলো ওর মনের ভুলও হতে পারে সেজন্য মায়া আগে সেইদিকটায় একবার উঁকি মেরে দেখতে চাইল আসলে সেইদিকে কেউ আছে কিনা। ভাবনা অনুযায়ী মায়া সত্যি সত্যি বাসের উল্টো পথে হাঁটল। অল্পসল্প চিপা রাস্তা ধরে হোটেলের পিছনে এসে তেমন কাউকে দেখল না। বেশ অন্ধকার হওয়ায় আশেপাশে তাকাতেই মায়ার গা চমচম করে উঠলো ভয়ে। হোটেলের পিছনের দিকটায় বেশ উঁচু পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। পাহাড়ি গাছ-গাছালিতে ঘেরা জঙ্গলের মতোন হয়ে আছে। মায়ার গা শিরশির করে উঠলো ভয়ে। অন্ধকারে আশেপাশের কাউকে দেখতে না পেয়ে মায়া ফিরতে গিয়েই কারও গোঙানির শব্দে কানে আসল। চমকে উঠার মতোন দ্রুত আশেপাশে তাকাল। তেমন কাউকে দেখতে না পেয়ে মায়া গোঙ্গানির শব্দ অনুসরণ করতে চাইল। থেমে থেমে অল্প শব্দ কানে আসতেই মায়া সেই শব্দ উৎস অনুসরণ করে একপা দুপা সামনে এগোতে এগোতে হোটেল থেকে বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ি চৌড়ায় উঠতে উঠতে দেখলো বেশ কিছু ছেলে একত্রে একটা মেয়ের হাত-পা, মুখ বেঁধে মেয়েটিকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে। আতকে উঠার মতোন মায়া থমকে গেল অন্ধকারের মধ্যে ওদের কলেজের সাদা ড্রেস পরিহিত মেয়েটিকে দেখে। তারমানে মায়া তখন গাড়িতে বসে ঠিক দেখেছিল। এই মেয়েটিই রাফা ছিল। আর এই ছেলে গুলো তখন রাফাকেই জোর-জবরদস্তি করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। অনেক দূর হওয়ায় মায়া তখন সেটা বুঝতে পারেনি। এজন্যই মায়া জুইকে এতোবার বলেছিস এইদিকটায় তাকাতে। বেখেয়ালি জুই তখন যদি মায়ার কথা গুলো একবার মনোযোগ দিয়ে শুনতো বা দেখতে চাইতো মায়া আসলে কি দেখাতে চাইছে ওকে তাহলে আজ রাফা মেয়েটা বিপদে পড়তো না। তার আগেই মায়া সবাইকে জানিয়ে রাফা মেয়েটাকে এইছেলে গুলোর হাত থেকে বাচিয়ে নিতো। আতঙ্কিত মায়া কি করবে চট করে বুঝতে পারলো না। এখন যদি মায়া দৌড়াদৌড়ি করে পুনরায় বাসের কাছে ফিরে যায় সবাইকে এটা জানাতে ওদের কলেজের রাফা নামের একজন শিক্ষার্থী বিপদে পরেছে কারা যেন মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেটা বলতে, তাহলে সবাইকে নিয়ে মায়া ফিরে আসতে আসতে রাফা মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলবে ওহ। আবার এই মূহুর্তে মায়া একা রাফার পিছনে গিয়েও কোনো লাভ নেই, ওর দ্বারা এতো গুলা ছেলের থেকে মেয়েটাকে একা বাঁচানো সম্ভব না। অস্থির মায়া কি করবে বুঝতে না পেরে ঐ পাহাড়ি নেশাখোর ছেলে গুলোর পিছনে হাঁটল। অন্তত কোথায় নিয়ে যায় রাফাকে সেই লোকেশন দেখে নাহয় মায়া পুনরায় ফিরে এসে সবাইকে জানাবে সেটা। ভাবনা অনুযায়ী মায়া তাই করলো। হোটেল থেকে বেশ অনেকটা দূরে নিয়ে যায় রাফাকে ছেলে গুলো। পাহাড়ের শিষ্য চৌড়ায় এনে রাখল মেয়েটিকে হাত পা, মুখ বাঁধা অবস্থায়। তার কিছুটা সামনেই আগুন জ্বালিয়ে হৈচৈয়ে নেশা করা বুদ হলো একেকজন। এই সবকিছুর মাঝে মায়া ছেলে গুলোর পিছন ছুটতে ছুটতে অন্ধকারের মাঝে নিজেদের হোটেলের রাস্তা ভুলে বসল। এই অচেনা অজানা পাহাড়ি এলাকায় মায়া নতুন। কোন দিকে মূল রাস্তা আর কোন দিকে বিপদ সংকেত তাও জানা নেই মায়ার। আতঙ্কিত মায়া রাফার খোঁজে নিজের জীবনও বিপদের ফেলল। পাহাড়ের চৌড়ায় উঠতে উঠতে অসংখ্য বার উঁচু নিচু গর্তে হুঁচট খেয়ে পরায় গায়ের সাদা ড্রেস লাল মাটিতে ময়লা ময়লা করে ফেলেছে ততক্ষণে, তারপরও হাল ছাড়েনি। নিশ্চুপের ছেলে গুলোর পিছনে ছুটতে ছুটতে নিদিষ্ট গন্তব্য পযন্ত পৌঁছাল। পাহাড়ি গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে দেখল প্রায় আট থেকে দশজনের মতো পাহাড়িয়ান নেশাখোর ছেলেপেলে হবে। আর এদের বসবাস মূলত পাহাড়ের চৌড়ায় হয়ে থাকে। মায়া আশেপাশের গা ছমছম করা পরিবেশটা দেখল। পাহাড়ী গাছের ডালপালা কেটে বসার মতোন একটা টুল বেঁধে রেখেছে। এর পাশেই একটা বাঁশের চৌকি দেখা গেল। আর মাঝের খালি জায়গাটাতে ছেলেগুলো গোল করে বসে মধ্যস্থতায় আগুন জ্বালিয়ে হাতের তালুতে কিছু একটা ঘঁষে ঘঁষে বার বার সেটা মুখে দিয়ে নেশা করছে তাঁরা। মূলত বোকা মায়ার ধারণা নেই পাহাড়ীয়ান নেশাখোর ছেলেগুলোর ভয়ংকরতা সম্পর্কে। যদি থাকতো তাহলে কখনোই নিজের জীবন বিপদে ফেলে একা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েকে বাঁচাতে আসতো না এই মধ্যরাতে। বরং দ্রুত নিজের কলেজের কর্তৃপক্ষদের জানাতো বিষয়টি। মায়ার বোকামিতে সে নিজেই ফেঁসে গেল। আর এই বিষয়টা সম্পর্কে ওর নিজেরও জ্ঞান ছিল না। মূলত পাহাড়ীয়ান নেশাখোর ছেলেদের কোন জাত বংশ হয়না। তাঁরা বেনামি পাহাড়ি জঙ্গি বলে মানুষের কাছে পরিচিত। এদের দিয়ে অন্ধকার জগতের সকল কাজ করায় দুনিয়ার ক্ষমতাশীল মানুষরা। চুরি, ছিনতায়, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী পাচার, অস্ত্র পাচার, কিডন্যাপিং, জঙ্গি আর দুনিয়ার সকল অরাজগতা কাজ করানো হয় এসব পাহাড়িয়ান নেশাখোর ছেলেপেলেদের দিয়ে। এমন ভয়ংকর জঙ্গিদের হাতে কোনো ছেলে মানুষ পড়লেই তার জীবন নিয়ে ফিরতে পারে না সেখানে মায়া একা মেয়ে হয়ে এসেছে আরেকজন মেয়েকে বাঁচাতে। নিরস্ত্র মায়ার হাতে একটা ফোন পযন্ত নেই যে কারও কাছে সাহায্য চাইবে। খালি হাতে বান্ধবীকে বাঁচাতে এসে সে নিজের জীবনও রিস্কে টানল। কিছুসময় পার হতেই পরিস্থিতি অল্প শিথিল হলো। ছেলেগুলোকে নেশায় মেতে থাকতে দেখে মায়া গাছের আড়াল হতে অল্প উঁকি মেরে দেখল রাফাকে। মায়ার থেকে কিছুটা দূরে রাফাকে ছেলেগুলোর ওর হাত,পা মুখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখেছে মাটিতে। হয়তো নেশা করার পরপরই ঝাপিয়ে পরার চিন্তা ভাবনা। মায়া আর কিছুই ভাবলো না, নিজের ক্লাসমেটকে বাঁচাতে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে বসল রাফার পিছনে। রাফা তখন নিজের হাতে পায়ের বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টায় আর্তনাদের চিৎকার করার মতোন গোঙ্গাচ্ছিল ছাড়া পাওয়ার জন্য। মাটিতে পরে ছটফট করার সময় হঠাৎ পায়ের কাছে যখন কারও উপস্থিত বুঝতে পারল তখন আতঙ্কিত রাফা প্রাণ বাঁচাতে প্রহার করে বসল মায়াকে। নিজের দুপা একত্রে বাঁধা অবস্থায় লাথি মারল মায়াকে। আঘাত পেয়ে ছিটকে পরার মতোন উল্টে পরলো মায়া। রাফা মনে করেছিল নেশাখোর ছেলে গুলোর মধ্যে কেউ একজন হবে ওকে ছুঁয়ার চেষ্টা করছে। সেজন্য গোঙ্গানি অবস্থায় মাথা তুলে পায়ের কাছটায় তাকাতেই দেখল মায়াকে পুনরায় দৌড়ে গাছের পিছনে লুকাতে। মায়াকে দেখেই আতঙ্কিত রাফা সুস্হির হলো। শেষ ভরসার আশ্রয় খোঁজে মায়াকে উদ্দেশ্য করে গাছের পিছনে তাকিয়ে আরও জোরে জোরে গোঙ্গাতে লাগাল ওকে বাঁচাতে। অথচ মায়া রাফাকে বাঁচাতে এসেও ওহ কেন পুনরায় পালিয়ে গেল সেটা বুঝতে রাফার আরও কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল যখন দেখল একটা নেশাখোর ছেলে এইদিকটায় এগিয়ে আসছে রাফার উদ্দেশ্যে। মূলত রাফার তখন মায়াকে দেখে হঠাৎ চিৎকারের শব্দে এই ছেলেটিকে পাঠিয়েছে দেখতে বাকি ছেলে গুলো। পাহাড়ি এলাকায় বনপ্রাণী বেশি থাকে। এরা একা মানুষ পেলে আক্রমণ করে বসে। সেজন্য রাফার চিৎকারে দেখতে আসল কোনো বনপ্রাণী আক্রমণ করেছে কিনা। কিন্তু আশেপাশে তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে রাফার সামনে ছেলেটি বসতে বসতে ওর গাল আকড়ে ধরে ঝরঝরে চট্টগ্রামের ভাষায় নেশাক্ত গলায় বলল…

‘ শালী হুদাই না চিল্লায়া শরীরে শক্তি ধরে রাখ। দশটা পুরুষ মানুষের সারারাত মনোরঞ্জন করতে তোর অনেক শক্তির প্রয়োজন হবে। নেশা করবি? তাহলে তোরও আমাদের মতোন বহুত শক্তি হইব শরীরে। তখন আমাদের মজা দিতে পারবি, তুইও মজা লইতে পারবি। দাঁড়া আনতেছি তোর জন্য নেশা।

কথা গুলো বলেই আবারও ছেলেখোর ছেলেটা হেলতে দুলতে হাঁটল বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্যে। হয়তো নেশা নিয়ে ফিরবে আবার। ছেলেটিকে চলে যেতে দেখে মায়া পুনরায় গাছের পিছন হতে বের হলো। এবার মায়াকে দেখে রাফা তেমন একটা হৈচৈ করলো না। বরং চুপ রইলো। তাড়াহুড়োর মায়া দ্রুত হাতে রাফার পিঠে ওর হাতের বাধন খোলে দিতেই রাফা উঠে বসল। মায়া ওর পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে রাফা নিজে ওর হাতে বাঁধন খোলে আতঙ্কিত গলায় খানিকটা উঁচু স্বরে মায়াকে শুধালো…

‘ তুই এখানে কিভাবে এসেছিস মায়া?

রাফার উঁচু গলায় আতঙ্কিত হলো মায়া। তাড়াহুড়োয় তৎক্ষনাৎ রাফার মুখ চেপে মায়া সর্তক করতে করতে ফিসফিস গলায় বলতে চাইল..

‘ আস্তে কথা বল রাফা! নয়তো ধরা পড়ে যাব আমরা।

মায়ার সর্তকতায়ও তেমন কাজ হলো না। রাফার বোকামিতে ততক্ষণে চলে যাওয়া ছেলেটিও পিছন ঘুরে তাকাল মেয়েলি কন্ঠ শুনে। দেখল ওদের ধরে আনা মেয়েটিকে অন্য নতুন আরেকটা মেয়ে মুখ চেপে ধরে আছে ছাড়া পাওয়া অবস্থায়। নতুন মেয়ে মায়াকে দেখেই নেশাখোর ছেলেটি চিল্লিয়ে উঠে বাকিদের উদ্দেশ্যে, পুনরায় চট্টগ্রামের ভাষায় ডেকে বলল…

‘ কিরে কই তোরা? দেখ এইখানে আরও একটা নতুন মাইয়া আইছে। আমাদের পুরাতন মাইয়াডারে তো ছাড়াই নিইয়া যাইতেছে। তোরা কই তাড়াতাড়ি আয়। ধর শালীদের।

বগল থাবার মতোন রাফার এক চেপে আতঙ্কিত মায়া তৎক্ষনাৎ দৌড়াল পাহাড়ি এলোমেলো রাস্তা ধরে। কোথায় যাচ্ছে? কোন রাস্তা ধরে দৌড়ালে হোটেলে পৌঁছাতে পারবে তার কিছু জানা নেই মায়ার। শুধু জানে এই ছেলেগুলোর হাত থেকে নিজেকে এবং রাফাকে বাঁচাতে হবে। হয়তো রাফার তখন ঐভাবে চিল্লিয়ে কথা গুলো না বললে দুজন নিশ্চুপে পালিয়ে আসতে সক্ষম হতো। কিন্তু ভয়ার্ত রাফার বোকামিতে ওর সাথে সাথে মায়াও ফেঁসে গেল জঙ্গিদের হাতে। আতঙ্কিত দুজন প্রাণের ভয়ে যেইদিকে দু’চোখ যাচ্ছে সেই দিকেই দৌড়াচ্ছে। অথচ অচেনা পথে দৌড়ানোতে দুইজন আবারও নতুন করে বিপদের সক্ষমহীন হবে কিনা জানা নেই কারও। পিছনের পাহাড়িয়ান জঙ্গি গুলোর খাক ছেড়ে চিল্লানোর শব্দ শুনা যাচ্ছে অনবরত। আতঙ্কিত দুই বান্ধবী পিছনে না তাকিয়ে বুঝতে পারছে ছেলেগুলো ওদের উদ্দেশ্যেই ঝড়ের বেগে দৌড়ে আসছে। প্রাণপূর্ণ দৌড় আর হুঁচট খেতে খেতে পাহাড়ের চৌড়ায় থেকে দেখল সারিবদ্ধ ভাবে মায়াদের কলেজের বাস চারটে চলে যাচ্ছে পাহাড়ের বুক ঘেঁষে রাস্তা দিয়ে। বাসের উজ্জ্বল আলোয় মায়াদের মোটেও চিনতে ভুল হলো না নিজেদের কলেজ বাসগুলোকে। আতঙ্কিত মায়া আরও আতঙ্কিত হলো নিজের আপনজনদের ওদের রেখে চলে যেতে দেখে। মায়াদের বাসগুলো ওদের খোঁজ না করেই চলে যেতে দেখে পাহাড়ের চৌড়ায় থেকেই মায়া রাফার হাত চেপে সেদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে চিল্লাতে চাইল বাস গুলোকে থামাতে। কিন্তু পরমূহুর্তে সর্তকতায় আর চিল্লাল না। পিছনের পরে থাকা ছেলে গুলো যদি ওদের খোজ পেয়ে যায় সেজন্য। দিনের আলোয়ই পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তায় চলা মুসকিল। হুচট খেয়ে পাহাড়ের উপর থেকে তলদেশে পড়ার সম্ভবনা বেশ। এমতবস্থায় রাতের এগারো-টায় চাঁদ বিহীন অন্ধকারে পাহাড়ের রাস্তায় দৌড়ানোটা আরও ভয়ংকর। জানাশুনা ট্রেনিং প্রাপ্ত ট্রেনারও এমন রাতে পাহাড়ের বুকে নামে না পাহাড়ি জঙ্গি বিষাক্ত জীব বস্তু বা বিষধর সাপের তাড়নায়। সেখানে দুটো মেয়ে হয়ে ওদের চারদিক থেকে বিপদ আর বিপদ জড়িয়ে। ভয় পেয়ে থেমে গেলে নেশাখোর ছেলেদের হাতে ইজ্জত খইয়ে মরতে হবে। আর নয়তো প্রাণের তাগিদে দৌড়াতে চাইলে যেকোনো সময় পাহাড়ি হিংস্র প্রাণী বা বিষাক্ত সাপের কবলে পরে মরতে হবে। মোট কথা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে মায়া প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রাফার হাত চেপে দৌড়াচ্ছে চলে যাওয়া বাস গুলোকে ধরতে। বেখেয়ালি দৌড়ানোতে একটা সময় অন্ধকারের ছোট গর্তে হুঁচট খেয়ে দুজনই উল্টে পরলো পাহাড়ের উঁচু থেকে নিচে। আর এই উল্টে পরা দুজনের বেশ কাজে দিল। পাহাড়ের উপর থেকে সোজা রাস্তায় এসে পরলো। মায়া থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পরলো রাফা। হাতে পায়ে, শরীরের জায়গা জায়গা ব্যথা পেল দুজনই এতো উঁচু থেকে পরায়। আতঙ্কিত মায়া ব্যথায় গোঙ্গিয়ে উঠে বসতে বসতে নিজেদের বাসের খোঁজ করলো। দেখল মায়াদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে বাস চারটে চলে যাচ্ছে। বসে থেকেই মায়া চেঁচাল বাস গুলোর উদ্দেশ্যে। মায়ার দেখাদেখি রাফাও সেইম কাজ করলো। কিন্তু বাস গুলোকে থামতে না দেখে মায়া নিজের শরীরে ব্যথা ভুলে পুনরায় রাফার হাত চেপে টেনে তুলে দৌড়াল বাসের পিছন পিছন। এমনই দীর্ঘ সময় ধরে পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে দৌড়াচ্ছে দুজন। এখন আবার চলন্ত বাসের পিছন পিছন দৌড়াতে হচ্ছে ওদের জন্য থামতে। কিন্তু চলন্ত বাস গুলোতে মায়াদের ডাক পৌঁছাল না। আর না মিউজিকের জন্য কেউ শুনতে পেল বুক ফাটা দুই কন্যার আর্তনাদের চিৎকার।

‘ বাস থামাও কেউ। আমাদের নিয়ে যাও। আরিফ ভাই! আরিফ ভাই! আমরা বিপদের পড়েছি আমাদের বাঁচাও। জুই! জুই! এই জুইইইইই!

মায়া, রাফার পরপর চিৎকারের শব্দে দুপাশের পাহাড়ের প্রতিধ্বনি হয়ে পুনরায় সেটা ফিরত আসছে তারপরও চলন্ত বাসের কেউ শুনলো না ওদের আর্তনাদের চিৎকার। দৌড়াতে দৌড়াতে বাস গুলো চোখের সামনে থেকে বহুদূর চলে যেতে দেখে থামে দুজন। দীর্ঘ সময় ধরে বাসে পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে নিশ্বাস ফুলে আসে দুজনের হাঁপাতে হাঁপাতে। গলা শুকিয়ে দুজনের কাশি উঠলো অনবরত। কাশতে কাশতে নিশ্বাসের অভাবে দুজনই মাঝ রাস্তায় বমিও করে বসলো। ক্লান্তিতে হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসতেই ওদের কানে আসলো ছেলেগুলোর হুংকারের শব্দ। ভয়ার্ত মুখে দুজনই তৎক্ষনাৎ পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল বাকি ছেলেগুলোর একজন ওদের ঠিক কাছাকাছি চলে এসেছে। মায়ারা এতক্ষণ বাসের পিছনে দৌড়ানোর ফলে পিছনে পরে থাকা গুন্ডা গুলোর কথা প্রায় ভুলে বসেছিল দুজন। কিন্তু এখন আতঙ্কিত দুই বান্ধবী পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল মোটা লাঠি হাতে একজন ছেলে দৌড়ে আসছে মায়াদের দিকে। বাকি ছেলে গুলো হৈচৈ করে পাহাড়ের চৌড়া থেকে নিচে নামছে চিল্লাতে চিল্লাতে। আতঙ্কিত দুই বান্ধবী তৎক্ষনাৎ প্রাণের ভয়ে উঠে দাঁড়াল। পুনরায় রাফার হাত চেপে মায়া একই ভাবে দৌড়াতে গেলে পিছনে দৌড়ে আসা ছেলেটা হাতের মোটা লাঠিটা ছুড়ে মারলো মায়ার উদ্দেশ্যে। দক্ষ হাতের ঢিলে মায়া পায়ে আঘাত পেতেই মুখ থুবড়ে পরলো পিচ ঢালা রাস্তায়। এক ভাবে রাফাও পরলো মায়ার সঙ্গে। সেই সুযোগে এগিয়ে আসা ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে আটকাল মায়াদের। মায়ার উপর ক্ষোভ থেকেই প্রথম প্রহার করলো মায়াকে ছেলেটি। মায়ার হিজাবের উপর দিয়ে মায়ার চুলের মুঠি চেপে ধরে বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে দিতে বলল…

‘ শালী অনেক দৌড় করিয়েছিস। আজকে দেখব তোর শরীরে কতো তেজ।

একহাতে মায়ার চুলের মুঠি চেপে অন্যহাতে রাফাকেও আটকাল। নিজের বাকি সঙ্গীদের ডেকে চট্টগ্রামের ভাষায় চিল্লিয়ে বলল ছেলেটি…

‘ এই তোরা কই? এদিকে আয়! শালীদের ধরেছি তাড়াতাড়ি আয়। আমা…. আহ!!

বাকি কথা গুলো শেষ করার আগেই ভাঙ্গা রাস্তার ভাঙ্গা ইট তুলে এলোমেলো ভাবে নেশাখোর ছেলেটির চোখ আর কপাল মিলিয়ে আঘাত করলো মায়া। আঘাতের তাড়নায় চিৎকার করে তৎক্ষনাৎ মায়ার চুল ছেড়ে নিজের চোখে হাত দিতেই উঠে দাঁড়াল মায়া। রাস্তায় পরে থাকা রাফা হাত টেনে তুলে পুনরায় পাহাড়ি রাস্তা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে আতঙ্কিত মায়া রাফার উদ্দেশ্যে বলল…

‘ আমাদের বাঁচানোর মতো আর কেউ নেই রাফা। নিজের প্রাণের লড়াই এবার আমাদেরই করতে হবে। আমাদের আপনজন গুলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রাফা। এখন আল্লাহ ভরসা। তিনি আমাদের সহায় হবেন ইনশাআল্লাহ। শুধু পা থামাস না তাহলেই হবে।

দীর্ঘ সময় দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে উঠেছে দুজনই। শ্বাস ফুলে যাচ্ছে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে আঘাতে আঘাতে। মায়া অনুভব করলো ওর ডানপায়ে ভিষণ ব্যথা আর ভিজা অনুভব করছে। হয়তো তখনকার ছেলেটি মায়াকে লাঠি ছুড়ে মারায় ওর পা কেটে রক্ত ঝড়ছে। কিন্তু তারপরও নিজের দৌড় কমাল না। মায়ার সঙ্গ ধরে রাফাও দৌড়াতে দৌড়াতে কান্না মিশ্রিত গলায় বলল…

‘ আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মায়া, যেকোনো সময় জ্ঞান হারাব মনে হয়। আজ আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত। ওরা আমাদের ধরতে পারলে জানে মেরে ফেলবে।

শরীরের ব্যথা, আঘাতে, ভয়ে চোখ দিয়ে পানি মায়াও পরছে। কিন্তু তারপরও হাল না ছেড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে রাফাকে সাহস দিয়ে বলল…

‘ আল্লাহ ভরসা রাফা। হাল ছাড়িস না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন ইনশাআল্লাহ। তারপরও আজ যদি মরতে হয় তাহলে ইজ্জত সম্মানে মরবো। কিন্তু তারপরও এসব নোংরা জঙ্গিদের হাতে ইজ্জত খুয়াব না। আয়।

সারি সারি পাহাড়ের বুক ঘেঁষে তৈরি করা যানবাহনের রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একেকটি পাহাড়। আবার সেই পাহাড়ের গায়ে হেলিয়ে উঠে আছে যেন অন্য একটি পাহাড়। ছোট-বড় উঁচু নিচু অসংখ্য পাহাড়ের মেলা দেখা যায় দিনের আলোয় এইদিকটায়। কিন্তু রাতের আলোয় সেই পাহাড় গুলো ভয়ংকর কালো ছায়া ছাড়া তেমন কিছুই দেখা বা বুঝা যায় না। এমন অন্ধকার রাতে দুই পাহাড়ের বুক ঘেঁষে মায়া রাফার হাত চেপে দৌড়াচ্ছে উদ্দেশ্য বিহীন গন্তব্যে। আশেপাশে বাড়িঘর, মানুষজনের চিহ্ন পযন্ত নেই যে কারও কাছে সাহায্য চাইবে। আছে শুধু নিস্তব্ধ পাহাড়ের হাহাকার আর ঝিঁঝি পোকার শব্দ, অসংখ্য বনশেয়ালের খাক ছাড়া হুংকারের ডাকও শুনা যাচ্ছে। এই অচেনা জায়গার নাম, ঠিকানা, লোকেশন কিচ্ছু জানা নেই মায়ার। এমন কি ওরা কোথায় আছে তাও জানে না। মায়া দৌড়াতে দৌড়াতে পিছন ফিরে দেখল ছেলে গুলোর অবস্থা কোথায়? আহত ছেলেটাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। বাকি ছেলে গুলো এইদিকটাই এগিয়ে আসছে মায়াদের ধরতে। এইখান থেকেও মায়া ওদের চিৎকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সেজন্য মায়া বুদ্ধি খাঁটিয়ে আর সোজা রাস্তা ধরে দৌড়াল না। কারণ সোজা রাস্তা ধরে দৌড়ানো মানেই একটা সময় ছেলেগুলো হাতে সহজেই ধরা পড়ে যাওয়া হবে। পিচ ঢালা রাস্তায় মায়াদের সরাসরি দেখতে পারবে সেজন্য ওদের ধরাও সহজ হবে। কিন্তু পাহাড়ী রাস্তা ধরে দৌড়ালে ওদের খোঁজ পাওয়াই মুশকিল হবে। মায়াদের দেখতে না পারলে খোঁজ মুশকিল হবে বলেই মায়া সোজা রাস্তা থেকে পাহাড়ি রাস্তা ধরল রাফাকে নিয়ে। অচেনা অজানা পাহাড়ের বুকে উঠতে লাগল অন্ধকারের মাঝে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই কিন্তু এই রাতে পাহাড়ের মাঝেই কোথাও একটা আশ্রয় নিতে হবে ওদের। নয়তো বেশিক্ষণ দৌড়া ওদের দ্বারা আর সম্ভব হবে না। অলরেডি দুজনের শরীর ছেড়ে দিচ্ছে আঘাতে আঘাতে। মায়ার আঘাত প্রাপ্ত পায়ে আরও আঘাত পাচ্ছে পাহাড়ের উঁচু নিচু গর্তে আর গাছের ডাল পালায় হুঁচট খেতে খেতে। দৌড়াতে দৌড়াতে পাহাড়ের মধ্যস্থতায় ছোট গোহায় সন্ধান পেতেই মায়া সেটাতে ঢুকে পরলো রাফাকে নিয়ে। চেপে চেপে দুই বান্ধবী একত্রে বসতেই মায়া দ্রুত ছোট ছোট গাছপালা টেনে গোহার মূখ ডেকে দিল। ভয়, অস্থিরতা, আতঙ্কে দুজনই সিঁটিয়ে বসল।

দীর্ঘ সময়ের দৌড়াদৌড়িতে শ্বাস ফুলে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে দুজনই। এর মাঝে ছেলেগুলো দৌড়াদৌড়ি আর খাক ছেড়ে হুংকারের শব্দ শুনা গেল গুহার সামনেই। আতঙ্কে রাফা কেঁদে উঠতেই মায়া দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরল ভয়ে। অন্ধকার মাঝেই রাফার মুখ চেপে মায়া ওকে আটকাল শব্দ করা থেকে। একবার যদি কোনো কারণে ছেলেগুলো হাতে ধরা পরে তাহলে এবার আর প্রাণের রক্ষা হবে না। আতঙ্কিত মায়া ততক্ষণ পর্যন্ত রাফার মুখ চেপে রইল যতক্ষণ পযন্ত ছেলেগুলো ওদের গুহা হতে দূর না যাচ্ছে। এর মাঝেই দেখতে পেল ছেলেগুলো হাতে ফোনে আলোয় ওদের সন্ধান করতে। রাগান্বিত ছেলেগুলো মায়াদের খোঁজতে খোঁজতে গুহার সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গালি দিয়ে বলল…

‘ শালী দুইটা জীবনের দৌড় করাচ্ছে আজ। একবার শুধু পাইয়ানেই দুইডারে কুবাইয়া মারুম শালীগো। নতুন মাইয়াডা আছে না যেটা আমাদের তুইলা আনা মাইয়াডারে ছাড়াইয়া লইয়া গেল? ঐ মাইয়াডা বেশ চতুর। এই শালীই আমাদের এতো দৌড় করাচ্ছে। একবার খালি এই শালী ধরতে পারলে সবার আগে কুবাইয়া মারুম এইডারে। তারপর শালীর কাঁচা মাংস সিদ্ধ ছাড়াই কাঁচা খামু। এই শালী আমার শরীরে জিদ উঠায় দিসে। এইডা না ধরা পযন্ত শান্তি নাই। এই সবাই একত্রে দৌড়ানোর দরকার নাই। সবাই আলাদা আলাদা হইয়া দৌড়া। মাইডা দুইডা আশেপাশেই হইব। এই পাহাড়ের বেশিক্ষণ দৌড়াইতে পারব না। এর থেকে সামনে গেলেই ডাকাতে হাতে পরবো। এর আগেই আমাদের মাইয়া দুইডারে ধরতে হইব।

ছেলেটির কথা হৈচৈয়ের বাকি ছেলেগুলো সম্মতি দিয়ে সবাই আলাদা আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পরলো মায়াদের খোঁজতে। গুহার সামনে কারও উপস্থিত ঠাহর না পেয়েই রাফার মুখ ছাড়ল মায়া। বুকে হাত বেঁধে মায়া সুস্থির নিশ্বাস নেওয়ার মধ্যেই রাফা ভয়ার্ত গলায় মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল…

‘ মায়া ওরা সবাই তো তোর উপর ভিষণ রেগে আছে আমাকে ছাড়িয়ে এসেছিস বলে। আমার জন্য তুই তোর নিজের জীবনও বিপদে ফেলে দিলি। আজকে তুই না থাকলে এতক্ষণে হয়তো আমার সবশেষ হয়ে যেতো ছেলেগুলোর হাতে। তোর ঋণ আমি কোনোদিন শেষ করতে পারবো না। তুই আমার জন্য ফেরেশতা হয়ে এসেছিস।

‘ আর তুই আমার জন্য রিনা খান হয়ে এসেছিস এই ফাটা বাশ গলা নিয়ে। বারবার সর্তক করছি উচু গলায় কথা না বলতে তারপরও ফাটা বাঁশের মতোন চিল্লিয়ে কথা বলছিস। তোর এই বাঁশ গলার জন্য আজ এই অবস্থা আমাদের। নয়তো সেই কখন তোকে নিয়ে চুপিসারে পালিয়ে যেতাম। গলার এতো জোর থাকলে তখন রাস্তায় পরে চিল্লালি না কেন? অন্তত তোর গলার জোরে আমাদের বাস থেমে যেতো। আমরাও নিরাপদে থাকতাম।

পুনরায় রাফার উঁচু গলায় মায়া খানিকটা রাগ নিয়ে উক্ত কথা গুলো ফিসফিসিয়ে শুধাল রাফাকে। মায়ার কথায় রাফা চুপ করে গেল। সত্যি তখন রাফা মায়াকে দেখে বোকামি করে না চিল্লালে হয়তো এখন ওদের এতো দৌড়াদৌড়ি করতে হতো না। নিশ্চুপে পালিয়ে আসতে পারতো। রাফা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মায়ার সঙ্গে আরও চেপে বসল। মায়া উদ্দেশ্য করে নরম গলায় ফিসফিসিয়ে বলল…

‘ তুই অনেক সাহসী মায়া। তোকে দেখে এতো সাহসী মনে হয়না। মনে হয় তুই ভিষণ বোকা আর সহজ সরল মেয়ে হবি। আচ্ছা তোর ভয় করছে না? ছেলেগুলোর হাতে ধরা পরলে কি হবে আমাদের সেটা ভেবে?

রাফার কথায় মায়া মাটির দেয়ালে হেলিয়ে বসল। ডানপায়ে ভিষণ ব্যথা করছে ওর। অন্ধকারে মায়া নিজের ডানপাটা ছুঁতেই চোখ খিঁচে গেল ব্যথায়। বুঝতে পারলো পা কেটে জখম হয়ে গেছে পুরোটা পা। মায়া দু’হাতে ডানপাটাকে কাছে টানতে টানতে রাফার কথার উত্তরের বলল…

‘ ভয় পেলে কি হবে? আমাদের কে বাঁচাতে আসবে এখানে? আশেপাশে দেখছিস কাউকে তুই ? তাহলে ভয় পেয়ে নিজেকে গুন্ডাদের হাতে তুলে দিব কেন বল আমাকে?

অন্ধকারে মায়ার পায়ের আঘাতটা ঠাহর করতে পারলো রাফা। সেজন্য একই ভাবে বলল…

‘ আমি তা বলিনি। আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম এমন একটা পরিস্থিতির মাঝে তুই এতো সাহস কোথায় থেকে পাচ্ছিস? আমার তো ভয়ে জান বের হয়ে যাচ্ছে।

‘ আমি জানি না রাফা এতো সাহস কোথায় থেকে পাচ্ছি। তবে আজ আমার মনের জোর এমনই আসছে বলেই নিজেকে ভিষণ সাহসী মনে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আজ লড়াই করে হলেও নিজেকে বাঁচাতে হবে কারণ আমি অন্য কারও আমানত। আমাকে না পেলে সে পাগল হয়ে যাবে। আমার তাঁর জন্য হলেও নিজেকে হেফাজতে রাখতে হবে রাফা।

মায়ার কথার মানে বুঝতে পারলো না রাফা। সেজন্য রাফা মায়াকে কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই মায়া বলল…

‘ তোর কাছে কোনো ফোন-টোন হবে রাফা? থাকলে বের কর। কারও সাথে যোগাযোগ করা দরকার। নয়তো এখান থেকে আমরা বের হতে পারব না।

মায়ার কথায় টনক নড়লো রাফার। ওহ দুটো ফোন সঙ্গে নিয়ে এসেছিল এই ট্যুরে। একটা টাচ্ ফোন অন্যটা বাটন ফোন ছিল। টাচ ফোনটাতে সারাদিনের ছবি তুলায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে ওর বান্ধবী নদীর কাছে সেটা জমা রেখেছিল। সেই জন্য এখন ওর কাছে সেই টাচ ফোনটা এখন নেই। বাকি বাটন ফোনটা ওর ব্যাগেই ছিল। আর সেই ব্যাগটা ওর কাঁধ জড়িয়ে কোমরে ছিল। কিন্তু নেশাখোর ছেলেগুলো ওকে তুলে আনায় সময় হয়তো ব্যাগটা কোথাও না কোথাও পরে গিয়েছে। এতক্ষণ পযন্ত ওর গায়ে থাকবে না সেটা। রাফা নিজের গা চেক না করেই মায়াকে বলল…

‘ আমার কাছে কোনো ফোন নেই মায়া। একটা ফোন বাসে ফেলে এসেছি অন্যটা ব্যাগে ছিল। ছেলেগুলো আমাকে তুলে আনার সময় হয়তো ব্যাগটা কোথাও পরে গিয়েছে।

রাফার কথায় মায়ার তৎক্ষনাৎ উত্তর আসল। মায়া বলল…

‘ তোর কোমরে যে ব্যাগটা ঝুলছে ঐটাতে ফোন-টোন নেই?

‘ আমার কোমরে ব্যাগ মানে?

কথা গুলো বলতে বলতে রাফা নিজের শরীরে হাত বুলিয়ে দেখল সত্যি সত্যি ওর কাঁধে ব্যাগটা এখনো রয়েছে। দীর্ঘ সময়ের আতঙ্কের দৌড়াদৌড়িতে রাফার মনে হয়েছিল ওর ব্যাগটা নাও থাকতে পারে। তবে এই মূহুর্তে ব্যাগটা পেয়েই রাফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে তৎক্ষনাৎ ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে মায়ার উদ্দেশ্য বলল…

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ এই ব্যাগটাতে আছে একটা ফোন। দাঁড়া! দাঁড়া দিচ্ছি।

ছোট ব্যাগটা থেকে একটা বাটন ফোন বের করে সেটাতে আলো জ্বালিয়ে মায়ার হাতে দিল রাফা। ফোনটা পেয়ে মায়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে রাফাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিল। এই অসময়ের এই ছোট ফোনটা আজ জীবন বাঁচাবে ওদের। পরিবারের মানুষ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে বলেই মায়া ভিষণ খুশি হলো। রাফা থেকে ফোনটা হাতে নিতেই মায়া আগে নিজের পায়ে ফোনের আলো ফেলে দেখল ওর পায়ের কি অবস্থা। অল্প আলোয় মায়ার পায়ের দিকে তাকাতেই রাফা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠার মতোন মায়ার পা দু’হাতে ধরতে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল…

‘ হায় হায় মায়া তোর পা তো পুরো শেষ। রক্তাক্ত হয়ে আছে। এই পায়ে এতক্ষণ দৌড়িয়েছিস?

মায়া রাফার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে হাতের ফোনটা রাফার হাতে দিল ওর পায়ে আলো দিতে। পায়ের ব্যথায় মায়ার মাথা পযন্ত টনটন করছে ব্যথায়। লাল রক্তে রক্তাক্ত হয়ে আছে মায়ার পুরো ডান পা। এমনকি মায়ার পরিহিত সাদা সেলোয়ারের নিচটা রক্তের ছিটায় লাল লাল হয়ে আছে। মায়া পা বাড়িয়ে ডানপায়ের সেলোয়ারটা একটু টেনে উপরে তুলল। পায়ের রক্ত পরা বন্ধ করতে নিজের গায়ের সাদা ক্রসিং বেল্ট টেনে খোলে শক্ত করে বাঁধল নিজের পায়ে। তারপর রাফার হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে সেটাতে নাম্বার টাইপিং করে কল মিলাল আরিফকে। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যা হওয়ায় মায়ার সেই কল কেটে যাচ্ছে বারবার। মায়া বুঝতে পারলো গুহায় ভিতরে নেটওয়ার্ক সমস্যা জনিত কল করা যাচ্ছে না। তাই মায়া এগিয়ে বসল গুহার সামনে। অল্প উঁকি মেরে মাথা বের করে গাছপালার আড়াল হতে দেখল বাহিরে কেউ আছে কিনা। আশেপাশে তেমন কাউকে দেখা না গেলেও ছেলেগুলোর খাক ছেড়ে ডাকাডাকির শব্দ কানে আসছে মায়ার। আতঙ্কিত মায়া খুবই সর্তকতার সহিত গায়ের হিজাবটা দিয়ে ফোনের আলো আটকে কল মিলাল আরিফকে। আরিফের ফোনে চার্জ না থাকায় বন্ধ পেতেই মায়া ভিষণ অসহায় বোধ করলো। বিপদের সময় ভাইকে না পেয়ে সাহসী মায়া নিঃশব্দে ঝরঝরে করে কেঁদে উঠলো। মায়ার এতো বিপদের সময় যদি আরিফকে না পায় তাহলে মায়ার মৃত্যু নিশ্চিত। কারণ একমাত্র আরিফই মায়ার আশেপাশে আছে। আর আরিফ পারবে বাস গুলো পুনরায় ফিরত এনে মায়াদের বাঁচাতে। অসহায় মায়া আর সাহস ধরে রাখতে না পেরে যখন নাক টেনে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল তক্ষুনি রাফা এগিয়ে এসে মায়াকে সাহস দিয়ে বলল…

‘ তোর ভাইয়ের নাম্বারে কল না গেলে অন্য কাউকে কল দে-না মায়া। স্যারদের কারও নাম্বার মুখস্থ পারিসতুই? পারলে দ্রুত কল দে। বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকতে পারব না আমরা। এখান থেকে উঠতে হবে আমাদের নয়তো ছেলেগুলোর হাতে ধরা পরে যাব যেকোনো সময়।

রাফার কথায় মায়া ওকে জানাল কোনো স্যারদের নাম্বার ওর মুখস্থ নেই। এমনকি নিজের ফোনটাতেও কল দিতে পারছে না জুইয়ের কাছে। কারণ মায়া নিজেই সেই ফোনের সিম খোলে রেখেছিল যাতে রিদ কল দিতে না পারে। এই অবস্থায় মায়া নিজের পরিবারের কারও কাছেও কল দিতে পারবে না, তাহলে সমস্যা আরও বাড়বে। স্যারদের কারও নাম্বারও মায়া মুখস্থ জানে না। মায়া শুধু আরিফ, জুই আর বাড়ির কয়েকটা ফোন নাম্বার মুখস্হ জানে। আর ওর স্বামীর নাম্বারটাও মুখস্থ জানে। এক মিনিট মায়া ওর স্বামী থেকে তো এই মূহুর্তে সাহায্য চাইতে পারে ওকে বাঁচাতে? মায়ার বিশ্বাস আরিফের থেকেও দ্রুত ওর স্বামী ওকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। আজ যদি এখানে মায়ার শেষ যাত্রা হয় তাহলে ওর শেষ কথা হবে স্বামী সাথে। মায়ার ওর স্বামীর কাছ থেকেও তো ক্ষমা চাওয়া উচিত। মায়া তাঁকে অমান্য করে আজ বিপদের মুখে পরেছে। নিজেকে আর কতক্ষণ বাচাতে পারবে জানা নেই মায়ার। তবে এতোটা বুঝতে পেরেছে মায়ার মৃত্যু আজ নিশ্চিত। হয়তো আর নাও ফিরা হতে পারে আপনজনদের মাঝে। চারপাশে জঙ্গি আর পাহাড়ি ডাকাতের উৎপাত। যেকোনো সময় মায়ারা ধরা পরে যাবে। এর আগে মায়াদের এখান থেকে বের হতে হবে। আর এখান থেকে বের হওয়ার আগে মায়া শেষবারের মতোন নিজের স্বামী সাথে একটু কথা বলতে চাই। ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রিদের নাম্বারে কল লাগাল মায়া। অল্প সময় নিয়ে রিদের ফোনে রিং হতেই মায়া মুখে হাত চেপে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো। রাত তখন ১১ঃ৫০ ঘরে। রিদ কফি হাতে ফাইল চেক করছিল কাপে চুমুক দিতে দিতে। সে মূলত রাত একটা ফ্লাইটে যাবে দুবাই ব্যবসায়ী কাজে। সেজন্য একদম পরিপাটি রেডি হয়ে হাতে কাজগুলো সারছিল। রিদের উপস্থিতি তার রুমেই ছিল। বিগত দিনে মায়ার খোঁজ খবর রিদের কাছে ছিল। রিদ জানতো তার বউ বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছে আজ দশদিন হলো। রিদের সাথে মায়ার যোগাযোগ না থাকলেও সেখানকার ছেলেপেলে গুলো রিদকে তার বউয়ের খবরাখবর দিয়ে থাকতো। কিন্তু বিগত তিনদিন ধরে রিদের কাছে মায়ার খবর তেমন একটা ছিল না তার কারণ রিদ আজ সন্ধ্যায় ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশ এসেছিল। এখন আবার দুবাই যাবে। সে মূলত ইন্ডিয়া থেকেই দুবাই চলে যেত কিন্তু তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল রি-চেকের জন্য বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে টিকেট করতে হয়। সেই সন্ধ্যার পর থেকে রিদ ফ্রেশ হয়ে নিজের ফাইল গুলোই রি-চেক করছিল। এরমাঝে আননোন নাম্বার থেকে কল আসায় রিদ ফাইল থেকে এক পলক দৃষ্টি উঠিয়ে ফোনে চোখ বুলিয়ে পুনরায় নিজের কাছে মনোযোগ হলো। অপরিচিত নাম্বার তার কখনো রিসিভ করা হয়না। তাই মায়ার কলটিও স্বাভাবিক নেয় রিসিভ করার হলো না। কিন্তু পরপর একই ভাবে একই নাম্বার থেকে অনবরত কল আসার রিদ বিরক্ত হয়ে হাতের ফাইল আর কফিটা রেখে দিল টেবিলে, বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কানে তুলতেই মায়ার ফুপানোর শব্দে রিদের মস্তিষ্ক টনক নড়ে উঠলো। সে বুঝতে পারলো এই অসময়ে তার বউ কল করেছে। বৈদ্যুতিক শকট লাগার মতোন রিদের শরীরে রক্ত টগবগিয়ে উঠলো মায়ার ভয়ার্ত কান্নায়।৷ রিদ অস্থির গলায় মায়াকে শুধালো…

‘ জান! জান কি হয়েছে কান্না করছো কেন? কোনো সমস্যা?

রিদের আদুরে গলায় ঝরঝরে কেঁদে উঠলো আতঙ্কিত মায়া। এতক্ষণ সাহসী নারী হয়ে থাকলেও রিদের আদুরে গলায় ভিষন দূর্বল হয়ে উঠল মায়া। নারী তার শখের পুরুষের কাছে এমনই দূর্বল হয়। প্রমাণ মায়া নিজেই..

‘ আমাকে বাঁচান নেতা সাহেব! আমি মনে হয় আর আপনার কাছে ফিরতে পারব না। আমি আপনার কথা শুনেনি, অবাধ্য হয়েছি, সেজন্য ভাগ্যও আজ আমাকে আপনার কাছে ফিরতে দিচ্ছে না। আপনার সাথে আমার আর এক জনমের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা অপূর্ণ রয়ে গেল। আমি মরে যাব নেতা সাহেব। ওরা আমাদের বাঁচতে দিবে না।

মায়ার হিচকি তোলা কান্নার দারুণ খুবই ফিসফিসে কানে বাটন ফোনটি চেপে রিদকে উক্ত কথা গুলো বলল মায়া। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিস্তব্ধতায় মায়া অল্প স্বরে কথা গুলোও যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারবার। আতঙ্কিত মায়া ফোনের আলোটাও গায়ের হিজাবটা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে ভয়ে যাতে আলোটা বাহিরে না যায়। রিদ মায়ার আতঙ্কিত স্বর আর ভাঙ্গা গলার কথায় বুঝতে পারলো পরিস্থিতি ঠিক নেই। তার বউ ভালো নেই। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা ঘরে। রিদের উপস্থিতি ঢাকা আর মায়া চট্টগ্রামে। মায়ার কি হয়েছে সেটাও জানে না সে। রিদ কিছু বলবে তার আগেই মায়া আবারও একই ভঙ্গিতে ফুপিয়ে উঠে কান্নায়। রিদ খৈ হারায়। মন মেজাজ দুটোই হারিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। মায়া শুনতে পায় ফোনের অপাশের রিদের স্ব-চিৎকার। সেই সাথে ভাংচুরের তান্ডব। মায়া আতঙ্কিত হতেই রিদের চিৎকার ভেসে আসে ফোনের অপাশ থেকে…

‘ রিত! এই রিত? কই আছিস তুই? লোকেশন বল?

মায়া ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মুখে কাপড় চেপে বলতে চাইলল…

‘ আমি জানি না কোথায় আছি! আশেপাশে কিচ্ছু চিনি না। ওরা আমাদের খোঁজছে! ওরা! ওরা পাহাড়ি জঙ্গি! আমাদের মেরে ফেলতে চাই প্লিজ আপনি আমাদের বাঁচান! আমি মরতে চাই না। আমার আপনার সাথে এখনো সংসার করা হয়নি! আপনার জন্য বউ সাজা হয়নি। আপনাকে নিয়ে এক জনমের স্বপ্ন বুনা বাকি। আমাদের বাঁচান নেতা সাহেব প্লিজ। আমি আপনাকে ছেড়ে মরতে চাই না। প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন!

চলবে…..

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৭
মায়া ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মুখে কাপড় চাপল। ফিসফিসিয়ে বলতে চাইলল…

‘ আমি জানি না কোথায় আছি! আশেপাশে কিচ্ছু চিনি না। ওরা আমাদের খোঁজছে! ওরা! ওরা পাহাড়ি জঙ্গি! আমাদের মেরে ফেলতে চাই প্লিজ আপনি আমাদের বাঁচান! আমি মরতে চাই না। আমার আপনার সাথে এখনো সংসার করা হয়নি! আপনার জন্য বউ সাজা হয়নি। আপনাকে নিয়ে এক জনমের স্বপ্ন বুনা বাকি। আমাদের বাঁচান প্লিজ নেতা সাহেব। আমি আপনাকে ছেড়ে মরতে চাই না। প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন!

মায়ার কান্নায় রিদের মন অস্থির হলো। ছটফটে ব্যাকুল হলো মস্তিষ্ক। হুট করেই যেন রিদ বুঝতে পারলো তার বউকে ছাড়া সে একেবারেই অচল। এই মেয়ের কিছু হবে ভেবেই যেন তাঁর নিশ্বাস আঁটকে আসছে। আল্লাহ না করুক তার বউয়ের কিছু হলে? এর এ-র বেশি ভাবতে পারলো না রিদ। নিশ্বাস আঁটকে আসার মতোন থমকে দাঁড়ালো। বলিষ্ঠ হাত জোড়ায় কম্পন অনুভব করলো মূহুর্তে। রিদ নিজের সেই কম্পিত হাতের দিকে তাকাল। ডানহাতটা রক্তে ছুপছুপ। হয়তো তখন টেবিলের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলার মধ্যে ধারালো কিছুতে লেগে কেটে গেছে। তাজা রক্তে ব্যথা তার অনুভব হলো না, বরং ভিষণ ভাবে বুক কাঁপলো, কলিজা নড়ছে বউয়ের বিপদের কথা শুনে। রিদের এতোদিন মনে হতো বউকে শুধু সে পছন্দ করে, রিদ চাইলে ঠিকঠাক সংসার করার মতোন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার পুরো দুনিয়া ঘুরে এই মেয়ের আগে-পিছু। এই মেয়ের শূন্যতা সে নিতে পারবে না। রিদের স্বাধ্যের বাহিরে বউকে হারিয়ে বাঁচা। অস্থির, উত্তেজিত রিদের কন্ঠে স্বর কমে আসল অসহায়ত্বে, এই প্রথম মনে হলো রিদ অসহায়। ভিষণ ভাবে অসহায় এই নারীর সামনে। তার ক্ষমতা, টাকা পয়সা কিচ্ছু কাজে দিচ্ছে না। সে পারছে বউকে সেইফ করতে। অস্হির রিদ ব্যাকুলতা চেপে ধীর গলায় মায়াকে শুধাল…

‘ জান! জান! রিলাক্স! এইতো আমি আছি। কিছু হবে না তোমার। শুধু একবার ঠান্ডা মাথায় বলো তুমি কোথায় আছো? আশপাশটা চেনার চেষ্টা করো জান।

রিদের নরম স্বরের পিছনে তীব্র অস্থিরতার ঠাহর করতে পারলো না ফোনের ওপাশের থাকা মায়া। বরং একই ভাবে ফুঁপানো গলায় মায়া বলল…

‘ আমি জানি নাতো কোথায় আছি। আশেপাশে কিচ্ছু চিনতে পারছি না অন্ধকারে। আমাদের কলেজ বাস আমাদের রেখে চলে গেলো অনেক আগেই। বিগত দু-ঘন্টা ধরে আমি আর আমার এক ফ্রেন্ড এই পাহাড়ের মাঝে দৌড়াচ্ছি জঙ্গি ছেলেদের হাত থেকে বাঁচতে। এখন আর দৌড়ানোর শক্তি নেই নেতা সাহেব। আমরা দুজনই আহত। পাহাড়ের একটা গুহায় লুকিয়ে আছি। আর কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারব জানি না। আশেপাশে জঙ্গি ছেলেগুলো আমাদের খুঁজছে। ধরতে পারলে সবশেষ। ইজ্জত আর আপনাকে দুটো হারাব নেতা সাহেব। প্লিজ আমাদের সেইভ করুন প্লিজ। প্লিজ!

মায়ার আকুতি কথায় রিদের মেজাজ খারাপে রক্ত টগবগিয়ে উঠলো রাগে রি রি করে। সে পারছে মায়াকে চিবিয়ে খেতে। তাঁর না করার শর্তেও মায়ার ট্যুরে যাওয়ার বিষয়টা রিদের মেজাজ খিচাল। হাতের কাছে থাকা কফির মগটা স্বজোড়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারতে মারতে চিচাল রিদ।

‘ কই গিয়েছিলি তুই আমাকে না বলে? রিত! রিত! তুই আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস। যদি তোর কিছু হয় আমি সবশেষ করে দিব রিত। আমা…

রিদের বাকি কথা গুলো শেষ করার আগেই টুট টুট শব্দ করে মায়া কলটি কেটে যেতেই রিদের পাগলামো আরও বাড়ল। রিদ বুঝতে পারছে তার বউ খারাপ কোনো জঙ্গির হাতে পরেছে। রিদ মন মস্তিষ্ক অচলে কম্পিত হাতে দ্রুত কল মেলাল মায়াকে। অথচ রাফার ফোনের ব্যালেন্স শেষ হতেই কল কেটে গেল। মায়া হ্যালো হ্যালো বলে পুনরায় সময় ব্যয় না করে রিদকে কল করতে গিয়ে বুঝতে পারলো ফোনে ব্যালেন্স না থাকার বিষয়টি। বিপদজনক অবস্থায় মায়াকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তার আগেই উচ্চস্বরে মুঠোফোনটি ভেজে উঠলো অন্ধকার নিস্তব্ধতা কাটিয়ে। ফোন সাইলেন্ট না থাকায় সেই শব্দ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়তেই মায়া তাড়াহুড়ো করে কলটি রিসিভ করে কানে তুলতেই শুনা গেল আশেপাশের জঙ্গি ছেলেগুলোর মাঝে হৈচৈ। মায়ার ফোনের শব্দে তাদের কানে ততক্ষণে পৌঁছে গেল। এবং সেই শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলেগুলো একত্রে হয়ে খোঁজ করলো মায়াদের। ভাগ্য খারাপ হওয়ায় মায়া রিদের কল রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই গুহার বাহিরের উপস্হিত পেল সেই ছেলেগুলোর। আতঙ্কিত মায়া রিদের ফোনটি রিসিভ করেও চুপ করে রইলো ভয়ে। জড়সড় অবস্থায় গুহার ভিতরে সিটিয়ে বসতেই ফোনের ওপাশে রিদের অস্থির অনবরত ডাকাডাকি শুনতে পেল। মায়া রিদের ফোন দু’হাতে মুঠোয় চেপে চুপ করে যেতেই গুহার বাহিরে জঙ্গি ছেলেগুলোর হৈচৈয়ের কথা শুনা গেল। ঝরঝরে চট্টগ্রামের ভাষায় বলতে শুনা গেল একে অপরকে…

‘ এই খোঁজ! খোঁজ! ফোনের আওয়াজটা এদিকটায় থেইক্কা আইছে। মাইয়া দুইডা মনে হয় আশেপাশেই কোনোখানে লুকাইয়া আছে। তাড়াতাড়ি খোঁজ। শালী দুইডারে পাইলে জীবনের কষ্ট দিইয়া মারুম।

মারুফ নামে ছেলেটির কথায় তৎক্ষনাৎ শ্রায় জানাল তিতাস নামের হ্যাঙলা পাতলা ছেলেটি। মায়ার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে লাগল…

‘ হ ভাই! নতুন মাইয়াডারে একটু বেশি কষ্ট দিতে হইব। হেতি আমাগো শাফিনের অবস্থা খারাপ কইরা দিছে। হের মাথাডা ফাটাইয়া ভাগ ভাগ করে দিছে। এই মাইয়া বহুত চালাক। আমাগো এতো দৌড়ের উপরে রাখছে এই মাইয়াডাই।

‘ এই শালীরে আগে ধরমু সবাই মিলে। কষ্ট কারে কই সব আজকে রাতেই বুঝবো। এই শালী আশেপাশেই কোনোখানে লুকাইয়া আছে। তোরা তাড়াতাড়ি খোঁজ
আবার পালাইবার আগে।

ছেলেগুলো চিল্লাচিল্লি কথা ফোনের ওপাশের রিদের কানেও পৌঁছাল। এই প্রথম আতঙ্কে রিদের বুক কাঁপল থরথর করে। মনে হলো রিদের দুনিয়ার ঘুরছে, থমকে যাওয়ার মতোন রিদের দুনিয়াটা শেষ হয়ে যাবে মূহুর্তে। রিদ তার কিছুই করতে পারবে না। তার বউ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আর রিদ ঢাকায় নিজের বাড়িতে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌছাতে রিদের যতোটা সময় লাগবে ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তাঁর বউকেও চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। হারানো ভয়ে রিদের সমস্ত কায়া নাড়িয়ে কেঁপে উঠলো শরীর। দূর্বলতায় শরীরের শক্তি খুইয়ে পরতেই পাশের টেবিলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। ফোনটা কানে চেপে কম্পিত স্বরে রিদ বলল…

‘ আমার জন্য নিজেকে কিছুক্ষণ সেইফ রাখতে পারবে বউ? ওয়াদা করছি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাব না তোমাকে। তোমার জামাই সুপারম্যান হয়ে হলেও পৌঁছাবে তোমার কাছে। শুধু একটুখানি রক্ষা করবে নিজের জান?

রিদের দূর্বলতার ভাষা মায়ার কান্নার কারণ হলো। অসাবধানতার বশে ফের ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই বাহিরের ছেলেগুলো ঠাহর করতে পারলো মায়াদের উপস্থিতির ঠিকানা। হৈচৈ ছেলেগুলো গুহার সম্মোহে আসতেই মায়া রিদের কথা উত্তর করার আগেই আতঙ্কে ফোন হাতে নিয়েই অপর হাতে রাফা হাতটা চেপে গুহার ভিতরের পথে হামাগুড়ি দিয়ে প্রাণপূর্ণ দৌড়াল বাহিরের রাস্তায়। ততক্ষণে ছেলেগুলো বন্ধ গুহার মুখ খুলল মায়ার ঢেকে দেওয়া গাছপালা টেনে সরিয়ে। হামাগুড়ি দিয়ে বসে সবার ফোনের আলো গুহার ভিতরের ফেলতেই দেখল মায়া রাফাকে নিয়ে গুহার ভিতরের পথে চলে যেতে। হৈচৈয়ের চিৎকারের মারুফ ছেলেটি আগে চেঁচাল। সবার উদ্দেশ্যে বলল…

‘ এইতো শালী দুইডারে পাইছি। এইবার যাইব কই? ধরা তো পড়বোই।এই তিতাস তুই পলাশরে নিইয়া গুহার ভিতরে ঢোক। আর আমি, রাসেল, সুজন, রতন, মানিক এই গুহার শেষ মাথায় গিইয়া দাঁড়াই। শালী দুইডা বাইর হইলেই কেল্লা ফতে। এই চল চল সবাই। মাইয়া দুইডা বাইর হইবার আগেই ধরতে হইব।

মারুফ ছেলেটির কথায় তৎক্ষনাৎ তিতাস আর পলাশ নামক ছেলেটি গুহায় ঢুকল মায়াদের পিছন পিছন। বাকি ছেলেগুলোও অন্ধকার রাস্তা দৌড়াল গুহার শেষ রাস্তার দিকে। যেটা দিয়ে মায়াদের বের হওয়ার কথা। চারদিক থেকে বিপদে ঘিরা মায়া তখনো প্রাণপূর্ণ চেষ্টা করছি দ্রুত বের হতে। এই গুহার যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ বিপদ। আতঙ্কিত মায়া, রাফা অনুভব করলো ওদের পিছন পিছন জঙ্গি ছেলেগুলোও প্রবেশ করেছে গুহায়। বাঁচতে হলে ওদের এই মূহুর্তে কি করতে হবে জানা নেই। তবে মায়া যেকোনো বিনিময়ে নিজের ইজ্জত খইয়ে মরতে চাই না। মরার হলে সে এমনই মরবে। মুঠোফোনে রিদের কলটি অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যথেষ্ট নেটওয়ার্কের সংযোগ না থাকায়। রিদ মায়াকে বারবার কল দিবে সেটা মায়া জানে। কিন্তু মায়ার কিছুই করার নেই। এই মূহুর্তে মায়া প্রাণ বাঁচানো দায়ে দৌড়াচ্ছে না বরং ইজ্জত খুয়ানো ভয়ে পালাচ্ছে। ভাগ্যক্রমে গুহার শেষ মাথায় আসতেই মায়া দেখলো এই গুহার দুটো সরো পথ দু’দিকে চলে গেল। প্রথম অবস্থায় মায়া বুঝল না ডানদিকে যাবে নাকি বামদিকের রাস্তায় যাওয়া উচিত। সময় নষ্ট না করে অনবরত আল্লাহ নাম নিতে নিতে ঘুরে গেল বামের রাস্তায়। ভাগ্য সহায় হওয়ায় সেইফলি গুহার থেকে বের হতেই দেখল ওদের থেকে অনেক দূরে গুহার অপর মুখে সবাই উৎপেতে দাঁড়িয়ে মায়া-রাফাকে ধরতে। আতঙ্কিত রাফা কিছু বলবে তার আগেই হঠাৎ পায়ে টান অনুভব করতেই দাঁড়িয়ে থাকা রাফা উল্টে পরলো মাটিতে। রাফার চিৎকারে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো মায়াদের দেখতে পেয়ে হৈচৈয়ে এইদিকটায় দৌড়ালে, মায়া দ্রুত রাফাকে টেনে ধরতে চেয়ে বুঝতে পারলো গুহার ভিতরে থাকা তিতাস ছেলেটি রাফার পা আঁকড়ে ধরে আছে যেতে না দিয়ে। তাড়াহুড়োর মায়া কি করবে বুঝতে না পেরে হাতে কাছে যা পেল তাই ছুড়ে মারলো গুহার ভিতর। পাহাড়ি লাল বালু মুঠো ভরতি নিয়ে অনবরত ছুঁড়ে মারায় মূহুর্তে চেঁচাল তিতাস আর পলাশ নামক ছেলে দুটো। মায়ার হঠাৎ বালুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না তারা। নিজেদের চোখ বাঁচাতে রাফার পা ছেড়ে দিতেই মায়া রাফাকে টেনে তুলে ফের দৌড়াল পাহাড়ের উঁচু পথে। বেখেয়ালি মায়া রাফাকে বাঁচাতে গিয়ে তাড়াহুড়ো হাতের ফোনটা সেখানে ফেলে আসল। কিছুটা পথ দৌড়াতে দৌড়াতে কানে আসল ফোনের রিংটোনের শব্দ। আতঙ্কিত মায়া পিছন ঘুরে দেখল গুহার সামনে অল্প আলোয় ফোনটি বাজছে। হয়তো রিদের কল এসেছে। কিন্তু ফিরে গিয়ে ফোনটা তুলে আনার সুযোগ মায়ার আর ছিল না। ততক্ষণে মায়ার পিছনে জঙ্গি ছেলেগুলোও ছুটছিল। অসহায় মায়া হু হু শব্দ কেঁদে উঠলো। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে মায়ার শুধু রিদের কথায় মনে পরছে। মনে হচ্ছে এই যাত্রায় মায়া বেঁচে যাক। জীবন একটা সুযোগ দিক মায়াকে ওর স্বামীর কাছে ফিরে যাবার। মায়া কতো স্বপ্ন জীবনকে নিয়ে। আজ যেন সব শেষে পথে লাগছে এই অন্ধকার পাহাড়ের পথে দৌড়িয়ে। উদ্দেশ্য বিহীন মায়াদের দৌড় শেষ হলো উঁচু পাহাড়ের শেষ প্রান্তে এসে। এখান থেকে এগোনোর পথ শেষ। সামনে মরণের গহীন খনন। পিছনে জঙ্গির আতঙ্ক। ওদের ফিরে যাবার পথ বন্ধ। এখান থেকে ঘুরে দৌড়াতে চাইলে ততক্ষণে ধরা পরে যাবে জঙ্গি হাতে। মায়া রাফা দুজন হা করে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে একে অপরের দিকে। দুজনের চোখেই আতঙ্ক, ভয় আর অশ্রু। এরপর কি হবে দুজনই জানে। এখান থেকে লাফ দিলে মৃত্যু নিশ্চিত। আবার দাঁড়িয়ে থাকলেও জঙ্গি হাতে ইজ্জত খইয়ে অসম্মানজনক মরতে হবে এটাও নিশ্চিত। দুইদিক থেকেই ওদের মৃত্যু নিশ্চিত। পার্থক্য শুধু পাহাড় থেকে লাফ দিলে সম্মানের সহিত মরবে আর প্রাণের ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে জঙ্গিদের হাতে অসম্মানের সহিত ইজ্জত খইয়ে মরবে। দূর্বল শরীরের দুজনের আঁকড়ে ধরা হাত গুলো অনবরত কাঁপছে। পিছন ছেলেগুলোর হৈচৈয়ের চিৎকার মায়া রাফা দুজনই ভয়ে, আতঙ্গে পিছনে তাকাল। ছেলেগুলো অনেকটা কাছে চলে এসেছে। যা করার মায়াদের এক্ষুনিই করতে হবে। মায়া যখন পাহাড় থেকে লাফ দিবার মনোস্থির করছিল তক্ষুনি আতঙ্কিত রাফা কাঁদতে কাঁদতে আকুতি স্বরে বাঁচার আহাজারি করে বলল…

‘ আমি পারব না মায়া। আমাকে দ্বারা হবে না এখান থেকে লাফ দেওয়া। আমি মরতে চাইনা মায়া। আমি বাঁচতে চাই। আমার ভয় করছে।

রাফার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরার মতোন মায়া তাকাল রাফার দিকে। একই কান্না মিশ্রিত কম্পিত স্বরে বলল…

‘ এর থেকে উত্তম আর সহজ মৃত্যু আমাদের আর হতে পারবে না রাফা। পিছনে দশটা ছেলে আছে তাদের হাতে ধরা পরা মানে বুঝিস? তাদের ভোগের কারণ হবো আমরা। তারপর তীব্র যন্ত্রা দিয়ে মারবে। এর থেকে ভালো মরতে যখন হবেই তখন ইজ্জত বাঁচিয়ে আগেই মরে যায়।

‘ আমি পারব না মায়া। প্লিজ আমাকে বাঁচা, আমি মরতে চাই না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। তোর তো অনেক সাহাস। চল আবার দৌড়ায় তারপরও লাফ দিতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই।

রাফার বাঁচার তীব্র আকুতিতে মায়ার কান্না বাড়লো। মরতে কে বা চাই? মায়া চাই মরতে? নিশ্চিত মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়ে রাফার যেমন বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে এরথেকে বেশি মায়ার আকুতি কোনো ভাবে ওরা বেঁচে যাক। কিন্তু এরপর কিছুই করার নেই ওদের।
রিদের কথা মায়া স্মরণে আসতেই ঝরঝর করে চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে দূর্বল গলায় বলল মায়া…

‘ তোর থেকে বহুগুণ বেশি আমার বাচার ইচ্ছে রাফা। আমি বিবাহিত। একটু আগে যার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল সে আমার স্বামী। আমার বিপদের কথা শুনে তার পাগলামি ঠাহর আমি এখান থেকেই পেয়েছি। কাল সকালে আমরা জীবিত থাকি বা মৃত্য, আমার মৃত্য দেহটা হলেও তার কাছে পৌঁছাবে। সে আমাকে ঠিক খোঁজে বের করবে। শুধু আফসোস থাকবে তার সাথে আমার ভালোবাসার লেনদেনটা হলো না। কিছু ইচ্ছে মানুষের অসম্পূর্ণ থেকেই থাকে। আমার তোর দুজনেরই থাকবে আজ মরে গেলে। আমার তার সাথে তোর থেকে বেশি বাঁচা ইচ্ছেটা ছিল রাফা। কিন্তু বেঁচে ফিরার পরিস্থিতি আমাদের হাতে আর নেই। বর্তমানে হয় পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে জান দিতে হবে, আর নয়তো ছেলেগুলোর হাতে নিজেদের মান হারাতে হবে। অপশন দুটো। কতগুলো পাহাড়ি জঙ্গি কুকুরের ভোগবিলাসের কারণ হওয়ার চেয়ে, এখান থেকে লাফ দিয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। মরতে যখন হবেই তখন ইজ্জত নিয়েই মরবো, চল।

মায়া রাফার হাত টেনে ধরতেই রাফা ভয়ে আরও কাঁদতে লাগল। উপস্থিত মৃত্যু সামনে দেখে কেই বা মরতে চাই। বয়সে দুজনই ছোট। সতেরো বছরের কিশোরী। তাদের দুনিয়াটায় হচ্ছে রঙ্গিন। বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা নেই। উড়ুচন্ডি মনে রঙ্গিন স্বপ্ন চোখে সবকিছুই ভালো লাগে। এই বয়সে মেয়েরা রঙ্গিন দুনিয়ার বাঁচার আকাঙ্ক্ষার বহুবছরের দেখে। সেখানে হুট করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার বুকফাটা আর্তনাদের কারণ। মায়া বুঝানো রাফার কাজে দিল না। সে মূলত মরতে চাই না বাঁচতে চাই। কিন্তু কিভাবে বাঁচবে জানা নেই। মায়া একহাত সে নিজের দু’হাতে চেপে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের শেষ পিষ্টে। বাঁচা মরার টানাটানিতে ততক্ষণে ছেলেগুলো মায়াদের ছুঁই ছুঁই। দশবারো কদম দৌড়ালেই হাতের লাগালে। কিন্তু এই অবস্থায় মায়া রাফাকে নিয়ে লাফ দিতে পারছে না। কারণ রাফা নিজে যেমন লাফ দিচ্ছে না তেমনই মায়াকেই দিতে দিচ্ছে না। শক্ত হাতে মায়াকে চেপে আছে। জোড়াজুড়িতে মায়া ভিষণ আতঙ্কিত হলো। সামনে ছেলেগুলো হাতে একবার ধরা পরলে সবশেষ। কিন্তু রাফাকে কে বুঝাবে এসব? মায়া আবারও ঘুরে পাহাড়ের তলদেশের অন্ধকার গহীনতা তাকাল। পর মূহুর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেগুলোর অবস্থান নিজেদের কাছে ঠাহর করতে পেরেই মায়া রাফার দিকে তাকাল। এই মূহুর্তে মায়ার ইচ্ছা করছে রাফাকে দুগালে কতক্ষণ চড়াতে। মায়াকে আটকিয়ে মরার থেকে বাঁচতে পারবে এই মেয়ে? নাকি নিজেদের জন্য আরও বিপদ বাড়াচ্ছে। আতঙ্কিত মায়া কি করবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ করেই রাফার হাত কামড়িয়ে ধরলো নিরুপায় হয়ে। ভয়ার্ত রাফা ব্যথা চিৎকার করে উঠতেই সেই সুযোগে মায়া রাফাকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ লাফ দিল পাহাড়ের চূড়ায় হতে। মায়াদের লাফের সাথে সাথে আতঙ্কিত মুখে চেঁচাল বাকি ছেলেগুলো। দৌড়ে মায়াদের অবস্থানের দাঁড়িয়ে হাফাতে হাফাতে তাকাল পাহাড়ের অন্ধকার তলদেশে। ভয়ার্ত মুখে তাঁরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়িও করলো। মূলত তাদের ধারণাতে ছিল না মেয়ে দু’টো হুট করে পাহাড় থেকে ঝাপ মারবে। এই পাহাড়ি এলাকায় জায়গা জায়গা চেনা তাদের তারা হলফ করে বলতে পারবে মেয়ে দুটো এই খানে ঝাপ দিয়ে নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এদের মাঝে ছেলেগুলোর সরদার মারুফ লোকটা রেগেমেগে গালি ছুড়ল মায়াদের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ সময় দৌড়ানোতে হাফাতে হাফাতে বলল….

‘ শালী বাচ্চারা মরার আর সময় পাইলো না। এতো উঁচু থেকে পরে নিশ্চয়ই এতক্ষণে দেহ ছিঁড়ে ভাগ ভাগ হয়ে গেছে পাহাড়ী গাছের ঢালে। ফ্রীতে বনশেয়ালের খাবার হইল। তারপরও আমাদের ধরা দিল না। কু**** জাত

মোটা করে রতন ছেলেটা একই ভাবে হাফাতে হাফাতে বলল….

‘ ভাই যদি মাইয়া দুইডা না মরে এখান থেইক্কা পড়য়া?

‘ হু মরবো নাতো কি করবো? এলাকায় সবচেয়ে বিপদসংকেত এরিয়া হইল এইদিকটা। দিনের বেলায় মানুষের এই এরিয়াতে ঢোকা নিষেধ। আর রাতের বেলা মাইয়া দুইডা এতো উপর থেকে ঝাপ দিইয়া মরবো নাতো বাঁচবো তোর মনে হয়? এরপরও যদি না মরে তাইলে নিচে ঝাওবনে আমাদের থেকেও হিংস্র ডাকাত দল বাস করে। কমে হলেও তারা তিনশো বেশি হইব। আমরা দশজন মাইয়া দুইডা ভোগ করতাম। এহন তিনশো ডাকাতদল ভোগ করবো। শালার আমাদের ভাগ্যটায় খারাপ শিকার করলাম আমরা মজস লইবো অন্য কেউ ধুর। চল!
~~

বিগত তিনঘন্টা ধরে পাহাড়িয়ান রাস্তার অলিগলি ধরে পাগলের মতোন মায়াদের খোঁজ করে যাচ্ছে আরিফ, রাকিবের সঙ্গে কলেজে মায়াদের সিনিয়র কিছু ছেলেপেলে। তখন মায়া রাফার নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ত্রিশ মিনিট পর জানতে পারলো মায়া গাড়িতে নেই। জুই শ্রেয়া পাশ থেকে উঠে নিজেদের সিটে গিয়ে বসতেই দেখল মায়া নেই পাশে। মায়ার কথা মাথায় আসতেই জুই তাড়াহুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে পুরো বাসে চোখ বুলিয়ে কোথাও মায়াকে দেখতে না পেয়ে চেচামেচি করে জানাল মায়া বাসে উঠেনি। আরিফ তখন ক্লান্তিতে বাসের পিছনের সিটে বসে ঝিমচ্ছিল, জুইয়ের চিৎকারে হঠাৎ মস্তিষ্ক তড়াক করে জেগে উঠে মায়ার মিসিংয়ের ব্যাপারটা শুনে। অবিশ্বাসের মতো তৎক্ষনাৎ এগোল। মায়ার খোঁজ করে যখন পুরো বাসে হৈচৈ পরে গেল তখন বুঝতে পারলো মায়া সত্যিই মিসিং। আরিফের পুরো দুনিয়া ঘুরে উঠার মতোন চক্র কাটলো। এতোকরে বোনদের চোখে চোখে রেখেও শেষ পযন্ত বোনকে হারিয়ে ফেলল কিভাবে? আরিফ আতঙ্কিত ভঙ্গিতে চিল্লাচিল্লি করে দ্রুত বাস থামিয়ে বাকি বাসগুলোতেও মায়ার খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারে রাফা নামের আরও একটা মেয়েও মিসিং আছে বাস থেকে। রাফার বান্ধবী চৈতী জানায় সেটা। চৈতী মনে করেছিল রাফা অন্যবাসে আছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সোহানীর সাথে কিন্তু মায়ার নিখোঁজের সাথে সাথে বুঝল রাফাও গায়েব। পরপর চারটে বাসই থামে পাহাড়ি রাস্তার মাঝে। হৈচৈয়ে সকল স্যার সিনিয়ররা গাড়ি থেকে নেমে পরলো টেনশনে। এতো রাতে মেয়ে দুটো কোথায় যাবে? উনারাই বা কোথায় ফেলে এসেছে মেয়ে দুটোকে। এতো কঠোর নজরদারি পরও এতো বড়ো দূর্ঘটনার জন্য কলেজের কর্তৃপক্ষের কৈফিয়তদারী করতে হবে এরজন্য। মেয়ে দুটো সহিসালামত না পেলে থানা-পুলিশ ঝামেলা বাড়বে, কলেজের বদলাম। টেনশনে একেকজন টিচার্স ঘেমে জবজব হলো। আতঙ্কিত দেখাল একেকজনের ফেইস। সবাই ধারণা করলো লাস্ট যখন তারা খাবার হোটেলে বাস থামিয়েছিল তখন হয়তো মেয়ে দুটো সেখানে রয়ে গেছে। ধারণা অনুযায়ী তাই হলো জুই জানাল মায়া ওকে বাহিরে যাবা কথা বলে বাস থেকে নেমে ছিল তখন। তাড়াহুড়ো আরিফ বাকি টিচার্সসহ তখনকার হোটেলের মেনেজারকে কল দিয়ে জানতে চাইল তাদের হোটেলে কলেজ শিক্ষার্থী দুটো মেয়ে পাওয়া গেছে কিনা? বা আশেপাশে খোঁজ নিতে। অল্প সময়ে হোটেলের মেনেজার জানায় সেখানে আপাতত কলেজ শিক্ষার্থীদের মতোন কেউ নেই। যদি এমন কেউ তাঁরা পাই তাহলে অবশ্যই জানাবে আরিফদের। অতিরিক্ত টেনশন থেকে আরিফের মাথা চক্কর দিয়ে উঠতেই পাশ থেকে রাকিব, আর আরিফের বন্ধু দিহান ঝাপটে ধরলো আরিফকে। ধরাধরি করে আরিফকে রাস্তায় বসাতে চাইলে আরিফ অস্থির গলায় কলেজ সহকারী অধ্যাপককে বলল….

‘ আমাকে একটা টিমের ব্যবস্থা করে দিন স্যার। আমি আমার বোনকে খোঁজবো। আপনি বাকি শিক্ষার্থীদের নিয়ে আপাতত চলে যান। দরকার হলে সকালে আবার আসবেন। ততক্ষণে আমরা এইদিকে আর্মি ক্যাম্পে যোগাযোগ করছি। তাঁরা আমাদের সাহায্য করবে মিসিং কেইসে।

আরিফের কথায় সেচ্ছায় একদল ছেলে আলাদা হয়ে এগিয়ে আসল আরিফের সাহায্যের জন্য। দশ-পনেরো জনের একটা টিম হয়ে পুনরায় হোটেলের দিকে যেতে চাইলে গাড়ির সংকীর্ণতার জন্য আটকে গেল। রাত তখন ১০ঃ৫৫ ঘরে।
এতো রাতে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি খোঁজে পাওয়া মুশকিল। সেজন্য পুনরায় বাসগুলো আবারও আরিফদের নিয়ে হোটেলে রাস্তায় গেল। সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি পৌঁছালও সেখানে। সকল স্টুডেন্টর গাড়িতে লক করে তাড়াহুড়ো নামল আরিফসহ বাকি টিচার্সরা। সকলেই আশেপাশে খোজ নিয়ে দেখল সত্যি মায়াদের উপস্থিতি সেখানে কোথায় নেই।
চৌদ্দ সদস্যের টিম মেম্বারদের জন্য হোটেল থেকে টচলাইট সংগ্রহ করে সবপ্রথম আরিফ যেতে চাইল আর্মি ক্যাম্পে। সেখান থেকে আর্মিদের সাহায্যে পাহাড়ের বুকে চড়বে মায়াদের খোঁজতে। এতোকিছু মাঝে মায়ার টেনশনে টেনশনে আরিফ জুইয়ের কথা ভুলে বসল। সে বের হয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল দ্বিতীয় বোনের কথা ভেবে। তাড়াহুড়ো আরিফ চলে যেতে গিয়েও ফিরে আসল জুইয়ের কথা ভেবে। আরিফ চলে গেলে এতো রাতে একা জুইকে কার কাছে দিয়ে যাবে? মায়া নেই, আরিফ নেই, জুই এতো রাতে কার কাছে থাকবে? বাসগুলো পুনরায় মুরাদপুরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত দুটোর উপর হবে। এতো রাতে একা মেয়ে হয়ে জুইয়ের পক্ষে সম্ভব হবে না বাসায় গিয়ে একা উঠার। আবার আরিফের সঙ্গেও এতো রাতে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ওরা জানে না সামনে কি হবে? কোন বিপদ থেকে কোন বিপদে পরে তাঁরা। উত্তেজিত আরিফ এগিয়ে এসে জুইয়ের দায়িত্ব দিয়ে গেল অন্য একজন টিচার্সের কাছে। হাতজোড় করে রুকিয়া ম্যাডামকে বলে গেল তাঁর বোনকে দেখে রাখতে। অন্তত আজরাতটা জুইকে উনার বাসায় রাখতে কাল সকালে আরিফ গিয়ে নিয়ে আসবে। জুইকে সেইফলি রেখে যেতেই আরিফ সকলকে নিয়ে চলল আর্মি ক্যাম্পে। পাহাড়ের বুকে চড়তে হলে অবশ্যই তাদের ট্রেনিং প্রাপ্ত একজন ট্রেনার লাগবে। যে তাদের পাহাড়ি পথের নিদর্শনা দিবে। আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। সেটাও সংগ্রহ করলো হোটেল থেকে একজনকে। আর সেই ট্রেনারের সাহায্যে প্রথম গেল আর্মি ক্যাম্পে। মিনতি করার মতোন তাদের কাছে সাহায্য চাইলে তাঁরা জানাল সকালে আগে তারা কিছুই করতে পারবে না। এতো রাতে তাদের দ্বারা কিছু সম্ভব না। আইনি সাহায্য চাইলে আরিফদের অন্তত সকাল পযন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অসহায় আরিফ মায়ার টেনশনে সময় ব্যয় না করে আর্মি ক্যাম্প থেকে বের হয়ে একায় চলল বোনকে খুঁজতে। সঙ্গে তাদের পনেরো সদস্যের টিমটিও ছিল। বয়স্ক ট্রেনারকে নিয়ে পাহাড়ি পথের অলিগলি চলতে গিয়ে বেশ কয়েকজনে আঘাতও পেল। তাদের মধ্যে আরিফও ছিল একজন। আশাহত আরিফ বুঝতে পারলো এই রাতে কোনো আইনি সহায়তা পাবে না তাঁরা। সাধারণ মানুষের সাহায্য কেউ করতে চাই না। মায়াকে হারিয়ে প্রায় ঘন্টা তিনেক মতো চড়তে লাগল এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চূড়ায়। রাত তখন একটার ঘরে। আরিফের টিম মেম্বার যখন মায়াদের খোজাখুজিতে ব্যস্ত তখনই দেখা গেল পাহাড়ি রাস্তার বুকে ছিঁড়ে উজ্জ্বল আলোয় কতোগুলো ট্রাকে উপস্থিতি। হৈচৈ আর চিৎকারের ভয়ংকর প্রতিধ্বনি হচ্ছে আশপাশটা। পাহাড়ের উপর থেকে সবাই রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখল বেশ কয়েকটা ট্রাক একত্রে এইদিকটায় আসছে। সবগুলো ট্রাকে মাল- বা অন্য কিছু নেই। বরং ট্রাক ভরতি অসংখ্য ছেলেদের উপস্থিত। প্রত্যেকের হাতে টচ, হকিস্টিক আর দা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করছে ক্ষেপ্ত ভঙ্গিতে। কাউকে কুপিয়ে মারা তেজ। এতো কিছু মাঝে আরিফ বা ওদের টিম বুঝলো না চোখে পলকে এতোগুলা ট্রাকে, এতো মানুষ কোথায় থেকে আসল? কেনই বা আসল? এই পাহাড়ি বুকে তাদের কি কাজ? দেখতে দেখতে মূহুর্তে মাঝে সবগুলো ট্রাক রাস্তায় পরপর দাঁড় করাতেই ট্রাক সবাই হৈ-হুল্লোড় চিৎকার চেচামেচি করে লাফে নামতে লাগলো ক্ষিপ্ত ছেলেগুলো। সবার হাতে হাতে দা, হকিস্টিক আর উজ্জ্বল আলোর টচ বিদ্যমান। চোখের পলকে রকেটের গতির মতো দেখতে দেখতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো পাহাড়ের বুকে। হুট করে এতোগুলো মানুষের উপস্থিত দেখে আরিফ আশ্বস্ত হয়ে তাদের কাছে সাহায্যের জন্য এগোতে চাইল। নিজেদের গতিপথ বদলিয়ে গেল নিচে। পাহাড়ের তলদেশে নামতে নামতে দেখলো দলবেঁধে আরও অনেকটি ট্রাক উপস্থিত হচ্ছে সেখানে। সবগুলো ট্রাকেই মানুষের একই রকমের হৈচৈ আর চিল্লাচিল্লি কলরব শুনা যাচ্ছে। রাকিব বোকার মতোন দাঁড়িয়ে থেকে সবগুলো ট্রাক গুনতে চাইল। ওর ধারণা মতে না হলেও বিশটা ট্রাকে উর্ধে হবে লাইন বেঁধে চলছে একটার পর একটা। একটা ট্রাকে কম করে পঞ্চাশজন মানুষ দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় আছে তাহলে বিশটা ট্রাকে একহাজার জন মানুষ হবে। এতো মানুষ, এতো রাতে কোথায় থেকে আসল? তাঁরা এতো ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে পাহাড়ের বুকে কি খোঁজছে? রাকিবের মতো কি ওদের কেউ মিসিং নাকি? নির্জন এলাকায় হুট করে অসংখ্য মানুষের আভাস পেয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে তাড়াহুড়ো সেদিকে দৌড়ে গেল আরিফ, রাকিবসহ তাদের দল। হকিস্টিক হাতে ছেলেগুলোর কাছাকাছি যেতেই ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে প্রায় একদল ছেলে আক্রমণ করে বসল আরিফদের। উত্তেজিত পরিস্থিতিতে হুট করেই কেউ কারও চেহেরা দেখা সময় পায়নি। কিন্তু চোখে পলকে একদফা মার আরিফদের উপর দিয়ে চলে যেতেই হঠাৎ পরিচিত কন্ঠের রাহাত সবাইকে ঠেলে থামিয়ে দিতে দিতে চিৎকার করে বলল…

‘ এই দাঁড়া দাঁড়া আর মারিস না। এটা আমাদের আরিফ ভাই। উনিও হয়তো ভাবিকে খোঁজতে এসেছে আমাদের মতো। থাম! থাম! তোরা থাম।

হাতে ঠেলে সবাইকে থামাতে থামতে লাঠির আঘাত বেশ আহত হলো সবাই। টচ লাইটের আলো আরিফদের উপর পরতেই বুঝলো তাঁরা সবাই অতি পরিচিত মানুষ। আরিফ নিজের এলাকার পরিচিত রাহাত ও তাদের সঙ্গীদের দেখে উত্তেজনায় ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো খুশিতে। এই বিপদের সময় এই বুঝি মায়াকে খুজতে সবাই সাহায্য করবে ওর। আরিফ কিছু বলার আগেই রাহাত আরিফকে আশ্বস্ত করে বলল…

‘ চিন্তা করবেন না ভাই। ভাবির কিচ্ছু হবে না আমরা সবাই আছি। পুরো পাহাড় ছেঁকে হলেও ভাবিকে খোঁজে বের করবো। শুনলাম ভাবির সাথে নাকি আরও একটা মেয়ে মিসিং আছে?

রাহাত কাকে ভাবি ডাকছে তখনও বুঝল না আরিফ। আরিফের ধারণা মায়ার সাথে যে মেয়েটা আছে তাকে হয়তো রাহাত ভাবি ডাকছে। সেজন্য আরিফ রাহাত শুধিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলল…

‘ তোমাদের ভাবির সাথে আমার বোন মায়া মিসিং। প্লিজ তোমরা আমাদের সাহায্য…

আরিফকে বলতে না দিয়ে রাহাত পুনরায় বলল…

‘ আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা ভাবির জন্যই এসেছি আরিফ ভাই। ঢাকা থেকে ভাইও আসছে। ভাবিকে আমরা অবশ্যই খোঁজে পাব ইনশাআল্লাহ।

আরিফ কিছু বলার আগেই দেখল সেখানে একে একে উপস্থিত হলো, আর্মি, রেব, ফোর্সের দলবেঁধে গাড়ি লাল-নীল সিগ্ন্যাল জ্বালিয়ে। কে বা কারা আর্মি, রেব বাহিনীকে খবর দিল আরিফ জানে না। তবে এর পিছনে অবশ্যই ক্ষমতাধর কারও হাত আছে। নয়তো যেখানে আরিফ একঘন্টার মতোন সময় ব্যয় করেও একটা আর্মির সদস্যকে রাজি করাতে পারলো না ওদের সাথে আসার জন্য। সেখানে বন্দুক হাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দলে দলে আর্মি, আর কালো পোষাক দারি রেব বাহিনী চলে আসল মায়াদের খোঁজতে? আরিফ, রাকিব শুধু বোকার মতোন দাঁড়িয়ে রইল। মূলত তাঁরা বুঝতে পারছে সবাই মায়াদের খোঁজে এসেছে। কিন্তু কে এতো বিশাল ক্ষমতাধর আয়োজন করলো দুটো মানুষকে খুঁজতে? আরিফের নিজের ভিতরের কৌতূহল চেপে সবাই সাথে পাহাড়ের চূড়ায় চলল মায়াদের খোঁজে। অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্ধকার পাহাড়ি এলাকা হয়ে উঠলো দিনের আলোয় নেয় উজ্জ্বল। পাহাড়ি গাছ-গাছালিতে থেকে মানুষের কলরবের শব্দ বেশি। একত্রে হাজার হাজার মানুষের আগমনে বন পশুগুলোরও ভয়ার্ত চিৎকার শুনা গেল চারদিকে। চোখের পলকে পাহাড়ের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া আর্মি, রেব, আর রিদের পাঠানো হাজার হাজার ছেলেপেলে। দূর থেকে যে -কেউ দেখলে বলে দিতে পারবে পাহাড়ের বুকে কোনো কিছুর অভিযান চলছে জড়োসড়ো। চারদিকে শুধু আলোর মেলা। সেখানে অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্ধকার আকাশে দেখা গেল উজ্জ্বল আলোর কতোগুলো হেলিকপ্টার। এতে কে বা কারা আছে আরিফরা বাদে সবাই জানে। রাত তখন ১ঃ২৮ ঘরে। তুমুল শব্দ করে হেলিকপ্টারের পাখার রাউন্ড রাউন্ড ঘুরে নামলো পাহাড়ী উম্মুক্ত রাস্তায়। পাখার তীব্র বাতাসে উপস্থিত মানুষ হতে পাহাড়ের ছোট বড় গাছ-গাছালীর ডাল-পাতা নুইয়ে নুইয়ে পড়ছে একে অপরের গায়ে। আশেপাশে মানুষজনের দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠতে সবাই দূরে গিয়ে দাঁড়াল হেলিকপ্টার থেকে। তীব্র গমগমে শব্দে পরপর নয়টি হেলিকপ্টার নামলো একই পাহাড়ি রাস্তায়। প্রথম হেলিকপ্টার থেকে রিদের সাথে আসিফকে লাফিয়ে নামতে দেখা গেলেও বাকি আটটা থেকে বন্দুক হাতে বডিগার্ডদের লাফিয়ে বের হতে দেখল সবাই। রিদকে দেখেই আরিফ বুঝতে পারলো এসব ক্ষমতার উৎস কোথায় থেকে এসেছে। হয়তো রাফা নামের মেয়েটির সাথে রিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে ভেবেই আরিফ রিদকে নিয়ে এতো মাথা ঘামাল না। তার এই মূহুর্তে বোনকে দরকার। সেজন্য আরিফ রিদকে দেখে এগিয়ে গেল সামনে। উদ্দেশ্য রিদকে জানাবে তার বোন মায়াও মিসিং রাফার সাথে। উত্তেজিত রিদ হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে নামতেই আর্মি, রেব ফোর্সের দুজন কমান্ডার এগিয়ে আসল রিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। অস্থির, উত্তেজিত রিদের মেজাজ বুঝা দায়। হিংস্রত্ব রাগে চোখের পাটা ফুলে আছে লাল লাল হয়ে। ঘায়েল বাঘের নেয় হিংস্রত্বে গর্জন ছাড়বে যেকোনো সময়। দৃষ্টিতে সেকি তেজ কিন্তু মুখে ভাষা নিশ্চুপ। কালো শার্টের হাতাগুলো টেনে গুটাতে গুটাতে সামনে এগোতেই পিছন থেকে আসিফ একটা বন্দুক এগিয়ে দিতেই সেটা দক্ষ হাতে তুলল রিদ। ডানহাতে বন্দুক চেপে বামহাতে ট্রিগার পয়েন্ট টানতেই পথ আটকে দাঁড়াল দুজন কমান্ডার। রিদকে আশ্বস্ত করতে চাইল তারা মেয়ে দুটোকে অতি শীঘ্রয় খোঁজে পাবে। কিন্তু ক্ষিপ্ত রিদ তাদের ভালো কথায় পোষাল না তার। মেজাজ হারিয়ে দাঁত পিষে বলল…

‘ আশেপাশে, যেখানে যাকে পাবেন সবাইকে বন্দী করুক। ছোট, বড়ো, ছেলে-বুড়ো, চোর, ডাকাত, জঙ্গি, সন্ত্রাস যাকে পাবেন, আমার সবাইকে বন্দী চাই। এই রাতে পাহাড়ের বুক থাকা একটা মানুষও যাতে পালাতে না পারে সেটা সিউর করুন। আমার সবাইকে মানে সবাইকে বন্দী চাই গড ইট?

‘ হয়ে যাবে মিস্টার খান। আপনি…

‘ রিদ ভাই!

কমান্ডারের কথা শেষ করার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো আরিফ। উত্তেজনায় কমান্ডারের কথা মাঝেই কথা বলে ফেলল রিদকে ডেকে। রিদের খিঁচে থাকা মেজাজ তড়াগ করে তপ্ত আগুনের নেয় জ্বলে উঠলো আরিফের উপস্থিতি দেখে। মেজাজ হারিয়ে মূহুর্তে মাঝে হিংস্র বাঘের নেয় থাবা বসাল আরিফের শার্টের কলারে। চোখের পলকে কারও কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই পরপর শক্ত হাতে ঘুসি পরলো আরিফের নাকে মুখে। উপস্থিত সবাই থমথমে খেয়ে গেল রিদের হঠাৎ কান্ডে। আসিফ দ্রুত সবাইকে ঠেঙ্গিয়ে রিদকে ঝাপটে ধরলো আরিফকে আঘাত করা থেকে। একা আসিফ রিদকে সামলাতে মুশকিল হতে দেখে পরপর সঙ্গে সঙ্গে আরও দুজন কমান্ডার এগিয়ে এসে রিদকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো আরিফ থেকে ছাড়াতে। টানাটানি করে আরিফ হতে রিদকে ছাড়িয়ে নিতেই ভয়ংকর মেজাজে চেঁচাল রিদ। আরিফকে উদ্দেশ্য করে ফের ত্যাড়ে যেতে চেয়ে গর্জে উঠে বলল…

‘ হারামির বাচ্চা তুই থাকতে আমার বউ হারাল কিভাবে? বোনকে যদি দেখে রাখতে না পারিস তাহলে দায়িত্ব নিতে গেলি কেন? তোকে কে বলেছে আমার বউকে ট্যুরে নিয়ে আসতি? আমার পারমিশন নিয়েছিলি?

আহত অবস্থায় পুনরায় রিদের আঘাত পেয়ে নুইয়ে পরলো আরিফ। রিদ কেন আরিফকে হঠাৎ আক্রমণ করলো বুঝল না সে। রিদের সাথে আরিফদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে সেই সুবাদে রিদ আরিফকে আঘাত করার কথা নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আরিফ রিদ খানের বউকে চিনে না পযন্ত।
তাহলে সেখানে আরিফ অন্য কারও বউকে ট্যুরে নিয়ে আসবে কিভাবে? আরিফ শুধু তার বোনদের দায়িত্বে ছিল। আর এরজন্য সে কারও থেকে পারমিশন নিবে না অবশ্যই। নুইয়ে পরা আরিফ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বামহাতে ঠোঁটের আঘাতের রক্তটা পরিষ্কার করতে করতে তাকাল রিদের হিংস্র চেহারার দিকে। রিদের বন্দুকের ট্রিগার দিয়ে আঘাত করায় বেশ কেটেছে আরিফের ঠোঁট। আরিফ ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে রিদকে বুঝাতে চেয়ে বলল…

‘ আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে ভাই। আমি আপনার ওয়াইফকে চিনি না। আমি শুধু আমার বোনের মিসিং কেইসটা আপনাকে জানাতে এসেছিলাম। আমার ছোট বোন মায়াকে তো আপনি চিনেন। ওহ আপনার বউয়ের সাথে মিসিং। আমাদের ধারণা ওরা হয়তো এই পাহাড়ি এলাকায় কোথাও আঁটকে আছে।

আরিফের ভদ্র কথায় রিদের মেজাজ যেন খারাপ হতেই থাকল। তার বউ হারিয়ে গেছে আর এখনো আরিফ বালে ভদ্রতা দেখাচ্ছে। সে যদি তার বউকে সহিসালামত না পাই তাহলে সবার আগে এই ছেলেই মারবে সে ট্রিগার পয়েন্ট রেখে। রিদ গর্জে উঠে ফের আরিফের দিকে তেড়ে যেতে চাইলে একই ভাবে বাঁধা দেয় আসিফ আর বাকি দুজন কমান্ডার। রিদ তেতে উঠে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে বলল…

‘ তোর বালে ধারণা আছে ভদ্রলোকের বাচ্চা। তুই জানিস তোর বোন কই আছে? সে পাহাড়ি জঙ্গি ছেলেদের হাতে পরেছে। এতক্ষণে কি হয়েছে তাদের সাথে সেই ধারণা আছে তোর? করতে পারবি?

রিদের কথায় আরিফ অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো….

‘ কিহ? আপনাকে এসব কে বলেছে?

‘ তোর বোনের ফোন এসেছি সে জানিয়ে সবটা। আরিফ দোয়া কর তোর বোনের যাতে কিছু না হয়। যদি কিছু হয় তাহলে তোকে আমি ছাড়বো না।
~~
রাত প্রায় শেষে দিকে। সময় তখন ৪ঃ২১ মিনিট। পুরো পাহাড়ি এলাকায় এতো অভিযান চালিয়েও মায়াদের খোঁজের সন্ধান পেল না কেউ। এমনকি মায়াদের তাড়ানো তখনকার সেই দশজন জঙ্গি ছেলেগুলোও ততক্ষণে আঁটকে পরেছে আর্মিদের হাতে। কিন্তু জানের ভয়ে তাঁরা কেউ মুখ খুলছে না পযন্ত। আর না এটা বলছে মায়াদের তাঁরা হোটেল থেকে তুলে এনেছিল। রিদের কথা মতো পাহাড়ের বুকে যাকে পেয়েছে সবাইকে বন্দী করেছে আর্মি, আর রেব ফোর্স। এমনকি মায়াদের তখন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পরা বিপদজনক এরিয়াতেও রেব বাহিনীর অভিযান চালিয়ে তিনশো ডাকাত দলকে আঁটুক করেছে মায়াদের খোঁজে। বিগত চার-পাঁচ ঘন্টার অভিযান চালিয়েও দুটো মেয়ের খোঁজ কেউ দিতে পারলো না। আর না জঙ্গি ছেলেগুলো জানে ভয়ে মুখ খুলে জানাচ্ছে মায়াদের পাহাড় থেকে লাফিয়ে পরার বিষয়টি। আটকে রাখা সবার সাথে তাঁরাও কিছু জানে না বলে অজানা সাজল। জঙ্গি ছেলেগুলোর ধারণা এতো উপর থেকে মেয়েগুলো ঝাপ দিয়ে অবশ্যই মরে গেছে এতক্ষণে। সেখানে মৃত্য মেয়ে দুটো এসে বলবে না তাদের পিছনে কারা লেগেছিল তখন। জঙ্গি ছেলেগুলো যদি এই মূহুর্তে চুপ থাকে তাহলে অবশ্যই প্রাণে বেঁচে যাবে সবার। আর নয় পরিস্থিতি যে গরম দেখছে একবার ধরা পরলে প্রাণ থাকবে না কারও। ভয়ার্ত মুখে সকলে বারবার একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। বুঝতে পারলো মেয়ে দুটো কোনো সাধারণ কেউ ছিল না। ওরা ভুল জায়গায় হাত দিয়েছিল। চারদিকে না পাওয়ার ব্যর্থতা সুর শুনতে শুনতে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ হয়ে গেল রিদ। মন মস্তিষ্ক টনটন করছে তপ্ত দহনে। বউকে না পাওয়ার ব্যর্থতা তাঁকে ঘায়েল করছে ক্ষণে ক্ষণে। এতো ফোর্স লাগিয়েও বউকে খোঁজে না পাওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করে তার বউ সহিসালামতে আর নেই। দূর্বল শরীরে রিদ মাথা ঘুরিয়ে খৈ হারিয়ে পরতে নিলেই পিছনের ছেলেগুলো হৈচৈ করে ধরলো রিদকে পরা থেকে। ততক্ষণে রিদ জ্ঞান হারাল। সবাই ধরাধরি করে ক্যাম্পে দিকে নিয়ে যেতেই সেখানে সারি সারি ভাবে দেখা গেল আরও কিছু গাড়ি ও পুলিশ ফোর্সের উপস্থিতি। ছেলের খবর শুনে মন্ত্রী নিহাল খানও শেষ রাতের দিকে উপস্থিত হয় সেখানে। সিকিউরিটি আরও বাড়িয়ে দিয়ে রিদের খোঁজ করলো। রিদকে তাবুতে দূর্বল অবস্থায় বেহুশ হয়ে পরে থাকতে দেখে আতঙ্কে বসল রিদের পাশে। উনার এতো বলিষ্ঠবান ছেলেকে কখনো দেখেনি দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারাতে। আজ প্রথম দেখল উনার ছেলে জ্ঞান হারিয়েছে। বাবার মনটা যেন হু হু করে উঠলো রিদের টেনশনে। ডাক্তার ব্যবস্থা ছিল তাবুতে। পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালাতে গিয়ে যদি কেউ আহত হয় তাহলে তার সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল আসিফ। নিহাল খান রিদের পাশে বসতেই আরিফ সবটা জানাল তাঁকে, কেন তাঁরা এখানে এসেছে। মায়াকে নিয়ে সবকিছু না বললেও এতোটা জানায় রিদের সাথে মায়ার একটা হালাল সম্পর্ক আছে। চতুর দাম্ভিক নিহাল খানকে আর কিছু ভেঙ্গে বলতে হয়নি আসিফের। চট করে বুঝে গেল ছেলের দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারানোর কারণটা। নারীর টানে বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠবান পুরুষকেও মূহুর্তে দূর্বল হতে দেখেছে তিনি। উনার ছেলেতো কিছুই না। রিদকে ঘুমের ইনজেকশন দিতেই নিহাল খান নিজে দায়িত্ব নিল সবকিছুর। বাকি রাতটা তিনি বিরতিহীন ভাবে দাঁড়িয়ে মায়াদের খোঁজের অনুসন্ধান করলো। কিন্তু ফলাফল তখনো শূন্য। রিদের জ্ঞান ফিরে প্রায় তিন ঘন্টা পর। সকাল তখন সাতটার ঘরে। খালি মস্তিষ্কের তারাক করে উঠলো কয়েক সেকেন্ড পরপরই। শিট!শিট! শিট! বলে চেঁচিয়ে পাগল পাগল হয়ে বের হলো তাঁবু থেকে। আশেপাশে পরিবেশটা সেই রাতের মতোন গমগমে আর উত্তেজিত দেখে বুঝল তাঁর বউকে এখনো খুজে পাইনি। নিহাল খান তাঁবুর বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। রিদকে জেগে উঠতে দেখে তিনি এগিয়ে আসল। রিদের চঞ্চল দৃষ্টি আর অস্থির বাচনভঙ্গি দেখে তিনি নিজ থেকেই রিদকে জানাল মেয়ে দুটোর নিখোঁজ থাকার বিষয়টি। নিস্তব্ধ রিদ হুম, হা কোনো শব্দ করলো না। শুধু নিশ্চুপ চোখে বাবার থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল পাহাড়ের দূর পথে। দৃষ্টি শান্ত। মন চঞ্চল। নিশ্চুপ রিদের অস্থির মনের অবস্থার ঠাহর ততক্ষণে করতে পারলো নিহাল খান। এগিয়ে এসে ছেলেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতেই রিদ ভাঙ্গা গলায় একটু করে বলল…

‘ আই লাভ হার বাবা। এন্ড আই ওয়েন্ট হার। প্লিজ বাবা যেকোনো মূল্যে মেয়েটিকে এনে দাও আমায়। আমার বুক কাঁপছে, ভিষণ কলিজা পুড়ছে, মনে হচ্ছে নিশ্বাস আঁটকে মারা যাব ওকে ছাড়া। প্লিজ বাবা আমার আবদারটা রাখো। এনে দাও আমার বউকে। নয়তো আমি পাগল হয়ে যাব বাবা। নিশ্বাস আঁটকে মরে যাব। প্লিজ বাবা সেইভ হার। প্লিজ।

#চলিত….