রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৩৮+৩৯

0
3

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৮
‘ আই লাভ হার বাবা। এন্ড আই ওয়েন্ট হার। প্লিজ বাবা যেকোনো মূল্যে মেয়েটিকে এনে দাও আমায়। আমার বুক কাঁপছে, ভিষণ কলিজা পুরছে, মনে হচ্ছে নিশ্বাস আঁটকে মরা যাব ওকে ছাড়া। প্লিজ বাবা আমার আবদারটা রাখো। এনে দাও আমার বউকে। নয়তো আমি পাগল হয়ে যাব বাবা। নিশ্বাস আঁটকে মরে যাব। প্লিজ বাবা সেইভ হার। প্লিজ।

নিরুপায় নিহাল খান রিদের পিঠে আশ্বস্তের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ আমরা খুব শীঘ্রই মেয়ে দুটোকে পেয়ে যাব বাবা। ইউ আর মাই ব্রেব বয়। ধৈর্য রাখো।

রিদের ঝিমিয়ে পড়া মস্তিষ্ক তড়াক করে জ্বলে উঠলো নিহাল খানের কথায়। মেয়ে দুটোকে খুব শীঘ্রই পেয়ে যাব মানে তার বউ এখনো নিখোঁজ। মাত্র দূর্বলতা প্রকাশ করা রিদ হয়ে উঠলো কঠিন। গুরুগম্ভীর মুখে বাবাকে ছেড়ে আশপাশটা তাকাল তীক্ষ্ণ নজরে। আশেপাশে হাজার হাজার মানুষের গমগমে ভিড়। অথচ তার বউ এখনো নিখোঁজ। গোটা রাত গড়িয়ে সকাল হলো অথচ দুটো নিখোঁজ মেয়ের সন্ধ্যা এতো এতো মানুষ মিলেও রিদকে দিতে পারলো না। শক্তপোক্ত রিদ ঘায়েল বাঘের নেয় হিংস্রত্বে প্রকাশের আগে শান্ত থাকল। কখন গর্জে উঠবে বা কখন হিংস্রত্বে থাবা বসাবে কার উপর কেউ জানে না। নিহাল খান ছেলের গম্ভীর ঘায়েল মুখটা দেখল। রিদকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে সেই ভাষা উনারও জানা নেই। হাজার হাজার মানুষের বাইরে, আর্মি, রেব ফোর্স লাগানোর পরও যখন মেয়ে দুটোর সন্ধ্যা পাওয়া যাচ্ছে না তখন আশা করা যায় মেয়ে দুটো হয়তো আর বেঁচে নেয়। পাহাড়ি জঙ্গির হাতে পরে তাদের মাটি চাপা হয়েছে এতক্ষণে। আর এই কথাটি উপস্থিত সবার ধারণা করছে। এমনকি তিনি আর্মি কমান্ডার সাথে মেয়ে দুটোর ব্যাপারে কথা বলতে, কমান্ডার উনাকে এমনটায় জানায়। কিন্তু এই কথাটা তিনি বাবা হয়ে রিদকে কিভাবে জানাবে? ছেলের দূর্বলতা এই প্রথম কোনো কিছু নিয়ে দেখেছেন তিনি। বুঝ হবার পর এই প্রথম উনার ছেলে, উনার কাছে কোনো কিছু নিয়ে আবদার করলো, তাও নিজের বউকে সেইফ করতে। অথচ চারপাশে হুলুস্থুল অভিযান সে নিজেই চালিয়ে রেখেছে। বাবা হয়ে উনার কিছু করার সুযোগ পযন্ত পাচ্ছেন না তিনি। ছেলের দূর্বলতার সামনে তিনি কিভাবে বাবা হয়ে ছেলেকে নিরাশ করে বলবে মেয়ে দুটো হয়তো আর বেঁচে নেই। মন্ত্রী হয়েও তিনি অসহায় বোধ করলো পরিস্থিতির কাছে। ছেলের পছন্দের মানুষকে খোঁজে না পেয়ে কিভাবে সামলাবে রিদকে সেই চিন্তা উনাকেও ত্রাস করলো। উনার বউটা এমনই যে রগচটে। যদি রিদের কিছু হয় তাহলে এই দ্বায়বার নিশ্চয়ই উনার উপর ঢালবে রিদের মা। দীর্ঘ ভারি নিশ্বাস গোপন করে তিনি এগিয়ে আসল রিদকে কিছু বলবে কিন্তু তার আগেই রিদ নিজের ক্রিমিনাল মাইন্ড চালাল। নিহাল খানকে উদ্দেশ্য করে ব্রেইন চালাতে চালাতে বলল…

‘ কমান্ডারদের দিগুণ ফোর্স বাড়াতে বলো বাবা। রেব বাহিনীর সাথে ট্রেকিং কুকুর পাহাড়ের বুকে নামাতে বলো জায়গায় জায়গায়। সন্দেহজনক যা পাবে সেটাই যেন সংগ্রহ করে। দরকার পরলে আমি নিজের ভিজিট করবো সেই সব জায়গা। দ্রুত ফোর্স বাড়াতে বলো। কুইক!

রিদের ট্রেকিং কুকুরের বিষয়টা নিহাল খানের দারুণ লাগল। এই কুকুর গুলো পাহাড়ের বুকে নামালে অবশ্যই মেয়ে দুটোর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে দ্রুত। কিন্তু এতো এতো আর্মি, রেব ফোর্সের সাথে রিদের হাজার হাজার ছেলেপেলে থাকতে আরও মানুষের কি দরকার? নিহাল খান আমতাআমতা করে রিদকে আপত্তি জানাতে চেয়ে বলতে চাইল…

‘ কমান্ডারদের বলে দিচ্ছি ট্রেকিং কুকুরের বিষয়টা। কিন্তু এতো মানুষ থাকতে আরও ফোর্সের কি প্রয়ো….

নিহাল খানের কথা শেষ করার আগেই কোমরে দু’হাত রেখে পাহাড়ের শেষ সীমানায় তাকাল রিদ। দৃষ্টিতে সেকি তেজ। কোনো কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলার মতোন ভয়ংকর তপ্ত চোখে। সকালের পরিবেশটা বেশ সুন্দর। কিন্তু চারপাশের মানুষের হৈ-হুল্লোড় চিৎকারে পরিবেশটা আর সুন্দর দেখাচ্ছে না। যেন মনে হচ্ছে কোলাহলের কোনো রর্ণক্ষেত্র এটি। যেখানে সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতিতে দাঁড়িয়ে। রিদ পাহাড়ের চূড়ায় তাকিয়ে নিহাল খানের কথা কেটে শক্ত গলা বলল…

‘ প্রয়োজন আছে বাবা। খুব প্রয়োজন আছে। শুধু আর্মি বা রেব ফোর্স নয় এই এলাকার পাহাড়য়ান লোক লাগাও আমার বউকে খোঁজতে। আমার এতো এতো ক্ষমতা আজ কোনো কাজে দিচ্ছে না বাবা। আমি আমার বউকে এখনো খোঁজে পাচ্ছি না। আমার জায়গাটা তোমাকে ব্যাখা দিতে পারব না। তুমি শুধু ফোর্স বাড়াও বাবা।

নিহাল খান আর আপত্তি করলো না। রিদের কথা মতো কাজ করলো। পিছন থেকে রিদের কাঁধ চেপে এগোল কমান্ডারদের দিকে। সেখানে কথা বলে ফোর্স বাড়াবে। সেই সাথে ট্রেকিং কুকুর পাহাড়ের বুকে নামাতে বলবে। নিহাল খান যেতেই আসিফ দৌড়ে এইদিকটায় এগিয়ে আসল রিদের দিকে। রিদকে জেগে উঠতে দেখে মূলত ওর কথা বলতে আসা। আসিফের দৌড়ে আসার মধ্যেই আকাশের বুকে দেখা গেল আরও একটি হেলিকপ্টারের চক্কর। দৌড়ে আসা আসিফ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। এই হেলিকপ্টার নিশ্চয়ই খান পরিবারের সদস্যদের থাকার কথা। আসিফকে রাতে আয়ন কল দিয়েছিল মায়ার খোঁজ নিতে। হয়তো আয়ন হতে পারে এই হেলিকপ্টারে। আসিফ আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে দৌড়ে গতি কমিয়ে দিল। হেলিকপ্টারের পাখা ধীর কমে এসে আসিফকে পার হয়ে রিদের মাথা উপর দিয়ে গিয়ে নামল বাকি হেলিকপ্টারের সঙ্গে। রিদ চোখ উঁচিয়ে তাকাল না পযন্ত উড়ন্ত হেলিকপ্টারের দিকে। কে বা কারা এসেছে তার দেখার দরকার পযন্ত পরলো না। রিদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই পাহাড়ের চূড়ায়। আসিফ দৌড়ে রিদের কাছাকাছি আসতেই ডাকাল রিদকে…

‘ ভাই!

‘ আকাশের বুকে হেলিকপ্টার গুলো উড়া আসিফ। সবগুলো নিষিদ্ধ জায়গায় হেলিকপ্টারের খোজ লাগা কুইক! আমি নিজে যাব সেইসব নিষিদ্ধ জায়গা গুলোতে। চল।

রিদ শুধুই তার ব্রেইন চালাচ্ছে এই মূহুর্তে। কিভাবে বউকে খোঁজে পাওয়া যাবে এই প্রদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বাকি সবাই শুধু রিদের কথা অনুযায়ী কাজ করছে। যেকোনো পরিস্থিতি রিদের তীক্ষ্ণ মাইন্ড দ্রুত চলে সেটা পূর্ব থেকেই অবগত আসিফ। তাই নতুন করে আবাক হলো না রিদের চালচলনে। আসিফ রিদের কথা শুনলো। এবং কিছু বলতে চাওয়ার আগেই রিদ নিজের কথা শেষ করতে করতে হাঁটে হেলিকপ্টার গুলোর দিকে। আসিফ বুঝল রিদকে এই মূহুর্তে কিছু বলার চেয়ে চুপচাপ সে কাজ করাটায় শ্রেয়। নয়তো যে আগুনে রিদের ভিতর জ্বলছে সেই আগুনে সর্বপ্রথম আসিফকেই পুড়াবে রিদ। আসিফ তৎক্ষনাৎ রিদের পিছন থেকে দৌড়ে সামনে এগোল ক্যাপ্টেনদের বলতে হেলিকপ্টার গুলো আকাশের উড়াতে। আসিফ ক্যাপ্টেনদের তাদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্যেই দেখল মাত্র আগত হেলিকপ্টার থেকে আয়ন আর রাদিফ দুজনই অস্থির, উত্তেজিত অবস্থায় নামতে। দুজনের হাঁটার গতিপথ ছিল রিদ। কিন্তু অশান্ত, অস্থির রিদ চোখ আওড়িয়ে তাদের দুজনকে দেখলো কি দেখলো না। কোমরের ইন করার শার্টে ভাজ খুলতে খুলতে গিয়ে বসল হেলিকপ্টারের ভিতর। আয়ন-রাদিফ রিদকে হেলিকপ্টারের ভিতর বসতে দেখে নিজের হাঁটার গতি বাড়িয়ে দৌড়াতে চাইল, কিন্তু ততক্ষণে দুজন বডিগার্ড দুইদিক থেকে উড়ন্ত যন্ত্রটির দরজা আটকে দিতে দিতেই ক্যাপ্টেন হেলিকপ্টারটি উড়াল আকাশে। আয়ন বা রাদিফ কারও সুযোগ হয়নি রিদের সঙ্গে যাওয়ার। আসিফ অপর হেলিকপ্টার উঠতে উঠতে চেঁচাল রাদিফ আর আয়নের উদ্দেশ্যে, তাড়াহুড়োয় বলল…

‘ আয়ন ভাই, আপনি আর রাদিফ ভাই দুজন দুটো হেলিকপ্টার উঠে পড়ুন। আমরা পাহাড়ি নিষিদ্ধ জায়গা গুলোতে যাব ভাইয়ের পিছন পিছন। আপনারা দুজন দুটো আলাদা আলাদা হেলিকপ্টারে, আলাদা দিশায় যান, ক্যাপ্টেনদের লোকেশন বলা আছে। সঙ্গে একজন করে বডিগার্ড নিয়ে যান।

আসিফ কথা মতো আয়ন রাদিফ দুজনই দৌড়াল দুই পথে। রিদের পিছন পিছন তাঁরাও একটি করে হেলিকপ্টার উড়িয়ে গেল ভিন্ন ভিন্ন দিশায়। আসিফ চলে যেতে গিয়েও একটু থামল। বাকি হেলিকপ্টারের ক্যাপ্টেন গুলোকে আবারও একবার করে লোকেশন বুঝিয়ে দিয়ে সে পুনরায় তার বরাদ্দকৃত হেলিকপ্টারে চড়তে চড়তে দেখল অস্থির উত্তেজিত আরিফ দৌড়ে এইদিকটাই আসছে। হয়তো আসিফকে কিছু বলতে চাই। আসিফ কি মনে করে পুনরায় নেমে গেল। কিছুদূর এগিয়ে এসে আরিফকে আশ্বস্ত করে বলল ওদের সাথে যেতে। মায়াদের খোঁজে পাহাড়ের বুকে হেলিকপ্টার নিয়ে চড়তে। আসিফের কথায় উত্তেজিত আরিফ তৎক্ষনাৎ রাজি হয়ে গেল। মূহুর্তের মাঝে দশটি হেলিকপ্টারের পাখা উড়িয়ে চলল পাহাড়ের বুকে। অল্প দূরত্বে পাহাড়ের বুক ঘেঁষে হেলিকপ্টার থেকে খোঁজ চলল মায়াদের। এতো এতো মানুষ শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইল রিদের খানের ক্ষমতার দিকে। তাদের দেখা কখনো এমন হয়নি কারও জন্য কেউ এতো অস্থির, পাগল পাগল হয়ে এতো মানুষ জড়ো করে ফেলতে মূহুর্তের মাঝে। হাজার হাজার মানুষকে বিরতিহীন ভাবে লাগাতার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের বুকে দৌড় করাচ্ছে শুধু দুটো মেয়ের জন্য। সেই সাথে এতো গুলো মানুষের খাওয়া, দাওয়া পানির, ডাক্তারের ব্যবস্থা পযন্ত করে রিদ খানের পক্ষে থেকে। তারপরও মেয়ে দুটো রিদ খানের চাই মানে চাই-ই। এখনো তো উপস্থিত মানুষের মধ্যে একটা তীব্র কৌতূহল জেগে উঠেছে কে সেই নারী যার খোঁজে রিদ খান আকাশ পাতাল এক করে দিচ্ছে অনুসন্ধানে। রিদ খানের শখের নারীকে সবাই এক পলক হলেও দেখতে চাই। কিন্তু আপসোস! সেটা আদৌও সম্ভব হবে কিনা কে জানে? সবার ধারণা মেয়ে দুটো হয়তো জীবিত নেই। কারণ জীবিত মানুষের সন্ধান এতক্ষণে পেয়ে যেত তাঁরা। কিন্তু মৃত মানুষের সন্ধান পাওয়া এই পাহাড়ের বুকে অনেকটায় দ্বায়। কারণ মৃত মানুষ বন্যপশুর শিকার হয়। যদি মেয়েদুটো মৃত হয় তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই পাহাড়ি বর্নপশুর আহার হয়ে গেছে। সেখানে একরাত কেন? একযুগ খোঁজলেও মেয়ে দুটোর সন্ধান পাওয়া যাবে না। দেখতে দেখতে আর্মি, রেব ফোর্স আর দ্বিগুণ বাড়াল হলো। সারি সারি গাড়ির ভিড় পরলো রাস্তায়। দুপাশে পাহাড়ি রাস্তায়, দুই কিলোমিটার পযন্ত শুধু গাড়ির ভিড়ই পরলো। আগত রেব বাহিনীর সাথে স্পেশালিষ্ট ট্রেকিং কুকুরের নামাল হলো পাহাড়ের বুকে। আর সেটা কাজেও দিল। কুকুর গুলোর ঘ্রাণ শক্তি তীব্র হয়। কোনো জিনিসের ঘ্রাণে চিহ্নিত করতে পারে মানুষের অবস্থান। রেব বাহিনী হাতে হাতে সেই কুকুর গুলো নিয়ে জায়গায় জায়গায় চড়িয়ে পরতেই মায়াদের চিহ্নর খোঁজ বের হতে শুরু করলো। প্রথমে রাস্তা রক্তের দাগ পেল। রাতে আধারে জঙ্গি ছেলেগুলোর হাতে মায়া পা কেটে উল্টে পড়ার সেই রক্তের দাগ গুলো কুকুর দিয়ে সনাক্তকরণ করতেই সেখানে রেব বাহিনী দাগ টেনে সিস করলো। পাহাড়ে উঠতে উঠতে আরও কয়েক জায়গায় অল্প অল্প রক্তের দাগ পেল বিভিন্ন জায়গায়। তদন্ত অনুযায়ী রেব ফোর্স ধারণা করছে মেয়ে গুলো রাতের আধারে হয়তো এই পথেই দৌড়ে পালিয়ে ছিল। এই সনাক্ত করা জায়গাগুলো রিদের কাছে পৌঁছাতে বার্তা পাঠানো হলো রিদের ক্যাপ্টেনের কাছে। সাতটা থেকে নয়টা পযন্ত প্রায় দু’ঘন্টা যাবত শুধু পাহাড়ের নিষিদ্ধ জায়গা গুলোতে হেলিকপ্টারে চড়ে বেড়িয়েও মায়াদের অনুসন্ধানের খোঁজ পেল না রিদ বা অন্য কেউ। তারপরও ক্লান্তিতে কেউ থেমে নেই। বিরতিহীন ভাবে একজায়গায় বারবার রাউন্ড দিয়ে খোঁজে বেড়াচ্ছে মায়াদের। অশান্ত রিদ দাঁত কিরমির করে বসে। তখনই ক্যাপ্টেন খবর দিল মায়াদের কিছু চিহ্নের সনাক্তকরণের বিষয়টি। অল্প আশার আলো দেখতে পেতেই রিদ তৎক্ষনাৎ উড়ন্ত যন্ত্রটি নামাতে বলল নিচে। দক্ষ ক্যাপ্টেন তাই করলো। পাহাড়ের শেষ চূড়ায় পাখার রাউন্ড রাউন্ড ঘুরিয়ে নামল নিচে। উড়ন্ত যন্ত্রটি নামতে দেরি কিন্তু রিদের লাফিয়ে বের হতে দেরি হলো না। রিদকে বের হতে দেখেই কালো পোষাক দ্বারি কিছু রেব ফোর্স এগিয়ে আসল। তাদের মধ্যে একজন কমান্ডারও ছিল। তিনি হাতে একটা ট্যাবে রিদকে তখনকার সনাক্তকরণের জায়গায় গুলো ছবিতে দেখাতে দেখাতে হাঁটল সামনে। রিদ ট্যাব হাতে চলল নিচে। যেদিকে ট্রেকিং কুকুর গুলো দিশা দিচ্ছিল। পাহাড়ের উঁচু হতে নিচে নামার মাঝ পথে আবারও হৈচৈ করলো কুকুর গুলো। গ্যাউ গ্যাউ শব্দে পা দিয়ে আশেপাশের বালুমাটি সরাতে লাগল কোনো কিছুর আভাস পেয়ে। রিদ থামে। সে থামে নয় তাঁকে থামতে হয় কুকুর গুলোর হৈচৈ দেখে। সেই সাথে থামলো পুরো বের ফোর্স। কুকুর গুলোর দেখানো জায়গায় অনুসন্ধান করে আশেপাশে খোঁজতে লাগল কি আছে সেখানে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কুকুর গুলো নিজেই পাহাড়ি লাল বালুর মাটি খুড়ে বের করলো ছোট একটি যান্ত্রিক ফোন। একজন রেব সদস্য গ্লাভস হাতে সেই ফোন তুলে কমান্ডারের হাতে দিতেই তিনি সেটা রিদের হাতে দিল। অস্থির, অশান্ত রিদ কম্পিত হাতে সেই ফোনটি হাতে তুলল। নিশ্চুপ ভঙ্গিতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই ফোনের দিকে। তখনই পাশ থেকে কমান্ডার রিদের উদ্দেশ্য বলল…

‘ এটা হচ্ছে আপনার পাঠানোকৃত নাম্বারের ফোনটি। যেটা আমরা রাতে লোকেশন ট্রেক করেছিলাম সেটি। ধারণা করা যায় এটি মেয়ে দুটো মধ্যে একজনের ফোন হবে। ওদের হয়তো সন্ত্রাসী গুলো এই রাস্তা দিয়েই ধরে কোথাও নিয়ে গেছে মিস্টার খান।

অশান্ত রিদের মন, মস্তিষ্ক দুটোই দপদপ করছে আগুনের লাভার নেয়। এই মূহুর্তে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে ফেলতে পারলেও তার মন শান্ত হবে না। রিদ এই মূহুর্তে ভয়ংকর ভাবে ঘায়েল হচ্ছে একের পর এক বউয়ের নিখোঁজ হওয়ার চিহ্ন পেয়ে। রিদ অনুভব করতে পারছে তার বউয়ের তীব্র আকুতি, আর ছটফটের লড়াই। নিশ্চয়ই তার বউ শেষ পযন্ত অনেক লড়াই করেছিল বেঁচে ফেরার। সেজন্য তো জায়গায় জায়গায় নিজের লড়াইয়ের চিহ্ন রেখে গেল। রিদ শক্ত হাতে মুঠোয় পিষল ফোনটিকে। চোয়াল শক্ত করে আশেপাশে তাকাল অশান্ত দৃষ্টিতে। বালুর মাটির উপর কয়েকজন মানুষ ধস্তাধস্তি করলে যেমন গর্তে উঁচু নিচু হয়ে থাকে বর্তমান তেমন অবস্থায় হয়ে আছে গুহার সামনে। হিংস্রত্ব রিদের চোখের পাটা ক্রমশ আবারও লাল হতে লাগল। অথচ তার বাচন ভঙ্গি ততই শান্ত দেখাল। রিদের শান্ত ভঙ্গি দেখে বুঝার উপায় নেই সে এই মূহুর্তে কতোটা হিংস্রত্বের ঘায়েল শিকারী হয়ে আছে শিকারের অপেক্ষায়। আশেপাশে সিল মেরে জায়গাটা সিস করে দিল কমান্ডার। তিনি প্রথম অবস্থায় রিদের মনোভাব ধরতে না পেরে পুনরায় বলল…

‘ মিস্টার খান এটা হচ্ছে একটা গুহা। ফোনটা যেহেতু এখানে পেয়েছি তাই আশা করা যায় মেয়ে দুটো হয়তো রাতে এই গুহার ভিতরেই ছিল। আমরা লোক পাঠাচ্ছি এর ভিতরে।

রিদ গুহার সামনে হাঁটু মুড়ে বসল ভিতরে দিকে তাকিয়ে। কি জানি সে কি দেখল গুহার ভিতরে? তার পরপরই শুনা গেল রিদের শান্ত কন্ঠ….

‘ এটা গুহা নয়। সুরঙ্গ পথ! এই সুরঙ্গের দ্বিতীয় রাস্তাটা খুঁজুন কমান্ডার। আশেপাশে কোথাও থাকতে পারে।

রিদের কথায় কমান্ডার একই ভাবে রিদের সাথে বসে।গুহার ভিতরে উঁকি মারতে মারতে বলল…

‘ এটা কোনো সুরঙ্গ নয় মিস্টার খান। দেখতে সুরঙ্গ মতো মনে হলেও আসলে এটা একটা গুহা। আমি আমার পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এসব পাহাড়ি গুহায় সন্ত্রাসীরা আশ্রয় নেওয়ার জন্য খনন করে। এসব গুহার দ্বিতীয় কোনো পথ থাকে না।

তীব্র মেজাজে হাতের মুঠোয় মায়ার ফোনটি পিষে তৎক্ষনাৎ জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রিদ। এই মূহুর্তে কমান্ডার রিদের পাশে বসে থাকা মানেই পরিস্থিতি বিগড়ে যাওয়া। এমনই রিদের মেজাজ হিংস্রত্বে হায়নারের হয়ে আছে। কখন থাবা বসাবে ঠিক নেই। মন মস্তিষ্ক জ্বলছে তপ্ত আগুনে। সেজন্য রিদ নতুন করে আর আগুন জ্বালাতে চাই না। কামান্ডার রেখেই রিদ এগিয়ে গেল সামনে। উপস্থিত বাকি রেব বাহিনীরও ট্রেকিং কুকুর নিয়ে দৌড়াল রিদের আগে আগে। পাহাড়ের উঁচু স্থান হতে অনেকটায় নিচে নামল সুরঙ্গ পথের খোঁজে। একটা সময় রিদের কথা মতো পেয়েও গেল। সুরঙ্গ মুখের খোঁজ পেতে কুকুর গুলো আবারও হৈচৈয়ে গ্যাউ গ্যাউ শব্দ করে চেঁচাতেই, থামল সবাই। পুনরায় সনাক্ত হলো মায়াদের ফেলে যাওয়া কিছু জিনিস। গুহার ভিতরে রেব ফোর্সের প্রবেশ ঘটতেই সেখানে থেকে উদ্ধার হলো রাফার ফেলে যাওয়া ছোট ব্যাগটি আর মায়ার রক্তাক্ত সাদা হিজাবটি। দুটো জিনিস সংগ্রহ করে রিদের হাতে তুলে দিতে রিদ প্রথমে ব্যাগটা হাতে নিল। অস্থির, অশান্ত মনে সেটি নাকে বাজাতে অপরিচিত ঘ্রাণ আসল ব্যাগ থেকে। রিদ তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারলো ব্যাগটা তার বউয়ের নয়। পুনরায় ব্যাগটি ফেরত দিতে দিতে মায়ার হিজাবটি তুলে নিল হাতে। আগের নেয় হিজাবটি আর নাকে বাজাতে হয়নি রিদের, তার আগেই পরিচিত সুবাস বাজল নাকে। রিদ থমকে যাওয়ার মতোন হিজাবটি দিকে তাকিয়ে রইল গুটি কয়েক সেকেন্ড। পরিচিত সুভাসটা বলছে এই হিজাবটি তার বউয়ের।
হিজাবের রক্তের ছিটা দাগ আর পাহাড়ী লাল মাটি ময়লা বর্ণনা করছে তার বউ রাতে এখানেই ছিল। না জানি কতোটা আতঙ্কে আর কতোটা অসহায়ত্বে আহত অবস্থায় এখানে আশ্রয় নিয়ে ছিল সে। আচ্ছা ফোনে যে রিদকে গুহার কথা বলেছিল সেটি কি এই গুহার কথায় বলেছিল তার বউ? নাহ! রিদ আর ভাবতে পারলো না। ছটফট, অস্থির মনে বলিষ্ঠ হাতে হিজাবটি পিষে হাঁটু ভেঙ্গে বসল সুরঙ্গ মুখে সম্মুখে। অন্ধকার সুরঙ্গে ভিতরে দিনের আলোয় এতোটা অন্ধকার দেখালে তাহলে রাতে হয়তো আরও ভয়ংকর অন্ধকার দেখায়। তার বউ নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে আহাজারি করেছিল অল্প আলোর জন্য? রিদের পাশাপাশি তখনকার কমান্ডারটিও বসল হাতে ফোনের আলো জ্বালিয়ে। সুরঙ্গের ভিতরে আলো ফেলতে দেখল ছোটখাটো গুহার মতোন বেশ বড়ো সুরঙ্গ পথ ভিতরের দিকে চলে গেছে। কমান্ডার সেটি দেখে রিদের দিকে তাকাল আঁড়চোখে। তখন রিদকে জোড় গলায় বলেছিল এসব পাহাড়ী গুহার দ্বিতীয় রাস্তা থাকে না। অথচ উনার পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা ভুল করে রিদ খানের ধারণা ঠিক হলো। দেখা মাত্র কিভাবে বলে দিতে পারলো এটা গুহার নয় সুরঙ্গ পথ ছিল? তিনি তো জানেন এসব গর্তের মতোন দেখতে গুহার পাহাড় কেটে বানানো হয় শুধু পাহাড়ি জঙ্গিদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য। যেমনটা মানুষ ঘর বানায় তেমন পাহাড় কেটে জঙ্গিরা গুহা বানায় তাদের নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু রিদ খানের ধারণা উনার অভিজ্ঞতা থেকে এতোটা প্রহর কিভাবে হয় এসব বিষয়ে? এতো সহজভাষায় কিভাবে সবকিছু আগে আগে বলে দেওয়া সম্ভব? কমান্ডারের চিন্তা ভাবনার মাঝেই রিদ সুরঙ্গে ভিতরের হাত ঢুকিয়ে একটা মচমচে শুকনো পাতা হাতে নিলো। রিদকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাতাটি দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনিও তাকাল সেদিকে। দেখল শুকানো পাতাটি রক্তের কালসিটে দাগে দুমড়ে মুচড়ে আছে। পাতাটি দেখে বুঝা যাচ্ছে কেউ একজন হয়তো এই পাতার সাহায্য নিজের রক্তাক্ত স্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছিল। রিদ পাতাটি হাতে নিয়েই আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকা আরও কিছু পাতা দিকে তাকাল। বেশ কিছু পাতাই একই ভাবে রক্তের দাগে দুমড়ে মুচড়ে পরে আছে। রিদ বুঝতে পারলো মায়া বা রাফার মধ্যে কেউ একজনের রক্ত পরিষ্কার করতে চেয়েছিল এই পাতার সাহায্যে। শ্বাস আটকে আসার মতোন কষ্টে রিদ বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানল কয়েক বারবার। শেষবার সুরঙ্গের ভিতর তাকিয়ে পুনরায় সে উঠে দাঁড়াল। যে পথে এসেছিল সেই পথে হাঁটল পাহাড়ের চূড়ায়। রিদকে পাহাড়ের উঁচুতে উঠতে দেখে কমান্ডার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তাড়াহুড়ো করে বলল…

‘ মিস্টার খান কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আমরা তো যাব নিচে? আপনি উপরে দিকে যাচ্ছে কেন?

শক্ত রিদ উত্তর করলো না কমান্ডারের কথায়। সে এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছে তার গন্তব্য এখন কোথায়? বউ তার এই সুরঙ্গ পথ ধরেই পাহাড়ের উপরে উঠেছিল রাতে। কিন্তু এরপর কোথায় গিয়েছে সেটাই রিদকে জানতে হবে। রাফাকে নিয়ে মায়ার দৌড়ে যাওয়া একই পথে হাঁটল রিদ। হাঁটতে হাঁটতে সেই একই পথে উঠে দাঁড়াল পাহাড়ের শেষ পিষ্টে। রিদ আশেপাশে তাকাল। নিজের ক্রিমিনাল মাইন্ড আর বিচক্ষণতা কাজে লাগিয়ে মায়াদের রাতের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে চাইল নিজে নিজে। বাজপাখির দৃষ্টি আর প্রহর ব্রেইন চালিয়ে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বর্ণনা করলো।
পাহাড়ের শেষ পিষ্টে চূড়ায় দাঁড়িয়ে এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ। সামনে গহীন গভীর খাদ। আর পিছনে ছিল জঙ্গি ছেলেগুলো। এখান থেকে ঘুরে পুনরায় দৌড়ানোর সুযোগ পাবে না তার বউ, কারণ এতে অনেক সময় লাগবে ততক্ষণে ছেলেগুলোর হাতে ধরা পরা সম্ভবনা বেশি। যদি তার বউ ধরা পরতো তাহলে এতক্ষণ তার মৃত দেহটা হলেও রিদ পেয়ে যেত। কারণ পাহাড়ের বুকে থাকা, চোর, ডাকাত, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, একটা মানুষকেও রিদ ছাড় দেয়নি বন্দী করার থেকে। এরমানে তার বউকে রাতে কিডন্যাপ করা জঙ্গি ছেলেগুলোও রিদের হাতে বন্দী এই মূহুর্তে। হয়তো তার বউয়ের সন্ধান পেলে ছেলেগুলোকেও সনাক্ত করা যাবে। তাই রিদের বিচক্ষণতা বলছে তার বউ রাতে জঙ্গিদের হাতে পরেনি। হয়তো প্রাণ বাঁচাতে কিছু একটা করেছে? কিন্তু কি? পিছনে জঙ্গি ছেলেগুলো থাকলে মানুষ ইজ্জত বাঁচাতে অসহায় অবস্থায় কি করতে পারে? পাহাড় থেকে লাফ দিতে পারে? রিদের হিসাব বরাবর মিলে যেতেই রিদের বুক আতঙ্কে কাঁপল। কম্পিত বুকে তাকাল নিচে। দিনের আলোয় উপর থেকে নিচে তাকালে মানুষের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতোন ভয়ংকর গহীনতা দেখা যায়। রিদ মায়ার লাফিয়ে পড়া একই স্থানে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল। একহাতে মায়ার হিজাব চেপে তো অন্য হাতে মুঠোফোনটি ধরা। অনর দৃষ্টিতে পাহাড়ের উঁচু হতে তলদেশে তাকিয়ে। রিদের আশেপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড়। সবাই মায়াকে খোঁজে বেড়াচ্ছে। অথচ রিদের বুক কাঁপছে এটা মানতে তার বউ হয়তো রাতে এইদিকটায় এসেছিল। জেনে-বুঝে নয়তো অসাবধানতায় এই পাহাড়ের চূড়ায় হতে নিচে পরে গিয়েছে। রিদ শূন্য চোখে নিচে একদমে তাকিয়ে রইল। রিদের হেলিকপ্টার ছাড়া বাকি নয়টি হেলিকপ্টার দেখা গেল এই পাহাড়ের তলদেশেই উড়ে বেড়াচ্ছে মায়াদের খোঁজে। রিদ নিজেও এতক্ষণ এই নিষিদ্ধ জায়গা গুলোতে মায়ার খোঁজ করেছিল। কিন্তু কোথায় পায়নি। রিদ বুঝতে পারছে না যদি মেয়ে দু’টোর এইদিকটায় লাফিয়ে থাকে তাহলে এতক্ষণ পযন্ত তাদের একটার চিহ্ন পযন্ত কেউ পাচ্ছে না কেন? রাত থেকে এই পযন্ত সবাই খোঁজে খোঁজে ক্লান্ত। এখন সময় দশটার ঘরে। তাঁর বউ যাবে তো যাবে কোথায়? মাটি খুঁড়ে হলেও পাহাড়ের তলদেশ থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার কথা অথচ বিগত বারো ঘন্টা ধরে খোজাখুজি পরও কোনো হুদিস পাচ্ছে না কেউ। চারপাশে চাপা গুঞ্জন চলছে মায়া জীবিত নেই। অথচ রিদের মন মস্তিষ্ক মানতে নারাজ তার বউ জীবিত নেই। রিদ বুঝতে পারছে সে অনেকটা দেরি করে ফেলেছে তার বউয়ের কাছে পৌঁছাতে। কিন্তু না জানি কতোটা দেরি করে ফেলেছে সেই ভয়ে আকাশের দিকে তাকাল রিদ। বেশ সময় নিয়ে শূন্য আকাশে তাকিয়ে রইল অনুভূতিহীন ভাবে। তার কঠিন ব্যক্তিত্ব নড়ে উঠছে বউয়ের দহনে। চোখের সামনে দুনিয়াটা ঘুরছে হারানো ব্যথায়। রিদ তপ্ত দহনে ব্যথা সয্য করতে না পেরে হঠাৎ বুকফাটা আর্তনাদে চিৎকার করে উঠলো গলা ফাটিয়ে। রিদের
চিৎকারে আশপাশটা ভয়াবহ হয়ে উঠলো থমথমে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রিদের চিৎকারের ধ্বনি বলতে শুনা গেল….

‘ রিততততত! আই হেট ইউ! আই জাস্ট হেট ইউ। তোর মতোন অবাধ্য নারীর প্রয়োজন এই রিদ খানের পরে না। শুনেছিস তুই? তোকে ছাড়াও আমি ভালো থাকব। খুব ভালো থাকব।

রিদের হঠাৎ চিৎকারে আশেপাশে সবাই থমথমে খেয়ে আবাক চোখে তাকাল রিদের দিকে। একটা মানুষ কতোটা ভিতর থেকে ভেঙ্গে পরলে এভাবে চেঁচাতে পারে পাহাড়ের বুকে। রিদের প্রতিটা আর্তচিৎকার ধ্বনি যেন পাহাড়ে বুকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরত আসছে বারেবার। উপস্থিত শতশত মানুষ নিজেদের খোঁজা খুঁজি ছেড়ে শুধু রিদের দিকে তাকিয়ে। রিদের না বলা কথা গুলো যেন সবাই পড়তে পারছে। বউ হারিয়ে পাগলপারা রিদের বুকফাটা আর্তনাদ সবাই দেখতে পারছে। কিন্তু আফসোস তাদের কারও ক্ষমতা নেই রিদের বউকে সুস্থসবল অবস্থায় ফিরত দিতে। কারণ তাদের সবার ধারণা মেয়েটি হয়তো রাতে জঙ্গিদের হাতে পরে পাহাড়ের বুকে কোথাও মাটি চাপা হয়ে গেছে যার জন্য এখনো তারা মেয়েটির সন্ধান খোঁজে পাচ্ছে না। ক্লান্ত রিদ আকাশের বুকে তাকিয়ে রইল তখনো। কয়েক সেকেন্ড সময়ের ব্যবধানে ক্রমশ চোখের পাতা বন্ধ করতে করতে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রিদ বিরবির করে আওড়াল।

‘ আমি ভালো নেই জান। তোকে ছাড়া নিশ্বাস আঁটকে আসার মতোন কষ্ট আমি পাচ্ছি। প্লিজ জান কাম ব্যাক। আই কান্ড লিভ উইথ আউট ইউ। আই কান্ড। প্লিজ কাম ব্যাক। প্লিজ!

.

#চলিত….

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৯
তীব্র খচখচ আর গা চুলকানিতে গাঢ় ঘুমটা হাল্কা হতে শুরু করলো মায়ার। ঘুমের মধ্যে শরীর জ্বালাপোড়ার অনূভুতি হতেই কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলো তাতে। গাঢ় ঘুমের রেশ কাটাতে না পেরে পাশে ফিরে শুতে চাইলে বুঝল কোথায় যেন একটা ঢুকে পরছে ধীরে ধীরে। শরীরে অদ্ভুত কিছুর উপস্থিত পেল ঘুমের মাঝেই। যেটা শরীরের জায়গা জায়গায় চুলকানির রেশ বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে নাকে, মুখে, কাঁধে চুলকানির রেশ অনেকটা ঠাহর করতেই গাঢ ঘুমটা ধীরই হাল্কা হতে লাগল মায়ার। বিরক্তি প্রকাশ করে ঘুম ঘুম চোখ টেনে খুলতে গিয়ে পলক ঝাপটে মূহুর্তে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল চোখে কিছু লাগাতে। অলস ভঙ্গিতে আবারও মায়া একই ভাবে চোখ খুলতে গিয়ে নিজের অবস্থান পেল অন্ধকার কিছুর ভিতর। কোথায় আছে সেটার ধারণা তৎক্ষনাৎ করতে পারলো না ওহ। মায়ার ঘুমন্ত মস্তিষ্ক জাগ্রত হতে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয় হলো নিজের অবস্থান নিয়ে। তখনো থম মেরে শুয়ে রইল নিস্ক্রিয় মস্তিষ্কে। অন্ধকার জগতে শুয়ে থেকে অসল ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল অল্প আলোয় উঁকি দেওয়া সেই সূর্যের রশ্মির দিকে। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর মায়া যখন অলস ভঙ্গিতে উঠে বসতে চাইল নিজের শরীরে তীব্র চুল্কানি অনুভব হতে, কিন্তু উঠে বসতে গিয়ে যখন নিচের দিকে ডেবে যাচ্ছিল শরীর তখনই মায়ার মস্তিষ্ক ভয়ে তড়াক করে জেগে উঠল আশপাশটা নিয়ে। ভয়ার্ত মায়া নড়াচড়া বন্ধ করে সর্তক হলো। ঘুমের রেশ কাটিয়ে খোলা চোখে আশপাশটা তাকাতেই বুঝল মায়ার কোনো মচমচে পাতার স্তুপে ডুকে আছে। সাতসকালে মায়া গায়ে পাতার বিষয়টা বুঝল না। রাতের কথা ও তেমন মনে করছে পারছে না। শুধু ভয়ার্ত ভঙ্গিতে নিজের শরীর থেকে পাতার স্তুপ সরাতে সরাতে কানে ভাজল মানুষের তীব্র কোলাহল আর মাথার উপর কিসের যেন গমগমে শব্দ। মায়া তৎক্ষনাৎ ধরতে পারলো না এতো শব্দের গুলো কিসের। ভয়ার্ত মায়া শুধু আতঙ্কিত হলো নিজেকে নিয়ে, মায়ার মনে হলো সে রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে ছিল কিন্তু সকালে উঠে নিজেকে কোন এক পাতা ঘিরা বিছানায় পাওয়াটা চারটে খানিক কথা নয়। মায়ার ধারণা ওকে কোনো এক দুষ্টু, বজ্জাত জ্বীনের দল উঠিয়ে নিয়ে এসেছে নিজের আস্তানায়। সেজন্য মায়া এই জঙ্গলে পরে। আচ্ছা মায়া সাথে যে জুই রাতে ঘুমিয়ে ছিল ওকে ও কি ধরে এনেছে দুষ্টু জ্বিনের দল? নাকি মায়াকে একাই আনলো? আতঙ্কিত মায়া নিজের গায়ের পাতা স্তুপ যত সরাতে চাইল ততই নিচে গহীনে প্রবেশ করতে লাগল। মায়ার শত চেষ্টাতে আরও ডেবেই যাচ্ছিল নিচে দিকে, যারফলে মায়ার পুরো শরীর হারিয়ে গেল শুকনো পাতার নিচে, শুধু অল্প মাথা বের করে থাকল খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে। মায়া ছটফটের মধ্যে দেখল মাথা উপর আকাশে বেশ কিছু হেলিকপ্টারের উপস্থিতি। আতঙ্কিত মায়া আরও আতঙ্কিত হলো নিজেদের অবস্থান অপরিচিত কোনো এক জঙ্গলে দেখে। মায়া আশপাশটা আতঙ্কিত চোখে ঘুরে তাকাতে তাকাতে রাতের ঘটনা গুলো মনে করতেই অস্থির, উত্তেজিত মনে আশেপাশে রাফাকে খোঁজল। রাতে দুজন একই সাথে পাহাড় থেকে লাফ দিয়েছিল। মায়া যদি বেঁচে থাকে তাহলে রাফাও মায়ার আশপাশে কোথাও থাকার কথা। ডুবন্ত পানিতে ডুবে মানুষ যেমন অল্প মুখ বের করে মাথা ভাসিয়ে রাখে, ঠিক তেমনই মায়া নিজের অল্প মাথা ভাসিয়ে আশেপাশে হাতড়িয়ে রাফাকে খোঁজল অস্থির গলায় ডেকে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে মচমচে পাতার ভিতর রাফার অবস্থান পেয়েও গেল মায়া। রাফার হাতে হাতে আঁকড়ে পাতার উপর সাঁতার কাটার মতোন টানতে লাগল উপরে তুলতে চেয়ে। কিন্তু মায়া রাফার হাত যত টানছে ততই যেন পাতার ভিতর ডুবে যাচ্ছে ঠায় না পেয়ে। মায়া বুঝল এইভাবে ওরা এই খাদ থেকে উঠতে পারবে না বরং আরও গহীনে ডুবে গেলে উঠা মুশকিল হবে দুজনের। মায়া রাফার হাত আঁকড়ে স্থির হতে হতে রাফাকে ডাকল উঁচু গলায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাফার হুশও ফিরল মায়ার মতোন করে। এতো উপর থেকে পরে দুই বান্ধবী বেঁচে আছে সেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে রাফা পাতার উপর দিয়েই মায়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলে মায়া তৎক্ষনাৎ চেচিয়ে উঠলো আতঙ্কে….

‘ এই, এই খবিশ মাইয়া ছাড় আমারে। পাহাড় থেইক্কা পইড়া না মরলেও এহন নিশ্চিত মরবো তোর কারণে। ভালোবাসা পরে দেখাস আগে নিজের জান বাঁচাই লই। ছাড়।

মায়ার আতঙ্কিত কথায় রাফা তৎক্ষনাৎ মায়াকে ছেড়ে দিতেই বুঝল সত্যি সত্যি ওরা যতো নড়াচড়া করছে ততই যেন পাতার ভিতর ডুবে যাচ্ছে। মায়া রাফা দুজনই আশেপাশে তাকাল উপরে উঠতে চেয়ে। কিন্তু উপরে উঠার মতোন কোথাও কোনো রাস্তা খুঁজে না পেয়ে বুঝল ওরা হয়তো বিশাল কোনো খাদে পরেছিল রাতে। সেই খাদ কতটা গভীর জানা নেই। তবে পানিবিহীন শুকনো খাদে পাহাড়ি গাছের পাতা পরে জমে জমে সমতল ভূমির মতোন হয়ে আছে। হুট করে দেখে বুঝার উপায় নেয় এটা কোনো ভয়ংকর খাদ হবে। অথচ ভাগ্য করে এই খাদই আজ মায়াদের জীবন বাঁচাল। আবার এই খাদ থেকে দ্রুত উঠার রাস্তা খোঁজে না পেলে তাহলে এই খাদই আজ মায়াদের মরণের কারণ হবে। দুই বান্ধবী জীবন বাঁচাতে চেয়ে নড়াচড়া করলো। ভাসমান পাতার উপর স্থির থাকার চেষ্টা করতেই রাফা আতঙ্কিত মুখে মায়াকে বলে উঠল…

‘ মায়া আমরা এখান থেকে বের হবো কিভাবে? চারপাশে এতো পাতা দেখে মনে হচ্ছে আমরা বড়সড় কোনো পাতার খাদে পরেছি। এখন উঠবো কিভাবে?

রাফার মতোন মায়া নিজেও আতঙ্কিত নিজেদের অবস্থান নিয়ে। এই খাদ থেকে বেঁচে উঠবে কিভাবে জানা নেই। কিন্তু এরমাঝে রাফার কথায় মায়া বিরক্ত হয়ে বলল…

‘ কিভাবে উঠবো আবার? এই যে দেখ তোর মাথার উপর আমার জামাইর হেলিকপ্টার ঘুরে! দেখেছিস? এই হেলিকপ্টারে চড়ে আমি একা উপর উঠবো আর তোকে পাতার ভিতর কবর দিয়ে যাব। রাতে চিল্লাচিল্লি করছিলি না? মায়া আমি মরতে চাই না। বাঁচতে চাই। তো এখন বেঁচে থাক এই পাতার সাথে। আমাকে বলছিস কেন?

মায়া হেলিকপ্টারের কথাটা এমনই বলেছিল রাফাকে রেগে। মায়ার ঘুনাক্ষরেও ধারণা ছিল না সত্যি সত্যি রিদ হেলিকপ্টার নিয়ে ওর সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে পাহাড়ের বুকে। বা মায়ার মাথার উপর ঘুরতে থাকা হেলিকপ্টার গুলো সত্যিই ওর জামাইর হবে। মায়ার হেলিয়ে কথা গুলোই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। মায়াদের মাথার উপর ঘুরতে থাকা এক ক্যাপ্টেনের চোখে পড়লো খাদের অতলে থাকা মায়ার আর রাফার অল্প মুখটা। নড়াচড়া আর সন্দেহ বশে তৎক্ষনাৎ হেলিকপ্টার ঘুরে গেল মায়াদের আশেপাশে। রাফা তখন মায়ার কথায় বোকা হয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে এসে শরীর ঘেষতে চেয়ে বলল….

‘ মায়া শুননা। আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে এই খাদ থেকে বের হওয়ার।

রাগান্বিত মায়া আরও রেগে গেল রাফার শরীর ঘেঁষা দেখে। এমনই শরীর নিয়ে ঠায় পাচ্ছে না পাতার উপর কোথাও। তারউপর আবার শরীর প্রচুর জ্বালাপোড়া আর চুলকাচ্ছে তীব্র ভাবে, এমনত অবস্থায় রাফার শরীর ঘেঁষা মানে শরীরে জ্বালাপোড়া আরও বাড়িয়ে দেওয়া। মায়া পুনরায় রাফার উপর ক্ষেপে গিয়ে বলল…

‘ এই সর মাইয়া! একদম ঘেঁষাঘেঁষি করবি না। এমনই পাহাড়ী পাতার জ্বালায় শরীর চুলকাচ্ছে, এখন আবার তোর ঘেঁষাঘেঁষিতে শরীরে আগুন লাগছে রাফা। তুই সর! দূরে যাহ।

মায়ার কথায় রাফা নিজের শরীরে তৎক্ষনাৎ জ্বালাপোড়া আর তীব্র চুল্কানি অনুভব করতেই মায়ার কথায় তাল মিলিয়ে বলে উঠলো…

‘ আরে তাই তো। আমার শরীরও চুলকাচ্ছে কেন মায়া?

এমন একটা পরিস্থিতিতে রাফার এমন কথাটা বড্ড বেমানান লাগল মায়ার কাছে। ওরা পাহাড়ি পাতার খাদে ডুবে আছে রাত থেকে। এসব পাতার ভিতরে অবশ্যই বিষাক্ত পোকামাকড় থেকে শুরু করে বিষাক্ত সাপের বসবাসও রয়েছে। আল্লাহ সহায় বলে এখনো পযন্ত এসব পাতার ভিতর থেকে কোনো বিষধর সাপ উঠে আসেনি আর ওদের কামড়ায়নি। কিন্তু তাই বলে আর কতক্ষণ বাঁচবে ওরা এইভাবে? আল্লাহ না করুক পাহাড়ি কোনো বিষধর সাপের তাড়নায় পরলো দুজনের জান যাবে দুই সুবলে। আর এখন দুজনের গা চুল্কাচ্ছে হয়তো এসব পাতার ভিতরে থাকা বিষাক্ত পোকামাকড় উঠেছে ওদের গায়ে সেজন্য শরীর জ্বালাপোড়া আর তীব্র চুল্কানী হচ্ছে। মায়া রাফার কথার ত্যাড়া উত্তর দিতে দিতে বলল…

‘ তোর শরীরে আমি রাতে চুলকানির পাউডার ঢেলেছিলাম মনে নেই? সেজন্য তোর শরীর এখন জ্বালাপোড়া করছে বুঝিছিস। তুই আম..

মায়ার কথা শেষ করার আগেই দেখল চোখে সামনে অল্প দূরত্বে একটা হেলিকপ্টারকে তীব্র গমগমে শব্দ তুলে নামতে। সেখানে থেকে ক্যাপ্টেন আর দুজন বডিগার্ড দৌড়ে আসলো মায়াদের উদ্দেশ্যে। সত্যি সত্যি মায়াদের খোঁজ পেয়ে তৎক্ষনাৎ খবর পাঠাল একজন বডিগার্ড রিদের কাছে। রিদ তখন আকাশের বুকেই উড়ে বেড়াচ্ছিল মায়াদের খোঁজে। খবর পেতেই রিদের হেলিকপ্টারটিও ঘুরে গেল মায়াদের উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে এগিয়ে আসা ক্যাপ্টেন আর দুজন বডিগার্ড সাহায্য করলো মায়াদেরকে উপরে তুলতে। দড়ি ফেলে দুজনকে টেনে তুলতেই মায়া রাফা মাটির উপর শুয়ে পরলো শরীরে তীব্র ব্যথা আঁচড়ে পরে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে দুজনই উঠে বসল আহত দূর্বল শরীরে। নিজেদের শরীরের দিকে তাকাতে দুজনই ভূত দেখার মতোন আতঙ্কে উঠে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবারও নিজেদের শরীরের দিকে তাকাল ঘুরে। পুরো শরীরে জায়গা জায়গা কাটাছেঁড়ার দাগ। রাতে পাহাড়ের উঁচুনিচু পথে দৌড়াতে গিয়ে শরীরের জায়গা জায়গা কেটেছে পাহাড়ি ছোট-বড়ো গাছে লেগে। অসংখ্য বারতো দুজন পাহাড়ের পথে দৌড়াতে গিয়েও পরেছিল রাতে। মায়া নিজের শরীর দেখে আহাজারি করে উঠলো। গায়ের সাদা কলেজ ড্রেসটাও শেষ। পাহাড়ি লাল মাটিতে লাল লাল হয়ে আছে, সেই সাথে বেশ কয়েক জায়গা গাছের ঢালে টান গেলে ছিঁড়েও গেছে। মায়ার হিজাব কই পরেছে কে জানে? গায়ের ক্রসিং বেল্টটাও পায়ের ক্ষতে বাঁধা। মায়ার নতুন কলেজ ড্রেস ছিল এটা। মাত্রই কয়েকদিন আগে বানিয়েছিল। আজ রাফার জন্য ড্রেসটা শেষ। মায়া দূর্বল শরীরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজের গায়ের ড্রেসটার দিকে তাকিয়ে রাফার উদ্দেশ্য মেজাজ দেখিয়ে বলল…

‘ তুই আমারে সাবান কিন্না দিবি রাফা। দেখ তোর জন্য আমার নতুন ড্রেসটার ইজ্জত শেষ। তুই শুধু সাবান না তুই আমার ড্রেস ধুইয়া দিবি, তারপর ছেঁড়া জায়গা গুলো সেলাই পযন্ত কইরা দিবি নয়তো তোর খবর আছে। দেখিস!

রাফা মায়ার গায়ের ড্রেসটার দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি ড্রেসটা ছিঁড়ে গেছে। রাফা মায়াকে শুধিয়ে কিছু বলতে চাইবে তার আগেই ক্যাপ্টেন হাতের দুটো পানির বোতল মায়া রাফার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ আপনারা ঠিক আছেন মিস? নিন একটু পানি পান করুন দুজন।

মায়া রাফা দুজনই নিজেদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতে দেখল ক্যাপ্টেন পানি বোতল হাতে মায়াদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ার হাতে ড্রেসটা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বডিগার্ড গুলো মায়ার কেমন চেনা চেনা লাগল। কিন্তু ক্যাপ্টেনকে অপরিচিতই লাগল। মায়া আমতাআমতা করে পানিটা হাতে নিলো। কে বা কারা হবে মানুষ গুলো কে জানে? মায়াতো তাদের চিনে না। এখন এই মানুষ গুলো যদি সাহায্যের নাম করে পুনরায় মায়াদের ক্ষতি করতে চাই তাহলে আর লড়াই করার মতোন এনার্জি মায়াদের শরীরের অবশিষ্ট নেই। মায়া সর্তকতা অবলম্বন করে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে ভয়ার্ত মুখে আমতাআমতা করে জানতে চেয়ে বলল…

‘ আপনারা কারা?

ক্যাপ্টেন অতি ভদ্রতা বজায় রেখে আন্তরিকতার সঙ্গে মায়ার কথায় উত্তর দিতে দিতে বলতে চাইল…

‘ আমরা রিদ খানে লোক ম্যাডাম। আপনাদের খোঁজে পুরো পাহাড়ের অভিযান চলছে। রিদ খান আপনা…

ক্যাপ্টেনের বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই মায়াদের মাথা উপর দেখা গেল পরপর দু’টো হেলিকপ্টারের উপস্থিতি। মায়া রিদের নামটা শুনতেই মূহুর্তে মনে পরলো রাতে কল করেছিল রিদকে মায়া। নিশ্চয়ই মায়াকে খুঁজতে ওর স্বামী আসবে এটাই স্বাভাবিক। ইশ মায়া নিজের আতঙ্কে কিভাবে ভুলে গেল নিজের স্বামী কথা। রাতে যে আবেগ ঢেলে স্বামীকে ফোন করেছিল এখন ততোটা মারাত্মক ভাবে ওকে খোঁজছে হয়তো। ইশ মায়াতো রাতে মরলোই না উল্টো নিজের জন্য বিপদ বাড়াল স্বামীকে কলটা করে। ওর স্বামী যে মানুষ, মায়াকে সামনে পেলে আস্ত রাখবে না এইবার। এই লোক তো জীবনেও কোনো কিছু ভুলে না। কড়ায় কড়ায় হিসাব করবে মায়া থেকে সবকিছুর। মায়ার না বলে ট্যুরে আসাটা তো মারাত্মক পাপ ছিল। ইশ মায়া শেষ। জীবনটা তচনচ হয়ে যাবে যদি একবার পাষাণ জামাইর হাতে ধরা পরে তো। জঙ্গি ছেলেদের হাতে থেকে বাঁচল, পাহাড়ের এতো উঁচু থেকে লাফ দিয়েও মায়া মরল না। কিন্তু জামাইর হাতে ধরা পরার ভয়ে আর আতঙ্কে মায়া এইবার মারা যাবে নিশ্চিত। আল্লাহ জানে ফ্রীতে কয়টা থাপ্পড় পরে গালে? মায়া যতগুলো অপরাধ করেছে এতে শুধু থাপ্পড়ে নয় আরও ভয়ংকর কিছু ওর কপালে আছে। কতোদিন মায়া রিদকে ইগনোর করলো, যোগাযোগ বন্ধ রাখল। মিথ্যা বলে এঙ্গেস্ট হলো অন্য কারও সাথে। তারপর আবার না করা শর্তেও অবাধ্য হয়ে ট্যুরে এসে নিজের বিপদ বাড়াল। আল্লাহ এতো অপরাধ মায়া কখন করলো? আতঙ্কে মায়ার মাথা ঘুরে চক্কর কাটার মতোন চোখে ঝলমল করলো নিজের অপরাধের হিসাবটা গুলো। আচ্ছা মায়া নিজের স্বামীর হাত থেকে বাঁচতে বেহুশ হওয়ার নাটক করলে কেমন হবে? দরকার হলে আগামী সাতদিন মায়া বেহুশ হয়ে পরে থাকবে হসপিটালের তারপরও চোখ খুলবে না। যেদিন বুঝবে পরিবেশ ঠান্ডা হয়েছে সেদিন না-হয় মায়া চোখ খুলে দুনিয়াটা দেখবে ততদিন না-হয় ওহ বেহুশই থাকল। আতঙ্কিত মায়া কি করবে তখনো বুঝতে না পেরে তৎক্ষনাৎ মাথার উপর তাকাল। অল্প দূরত্বে উড়তে থাকা হেলিকপ্টার গুলোকে মাটিতে নামতে দেখে মায়া কলিজা লাফিয়ে উঠলো ভয়ে। রিদ পারে না হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে পরতে মায়াকে সুস্থ সবল অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। অস্থির, উত্তেজিত রিদ হেলিকপ্টার নামার আগেই সেখানে থেকে লাফিয়ে পরলো। রিদকে হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখে আতঙ্কিত মায়া তৎক্ষনাৎ রাফার হাত চেপে ধরল পালানোর উদ্দেশ্য। রিদকে মায়াদের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে দেখে মায়া আতঙ্কিত মুখে চেঁচিয়ে উঠে বলল…

‘ রাফারে আমি শেষ। এতক্ষণ না মরলেও এবার নিশ্চিত মরবো। দ্রুত পালা রাফা।

বলতে বলতে মায়া রাফার হাত চেপে উল্টো পথে দৌড়াল রিদের হাত থেকে বাঁচতে। উপস্থিত দুজন বডিগার্ডসহ ক্যাপ্টেন তিনজনই বোকার মতোন থমথমে খেয়ে গেল মায়াকে রিদের ভয়ে দৌড়াতে দেখে। যে রিদ খান রাত থেকে পাগলের মতোন অবিরাম বউকে খোঁজে বেড়াচ্ছে সেই বউ রিদ খানকে ভয় পাচ্ছে কেন সেটা বুঝল না ক্যাপ্টেন।
মায়াকে রিদের ভয়ে পালাতে দেখে রিদ মেজাজ হারিয়ে চেঁচাল তৎক্ষনাৎ। মায়ার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল….

‘ রিততত দাঁড়া! আমি ধরতে পারলে তোর খবর আছে।

রিদের প্রতিটা চিৎকারে মায়ার কলিজা পযন্ত নড়ছে ভয়ে আতঙ্কে। রিদ যতো চেঁচাচ্ছেন মায়া ততই দৌড়াচ্ছে ভয়ে। মায়া সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাফা আর দৌড়ে পারলো না। কারণ শরীর ভেঙ্গে আসছে আঘাতে আঘাতে ব্যথায়। এতোকিছু ঘটে যাওয়ার পর পুনরায় নতুন করে দৌড়ানোর মতোন শক্তি দুজনে শরীরেই নেই। মায়া নিজেও এই অবস্থায় দৌড়ানোর সাহস পেত না। কিন্তু রিদের ভয়ে শরীরে ব্যথা ভুলে শুধু আতঙ্কে দৌড়াতে লাগল। রাফাকে থেমে যেতে দেখে মায়া পুনরায় রাফার হাত চেপে দৌড়াতে চাইলে রাফা দূর্বলতায় হাফাতে হাফাতে নাহুচ করে বলল…

‘ আমরা দৌড়াচ্ছি কেন মায়া? কার ভয়ে? এখানে সবাই তো আমাদের উপকার করতে এসেছে। রিদ খানকে তো আমরা চিনি। তাহলে আমরা আবার দৌড়াচ্ছি কেন?

আতঙ্কিত মায়া রাফার পিছনে রিদের দৌড়ে আসা দেখে রাফার কথা শেষ করার আগে আগেই বলল…

‘ তোর না দৌড়ালেও চলবে। তোকে কেউ কিছু করবে না। কিন্তু আমাকে ধরতে পারলে আস্ত রাখবে না। গেলাম আমি।

বলতে বলতে মায়া পুনরায় দৌড়াল রাফাকে ফেলে। ততক্ষণে রিদ মায়ার অনেকটাই কাছে। একজন তাগড়া বলিষ্ঠবান মানুষের দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবশ্যই একজন কিশোরী মেয়ে পারবে না কখনো। হলোও তাই। চোখের পলকে কয়েক সেকেন্ড ব্যবধানে মায়ার পা শূন্য উঠে গেল। মায়ার ছোট দেহ বন্দী হলো রিদের বাহুতে। পিছন থেকে মায়াকে আঁকড়ে শূন্যে তুলতেই রিদ নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে ঘুরে গেল মায়াকে নিয়ে। খেই হারিয়ে পড়তে নিলেই মায়াকে নিয়ে মাটিতে বসে গেল রওূ ঝাপটে ধরে। আতঙ্কিত মায়া আরও আতঙ্কিত হলো রিদের ভয়ে। নিজের পিঠ রিদের বুকে ঠেকে যেতেই ভয়ার্ত মায়া
আতঙ্কিত গলায় চেঁচিয়ে রিদের কাছে ক্ষমা চাইল অনবরত…

‘ আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ। আমি আর জীবনেও আপনার অবাধ্য হবো না। এটাই শেষ বার। প্লিজ প্লিজ মাফ চাই। আল্লাহ গো।

রিদের ভয়ে রীতিমতো মায়া থরথর করে কাঁপছিল অস্থির উত্তেজনায়। কিন্তু আতঙ্কিত মায়ার পিছনে ঝাপটে জড়িয়ে থাকা রিদের মনোভাব ছিল ভিন্ন। বউকে হারিয়ে কতোটা টানাপোড়ার দহনে কেটে রিদের বিগত সময় গুলো সেটা শুধু রিদই জানে। মায়া যদি জানতো তাহলে এই মূহুর্তে রিদকে ভয় নয় বরং অন্য কিছু করতো। ঝাপটে জড়িয়ে রিদের অশান্ত বুক শান্ত করতো। কিন্তু মায়া রিদের শত পাগলামো সম্পর্কে অবগত ছিল না। যার জন্য রিদকে এই মূহুর্তে ভয় পাওয়া ছাড়া অন্য কিছুই মায়ার মাথায় ছিল না। ঘায়েল রিদ মায়াকে জড়িয়ে ধরতেই চুপ করে গেল। রিদের ভয়ংকর নিশ্চুপতা বর্ণনা করছে তার রুহ ফিরে পেয়েছে মায়াকে পেয়ে । গোটা রাত থেকে এই পযন্ত রিদ হারানো তীব্র দহনে পুড়চ্ছিল এতক্ষণ। মায়াকে সামনে পেয়ে রিদের আঁটকে আসার শ্বাসটা যেন ধীরে চলছে থেমে থেমে। রিদ মায়াকে পিছন থেকে ঝাপটে জড়িয়ে সেই অবস্থায় হাঁটু গেড়ে বসে থাকল মাটিতে। নিজের বলিষ্ঠ দেহে মায়াকে বন্দী করতে করতে মুখ ডুবাল মায়ার কাঁধে। মায়া শরীর তখনো টকটক করে কাপছিল রিদের ভয়ে। আতঙ্কিত মায়া আরও অনুভব করলো একই ভঙ্গিতে রিদের শক্তিপোক্ত দেহটাও কাপছিল মায়াকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়। মায়া বুঝল না রিদের অস্থির, উত্তেজনা, আর ভয়ংকর শরীর কম্পনের বিষয়টা। বুঝার কথাও না। মায়া দেখেনি রিদের শত পাগলানো গুলো মায়াকে হারিয়ে। মায়ার শুধু মনে হচ্ছে মায়া ভিষণ অন্যায় করেছে আর এরজন্য রিদ ওকে ভয়ংকর শাস্তি দিতে পারে। মায়া রিদের শাস্তি থেকে বাঁচতে পুনরায় একই আতঙ্কিত, অস্থির গলায় রিদকে মিথ্যা বলে বলল…

‘ আমাকে মারবেন না কেমন? আমি কিন্তু ইচ্ছা করে কিছু করিনি। আমি ট্যুরেও আসতে চাইনি। আমার আব্বু বলেছিল জুই সাথে আসতে। সেজন্য এসেছি। সত্যি বলছি।

নিশ্চুপ রিদ তখনো একই ভাবে মায়ার কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে মায়াকে ঝাপটে জড়িয়ে বসে রইল। রিদের নিশ্চুপতা আর ধীরে ধীরে নিশ্বাসের গতি বলছে সে কতোটা ক্লান্ত। মায়া রিদের মুখটা দেখতে পারলো না, তবে মায়ার মনে হলো রিদ হয়তো ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছে মায়ার কাঁধে। আচ্ছা এতো অল্প সেকেন্ড মাঝে কেউ ঘুমাতে পারে নাকি? মায়া জানে রিদ ঘুমাইনি কিন্তু কিসের জন্য এতো ক্লান্তিতে আছেন উনি? মানুষটা কি কোনো কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল এতক্ষণ? মায়াকে নিয়ে টেনশনে ছিল তাহলে? হ্যাঁ মায়াকে নিয়ে টেনশনে থাকতেই পারে। মায়াতো নিখোঁজ ছিল এতোটা সময়। মায়াকে নিয়ে চিন্তিত থাকলে তাহলে নিশ্চয়ই ওর স্বামী ওকে আর শাস্তি দিবে না কোনো কিছু নিয়ে। মায়া এমনই বেঁচে যাবে। এই অস্থির পরিস্থিতিতে মায়া শুধু রিদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর কথায় ঘুরলো। অথচ মায়াকে জীবিত অবস্থায় পেয়ে যে কারও আটকে থাকা শ্বাসটা চলছে ক্রমই সেটা বুঝল না সে। মায়া এবার নিজেও চুপ করে গেল রিদের ভয়ে। সময় নিয়ে রিদ সুস্হির হতে হতে নিজের হাতে বন্ধন শক্ত করলো মায়ার শরীরে উপর….

‘ আমাকে মানুষ মনে হয়না তোর?

রিদের হাত মায়ার শরীরে শক্ত হয়ে আসতেই মায়া ভয়ে অস্থির গলায় আওড়াল….

‘ এ্যাঁ মনে হয়! মনে হয়! আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর জীবনেও কিছু করবো না আপনার কথা বাইরে। প্লিজ মাফ করে দিন। প্লিজ! প্লিজ!

মায়ার মাফ চাওয়ার মধ্যেই রিদ ঠাস করে মায়াকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে মায়াকে কোলে তুলে নিলো মূহুর্তে। আতঙ্কিত মায়া রিদের গলা জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ধরতে পারলো না। দুহাতে তীব্র শরীর চুলকাতে চুলকাতে রিদের দিকে ভয়ার্ত মুখে তাকিয়ে বলল…

‘ আমাকে কিন্তু ফেলবেন না কেমন। আমার শরীরের এমনই অনেক ব্যথা।

চোয়াল শক্ত করে রিদ মায়াকে নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ল। মায়ার সাথে একটা শব্দ পযন্ত ব্যয় করলো না। আর না মায়াকে কোল ছাড়া করলো। অপরাধী মায়া মুখে চুপ থাকলেও শরীরের ভঙ্গিতে ছিল ভিন্ন। বারবার গলা, হাতে, কাধে, পিঠে পেটে পায়ে চুলকাচ্ছিল রিদের কোলে বসে। মায়াকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টা মূহুর্তের মাঝে ছড়িয়ে পরলো সবার মাঝে। সবার খোঁজা খুঁজি বন্ধ হলো। রিদ মিনিট পাঁচেক মতো সময় ব্যয় হলো তাবুতে ফিরতে। যেহেতু পূর্ব থেকে ডাক্তারের ব্যবস্থা ছিল সেজন্য মায়াকে নিয়ে তেমন সমস্যা হলো না রিদের। রাউন্ড রাউন্ড পাখা ঘুরে তাবুর বাহিরে হেলিকপ্টার নামতে রিদ মায়াকে কোলে নিয়ে নামল সেখান থেকে। নিহাল খান সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। রিদের কোলে কোনো মেয়েকে দেখে তিনি বুঝল এটি হয়তো রিদের হারিয়ে যাওয়া বউ হবে। তিনি এর আগেও একবার মায়াকে দেখেছিল নিজেদের বাড়িতে আরিফের সঙ্গে। কিন্তু তখন এতো গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি সেজন্য মেয়েটির ফেইস উনার মনে ছিল না। নিহাল খান এগিয়ে এসে রিদকে ডাকলে রিদ তাবুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল…

‘ নট নাউ বাবা।

মায়া রিদের কোলে গা চুল্কাতে চুল্কাতে রিদের বাবার দিকে তাকাল সে। রিদের বাবাকে চিনতে মায়ার একটুও দেরি হয়নি। কিন্তু উনাকে এই পাহাড়ি এলাকায় দেখে মায়া আবাকই হলো। উনি কেন এখানে এসেছেন? কিসের জন্য? মায়ার খোঁজে বড়োজোর মায়ার স্বামী আসতে পারে কিন্তু শশুর মশাই কেন আসবে? মায়া ভাবনা চিন্তা মাঝেই রিদ ডাক্তারের ক্যাম্পে এগোল। দুজন ডাক্তার এগিয়ে আসতেই রিদ তাদের উদ্দেশ্য শক্ত গলায় বলল…

‘ আপনারা বাহিরে অপেক্ষা করুন। প্রয়োজনে ডাকবো আমি।

একজন ডাক্তার আপত্তি জানাতে চাইল মায়াকে শরীর চুলকাতে দেখে রিদকে বলতে চাইল…

‘ উনার বডি ক্লিন ওয়াশ করতে হবে মিস্টার খান। বিষাক্ত কোনো ভাইরাস শরীরে…

ডাক্তারে কথা শেষ করার আগেই রিদ মেজাজ হারিয়ে দাঁত পিষে বলল…

‘ জ্ঞান দিতে বলছি? অন্য কাউকে জয়েন করেন যান! এটা আপনার পেশেন্ট নয়।

ডাক্তার চুপ করে যেতেই রিদ মায়াকে নিয়ে তাবুতে ডুকল। অনেক ছুঁড়ে ফেলার মতোন মায়াকে ফেলল কোল থেকে। তাবুর ভেতরে ডাক্তারী জিনিসপত্র রাখার টেবিলটি ধরে নিজেকে পরা থেকে বাঁচাল মায়া। একই ভঙ্গিতে গা চুল্কাতে চুল্কাতে রিদের দিকে ভয়ার্ত মুখে তাকাতে দেখল, রিদ তাবুর ভিতরে বড়ো বড়ো পানি কন্টেইনার খোলে তাতে অ্যান্টাসিটিক ঢালছে একের পর এক। মায়া তাঁবুর এককোনায় দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত মুখে রিদের কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল।
রিদের তেজি কর্মকান্ড বলছে সে কতোটা রাগ
কন্ট্রোল করতে চাচ্ছে চোয়াল শক্ত করে। মিনিট দুইয়েক সময় ব্যয় করে রিদ সবগুলো পানির কন্টেইনারে অ্যান্টাসিটিক মিশাল। বলিষ্ঠ হাতে সেই কন্টেইনার উঠিয়ে চোখের পলকে ঢালল মায়ার মাথায়। ডেটলের পানি মায়ার কাটা ছেঁড়ার শরীর বেয়ে পড়তেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মায়ার
গা। শরীরে তীব্র জ্বালাপোড়া আর মরিচের মতোন দহন অনুভব করতেই মায়া গলা কাটা মুরগীর নেয় ছটফটিয়ে চিৎকার করে উঠলো লাফাতে লাফাতে। পাষান্ড রিদ একে পর এক পানির কন্টেইনার ঢেলে শেষ করতে লাগল মায়ার উপর। লাফালাফিতে মায়া সরে যেতে চাইলে রিদ শক্ত হাত মায়াকে চেপে ততই পানি দিতে লাগল মায়ার উপর। এতে করে রিদ নিজেও ভিজে গেল মায়ার সাথে। ব্যথায় আর্তনাদের মায়া ছটফটিয়ে চিৎকার করে রিদকে থামাতে চেয়ে বলল….

‘ প্লিজ আর না। আর না। আমার শরীর ভিষণ জ্বলছে। কি যেন আরও বেশি বেশি কামড়াচ্ছে শরীরে।

বলেই মায়া কাঁধে পিঠে বেশি বেশি করে হাত চালাতে লাগল অস্থির ভঙ্গিতে। রিদ চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে মায়ার মাথায় শেষ পানিটুকু ঠেলে হাতে কন্টেইনারটি দূরে উল্টে ফেলে তৎক্ষনাৎ মায়াকে চেপে ধরলো টেবিলে সঙ্গে। মায়া টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়তেই রিদ পিছনে থেকে মায়ার জামার চেইন কাঁধ থেকে টেনে মূহুর্তে মাঝে কোমরে নামিয়ে নিল। রিদের হঠাৎ কান্ডে মায়া প্রস্তুত ছিল না। লজ্জায় আতঙ্কে মায়া নিজের জামার আঁকড়ে ধরে ঘুরে যেতে চেয়ে আঁতকে উঠে বলল…

‘ এই কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।

রিদ মায়ার কাধের জামাটা টেনে ওর বাহু ছাড়িয়ে কুইন অবধি নামাতে নামাতে রাগে দাঁত দাঁত পিষে ধমক উঠলো রিদ…

‘ চুপ!

মায়া চুপ করতে পারলো না। লজ্জা শরমে সিঁটিয়ে নিজের বাহুর নিচে পরে থাকা জামাটা টেনে উঠাতে চাইলে রিদ একই ভাবে মায়ার সামনে থেকে টেবিলের উপর থাকা ডাক্তারি সেজার্স উঠাল হাতে। দক্ষ হাতে মায়ার কাঁধে কি করতে লাগল মায়ার জানা না। কিন্তু রিদ মায়ার কাঁধে হাত দেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই মায়ার কাঁধের সেই জায়গাটা হাল্কা অনুভব করলো। কি যেন একটা সরিয়ে দিল রিদ সেখান থেকে। মায়া বুঝতে পারলো রিদ হয়তো মায়ার শরীর থেকে কিছু ফেলতে সাহায্য করছে মায়াকে। রিদ মায়া কাঁধ থেকে পিঠে নেমে গেল। খোলা পিঠে সেজার্স সাহায্যে রিদ কি ফেলছিল মায়ার শরীরে থেকে মায়া সেটা তখনো বুঝলো না। তবে মায়া কেমন একটা অনুভব করছিল পিঠে। মায়া নিজের ছটফট আর চিৎকার থেমে গেল রিদকে ডাক্তারি করতে দেখে। লোকটা কি ডাক্তারী জানে নাকি? এতো দক্ষ হাত কিভাবে চালাচ্ছে মায়ার পিঠে? তখন ডাক্তার গুলাকেও এলাউ করলো না মায়াকে দেখতে। নিজে নিজেই ডাক্তারী করছে। মায়ার কৌতূহল জাগল রিদ মায়ার পিঠে কি এমন করছে সেটা জানতে। অধৈর্য্য মায়া কান্না থামাতে চেয়ে নাক টেনে কৌতূহলী হয়ে বলল…

‘ কি আছে আমার পিঠে? কি করছেন আপনি?

মায়া পিঠে পাহাড়ি জোঁকের বাসা বেঁবেছে রক্তে আভাস পেয়ে। সেজন্য এতক্ষণ যাবত শরীর চুলকাচ্ছিল মায়া। শরীরে জ্বালাপোড়া অনুভব সেখান থেকেই হচ্ছিল। রক্তচোষা জোঁক গুলো বেশ বড়সড় হতে পারেনি। এরমানে বেশি সময় হয়নি জোঁকের পাল্লায় পরতে মায়াকে। মায়ার শরীরের আরও জায়গা জায়গায় এসব রক্তচোষা জোঁক থাকতে পারে সেটা রিদের ধারণা। যে জায়গা থেকে মায়াকে উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে এসব পাহাড়ি জোঁকে বসবাস হবে সেটাই স্বাভাবিক। রিদ মায়াকে একই ভাবে ধমক দিল চুপ করাতে চেয়ে…

‘ চুপ থাকতে বলছি না?

রিদের ধমকে মায়া গাল ফুলিয়ে বলল…

‘ আপনি সবসময় আমাকে ধমকে রাখেন।

মায়ায় কথায় রিদ একই ভাবে দাঁত পিষে বলল…

‘ শাসনে থাকিস তারপরও পোষ মানিস না। ছেড়ে দিলে কি করবি? উড়ে যাবি?

রিদের ত্যাড়া কথায় মায়া দুঃখ প্রকাশ করে বলল…

‘ আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। একটুও পছন্দ করেন না। মানুষের বউ হারালে কতকিছু করে, কষ্ট পায়, কান্নাকাটি করে। আর আপনি আমার জন্য কষ্টও পাননি, কান্নাকাটি ও করেননি। উল্টো আমি সুস্থ ফিরে আসাতে মেজাজ দেখাচ্ছেন।

‘ তুই আমার জনম জনমের শত্রু হুস সেজন্য তোকে মেজাজ দেখায়। হয়েছে শান্তি?

রিদ দাঁড়িয়ে থাকা থেকে পাশের চেয়ারটা টেনে বসল মায়ার কোমরে হাত রেখে। গায়ের জামাটা উপরে উঠাতে চাইলে মায়া লজ্জা বাধা দিতে চাইল রিদকে। রিদ মায়ার হাতটা একই ভা ঝাড়া দিয়ে ফেলতেই মায়া লজ্জায় সিঁটিয়ে গেল। রিদ মায়ার কোমরে বামপাশ থেকে জোঁকের কামড় ছাড়ানোর মধ্যে মায়া মিনমিন গলায় রিদকে বলল…

‘ আমাকে আপনি শত্রু ভাবেন। আর আমি আপনাকে কতো আপন ভাবি। আজ যদি আমি বেঁচে না ফিরতাম তখন কি করতেন আপনি?

রিদের কাটকাট উত্তর আসলো তক্ষুনি…

‘ আরেকটা বিয়ে করতাম আমি।

রিদের কথায় মায়ার রাগে নাকের ফাটা ফুলে গেল মূহুর্তে। মায়া না থাকলে রিদ আবার বিয়ে করে নিবে বিষয়টা বেশ অপমানজনক মনে হলো মায়ার। মায়া রিদের হাতটা নিজের কোমর থেকে ঝাড়া মেরে ফেলে দিতে দিতে অভিমান গলায় বলল…

‘ সেজন্যই আমি মরেনি। আর মরবো না।

‘ শিট! আমার বিশাল লস হয়ে গেল।

রিদের হেলিয়ে কথায় মায়া অভিমান পাল্লা ভারি হলো…

‘ আপনি বিয়ে করলে আমিও একটা বিয়ে কর….

‘ এই চুপ!!

মায়া নিজের কথাটা শেষ করতে পারলো না আর। তার আগেই রিদের হিংস্রত্ব ধমকে চমকে উঠার মতোন ঘুরে তাকানোর আগেই রিদের শক্ত হাতের থাবা পরে মায়া দু’গালে।
শান্ত থাকা রিদের মেজাজ মূহুর্তে চটে গেল মায়ার মুখে দ্বিতীয় বিয়ে কথা শুনে। রিদ মজা করেও মায়ার মুখে অন্য কারও নাম সহ্য করতে পারে না বিশেষ করে কাল রাতে পর, রিদের মনে হয় জীবনের কোনো কিছুর বিনিময় হলেও বউকে হারাতে রাজি নয় সে। তার বউকে চাই মানে চাই। সেখানে মায়ার মুখে দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টা রিদের মেজাজ বিগড়ানো কারণ হলো। সে এমনই মায়ার উপর চটে ছিল। দাঁতে দাত কামড়ে এতক্ষণ চুপ ছিল বউয়ের আঘাতে শরীর দেখে তারমানে এই না বউ তার যা খুশি তাই বলবে? আর রিদ চুপ থাকবে? মায়ার কথা শেষ হবার আগেই রিদ হিংস্রত্বে গর্জে উঠে তৎক্ষনাৎ থাবা বসাল মায়ার গাল চেপে। রিদের উঠে দাঁড়ানোর তেজে চোখে পলকে চেয়ার উল্টে পরলো মাটিতে। মায়ার গালের দুমারি রিদের হাতে পিষ্ট হতেই মায়া ছটফটিয়ে উঠে নিজের গাল রিদের হাত থেকে ছাড়াতে চেয়ে কোনো রকমে আওড়াল..

‘ উফফ! ছাড়ুন আমাকে পাষাণ লোক! ব্যথা লাগছে আমার।

‘ লাগুক! জানের ভয় নাই না? কলিজা নড়ে না? আমার সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় পুরুষের নাম নিতে বুক কাঁপলনা না? জবান কেটে হাতে ধরিয়ে দিব রিত। যে জবানে আমি ছাড়া অন্য কারও নাম আসবে সেই জবানের দরকার নেই আমার। বোবা বউ চলবে কিন্তু বেঈমানী? উহুম! নট এলাউ।

#চলিত…