#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৪১_প্রথমাংশ
সময়টা ১১ঃ৪৫ ঘরে! চাঁদ বিহীন আকাশে অসংখ্য তাঁরা মেলা। ঠান্ডা ফুরফুরে বাতাস গা ছুঁয়ে মন সিক্ত করছে। জুই তিনতলা ভবনের এককোণে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে সিক্ত নুনা চোখে। বাহিরের পরিবেশটা যতটা শান্ত জুইয়ের ভিতরটা ততটাই অশান্ত। বিগত গোটা একটা দিন একটা রাতের ব্যবধানে কতো কিছু ঘটে গেল জুইদের জীবনে। মায়া রাঙ্গামাটিতে হারিয়ে আজ অচেতন অবস্থায় হসপিটালের বেডে পরে। মায়াকে খুঁজতে গিয়ে আরিফও হসপিটালের একই অবস্থায় শুয়ে। আপন দুটো মানুষকে এইভাবে বেডে অচেতন অবস্থায় পরে থাকতে দেখে জুইয়ের ভিতরটা বারবার হু হু করে কেঁদে উঠছে বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায়। এইতো সন্ধ্যার নাগাদ জুইকে কলেজ টিচারের বাসায় থেকে হসপিটালের নিয়ে এসেছে আসিফ। এখানে আসার পর থেকে মায়া আর আরিফকে অচেতন অবস্থায় কেবিনে পেয়েছে জুঁই। নিজের ভাই বোন দুজনকে অসুস্থ অবস্থায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি জুঁই হাউমাউ করে কেঁদেছিল তখন। তবে জুইকে সামলাতে আয়ন, আসিফ দুজনকেই পাশে পেয়েছিল সে। এই অসময়ে বিপদে যেখানে জুইদের পরিবারই পাশে নেই সেখানে আয়নদের ডাল হয়ে দাঁড়ানোটা ছিল ঘোর অন্ধকারে বিশাল আলোর নেয় আস্থাবহল। আরিফ, মায়ার হসপিটালের তদারকি থেকে জুইয়ের খেয়াল পযন্ত রাখছে এই দুজন মানুষ। আয়ন প্রোফেশনালি ডাক্তার হওয়ায় আরিফ, মায়ার চিকিৎসার তদারকি সে নিজেই করছে। আর আসিফের কথা যত বলবে ততই কম মনে হবে জুইয়ের। চমৎকার একটি মানুষ। অসাধারণ দায়িত্ববান পুরুষ। কেউ সামান্য চাকরির জন্য তার মালিকের এতোটা বিশ্বস্ত আর আপন হয়ে থাকতে পারে সেটা আসিফকে না দেখলে বুঝতো না জুই।
আবছা আলোয় হঠাৎ নিজের উপর কারও কালো ছায়া পড়তেই বিষন্ন জুই গ্রিল থেকে মাথা উঠিয়ে পিছনে তাকাল। দরজার সামনে আয়নকে দেখতে পেয়েই অস্বস্তিতে আছড়ে পরলো জুই। না চাইতেও আয়নের সঙ্গে পুরনো অতীত গুলো স্মৃতিচারণ হতেই জুই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দু’হাত কুচলালো অস্বস্তিতে। এলোমেলো দৃষ্টিতে ফ্লোরে ফেলে মিহি স্বরে জিগ্যেসা করল…
‘ কিছু বলবেন?
‘ কিছু না বললে কি এখানে দাঁড়ানো যাবে না মিস জুঁই?
আয়নের কাটকাট কথায় কিছুটা রাগের আভাস পেল জুই। রাগটা কিসের তা বুঝতে দেরি হলো না জুইয়ের। জুইয়ের বিচলিতা বাড়লো। আয়নকে এরাতে চেয়ে বলল…
‘ তা কেন হবে? আপনি বরং এখানেই দাঁড়ান আমি কক্ষে যাচ্ছি মায়ার পাশে।
কথা বলেই জুই এক প্রকার চোরের মতোন আয়নের পাশ কাটিয়ে তাড়াহুড়োয় চলে যেতে চাইলে বাঁধা দেয় আয়ন। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া জুইয়ের বাহু টেনে নিজের মুখোমুখি করতেই আয়নের কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়ানো চেষ্টা করে জুই খানিকটা শক্ত গলায় বলল…
‘ এসব কি ধরণের অভদ্রতা ডাক্তার সাহেব? হাতটা ছাড়ুন? যেতে দিন আমাকে।
আয়ন একই ভাবে জুইয়ের হাতটা চেপে ধরেই বলল…
‘ আমি এখন অভদ্র হয়ে গেলাম? তাহলে আমাকে আপনার মতো করে ভদ্রতা শেখান জুই। কিভাবে মানুষকে মায়ায় ফেলে চট করে ঘায়েব হয়ে যাওয়া যায় সেইসব শেখান। আমি আপনার কাছে থেকে সলিড ধোঁকাবাজি শেখতে চাই জুই। যেন একটা মানুষকে পুরো ধ্বংশ করার মতোন ক্ষমতা রাখে এমন বেঈমানী হতে চাই। শেখাবেন আমাকে? আপনি তো আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ভদ্র মানুষ। আপনি নিশ্চয়ই এসবে ডিগ্রিদারি ভদ্র মানুষ।
আয়নের জুইকে করা অপমানের কথায় জুই রাগে মেজাজ দেখিয়ে বলল..
‘ হাতটা ছাড়ুন! আপনি এখন বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। যেতে দিন আমাকে। ছাড়ুন!
জুইয়ের মেজাজে আয়নও মেজাজ দেখিয়ে বলল..
‘ কেন যেতে দিব? আমার কথা আগে শেষ হোক তারপর যাবেন আপনি। এখন বলুন এতোদিন আমার কল ধরেন নি কেন আপনি?
‘ আমার ইচ্ছে করেনি তাই ধরেনি! কেন ধরবো আপনার ফোন? কে হোন আপনি আমার, যে সারভর ফোনে কথা বলতে হবে আমাকে?
বরাবরই জুইয়ের কথায় আয়নকে রাগ, ক্ষোভ কষ্ট দুটোই দেয়। এই মূহুর্তেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আয়ন জুইয়ের বাহু ঝাকিয়ে কানে টেনে রাগের তোপে বলল…
‘ ইচ্ছে করেনি তাই ধরেন নি তাই না? বিগত তিনটা মাস আমার সাথে কি ছিল আপনার হ্যাঁ? রাতভর ফোনে কি করতেন আমার সাথে আপনি? তখন আপনার মনে হয়নি আমি কে? কেন আমার সাথে তখন ফোনে কথা বলতেন? আপনি তো জানতেন আমাদের দুজনের মধ্যে কি সম্পর্ক চলছিল এতোদিন? তাহলে এখন না জানার ভান করছেন কেন?
জুইও একই ভাবে বলল…
‘ আমি যাকে মনে করেছিলাম সে আপনি নই। একটা ভুল বুঝাবুঝি সম্পর্ক ছিল বলে সেটা আমি শেষ করে দিয়েছি।
‘ আপনি একা শেষ করলে হবে? সম্পর্কটা ছিল আমাদের দুজনের। শেষ করতে হলে আমাদের দুজনের সমান মতামত থাকবে সেখানে, আপনি একার শেষ করার কে? আপনি কি শুধু একাই ছিলেন এই সম্পর্কে? আমি ছিলাম না? তাছাড়া
ভুল বুঝাবুঝি শুধু আপনার পক্ষ থেকে ছিল জুই, আমি শুরু থেকেই জানতাম ফোনের ওপাশের মানুষটা আপনি ছিলেন। আপনাকে জেনেশুনেই সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম আমি, তাহলে এখানে আমার দোষটা কোথায় সেটা বলবেন জুই? আমিতো আপনার কাছে যায় নি, আপনাকে ফোন করেনি, বরং আপনি আমার কাছে এসেছেন নিজের ভালোবাসা ঝুলি নিয়ে। আমাকে আপনার অভ্যাসে পরিণত করে হঠাৎ হারিয়ে গেলেন অন্য কারও অযুহাত দিয়ে। আপনি একটা বারও আমার কথা ভেবেছেন জুই? আপনাকে ছাড়া আমি কেমন থাকবো? আপনি তো আমাকে ভালোবাতেন জুই তাহলে কেন এমন করছেন? কেন আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছেন? সবটা ঠিক করে নেওয়া যায়না? আমিতো মানুষটা সেই আগেরই আছি, যার সাথে আপনি মন খোলে কথা বলতেন, সবকিছু শেয়ার করতেন তাহলে আপনি এখন কাকে খোঁজছেন জুই?
জেদ্দি জুই জেদ ধরেই বলল…
‘ বললাম তো সবটা ভুল বুঝাবুঝি ছিল। আমি আপনাকে কখনো ভালো বাসিনি।
জুইয়ের মুখে ‘আপনাকে কখনো ভালোবাসিনি’ কথাটা আয়নের বুকে কোথায় যেন একটা চিনচিন ব্যথা শুরু হলো গুমোটে। আয়ন সেইভাবেই বলল…
‘ তো কাকে ভালোবেসেন জুই? রাদিফকে? আমাদের ফোনে কথা বলার আগে রাদিফকে কইবার আপনি সরাসরি দেখেছেন জুই? একবার? এই একবার দেখাতে আপনি রাদিফকে এতোটা ভালোবাসলেন যে আমার সাথে তিনমাস এতো এতো কথা বলেও আপনার মনে আমার জন্য সামান্য ভালো লাগা সৃষ্টি হয়নি? আপনার সব ভালো গালা, ভালোবাসা, ফিলিংসের আদান প্রদান সবকিছু তো আপনি আমার সাথে শেয়ারিং করেছিলেন জুই, তাহলে আপনার সেই ফিলিংস গুলো কি মিথ্যা ছিল? আপনার ধারণা করা মানুষটা আমি হতে পারিনি বলে আমার সাথে সবকিছু আপনি মিথ্যা করে দিলেন জুই? রাদিফের সাথে তো আমার কোনো কিছুই ছিল না জুই। আপনার সকল স্মৃতি, সকল ভালো লাগার ফিলিংস তো আমার সাথে ছিল তাহলে আমি কিভাবে আপনার কিছু হলাম না? নাকি রাদিফের মতোন আমি ফর্সা নয় কালো মানুষ বলে আমাকে মেনে নিতে পারছেন না আপনি? কোনটা?
‘ এমন কিছুই না। হাতটা ছাড়ুন!
‘ তো কেমন কিছু জুই, বুঝান আমাকে। আপনার যদি আমার গায়ের রংয়ে সমস্যা না থাকে তাহলে কিসে সমস্যা? আমি রাদিফের বাবার মতোন বড়োলোক নয় সেজন্য ভাবছেন আপনি ঠকে যাবেন আমাকে নিয়ে। তাহলে আপনাকে বলে রাখি জুই, আমি একজন স্টাবলিশ কর্মজীবী মানুষ। আমার কর্ম আছে যেটা রাদিফের নেই। রাদিফের বাপ-ভাই বড়োলোক হলেও রাদিফ তার পরিবারের উপর নির্ভরশীল। রাদিফ এখনো নিজের পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি আর না কোনো চাকরি বা ব্যবসায় জড়িয়েছে। আপনি রাদিফকে এতো বড়োলোকী ভাব দেখছেন না সেটা শুধু রাদিফের বাবা-দাদার পৈতৃকসম্পত্তি দাপটে। সেই সম্পত্তির ভাগ কিন্তু আমার মারও আছে। সেক্ষেত্রে আমার পরিবারও কম যায় না খান পরিবার থেকে। হয়তো রিদের বিষয়টা আলাদা। রিদের নিজস্ব কর্ম আছে। সে একজন সফল ব্যবসায়ী। রিদের হয়তো বাপ-দাদার পৈতৃকসম্পত্তি ভাগের প্রয়োজন নেই কিন্তু রাদিফের এই মূহুর্তে তার পরিবার ছাড়া গোটা শূন্যতে আছে। সেক্ষেত্রে আমি আমার ওয়াইফকে বিলাসবহুল জীবন দিতে পারব জুই। আমার নিজস্ব গাড়ি-বাড়ি পেশা সবই আছে। আমার বাবার সম্পত্তির প্রয়োজন পড়বে না। আমি আপনাকে ভালো রাখতে পারবো জুই।
আয়নের কথায় জুইকে লোভী টাইপের মেয়ে মনে হলো। জুই কখনোই আয়নকে টাকা-পয়সা জন্য দূরে ঠেলে দেয়নি। জুই কোনো লোভী মেয়ে নয়। আয়নকে দূরে সরিয়ে রাখার পিছনে জুইয়ের বড়ো কারণ আছে। যেটা জুই এই মূহুর্তে প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। কিন্তু আয়নের কথার ধরণে জুইয়ের নিজেকে লোভী মেয়ে মনে হলো। জুই ঘৃণায় নাক মুখ ছিটকিয়ে আয়নের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল….
‘ আপনি একটা বিকৃত-মস্তিস্কের মানুষ। আপনার আমার সম্পর্কে এমন ধারণা ছিঃঃ!
‘ আপনি কেমন আমি জানি না জুই তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আপনাকে বুঝানোর।নয়তো আমি একবার হারিয়ে গেলে আপনার সাধ্যে হবে না আমার আর ফিরিয়ে আনার।
আয়ন কথা গুলো শেষ করেই প্রস্থান করলো বারান্দা ছেড়ে। ভগ্নহৃদয়ে বুকটা কেমন হা হা করে উঠলো আবারও। আজ কতোটা দিন ধরে জুই আয়নকে অকারণে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে। আয়নকে জুই রাদিফ ভেবে কথা বললেই বা কি? জুইয়ের ফিলিংসের আদান প্রদান সবকিছু তো আয়নের সঙ্গে হয়েছিল। দুজনের এতো স্বপ্ন, মায়া, টেক কেয়ার, ভালো লাগা, মুগ্ধতা, সবকিছুতে দুজনের মিলে যাওয়ার এতোকিছু পরও জুই কিভাবে আয়নকে দূরে সরিয়ে দেয় সামান্য দেখায় রাদিফের প্রতি ভালো লাগা থেকে। রাদিফের প্রতি তো ভালো লাগা ছিল জুইয়ের যেটা জুই কখনো প্রকাশ করতে পারেনি। সামন্য ভালো লাগা থেকে যদি জুই রাদিফের জন্য আয়নকে অস্বীকার করতে পারে, তাহলে আয়নের প্রতি ভালো লাগাটা তো জুই অসংখ্য বার আয়নকে বলেছিল ফোনে, তাহলে আয়ন কিভাবে সবকিছু ভুলতে পারবে এতো সহজে? এলোমেলো পায়ে আয়ন বারান্দা থেকে বেড়িয়ে কক্ষে বাহিরের যেতে যেতে শুনা গেল জুইয়ের ফুপিয়ে কান্নার শব্দ বারান্দা থেকে। জুইয়ের কান্নায় আয়নের বুকে আবারও চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো। চারপাশে কেমন যেন গুমোট আর কষ্টে ভরা পরিস্থিতি। এখানে যে ভালোবেসেছে সেই ভালো নেই আজ। আয়নকে দরজা ধরে বেড়িয়ে যেতে দেখে দুচোখ মেলে তাকাল মায়া। জুই-আয়নের কথার মাঝেই মায়ার হুশ ফিরে ছিল। দুজনের তর্ক- বিতর্কে মায়া আর শব্দ করলো না বরং চুপচাপ চোখ বন্ধ করেই পরে রইলো বিছানায়। প্রথম থেকেই মায়ার কানে এসেছিল দুজনের কথা। অসুস্থ মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বারান্দার দিকে। ভিতর থেকে ভেসে আসছে জুইয়ের কান্নার শব্দ। মায়া ঘাড় বেঁকে তাকাল পাশের বেডে শুয়ে থাকা আরিফের দিকে। মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। চিৎ হয়ে লম্বা করে পড়ে আছে সেখানে। মায়া আরিফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই চোখ দিয়ে ধরধর অশ্রু জড়াল অপরাধ বোধে। বিকালে ঘটনা স্মৃতিচারণ করতে করতে ভাঙ্গা গলায় ধীরস্বরে ডাকল আসিফকে। মায়ার ছোট স্বর ডাক কেবিনের বাহিরে না পৌছালেও বারান্দার থাকা জুইয়ের কানে ঠিকই পৌছাল। দ্রুততায় হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে তাড়াহুড়ো কক্ষে প্রবেশ করতেই জুই দেখলো মায়ার হুশ ফিরতে। মায়াকে সজ্ঞানে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা জুই তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়ে মায়াকে ঝাপটে ধরতেই ব্যথায় গোঙ্গাল মায়া। ব্যথিত মায়ার ব্যথার ঠাহর করতেই তৎক্ষনাৎ মায়াকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জুই বলল….
‘ সরি সরি! আমার মনে ছিল না তুই অসুস্থ। খুব ব্যথা পেয়েছিস? ডাক্তার ডাকবো?
জুইয়ের অস্থিরতায় মায়া তেমন কিছুই বললো না। এই মূহুর্তে মায়ার অল্প শব্দ করতেও কষ্ট হচ্ছে। তারপরও মায়া ছোট গলায় জানতে চাইল আসিফের কথা…
‘ আসিফ ভাইকে ডাক দে জুই।
আসিফের খোঁজ করতে দেখে বিচিলিত হলো জুই। উদ্বিগ্ন গলায় বলল…
‘ কেন কোনো সমস্যা হচ্ছে রিতু? ব্যথা পেয়েছিস খুব?
মায়া একই অবস্থা বলল…
‘ জুই আসিফ ভাইকে ডাক আমি কথা বলবো।
মায়ার ব্যথাতুর কন্ঠে জুই তৎক্ষনাৎ আসিফকে ডাকল কক্ষে আসতে। মায়ার হুশ ফিরেছে শুনে মূহুর্তে কেবিনে ছুটে আসল আসিফ। মায়ার মুখোমুখি হয়ে মায়ার অবস্থা জানতে চাইলে মায়া আসিফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রিদের কথা জানতে চেয়ে বলল….
‘ উনি(রিদ) কোথায় আসিফ ভাইয়া?
আসিফ মায়ার প্রশ্ন করাটা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো। যেন মায়া হুশে ফিরে রিদের কথা জানতে চাইবে সেটা জানতো আসিফ। তাই স্বাভাবিক নেয় উত্তর দিয়ে বলল…
‘ রিদ ভাই তো ঢাকায় চলে গেছে ভাবি।
মায়া থেমে থেমে আবারও বলল…
‘ উনাকে কল দেন ভাইয়া, আমি কথা বলবো।
মায়ার কথায় আসিফ অনেকটা আমতাআমতা করে বলল…
‘ ভাইয়ের ফোন বন্ধ ভাবি। ভাই(রিদ) এই মূহুর্তে খুবই ডিস্টার্ব। রাদিফ ভাই আছেন রিদ ভাইয়ের বাড়িতেই তবে রিদ ভাইয়ের আশেপাশে যাওয়ার অনুমতি আপাতত কারও নেই ভাবি। আপনি বরং এখন রেস্ট করুন, ভাইয়ের সাথে কাল কথা বলিয়েন। আমি বরং আপনার জন্য ডাক্তার ডাকি।
#চলিত…..
#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৪১_শেষাংশ
নিস্তব্ধ রাত আর ঘোর কালো অন্ধকারে অল্প আলোয় মিটমট তাঁরা গুলো যেন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে আকাশের বুকে। শহর জুড়ে ঠান্ডা হওয়া আর ঝিঝিপোকা ডাক ঘুমন্ত শহরটা যেন অদ্ভুত ছান্দ তুলছে। উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে যান্ত্রিক ল্যাম্পপোস্ট গুলো। চাঁদ বিহীন অন্ধকারের মাঝেও ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় আলোকিত ঘুমন্ত শহর। মাঝেমধ্যে দুই একটা যান্ত্রিক গাড়িকে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে। তবে এই মধ্যে রাতে যেটা বেশি দেখা যাচ্ছে যেটা হলো একদল ছন্নছাড়া কুকুর। রাস্তা মাঝে এলোমেলো দৌড় আর ঘেউঘেউ শব্দ করে ঘুমন্ত শহরটাকে জানান দিচ্ছে তাদের পাহাড়াদারীতার খবরটির। আবার দুই একটা কুকুরকে রাস্তার মাঝে বুক লাগিয়ে শুয়ে পরতেও দেখা যাচ্ছে। মায়া বিরতি বিহীন দৃষ্টিতে সেইসব তাকিয়ে দেখছে চারতলা ফ্ল্যাটে বারান্দা হতে। মধ্যরাতের প্রহর তখন ২ঃ২০ ঘরে। এতো রাতে না ঘুমিয়ে স্বাভাবিক মাত্রায় চুপচাপ বসে থাকাটাও অস্বাভাবিক কিছুর ইঙ্গিত করে। নিশ্চুপ উদাস মায়া আবারও শব্দ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাতের ফোনটা দিয়ে ৫৬বারের মতোন কল মিলাল রিদকে। প্রতিবারের মতোই রিং হতে হতে কল কাট হয়ে গেল এক সময়ে। মায়া জানে রিদ ওর কল রিসিভ করবে না তারপরও বিরতি বিহীন একের পর এক করেই যাচ্ছে। মায়া পুনরায় কল মিলিয়ে তাকিয়ে রইল সেই ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় রাস্তার দিকে। তখনই হঠাৎ কেউ অন্ধকার বারান্দার আলো জ্বালাতেই মায়া চমকে পাশে তাকাল। ঘুমন্ত জুইকে দরজার পাশে সুইচ বোর্ডে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বাভাবিক নেয় মায়া পুনরায় সেই দৃষ্টি ফেলল রাস্তায়। নিস্তব্ধ নিরবতা ভেঙ্গে মায়াই প্রথমে বলল…
‘ আলোটা চোখে লাগছে জুই। লাইটটা অফ করে দে।
মায়ার কথায় সত্যি সত্যি জুই তৎক্ষনাৎ লাইট অফ করে মায়ার পাশে বসতে বসতে ঘুমন্ত গলায় বলল..
‘ এতো রাতে এখানে কি করছিস তুই?
মায়ার উদাসীন উত্তর আসলো তক্ষুনি…
‘ আকাশের চাঁদ গুলো গুনছিলাম।
মায়ার কথায় জুই ঘাড় বেঁকে উঁকি ঝুঁকি মেরে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে অসংখ্য তাঁরার মাঝে একটা চাঁদের সন্ধানও না পেয়ে জুই। এই আমাবস্যার চাঁদ পাবে কোথায়? তাছাড়া চাঁদ তো একটায় হয় কিন্তু মায়া বলল অসংখ্য চাঁদের কথায়। জুই একই গলায় বলল…
‘ এই অন্ধকার রাতে চাঁদ কোথায় পেয়েছিস তুই? আমিতো দেখছি না।
‘ না দেখলে চলে যাহ। রুমে গিয়ে ঘুমা। তোর জন্য আজ চাঁদ আকাশে উঠে। আমার জন্য উঠেছে তাই আমি দেখছি। তুই যাহ!
মায়ার মন খারাপের আভাস জুই বুঝতে পেরেই বলল…
‘ মুড অফ?
মায়া একই ভাবে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসীন গলায় বলল…
‘ আজ বিশ দিন হয়েছে উনার সাথে আমার যোগাযোগ নেই জুই। উনি নিশ্চয়ই খুব বেশি রেগে আছে আমার উপর। উনাকে(রিদ) আমি কিভাবে বুঝাব, যা হয়েছে তাতে আমার কোনো হাত ছিল না। আমিতো উনাকে ভালোবাসি তাঁকে রেখে নিশ্চয়ই অন্য কারও কাছে যেতাম না।
মায়ার কথায় এবার জুইও সিরিয়াস হয়ে বসল। আজ অনেক দিন ধরে রিদ-মায়া, আরিফের মনমালিন্যতার কাহিনি গুলো দেখছে জুই। সবকিছু বুঝেও জুইয়ের মায়ার সঙ্গে এই বিষয়ে তেমন কোনো কথা হয়নি । এমন না জুই এই বিষয়ে কথা বলতে চাইনি, বরং জুই প্রথম থেকেই মায়ার সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু মায়াই প্রতিবারের মতোন ওদের সম্পর্কের বিষয় গুলো এড়িয়ে গেছে। তাই এখন মায়াকে নিজ থেকে এসব বিষয়ে কথা বলতে দেখে জুইও আগ্রহী হলো, মায়াকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলল…
‘ ভুলটা তোর দ্বারায় হয়েছে রিতু। তোর উচিত ছিল সবটা আরও আগে ভাইয়াকে জানানোর। তাহলে হয়তো সবকিছু এতোটা বিগড়ে যেত না। আরিফ ভাইয়াও খুব কষ্ট পেয়েছে সেদিন। আজ পযন্ত তোর সাথে কথা বলছে না ভাই।
জুইয়ের কথায় মায়া গোপন দীর্ঘশ্বাসটা প্রকাশেই ছাড়ল। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাতের ফোনটা পাশে রাখল। ঐ আকাশে তাঁরা দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ আজ আমি যতোটা অপরাধী, সেদিন সবাইকে সবটা আগে জানালেও ঠিক ততটাই অপরাধী থাকতাম জুই। হয়তো আরিফ ভাই আর উনার(রিদ) জায়গায় ভিন্ন মানুষ গুলো দাঁড়িয়ে থাকতো। তবে সবদিক থেকে আমিই আসামী হতাম। আমার দিকটা কেউ বুঝতে চাইতো না যেমনটা আজ চাচ্ছে না কেউ।
মায়ার মন খারাপে জুইয়েরও মন খারাপ হলো। বিগত দিনগুলো ধরে দেখে আসছে মায়াকে রিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে। প্রতিবারই মতোই মায়া বিফল। শুধু তাই নয়। খান বাড়ির কারও সঙ্গেই মায়া যোগাযোগ করতে পারছে না এমনকি আসিফের সঙ্গে পযন্ত না। রিদের সঙ্গে মায়া মনমালিন্যতা বুঝা যায় কিন্তু তাই বলে আসিফের সঙ্গে কেন মায়া যোগাযোগ করতে পারছে না সেটাই বুঝতে পারছে না জুই। সেদিন হসপিটাল হতে মায়া আর আরিফকে আসিফই বাসায় পৌঁছে দিয়ে সে ঢাকায় ব্যাক করে। তারপর থেকে আসিফ অনেকটা নিরুদ্দেশ বলা যায়। মায়ার সঙ্গে যোগাযোগ পযন্ত করছে না। জুই মায়াকে হঠাৎই বলল…
‘ ঢাকা যাবি রিতু, ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে?
জুইয়ের কথায় মায়া দূর আকাশ হতে দৃষ্টি সরিয়ে তাকাল জুইয়ের দিকে। হাল্কা ভ্রুর কুঁচকে বলল..
‘ ঢাকা?
‘ হ্যাঁ!
‘ কেন?
‘ দেখ ভাইয়া তোর উপর খুব রেগে আছে। আমার মনে হয়না তিনি কখনো তোর ফোন রিসিভ করবে। এজন্য বলছিলাম তুই বরং কাল ঢাকা চলে যাহ ভাইয়ার কাছে। দুজন সামনাসামনি হলে তুই তোর দিকটা ভাইয়াকে বুঝাতে পারবি।
‘ আর উনি যদি বুঝতে না চাই আমাকে তখন?
‘ দেখ রিতু, কোনো মানুষ এতোটাও শক্ত হয়না যে সে তার ভালোবাসার মানুষের দিকটা বুঝতে চাইবে না। অবুঝের মতোন বারবার আঘাত করবে। আমার মনে হয় তুই ভাইয়ার কাছে গেলে তিনি আর রাগ করে থাকবে না তোর উপর। বরং তোর দিকটা শুনতে চাইবে। তারপরও যদি দেখিস তিনি তোর দিকটা বুঝতে চাইছে না তাহলে মনে করবি ভাইয়া তোকে আর নিজের জীবনে চাইছে না। হয়তো তিনি ভিন্ন কিছু চাইছে। হতে পারে সেপারেশন।
জুইয়ের মুখে সেপারেশন শব্দটা শুনে মায়ার কোথায় যেন প্রচন্ড আঘাত করলো। মায়া জুই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দু’হাতে মাথা চেপে ঝুঁকে বসতে বসতে বলল..
‘ তুই যা জুই। আমার ভালো লাগছে না।
জুই থাকার আকুতি জানিয়ে বলল…
‘ আর একটু থাকি না।
‘ না।
জুই প্রসঙ্গ এড়াতে চেয়ে বলল…
‘ কাল কলেজে যাবি রিতু? অনেক দিন-তো হলো কলেজে যাস না। রাফা তোর কথা রোজ জিগ্যেসা করে। যাবি কাল?
মায়া একই ভাবে বলল…
‘ জানি না। তুই যা এখন।
জুই মায়াকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। কিন্তু মায়াকে ছেড়ে রুমেও গেল না। বরং ঠায় মায়ার পাশে বসে রইল। মূলত জুইয়ের মন চাচ্ছে না মায়ার মন খারাপের অবস্থায় একা ফেলে চলে যেতে। মায়া মাথা ঝুঁকে কিছুটা সময় বসে থাকার পরও জুইকে নড়তে না দেখে পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে ঠাস করে উঠে দাঁড়াল। জুইকে পাশ কাটিয়ে সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো উপুড় হয়ে। মায়াকে শুয়ে পরতে দেখে জুইও বারান্দার দরজা চাপিয়ে মায়ার পাশে শুতে শুতে ভাবল মায়ার কথা। মায়ার রিদের জন্য মন খারাপ হয় কিন্তু হসপিটাল থেকে আসার পর কখনো মায়াকে রিদের জন্য কাঁদতে দেখেনি। বরং চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখেছে বড় জোর। কিন্তু আরিফ যখন মায়াকে নিরবে এড়িয়ে যায়, মায়াকে দেখেও না দেখার মতো করে থাকে, আবার মায়ার সঙ্গে কথা বলে না তখন মায়াকে খুব কাঁদতে দেখা যায়। জুই এতোটা দিন মায়াকে পর্যবেক্ষণ করে যেটা বুঝতে পেরেছে সেটা হলো, মায়া হয়তো রিদের রাগের ধারণা আগে থেকেই ছিল সেজন্য হয়তো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল এমন কিছু হবে বলে। কিন্তু আরিফের অভিমান, নিরতার, ভার নেওয়ার জন্য হয়তো মোটেও প্রস্তুত ছিল না মায়া। সেজন্য ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে টানাপোড়ায় মায়া সহ্য করতে না পেরে কেঁদে উঠে নিজের অজান্তেই। জুই মায়ার দিকে কাত হয়ে শুয়ে, গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাবল না-জানি কবে সবটা ঠিক হয়। জুই নিজেরও কখনো আরিফকে দেখেনি তীব্র অভিমানে এইভাবে চুপ করে যেতে। যেখানে আরিফ সবার থেকে মায়ার প্রতি যত্নশীল। সেই আরিফ আদুরের মায়ার প্রতি এতোটা নিশ্চুপ হয়ে যাবে সেটা সত্যিই জুই ভাবিনি কখনো। আরিফের নিশ্চুতা মায়ার অপরাধ বোধকে ক্ষণে ক্ষণে পাপে তুলছে। মায়ার প্রতি জুইয়ের খুব মায়া হয়। চোখের পলকে কেমন মায়া ভালোবাসার দুটি সুন্দর সম্পর্ক, ভরসা জায়গা হারিয়ে অবিশ্বাসের পোকা ধরলো। আল্লাহ করুক! মায়ার জীবনে সবটা আবার ম্যাজিকের মতো ঠিক হয়ে যাক। আরিফ- রিদ দুজনই মায়াকে আবার বিশ্বাস করে যারযার সম্পর্কের জায়গা থেকে আগলে নিক। জুইয়ের ভাবনা চিন্তার মাঝেই মায়া হঠাৎ মাথা উঁচিয়ে অন্ধকারে তাকাল জুইয়ের দিকে। হঠাৎ এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বলল…
‘ আমাকে তোর ধ*র্ষি*তা মনে হয় জুই?
মায়ার অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে চমকে উঠে জুই। হতভম্ব হয়ে তৎক্ষনাৎ পাল্টা প্রশ্ন করে বলল জুই…
‘ এসব কি বলছিস তুই? ধ*র্ষি*তা হতে যাবি কেন? তোরাই তো বলেছিস সেদিন রাতে জঙ্গিদের হাত পরিস নি তাহলে এখন আবার এসব কথা কোথায় থেকে আসছে?
জুইয়ের কথায় মায়া পুনরায় বালিশে মাথা রাখতে রাখতে ভাঙ্গা ভেজা গলায় বলল…
‘ আমি মনে হয় আমার স্বামীর চোখে ধ*র্ষিতা জুই। আমাদের যখন খাদ থেকে উদ্ধার করা হয় তখন আমাদের দুজনের শরীরের জখম ছিল৷ হয়তো সেই জখম গুলো দেখেই উনি(রিদ) আমায় ঘৃণা করছেন। ভেবেছেন আমি ধ*র্ষি*তা। নষ্টা বউকে চাইনা বলেই যোগাযোগ করতে চাইছে না। সেপারেশন চাই।
মায়ার কথায় জুই খানিকটা ধমক স্বরে বলল…
‘ বাজে বকিস না মায়া। তোকে উদ্ধার করা থেকে ডাক্তার দেখানো সবকিছু রিদ ভাই নিজের হাতেই করেছেন। কই তখন তো এমন কিছু বলতে শুনেনি? নাকি তুই রিদ ভাইকে এমন কিছু বলতে শুনেছিস? আমার জানা মতে রাফা ঐ জঙ্গি ছেলেগুলোকে সনাক্ত করতে রেব ক্যাম্পে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিল। ছেলেগুলোকে সনাক্তও করা হয়েছে। জঙ্গি ছেলেগুলো স্বীকারোক্তি দিয়েছে তারা শুধু রাফাকে তুলে এনেছিল সেদিন, তোকে তারা আনেনি। তুই নাকি নিজে গিয়েছিস রাফাকে বাঁচাতে। রাফা বা তোর কারও ক্ষতি তারা করেনি। এমনকি তারা নাকি তোকে দেখেনি পযন্ত, আর না ধরতে পেরেছে। তাহলে তুই হঠাৎ এসব কথা কেন বলছিস? রিদ ভাই শুধু তোর এঙ্গেস্ট হওয়া বিষয়টা নিয়ে রেগে অন্য কিছু নিয়ে নয়। তুই ভুল ভাবছিস উনাকে।
জুইয়ের কথায় মায়াকে আর নড়তে দেখা গেল না। জুই অনেক অপেক্ষা করলো মায়ার উত্তরের কিন্তু মায়াকে উত্তর করতে না দেখে বুঝল মায়া হয়তো এসব বিষয়ে আর কথা বলতে চাইছে না। তাই জুইও আর কথা না বাড়িয়ে মায়ার দিকে মুখ করেই একটা সময় ঘুমিয়ে পরলো। তবে মনে মনে দোয়া করলো যাতে মায়ার জন্য যেন নতুন একটা ভোর হয়। ভালোবাসা আর বিশ্বাসময়।
~
সকাল ৪ঃ৪৫ মিনিট। রিকশা থেকে থেমে ভাড়া মিটাল জুই। মায়া পাশেই কলেজ ড্রেসে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে। রিকশা থেকে নামতেই মায়া লক্ষ করলো আশেপাশে সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে। কেউকেউ আঁড়চোখেও মায়াকে দেখছে। মায়া বুঝল না সবার এমন দৃষ্টি কারণ। আর না জানতে চাইল কেন সে সবার দৃশ্য কেন্দ্রবিন্দু। অসুস্থ মায়া বিগত একটা মাস কলেজে আসেনি। সুস্থ হওয়ার পরও মানসিক টানাপোড়ায় আসলো না। সামনে টেস্ট পরীক্ষা বিদায় আসতে হলো। নতুন করে আবারও পড়া শুরু করতে হবে। বিগত দিনের অনেক পড়া বাকি তাই আজ মায়ার কলেজে আসা। জুই ভাড়া মিটিয়ে মায়াকে নিয়ে কলেজে প্রবেশ করতে করতে আশেপাশে সবার নজর মায়ার উপর লক্ষ করলেও সে চুপ থাকল। জুই জানে সবার কৌতহলের দৃষ্টি মায়ার উপর কেন? বিগত দিনগুলোতে মায়া কলেজে উপস্থিত না থাকলেও জুই ঠিকই উপস্থিত ছিল। তাই সেজন্য সে জানে বিগত দিনগুলোতে মায়াকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ভিতর কতেটা চর্চা হয়েছে। স্যার থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের সিনিয়র, জুনিয়র সবার মুখে মুখে মায়ার চর্চাই ছিল। আর সেই চর্চার বিশেষ কারণও ছিল। কলেজের কর্তৃপক্ষ মন্ত্রী নিহাল খানের ছেলে রিদ খানের বউ মায়া। আর এটাই ছিল মায়াকে সকলের চোখে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করার। সেদিন ট্যুর যাত্রার পর থেকেই রিদ-মায়ার কাহিনি পুরো ক্যাম্পাসের অলিগলি ছড়িয়ে। হয়তো কিছুক্ষণ পর মায়াও এই বিষয়টি নিয়ে অবগত হয়ে যাবে। ক্যাম্পাসের করিডোর ধরেই হাঁটছিল মায়া আর জুই। দ্বিতীয় তলায় ক্লাসরুম ওদের। শ্রেয়া, নাদিয়া কলেজে এসেছে কিনা আপাতত জানা নেই মায়া বা জুইয়ের কারওই। এরই মধ্যে দুজনের যাওয়ার পথে হঠাৎ কোথা থেকে রাফা দৌড়ে এসে পিছন থেকে মায়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলে খৈ হারায় মায়া। তাল সামলাতে না পেরে আতঙ্কে জুইকে ধরতে চাইলে অপ্রস্তুত জুইও খৈ হারিয়ে তিনজনই পড়লো একত্রে। করিডোরে দেয়াল ঘেঁষেই পরলো এতে ব্যথা পেল তিনজনই। কিন্তু মায়া গলায় রাফার দুহাত বাঁধা থাকায় নিশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম হতে মায়া জোর করে রাফার হাতটা গলা থেকে ছাড়াতে চেয়ে বলল…
‘ বেয়াদব মহিলা ছাড়! নিশ্বাস নিতে পারছি না আমি।
মায়া কথায় রাফা তাড়াহুড়ো করে গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল..
‘ সরি! সরি! বেশি ব্যথা পেয়েছিস?
মায়া দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অধৈর্য্যের রাফা আবারও মায়ার হাত টেনে ধরলে মায়া কপাট গলা বলল…
‘ বেয়াদব মাইয়া, তুই কি আমার জামাই লাগুস? ঘেঁষাঘেঁষি করিস কেন? ছাড়!
জুইও সবে সোজা হয়ে দাড়িয়েছিল এর মধ্যে মায়ার ত্যাড়া কথায় জুই কাঁধে ব্যাগ টেনে ঠিক করতে করতে বলল…
‘ কথাটা কপি পেস্ট মনে হয়! তুই ঠিক কাকে কপি করেছিস বলতো মায়া?
একদিকে রাফার টানাটানি শেষ হচ্ছে না অন্যদিকে জুইয়ের খোঁচায় মায়া বিরক্তি চোখে জুইয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের পড়ে থাকা ব্যাগটা তুলে ঝেড়ে কাঁধে পড়তে পরতে ক্ষিপ্ত গলায় বলল…
‘ নিজের জামাইরে কপি করছি। হয়ছে এবার? সর!
কথা বলেই মায়া জুইকে পাশ কাটাতে চাইলে পুনরায় হাত টেনে রাফা বলল…
‘ জানু কই যাস?
রাফার টানাটানিতে বেশ বিরক্ত হলো মায়া। কিন্তু রাফার মুখে জানু ডাক শুনে খানিকটা ভ্রুর কুঁচকে বলল।
‘ জানু?
‘ হহ! তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না? জানু তো ডাকতেই পারি।
‘ তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হলি কবে থেকে?
‘ যবে থেকে তুই আমার জীবন বাঁচালি তবে থেকে। এই জীবন তোর। আর এই জীবনে তুই হলি আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড বাকি সব বাদ। যে মানুষের জীবন বাঁচাই আমার চোখে তার মূল্যায়ন অনেক বেশি। আর সেখানে তুই তো আমার জীবন, ইজ্জত দুটোই বাঁচিয়েছিস তোর মূল্যায়ন আমার মনে, প্রাণে, বুকে, কলিজায় সবখানে জানু।
কথা গুলো বলতে বলতে রাফা পুনরায় অধিকার দেখিয়ে মায়ার কাঁধ জড়িয়ে গলা পেচিয়ে ধরলো। মায়াকে নিয়ে সামনের দিকে কদম বাড়ালে মায়া অসহায় গলায় বলল।
‘ আমার ঠিক হয়নি সেদিন তোকে জঙ্গিদের হাত থেকে বাঁচানোর। তোকে সেদিন জঙ্গলে ফেলে আসলেই ভালো হতো।
মায়ার কথায় দুই পয়সার পাত্তা দিল না রাফা। ওদের পাশে পাশে জুইও হাঁটছিল। রাফার নতুন বন্ধুত্ব জুইয়ের সাথেও হয়েছে। রাফার চঞ্চলতা সম্পর্কে মায়ার ধারণা না থাকলেও বিগত দিনে জুইয়ের বেশ ধারণা হয়েছে। সেজন্য জুই চুপ রইল। কিন্তু চঞ্চল রাফা মায়ার কাঁধ জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল…
‘ ভুলতো তুই করেছিস আমাকে বাঁচিয়ে, সেটা তোকে মানতেই হবে জানু। আচ্ছা শুন! রিদ জিজুর সঙ্গে একটা বলদ থাকে না সবসময় ঐ মালটা কইরে?
রাফার কথায় মায়ার সঙ্গে সঙ্গে জুইও দাঁড়িয়ে গেল সন্দিহা প্রকাশ করে। ঘাড় বেঁকে রাফার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মায়া বলল…
‘ কার কথা বলছিস তুই?
মায়ার কথায় রাফা মনে করার মতোন করে বলল…
‘ আরে আছে একটা হাবাগোবা বলদ টাইপের রিদ ভাইয়ের আগেপিছে ঘুরে। কি যেন নাম তার? অ না আ দিয়ে ছিল একটা নাম। আকিম না কি যেন নাম?
পাশ থেকে রাফাকে সহজ করে জুই সন্দেহ বশে আসিফের নাম ধরে বলল…
‘ আসিফ ভাই?
‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ! এটাই, এটাই। আসিফ! আসিফ!
মায়া সন্দেহ করে বলল…
‘ আসিফ ভাইকে কেন চাই তোর?
‘ আজব আমি কেন তাকে চাইব? সেকি ফ্রী ইন্টারনেট নাকি যে চাইব। তাঁকেই তো দেখলাম আমার আম্মুর সাথে সেই ভাব জামাতে। উড়ন্ত খবরের শুনলাম সে নাকি আমার আম্মুর মেয়েকে পছন্দ করে। ঘটনা কতখানি সত্য সেটাই তো জানতে তোর কাছে তার খবর নিতে আসলাম, বুঝছিস।
রাফার কথায় মায়া জুই দুজনের চোয়াল ঝুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। মায়ার আগে জুই আবাক হওয়ার স্বরে বলল…
‘ আসিফ ভাই তোর বড় বোনকে পছন্দ করে রাফা? আল্লাহ! আসিফ ভাইকে দেখে তো মনেই হয়না তিনি কখনো কোনো মেয়েকে পছন্দ করতে পারেন।
জুইয়ের কথায় মায়ারও একই মত পোষণ করলো। রাফা খানিকটা ভাব নিয়ে মায়ার কাঁধ আবারও আগের মতোন পেচিয়ে সামনে হাঁটতে হাঁটতে জুইয়ের কথার উত্তরে বলল…
‘ আমি আমার পরিবারের একমাত্র সিঙ্গেল পিস। আমার ছোট-বড়, সামনে -পিছে, উঁচু নিচু, কোনো ভাইবোন নাই। মা-বাবার একমাত্র সুকন্যা আমি বুঝছিস।
ক্লাসমেট হিসাবে রাফার সঙ্গ মায়াদের পূর্ব পরিচিত থাকলেও কখনো সেইভাবে রাফাকে চেনা-জানা হয়নি কারও। ট্যুরের পর থেকেই রাফার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত হওয়া মায়াদের। রাফার খবর পেয়ে রাফার বাবা-মা রাঙ্গামাটিতে গিয়েছিল কিন্তু তখন মায়াকে নিয়ে রিদ চলে এসেছিল সেখান থেকে। কিন্তু তার পরদিনই মায়ার সঙ্গে দেখা করতে হসপিটালে যায় রাফার পুরো পরিবার। মায়াকে জড়িয়ে ধরে রাফার মা হাউমাউ করে কেঁদেছিল সেদিন। একমাত্র মেয়ে রাফার জীবন বাঁচানোর জন্য। রাফার বাবাও কেঁদেছিল। মায়ার মাথাই দোয়ার হাত বুলিয়ে দোয়াও করেছিলেন তিন। এরপর থেকেই রাফার বা-বাবা মায়াকেও রাফার বোন আর নিজেদের আরেকটি মেয়ে বলে মায়াকে মেনেছিল। সেদিন হতে বলতে গেলে রাফার পরিবারের সঙ্গে মায়ার একটা ঘনিষ্ঠ সু-সম্পর্ক হয়ে উঠেছে। কিন্তু মায়া এটা জানতো না রাফার আর কোনো ভাইবোন ছিল না। এখন রাফার মুখে সে একমাত্র সন্তান হওয়ার কথাটা শুনে মায়া খানিকটা আবাক স্বরে বলে…
‘ তারমানে আসিফ ভাই তোকে পছন্দ করে রাফা?
‘ হতে পারে। আই ডোন্ট নো।
‘ আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে তোর যোগাযোগ হয়? কথা বলিস তোরা ফোনে?
‘ আমি কেন কথা বলতে যাব আজব? তবে আমার আম্মুর সাথে যোগাযোগ আছে এই লোকের। কাল রাতেও দেখলাম আম্মুকে ফোন করতে। কিন্তু কেন?
মায়া বুঝতে পারলো আসিফ শুধু মায়ার একার ফোনটাই রিসিভ করছে না। বাকি সবার সাথেই আসিফের যোগাযোগ আছে। মায়া হাঁটা থামিয়ে অনেক রাগান্বিত গলায় রাফার কাছে ফোন চেয়ে বলল…
‘ তুই ফোন এনেছিস রাফা?
রাফা সম্মতি দিয়ে বলল…..
‘ হ্যাঁ!
‘ ফোনটা দে আমাকে।
‘ কেন কি করবি?
‘ আসিফ ভাইকে কল দিব।
রাফা আশেপাশের পরিবেশটা দেখে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে করতে মায়াকে বলল…
‘ এখানে দিব? নাকি আগে ক্লাসে যাবি?
‘ ক্লাসে সবাই থাকবে ক্যান্টিনে চল। ক্যান্টন এখন খালি থাকবে। চল!
রাফা ফোন দিতেই মায়া আসিফের মুখস্থ নাম্বারটা টাইপিং করে তৎক্ষনাৎ কল মিলাল আসিফকে। সকাল হওয়ায় আশেপাশে ছাত্র- ছাত্রীদের আনাগোনা কম। ক্লাস শুরু হতে আরও চল্লিশ মিনিট বাকি। ক্যান্টিনে গিয়ে বসতে কয়েক মিনিট সময় লাগবে বলে অধৈর্য্যের মায়া ক্যাম্পাসের করিডোরে একপাশে গিয়ে দাঁড়াল। অধৈর্য্যের নেয় আসিফকে পরপর কল মিলালেও আসিফ সেটা রিসিভ করলো না। তৃতীয়বারে মতোন ওপাশের কলটা রিসিভ হতেই অধৈর্য্যের মায়া শক্ত গলায় বলল আসিফকে শুধালো…
‘ ফোনটা আপনার ভাইকে দিন আসিফ ভাই।
রাফা নাম্বার থেকে মায়ার কন্ঠ পেতেই আসিফ বুঝতে পারলো আজ মায়া কলেজে গিয়েছে। হয়তো দুজন এখন একত্রেই আছে। আসিফ রাফাকে ভেবে মায়ার কল রিসিভ করে যেন বিপদে পরে গেল। একদিকে রিদ অন্যদিকে মায়া। আসিফ কার কথা শুনবে? জামাইর নাকি বউয়ের? কি করবে আসিফ সেটা ভেবে না পেয়ে আমতা আমতা করে বলল…
‘ ভাবি ভাইতো রুমে।
‘ সেখানে নিয়ে যান।
‘ ভাই অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে ভাবি। আমি এখন গেলে ডিস্টার্ব হবে।
মায়া একই ভাবে জেদ্দি গলায় বলল…
‘ আমি ডিস্টার্ব করবোই।
মায়ার জেদ্দি গলায় আসিফ অসহায় বোধ করে বলল…
‘ ভাবি আপনার ফোন আমি রিসিভ করেছি শুনলে রিদ ভাই রাগ করবেন।
আসিফের কথাটা শুধিয়ে মায়া রাগান্বিত গলায় বলল…
‘ আপনি আমার ফোন কোথায় রিসিভ করেছেন? আপনি তো রাফার কল রিসিভ করেছেন। রাফা সাথে আপনার কি চলে আমি জানি না বুঝি?
আসিফ তাড়াহুড়ো করে বলল…
‘ আস্তাগফিরুল্লাহ ভাবি! আমার কারও সাথে কিছু চলে না। সবই ষড়যন্ত্র!
‘ ঠিক আছে, আমি সেটা রাফার আম্মুকে বলে দিবনে তাহলে।
মায়ার কথায় এবার আসিফ চুপ করে গেলে। একদিকে রিদ অন্যদিকে মায়া দুটোই জেদ্দি টাইপের মানুষ। যেমন বউ তেমন জামাই। কার আদেশ শুনবে আসিফ। অসহায় আসিফ নিরুপায় হয়ে বলল…
‘ দুই মিনিট সময় দিন ভাবি। এক্ষুনি যাচ্ছি।
‘ আমি ভিডিও কল দিচ্ছি তাহলে।
অধৈর্য্যের মায়া তৎক্ষনাৎ কল কেটেই রাফার একই নাম্বার হতে আসিফকে ভিডিও কল মিলাল হোয়াটসঅ্যাপে। আসিফ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সেই কলটি দেখল। রিদের কক্ষের দরজা নক করতেই ভিতর থেকে ডাকল রিদ। আসিফ একবুক সাহস নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখল সত্যি সত্যি রিদ প্যান্ট শার্ট ইন করে পরছে অফিসে জন্য রেডি হতে। আসিফ ফোন হাতে নিয়ে রিদকে দেখল আয়না ভিতর। রিদ তখনো প্যান্টের বেল্ট কোমরে জড়াতে জড়াতে তাকাল জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফের দিকে। ফোনের রিংটোনের শব্দ রিদের কানেও যাচ্ছে কিন্তু আসিফকে কিছু বলতে না দেখে বরং চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিদ হাল্কা কপাল কুঁচকে জিগ্যেসা করল…
‘ কি চাই? কেন এসেছিস?
আসিফ একবুক সাহস নিয়ে মায়ার ভিডিও কল রিসিভ করল। রিদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল..
‘ ভাই জরুরি ফোন এসেছে। আপনি ছাড়া সমাধান হচ্ছে না। একটু কথা বলে দেখুন প্লিজ।
রিদ জরুরি ফোন মনে করেই হাত বাড়িয়ে আসিফ থেকে ফোনটা নিতে চেয়ে জিগ্যাসু গলায় বলল..
‘ কে ফোন করেছে?
আসিফ রিদের হাতে ফোনটা দিয়েই তৎক্ষনাৎ দরজার দিকে দৌড় দিতে দিতে বলল…
‘ ভাবি ফোন করেছে।
চোখের পলকে আসিফ উধাও। কিন্তু রিদের হাতে থাকা ফোনটিতে মায়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখটি ভাসছে। রিদ ফোনের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। অনেকটা দিনপর দুজনের আবারও মুখোমুখি হওয়া। রিদ রাগের তোপে ফোন কাটতে চাইলে মায়া অধৈর্য্যের নেয় তাড়াহুড়ো করে বলল…
‘ এই কল কাটবেন না! কাটবেন না।
চোয়াল শক্ত করা রিদকে তারপরও কল কাটার মনোভাব দেখে মায়া আবারও তাড়াহুড়ো বলল…
‘ আই লাভ ইউ জান। আই লাভ ইউ।
কল কাট করা লাল বাটনের থাকা রিদের বৃদ্ধা আঙ্গুলটি তৎক্ষনাৎ কেঁপে উঠলো। যতোটা রাগ মায়ার কল পেয়ে হয়েছিল ঠিক ততটাই বরফ নেয় গলে গেল মায়ার মুখে ‘আই লাভ ইউ জান’ বাক্যটি শুনে। রিদের তপ্ত মেজাজ শীতল হলো। দুজনের মধ্যে এই প্রথম ভালোবাসার লেনদেন করা। মায়ার ভালোবাসা সম্পর্কে রিদ প্রথম থেকেই জানতো কিন্তু কখনো মায়া বা সে সরাসরি কেউ কাউকে ভালোবাসি বলা হয়নি আজও। এই প্রথম মায়ার মুখে ভালোবাসি শব্দটা বলা। রিদের মায়ার উপর জমা থাকা সকল রাগ যেন এক মূহুর্তে শেষ হয়ে গেল। রিদ চেয়েও যেন নিজের রাগ ধরে রাখতে পারছে না মায়ার উপর। রিদ বুঝল না সেকি এই কথাটা শুনার জন্য এতোদিন রাগ করে বসেছিল? কই নাতো। রিদ তার বউয়ের বেঈমানীর জন্য রাগ করেছিল তাহলে সেই নারীর মুখে সামান্য ভালোবাসি কথা শুনে সে কেন গলে যাচ্ছি। তার আরও রেগে থাকার কথা। এতো ভালোবাসা দেখিয়ে তো এই নারীই অন্য কারও নামে এঙ্গেস্ট হয়েছিল। তাহলে এই নারী যে এখন ভালোবাসি বলে আবারও বেঈমানী করবে না তার কি গ্যারান্টি? মায়ার এঙ্গেস্ট হওয়ার কথা রিদের স্বরণে আসতে মস্তিষ্ক তড়াক করে জ্বলে উঠে রাগে। রিদকে চোয়াল শক্ত করতে দেখে মায়া আবার নরম সুরে বলে…
‘ আই মিস ইউ জান। এত্তো গুলা মিস করছি আপনাকে। আমার মন জ্বলে আপনার জন্য। সারারাত ঘুমাতে পারি না। খালি কেমন কেমন করে।আপনি সাথে থাকলে কতো আদুরে করতাম আপনাকে। আপনি কেন আসেন না আমার কাছে? চলে আসেন তো তাড়াতাড়ি।
মায়ার দুষ্ট কথায় রিদ অভ্যস্ত নয়। হুটহাট মায়ার দুষ্ট কথায় রিদ অপ্রস্তুত হলো। রিদের মনে হলো বউ তার ইজ্জত নিয়ে টানছে। আর একটু কথা বাড়ালে এই মহিলা আরও উল্টা পাল্টা কথা বলে রিদের ইজ্জতে হাত দিয়ে বসবে। কি সরাসরি আবদার, তাঁকে আদুর করতে চাই। বেয়াদব মহিলা তাঁকে অপদস্তক করে। রিদ কি বলবে ভেবে না পেয়ে মিথ্যা রাগরাগি ফেস করে ধমক স্বরে বলল…
‘ বেয়াদব!
সঙ্গে সঙ্গেই রিদের কল কাট হয়ে গেলে মায়া কান থেকে ফোন নামিয়ে দুষ্টু হাসলো। জুই রাফা থেকে একটু দ্রুত বজায় রেখেই এতক্ষণ রিদের সাথে কথা বলছিল মায়া। কল কেটে যেতেই দুজন এগিয়ে আসল মায়ার দিকে। মায়াকে একা হাসতে দেখে রাফার আগে জুই বলল…
‘ হাসছিস কেন? কি হয়েছে? ভাইকে মানাতে পেরেছিস?
‘ মনে হয় একটু পেরেছি!
‘ মনে হয় মানে? এরমানে ভাইয়াকে এখনো মানাতে পারিস নি তুই?
মায়া রাফার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে জুইয়ের কথার উত্তরে বলল…
‘ উনার প্রেমিকা নয় বউ হয় আমি জুই। আমার সাথে কতোদিন রাগ করে থাকবে সে? উনাকে যদি পাগল না বানাই তাহলে আমি রিদ খানের বউ না।
মায়ার কথার সঠিক অর্থ জুই বুঝল না। জুই মনে করলো মায়া উল্টা পাল্টা কোনো কাজের ইঙ্গিত করছে সেজন্য জুই ভয়ার্ত গলায় মায়াকে শুধিয়ে বলল…
‘ পাগল বানাবি মানে? কি করবি তুই? দেখ মায়া উল্টা পাল্টা কিছু করিস না কিন্তু। রিদ ভাই এমনই তোর উপর রেগে আছেন।
জুইয়ের কথায় মায়া বলল…
‘ উনার সাথে সকল লিমিট ক্রস করার রাইট আমার আছে। বউ হয় উনার আমি। দেখ জুই, সম্পর্কের মধ্যে একজন রাগ করলে অপরজনকে তাঁকে বুঝাতে হবে এটাই একটা সম্পর্কের সৌন্দর্য্য। আমার স্বামী রাগ করেনি, বরং আমাকে ভুল বুঝে আছে, এই অবস্থায় আমি তার ভুল না ভাঙ্গিয়ে যদি চুপ থাকি তাহলে আমার সম্পর্কে ফাটল ধরবে সেটা নিশ্চিত। একটা সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি হতেই পারে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু সম্পর্কের ভুলটা শেষ না করে উল্টো সেই সম্পর্কটাই শেষ করাটা হলো বুদ্ধিহীনতার কাজ। একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনো নিজের সম্পর্ক শেষ করবে না বরং সম্পর্কে হওয়া সেই কারণটা শেষ করতে চাইবে।
কথাটা বলেই মায়া রাফার কাছে ফোনটা দিয়ে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটল। জুই তখন সেখানেই হতবুদ্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। জুইয়ের মনে হলো মায়া শেষের কথা গুলো জুইকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। আয়ন আর জুইয়ের সম্পর্কে চলা সমস্যা গুলো ঠিক করতে ইঙ্গিত করেছে। মায়ার মাঝেমধ্যে বেশ ম্যাচুয়েট আর গম্ভীর কথা বার্তা বলে। এই যেমন এখন বলল। আয়নের কথা মাথায় আসতেই জুই বিষন্ন ভগ্নহৃদয় হলো। সেদিন হসপিটালের সেই সাক্ষাৎকারে পর আয়ন আর জুইকে কল করেনি। জুই অবশ্য আয়নের ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিল না। তারপরও জুইয়ের অবুঝ মন বারবার যেন আয়নের ফোনের অপেক্ষায় ছিল। না চাইতেও আয়নের ফোন না করা নিয়ে মন খারাপ হয়েছে জুইয়ের। কিন্তু কেন সেটা জানে না জুই।
~
#চলবে….