#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৫৩
সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে। সময়টা তখন ৩ঃ১৫ ঘরে। আয়ন সবে মাত্র জুইকে নিয়ে পৌঁছাল রিদের বিল্ডিংয়ের সম্মুখে। গাড়ি থামতেই আয়ন সিট বেল্ট খুলতে খুলতে নত মস্তিষ্কের জুইয়ের দিকে তাকাল। অনবরত কান্নায় ফর্সা মুখটা লাল লাল হয়ে আছে। চোখের পাতা ফুলে গালে পানির দাগরেখা দৃশ্যমান। আয়ন জুই দেখে স্বাভাবিক নেয় গাড়ি থেকে নেমে অপর পাশের দরজা খোলে দাঁড়াল জুইয়ের নামার অপেক্ষায়। আয়ন নিস্তব্ধ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। জুই মাথা ঝুঁকে ফুপিয়ে কাঁদছে বারবার হাতের টিস্যুতে অশ্রুকণা মুছতে মুছতে। নিশ্চুপ আয়ন খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে একটা সময় বলে উঠল…
‘ আমরা এসেছে পরেছি জুই। আপনি নামুন।
আয়নের কথায় জুই মাথা তুলে তাকাল না তীব্র অপরাধ বোধে। নত মস্তিষ্কেই কেমন ফুপাতে লাগল আয়নের গলা শুনে। জুইয়ের কান্নার গতি বাড়তে দেখে আয়ন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল…
‘ প্লিজ কাঁদবেন না জুই। এখন কেঁদে কি হবে? সবকিছু আপনার ইচ্ছায় হয়েছে। এখন আসুন। আপনাকে রিদের ফ্ল্যাটের দিয়ে আমি ঢাকায় ফিরব।
আয়নের কথায় জুই চমকে উঠার মতোন মাথা তুলে তাকাল আয়নের দিকে। মূহুর্তে চোখাচোখি হলো দুজনের। জুইয়ের ভেজা চোখে অশ্রু দেখে আয়নের কেমন মায়া হলো জুইয়ের প্রতি। জুই জড়ানো ভেজা গলায় বলল…
‘ এখন চলে যাবেন?
আয়নের উত্তর আসলো তক্ষুনি…
‘ না রাতে রিদের সাথে ফিরব। এখন খান বাড়িতে যেতে হবে নির্বাচনের কাজে হয়তো রিদও যাবে। আশেপাশের রিদের লোকদের দেখা যাচ্ছে আমি ওদের সাথেই যাব। আপনি এখন উপরে উঠে যান, মায়াকে ফ্ল্যাটেই পাবেন।
আয়নের কথায় জুই নেমে দাঁড়াল। অসাবধানতায় নামতে গিয়ে আয়নের বাহুতে জুইয়ের মুখে ঠেকে যেতেই তৎক্ষনাৎ পিছুপা হয়ে জুই ক্ষমা চেয়ে বলল…
‘ সরি আমি দেখিনি।
‘ ইট’স ওকে। আপনি আসুন!
আয়নের পিছন পিছন হাঁটল জুই। কয়েক কদম সামনে এগোতে আয়ন দেখল আশেপাশে সাদা পাঞ্জাবিতে রিদের প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশজনের মতো ছেলে পেলে দাঁড়িয়ে। আসিফকেও দেখা গেল সেখানেই। রাস্তা এপাশ ওপাশ দুপাশেই জায়গায় জায়গায় রিদের ছেলেপেলেদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ন থেমে গেল। যেহেতু আশেপাশে রিদের ছেলেপেলে উপস্থিতি আছে তারমানে রিদকেও এখানে কোথাও পাওয়া যাবে। আয়ন জুইকে মায়ার সঙ্গে ফ্ল্যাটে দিয়ে সে আবার নিচে নেমে যাবে বলে এমনটা চিন্তা করে উপরে উঠতে গেলে তক্ষুনি হাঁক ছেড়ে ডাকাল রিদের এক ছেলে। আয়নকে চিনতে পেরে চিৎকার করে বলল সে….
‘ আয়ন ভাই! উপরে কেউ নাই। ভাই-ভাবি নিচেই আছে। ফ্ল্যাট তালা। আপনি ভাইকে সামনে পাবেন।
আয়ন আর সামনে এগোল না। যেহেতু রিদের ফ্ল্যাট তালা তাহলে সেখানে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। আয়ন সামনে এগোতে এগোতে জুইকে বলল….
‘ আমার সাথে আসুন জুই।
জুই আশেপাশে তাকিয়ে নিজের চোখে পানি মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। আশেপাশে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। রাস্তা এপাশ অপাশ শুধু রিদের লোকই দেখা যাচ্ছে। জুই নত মস্তিষ্কের হলো। আয়নের পিছন পিছন পা মেলাল। আয়ন খানিকটা পথ এগোতে রিদের গাড়ি দেখতে পেল। কিন্তু আশেপাশে কোথাও রিদকে দেখা গেল না। তবে আসিফকে দেখা গেল আয়নের থেকে কিছুটা পথ দূরে দাঁড়িয়ে ছেলেদের সঙ্গে। হয়তো রিদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সেখানে। আয়ন সেদিকে এগোতে চাইলে পথে দেখা পেল আরিফের। রিদের জনসভায় আরিফের উপস্থিত দেখে আয়ন খানিকটা কপাল কুঁচকাল। আয়ন যতটুকু জানে রিদের সঙ্গে আরিফের বনাবনি নেই। সেখানে আরিফ রিদের ছেলেপেলের সঙ্গে একত্রে দাঁড়িয়ে আছে বিষয়টা কেমন জানি লাগল আয়নের। আয়নের দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জুইয়ের দৃষ্টিতেও আরিফকে পরলো। রাস্তার অপাশে একটা দোকানে নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাকিরা খাবার কিনতে ব্যস্ত। প্রায় চল্লিশ জনের মতো ছেলেদের খাবার আনতে ছয় থেকে সাতজন ছেলের মতো হোটেলের ঢুকেছে। বাহিরে আরিফ রাকিবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। আরিফকে দেখেই জুই আয়নের হাতটা চেপে ধরলো ভয়ে। আয়ন জুইয়ের ভয়ের কারণ বুঝতে পেরে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বলল….
‘ আপনি ভয় পাবেন না জুই। আমি আছি।
আয়ন এগিয়ে এসে আসিফের সঙ্গে দেখা করে জুইকে একটা চেয়ারে বসাল আসিফকে জুইয়ের জিম্মাদার বানিয়ে। জুই খোলা ছাতার নিচে বসল জড়সড় হয়ে। একজন ছেলেকে দিয়ে জুইয়ের জন্য খাবার অর্ডার করে আয়ন এগোল রাস্তা অপর পাশে আরিফের উদ্দেশ্য। আয়নের কিছু কথা বলা বাকি। কথা বলতে আরিফের পারিবারিক মনোভাব বুঝতে চাই সে। যেহেতু মায়ার বিয়েটা এখন প্রকাশ্যে সবার সামনে আছে তাহলে আরিফের পরিবার রিদ-মায়ার বিয়েটা কেন মেনে নিচ্ছে না সেটাই মূলত আয়ন জানতে চাই। আয়নকে আসতে দেখে আরিফ নিজ থেকে এগিয়ে আসল আয়নের দিকে হাত বাড়িয়ে। হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময়ের বলল…
‘ আসসালামু আলাইকুম ভাই।
আয়ন হাত মিলিয়ে একই উৎফুল্লতায় হাসি মুখে উত্তর দিতে দিতে বলল…
‘ ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো আরিফ?
‘ এইতো ভাই আলহামদুলিল্লাহ আছি আপনাদের দোয়ায়। আপনি কেমন আছেন?
‘ আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ রাখছে। তা তোমরা এখানে কি করো?
কথা বলতে বলতে আয়ন রাকিবের সঙ্গেও হাত মিলাল। আরিফ উত্তর দিয়ে বলল…
‘ নিহাল আঙ্কেল কল দিয়েছিল উনাদের বাড়িতে যেতে। আসিফ ভাই ফোন করে বলল এখানে আসতে তাই আসলাম।
‘ যাক ভালো করেছো তাহলে। তোমাকে দেখে খুশি হলাম। আমরা সবাই চাই তুমি আমাদের সঙ্গেই মিলেমিশে থাকো। আমরা এখন একে অপরের আত্মীয় মানুষ তাই না?
আয়নের কথায় আরিফ অল্প হাসলো। তার মূলত কারও সাহায্য নিয়ে সামনে এগোনো পছন্দ না। সে কারও দাপটে নয় বরং নিজের যোগ্যতায় সামনে এগোতে চাই। আরিফ সৌজন্য মূলত হাসি দিয়ে বলল…
‘ দেখা যাক ভাই। আল্লাহ কপালে কি রাখছে।
আয়ন বলল…
‘ শুনলাম তুমি নাকি নতুন ব্যবসা শুরু করেছো?
‘ জ্বি ভাই।
‘ ভেরি গুড! তা তোমার ব্যবসার কি খবর? কেমন চলছে?
‘ জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের দোয়ায় ভালোই যাচ্ছে ভাই। এই সাপ্তাহ পর ইন্ডিয়া যাব কিছু নতুন কালেকশন ইনপুট করতে। ব্যবসাটা একটু বড়ো করতে চাইছিলাম।
‘ ইনশাআল্লাহ দোয়া রইল। আর কোনো হেল্প লাগলে অবশ্যই একজন বড় ভাই হিসাবে বলতে পারো আমাকে। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব।
আয়নের মনোভাব বুঝতে পেরেই আরিফ হেসে বলল….
‘ কি ব্যাপার ভাই? আপনিও কি আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষা করার মুডে আছে নাকি?
আরিফের কথায় আয়ন পাল্টা প্রশ্ন করে বলল…
‘ তোমার কি মতামত? আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষা করব না বলছো?
আয়নের পাল্টা প্রশ্নে আরিফ চুপ করে যায়। আয়ন আরিফকে চুপ করে যেতে দেখে ফের প্রশ্ন করে বলল…
‘ তোমরা কি এখনো রিদ-মায়ার সম্পর্কটা নিয়ে কোনো দ্বিধায় আছো আরিফ?
আরিফ সহজ গলায় বলল…
‘ না ভাই।
আয়ন তীক্ষ্ণতায় বলল…
‘ তাহলে তোমার পরিবার কেউ?
‘ বাসায় এখনো জানানো হয়নি মায়ার বিয়েটা সম্পর্কে। ভাবছি, আজকে রাতের ট্রেনে বাসায় ফিরে কাল এই বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে বসবো। তারপর সঠিক কোনো কিছু বলতে পারবো।
আরিফের কথায় আয়ন কৌতূহলী গলায় বলল…
‘ কেন তোমার পরিবার কি কোনো ভাবে রিদকে জামাতা হিসাবে মানতে আপত্তি আছে নাকি?
আরিফ নিজের পারিবারিক দিকটা প্রকাশ করে বলল…
‘ তেমন কিছু না ভাই, আসলে আমরা মায়ার বিয়ে চেয়ারম্যান পরিবারের ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার আব্বু-চাচ্ছুরা অনেক স্ট্রিক্ট আর জবানদারী মানুষ। উনারা মায়ার বিয়ের ওয়াদা করছিল চেয়ারম্যান পরিবারের সঙ্গে সেজন্য এটা নিয়ে একটু টেনশনে আছি আরকি। বাকি কিছু না।
আয়ন ফের প্রশ্ন করে বলল…
‘ তোমার পরিবার যদি মায়ার বিয়েটা নিয়ে আপত্তি জানায়?
আয়নের কথায় আরিফ দৃঢ়তায় উত্তর দিয়ে বলল…
‘ তাহলে মায়ার জায়গায় জুইয়ের বিয়ের প্রস্তাব রাখব পরিবারের। মায়া অলরেডি ম্যারিড সেখানে ওকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। চেয়ারম্যান পরিবার ভালো। ছেলেও শিক্ষিত জুইকে ভালো রাখবে। আব্বু-চাচারও ওয়াদা রক্ষা হবে।
আরিফের কথাটা যেন আয়নের কলিজায় লাগল। শকট খাওয়ার মতোন কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। আয়ন প্রথম ভেবেছিল এমন কিছু একটা হবে মায়াকে বিয়ে দিতে না পারলে পারিবারিক প্রেশারে জুইকে মায়ার জায়গায় বসাতে চাইবে। হচ্ছেও তাই। এজন্য আয়ন বিয়েটা নিয়ে জুইকে তাড়াহুড়ো করেছিল। শূন্য মস্তিষ্কের আয়ন এই মূহুর্তে আরিফকে কিছু বলার মতোন ভাষা খোঁজে পেল না। খানিকটা সময় নিয়ে আয়ন নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে চাইল আরিফের সামনে। জুইয়ের প্রসঙ্গটা এরিয়ে পুনরায় রিদ-মায়ার সম্পর্কের কথাটা জানতে চেয়ে বলল…
‘ রিদ মায়াকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছে সেটা তোমার পরিবারের মেনে নিবে?
আরিফ বুক ভারির দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে নরম গলায় বলল….
‘ এখানে আমি বা আমার পরিবারের কেউ ম্যাটার করে না ভাই। আমরা যদি কেউ গুরুত্বপূর্ণ হতাম, তাহলে এখানে আমাদের মত-অমতের প্রসঙ্গ আসতো। বলতে পারতাম আমাদের বোন আমাদের বাসায় যাবে আগে, তারপর বোনকে সসম্মানের ওর শশুর বাড়িতে পাঠাবো। এখানে আমরা অমূল্যহীন আর অমূল্যহীন মানুষের মতামত হয়না। সেজন্য আমি শুধু বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছি। নয়তো আমার বোন শব্দটা তো সেই কবেই পর হয়ে গেছে।
আরিফের কথার মানে আয়ন বুঝল। মান অভিমানে আরিফ মায়ার উপর কষ্ট পেয়েই চুপ করে থাকছে। ভাই-বোনের বনাবনি করার দরকার। রিদের সঙ্গে এই বিষয় কথা বলাও দরকার। নতুন সম্পর্ক গড়তে গিয়ে পুরাতন সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। সকল সম্পর্ক নিয়েই একত্রে আমাদের চলতে হবে। তবে তার আগে আরিফের মায়ার প্রতি অভিমানে দেয়াল ভাঙ্গতে হবে। আয়ন আঙ্গুল তুলে রাস্তা অপর পাশে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিদ-মায়াকে দেখিয়ে বলল…
‘ তোমার মায়ার প্রতি কষ্ট- অভিমান থাকতে পারে আরিফ। কিন্তু তোমার কি মনে হয় মায়ার নিজের জন্য ভুল কাউকে চুস করেছে?
আরিফ চোখ তুলে তাকাল আয়নের আঙ্গুল তাক করার পথে। অদূরে দেখা গেল রাস্তা একপাশে রিদ মায়া দুজনই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। রিদের একহাত কানে চেপে ফোনে কথা বলছে তো অপর হাতে মায়ার কলেজ ব্যাগ চেপে ধরা। মায়া রিদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রিদের প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বের করছে ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য। আয়নের কথায় আরিফকে চুপ করে যেতে দেখে আয়ন ফের বলল….
‘ আমি জানি তুমি হয়তো রিদের প্রতি নারাজ। কিন্তু আমি বলবো তুমি তোমার পার্সোনাল বিষয় গুলো আলাদা রেখে শুধু রিদ-মায়াকে দেখো। মায়ার জন্য রিদ থেকে পারফেক্ট কেউ হতে পারবে না আরিফ। তোমরা চেষ্টা করেও রিদের মতোন কাউকে মায়ার জন্য এনে দিতে পারবে না। রিদের রাগ বেশি হতে পারে কিন্তু সে তোমার বোনকে নিয়ে খুবই সেনসেটিভ। জীবনের এমন অনেক ছেলে পাবে তুমি যে প্রেম করে ধোঁকা দেয়। আবার কিছু ভালোবাসা সত্যিকারের হয়েও দেখবে শেষ পযন্ত ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে পারে না। কোনো না কোনো কারণে হেরে যায় তাঁরা, হয় পারিবারিক নয়তো সামাজের ভয়ে আর নয়তো মন বদলে ভালোবাসা গুলো হারিয়ে যায় কোথাও। তুমি এমন ভালোবাসা খুব কমই দেখতে পাবে যে তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার সাথেও লড়াই করে নিবে। সমাজ, পরিবার বা অন্য কোনো কিছু তাদের কাছে ম্যাটার করে না একমাত্র ভালোবাসার মানুষটা ছাড়া। মোট কথা কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমার হারাতে ইচ্ছুক নয়। আর সেটাই হচ্ছে রিদ খান। যে মায়াকে পাওয়ার জন্য, নিজের পরিবার, তোমার পরিবার এমনকি মায়াকেও সুযোগ দিচ্ছে না রিদ ছেড়ে যাওয়ার। এবার তুমি বলো, তুমি পারবে রিদের মতোন একটা ছেলে নিজের বোনকে এনে দিতে? পারবে?
আরিফ আবারও চুপ। আয়নের কথা ওর মস্তিষ্কের ধারণ করছে বুঝতে পেরে আয়ন ফের বলল…
‘ রিদ খানের ভালোবাসা শুধু ভয়ংকর নয় ভয়াবহ বটে । এই যে এক্ষুনি দেখো, আমি তুমি, রিদের বাবা, আমরা সবাই রিদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে অথচ রিদ খান নিজের বউয়ের ছোট ছোট আবদার পূরণ করতে ব্যস্ত। এরপর ও কি তুমি ভাববে এদের দুজনকে আলাদা করার কথা?
আয়নের পরপর কথায় আরিফ উত্তর করতে পারলো না। শুধু চুপ করে রইল। তার কাছে বলার মতোন আপাতত কোনো ভাষা নেই। তবে মায়া যে নিজের জন্য ভুল কাউকে বাচাই করে তাতে আরিফও সন্তুষ্ট।
~
রিদ কান থেকে ফোন নামিয়ে হাতে রাখল। পকেটে ফোন রাখা অভ্যাস তার নেই। মায়া পাশেই দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি চিবুচ্ছে। রিদ কপাল কুঁচকে মায়ার হাতের দিকে তাকাল। ঝালমুড়িতে মুড়ি কম মরিচ বেশি দেখা যাচ্ছে। মায়ার এতো ঝাল খাওয়ার ব্যাপারটা মোটেও রিদের পছন্দ নয়। মায়ার গায়ে এখনো সকালের কলেজ ড্রেস পড়া। মায়াকে রিদ কলেজ থেকে নিয়ে এসেছিল দুপুরে। তারপর দুপুরে লাঞ্চ দুজন একত্রে করেছে। এরপর থেকে মায়াকে সঙ্গে সঙ্গেই রাখছে রিদ। এখানের খালি ফ্ল্যাটে মায়াকে একা রাখা যাবে না বলে রিদ মায়াকে খান বাড়িতে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু আশেপাশে এতো ছেলেপেলে বলে রিদ মায়াকে নিয়ে সেও আলাদা আলাদা থাকছে। মায়ার গায়ে বোরখা না থাকার বিষয়টা মাত্রই লক্ষ করলো রিদ। কপাল কুঁচকে বলল…
‘ তোমার বোরখা কই?
মুড়ি চিবোতে চিবোতে মায়া ঝটফট উত্তরে বলল…
‘ আমার বোরখা নেই।
‘ কেন?
‘কেউ বলেনি কখনো বোরখা পড়তে সেজন্য দরকার পরেনি। কিনেও দেয়নি কেউ।
মায়ার কথায় রিদের মেজাজ খারাপ হলো। সে চোয়াল শক্ত করে বলল…
‘ স্টুপিড! কারও বলাতে তোমার বোরখা পড়তে হবে? নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে পড়তে পারো না?
মায়া মুড়ি চিবোতে চিবোতে রিদের দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ নাহ আমার বুদ্ধি নেই। আমি ছোট মানুষ সেজন্য বুদ্ধি খাটাতে পারি না।
মায়া কথা রিদ রাগে কটমট করে বলল…
‘ তুমি ছোট?
‘ হ্যাঁ!
‘ তাহলে আমি কে?
‘ আপনি মানুষ।
‘ শাটআপ।
‘ওকে!
রিদ দাঁতে দাঁত পিষে বলে…
‘ তুমি ছোট হলে আমি কি করে তোমার সাথে? স্বামী তো আরও আড়াই বছর আগেই জুটাইছো। তাহলে বুদ্ধি করে বোখরা পড়তে পারো না।
রিদকে রেগে যেতে দেখে মায়া খাওয়া থামিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল…
‘ রাগ করছেন কেন? কেউ আমাকে কখনো বোরখার কথা বলেনি সেজন্য পড়া হয়নি। আপনি বললে অবশ্যই পড়বো। আমিতো আপনার সব কথা শুনি তাই না।
মায়ার গাল ফুলানো কথায় মূহুর্তে রিদের সব রাগ নেমে গেল। মন মস্তিষ্ক শীতল হলো মায়ার কথায়। হঠাৎ করে অজানা কারণে মায়ার প্রতি খুব মায়া হলো রিদের। মনে হচ্ছে দুজনের শেষ দেখা এটা। যদি রিদ এসবে বিশ্বাসী নয়। তারপরও রিদ হাত বাড়িয়ে মায়ার মাথায় হাত রাখল পরম যত্নে। পরপর মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল…
‘ আমার হয়ে থাকবে তো সারাজীবন?
মায়া মিহি গলায় উত্তর করলো তক্ষুনি। বলল…
‘ আমিতো আপনারই।
‘ আমি না থাকলেও আমার হয়ে থাকবে তো?
রিদের কথাটা মায়া পছন্দ হয়নি। রিদ ছাড়া মায়ার অস্তিত্ব শূন্য। তাই মায়া কেমন জেদি সুরে উত্তরে বলল…
‘ আপনি না থাকলে আমিও নেই। আপনি আছেন বলেই আমি আছি। আপনি আমাকে ছাড়া কোথাও যাবেন না। আমি থাকতে পারবো না।
মায়ার কথায় রিদের মন শান্ত হলো। রিদ মায়াকে আশ্বস্ত করে বলল…
‘ কোথায় যাচ্ছি না বউ! এইতো আছি আমি।
রিদ মায়ার মাথা থেকে হাত নামাতে নামাতে পুনরায় হাতের ফোনটা ভেজে উঠতেই রিদ ফোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফের মায়ার দিকে তাকাল। মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল….
‘ আর কিছু খাবে তুমি?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই রিদ বলল….
‘ আচ্ছা তাহলে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে খাও আমি কলটা এটেন্ড করে আসছি কেমন?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল…
‘ আচ্ছা।
রিদ হাতের ফোনটা নিয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়াল মায়ার থেকে। বেশ একটা দূরে নয় এইতো দশ-পনেরো কদমের দূরত্বে দাঁড়িয়ে রিদ নিজের জরুরি ফোনালাপ চালাল। সাথে সর্তকতা অবলম্বন করে ফুটপাতের খানিকটা পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। সামনে দিয়ে রিকশা, অটোরিকশা, আর প্রাইভেট কারের যাতায়াত চলছে পরপর। সবকিছুই ঠিকঠাক স্বাভাবিক। আশেপাশে রিদের ছেলেপেলে আনাগোনা। মায়া ঝালমুড়ি চিবুচ্ছে। আর আয়ন আরিফসহ বাকি ছেলেদের নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে হাতে সকলের জন্য খাবার প্যাকেট নিয়ে। এমন্ত অবস্থা বিকশ শব্দে সবকিছু যেন থমকে দাঁড়াল। এক মূহুর্তে জন্য উপস্থিত কেউ বুঝল না কি হয়েছে আসলে। দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যে মায়ার গর্গন ফাটানো চিৎকারের মন্ত হলো সবকিছু। চোখে পলকে মায়ার হাতে ঝালমুড়ি আর রিদের ফোন দু’টোই রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো এলোমেলো ভাবে। তার সঙ্গে সঙ্গে রিদের নৃত্যন্ত দেহটা চলন্ত ট্রাকের সঙ্গে বাড়ি হয়ে লুটিয়ে পরলো রাস্তায়। মূহুর্তে মাঝে তরল তাজা র*ক্ত ভেসে গেল রাস্তা। গরগর করে ভেসে গেল সবকিছু। রিদের নিশ্বাস তখনো থেমে থেমে চলছিল। চোখের পাতা বন্ধ হওয়া পথে দেখা গেল মায়াকে চিৎকার করে দৌড়ে আসতে। রিদের দেহ অক্ষত অবস্থায় হলো মাথাটা বেশ থেঁতলে গেছে ট্র্যাকের সঙ্গে ভাবি খেয়ে। কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে র*ক্ত চোখের পাতা বেয়ে রাস্তায়। সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ আর নিশ্চুপ লাগছে রিদের কাছে। অথচ চারপাশে কেমন সোরগোল আর অস্থির উত্তেজিত পরিবেশ হয়ে উঠলো রিদের এক্সিডেন্টে। চারপাশের রিদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলেপেলে মাঝে মূহুর্তে দৌড়াদৌড়ি আর অস্থির উত্তেজনা চিৎকার শুনা গেল। সকলের মুখে মুখে ভাই! ভাইয়ের! স্বর চিৎকারের কম্পিত পরিবেশ। আয়নের আরিফের খাবার প্যাকেট গুলো রাস্তায় পরে রইল অবহেলিত অবস্থায়। শুধু রিদের ছেলেপেলেদের মধ্যে অস্থির উত্তেজানা প্রকাশ পাইনি। রাস্তা সবত্রে গাড়ি থেমে যায় রিদ খানের এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে। হৈচৈ, সোরগোল, দোকান পার্ট থেকে শুরু করে গাড়ি থেকে মানুষজন বেড়িয়ে দৌড়াল ট্র্যাকের পিছন পিছন আর বাকি রিদের উদ্দেশ্যে। মুখে মুখে সকলের একই কথা দেখেশুনে রিদ খানকে ট্র্যাক চালক টক্কর মেরেছে নয়তো রিদ রাস্তার ফুটপাতের ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল সেথায় সচারাচর রিকশা ব্যাতিত ট্র্যাক চলা নিষেধ। সেখান থেকে এক্সিডেন্ট মানে কেউ সেচ্ছায় এই কাজটা করেছে যড়যন্ত্র করে। এখন প্রশ্ন হলো রিদ খান বাঁচবে তো?
শান্ত স্বাভাবিক পরিবেশটা হঠাৎ করেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠলো। মায়ার গগন কাঁপানো চিৎকারের যেন মাটিসহ সবকিছু কম্পিত হচ্ছে। মায়া প্রথম রিদের মাথা কাছে বসল। উপুড় হওয়া রিদকে রাস্তা থেকে টেনে নিজের কোলে শোয়াল। রিদের থেঁতলে যাওয়ার মাথা দেখে মায়া শরীরের কম্পন বাড়াল। রিদকে দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে পাগলে মতোন চিৎকারে বলতে লাগল…
‘ জান, জান, জান চোখ বন্ধ করবেন না জান। কিচ্ছু হবে না আপনার। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। জান জান।
মায়ার অনবরত প্রবলে রিদ চোখ টেনে মায়ার দিকে তাকাল। নিশ্বাস প্রায় বন্ধের পথে তারপরও হাত বাড়িয়ে মায়ার মাথায় হাতটা রাখতে চাইলে মায়া মূহুর্তে মাথাটা ঝুঁকে দিলে রিদের সামনে। মায়া মাথার সাদা হিজাবের উপর রিদের কম্পিত হাতটা কোনো রকমের রাখতে র*ক্ত রঞ্জিত হয়ে গেল সেটা। রিদের মায়ার সঙ্গে আর শেষ কথা বলা হলো না তার আগে রিদের হাতটা মায়া মাথায় থেকে কোলে ঢলে পড়তেই মায়া পুনরায় চিৎকার করে পাগলামি করে বলল…
‘ এই,এই, আপনি এক্ষন আমারে বলছেন, আপনি আমারে ছাড়া কোথাও যাবেন না। তাহলে চোখ বন্ধ করলেন কেন? চোখ খুলুন। খুলুন বলছি। আমি আপনারে ছাড়া বাঁচব না জান। (রিদের সারা শব্দ না পেয়ে মায়া গগন কাঁপানো চিৎকার আসলো তক্ষুনি) আল্লাহ গো। আল্লাহ তুমি কই। আল্লাহহহহহ! আআআ।
মায়ার বুক ফাটা আর্তনাদে মানুষ থেকে শুরু করে যেন জমি, আসমান, গাছে পাতা গুলো যেন হাহাকার করছিল মিলের অমিল দেখে। ততক্ষণে রিদ মায়াকে ঘিরে দাঁড়াল সকলেই। আসিফ, আয়ন, আরিফ, জুইসহ উপস্থিত সকলের ভিড় পরলো সেখানে। ছোট বড় সকালের চোখে পানি। আয়ন আসিফ এমনকি আরিফসহ সকলেই কাঁদছে ভাই ভাই বলে। আয়নের চোখেও পানি। একজন ডাক্তার হয়েও সে কম্পিত হাতে রিদের পার্লস চেক করছে। চারপাশে মূহুর্তে মাঝে কেমন হাহাকার চেয়ে গেল। আয়ন আসিফসহ কিছু ছেলেপেলে রিদের দেহটা ধরাধরি করে উঠাতে চাইলে জুই আরিফ এগিয়ে এসে মায়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে আঁটকাল দু’হাতে টেনে। মায়া শক্তিতে আরিফ আর জুইয়ের সঙ্গে উঠতে না পেরে ছটফটে লাফাতে লাগল রিদকে নিয়ে যেতে দেখে। মায়া পাগলের মতোন ধ্বস্তাধস্তি করল জুই আরিফের থেকে ছাড়া পেতে।আর্তচিৎকার বলতে বলতে লাগল মায়া…
‘ জুই আমারে ছাড়। আমারে যাইতে দে তোরা। আমার স্বামী! আমার স্বামী ভালো নেই জুই। আমার স্বামী ভালো নেই। আমি উনারের ছাড়া বাঁচবো না জুই। আমারে যাইতে দে তোরা। যাইতে দে। আল্লাহ! ওহ আল্লাহ! আল্লাহহহহ গো!
চিৎকার করতে করতে মায়া শক্তিতে উঠতে না পেরে বসে গেল। মায়াকে রাস্তায় বসে যেতে জুই আরিফ দুজনই মায়ার দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাস্তায় বসিয়ে রাখলে মায়া পুনরায় ধ্বস্তাধস্তি করে আরিফের কাছে আকুতি করে বলল…
‘ ভাই আমারে যাইতে দাও না ভাই। তোমার পায়ে পড়ি আমি। আমার স্বামী ভালো নেই ভাই, আমার তার কাছে যাইতে দাও। আমার উপর দয়া করে ভাই। আমারে যাইতে দাও। সবাই উনারে নিইয়া চইলা যাইতাছে ভাই। আমারে যাইতে দাও তুমি। আমি উনারে ছাড়া বাচবো না ভাই। বাঁচবো না। আল্লাহহ। আল্লাহহহহহ।
মায়ার আর্তচিৎকার জুই আরিফ দুজনই কাঁদল তারপরও মায়াকে ছাড়াল না। এখানে অসংখ্য ছেলেদের মাঝে মায়া কোথায় যাবে? তাছাড়া রিদের এই কন্ডিশনল মায়ার থাকা ঠিক হবে না। কারণ রোগীর কাছে চিৎকার করা ঠিক না। তাছাড়া মায়ার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে সে রিদের ক্ষতি না করলেও নিজের ক্ষতি করে ফেলবে পাগলামি করতে করতে। তাই আপাতত মায়াকে রিদের থেকে দূরে রাখতে আরিফ জুই মায়াকে আঁটকে রাখল। রিদকে হসপিটালাইজ করলে না-হয় তখন আরিফ মায়াকে নিয়ে যাবে দেখতে। রিদের দেহটাকে সকলে দৌড়াদৌড়ি করে গাড়িতে উঠাতে দেখে মায়া ফের গর্জের চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকল সাহায্য চেয়ে…
‘ আল্লাহহহহ! ওহ আল্লাহহ! তুমি কই আল্লাহ তুই কই? তুমি সহায় হও তার। আল্লাহহহ! আআআআআ
বলতে বলতে মায়া জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরলো আরিফের কোলে। মায়ার সাদা ড্রেস রিদের তাজা র*ক্তে লাল লাল হয়ে আছে মাথা থেকে পা পযন্ত। রিদের গাড়ি নিয়ে যেতেই রাস্তার মানুষজন মায়াকে ঘিরে ভিড় জমাল গঞ্জন করতে করতে।
#চলিত….