রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৫৪

0
5

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৫৪_ প্রথমাংশ
কোলাহলময় একটি অস্থির উত্তেজিত পরিবেশ। দিনের শেষে সন্ধ্যার আবেশ ধরনী জুড়ে। সময়টা প্রায় ছয়টা ত্রিশের ঘরে। অবস্থান চট্টগ্রাম মেডিকেল হসপিটাল। রিদের এক্সিডেন্ট হয়েছিল প্রায় চারটের নাগাদ। বিগত আড়াই ঘণ্টা যাবত রিদকে নিয়ে ওটিতে ডক্টররা। ইমার্জেন্সি চলছে। সেখানে উপস্থিত আয়ন নিজেও। প্রফেশনাল ডাক্তার হয়েও আজ তার বুক হাত উভয় কাঁপছে রিদকে শয্যাশায়ী দেখে। আয়নের দেখা এই প্রথম রিদ খান নিস্তব্ধ আর নিশ্চুপ শুয়ে আছে। মাথা একপাশ থেঁতলে যাওয়ায় সেখানটায় ট্রিটমেন্ট চলছে। আয়ন প্রফেশনাল ডাক্তার হওয়ায় সে বুঝতে পারছে এসব চিকিৎসা রিদের তেমন কাজে দিবে না। রিদের শ্বাস খুবই ধীর গতিতে ফেলছে। বলতে গেলে থেমে থেমে। মস্তিষ্কে আ*ঘাত পেয়েছে ভিষণ। সেজন্য শরীর রেস্পন্স করছে না। মৃ*ত্যু দেহের নেয় নেতিয়ে রিদের শক্তপোক্ত শরীরটা। রিপোর্টে এসেছে এক্সিডেন্টের ফেলে রিদের মস্তিষ্কে র*ক্ত*ক্ষ*রণ হয়েছে বেশ। যার জন্য রিদের নাক-কান উভয় পথে র*ক্ত ঝরেছে। মস্তিষ্কে র*ক্ত জমাট বাঁধার কারণে এটা রিদকে কোমায় নিয়ে যাওয়ার চান্স বেশি। আয়নের দুচোখ সিক্ত হলো নোনা জ্বলে। সে ইতিমধ্যে রিদের সকল রিপোর্ট দেখেছে। সেখানে স্পষ্ট লেখা পেশেন্টের লাইফ চান্স ১০%। যার জন্য আয়নের বুক কাঁপছে রিদের বর্তমান পরিস্থিতি কথা ভেবে। অসহায়, হাহাকার বুকে দু’হাতে মুঠোয় রিদের হাতটা চেপে ডাক্তার সঙ্গে ওটিতে দাঁড়িয়ে। সে নিজে ডাক্তার হয়েও রিদকে চিকিৎসা করার মতোন শক্ত মনোবল আয়নের এই মূহুর্তে নেই। তার চেয়ে যেটা আয়নকে বেশি ঘায়েল করছে সেটা হলো রিদের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। বাহিরে দেশে কোথাও নিতে হবে। কিন্তু বাহিরে দেশে নেওয়া অব্দি রিদের শ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে কিনা সেই আশঙ্কার ভয়ে আয়নসহ গোটা ডক্টর টিম। ভঙ্গ হৃদয়ে আয়নের চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইল। কারণ এই মূহুর্তে রিদের জন্য করার মতোন কারোও হাতে কিছু নেই। আয়ন চেয়েও রিদের জন্য কিছু করতে পারছে না। ডক্টররা যারা ইমার্জেন্সিতে রিদের ট্রিটমেন্ট করছে তারা একটু পর ট্রিটমেন্ট শেষে আয়নকে কি বলবে সেটা আগ থেকেই জানা আয়নের। নিরাশ আয়নের বারবার চোখের পাতা ভিজে উঠলো নোনাজলে। ছেলেদের কাঁদতে নেই অথচ আয়ন আজ চেয়েও নিজের চোখের পানি থামাতে পারছে না। বুক ফাটা কষ্টে তীব্র কান্না পারছে ওর। ওটির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা আপনজনদের কি জবাব দিবে সে? যখন জানতে চাইবে রিদ কেমন আছে? কি বলবে? রিদ ভালো নেই? রিদের বাঁচার সম্ভবনা ১০% বা তারও কম? আয়নের চিন্তা ভাবনার মাঝেই বাকি ডক্টরা রিদের মাথার আঘাত প্রাপ্ত যায়গা গুলোতে ওয়াশ করে প্রাথমিক সেলাই করে পিছন ঘুরতে ঘুরতে ডক্টর রাশেদ আয়নের উদ্দেশ্যে বলল…

‘ পেশেন্টের মাথার অবস্থা খুবই খারাপ ডক্টর আয়ন। আমাদের ধারণা বাকি চিকিৎসা সম্ভব নয়। যত দ্রুত সম্ভব পেশেন্টকে ঢাকা ট্রান্সফার করুন প্লিজ। উনার বাঁচা খুব কম। বাকিটা আপনি হয়তো রিপোর্টে দেখেছেন ডক্টর আয়ন।

ডক্টর রাশেদ কথা গুলো বলেই আবারও রিদের রিপোর্ট গুলো চেক করতে বেড়িয়ে যেতেই আয়ন হাঁটু গেঁড়ে বসে গেলো ফ্লোরে। দু’হাতে মুঠোয় রিদের নিস্তেজ হাতটা চেপে কপালে ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল বুক ফাটা আর্তনাদে…

‘ আই এম সরি ভাই। আই এম সরি! তোর জন্য কিছু করতে পারছি না। কিছু না।

আয়নের কান্না বলে দিচ্ছে রিদকে ইমার্জেন্সিতে ঢাকা ট্রান্সফার করালেও সেখানে ডক্টরাও তাই বলবে যা এই মূহুর্তে ডক্টর রাশেদ বলে গেল। তাঁরাও হয়তো ডক্টর রাশেদ মতোন দু’ঘন্টা চেষ্টার পর জানাবে তাদের ধারণা সম্ভব নয় পেশেন্টের সুস্থতা নিশ্চিত করা। অথচ ওটির বাহির থেকে আপনজনদের হাহাকার আর কান্নার গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। তাদের কি উত্তর দিবে আয়ন? কি বলবে? আয়নের কান্নার মাঝেই হসপিটালের তীব্রস্বরের যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এলো বাহির থেকে। তীব্র কম্পনে শাঁ শাঁ শব্দে আয়ন রিদের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে জানে শব্দ কিসের। কার আগমন ঘটেছে চট্টগ্রামের মাটিতে। আয়ন অশ্রু সিক্ত চোখে গিয়ে দাঁড়ালো ওটির জ্বানালার পাশে। থাই গ্লাস দিয়ে নিচে তাকাতেই চোখে পড়লো শতশত মানুষের ভিড় হসপিটালের চত্বরে। সকলেই রিদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে হসপিটালের চত্বরে। মন্ত্রী নিহাল খানের ছেলে রিদ খানের এক্সিডেন্ট বলে কথা হসপিটালের ভিড়তো এমনি হতো। তবে প্রশাসনের পুলিশ ভিড়ও দেখা গেল সেখানে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জায়গায় জায়গায় পুলিশ দাঁড়িয়ে। কিন্তু অস্থির উত্তেজিত পরিস্থিতির জন্য হসপিটালের অন্যান্য রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে সেটা জেনেও কারও হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার মতোন কিছুই নেই। প্রতিনিয়ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নিহাল খানের রাজনৈতিক দলের লোক থেকে শুরু করে বড় বড় নেতৃবৃন্দসহ উপস্থিত আজ হসপিটালের চত্বরে। আয়ন চোখ ঘুরিয়ে তাকাল শূন্য আকাশ থেকে নামা হেলিকপ্টারটির দিকে। গোল গোল পাখা ঘুরিয়ে হেলিকপ্টারটি নামলো হসপিটালের থেকে বেশ দূরে খালি মাঠে। যেখানে আগ থেকেই উপস্থিত ছিল রিদের বেশ কিছু বডিগার্ড। ক্যাপ্টেন হেলিকপ্টারের দরজার লক খুলে দিতেই দুজন বডিগার্ড এগিয়ে এসে দরজা টেনে খুলতেই বেড়িয়ে আসল রিদের মা সুফিয়া খান। তিনি হেলিকপ্টার থেকে বেড়িয়ে সোজা হাঁটল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আজ প্রায় পনেরো বছর পর এই চট্টগ্রামের মাটিতে পা পরেছে উনার। সেই পনেরো বছর আগে এক কাপড়ে স্বামী ঘর ছেড়েছিলেন তিনি ,আর আজ পনেরো বছর পর ফিরছেন ছেলের এক্সিডেন্টের খবর শুনে। বিগত পনেরো বছর আগে যখন এই দিনে স্বামীর ঘর ছেড়েছিলো সেদিন উনার চোখে জল ছিল না। ছিল শুধু রাগ আর জেদের বশবতী হয়ে স্বামী ও সংসার ছেড়েছিলো তিনি কিন্তু আজ চোখ ভরতি মমতার। শক্ত মানুষ গুলো নাকি কাঁদলে মানায় না। যেমনটা সুফিয়া খানকে দেখলে যেকেউ বলবে সেটা। আজ অবধি কখনো কেউ সুফিয়া খানকে কাঁদতে দেখেছে কিনা জানে না। নিহাল খান নিজেও হয়তো কখনো নিজের বউকে কাঁদতে দেখেনি। এমনকি সুফিয়া খানের বাবা-মার মারা যাওয়ার সময়কালেও তিনি দেখেনি সুফিয়া খান কাঁদতে। অথচ আজ উনার চোখের পাতাসহ লাল হয়ে ফুলে আছে অতিরিক্ত কান্নার ফলে। শক্ত মানুষ গুলো কাঁদলে শব্দ হয়না। নিশ্চুপে শুধু চোখে জলই ঝরে যায়। এই মূহুর্তে সুফিয়া খানের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে অতিরিক্ত রাগে অথচ চোখসহ গাল অনবরত ভিজে উঠছে কান্নায়। সুফিয়া খান হসপিটালের করিডোরে পা রাখতেই আপনজনের কান্নার শব্দ ভেসে এলো কানে। রিদের তিন ফুপির দুই ফুপিও উনাদের স্বামী সন্তানেরা সকলেই উপস্থিত হসপিটালে। আয়নের বাবা-মা বাদে। উনারা লন্ডনের বাসিন্দা সেজন্য আজ এই মূহুর্তে এখানে নেই। তবে শশী ও তার মা-বাবা দুজন অশ্রু সিক্ত চোখে খান বাড়ির সকলের সাথে দাঁড়িয়ে। বলতে গেলে খান বাড়ির হাতেগোনা কয়েকজন কর্মচারী বাদে সকলেই উপস্থিত হসপিটালে রিদের খবর জানতে। সুফিয়া খান পরিচিত মানুষের মুখ সেই নিচ তলা হতে তৃতীয় ফ্লোরে উঠা অবধি দেখা পেয়েছে। সকলের দৃষ্টি কেন্দ্র বিন্দু ছিল রিদের মা সুফিয়া খান। হসপিটালের করিডোরের পরিচিত অপরিচিত অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে থাকায় হাঁটা রাস্তা নেই। তবে সুফিয়া খানের আগমন সকলেই করিডোরে দুপাশে হয়ে দাঁড়াল রাস্তা করে। অপারেশন থিয়েটার সম্মুখে মাথা ঝুঁকে ফ্লোরে বসেছিল নিহাল খান। হঠাৎ পায়ের খটখট শব্দে সামনে তাকাতে চোখে পরলো একটা প্রিয় মুখ। নিস্তব্ধ নিশ্চুপ পলকে তিনি সেদিকেই তাকিয়ে রইল তেজে হেঁটে আসা রাগান্বিত মহিলাটির দিকে। অতি আপনজনে অতি প্রিয় একটা মুখ নিহাল খানের। অথচ আজ কতোটা বছর পর সামনে থেকে দেখা পেল তিনি। নিহাল খানকে একই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রথম রাদিফ পরে সকলেই তাকাল সুফিয়া খানের দিকে। সুফিয়া খানকে দেখে অতি আবেগ ভালোবাসা দেখিয়ে শশীর মা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরতে চাইলে সুফিয়া খান হাতের ইশারায় বাধা দিয়ে সামনে হাঁটালো। উপস্থিত সবাইকে এরিয়ে মুখোমুখি হলো ডক্টরের সঙ্গে। ডক্টর রাশেদ সবেমাত্র ওটি থেকে বেড়িয়ে ছিল সবার সঙ্গে কথা বলবে বলে। কিন্তু তার আগেই মুখোমুখি হলো সুফিয়া খান। ডক্টর রাশেদ কিছু বলবে তার আগেই অস্থির উত্তেজিত ব্যাকুলতায় প্রশ্ন করলো সুফিয়া খান…

‘ ডক্টর আমার ছেলের কি অবস্থা? ওকে দেখতে পারবো একটু?

সুফিয়া খানের সম্পর্কে বেশ ধারণা ছিল না ডক্টর রাশেদের। তিনি মন্ত্রী নিহাল খানকে চিনলেও উনার বউ হিসাবে সুফিয়া খানকে চিনেন না। আর না কখনো দেখেছে। ডক্টর রাশেদ সুফিয়া খানের কথার উত্তর করলো না মেয়ে মানুষ বলে তিনি সরাসরি কোনো পুরুষের সাথে কথা বলতে চাই। বিশেষ করে রিদের বাবা নিহাল খানের সঙ্গে। সেজন্য তিনি আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে নিহাল খানের খোঁজ করলো রিদের কন্ডিশন জানাতে। পেয়েও গেল নিচে ফ্লোরে বসা নিরুপায় বিধস্ত নিহাল খানকে। ডক্টর রাশেদ সুফিয়া খানকে এরিয়ে নিহাল খানের দিকে ঘুরে বলতে চাইল…

‘ স্যার পেশেন্টের কন্ডিশন স্টেবল না। প্রচুর র*ক্ত*পাত হয়েছে মাথা থেকে…

ডক্টর রাশেদ বাকি কথা শেষ করার আগেই সুফিয়া খান অস্থির উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডক্টরের উদ্দেশ্য বলল….

‘ আমাকে বলুন যা বলার ডক্টর। পেশেন্টের অবস্থান সম্পর্কে আমাকে জানান। আমি গার্ডিয়ান পেশেন্টের।

সুফিয়া খানকে না চিনায় এবারও ডক্টর রাশেদ সুফিয়া খানকে অপেক্ষা করে পুনরায় ঘুরে গেল নিহাল খানের দিকে। যেখানে স্বয়ং মন্ত্রী নিহাল খান দাঁড়িয়ে আছে সেখানে অন্য কারও সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না ডক্টর রাশেদ। ততক্ষণে নিহাল খানও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল ডক্টরের সঙ্গে কথা বলতে। উনার চোখ মুখ ফুলে আছে অতিরিক্ত কান্নায়। উপস্থিত সকলের চোখে নোনাপানি। ডক্টর রাশেদ নিহাল খানের উদ্দেশ্য আবারও বলতে চাইল…

‘ স্যার পে….
ডক্টর রাশেদ বাকি কথা শেষ করার আগেই শক্ত হাতে উনার কর্লার চেপে ধরলো সুফিয়া খান। গর্জে উঠার মতোন রাগে তিরতির মেজাজে বলল…

‘ আমাকে চোখে পরে না? আমি কথা বলছি কানে যায় না? কই টাকার ডাক্তার তুই? আমাকে উপেক্ষা করিস। সাহস দেখাস? আমাকে চিনিস?

সুফিয়া খানকে ক্ষেপে যেতে দেখে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে আসল রাদিফ, আসিফ আর হেনা খান। আসিফ সুফিয়া খান কে টাচ্ না করলেও রাদিফ নিজের মাকে শান্ত করার জন্য হাত টানলো পরিস্থিতি সামাল দিতে। ভাঙ্গা গলায় ডক্টর রাশেদের উদ্দেশ্যে বলল….

‘ উনি আমাদের মা ডক্টর। যা বলার আম্মুকে বলুন। আমরা শুনব।

সুফিয়া খানের বগল থাবাই যতটা না ভয় পেয়েছিল এখন আসল পরিচয় পেয়ে ভিতরকার ভয়টা আরও বেড়ে গেল ডক্টর রাশেদের। তিনি এবার সুফিয়া খানকে বলতে লাগল…

‘ আসলে পেশেন্টের মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে। মাথার বাম পাশটা পুরো থেঁতলে যাওয়ার কারণে পেশেন্টের মস্তিষ্কের রক্ত উঠে গেছে যার জন্য পেশেন্টের লাইফ চান্স ১০%। এতো রিস্কের মধ্যে ট্রিটমেন্ট করা আমাদের ধারণা সম্ভব নয়। আমরা ঢাকা ট্রান্সফার করালেও সেখানেও সেইম কথাটাই বলবে। বলতে পারেন পেশেন্টের কন্ডিশন অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা বাংলাদেশ কোথাও সম্ভব নয় এই মূহুর্তে। বাংলাদেশের ডক্টর পারবে না পেশেন্টের মাথার সেনসেটিভ পার্টে সার্জারী সঠিকভাবে করতে। আমরা….

ডক্টর রাশেদের কথায় শেষ না হতেই পুনরায় তেতে উঠলো সুফিয়া খান। তাঁরা যদি সঠিক ট্রিটমেন্ট করতে না পারে তাহলে এতক্ষণ পযন্ত তাদের কাছে পেশেন্টটা আটকিয়ে রাখল কেনো এই হসপিটালে? এতে পেশেন্টের চিকিৎসার অভাবে লাইফ চান্স কমছে না প্রতিনিয়ত? তেতে উঠা সুফিয়া বেগম পুনরায় নিজের মেজাজ হারিয়ে একই ভাবে কর্লার চেপে ধরলো ডক্টর রাশেদের। রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলল….

‘ কিছু করতে না পারলে আমার ছেলেকে এতক্ষণ কেন রেখেছেন হসপিটালের মধ্যে ? আমার ছেলের কিছু হলে এর দ্বায়ভার কে নিবে? আপনি? বলেন আপনি?

সুফিয়া খান নিজের অতিরিক্ত রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আবারও বলল….

‘ আমার ছেলের যদি কিছু হয় তোর মতোন শত ডাক্তারের ঠিকানা আমি একাই লাগাবো ডক্টর।

করিডোরে ভিড়ে জমে থাকা অসংখ্য মানুষ গুলো হঠাৎ কেমন নিশ্চুপ আর ভয়ে চুপ হয়ে গেলো সুফিয়া খানের তেজ দেখে। উপস্থিত সকলেই কেমন অবাক চোখে তাকালো সুফিয়া খানের দিকে। সকলেই জানতো রিদ খানের মা আছেন কিন্তু তিনি কে? বা কেমন সেটা কেউ জানতো না। আর যারা জানে সুফিয়া খানের সম্পর্কে তাঁরা সকলেই চুপ। নিহাল খানের সঙ্গে উনার দলের লোকসহ থানার ওসি, এসআই বেশ কিছু পোষাকদারি পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। সুফিয়া খানের রাগ দেখে তারাও বোকার মতোন তাকিয়ে আছে। মেয়ে মানুষের এতো রাগ হতে পারে সেটা জানা ছিল না কারোও। এ যেনো রিদের প্রতিচ্ছবি যেটা আজ দেখলো। নিহাল খান নিজের বউয়ের সম্পর্কে ধারণা থাকায় তিনি উত্তেজিত পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসতে চাইল সুফিয়া খানের দিকে। আজ বিগত পনেরো বছরের মনমালিন্যতা পিছনে ফেলে প্রথমবারের মতোন নিজের বউয়ের মুখোমুখি হতে চেয়ে কথা বলতে চাইল। সুফিয়া খানকে বাঁধা দিয়ে এগিয়ে এসে বলতে চাইল…

‘ তুমি প্লিজ শান্ত হও সুফ….

নিহাল খানের বাকিটা শেষ করার আগেই ঠাস করে থাপ্পড় পরলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাদিফের গালে। এই পরিস্থিতিতে মায়ের হাতের থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল বাবার দিকে তাকিয়ে। রাগে কটমট করছে সুফিয়া খান। রাদিফকে মারতে দেখে হাই হাই করে উঠলো হেনা খান। আরাফ খান এই হসপিটালেই এডমিট। তিনি অসুস্থ হয়ে পরেছেন রিদের খবর শুনে। বয়স্ক মানুষ হওয়ায় রিদের এক্সিডেন্টের খবর শুনে অতিরিক্ত কান্নার ফলে জ্ঞান হারিয়ে একই হসপিটালের অন্য কেবিনে শুয়ে আছে। নিহাল খান রাদিফকে মারতে দেখে তিনি সুফিয়া খানকে আবারও বাঁধা দিয়ে বলতে চাইল…

‘ ওকে কেন মারছো? ওহ….

পুনরায় ঠাস শব্দে রাদিফের অপর গালে থাপ্পড় পরলো সুফিয়া খানের। নিশ্চুপ পরিস্থিতি আরও নিশ্চুপ হয়ে গেল পরপর দুটো থাপ্পড়ের শব্দে। নিহাল খান বুঝতে পারলো রাদিফের গালে পড়া থাপ্পড় দুটো রাদিফের গালে নয় বরং অদৃশ্য ভাবে উনার গালে মেরেছে সুফিয়া খান। কারণ রিদের আজ এই পরিস্থিতির জন্য উনার বউ সরাসরি উনাকেই দ্বায়ী করছে সেজন্য উনার রাগটা রাদিফের উপর দিয়ে যাচ্ছে এখন। রাদিফ পরপর দু’গালে হাত দিয়ে অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে, রাদিফের অসহায় দৃষ্টি বলছে, বাবা তুমি এই মূহুর্তে চুপ থাকো প্লিজ। নিহাল খান চুপ করে গেলেও হেনা খান সুফিয়া খানের হাত টেনে নিজের দিকে ফেরাতে ফেরাতে বলল….

‘ কি করছো তুমি সুফিয়া? সবাই দেখছে তোমাকে। এটা হসপিটাল বাড়ি নয়।

হেনা খানের কথায় তৎক্ষনাৎ সুফিয়া খান রাগে তেতে উঠে বলল…

‘ আপনার ছেলের জন্য আজ আমার ছেলের এই অবস্থা হয়েছে মা। আজ যদি আমার ছেলের কিছু হয় আপনার ছেলের জন্য তাহলে আমি আপনার ছেলেকে ছাড়বো না মা। পনেরো বছর আগে যে কারণে আপনার ছেলেকে আমি ছেড়েছিলাম আজ ঠিক একই কারণে আমার ছেলে মরতে বসেছে। আজ আপনি কি বলবেন?

সুফিয়া খানের কথায় নরম হয়ে আসল হেনা খানের সুর। তিনি বলল…

‘ নিহাল কি ওর ছেলের ক্ষতি করবে সুফিয়া?

‘ দোষ গুণ জানি না মা। আমার ছেলের কিছু হলে আমি আপনার ছেলেকে ছাড়বো না। এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব।

কথাটা বলতে বলতে তিনি তৎক্ষনাৎ তেজি স্বরে ডাকল আয়নকে….

‘ আয়ন। আয়ন!

ওটি থেকে কয়েক সেকেন্ড মধ্যে বেড়িয়ে আসল আয়ন। গায়ে ওটির পোষাক। মুখে মাক্স খুলে সুফিয়া খানের মুখোমুখি হতে হতে নরম গলায় বলল…

‘ জ্বি মামী।

‘ কি করতে হবে বলো? কোন দেশে নিতে হবে আমার ছেলেকে। ১০ % কেনো? ১% চান্স হলেও আমি ছেলেকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনব ইনশাআল্লাহ। দ্রুত বলো কোথায় নিতে হবে বাকিটা আমি সামলে নিবো। আমি আমার ছেলের সুস্থ্যতা নিশ্চিত করতে চাই।এ্যাট এনি কস্ট।

‘ মামী রিদের কন্ডিশন স্টেবল না। এই অবস্থায় ওকে আগে চব্বিশ ঘণ্টা ট্রিটমেন্টের মধ্যে রাখতে হবে নয়তো বিপদে পরে যাবো আমরা।

‘ তাহলে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ডাক্তারসহ নিয়ে নাও আয়ন। কোন দেশে নিতে হবে বলো। আমরা এখান থেকে রিদকে ট্রিটমেন্ট দিতে দিতে নিয়ে যাবো বাহিরে। সময় কম দ্রুত বলো কোন দেশ ভালো হবে।

‘ ডক্টররা সিঙ্গাপুর কথা বলছে। তবে আমার মনে হয় লন্ডনে গেলে রিদের ট্রিটমেন্টের জন্য বেস্ট হবে। সেখানে আমাদের পরিবারের সবাইও আছে। হসপিটাল থেকে শুরু করে ডক্টরদের সঙ্গে আমার রিদের রাদিফের তিনজনেরই পরিচিত ভালো আছে।
সবটা সহজে সামলে নেওয়া যাবে।চিকিৎসার জন্য উত্তম হবে।

‘ ওকে ডান। আসিফ!

সুফিয়া খান ডাকতেই তৎক্ষনাৎ উত্তর আসলো আসিফের…
‘ জ্বি ম্যাডাম।

‘ ইমার্জেন্সি এয়ারলাইনসের জন্য যা যা করা লাগে সব ঠিক কর। দরকার হলে পুরো ফ্লাইংজেট বুকিং কর। আজ রাতের মধ্যেও লন্ডন যেতে চাই।

‘ জ্বি ম্যাডাম সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

#চলিত…..

#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া

৫৪_শেষাংশ
রাত তখন দশ-টার ঘরে। আরিফ ক্লান্তিতে বাসায় ফিরলো সবে। চোখে মুখে উদাস আর ব্যর্থতার গ্লানি। বাসার কলিংবেল বাজাতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিলো নিজের অজান্তে। দরজায় কপাল ঠেকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো পরপর। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো তিক্ততায়। কিছু ভয়ংকর অনুভূতি হচ্ছে আরিফের এই মূহুর্তে। সময়টা কোথায় থেকে কোথায় এনে দাঁড় করালো। দরজার ওপাশে আদুরের ছোট বোন বেহুশ অবস্থায় পরে। আর দরজার এপাশে আরিফ অপরাধীর নেয় দাঁড়িয়ে। যখন মায়ার জ্ঞান ফিরবে আর জানতে চাইবে ওর স্বামী কোথায়? ঠিক আছে কিনা তখন আরিফ কি উত্তর দিবে? কি বলবে? যে আরিফ গিয়ে ছিলো হসপিটালে রিদের খবর নিতে অথচ মানুষের ভিড়ে সে কারও সাথে দেখা করতে পারেনি এমনটা বলবে? আসলেই আরিফ দেখা করতে পারেনি নাকি অন্য কিছু ছিল? রিদের এক্সিডেন্টের পর সবাই যখন রিদকে হসপিটালে নিয়ে যায় তখন আরিফ অজ্ঞানরত মায়াকে বাসায় নিয়ে আসে। ডাক্তার দেখায়। মায়ার হুশে ফিরার অপেক্ষা করে। একবার মায়া হুশে ফিরে আসলে তখন মায়াকে বুঝিয়ে শুনিয়ে হসপিটালে যাবে এমনটা আরিফের চিন্তা ভাবনা ছিলো। সেজন্য ডাক্তার দেখিয়ে মায়ার হুশে ফিরার অপেক্ষা পর্যন্ত করেছিলো আরিফ। অবশেষে দেখা যায় ঘন্টা খানিকের ভিতর মায়ার হুশ ফিরে আসলেও মায়া তখন মানসিক ভাবে স্টেবল ছিল না। বরং অতিরিক্ত পাগলামি আর চিল্লাচিল্লি করতে করতে দশ মিনিটের মাথায় আবারও জ্ঞান হারায় মায়া স্বামী,স্বামী করতে করতে। মায়ার অবস্থা দেখে আরিফ আবারও ডাক্তার ডাকলো। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মায়ার ব্রেইন শান্ত থাকার জন্য ঘুমের ইনজেকশন দিলো মায়াকে। আরিফ বাধ্য হয়ে মায়াকে ঘুমে রেখে ওহ একাই হসপিটালে গিয়েছিলো রিদের খবর নিতে। আরিফ হসপিটালে যেতে যেতে দেখলো বিশাল ভিড় জমে আছে হসপিটালের চত্বরে। খান বাড়ির সকলের হাহাকার আর আর্তচিৎকারে উপস্থিত সকলের চোখে পানি। আরিফ আজ প্রথমবারের মতোন রিদ খানের মাকেও দেখেছিলো সে। সেকি দারুণ তেজ মহিলার। এমন শক্ত পার্সোনালিটির মহিলা আরিফের দেখা এই প্রথম ছিলো সুফিয়া খান। চোখের পলকে ছেলেকে ঢাকা ট্রান্সফার করান। কারও কোনো কথা বা কাউকে ভিড়তেও দেয়নি ছেলের আশেপাশে। হসপিটালের আরিফ ছিল তৃতীয়পক্ষ। সবে একদিন হয়েছিলো রিদ-মায়ার সম্পর্কে কথাটা সবাই জেনেছিল। এখনো কেউ খান বাড়িতে মায়ার সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে, এমনটা বলেনি অথচ এই ধোঁয়াশায় অবস্থায় রিদের এক্সিডেন্ট হওয়াতে আরিফ আগ-বাড়িয়ে বোনের স্বামী হিসাবে রিদের খবর জানতে পারছে না। কেমন একটা সংকোচবোধ ছিল আরিফের মনের মধ্যে। তারপরও আরিফ সকল সংকোচবোধ পা ঠেলে আগ বাড়িয়ে গিয়েছিলো রিদের খবর জানতে। কিন্তু খান বাড়ির কেউ আরিফের সঙ্গে কথা বলার মতোন মনমানসিকতা দেখায় নি। আর না আরিফের কোনো কথায় কেউ উত্তর দেয়। বলতে গেলে আরিফ যাদের কাছে রিদের খবর জানতে গিয়েছিল তারা সবাই আরিফকে নীরবতা দেখিয়ে এরিয়ে গেছে। বারবার একই কাজ হওয়াতে আরিফ আর কারও কাছে না গিয়ে রিদের ছেলেপেলেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু নিরব চোখে দেখল রিদের মায়ের তোলপাড় করা কান্ড গুলো। তিনি মূহুর্তে মাঝে আসিফ, রাদিফ, আয়নকে দিয়ে রিদকে ঢাকা ট্রান্সফার করান ডাক্তারসহ। আরিফ অনেক চেয়েছিল আসিফ, আয়ন বা রাদিফের মধ্যে কারও সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু সেই সুযোগটায় সে পেলো না। সবাই কেমন তাড়াহুড়ো করে রিদকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরছিল। ব্যস্ত হওয়াটাও স্বাভাবিক। রিদ খানের জীবন মরণ নিয়ে কথা। ব্যস্ত তো হবেই। রিদকে নিয়ে ঢাকার যেতে যেতে নিহাল খান, আসিফ দুজন ক্যাশ টাকায় ইয়ার এম্বুলেন্স বোকিং করলো। আরিফ যতটুকু জেনেছে রিদের সঙ্গে নিহাল খান, সুফিয়া খান, আয়ন, রাদিফ আপাতত এই চারজনই গিয়েছে পরবর্তী হয়তো আরাফ খান সুস্থ হলে হেনা খান, আরাফ খানকে নিয়ে লন্ডনে যাবে। আসিফ দেশেই থাকবে রিদের ব্যবসা আর খান বাড়ির তদারকি করতে। আরিফের হসপিটালের যাওয়ার ঘন্টা খানিকের ভিতর রিদকে নিয়ে খান বাড়ির সকলেই ঢাকা চলে যাওয়াতে আরিফ হসপিটালের চত্বরের আরও ঘন্টা খানিক বসে ছিল দুশ্চিন্তায়। বাসায় ফিরে সে মায়াকে কি উত্তর দিবে? রিদ খান ভালো নেই সেটাতো আরিফ নিজের চোখেই দেখে এসেছে। রিদকে নিয়ে পরদেশে পাড়ি দেওয়ার বিষয়টাও সে দেখেছে। হয়তো এতক্ষণে ফ্লাইটে উঠে পরেছে সবাই। অথচ মায়ার খবর কেউ জানতে চাইলো না। আর না শেষবারের মতো মায়া নিজের স্বামীকে দেখতে পেল। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে মায়ার খোঁজ খবর নেওয়া তো দূর মায়াকে খান বাড়ির কেউ চিন্তে পারছে না এমনটা খান পরিবারের মনোভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু আরিফ এই মূহুর্তে নিজের বোনকে কি জবাব দিবে সেই চিন্তায় দরজায় কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা সময়। পকেটের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠতেই আরিফ ঐ অবস্থায় পকেটে থেকে ফোনটা বের করে কানে তুলতেই উদ্বিগ্নতায় গলা শুনা গেল রাকিবের। আরিফের সঙ্গে রাকিবও হসপিটালের ছিল। আরিফ বাসায় আসার সময় রাকিবকে বলে আসেনি সেজন্য হয়তো রাকিব কল দিচ্ছে আরিফের খোঁজ নিতে। আরিফ কল রিসিভ করতেই রাকিব উদ্বিগ্নতায় বলল….

‘ কই তুই?

দীর্ঘ শ্বাসে আরিফ মন্ত হয়ে ভাঙ্গা গলায় অল্প আওয়াজে বলল….

‘ বাসায় আয় তুই।

আরিফ সচারাচর নিজের বাসায় বন্ধুদের কাউকে আনে না কখনো। নিজের বাসায় দুবোন থাকাতে সে বন্ধুদের বাসার বাহিরের রাখে সবসময়। কিন্তু আজ এই পরিস্থিতিতে আরিফ নিজের মনোবল পাচ্ছে না সবকিছু সামলাতে সেজন্য রাকিবকে বলল নিজের বাসায় আসতে। রাকিব আরিফের কথায় পুনরায় নিশ্চিত হতে আবারও একই ভাবে জিজ্ঞেসা করলো…

‘ তোর বাসায় আসব?
‘ হুম।
‘ এখন?
‘ আয়।

কথাটা বলেই আরিফ কল কেটে দিল। কথা বলতে ভালো লাগছে না ওর। কেমন ক্লান্তি আর দূর্বল লাগছে। দরজা হতে সরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আরিফ কলিংবেল বাজাতে তৎক্ষনাৎ দরজা খোলে দিলো জুই। সে যেন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ অপেক্ষা করে। তাড়াহুড়ো করে জুই দরজা খোলে উদ্বিগ্নতায় পরপর প্রশ্ন করলো আরিফকে রিদের খবর জানতে..

‘ রিদ ভাইয়া কেমন আছে ভাই? উনি ঠিক আছেন? ডাক্তার কি বলেছে? বেশি ব্যথা পেয়েছে?

আরিফ দরজার বাহিরে জুতা রেখে বাসায় ঢুকলো। জুইকে এরিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে তাকালো মায়ার রুমের দরজার দিকে। ক্লান্তিতে মায়ার খবর জানতে চেয়ে বলল আরিফ…

‘ মায়ার হুশ ফিরেছে?

জুইয়ের কথার উত্তর না করে আরিফকে পাল্টা প্রশ্ন করতে দেখে অস্থির হলো জুই। নিজের কথার উত্তর না পেয়ে তারপরও আরিফের কথার উত্তর দিয়ে বলল জুই।
‘ না।
‘ ওহ

আরিফ উদাসীনতায় গিয়ে গা এলিয়ে বসল ড্রয়িংরুমের সোফায়। জুই দরজা লাগিয়ে আরিফের দিকে এগোতে চাইলে আরিফ সোফায় গা এলিয়ে কপালে হাত ঠেকাতে ঠেকাতে বলল…

‘ ভাইকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াতে পারবি জুই? খুব ক্লান্ত লাগছে।

‘ এক্ষুনি আনছি।

অস্থির উত্তেজিত জুই এই শীতের মাঝেও আরিফের জন্য ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি গ্লাসে করে নিয়ে আসল। আরিফ সেটা এক টানে খেয়ে জুইয়ের হাতে গ্লাসটা দিতে দিতে আবারও বলল…

‘ আরেকটা গ্লাস খাওয়াতে পারবি?

জুঁই চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে পুনরায় গ্লাস ভরতি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলো। আরিফও আগের নেয় ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানির গ্লাস খালি করলো এক চুমুকে। তীব্র পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল তার। ভিতরটা হাহাকার করছিলো তৃষ্ণায়। এতো পানি খেয়েও যেন তৃষ্ণা মেটেনি আরিফের। আরিফ পানির গ্লাসটা টি-টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল…

‘ তুই কিছু খাবি জুই? দুপুর থেকে না খাওয়া তুই। অর্ডার করবো?

আরিফের কথায় জুঁই খানিকটা অসন্তুষ্ট গলায় তৎক্ষনাৎ উত্তর করে বলল…

‘ আমি কিছু খাব না ভাই। এই পরিস্থিতিতে আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আগে বলো রিদ ভাইয়া কেমন আছে? ডাক্তার কি বলেছে।

জুঁইয়ের কথায় আরিফ রয়েসয়ে বলল…

‘ রিদ খানের অবস্থা ভালো নেই জুঁই। ডাক্তার বলেছে মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছে সে। বাংলাদেশের চিকিৎসা রিদ খানের জন্য যথেষ্ট হবে না। সেজন্য রিদ খানের পরিবার রিদ খানকে দেশের বাহিরের লন্ডন নিয়ে যাচ্ছে আজ রাতের ফ্লাইটে। খুব সম্ভবত এতক্ষণে ইয়ার এম্বুলেন্সের উঠে যাওয়ার কথা তাদের।

আরিফের কথায় জুই আতঙ্কিত ভঙ্গিতে বলল…

‘ আল্লাহ! কি বলো ভাই? রিদ ভাইয়াকে লন্ডন এ নিয়ে যাচ্ছে? আল্লাহ জানে কি হয়। আল্লাহ রিদ ভাইয়ার হেফাজত করুক। মায়ার কথা কেউ জানতে চাইনি? মায়াকে ছাড়া সবাই চলে গেলো?

জুঁইয়ের কথায় আরিফ আগের নেয় বলল…

‘ না

‘ কেন?

‘ আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না জুঁই। আমি অনেকবার চেয়েছিলাম খান পরিবারের সবার সাথে কথা বলতে কিন্তু কেউ আমার কথা উত্তর দেয়নি। অপরিচিতর মতোন চুপ থেকেছে সবাই। এখন আমি বুঝতে পারছি না তাঁরা কি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে ইগনোর করলো নাকি রিদ খানের এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে তাঁদের মন মানসিকতা ঠিক নেই বলে কথা বলতে পারেনি। আমি আপাতত কিছু জানি না জুঁই। তবে আজ কেউ মায়ার কথা জানতে চাইনি। তবে এতটুকু বলতে পারি রিদ খানের ঠিক হয়ে দেশে না ফিরা পর্যন্ত মায়ার খেয়াল আমাদের রাখতে হবে জুঁই।

আরিফের কথায় জুঁই চুপ করে যায়। এতো কিছুর মাঝে সবে খান পরিবারের সবাইকে মায়াদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছিল। এখনো মায়ার পরিবারের জানানো বাকি। দুই পরিবারের সম্মতি দেয়নি রিদ-মায়ার সম্পর্কে। এরমধ্যে রিদের এক্সিডেন্ট হওয়াতে এই পরিস্থিতিতে মায়া আবারও একা হয়ে গেলো। যেখানে মায়ার একমাত্র বিশ্বাস আর ভরসার জায়গায় ছিল রিদ খান। এখন মায়া একা এই পরিস্থিতির মোকাবেলা কিভাবে করবে আল্লাহ জানে। জুইকে চুপ থাকতে দেখে আরিফ পুনরায় বলল…

‘ মায়ার কাছে যাহ জুঁই। ওর সাথে থাক। যা হবার হবে সেটা দেখা যাবে। আল্লাহ ভরসা। আমি আছি মায়ার পাশে। বোনকে কখনো একা ছাড়বো না ইনশাআল্লাহ।

জুঁই কথা না বাড়িয়ে মায়ার কক্ষে গেল। নিস্তব্ধ ঘরে মায়াকে নিস্তেজ অবস্থায় খাটে শুয়ে থাকতে দেখে জুঁই গিয়ে মায়ার মাথার কাছে বসলো। সবে মাত্র দশ-টা পাঁচ। মায়াকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা যাবত ইনজেকশন দিয়ে ঘুমিয়ে রেখেছে। ঘুম থেকে জাগ্রত হলে কি হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সকলে।
~~
রাত তখন বারোটা ঊর্ধ্বে। মায়াকে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে হসপিটালের ছুটছে আরিফ। সঙ্গে জুঁই আর রাকিব। মায়ার অবস্থা খুবই সূচনীয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপে প্যানিক অ্যাটাক করেছে মায়া। হাত-পা সর্বাঙ্গ খিঁচে কাঁপুনি দিচ্ছে বারবার, ধরধর ঘাম সঙ্গে রেসিং হার্টবিটের ধড়ফড় ক্রমশয় বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট সঙ্গে বুকে ব্যথা বা অস্বস্তিবোধে বমি বমি ভাব। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অতিরিক্ত ভয়ে অস্থির উত্তেজনায় মায়া শ্বাস নিতে পারছে না বলে মা*রা যাচ্ছে এমনটা মনে হচ্ছে। সচরাচর প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণ এসবই হয়ে থাকে। মায়াকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দেখে প্রথমে জুই-ই পাগলের মতো চিল্লাতে লাগলো ভয়ে। আরিফ পাশেই ছিল। এই অসময়ে বন্ধুর মতোন রাকিবও ছিল আরিফের সঙ্গে। আরিফ মায়াকে পাঁজর কোলে তুলে এতো রাতে চারতলা হতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো দৌড়ে। জুঁই তাড়াহুড়ো বাসার তালা বন্ধ করে সেও দৌড়াল আরিফের পিছন পিছন চিল্লাতে চিল্লাতে। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের সকলেই ততক্ষণে ঘুম ছেড়ে বাসা হতে বেড়িয়ে আসল জুঁই এর চিল্লাচিল্লিতে। রাকিব সকলের আগে বাসা থেকে বেড়িয়ে এতো রাতে গাড়ির খোঁজ করলো। ততক্ষণে আশেপাশে সকল মানুষজন আরিফদের ঘিরে দাঁড়ালো মায়াকে দেখতে। আরিফের দু-চোখ ভিজে আছে বোনের দুর্দশা দেখে। মায়ার শ্বাস পরছে না। মুখ থেকে সাদা ফেনা ফেনা ঝাঁঝ বের হচ্ছে। জুঁইয়ের চিৎকারের আশেপাশে সকলেই এগিয়ে এসে ভিড় জমাচ্ছে মায়াকে দ্রুত হসপিটালের নিয়ে যেতে। মধ্যেরাতে সিএনজিতে করে মায়াকেও সেই একই চট্টগ্রাম মেডিকেল হসপিটালের নিয়ে যাওয়া হলো। ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসাও দেওয়া হলো। একদিকে রিদকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হলো তো অন্য দিকে রাতভর মায়া চিকিৎসা চলল হসপিটালের বেঁডে শুয়ে। দিন গেল রাত পোহাল। অতিরিক্ত মানসিক চাপে মায়াকে টানা তিনদিন হসপিটালের বেঁডে শুধু ইনজেকশন দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখল ওর বেইন শান্ত রাখার জন্য। কারণ এই তিনদিনে মায়া যতবার হুশে এসেছিল ঠিক ততবারই রিদের কথা জানতে চেয়ে পাগলামো করেছে বারবার। তৃতীয় দিনে মায়া অবস্থা ছিল সূচনীয়। হঠাৎ হঠাৎ করে মায়া আগের সবকিছু ভুলে যায়। এক মূহুর্তের জন্য নিজের নাম, এমন কি পরিচিত মানুষকে পর্যন্ত চিন্তে পারে না। আরিফকে? জুই কে? ওদের নাম কি? ওদের সাথে মায়ার কি সম্পর্ক সেই সবকিছু মায়া এক মূহুর্তের জন্য ভুলে যায়। সামান্য টাকা চিনার মতোন স্মৃতিশক্ত মায়ার মস্তিষ্ক ধারণ করে রাখতে পারে না। ডাক্তার দেখানো সামান্য টাকাকে মায়া পাতা বলে আখ্যায়িত করে। ডাক্তারের ভারসাম্য মতে মায়া অতিরিক্ত মানসিক চাপে কারণে মেন্টাল ট্রমায় আছে সেজন্য হঠাৎ হঠাৎ সবকিছু ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু মায়ার মস্তিষ্ক যখন শান্ত থাকে তখন আবারও সবকিছু মনে করে পাগলামো শুরু করে রিদের জন্য। এই তিনদিনে আরিফ খান বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারলেও আসিফের সঙ্গে ফোনের যোগাযোগ হয়েছিল একবার। সেখান থেকে জানা যায় আগামী সাপ্তাহর ভিতরের আরাফ খান আর হেনা খানকেও লন্ডনে পাঠানো হবে আয়নদের বাড়িতে। আপাতত খান পরিবারের সবাই সেখানেই আছে। তবে দুঃখজনক বিষয়ে হলো রিদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। অলরেডি রিদের মাথায় সার্জারী করা হয়েছে কিন্তু রিদের হুশ ফিরেনি এখনো। সহজে ফিরবে বলে মনেও হয়না। কোমায় চলে গেছে রিদ। রিদ হুশে কখন ফিরবে কেউ বলতে পারে না। দিনদিন অবস্থা নাকি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে রিদের। আসিফের কাছ থেকে রিদের এসব খবরের কথা জেনে আরিফের মনে হয়নি আগ বাড়িয়ে মায়ার কথাটা আসিফকে জানানো উচিত। আর না আসিফ মায়ার কথা জানতে চেয়েছে আরিফের কাছে। তাছাড়া আসিফ মায়ার কথা জানলেও বা কি করতে পারবে? এখানে কারও কিছু করার নেই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। তিনি ভালো জানেন আগামীতে কি হবেন। পাঁচদিনের মধ্যে মায়াকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসল আরিফ। বাসায় আনতে চাইনি সে। কারণ মায়ার অবস্থার তখনো ভালো ছিল না। আরও কয়েক দিন হসপিটালের রাখতে চেয়েছিল আরিফ কিন্তু হুট করে চট্টগ্রামে আরিফের বাবা আর চাচার উপস্থিতি দেখতে পেয়ে বাধ্য হয়ে মায়াকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হয় আরিফকে। হঠাৎ করে আরিফের বাপ-চাচার চট্টগ্রামের উপস্থিত হওয়ার কারণটা ভালো করেই জানা ওর। না জানার কিছু নেই। মায়া রিদ খানের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে এমনটা আরও দুইদিন আগেই পরিবারের জানিয়েছিল মুক্তা। কিন্তু রিদের এক্সিডেন্টের পর মায়ার অবস্থা কি হয়েছে সেটা পরিবারের কারও জানা ছিল না। মূলত আরিফই কাউকে জানাই নি। তবে মায়ার প্রেমের সম্পর্কের কথাটা শুনে রেগেমেগে আগুন হয়ে আরিফকে ফোন দিয়েছিল বাপ-চাচা দুজনই। মায়াকে নিয়ে দ্রুত আশুগঞ্জ ফিরতে আদেশও করেছিল তারা। কিন্তু আরিফ কারও কথা কানে তুলে নি। আর না মায়ার অবস্থার কথা জানিয়েছে পরিবারের। মূলত আরিফকে আশুগঞ্জ ফিরতে না দেখে উনারা দুজন রেগেমেগে চট্টগ্রামে উপস্থিত হয় মায়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু এখানে এসে মায়ার সূচনীয় অবস্থা দেখে তারা দুজন থমকে যায়। উনাদের মেয়ের এতো অসুস্থতার কথাটা পরিবারের জানাই নি কেন? সেটা নিয়ে আগুন হয়ে যায় দু’ভাই। বিশেষ করে মায়া কথা বলার মতোন পরিস্থিতিতে নেই এই বিষয়টা তাদের মনে আঘাত করে বেশি। সেজন্য মায়ার উপর থাকা সকল রাগ গিয়ে পরলো আরিফের উপর শফিকুল ইসলামের। জুইয়ের বাবাও কম নই। এতোসব কিছু ঘটে যাচ্ছে আর সেইসব তাদের অবগত করেনি বলে তিনি প্রথমবারের মতোন জুইয়ের গায়ে হাত তুলেন। রাগের তোপে জুইয়ের গাল বেড়িয়ে থাপ্পড় মারলো জড়সড়ে। পারছে না সেই রাগটা আরিফের উপর দিয়ে তুলছে জুইয়ের বাবা। সেই রাতের মধ্যে প্রাইভেট কারে করে শফিকুল ইসলাম সপরিবারে আশুগঞ্জ ফিরেন সঙ্গে আরিফকেও নিয়ে। বাসায় ফিরে যেন মায়ার জন্য মানসিক চাপ আরও বাড়লো। হাহাকার বয়ে গেল পরিবার জুড়ে। মায়ার বাপ-চাচা মায়ার অবস্থা দেখে চুপ করে গেলেন ভয়ে। উনারা আপাতত মায়ার সুস্থতা চাচ্ছেন। অথচ আত্মীয়দের মাঝে বদনাম রটে গেল মায়া বড়লোক ছেলের পিছনে ঘুরে প্রেমে পাগল হয়ে গেছে।

#চলিত….