#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৫৭
রাতের শেষ প্রহর কাটিয়ে ধরনীতে ভোরের আভাস। চারপাশের অন্ধকার আবছায়া তখনো কাটেনি পুরোপুরি। সকাল চারটে ছাপ্পান্ন কি সাতান্নর ঘরে। রিদের রেগুলার চেক-আপের ডাক্তারা উপস্থিত। সঙ্গে খান পরিবারের সকলেই কেবিনে জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে। রিদের এক্সিডেন্টের বিগত পয়তাল্লিশ দিনের পর আজ রিদের হুঁশ ফিরেছে। যদিও এখনো চোখ মেলে তাকাইনি তবে ডাক্তারদের খবর পেয়ে এই শেষ রাতের মধ্যেই খান পরিবারের সকলে হসপিটালে ভিড় জমিয়েছে খুশিতে। রিদ চোখ মেলে যেন আপনজন সকলকে পাশে পায় সেই আশ্বস্তে। যদিও রিদের শরীর বিগত এক সাপ্তাহ ধরেই রেসপন্স করেছিল তবে আজ সজ্ঞানে ফিরবে বলে এমনটা জানায় ডক্টরা। হলোও তাই। সকাল পাঁচটা সাত মিনিটে রিদের হুশ ফিরলো। নাকে অক্সিজেন নলটা বাঁধা। অল্প মাথা দুলিয়ে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে হুঁশে ফিরলো রিদ। বন্ধ চোখের পাতা টেনে খুলতে গিয়ে আবারও ঝাপটিয়ে বন্ধ করে নিলো সে। অনেক দিন পর হঠাৎ আলোর তেজ রশ্মিটা যেন হুট করেই রিদের চোখে সইলো না। তাই ডক্টর নার্সকে বলে রুমে আলো কমিয়ে দিতেই রিদ ঝাপ্সা চোখে পুনরায় একই ভাবে চোখ খোলার চেষ্টা করতে অল্প আলোয় দেখলো বেশ অনেক গুলো পরিচিত মুখকে। মাথার অসহ্য ব্যথা অনুভব হতে রিদ বিরক্তিতে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিজের বাম হাত মাথায় রাখতে চাইলে সেই হাতটা কেঁপে উঠলো দূর্বলতায়। পাশে দাঁড়ানো ডক্টর তৎক্ষনাৎ রিদের হাত ধরে সাহায্য করলো ভারসাম্য রাখতে। রিদ কোথায় আছে? তার সাথে কি হয়েছে? সে-সব হুট করেই কোনো কিছু মনে করতে পারলো না। আর না আশেপাশের উৎসুক মানুষগুলো কারা সেটাও ঠাহর করতে পারলো। শুধু বিরক্তিতে কেমন কপাল কুঁচকে রাখছে বারবার। ঝটকায় ডক্টরের হাতটাও ছাড়িয়ে নিলো নিজের থেকে। অল্প আওয়াজে কিছু বলতে চেয়ে ঠোঁট নাড়াল। স্পষ্ট ভাষায় কিছু বলতে না পেরে পুনরায় চোখ মেলে তাকালো সামনে। এবার বেশ কিছু মুখ রিদের চোখে স্পষ্ট হলো। সেই সাথে পরিচিতও লাগল সবাইকে। এক পাশে সুফিয়া খান, রাদিফ দাড়িয়ে, অন্য পাশে নিহাল খান, আয়ন আর ডাক্তারসহ দুজন নার্স। পায়ের কাছে আরাফ খান, হেনা খান সঙ্গে আয়নের পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে। সকলের মাঝে খুশির অশ্রু। রিদ তাদের হাসি কান্নার ব্যাপারটা তখনো বুঝলো না। আর না ধরতে পারলো এই অসময়ে সকলে কেন রিদের রুমে ভিড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে। তার অসহ্য মাথা ব্যথাটাও কমছে না। বিরক্তিতে রিদ হুট করে উঠে বসতে চাইলে হাতের ক্যানুলা আর নাকের অক্সিজেন নলে টান খেলে রিদ বিরক্তিতে উঠে বসতে বসতে দু’হাতে টেনে নাকে নল আর বামহাতের ক্যানুলা খোলে ফেলতে ফেলতে বলল…
‘ বাল! এই বাল-ছাল কে লাগাইছে আমার হাতে? ফালা এই গুলা। অসহ্য!
রিদ চট করে মনে করতে পারলো না নিজের এক্সিডেন্টের বিষয়টা। আর না বুঝতে পারলো তার মাথা ব্যথার কারণটা। তার মনে হলো সে ঘুম থেকে সবে উঠে বসেছে মাত্র। কোথায় আছে? কেন আছে? এই বিষয় গুলো এখনো রিদের বোধগম্যে নেই। রিদকে দু’হাতে টেনে-টুনে সবকিছু খোলে ফেলতে দেখে উপস্থিত সকলেই আঁতকে উঠল। আয়ন অস্থির ভঙ্গিতে রিদকে থামাতে চেয়ে চিৎকার করে বলল…
‘ এসব কি করছিস রিদ? থাম প্লিজ! তুই অসুস্থ!
আয়নের কথায় অধৈর্য্যে রিদ বিরক্তিতে বলল…
‘ বা’লের অসুস্থ আমি! সর সামনে থেকে। আমার রুমে কি তোদের? বের হ! যাহ!
কথা গুলো বলতে বলতে রিদ পেট গলিয়ে র*ক্ত বমি করতে ছেলেকে তৎক্ষনাৎ দু’হাতে ঝাপটে ধরলো সুফিয়া খান। রিদের খালি পেটে তেমন কিছু না থাকায় গলার আটকে থাকা মরা র’ক্তটুকু বের হতে রিদ আবারও নিস্তেজ হয়ে পরলো। উপস্থিত ডক্টরা রিদের চেক-আপ করতে চেয়ে আদেশ করলো পরিবারের সকলকে বাহিরের যেতে পেশেন্টের কাছে ভিড় না জমিয়ে। উপস্থিত সকলেই দ্বি মনা করলো বের হতে। সবাই রিদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। অথচ রিদ অকারণে অধৈর্য হয়ে রেগে যাচ্ছে বারবার। গায়ের উপর ডক্টরের হাতটাও বিরক্তিতে ঝটকা মেরে ফেলে দিতে দিতে রিদ বলল….
‘ বা’ল! মেয়ে মানুষের মতোন হাতাহাতি করছেন কেন? সরেন!
রিদের তপ্ত মেজাজে বাংলা ভাষায় বলা কথা গুলো ইউরোপীয়ান ডক্টরের বোধগম্য না হলেও উপস্থিত সকল বেশ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। হুশে ফিরার পর থেকে রিদ অকারণে বিরক্ত আর রেগে যাওয়ার কারণটা সকলে বুঝতে না পারলেও ডক্টর রিদের মেজাজ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বরং খুবই স্বাভাবিক নেয় হাসোজ্জল মুখে নিজ ভাষায় রিদের উদ্দেশ্যে বলল…
‘ নাউ ইউ আর পারফেক্টলি হেলদি ইয়ং ম্যান।
রিদ কিছু বলবে তার আগেই একজন নার্স কাপে করে অল্প গরম পানি নিয়ে আসলো রিদের গলায় আটকে থাকা র’ক্তটুকু পরিষ্কার করতে। রিদ সুন্দরী নার্সটিকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে ফেলতেই সুফিয়া খান আগ বাড়িয়ে নিজের হাতে নিলো সেই কাপটি। রিদের হুশ ফেরার পর থেকেই তিনি নিরব দর্শক ছিল। ছেলের মতিগতি লক্ষ করছিল। এক্সিডেন্ট কারণে রিদের মুডে পরিবর্তন এসেছে। এবার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেটা এখনো বুঝা দায়। তিনি রিদের কপালে হাত রাখতেই রিদ ঘাড় বেঁকে তাকাল মায়ের দিকে। চোখে সামনে মাকে দেখে একই মেজাজে বলল…
‘ এতো রাতে আমার রুমে কি তোমাদের? বিরক্ত লাগছে। যাও সবাই।
সুফিয়া খান বেশ শান্ত ভাবে রিদের পিঠে হাত বুলিয়ে কাপে গরম পানি টুকু ছেলের মুখে দিতে দিতে বলল…
‘ ঠিক আছে সবাই চলে যাবে। আগে তুমি গরম পানিটুকু দিয়ে গলা পরিষ্কার করো তারপর।
রিদ মুখে পানিটুকু নিলো না। বরং দু’হাতে মাথা চেপে ধরে শুধালো…
‘ আমার মাথা ব্যথা করছেন কেন? আসিফ কই? আসিফ ডাক দাও।
হাতের কাপটা চেপেই সুফিয়া খান শান্ত গলায় উত্তর করে বলল…
‘ আসিফ নেই।
আসিফ নেই কথাটা শুনে আবারও চট করে মেজাজ খারাপ হলো রিদের। বিরক্তিতে বলল..
‘ আসিফ নেই মানে? মারা গেছে ওহ?
সুফিয়া খানের একই শান্ত উত্তর আসলো তক্ষুনি…
‘ নাহ মরে নাই। আছে।
‘ তাহলে ডাক দাও।
সুফিয়া খানকে বলতে না দিয়ে কথা মাঝে রাদিফ উত্তর করে বলল….
‘ ভাই তুমি আগে একটু রেস্ট করো। আসিফের ভাইয়ের সঙ্গে না-হয় পরে কথা বলো।
‘ তোরে বলছি জ্ঞান দিতে? তোরে বলছি ডাক দিতে।
রিদ অকারণে সবার উপর রেগে যাচ্ছে দেখে সুফিয়া খান রাদিফকে থামিয়ে রিদকে শুধিয়ে বলল…
‘ তুমি অসুস্থ বলে আসিফ এখানে নেই। তুমি হসপিটালের আছো রিদ। তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল মনে নেই?
সুফিয়া কথায় রিদের কপালে ভাজ তীক্ষ্ণ হয়। এক মিনিট চুপ করে যেতেই সম্পূর্ণ ঘটনা মাথায় আসলো। সে-তো বিকালে দিকে এক্সিডেন্ট করেছিল। আচানক একটা ট্রাক তাকে চাপা দেয়। তারপর সে রাস্তায় লুটিয়ে পরে। জ্ঞান হারানো আগে সে দেখেছিল বউকে চিৎকার করে কাঁদতে। তার বউ তার পাশেই ছিল। বউয়ের কথা মাথায় আসতেই রিদ চট করে আশেপাশে তাকিয়ে মায়ার খোঁজ করলো। আশেপাশে উপস্থিত সবাইকে খোজে পেল শুধু তার বউ আর আসিফকে ছাড়া। বেয়াদব বউটা তার এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে হসপিটালের আসলো না দেখা করতে? নাকি এসেছে? যদি এসে থাকে তাহলে রিদের যে হুশ ফিরেছে সেই খবর পাইনি এখনো? নাকি হসপিটালের মধ্যেও পরে পরে ঘুমাচ্ছে স্বামীর খবর না নিয়ে। শান্ত হয়ে যাওয়া মেজাজ আবারও খিঁচে গেল মায়ার উপর। তার হুশ ফিরার পর কেন বেয়াদব বউটা দেখতে পেল না সেই কারণে। রিদ খিঁচে যাওয়া মেজাজে কিছু বলবে তার আগে আবারও মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো রিদের। শরীর দূর্বল থাকায় ঝুলে পরে যেতে দেখে ডাক্তারসহ প্রায় সকলে রিদেকে ধরলো। রিদ শরীর ছেড়ে বেঁটে শুয়ে পরতে পরতে ডক্টর মূহুর্তে রিদের নাকে অক্সিজেন নল লাগাতে চাইল। রিদ তাতে বাঁধা দিয়ে সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে ছোট গলায় বলল…
‘ আমার বউ কই আম্মু?
রিদের ছোট কথায় সুফিয়া খানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পরলো। ছেলে যে বিয়ে করেছে, তার বউ আছে সেটা এতোদিন উনার মাথায় ছিল না। ছেলের টেনশনে টেনশনে বাকি সবকিছু ভুলে বসেছিল তিনি কিন্তু ছেলে সজ্ঞানে ফিরে সে তার বউ খোঁজ করছে দেখে তিনিও তৎক্ষনাৎ উত্তর করতে পারলো না। কেমন নিশ্চুপ আর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মূলত উনি নিজেও জানে না উনার ছেলের বউ কোথায় আছে। কেমন আছে? স্বামীর অসুস্থতায় বউকে পাশে রাখতে হবে সেটাও এতোদিন উনার ধারণাতে ছিল না। সুফিয়া খানকে উত্তর করতে না দেখে রিদ পুনরায় একই প্রশ্নটা করলো।
‘ আমার বউ কই?
সুফিয়া খানের মেরুদণ্ড সোজা হলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল। রাদিফ, আয়ন, হেনা খান আরাফ খান, নিহাল খান এমন কি আয়নের মা-বাবাও সুফিয়া খানের মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর দৃষ্টিতে। সকলেই জানে রিদ বিবাহিত অথচ কারও কাছে রিদের বউয়ের কোনো খবর নেই। সুফিয়া খান দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবারও তাকাল বেহুশরত রিদের দিকে। ডক্টর রিদকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করছে। তিনি সেদিকে তাকিয়ে থেকে আয়নের উদ্দেশ্য বলল…
‘ আসিফকে ফোন দাও আয়ন। বলো মায়াকে ভিডিও কলে আসতে।
‘ জ্বি মামি।
~~
দুপুর বারোটার ঘরে। তীব্র ঠান্ডায় তুষার পাতে তলিয়ে লন্ডন শহর। সকাল থেকে মায়ার খোঁজে খান পরিবারের সকলে অথচ সকাল থেকে দুপুর গড়াল দুপুর থেকে বিকাল, লাপাত্তা মায়ার খোঁজ
খান পরিবারের কেউ করতে পারলো না। প্রথমে বিষয়টি এতো জটিল না লাগলেও এখন বেশ টেনশনে কপাল কুঁচকে যাচ্ছে সুফিয়া খানের। নিহাল খান বাংলাদেশে আরিফের কাছে কল করে যাচ্ছে মায়ার সন্ধ্যানে। ফাহাদকেও করেছেন। অথচ আরিফের নাম্বারটাও অফ যাচ্ছে বরাবরের মতোই। ফাহাদ নিজেও তার শশুর বাড়ির কারও খবর দিতে ব্যর্থ। মুক্তা ফোনও অফ! নিজের বউ কোথায় আছে সেই খবর বিগত দুইদিন ধরে ফাহাদের কাছে নেই। এইতো দুইদিন আগে অকারণে ফাহাদের সঙ্গে ঝগড়া করে ফোন বন্ধ করেছিল মুক্তা তারপর থেকে ঐ বাড়ির কারও খবর নেই। শশুর শাশুড়ী নাম্বারও অফ যাচ্ছে। হুট করে ঐ বাড়ির সকলের নাম্বার অফ হয়ে যাওয়াতে টেনশনে পরে গেল সুফিয়া খান। আসিফকে দিয়ে তৎক্ষনাৎ লোক পাঠালো আশুগঞ্জ। দুপুর থেকে বিকাল হতে হতে খবর আসলো মায়াদের বাড়িতে মস্ত বড়ো তালা ঝুলছে গেইটের দরজায়। সেখানে মায়াদের পরিবারের কেউ উপস্থিত নেই। মায়া বা তার পরিবারের লোক কোথায় আছে কারও জানা নেই। টেনশনে টেনশনে কেমন অপরাধ বোধে ভুগলো রিদের মা-বাবা দুজনই। আয়ন অস্থির উত্তেজনায় মানুষ লাগিয়ে খোঁজ করলো জুইয়ের। কিন্তু সকলেই খবর দিতে ব্যর্থ। আয়নের মনে হলো এতোদিন জুইদের খবর না নিয়ে সে এক প্রকার পাপ করেছে। সেদিন ফাহাদের উড়ন্ত কথায় বিশ্বাস করাটাও তার ঠিক হয়নি। অন্তত একবারে মতোন আয়ন আশুগঞ্জ লোক পাঠিয়ে সবার খোঁজ করার দরকার ছিল তাহলে হয়তো আজ এইভাবে হারিয়ে যেতে পারতো না। টেনশনে টেনশনে আয়নের কেমন বুক ব্যথা অনুভব করলো। রিদকে কি উত্তর দিবে সেই চিন্তায় অস্থির হলো। রিদের হুশ আবারও যখন সন্ধ্যার দিকে হুশ ফিরলো তখন সেই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো সুফিয়া খানকে।
‘ মায়া কই আম্মু?
রিদের প্রশ্নে নিশ্চুপে দাঁড়ালো সুফিয়া খান। আয়ন, নিহাল খান, রাদিফ সকলেই থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। শুয়ে থাকা রিদ উঠে বসতে চাইলে রাদিফ, নিহাল খান ধরে বসাল। রিদ শারীরিক ভাবে সুস্থ। শরীরে কোথাও কোনো ব্যথা পাইনি সে। মাথার আঘাতটা দেড়মাসে শুকিয়ে গেছে প্রায়। মাথায় সার্জারী হয়েছে মোট দুটো। মাথায় অস্ত্রপাচার করায় মাথা ব্যথা করছে তার। হাই পাওয়ার মেডিসিনের কারণে শারীরিক ভাবেও বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। শরীর ফুলে চটচটে মেজাজের হয়ে গেছে। রিদকে রেগে যেতে দেখে সুফিয়া খানের হয়ে রাদিফ কিছু বলতে চাইলে হাত উঠিয়ে থামায় সুফিয়া খান। তিনি শান্ত স্বরে বলল…
‘ এখানে নেই।
সুফিয়া খানের কথা শেষ হতে হতে রিদ অধৈর্য্যে গলায় শুধালো…
‘ এখানে না থাকলে কই আছে? ওকে আসতে বলো।
সুফিয়া খান ঘুরাতে চেয়ে বলল…
‘ মায়া পরে আসবে। তুমি আগে রেস্ট করো।
নিজের মাকে কথা ঘুরাতে দেখে রিদের কপাল কুঁচকে আসলো। সন্দিহান দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ আমার সাথে মায়াও ব্যথা পেয়েছিল কাল?
রিদের ধারণা সে কাল এক্সিডেন্ট করেছিল আর আজ সে হুশ জ্ঞানে ফিরেছে। রিদ নিজের অসুস্থতা নিয়ে সে এখনো অবগত নয়। সুফিয়া খান ছোট করে উত্তর দিয়ে বলল…
‘ নাহ!
‘ তাহলে এতো কাহিনি করছো কেন? ডাকো ওকে।
আই ওয়েন্ট টু সি হার।
সুফিয়া খান কিছু বলবে তার আগেই রাদিফ উত্তর দিয়ে বলল…
‘ভাবিতো এখানে নেই ভাই। বাংলাদেশে আছে।
খানিকটা অসন্তুষ্ট গলায় জানতে চাইলো রিদ…..
‘ তাহলে আমরা কই?
‘ লন্ডনে!
‘ লন্ডনে?
রাদিফ রিদকে সবটা জানিয়ে বলল…
‘ হ্যাঁ ভাই! আমরা তোমাকে নিয়ে লন্ডনে আছি দেড়মাস যাবত। আজ দেড়মাস পর তোমার জ্ঞান ফিরেছে সকালে। সেজন্য ভাবি এখানে নেই।
রাদিফের কথাটা যেন রিদের মস্তিষ্কে টনক নড়ে উঠল। সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বলল…
‘ আমি লন্ডনে হলে আমার বউ বাংলাদেশে কেন আম্মু?
সুফিয়া খান থমথমে মুখে উত্তর দিয়ে বলল…
‘ তোমার টেনশনে বাকি কিছু মনে ছিল না আমার। মায়ার ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে ছুটে গিয়েছিল।
মা-য়ের কথায় শরীরের রক্ত টক-বগিয়ে উঠলো রিদের। সে অসুস্থ বলে তার বউয়ের খোঁজ করবে না তার পরিবার? অবহেলা করবে? আজ যদি রিদ জীবিত না থাকতো তাহলে তার বউয়ের খেয়াল করতো না তাঁরা? রিদ তিরতির মেজাজে বলল….
‘ তোমার কি মনে ছিল না আম্মু? ছেলের টেনশনে ছেলের বউয়ের খোঁজ করতে মনে ছিল না?
সুফিয়া খানকে চুপ থাকতে দেখে রিদ মেজাজ বিগড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে আয়নের উদ্দেশ্য বলল…
‘ আরিফকে কল দে আয়ন। বল মায়াকে দিতে। কথা বলবো আমি।
আয়ন কেমন অনিশ্চয়তা বলল….
‘ আরিফের ফোন অফ। সে ইন্ডিয়াতে আছে।
‘ তাহলে ঐ বাড়ির অন্য কাউকে কল দে।
আয়ন রিদকে সত্যিটা জানিয়ে বলল…
‘ সকাল থেকে খোঁজ করছি। ঐ বাড়ির কারও কোনো খবর পাচ্ছি না। সবার ফোন অফ। লোক পাঠিয়েছিলাম আশুগঞ্জে তারা জানিয়েছে মায়াদের বাড়ির নাকি তালা। আশেপাশে খোঁজ করেছিল আমাদের লোক কেউ মায়ার পরিবার খবর দিতে পারেনি। বলতে গেলে এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি মায়াদের।
আয়নের কথা শেষ হতে হতে রিদ হাতে ক্যানুলা টেনে খোলে ছিটকে ফেললো ফ্লোরে। তার যা বুঝার তা বুঝা হয়ে গেছে। তার অনুপস্থিতিতে কেউ তার বউয়ের খোঁজ করেনি। তার বউ ভালো নেই। ভালো থাকার কথাও না। ওদের বিয়েটা এখনো দুই পরিবারের সম্মতি পাইনি। এর মাঝে রিদের এক্সিডেন্ট হওয়াতে তার বউ একা হয়ে যাবে সেটা স্বাভাবিক। রিদের অনুপস্থিতিতে তার পরিবার অন্তত তার বউয়ের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন ছিল। অপ্রয়োজনীয়, অবহেলায় না জানি কতোটা দেরি হয়েছে রিদের হুশে ফিরতে। অজানা ভয়ে হুট করেই রিদের বুক কাঁপলো। বাংলাদেশে ফিরতে খুব বেশি দেরি যাতে না হয় সেই দোয়াও করলো। বাকি সবাই বাদ, রিদের অন্তত নিজের মা-বাবার উপর বিশ্বাস ছিল তাঁরা রিদের অনুপস্থিতিতে তার আমানতের খেয়াল রাখবে। অন্তত অযত্নে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রাখবে না। কিন্তু তার কিছুই হলো না। রিদের বাবা-মা দুজনই ওর বিশ্বাস ভাঙ্গল। সেজন্য আপাতত রিদ নিজের বাবা-মাকে এরিয়ে যেতে চাইলো। নয়তো দেখা যাবে রাগের বশে বাবা-মার সঙ্গে সে বেয়াদবি করে ফেলবে।
অতিরিক্ত রাগে রিদের শরীরের শিরা দপদপ করে উঠলো। ইংল্যান্ডের বাতাসও হুট করেই কেমন বিষাক্ত লাগলো। তার এই মূহুর্তে বাংলাদেশে ফিরা জরুরি। তাই বেট থেকে নামতে নামতে নাকের অক্সিজেন নলটা টেনে খোলে ফেলতে ফেলতে রাদিফকে বলল…
‘ আসিফকে কল দে রাদিফ। আমি বাংলাদেশে ফিরব।
রিদের কথায় আঁতকে উঠল সকলে। রিদের চিকিৎসা এখনো শেষ হয়নি। লন্ডনে থাকা রিদের জন্য জরুরি। রাদিফ আঁতকে উঠার মতো করে বলল…
‘ ভাই তুমি অসুস্থ। তোমার চিকিৎসা প্রয়োজন।
রাদিফকে বলতে না দিয়ে রিদ বলল…
‘ চিকিৎসা শেষ। শার্ট দে।
বলতে বলতে রিদ গায়ের হসপিটালের ইউনিফর্মটা টেনে খোলতে লাগল। রিদের জন্য আনা রাদিফের শার্ট গুলোর থেকে একটা শার্ট গায়ে জড়াল। পরপর সবগুলো শার্ট একের পর এক গায়ে জড়িয়ে টেনে খোলতে লাগল রাগে। রাদিফের আনা একটা শার্টও তার গায়ে ফিট আসলো না। রিদের বিগড়ানো মেজাজটা আবারও খিঁচে গেল রাদিফের উপর। চোয়াল শক্ত করে বলল…
‘ বা’লে শার্ট এনেছিস তুই আমার। একটাও গায়ে লাগে না। আমার সাইজ জানিস না তুই?
‘ জানি ভাই।
‘ তাহলে এসব ব্রাউজের মতো শার্ট কেন এনেছিস? একটাও গায়ে আসে না।
রাদিফ চোখ আওড়িয়ে রিদের মাথা থেকে বডি পযন্ত চোখ ঘুরাল। রিদকে দেখতে কেমন গাজনী টাইপ আমির খানের মতো লাগছে। সার্জারী করার কারণে নেড়া মাথা করতে হয়েছিল রিদকে। যদিও এখনো নেড়া মাথায় আছে তবে দেড়মাসে রিদের চুলগুলো হাফ ইঞ্চির চেয়ে কম আছে মাথায়। মাথার বামপাশের আঘাতের জায়গাটা সেলায় করা। সেলায় দাগটাও স্পষ্ট A বর্ণের মতো করে ফুটে উঠেছে। রাদিফ চোখ ঘুরিয়ে রিদকে দেখে বলল…
‘ শার্ট তো তোমার সাইজেই এনেছিলাম ভাই। তুমি মোটা হয়ে গেছো।
রাদিফের কথায় রিদ কিছু বলবে তার আগেই আয়ন রিদকে বলল…
‘ আমি তোর কাপড়ের ব্যবস্থা করছি রিদ। তুই প্লিজ শান্ত হ। হুটহাট কিছু করতে যাস না প্লিজ, তুই এখনো অসুস্থ। তোর হসপিটালের থাকাটা জরুরি।
আয়নের কথাটা না শুনার মতো করে বলল…
‘ তোকে জ্ঞান দিতে বলি না। আমার প্রয়োজন আমি বুঝি। সর সামনে থেকে।
আয়ন রিদকে বাধা দিতে দেখে রাদিফও এগিয়ে আয়নের সঙ্গ ধরে রিদের পথ আটকে দাঁড়ালো। রিদ মেজাজ হারিয়ে কক্ষে থাকা সেল্ফ ধরে টেনে উল্টে ফেলে চেতে উঠলো সুফিয়া খানের উপর। কন্ট্রোল করা রাগটা ধরে রাখতে না পেরে গর্জে উঠে বলল…
‘ আমি তোমার উপর ভরসা করেছিলাম আম্মু। ভেবেছিলাম আমার অনুপস্থিতিতে আমার বউয়ের খেয়াল তুমি রাখবে। অথচ তুমি রাখনি। আমি জীবিত কিন্তু আমার বউ নিখোঁজ। সুস্থতার চেয়ে বউকে হারানোর পেইন বেশি হচ্ছে আমার। তুমি বুঝবে আমার কষ্ট?
রিদকে উত্তর দেওয়ার মতোন কোনো ভাষায় এই মূহুর্তে সুফিয়া খানের নেই। তিনি কেমন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। ছেলেকে সুস্থ করতে গিয়ে যে ছেলের আমানতের খেয়াল করতে পারেনি তার আফসোস উনার হচ্ছে। মূলত উনার একটা বারের জন্য মনে হয়নি ছেলের বিবাহিত। হবার কথাও না। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে হয়নি দুজনের। মায়া রিদের সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাসও করতো না সেজন্য অভ্যাসে ছিল ছেলের বউয়ের খোঁজ রাখা। কিন্তু এখন যখন ছেলের বউয়ের খোঁজ করতে গেল তখন ছেলের বউকে খোঁজে পাওয়ার মতো কোনো পথই তিনি এই লন্ডন শহরে বসে পাচ্ছেন না। সেজন্য তিনিও ঠিক করেছিল দুই একদিনের মধ্যে বাংলাদেশ ফিরবেন মায়ার খোঁজে। অথচ তার আগেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো ছেলের কাছে। রিদ পুনরায় একই ভাবে গর্জে উঠে বলল…
‘ যে ছেলেকে সুস্থ করতে তোমাদের দিন-রাত এক করতে হয়েছে সেই ছেলের সাথে আজ শেষ দেখা তোমাদের, যদি না আমি আমার বউকে গিয়ে হেফাজতে পাই। জীবনে দ্বিতীয়বারের মতোন ছেলের মুখ দেখার সুযোগ তোমরা পাবে না আর।
রিদের কথায় দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙ্গে কথা বলল নিহাল খান। তিনি নিজেও ছেলের অপরাধী বলে এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। কিন্তু এখন যখন ছেলেকে হারানো ভয় হলো তখন তিনিও রিদকে বুঝাতে চেয়ে বলল…
‘ এক্সিডেন্টের পর তোমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল রিদ। ঐ অবস্থায় আমরা শুধু তোমার কথা ভেবে লন্ডনে চলে এসেছিলাম। তাছাড়া মায়ার পাসপোর্ট আমাদের হাতে ছিল না। আর না লন্ডনে আসার ভিসা….
নিহাল খান বলতে না দিয়ে রিদ বলল…
‘ তোমরা চাইলে এই দেড়মাসে মধ্যে যেকোনো সময় আমার বউকে এখানে নিয়ে আসতে পারতে আব্বু। মায়ার পাসপোর্ট আসিফের কাছে ছিল। তুমি জানতে আব্বু হাউ মাচ আই লাভ হার? তারপরও আমার বউকে কিভাবে একা ছেড়ে দিলে তোমরা?সে আমার আমানত ছিল তোমাদের কাছে। তাহলে অবহেলা করলে কিভাবে?
রিদের কথায় নিহাল খানের মুখটা বন্ধ হয়ে যায় তক্ষুনি। রিদ হসপিটালের ইউনিফর্মের বেড়িয়ে যেতে রিদের পিছন পিছন রাদিফও দৌড়াল ভয়ে। রিদকে একা ছেড়ে দিলে যদি কোথাও কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে সেই ভয়ে। সুফিয়া খান ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তখনো গম্ভীর মুখে তাকিয়ে। এই মূহুর্তে উনার মাথায় কি চলছে সেটা মুখ দেখে বুঝা দায়।
~~
তিন কবুলে মায়ার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে যেতেই শফিকুল ইসলাম নাদিমের হাতে মায়া কম্পিত ঠান্ডা হাতটা শপে দিলো। দুই পরিবারের উপস্থিততে ঘরোয়া বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে মায়া আর নাদিমের। বিয়েটা মায়ার ছোট ফুপির গ্রামের বাড়ি থেকেই হলো। চেয়ারম্যান পরিবারের সদস্যরা বরযাত্রী সমেত মাত্র দুই গাড়িতে করে পনেরো জন সদস্য উপস্থিত হয়েছিল বিয়েতে। মায়ার গায়ে লাল টুকটুকে বেনারসি। দু’হাতে ভরতি লেপ্টানো মেহেদী। গায়ের তীব্র জ্বরে রাফাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। অন্য হাতটা নাদিমের হাতের উপর। উপস্থিত সকলে মায়াকে নাদিমের হাতে শপে দিয়ে বউ বিদায় করার তাড়া দিলো। মায়া হু হা কিছুই বললো না। কেমন পাথর মূর্তি নেয় সকলে সঙ্গে হাটলো গাড়ি অবধি। মায়া বা রাফা তখনো দুজন দুজন চেপে দাঁড়িয়ে। কেউ কাউকে ছাড়তে নারাজ। বিদায় বেলাও মায়া নিজের পরিবার কারও সঙ্গে কথা বললো না আর না চোখ আওড়িয়ে কাউকে দেখার চেষ্টা করলো। সকলের চোখেই পানি বিশেষ করে মায়ার মা রেহেনা বেগমের নিশ্চুপ কাঁদছে দূরে দাঁড়িয়ে। উনার অসুস্থ মেয়েটাকে এক প্রকাশ গলায় পা দেওয়ার মতোন করে বিয়েটা দিয়েছেন সবাই। আল্লাহ জানে সবটা কিভাবে সামলিয়ে উঠে উনার ছোট মেয়েটা।
#চলিত….
#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
রিক্তা ইসলাম মায়া
৫৮
তিন কবুলে মায়ার বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে যেতেই শফিকুল ইসলাম নাদিমের হাতে মায়া কম্পিত ঠান্ডা হাতটা শপে দিলো। দুই পরিবারের উপস্থিততে ঘরোয়া বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে মায়া আর নাদিমের। বিয়েটা মায়ার ছোট ফুপির গ্রামের বাড়ি থেকেই হলো। চেয়ারম্যান পরিবারের সদস্যরা বরযাত্রী সমেত মাত্র দুই গাড়িতে করে পনেরো জন সদস্য আসলো। মায়ার গায়ে লাল টুকটুকে বেনারসি। মাথায় লাল দোপাট্টা। সিঁথিতে গোল্ডের টিকলি ঝুলছে কানে ঝুমকো। গলায় স্বর্ণের হার। দু’হাতে দুটো স্বর্ণের চুড়িতে মায়ার সাদামাটা সাজ কমপ্লিট।
অসুস্থ মায়ার তীব্র জ্বরে তাপে মেকাপ করাল না কেউ। শুকনো ঠোঁটে ঐ একটু লাল লিপস্টিক দিয়েছিল নাদিমের বড় বোন রুপা। অল্প সাজেও যেন মায়ার রুপ চকচক করলো। ভেজা চোখ, লাল মুখে দূর্বলতায় নুইয়ে জড়িয়ে ধরে আছে রাফাকে। শফিকুল ইসলাম যখন মায়াকে নাদিনের হাতে শপে দেয় তখনো রাফাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। নাদিমের বড়ো বোন রুপা এগিয়ে গিয়েছিল মায়াকে ধরতে কিন্তু মায়া বা রাফা কেউ কাউকে ছাড়ল না এতো মানুষের ভিড়েও। মায়ার দু’হাত ভরতি লেপ্টানো মেহেদী। গায়ের তীব্র জ্বরে রাফাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। অন্য হাতটা নাদিমের হাতের উপর। উপস্থিত সকলে মায়াকে নাদিমের হাতে শপে দিয়ে বউ বিদায় করার তাড়া দিলো। মায়া হু হা কিছুই বললো না। কেমন পাথর মূর্তি নেয় সকলে সঙ্গে হাটলো বাড়ির গেইট পেরিয়ে গাড়ি অবধি। মায়া বা রাফা তখনো দুজন দুজন চেপে দাঁড়িয়ে। কেউ কাউকে ছাড়তে নারাজ।
এটা নিয়ে অবশ্যই বড়োদের মাঝে দৃষ্টিকটু করেছিল দুজন আলাদাও করতে চেয়েছিল। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়েও মায়া বা রাফা কেউ কাউকে ছাড়ল না। বড়োদের শাসানোতেও না। অবশেষে মায়ার সঙ্গে রাফাকেও দেওয়া হলো। মায়ার অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনা করেই সবার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বিদায় বেলাও মায়া নিজের পরিবার কারও সঙ্গে কথা বললো না আর না চোখ আওড়িয়ে কাউকে দেখার চেষ্টা করলো। সকলের চোখেই পানি বিশেষ করে মায়ার মা রেহেনা বেগমের নিশ্চুপ কাঁদছে দূরে দাঁড়িয়ে। উনার অসুস্থ মেয়েটাকে এক প্রকাশ গলায় পা দেওয়ার মতোন করে বিয়েটা দিয়েছেন সবাই। আল্লাহ জানে সবটা কিভাবে সামলিয়ে উঠে উনার ছোট মেয়েটা।
বরের গাড়িতেও মায়া রাফা দুজন পাশাপাশি বসে। মায়া ঢলে রাফার কোমর জড়িয়ে কাঁধে মাথা ফেলে বসে। নাদিম শশুর বাড়ির সকল থেকে বিদায় নিয়ে মায়ার অপর পাশে উঠে বসতে বসতে কোমল চোখে নুইয়ে পরা মায়ার দিকে তাকাল। ততক্ষণে সামনে থেকে ড্রাইভারের সঙ্গে রুপার জামাই উঠে বসলো। গাড়ি লাইট কমিয়ে স্টাট দিতেই নাদিম নরম হাতে মায়ার হাত টানতে চাইল মায়াকে নিজের কাঁধে শুয়াতে। কিন্তু নাদিমের হাত মায়ার বাহু ছুঁতেই ঝটকা মেরে ছিটকে ফেললো রাফা। কেমন শক্ত গলায় তৎক্ষনাৎ নাদিমকে শুধালো….
‘ মায়া অসুস্থ ভাইয়া। ওহ আমার কাছেই থাকুক।
রাফার শক্ত গলার কথায় কেমন কপাল কুঁচকে আসে নাদিমের। মায়া অসুস্থ সেটা সে কয়েকদিন আগেই শুনেছিল। শফিকুল ইসলাম বলেছিল ব্যাপারটা। সব জেনেও সে মায়াকে বিয়ে করেছে কারণ তার শখের নারী হচ্ছে মায়া। ভালোবাসার মানুষের অসুস্থতায় হাত ছেড়ে দেওয়ার মতোন ছেলে সে নয়। বরং যত্নে আগলে রাখার মানুষ। ভালোবাসার মানুষের অসুস্থতার তার হৃদয়টাও পুড়াচ্ছে। ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুতই সে মায়াকে সুস্থ করে তুলবে। যত্নসহকারে তার বুকেই ঠায় দিবে।
~~
গ্রামের ইট পাথরের রাস্তা। বরযাত্রীর দুটো গাড়িই পরপর রাস্তায় উঠলো। বরের গাড়িটা পিছনে। সামনে নাদিমদের পরিবারিক গাড়িটা এগিয়ে। ফুলে ফুলে সাজানো বরের গাড়িটা অনেকটা পিছনে। অন্ধকার রাস্তায় চাঁদের দেখা নেই, আর না আছে রাস্তার মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো। অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি হেডলাইটের আলোয় আলোকিত রাস্তা। পরিবেশ শীতল। ঠান্ডা হওয়া বইছে বাহিরে। রাস্তা কুকুর গুলো ঘেউঘেউ শব্দ করছে থেকে থেকে। সময় ৭ঃ৪৫ ঘরে। জনমানবহীন রাস্তাটা কেমন মধ্যে রাতের নিশি লেগে আছে। এমন রাস্তা সাই-সাই করে ধুলো উড়িয়ে হঠাৎই বরের গাড়ির মুখোমুখি হলো পরপর তিনটে গাড়ি। তিনটের দুটো গাড়িই জীপ। একটি কালো মার্সিডিজ। আকস্মিক ঘটনায় গাড়ির তাল সামলাতে না পেরে এক্সিডেন্টে ভয়ে দু’হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি থামাল ডাইভার। গাড়ির ভিতরের থাকা মায়া-রাফা দু’জনই সামনে ঝুঁকে পরলে দ্রুততায় দুজনকে দু’হাতে ধরে বাঁচাল নাদিম। তারপরও গাড়ির ভিতরে থাকা সবাই অল্প-সল্প ব্যথা পেল। নাদিম হাতে ব্যথা পেয়েও মায়া রাফাকে দু’হাতে ধরে ডাইভার থেকে জানতে চাইবে কি হয়েছে তার আগেই গাড়ির সচ্ছ গ্লাসে ভিতর দিয়ে চোখে পরলো পরপর তিনটে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামা দলবলদের। এই রাতে ডাকাতের ভয়ে নাদিম দু’হাতে আগলে নিল রাফা আর মায়াকে যদিও রাফা নাদিমের হাতটা ছিটকে ফেলতে গিয়েও বাহিরের ডাকাত দলের হৈচৈয়ে মায়াকে নিয়ে ভয়ে সিটিয়ে গেল গাড়িতে। গাড়ি থামলো কি থামলো না তার আগেই চলন্ত জীপ থেকে লাফিয়ে নামলো রিদ। হিংস্রত্ব চেহারায় চোয়াল শক্ত করে তেড়ে বরের গাড়ির দিকে যেতে যেতে পাশে থাকা ছেলেটির হাত থেকে হকিস্টিকটি ছিনিয়ে নিলো। দু’হাতে গায়ের জোরে প্রথমেই ভারি মারলো ডাইভারের মুখোমুখি গ্লাসটিতে। ঝরঝর করা শিশার মতো গ্লাসটি ভেঙে যেতেই আঘাত প্রাপ্ত হলো ডাইভারসহ নাদিমের দুলাভাই। ভয়ে পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো রাফা। কারও কিছু করার আগেই রিদ পরপর আক্রমণ চালাই নাদিমের বসে থাকা পাশের গ্লাসটিতে। অসংখ্য কাঁচে টুকরো গাড়ির ভিতরের আঁচড়ে পরতেই গাড়ির ভিতরের সকলেই চেঁচিয়ে উঠলো। মায়া তখনো বেঘোরে রাফার কাঁধে ঢলে। হুশে আছে। তবে উপস্থিত পরিস্থিতি দেখার মতোন সচ্ছলতা নেই। শরীর নুইয়ে তরতর করে কাঁপছে তীব্রতর। কানে এসেছে ডাকাতদলের হামলা করার খবরটি। তারপরও মাথা উঠিয়ে দেখতে চাইল না ভয়ে। বরং রাফাকে জড়িয়ে আরও সিঁটিয়ে গেল সে। মায়া রাফা দুজন কাঁদছে। বয়স্ক ডাইভার আকুতি মিনতি করছে এতো মানুষ দেখে। নাদিম বা তার দুলাভাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু করার সুযোগ পাচ্ছে না। চারপাশ থেকে ছেলেরা দা, হকি’স্টিক ছু’রি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাই ভয়ে ভয়ে রুপার স্বামী কল লাগাল চেয়ারম্যান শশুরের কাছে। রিসিভ হতে ওপাশ থেকে কথা বলবে তার আগেই বিরতিহীন রিদের আক্রমণে মুঠোফোনটি ছিটকে পরলো গাড়িতে। রিদের হুংকার ছাড়া চিৎকারের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতোন। হকিস্টিক তুলে একের পর এক গাড়ির কাঁচ ভাঙছে হিংস্রতায়। হুংকারের চিৎকারে আওড়াচ্ছে রিদ….
‘ আমি বলেছিলাম আমার সাথে বেঈমানী করবি না। তারপরও কেন করলি বেঈমানী? কেন আমার অসুস্থতা সুযোগ নিয়ে অন্যের বউ হয়ে গেলি? কেন?
পুনরায় একই ভঙ্গিতে রিদ প্রাণপূর্ণ শক্তিতে অপর দরজার কাঁচে ভারি দিতে দিতে চিৎকার করলো মায়ার নাম নিয়ে…..
‘ মায়াআআআআআ! কেন করলি বেঈমানী? কেনঅঅঅ? আআআআআ!
রিদের হুংকারের চিৎকারের সঙ্গে পরপর গ্লাস ভাঙ্গার শব্দটা যেন ঝংকার তুলল চারপাশে।
রাগে, হিংস্রতার কথা গুলো বলতে বলতে রিদ দু’হাতে আবারও ভারি বসাল দরজায়। ঝরঝরে গ্লাস ভেঙে যেতেই রিদের চোখে পরলো গাড়িতে বসা রাফার দিকে। একহাতে হকিস্টিক চেপে অপর হাতে তৎক্ষনাৎ গাড়ির দরজার টানল খোলতে। লক করা দরজা খুলতে না পেরে পরপর দু’হাতে আঘাত করলো দরজাতে। টেনে হিঁচড়ে রিদ গাড়ির দরজা ভেঙ্গে রাফাকে টেনে ছিটকে ফেলল মায়ার থেকে। রাফা রিদের পায়ে কাছে মুখ থুবড়ে পরতেই রিদ আতংকিত মায়ার হাতে থাবা বসাল বের করতে। কিন্তু অপর পাশ থেকে নাদিম মায়ার হাত টানল বাঁচাতে চেয়ে। মুহূর্তে রিদের মস্তিষ্কে আগুন লাগার মতোন তেলবিলিয়ে উঠলো তিরতির করে। রিদের চোখে পরলো মায়ার পাশাপাশি নাদিমকে বর সেজে বসে থাকতে। তার হিংস্রতা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো যখন দেখল নাদিম মায়ার বাহু টেনে গা ঘেঁষে বসে আছে। হাতের হকিস্টিকটা ফেলে দিয়ে মূহুর্তে থাবা বসাল নাদিমের কলারে। একহাতে মায়ার বাহু অপর হাতে নাদিমের কলার চেপে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করলো দুজনকে। নাদিম গাড়ি থেকে বের হলো কি হলো না। তার আগেই রিদ নাদিমকে গাড়ির সঙ্গে চেপে হাতের শক্ত পিঠে কুইন চাপলো নাদিমের গলায়। হিংস্রতায় হুংকার ছেড়ে রক্তিম চোখে রি রি করে বলল…
‘ কিরে হরামিরবাচ্ছা? আমি থাকতে আমার বউকে কেমনে বিয়ে করলি? খবর নেস নাই এই নারী আমার ছিল? তাহলে তুই আসলি কোত্থেকে? জানে ভয় নাই? মরার পাখ গজাইছে? তোর বাপের কই ছেলে নিয়ে ঘুরে? তোরে বুঝি বুলি দেওয়ার জন্য পাঠাইছে রিদ খানের বউকে বিয়ে করতে?
হিংস্রতার রিদের চোখে মুখে উপছে পরার মতোন। নাদিমের সর্বাঙ্গ কাঁপলো রিদের হিংস্রতা প্রকাশতা দেখে। গায়ে দুজনের সাদা পাঞ্জাবি জড়িয়ে। রক্তের ছিটা দুজনের গায়েই বহমান। তবে রিদের গায়ের সাদা পাঞ্জাবিটি যেন ঘামে ভিজে শরীরে লেপ্টে। অতিরিক্ত রাগে হাতের রগ ফুলে টনটনে। নাদিম রিদের চেহারা দিকে চোখ বুলাতে ভয় পেল। রিদ খানকে সে চিনে। এর আগে দুবার দেখেছিল মায়ার বড় বোন মুক্তার বিয়েতে। তবে রিদের সঙ্গে মায়ার সম্পর্ক কি ছিল সেটা তার অবগত নয়। জানলে হয়তো সে এই বিয়েটা করতো না। কিন্তু এখন দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। মায়ার তার বউ। সে মরলেও অন্তত বউয়ের সম্মান বাঁচাবে। রিদের ভয়ে নাদিমের শরীরে ঘাম ঝরে গেল। আশেপাশে ত্রিশ চল্লিশটার মতো ছেলেপেলে ঘিরে দাঁড়িয়ে। ডাইভার আর তার দুলাভাই ছেলেগুলো হাতে বন্দী। কিছু করার মতোন তাদের হাতে উপায় নেই। তারপরও নাদিম অসুস্থ মায়াকে দেখল মাথা নুইয়ে কাঁদছে ভয়ে। অথচ রিদ একহাতে মায়ার বাহু ধরে অপর হাতে নাদিমের গলা চেপে দাঁড়িয়ে। নাদিম ব্যথিত গলায় রিদের থেকে নিজের ছাড়ানো চেষ্টা না করে বরং মায়াকে বাঁচাতে চেয়ে সে আকুতি স্বরে বলল….
‘ মায়াকে প্লিজ ছেড়ে দিন। ওহ অনেক অসুস্থ। আপনি বরং আমার সাথে কথা বলুন।
রিদের রাগে ঘি ডালার মতোন কাজ করলো নাদিমের কথাটা। তার নারীকে বিয়ে করে তাঁকে বলছে তার বউ ছেড়ে দিতে? রিদ হিংস্রতায় দাঁত পিষে রাগে রি রি করে বলল….
‘ দরদ দেখাস? দরদ? তোর দরদের তেজ আজ আমিও মাপবো। জান দিতে পারবি এই নারীর জন্য? পারবি? আমি কিন্তু জান নিতে পারবো এই নারীর জন্য? দেখবি? দাঁড়া?
কথা বলতে বলতে রিদ হুংকার ছাড়ার মতোন সঙ্গে সঙ্গে ডাকলো আসিফকে….
‘ আসিফফ! আসিফফ!
সঙ্গে সঙ্গে আসিফ দৌড়ে আসার মতো একটা হকিস্টিক নিয়ে আসলো। থাবা বসানো মতোন ছিনিয়ে নিয়ে আঘাত বসাল নাদিমের মাথায়। রিদ এলোমেলো হাতে নাদিমকে আঘাত করতে দেখে ডাইভার আর নাদিমের দুলাভাই আঁতকে উঠল ভয়ে। এইভাবে মারতে থাকলে নাদিম মারা যাবে নিশ্চিত। তাই দুজন নিজেদের ছাড়াতে চেয়ে চিৎকার করলো নাদিমকে বাঁচাতে। কিন্তু পাঁচে রিদের ছেলেপেলের হাতে বন্দী পরলো তারাও। অথচ নাদিমের চিৎকারে শান্ত পরিবেশটা অশান্ত হয়ে উঠলো মূহুর্তে। নাক, মুখ, হাত, কপাল সর্বাঙ্গ ফে’টে র’ক্ত ঝরলো চুইয়ে চুইয়ে। মায়ার রিদের উপস্থিত ঠের পেয়েছিল গাড়িতে বসেই। কিন্তু রিদের হিংস্রতায় আর নিজের তীব্র অপরাধ বোধে আগাতে পারেনি এতোদিন পর স্বামীকে সুস্থ পেয়েও। এখনকার গল্পটা ভিন্ন। এখানে মায়া বেঈমান নারী। তাই মায়ার হাতে করার মতোন কিছু ছিল না। এই মূহুর্তে নাদিমকে মার খেতে দেখেও মায়া কিছু বলতে বা করতে পারলো না। আর না জায়গা থেকে নড়াচড়া করলো। নাদিমকে র’ক্তা’ক্ত করেও যখন রিদের মন ভরলো না তখন পুনরায় চিৎকার করে বলল…
‘ আসিফ আমার বন্দুক দে!
বলতে বলতে রিদ নিজেই তেড়ে গেল আসিফের দিকে। থাবা মেনে আসিফের থেকে ব’ন্দু’ক ছিনিয়ে নিয়ে মূহুর্তে দু’হাতে টেনে ট্রিগার অন করলো নাদিমের দিকে এগোতে এগোতে। নাদিমের দুলাভাই আহাজারি চিৎকার করে উঠলো যখন দেখলো রিদকে বন্দুক হাতে নাদিমের দিকে যেতে। তিনি মায়ার কাছে নাদিমের জীবন বাঁচাতে সাহায্য চাইলে মায়া ফুপিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো ভয়ে।
মায়ার কান্না রিদের কানে যেতে রিদে পথ ঘুরে যায়। নাদিমের দিকে তেড়ে যাওয়া পথ মায়ার দিকে ঘুরে যায়। একহাতে মায়ার বাহু টেনে ঠাস করে গাড়িতে ঠেকাল পিঠ। মায়া পিঠের ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠতে রিদ শক্ত হাতে মায়ার গলা চেপে মুখের ভিতর বন্দীক ঠেকিয়ে হিংস্রত্বের গর্জে উঠে রাগে রি রি করে বলল…
‘ মেরে দেয়? দেয় মেরে? বুক কাঁপে নাই? জানের ভয় নাই। কতো বড়ো কলিজা নিয়ে ঘুরিস তুই? আমার বউ হয়ে অন্যের নামের কবুল বললি কিভাবে? আমার কথা মনে আসে নাই? আমি ফিরব তুই জানতি না? আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অন্যের বউ হয়ে গেলি? তোর বউ হওয়ার শখ? বউ? বাসর করবি জামাই লগে? বাসর? তোর জামাইকে মে’রে তোকে বিধবা বানিয়ে তারপর যাব আমি। কি ভেবেছিস? আমি ফিরবো না? মরে গেছি? দেখ তোর জম হয়ে ফিরে এসেছি। এবার তোকে কে বাঁচাবে আমার থেকে? তোর জামাই? ওয়েট!
হিংস্রতায় রিদ হিতাহিত অজ্ঞ হয়ে পরলো। সে যেন নিজের মধ্যে নেই। বিয়ে করা বউ তার ভালোবাসার মানুষ। সেই বউকে যখন অন্যকেউ জড়িয়ে বসে থাকে তখন দুনিয়া ধ্বংস করার মতন আগুন জ্বলে উঠে ভিতরে। সবকিছু ভেঙে গুলিয়ে দেওয়ার মতোন তোলপাড় হয় মনে। আজ সে সঠিক সময়ে না আসলে তাহলে কি করতো তার বউ? অন্যের বাসরে ঘোমটা দিয়ে অপেক্ষা করতো দ্বিতীয় স্বামীর জন্য? নিজের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় খিঁচে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল রিদের। দপদপ করে শিরা-উপশিরায় জ্বলল হিংস্রতায়। তার বউ তাকে জীবিত রেখে আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে সেটাই যেন মানতে পারছে না সে। রাগে হিংস্রতায় জ্ঞান হারিয়ে হাতের বন্দুকটা মায়ার মুখ থেকে বের করে নাদিমের দিকে তাক করে গুলি করতে চাইলে মূহুর্তে হাত টেনে ধরে মায়া। খোলা আকাশের গুলি ছুড়ে যেতেই রিদের হিংস্রতা দ্বিগুণ প্রকাশ পাই। মূহুর্তে মাঝে মায়ার গালে থাপ্পড় পরলো রাগে। পরপর একই ভাবে দ্বিতীয় থাপ্পড়টা বসাতে বসাতে বলল….
‘ স্বামীর জন্য দরদ দেখাস। এতো ভালোবাসা তোর? তাহলে আমার সাথে নাটক করলি কেন? তোরে বলছিলাম না আমার সাথে বেঈমানী না করতে? তাহলে কেন করলি? আমাকে সস্তা পেয়েছিস এজন্য?
কথা গুলো বলতে রিদ পরপর আরও একটা থাপ্পড় বসায় মায়ার অপর গালে। মায়ার মাথা টিকলি, গলার হার, দোপাট্টা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে রিদ একই ভাবে বলল…
‘ এসব কি পরেছিস তুই? খোল! খোল সব! আমি কি ভালোবাসতাম না তোকে? কেন অন্যের বউ হতে গেলি? কেন আমার ভালোবাসাটাকে হারায় করেদিলি। কেন বিয়ে করলি? মরে যেতি তারপরও এই বিয়ে কেন করলি তুই?
মায়ার ঠোঁটের লিপস্টিক লেপ্টে পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে রিদ ডলে পরিষ্কার করতে করতে বলল…
‘ এই লিপস্টিক কার জন্য পরেছিস তুই? জামাই জন্য? আমি আদর করতাম না তোকে? তাহলে কেন বউ সাজতে গেলি। তোর সাজ তো আমার জন্য ছিল। তাহলে সেখানে কেন অন্য কাউকে আসতে দিলি? এই শাড়ি ঐ ছেলে দিয়েছে না তোকে? খোল এটা। খোল।
বলতে বলতে রিদ দু’হাতে থাবায় মায়ার গায়ের বেনারসিটা টেনে খোলতে চাইলে মায়া ইজ্জতের ভয়ে তৎক্ষনাৎ দু’হাতে রিদকে ঝাপটে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে আকুতি স্বরে বলল….
‘ প্লিজ আমাকে অসম্মান করবেন না এতো গুলো মানুষের সামনে। আমি আপনার থেকে অনেক দূরে সরে যাব। আর আসব না সামনে। তারপরও আমাকে অসম্মান করবেন না প্লিজ। আপনার পায়ে পরছি আমি। দয়া করুন প্লিজ।
মায়ার কথা গুলো শেষ হতে হতে রিদ মায়াকে ছিটকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে ফেলতে বলল…
‘ তুই নোংরা হয়ে গেছিস। তোর শরীর নোংরা হয়ে গেছে। এই শরীরে অন্য পুরুষের ছুঁয়া লেগেছে আছে তাই এই শরীর নিয়ে কখনো আমাকে ছুঁতে আসবি না। আমার জন্য তুই অপবিত্র হয়ে গেছিস তোকে….
রিদের কথা শেষ হওয়ার আগেই পিছন থেকে রিদের উপর আক্রমণ করলো কেউ। রিদ বুঝে উঠার আগেই জুইয়ের বাবা সাজিদুল ইসলাম রিদের কাঁধ টেনে মুখ বরাবর ঘুষি বসাতেই বামে ঝুঁকে গেল রিদ। মায়া আতংকে উঠে সাজিদুল ইসলামকে থামাতে চাইলে তিনি মায়াকে হাতের ধাক্কায় দূরে সরিয়ে ফেলে পুনরায় রিদকে ধরতে যাবে তার আগেই রিদ উনার হাত চেপে মুচড়িয়ে পরপর ঘুষি বসাল জুইয়ের বাবা সাজিদুল ইসলামের মুখে। মায়ার চিৎকার আর থমথমে পরিবেশে সকলে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বরের গাড়ি ডাকাত পরেছে খবরটা শুনে সাজিদুল ইসলামের সঙ্গে মায়ার পরিবারের সকলেই লাঠিসোঁটা নিয়ে এসেছিল টচ হাতে হাতে। মায়ার বাবা-মা ফুপা-ফুপিরা, জুই, জুইয়ের মা সকলেই থমকে আছে উপস্থিত পরিবেশ দেখে। রিদের হাতে বেদম মার সাজিদুল ইসলামকে খেতে দেখে চিৎকার করে এগিয়ে গেল জুইও ওর মা। মূহুর্তে সাজিদুল ইসলামের উপর মা মেয়ে দুজনই আড়াআড়ি ভাবে পরে গেল বাচাতে চেয়ে। আসিফ বাধ্য হয়ে এগিয়ে এল রিদের দিকে। ছেলেপেলেদের নিয়ে রিদকে দু’হাতে ঝাপটে ধরে আটকাল মায়ার পরিবারকে আঘাত করতে না দিয়ে। কারণ রিদের মায়ার পরিবারকে আঘাত করার দৃষ্টিকটুর দেখাচ্ছে তাই। এই মূহুর্তে মায়ার বাবাও যদি সাজিদুল ইসলামকে বাঁচাতে চেয়ে এগোত তাহলে হয়তো তিনিও রেহাই পেত না হিংস্রত রিদের হাত থেকে। তিনি চোখ মুখ শক্ত করে রিদের দিকে তাকিয়ে। তারপর চোখ ঘুরাল র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় পরে থাকা নাদিম দিকে, পাশেই তার ভাই সাজিদুল ইসলামকে জড়িয়ে কাঁদছে জুই ও সাবিনা বেগম। রিদ নিজেকে টেনে সবার থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে উপস্থিত সকলের সামনে মায়ার উদ্দেশ্যে বলল…
‘ জীবনে একই ভুল আমি দ্বিতীয় বার রিপিট করি না। তোর বিয়ে করার শখ না? থাক তুই তোর স্বামী নিয়ে। আমি সেই নারীর দিকে ঘুরে তাকাব না যে নারী আমি জীবিত অবস্থায় অন্য কারও হাত ধরে। জীবনে একা থাকবো তারপরও তোকে চাইব না। বেঈমান প্রত্যারক নারী তুই। আমার ঘৃণার লিস্টে তুই প্রথম মনে রাখিস।
#চলিত….