#রিদ_মায়ার_প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা_ইসলাম_মায়া
৭১
‘ আই লাভ ইউ জান।
মায়া তখনও কাঁপছে। রিদের উষ্ণ নিশ্বাস গলায় অনুভব হতে মায়ার অদ্ভুত শিহরণ জন্মাল সর্বাঙ্গে। কম্পিত মায়া এক হাতে রিদের বুকে ধাক্কা দিতে চাইলে রিদ আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। মায়ার বাধা দেওয়া হাতটা চেপে রিদ মাথা তুলে তাকায় মায়ার বন্ধ দু’চোখের পাতায়। নিস্তব্ধ রুমজুড়ে শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে দুজনের উষ্ণ নিশ্বাসের শব্দ। কম্পিত মায়ার বুক ধড়ফড় করলো। রিদের উষ্ণ নিশ্বাস মুখের উপর অনুভব করে চোখ মেলে তাকাতে মুহূর্তে দৃষ্টি মিললো রিদের অদ্ভুত দৃষ্টিতে। ঘায়েল মায়া আরও ঘায়েল হলো। রিদের দৃষ্টিতে আড়ষ্ট হয়ে লজ্জায় নত মস্তিস্কের হতে চাইলে তৎক্ষণাৎ অধরে অধর মিললো। রিদ মায়ার অধরে মগ্ন হতে মায়া ভাসা ভাসা চোখে তাকালো, রিদের ভালোবাসার আকুতি বুঝতে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো রিদের শার্ট মুঠোয় পিষে। অন্ধকার ঘরে সময়ের খেয়াল কারও নেই। তবে অন্ধকার ঘরের ঘোর বাড়িয়ে রিদ মায়ার শাড়ি ভেদ করে উন্মুক্ত কোমরে বাঁধলো নিজের শক্ত দু’হাতে। মায়াতে মগ্ন রিদের ঘোর কাটিয়ে ফের দরজায় নক করল কেউ। পরপর শব্দে রিদ বিরক্ত ভঙ্গিতে মায়ার ঠোঁট ছেড়ে কপালে কপাল ঠেকালো। দুজনের উষ্ণ নিশ্বাস একে অপরের মুখে আছড়ে পড়ার মাঝে আবারও শোনা গেলো দরজার অপর পাশের শশীর গলা। রিদকে ডেকে বলল…
‘রিদ ভাই দরজাটা খোলো। তোমাকে নিচে যেতে বলেছে নানাভাই। রিদ ভাই? শুনছো?
রিদ বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে মায়াকে ছেড়ে দাঁড়ালো। এবার বেশি বেশি হচ্ছে ব্যাপারটা। রিদের চট্টগ্রামে আসার পর থেকে পার্সোনাল স্পেস পাচ্ছে না। যেখানে কেউ রিদের সঙ্গে কথা বলতে সম্মতি প্রয়োজন হয় সেখানে যখন তখন তার ব্যক্তিগত মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করছে। যেটা রিদ মোটেও পছন্দ করে না। এই রাতে অন্তত রিদকে ডিস্টার্ব করাটা মোটেও পছন্দ হয়নি তার। রিদ তপ্ত মেজাজে বন্ধ দরজার দিকে এক পলক তাকিয়ে মায়ার দিকে দৃষ্টি ঘুরাতে খানিকটা শান্ত হয়ে আসলো মায়াকে তখনো কম্পিত শরীরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নত মস্তিস্কের ঘনঘন শ্বাস ফেলতে দেখে। বিরক্ত রিদ কপালের একপাশ চুলকে মায়াকে শান্ত গলায় বললো…
‘বিছানায় যাও। আমি আসছি।
রিদের কথাটা অল্প কিন্তু মায়ার কাছে ভয়ংকর শোনালো। বিছানায় যাও মানে? মায়ার শরীরের কম্পন তীব্র থেকে তীব্র হলো রিদের কথায়। রিদ দরজা খুলে বাহিরে যেতে মায়া রিদের গমন পথের দিকে চোখ তুলে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরাল খালি বিছানায়। মুহূর্তে শরীরের অদ্ভুত শিহরণে আছড়ে সিটিয়ে গেলো দেয়ালের সঙ্গে। ভয়ার্ত মায়া হঠাৎ করে ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করলো। গলা শুকিয়ে আসতে পানির খোঁজ করলো। তৃষ্ণার্ত মায়া আবছা আলোয় সোফার দিকে এগিয়ে গেলো। ট্রে-তে রাখা খাবারের সঙ্গে পানির জগ হতে পানি ঢেলে পান করতে করতে ভাবলো রিদ ফিরে আসার আগেই মায়া ঘুমিয়ে যাবে। ভয়ার্ত মায়ার ভাবনা অনুযায়ী তাই করলো। বিছানার পাশ ঘেঁষে শুয়ে শরীর কুঁজো করে। ঘুমের ভান ধরতে রিদ দরজার বাইরে দেখলো শশীকে অস্বস্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতে। রিদের উপচে পড়া বিরক্তি বাড়লো শশীকে দেখে। তপ্ত মেজাজে বলল…
‘ কী সমস্যা? কী চাই?
‘ তোমাকে কখন থেকে ডাকছি শুনছো না কেন? রুমে এতক্ষণ কী করছিলে?
রিদকে করা শশীর অযাচিত প্রশ্নটা রিদের বাড়াবাড়ি মনে হলো। রিদের মেজাজ এমনই চটে ছিলো এর মাঝে শশীর রিদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার মতন প্রশ্নটা করতে রিদ ক্ষেপে গিয়ে বললো…
‘ আমি রুমে কী করছিলাম সেই কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে? আমি আমার রুমে কতক্ষণ থাকবো, না থাকবো সেটা নিশ্চয়ই তুই ঠিক করে দিবি না আমাকে?
রিদের শক্ত গলায় শশী মিনমিন করে বললো…
‘না মানে আমি অনেকক্ষণ যাবত তোমার দরজায় নক করছিলাম। তুমি খুলছিলে না তাই…
শশীকে শেষ করতে না দিয়ে রিদ একই তেজে বললো…
‘তোকে আমি বলছিলাম আমার দরজা নক করতে? কী বলতে এসেছিস সেটা বলে বিদায় হ।
রিদের শক্ত গলায় শশী বলল…
‘নিচে পুলিশ এসেছে। তোমাকে নিচে যেতে বলেছে নানাভাই।
‘তুই যা।
শশী তৎক্ষণাৎ চলে যায় না। ওর চোখ ভেজা নোনা জলে। বারবার আড়চোখে বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো শশী বুঝতে পারছে রিদ এতক্ষণ যাবত মায়ার সঙ্গে বন্ধ দরজার ভিতরে সময় কাটাচ্ছিল। শশীর ডাকে রিদ বিরক্ত হয়েছে। শশী জানে স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে প্রশ্ন করতে নেই তৃতীয় পক্ষ হয়ে। রিদ-মায়ার সম্পর্কে শশী এখন তৃতীয় পক্ষ এটা জেনেও শশীর মন মানতে নারাজ। মায়ার আগে রিদের জীবনে শশী প্রথমে এসেছিলো। আজ মায়া না থাকলে হয়তো রিদের ভবিষ্যৎ নারী শশীই হতো। শশী ফের রিদকে একটা অযাচিত প্রশ্ন করে বললো..
‘মায়া তোমার রুমে?
শশীর কথাটা শুনতেই রিদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে, রাগে দাঁতে দাঁত পিষে তৎক্ষণাৎ বললো…
‘আউট।
ভেতরকার কষ্টে শশী ভাঙা গলায় আকুতি স্বরে ডাকতে চাইল রিদকে…
‘রিদ ভা..
রিদ ফের একই ভঙ্গিতে শশীকে থামিয়ে চিবিয়ে বলল…
‘তোকে যেতে বলছি আমি। আউট।
ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত করে রিদের সম্মুখ থেকে দৌড়ে পালালো শশী। শশীকে দৌড়ে চলে যেতে দেখলো সিঁড়ি বেয়ে ওঠা রাদিফও। সে তৎক্ষণাৎ কিছুই বুঝলো না। তবে সামনে থেকে রিদকে রাগান্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে দেখে ব্যাপারটা আংশিক বুঝতে পারলো রাদিফ। রাদিফের শশীর জন্য মায়া হলেও তার কিছু করার ছিলো না। জীবনে সবকিছু স্যাক্রিফাইস করে ভালো থাকা যায় কিন্তু ভালোবাসা স্যাক্রিফাইস করে জীবনে ভালো থাকা যায় না। আর রিদ খানের মতো শক্ত পার্সোনালিটির মানুষ কখনো নিজের ভালোবাসা স্যাক্রিফাইস করবে না বরং না পেলে ছিনিয়ে নিবে তারপরও ছেড়ে দিবে না। তাই এক্ষেত্রে শশীর রিদের আশা ছেড়ে যত দ্রুত বাস্তবতা মেনে নিবে তত শশীর জন্যই ভালো হবে। তবে রাদিফের মনে হলো সে একবার শশীর সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলবে। আজ না-হয় কাল অবশ্যই। রাদিফ সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে পড়তে রিদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে রাদিফ রিদের পিছন পিছন যেতে যেতে বললো…
‘ ভাই পুলিশ কমিশনার এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু না হলে আমরা তোমায় ডাকতাম না।
রাদিফের কথায় রিদকে শুধু গম্ভীর দেখাল। নির্বাচনের সম্মুখে রেখে বাসায় বসে থাকা যায় না সেটা রিদ নিজেও জানে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনও পিছনে ফেলা যায় না, দুটো সামলিয়ে চলতে হয়। রিদ সময় নিয়ে গম্ভীর মুখে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলল। নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো জটিলতা নেই আবার নিশ্চিন্তেও থাকা যাচ্ছে না। প্রতিবছরের মতো এবার নিহাল খানের প্রতিদ্বন্দ্বী জসিম নেই। বাকিরা যারা আসনে আছেন সবার একত্রে ভোটের চেয়েও নিহাল খানের একপাক্ষিক বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে এমনটা সবাই আশাবাদী। এতকাল নির্বাচনে নিহাল খান যে হারে জয়লাভ করেছেন এবছরও তাই করবেন। কিন্তু এর মাঝে জটিলতার বিষয়টি হচ্ছে জসিম জীবিত নেই তাহলে নিহাল খানের উপর সেদিন কে আক্রমণ করেছিল সেটি শনাক্তকরণের জন্য রিদ কাজ দিয়েছিল পুলিশ কমিশনারকে। সেই খবর নিয়েই মাঝরাতে হাজির হন কমিশনার সাহেব। সেদিনের রাদিফ ও নিহাল খানের উপর হওয়া হামলার পিছনে আসামি তথ্য জানতে রিদের কপাল কুঁচকে আসে খানিকটা অবিশ্বাসে। তারপরও কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং আসিফকে দিয়ে কমিশনারকে বিদায় জানিয়ে রিদ তার ঘরে ফিরল। অন্ধকার ঘরে মায়ার কথা স্মরণে আসতে রিদ বিছানার দিকে তাকাল। মায়াকে কুঁজো হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে রিদের বিরক্তি আরও বাড়ল। অসময়ে যে মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে রিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শব্দ করে দরজা লাগাল। দরজার হঠাৎ শব্দে জাগ্রত মায়া খানিকটা নড়ে উঠতে সেটা রিদের চোখে পড়ল। রিদ হু হ্যাঁ আর কোনো শব্দ না করে গিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখের উপর হাত ঠেকিয়ে। নিস্তব্ধ ঘরে জুড়ে ভয়ংকর নীরবতা ছেয়ে যেতেই মায়া চোখ মেলে তাকাল রিদের সাড়াশব্দ না পেয়ে। সেকেন্ডের কাঁটা মিনিট পেরিয়ে ঘন্টায় চলে যেতে মায়া মাথা তুলে তাকাল পিছনে। রিদকে চিত হয়ে চোখের উপর হাত ঠেকিয়ে অপর হাতটা বুকে রেখে পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে থাকতে দেখে মায়া ভাবল রিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। রিদ রুমে এসেছে প্রায় ঘন্টা পেরোতে চলল। এতোটা সময় নিশ্চয়ই রিদ জেগে থাকবে না? জড়তার মায়া সহজ ভাবেই রিদের দিকে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত রিদের বুকে রাখা হাতটা ছুঁতে মুহূর্তে রিদ মায়ার দিকে পিঠ বেঁকে শুয়ে পড়ল। রিদের হঠাৎ কাজে মায়া থমকে বসল। রিদ ঘুমন্ত অবস্থায় মায়ার দিকে পিঠ মুড়ে শুয়েছে নাকি জাগ্রত অবস্থায় সেটা মায়া তখনও বুঝল না। হাঁসফাঁস করা মায়া কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ফের রিদের বাহু টেনে নিজের দিকে ঘুরতে চাইলে রিদ মায়ার হাতটা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে মায়া বুঝতে পারল রিদ জাগ্রত। শুধু জাগ্রত নয় বরং মায়ার সঙ্গে রাগ করে শুয়ে। কিন্তু কেন? মায়া তখন রিদের কথা শুনে অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়েছে বলে সেজন্য? কিন্তু মায়াতো ঘুমায়নি? বরং ঘুমের ভান করেছিল ভয়ে। মায়া জানে ব্যাপারটা এবার বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু মায়া বিষয়টা সহজ ভাবে নিতে পারছে না। ভয় লাগছে ভীষণ। জড়তার মায়া ফের রিদের বাহু টানতে রিদ একই কাজ করল মায়ার হাতটা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে মায়া রিদের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে পেট জড়িয়ে। রিদের পিঠে মুখ গুঁজে গুনগুনিয়ে বলল…
‘ আমি ঘুমাইনি তো। এই যে দেখুন জেগে আছি।
রিদের পেটের উপর মায়ার হাতটা রিদ ঝটকায় ফেলে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে শুতে শুতে বললো…
‘ নট ইন্টারেস্টেড। গেট আউট।
রিদের কথায় মায়া বেশ অপমানিত বোধ করলো। নীরবে চোখ ভিজল নোনা জলে। মায়া ফের রিদের শরীর ঘেঁষে একই ভাবে রিদের পেট জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো…
‘ আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড। আমি এভাবেই শুবো।
রিদের সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না আর। কয়েক সেকেন্ড পেরোতে মায়া মাথা তুলে রিদের কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল…
‘ সরি। আর হবে না এমন। এবার থেকে আপনার সব কথা শুনবো সত্যি বলছি।
রিদকে তখনো জেদ দেখিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে মায়া রিদের পিছনে হতে সামনে আসলো রিদের উপর ডিঙিয়ে। রিদের বুকে নিজের জায়গা করে দু’হাতে রিদকে জড়িয়ে ধরতে রিদ তপ্ত মেজাজে বললো….
‘ কী সমস্যা তোমার? ঘেঁষাঘেঁষি করছো কেন? দূরে যাও। ঘুমাবো আমি।
মায়া মাথা তুলে টুপ করে রিদের গালে চুমু খেয়ে পুনরায় রিদের গলায় মুখ ডুবাতে ডুবাতে বলল…
‘ওকে ঘুমান, গুড নাইট।
কথাটা বলেই মায়া রিদকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করতে রিদের ফুসফুসের তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ কানে আসলো মায়ার। হয়তো মায়ার কথাটা পছন্দ হয়নি রিদের। তারপরও মায়া আর প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বরং রিদকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যেতে চাইল। সময় নিয়ে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে রিদের হাত নেমে আসল মায়ার পিঠে। মায়ার চোখ সবে ঘুমে বুজে এসেছিলো কিন্তু রিদের বেগতিক হাতের স্পর্শে তড়াক করে তাকাতে মায়া কিছু বলবে তার আগেই রিদের দক্ষ হাত ততক্ষণে মায়ার শাড়ির আঁচল টেনে ফ্লোরে ফেলতে ফেলতে রিদ বিরক্তি গলায় বললো…
‘কী পড়েছো তুমি? কাপড়ে বাজে স্মেল আসছে কেনো? জানো না আমার বাজে স্মেল সহ্য হয়না।
মায়ার ঘুমিয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক সজাগ হলো। শরীরের কম্পন দেখা দিলো তক্ষুনি। কম্পিত মায়ার মুখ রিদের গলায় ঠেকে যেতেই ভয়ার্ত গলায় বলতে চাইল…
‘আমার ভয়…
রিদ মায়াকে জড়িয়ে উপরে উঠতে মায়ার গলায় মুখ ডুবাতে ডুবাতে বললো…
‘বাজে কথা বললে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো রিত।
মায়া গোঙাল। ছটফট করার মতন রিদের বক্ষে সিঁটিয়ে যেতে রিদ ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে মায়ার কানে ফিসফিস করে বলল…
‘আমার অসুখের সুখ তুমি। আমার বসন্তের ফুল তুমি। আমার বেপরোয়া জীবনের চাওয়া তুমি, আমার রাজ্যের রানী তুমি। তোমাতে পূর্ণ আমি।
~~
একটা সুন্দর সকালের সূচনা। রিদ ফোনটোন বন্ধ করে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে। রুমে জুড়ে অন্ধকারের বিচরণ। সকালের মিষ্টি আলো মোটা পর্দা ভেদ করে ঘরে ঢুকতে অক্ষম। সকাল তখন নয়টার ঘরে। রিদ এতো বেলা করে ঘুমায় না। রাতে অসময়ে ঘুমের জন্য আজ এতো বেলা অবধি তার ঘুমানোর কারণ। ঘুমন্ত রিদের হঠাৎ ঘুমের রেশ হালকা হয়ে আসতে বিছানা হাতড়িয়ে মায়ার সন্ধান করল। আশপাশের কোথাও মায়াকে না পেয়ে বন্ধ চোখে কপাল কুঁচকাল বিরক্তিতে। রিদ কতবার বলেছে বেয়াদব বউটাকে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে যেন কোথাও না যায়। বেয়াদব নারী কথাটা শুনলে তো?
রিদ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল। খালি গা স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা দেখে আরও বিরক্ত হলো। এই গরমের জন্য তার ঘুমটা ভেঙেছে। রিদ বিরক্ত চোখে রুমের এসির দিকে তাকাতে দেখল সেটা অফ। রিদের রুমের এসি সচরাচর কখনো বন্ধ থাকে না। তাহলে এখন এসি বন্ধের কারণটা খুঁজতে গিয়ে রিদের মনে পড়ল শেষ রাতে গোসলের পর মায়ার শরীরের তীব্র কম্পন ধরে ছিল ঠান্ডায় যার কারণে রিদ নিজেই এসি অফ করে দিয়েছিল। মায়ার কথা স্মরণে আসতে রিদ খানিকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। শেষ রাতে মায়াকে বেশ দুর্বল আর অসুস্থ দেখাচ্ছিল এখন কেমন আছে সেটা জানতে চেয়ে রিদ ঘর ছেড়ে বাহিরে যেতে চেয়েও গেল না। এখন বের হলে সে আর রুমে ফেরার সময় পাবে না ব্যস্ততায়। তাই রিদ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গায়ে সাদা পাঞ্জাবি জড়াল। সে চট্টগ্রামে থাকাকালীন এসব সাদা পাঞ্জাবি পরে রাজনৈতিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখে কিন্তু ঢাকা ফিরে সে এসব পরে না। রিদ গায়ে পাঞ্জাবি জড়িয়ে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করতে চোখে পড়ল গলার কিছু অবাঞ্ছিত দাগ। এসব দাগ তার শরীরেও আছে। কিন্তু রিদের শরীর কাপড় ঢাকা হলেও গলা উন্মুক্ত। রিদ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড বক্স নিল। সেখান হতে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ গলার দুই-তিন জায়গায় লাগিয়ে কভার করতে চোখে পড়ল গালের ডানপাশের একটা দাগ। এসব বিষয়ে যদিও রিদের লজ্জা-শরম কম। কিন্তু রাজনৈতিক সমাবেশে ছোট থেকে ছোট বিষয় গুলোও মিডিয়া বড় বড় করে দেখাবে বলে রিদ মুখেও ওয়ান টাইম মাস্ক পরার সিদ্ধান্ত নিল। এর মাঝে রিদ নিজের ফোনের সঙ্গে মায়ার ফোনটাও ওপেন করতে দরজার ধরে দাঁড়াল কেউ। রিদ আয়নায় দিয়ে মায়াকে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল….
‘এদিকে এসো।
রিদের ডাকে নত মস্তিস্কের মায়া ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল সেদিকে। মায়াকে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটতে দেখে রিদ সেদিকে তাকাল। মায়া কাছাকাছি আসতে রিদ মায়ার বাহু টেনে নিজের মুখোমুখি করে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করে বলল…
‘হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে? ব্যথা পাচ্ছো?
নিশ্চুপ মায়ার নত মস্তিস্ক আরও নত করে নিতে রিদ পুনরায় একই ভাবে বলল….
‘বাহিরে যাওয়ার দরকার নেই। রুমে রেস্ট নাও। সার্ভেন্ট তোমার খাবার ঘরে দিয়ে যাবে। বুঝেছ?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে রিদ মায়ার লালচে মুখটার দিকে তাকাল। রিদ চোখ বুলিয়ে মায়াকে অবলোকন করতে দেখতে পেল মায়ার শরীরে কালো একটা সুতির থ্রি-পিস জড়িয়ে ওড়নাটা মাথায় গোল করে বেঁধে শরীরে জড়িয়ে। রিদ বুঝতে পারছে মায়ার অসময়ে ওড়নাটা হিজাব করার কারণ। রিদের নিজেরও পছন্দ না তাঁর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের সাক্ষী অন্যকাউকে করতে। সে এসব বিষয়ে খুব সেনসিটিভ। উচ্ছৃঙ্খল কোনো কিছুই তার পছন্দ না। রিদ হাত বাড়িয়ে মায়ার কাটা ঠোঁটে আলতো আঙুল চেপে বলল….
‘কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিবে তাহলে ভালো লাগবে কেমন?
মায়া আবারও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে রিদ মায়াকে ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে পরপর দুটো বক্স বের করে রাখল। প্রথম বক্সটি খুলে তাতে ডায়মন্ড রিং বের করে মায়ার বামহাতের আঙুলে পড়াতে পড়াতে বলল…
‘বউকে দেনমোহর দিতে হয়। যদিও তোমার দেনমোহর পরিশোধ করা আছে তারপরও আবার দিলাম। এটা তোমার জন্য অনেক আগেই কিনে ছিলাম। মুরাদপুরের ফ্ল্যাটে তোমাকে একটা চাবির রিং দিয়েছিলাম মনে আছে? এই রিংটা তখন তোমার জন্য কিনেছিলাম আর আজ দিলাম।
রিদের কথায় মায়া চোখ তুলে তাকাল রিদের দিকে। দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে কৌতূহল নিয়ে মিহি স্বরে বলল….
‘সেদিন মুরাদপুর ফ্ল্যাটে আমাদের বিয়েটা কি আসল ছিল?
‘ হ্যাঁ।
‘ তাহলে আপনি আমাকে বললেননি কেন?
‘আমি বললে তুমি বিশ্বাস করতে? গ্রহণ করতে আমায় স্বামী হিসাবে?
রিদের কথায় মায়া চুপ হয়ে যায়। সেদিন রিদ বললে হয়তো মায়া বিশ্বাস করত না রিদ মায়ার স্বামী সেটা। বরং মায়ার মনে হতো রিদ মায়ার অচেনা মায়ার সম্পর্কে জেনে এখন রিদ মায়ার সুযোগ নিয়ে নিজেই মায়ার অচেনা স্বামী বলে নিজেকে দাবি করছে। তখন ব্যাপারটা মায়া বিশ্বাস না করলেও রিদ অন্তত একবার মায়াকে জানাতে পারত রিদ মায়ার স্বামী হয় সেটা। মায়া মিনমিন করে বলল…
‘ তারপরও আপনার দায়িত্ব ছিল আমাকে অন্তত একবার জানানোর।
মায়ার কথায় রিদের পাল্টা প্রশ্ন আসল তক্ষুনি। বলল…
‘সে রাতে তুমি আমাকে বলে পালিয়েছিলে যে আমি দায়িত্ব পালন করব তোমাকে জানিয়ে?
‘ আমি জানাইনি বলে আপনিও জানাবেন না?
‘ না।
মায়া গাল ফুলিয়ে দাঁড়াল। রিদ অপর বক্স হতে মায়াকে গলায় ডায়মন্ডের লকেট গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
‘ বক্সে আরও কিছু জুয়েলারি আছে ভালো লাগলে পড়ে নিও। আর নয়তো রেখে দিও।
মায়া হাতে পায়ে গলায় সুফিয়া খানের দেওয়া গোল্ড জড়ানো। রিদ-মায়ার মনোমালিন্যতার সময়ে সুফিয়া খান মায়াকে এসব কিনে দিয়েছিল। মায়া ভেবেছিল সবসময় পড়ে রাখবে কিন্তু আজ রিদের দেওয়া প্রথম উপহার গ্রহণ করতে মায়া সুফিয়া খানের দেওয়া সোনার বালা দুটো খুলে শূন্য হাত দুটো রিদের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
‘এগুলো আপনি পড়িয়ে দিন।
রিদ যত্ন সহকারে মায়ার দুহাতে দুটো ডায়মন্ডের চুড়ি পড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
‘বেড সাইডের ড্রয়ারে তোমার জন্য মেডিসিন রাখা আছে সেটা খেয়ে নিবে বুঝেছ?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে দিতে চোখ তুলে রিদের দিকে তাকিয়ে বলল…
‘আপনি দুপুরে খেতে আসবেন না?
‘না।
‘তাহলে কখন আসবেন?
‘ দিনে আসা হবে না তবে রাতে অবশ্যই আসব।
রিদের কথায় মায়া লজ্জা পেতে মুহূর্তে নত মস্তিস্কের হয়ে দাঁড়াল। রিদ মায়ার নাক টেনে কপালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যেতে মায়া সেদিকে তাকাল। রিদের বলে যাওয়ার পরও মায়াকে মেডিসিন খেতে দেখা গেল না। বরং অবহেলায় ফেলে রাখল সেগুলো। এর মাঝে জুইকে দেখা গেল মায়ার খোঁজে রিদের রুম অবধি পৌঁছাতে। মায়াকে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুই বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে বলল….
‘তোর আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই রিতু?
মায়া আয়নার সম্মুখে বসে রিদের দেওয়া জুয়েলারি বক্স খুলে রাখা বাকি গহনা গুলো তুলে রাখতে রাখতে মায়া বলল…
‘সপ্তাহ খানিক আগে ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মুরাদপুরে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু রাফার জন্য শেষ পর্যন্ত দেখা হয়নি।
‘ রাফার জন্য দেখা হয়নি মানে? রাফা কী করেছে?
মায়া সেদিনকার ঘটনা সম্পূর্ণটা বলল জুইকে। সবটা শুনে জুই খানিকটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল…
‘ রাফা কি এখনো নাদিম ভাইকে স্বামী হিসাবে মানে রিতু? কিন্তু এই বিয়ে তো হবে না। একজনের বিয়েতে অন্যজন কবুল বললে সেটা গ্রহণযোগ্য না।
মায়া আগের ন্যায় বলল….
‘রাফা জানে সেটা।
‘জেনে-বুঝেও নাদিম ভাইকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে কিভাবে? ওহ কি পাগল?
‘ ব্যাপারটা এখন রাফার মনজনিত। সামান্য কবুল বলাকে ঘিরে রাফার মনে নাদিম ভাইকে নিয়ে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে জুই।
মায়ার কথায় জুই তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানিয়ে বলল…
‘ কিন্তু রাফা কি আসিফ ভাইকে পছন্দ করতো না? আসিফ ভাইয়ের বিষয়টা কি হবে তাহলে?
‘ আসিফ ভাই পছন্দটা রাফার জন্য একতরফা ছিল জুই। রাফা চঞ্চলতায় আসিফ ভাইয়ের ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারেনি। আর নয়তো আসিফ ভাইয়ের ঘাটতি ছিল রাফাকে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে। যার জন্য রাফা আসিফ ভাইয়ের জায়গায় নাদিম ভাইকে স্বামী হিসাবে চাচ্ছে।
মায়ার কথায় জুই ফের আপত্তি জানিয়ে অসন্তুষ্টি গলায় বলল…
‘ আসিফ ভাই রাফাকে পছন্দ করে সেটা আমরা সবাই জানতাম। রাফা নিজেও জানে আসিফ ভাই ওকে পছন্দ করে সেখানে ঘটা করে আবার আসিফ ভাইয়ের মুখে বলার প্রয়োজন কি আছে বুঝলাম না আমি।
মায়া বেশ তীক্ষ্ণ গলায় জুইকে বুঝিয়ে বলল…
‘ প্রয়োজন আছে জুই। ভালোবাসি বললে ভালোবাসা তোমার হয়ে যায় না জুই। ভালোবাসার চেয়ে ভালোবাসা আগলে রাখাটা কঠিন। যত্নে মায়া বাড়ে। অযত্নে পচন ধরে কথাটা তো তুই শুনেছিস তাই না? মানুষের মন পরিবর্তনশীল। মনের খোঁজ না নিলে মন কিন্তু তার ঠিকানা ঠিকই খোঁজে নিবে অন্য কারও মাঝে। আসিফ ভাই রাফাকে ভালোবেসেছিল কিন্তু যত্ন করতে পারেনি বলে আজ রাফা মনের শূন্যস্থানে নাদিম ভাইকে বসাতে চাচ্ছে ওহ।
#চলিত…
#রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকা:রিক্তা_ইসলাম মায়া
৭২
থমথমে মুখে বসার ঘরে বসে আছেন নিহাল খান। তাঁকে ঘিরে আত্মীয়দের মেলা। হেনা খান, আরাফ খানসহ উনার দুই কন্যা ও তাদের জামাতা সকলেই উপস্থিত নিহাল খানকে ঘিরে ড্রয়িংরুমে। শশীর মাকে দেখা গেল ফাহাদের মায়ের সঙ্গে বসে থাকতে। তবে অসুস্থ নিহাল খান সুস্থতার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছেন নিজের স্ত্রী সুফিয়া খানের আক্রমণ দেখে। অতি শকটে তিনি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েও ছিলেন স্থির নয়নে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন তিনি বসার ঘরে সকলের ভিড়ে বসে আছেন, তখন হুট করে কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন থমথমে মুখে। বেশ কসরত করে খানিকটা নিজেকে সংযমনও করতে চাইলেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। সুফিয়া খানের আগমনে উনার মন-মস্তিষ্ক এতটাই নড়বড়ে হলো যে, নিজের ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য ভুলে বসলেন এক মুহূর্তের জন্য। না চাইতেও বারবার দৃষ্টি ঘুরল সুফিয়া খানের ওপর। স্তব্ধ, হতবাক, হতবুদ্ধি নিহাল খানের নড়বড়ে মনোভাব বসার ঘরের সকলের দৃষ্টিতে পড়লেও কেউ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করল না নিহাল খানের জন্য। বরং অদেখা করার মতোন বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল উপস্থিত সকলেই। এখানে কেউ ছোট না, আর না নিহাল খানও সুফিয়া খানের সঙ্গে হেয়ালি করার মতো সুযোগ আছে। দুজনই বেশ সম্মানিত মানুষ। তাঁদের সঙ্গে মজা বা চলচাতুরী করাও দৃষ্টিকটু ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিহাল খান বা সুফিয়া খান কখনোই কাউকে এতটুকু সুযোগ দেন না যে কেউ তাঁদের নিয়ে মজা বা হেয়ালি করে কথা বলবে। উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারছে দীর্ঘ পনেরো বছরের মনোমালিন্যের অবসান ঘটতে হয়তো তাদের আরও সময় লাগবে, কিন্তু তারপরও কেউ আগ বাড়িয়ে নিহাল খান আর সুফিয়া খানের মাঝে মিটমাট করিয়ে দিতে চাইল না। কারণ নিহাল খান কিংবা সুফিয়া খান তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়ে অন্য কারও হস্তক্ষেপ পছন্দ করেন না বলে সবাই যার যার মতো করে জায়গায় বসে রইল। তবে গম্ভীর সুফিয়া খানকে দেখা গেল ডাইনিংয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কাজের নির্দেশনা দিতে সার্ভেন্টদের। স্তব্ধ নিহাল খানের দৃষ্টি চতুর সুফিয়া খানের চোখেও পড়েছে। ব্যাপারটা তিনি বুঝেও অদেখার মতো করে আছেন। এর মাঝে দেখা গেল রিদকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে। রিদের পেছন পেছন রাদিফকেও দেখা গেল আসতে। রিদ বসার ঘরে আসতে শশী সেদিকে তাকাল। সকালে মায়াকে লক্ষ্য করেছিল শশী। বেশ কিছু আপত্তিকর পরিবর্তনও দেখেছে মায়ার মাঝে, যেটা শশীর জন্য কষ্টদায়ক হলেও একটা সুখী দাম্পত্যের জন্য বিষয়টা বেশ স্বাভাবিক। গুমরে উঠা শশীর চোখ ফের ভিজল নোনাজলে। ভেতরকার কষ্ট চাপতে মাথা নুইয়ে নত মস্তকে বসতে শশীর মা সেদিকে তাকালেন। শশীকে কাঁদতে দেখে তিনি অশান্ত হলেন। রাগে তিল মিলিয়ে উঠলেন রিদ-মায়ার ওপর। আজ মায়ার জায়গায় উনার মেয়ে থাকত রিদের জীবনে। শশীর জায়গাটা মায়া কেড়ে নিয়েছে, ব্যাপারটা মস্তিষ্কে আসতে ক্ষোভ প্রকাশ করলো শশীর মা সালমা। এই মুহূর্তে একমাত্র সুফিয়া খানই পারবে মায়ার জায়গায় পরিবর্তন করে শশীকে রিদের জীবনে রাখতে। শশী তো সুফিয়ারও মেয়ে। শশীর কষ্টে অবশ্যই সুফিয়ার মনও নরম হবে? শশীর মা সালমা সুফিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে উঠে দাঁড়াতে রিদ বসার ঘরে প্রবেশ করে। সুফিয়া খান রিদ ও রাদিফ দুই ভাইকে চলে যেতে দেখে ডেকে বললেন…
‘ রিদ, রাদিফ, এদিকে এসো, নাস্তা করবে।
রিদ স্বভাবতই গম্ভীর মুখে বসার ঘর ছাড়তে চেয়ে বলল…
‘ সময় নেই আম্মু। বাইরে করে নেব।
রিদের কথায় তৎক্ষণাৎ উত্তর আসল সুফিয়া খানের। তিনি বললেন…
‘পাঁচ মিনিটে কিছু হবে না। কাম!
রিদ চলে যেতে গিয়েও গেল না। বরং মায়ের কথা রাখতে ডাইনিংয়ে বসল। রাদিফ রিদকে ডাইনিংয়ে বসতে দেখে সে তাড়াহুড়ো করে বাইরে হাঁটতে চাইলে তক্ষুনি শোনা গেল সুফিয়া খানের শক্ত গলা। রিদের সম্মুখে প্লেট রাখতে রাখতে তিনি রাদিফকে শক্ত গলায় ডেকে বললেন…
‘তোমাকে কি আলাদাভাবে বলতে হবে রাদিফ? ডাকছি আমি, কথা কানে যাচ্ছে না তোমার?
ব্যস্ত রাদিফ থমথমে মুখে উত্তর দিতে দিতে বলল…
‘আম্মু, একটু আর্জেন্ট ছিল। আমি বাইরে নাস্ত…
রাদিফের প্লেট চেয়ারের সম্মুখে রাখতে রাখতে ফের শক্ত গলায় বলল সুফিয়া খান…
‘নেক্সট টাইম তোমাদের সব ব্যস্ততা বাড়ির বাইরে রেখে আসবে। খেতে আসো।
মায়ের শক্ত গলায় রাদিফ রিদের পাশাপাশি চেয়ারে বসে নাস্তা করতে লাগল। এর মাঝে সুফিয়া খান কিচেনে গেলে রাদিফ সুযোগ বুঝে রিদের দিকে হালকা ঝুঁকে বলল…
‘ভাই, তোমাকে একটা জরুরি কথা বলা ছিল।
রিদ স্বভাবতই গম্ভীর মুখে খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলল…
‘বল!
রাদিফ ফের সুফিয়া খানের গমন পথ লক্ষ্য করল। সুফিয়া খানকে কিচেনে দেখে চট করে রিদকে বলল…
‘ভাই, আমি আমার ডাক্তারি প্রফেশন চেঞ্জ করতে চাই। আমাদের পারিবারিক রাজনৈতিক দলে আব্বুর সাথে যোগ হতে চাই। তুমি এই বিষয়টা আম্মুকে বুঝিয়ে বলবে প্লিজ।
রিদ খাওয়া ছেড়ে কপাল কুঁচকে তাকাল রাদিফের দিকে। রাদিফকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে পুনরায় খাওয়ায় মনোযোগ দিতে দিতে বলল…
‘ রাজনৈতিক মাঠ তোর জন্য না রাদিফ। এসব নোংরামিতে পেরে উঠবি না তুই। নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস কর।
রিদের কথার যথাযথ অর্থ রাদিফ না বুঝে খানিকটা অধৈর্য নিয়ে রাদিফ রিদকে শুধিয়ে বলল…
‘ভাই, আমি অনেক ভেবেচিন্তে এই ডিসিশন নিয়েছি। আমি আব্বুর সাথে রাজনৈতিক মাঠে থাকতে চাই। আমি এই কয়েকদিনে রাজনৈতিক মাঠে থেকে যতটা শান্তি পেয়েছি, ততটা শান্তি আমি ডাক্তারি ক্যারিয়ারে পাইনি। আমি আর লন্ডনে ফিরব না ভাই। এখানেই থাকব আব্বুর পাশে। তুমি প্লিজ এই বিষয়টা আম্মুকে বুঝিয়ে বলবে। যেন আম্মু বাঁধা না দেয়।
রিদ রাদিফের কথায় মনোযোগ না হয়ে চামচের শেষ খাবারটা মুখে তুলতে তুলতে বলল…
‘ তোর পিছনে আম্মু তুই-ই বল।
‘ কী বলবে?
হাতের বাটিগুলো টেবিলের উপর রাখতে রাখতে সুফিয়া খান প্রশ্নটা করলেন রিদকে। রাদিফ ভয়ার্ত মুখে সুফিয়া খানের দিকে তাকাতেই রিদ পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে বলল…
‘রাদিফ প্রফেশন চেঞ্জ করতে চাই। ডাক্তারি ছেড়ে রাজনীতি মাঠে থাকতে চাই আব্বুর পাশে। বলতে পারো ভবিষ্যৎ মন্ত্রী হতে চাই। এতে তোমার সম্মতি চাচ্ছে। ব্যস এটুকুই।
রিদ কথাগুলো শেষ করে ডাইনিং ছাড়ল। ব্যস্ততায় কফির পান করার সময়টুকুও তার হলো না। রিদ চলে যেতে অসহায় রাদিফ ভয়ার্ত মুখে মায়ের দিকে তাকাতে শক্ত গলায় সুফিয়া খান বললেন…
‘নির্বাচনের পরপরই তুমি লন্ডনে ব্যাক করবে রাদিফ। বাংলাদেশে তোমার কোনো কাজ নেই।
স্বাভাবিকভাবেই মায়ের থেকে এসব কথা শুনতে হবে, সে বিষয়ে প্রস্তুত ছিল রাদিফ। তাই নিজের মনোবল বাড়িয়ে মায়ের কথার উত্তরে বলল সে…
‘আমি আর পড়াশোনার জন্য লন্ডনে ফিরব না আম্মু। আমি বাংলাদেশে থাকতে চাই। ডাক্তারি পেশায় আমার মন বসে না। তোমার জন্য এই পেশায় পড়াশোনা করেছি, কিন্তু এই পেশায় নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই না।
রাদিফের কথায় বেশ স্বাভাবিকভাবে সুফিয়া খান সম্মতি দিয়ে বললেন…
‘ওকে, সমস্যা নেই। তুমি ডাক্তারি পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে না চাইলে পারিবারিক ব্যবসায় জয়েন হও। আর নয়তো তোমার যে সেক্টরে মন বসে আমাকে জানাও, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তোমাকে। তারপরও রাজনীতি নয় রাদিফ। তুমি ছোট মানুষ রাজনৈতিক নোংরামি তুমি বুঝবে না।
রাদিফ খানিকটা জেদ করে বলল…
‘ রাজনীতি ছাড়া আমার অন্য কোথাও মন বসে না আম্মু। আমি রাজনীতি ক…
‘আমাকে কোনো কিছুতে বাধ্য করবে না রাদিফ। আমি তোমার মা হই, আমাকে টপকাতে যেও না। চুপচাপ লন্ডনে ফিরবে তুমি। তোমার টিকিট করে দিচ্ছি আমি।
মা-ছেলের কাটাকাটিতে বসার ঘরের সকলের দৃষ্টি কাড়ল। আরাফ খান, হেনা খান, নিহাল খানসহ একে একে সকলে ডাইনিংয়ে উপস্থিত হতে লাগলে রাদিফ জেদি গলায় বলল…
‘আমি বললাম তো কোথাও যাব না। কেন ফোর্স করছো তুমি? আমার ডাক্তারি পেশা ভালো লাগে না। আমি রাজনীতি করতে চাই আব্বুর সাথে।
রাদিফের কথায় তেতে উঠলেন সুফিয়া খান। বললেন…
‘রাজনীতি করবে? কী বুঝো তুমি রাজনীতি সম্পর্কে? কী অভিজ্ঞতা আছে তোমার এই নোংরা রাজনীতি সম্পর্কে? তুমি যে ওপর দিয়ে স্বচ্ছ আর পরিষ্কার রাজনৈতিক মাঠ দেখছো, সেটার পেছনে কতশত নোংরামি কাহিনি রয়েছে, সেই গল্প জানো তুমি? অবুঝের মতো বায়না করছো রাজনীতি করবে। খেলার পুতুল পেয়েছ? আজ খেলবে, মন না চাইলে কাল ফেলে দেবে এমন? তোমার বাবাকে দেখছ? একমাত্র এই নোংরা রাজনীতির জন্য আজও একটা খাপছাড়া জীবন লিড করছে সে। জিজ্ঞাসা করো তোমার বাবাকে, তাঁর জন্য আমাকে, রিদকে কতটা নোংরামিতে নামতে হয়েছিল। আজও সেই নোংরামি খেলা শেষ হয়নি সেখানে তুমি আবার নতুন করে যোগ হতে চাচ্ছ। তোমরা আসলে কি চাচ্ছ? তোমাদের জন্য আমরা স্বাভাবিক জীবন লিড করতে পারব না? আমাদের শান্তিতে থাকতে দিবে না তোমরা? তোমার বাবার অদক্ষতার জন্য রিদকে রাজনৈতিক মাঠে থাকতে হয় সবসময়। এখন আবার তুমি এই একই মাঠে থাকতে চাচ্ছো? তোমাদের মতো নরম মনের মানুষের জন্য এই রাজনৈতিক মাঠ না, এই কথাটা কবে বুঝবে তোমরা?
রাদিফকে নরম মনের মানুষ সেটা রাদিফ নিজেও জানে। সে সহজে মানুষের মায়ায় জড়িয়ে যায়, কিন্তু এটা কোনো খারাপ গুণ নয়, বরং ভালো গুণ। কিন্তু সুফিয়া খান রাদিফকে দুর্বল আর নরম মনের মানুষ বলায় সেটা খুব অপমানজনক মনে হলো রাদিফের। তাই রাদিফ খাবার ছেড়ে টিস্যু নিতে নিতে চওড়া গলায় বলল…
‘আমার কারও প্রয়োজন নেই। আমি একাই সামলাতে পারব নিজেকে।
রাদিফের কথায় ফের তেতে উঠলেন সুফিয়া খান। তিনি নিজেকে সামলে রাদিফকে বুঝাতে চেয়ে বলল…
‘রাদিফ, আমি তোমার মা। তোমার ভালোর জন্য বলছি। আমার সাথে জেদ করো না। ডাক্তারি পেশা ভালো না লাগলে পারিবারিক ব্যবসায় জয়েন হও। পারিবারিক ব্যবসায় ভালো না লাগলে নিজের কোনো ব্যবসা দাঁড় করাও। তারপরও রাজনীতি তোমার জন্য ঠিক হবে না। তুমি বাংলাদেশে এসেছ তিন মাস। এই তিন মাসে তোমার উপর এই নিয়ে চারবার হামলা হয়েছে। সবগুলোই রিদের অনুপস্থিতিতে হয়েছে। তারমানে রাজনৈতিক মাঠে সবাই জানে তুমি তোমার বাবার মতোন নরম মনের মানুষ। সেজন্য রিদের সাথে পেরে না উঠলে তোমাদের বারবার টার্গেট করে। সেজন্য বলছি আম্মুর কথা শোনো রাদিফ লন্ডনে ফিরে যাও। এখানে থেকে নিজের বিপদ বাড়িও না।
রাদিফ রাগ ছেড়ে মায়ের কথার মানে বোঝার চেষ্টা করে ডাইনিং ছেড়ে চলে যেতে যেতে বলল…
‘এত কিছু বুঝি না আম্মু। আমি লন্ডনে ফিরব না। পড়াশোনা করব না। আমি রাজনৈতিক মাঠে থাকব, দরকার হলে পারিবারিক কোম্পানি দেখাশোনা করব, তারপরও পাশাপাশি রাজনৈতিক মাঠে থাকব – এটাই শেষ।
রাদিফ চলে যেতেই চঞ্চলতা দেখা গেল উপস্থিত সবার মাঝে। একেক জন একেক রকমের বোঝাতে চাইলেন সুফিয়া খানকে শান্ত করতে। এর মাঝে নিশ্চুপ নিহাল খান নীরবতা ভেঙে বললেন…
‘রাদিফ বড় হয়েছে। ওকে ফোর্স করা ঠিক হবে না তোমার।
রাগান্বিত সুফিয়া খান এমনই রেগে ছিল। নিহাল খানের কথায় তেতে ওঠে বললেন…
‘অবশ্যই আমি ফোর্স করব আমার সন্তান কী করবে না করবে সে ব্যাপারে। সন্তান জন্ম দিয়েছি আমি। আমার রাইট আছে আমার সন্তানকে সঠিক পথ দেখানো। একটা নোংরা রাজনীতি কখনো আমার ছেলের জন্য সঠিক পথ হতে পারে না। রাদিফ আমার সন্তান। আমি বুঝি আমার সন্তান কেমন। আজ রাদিফের জায়গায় যদি রিদ এসে আমাকে জানাত সে রাজনৈতিক মাঠে থাকতে চায়, তাহলে আমার এই বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকত না। রাদিফ আমার ছোট ছেলে। রিদের থেকে রাদিফকে নিয়ে আমার বেশি টেনশন করতে হয়। সারাক্ষণ রাদিফকে আমার নজরে রাখতে হয় ওর নিরাপত্তার জন্য। আমার সেই ছেলে হঠাৎ এসে যদি বলে সে রাজনীতি করবে, তাহলে মা হিসেবে অবশ্যই আমার কর্তব্য আমার ছেলেকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়ার। রাজনৈতিক মাঠ আমার রাদিফের জন্য কখনোই উত্তম নয়।
নিহাল খানের কিছু বলার আগেই আরাফ খান পরিবেশটা শান্ত করতে সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে বললেন…
‘ এখন জোর করলে হয়তো রাদিফ বুঝবে না বউমা। কিছুদিন সময় নাও, তারপর না হয় রাদিফকে এসবের জন্য বোঝানো যাবে। তাছাড়া এই রাজনৈতিক মাঠে নিহাল আছে, রিদ আছে, তাহলে রাদিফ থাকলে সমস্যা কোথায়?
‘অবশ্যই সমস্যা আছে বাবা। আপনার ছেলে যেমন একজন অদক্ষ শাসক, রাদিফও তাই হবে। একজন লিডারকে হতে হয় শক্তপোক্ত সিংহের ন্যায়। প্রকৃত লিডার লিড করে নিজের যোগ্যতায়, সে কখনো অন্যের লাঠিতে ভর করে রাজনৈতিক মাঠ চড়াবে না। অথচ আপনার ছেলে আর রাদিফ দুজনই রিদের উপর নির্ভর করে রাজনীতি মাঠে থাকতে চায়। মা হিসেবে সেটা আমার মোটেও পছন্দ না। আমি চাই রিদ নিজের লাইফ লিড করুক। বাপ-ভাইয়ের জন্য অন্তত রাজনৈতিক মাঠ পড়ে না থাকুক।
সুফিয়া খানের কথার মাঝে শশীর মা সালমা বেগম ফোড়ন কেটে বললেন…
‘ভাই ভাইকে সাহায্য করলে সমস্যা কি আপা? বরং এই বিষয়তা ভালো। তুমি শুধু শুধু দুই ভাইয়ের মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টি করছো। রিদ চতুর বলে তুমি রাদিফকে নিজের কাছে বেঁধে রাখতে চাইছো, সেজন্য রাদিফকে জোর করে লন্ডনে পাঠাতে চাচ্ছো যেন তুমি…
সালমা বেগমের অযুক্তিক কথায় তেতে উঠলেন সুফিয়া খান। গর্জনের ন্যায় হাতে কাছের প্লেটগুলো ঠেলে ফ্লোরে ফেলে দিতে দিতে বললেন…
‘ছেলে জন্ম দিছি আমি, দরকার হলে ছেলের ভালোর জন্য শুধু বেঁধে না, বন্দী করেও রাখব। কিন্তু তুই বলার কে? তোকে মানা করছিলাম না আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা না বলতে? জবান বেশি চলে না?
রাগান্বিত সুফিয়া খান এমনই রেগে ছিলেন রাদিফের চিন্তায়। এর মাঝে শশীর মা সালমা বেগমের অহেতুক কথায় তেতে উঠলেন তিনি। সালমা বেগম পূর্ব থেকে ক্ষুব্ধ ছিলেন সুফিয়া খানের উপর, শশীর জায়গায় মায়াকে রিদের বউ করাতে। আজ তার রেশ টেনে খোঁচা মেরে তিনি পুনরায় বলে উঠলেন…
‘এখানে তোমার ব্যক্তিগত বলতে কিছু নেই আপা। আমি খান বাড়ির ছেলেদের সম্পর্কে কথা বলছি। তুমি দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে খান বাড়িতে ছিলে না। বলতে গেলে সম্পর্ক ছিন্ন করে রেখেছ সবার সাথে। মাত্র কাল এই বাড়িতে ফিরেছ, আর আমি এই বাড়িতে যাতায়াত করি সেই পঁচিশ বছর ধরে। এই বাড়ির সাথে তুমি বাদেও একটা সম্পর্ক আছে আমার। আরাফ আঙ্কেল, হেনা আন্টি আমাকে মেয়ের মতোন দেখেন, আমি তার দাবি নিয়ে এই খান বাড়ির ছেলেদের সম্পর্কে কথা বলছি, সেই রাইটস ওনারাই আমাকে দিয়েছে।
সালমার বেগমের কথায় রাগে রি রি করে সুফিয়া খান বললেন…
‘খান বাড়ির মানুষদের কে রাইটস দিয়েছে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলার? আমি তো তাদের সেই অধিকার দেইনি, তাহলে তারা তোকে কীভাবে দিল? আরেকটা কথা তোর যদি মনে হয় ওরা আমাকে টপকে তোকে গ্রহণ করবে, তাহলে নে, পুরো খান বাড়ির মানুষ তোর সম্মুখে দাঁড়িয়ে, প্রশ্ন কর, তাদের তোকে চায় কিনা। যদি চায়, তাহলে তুই-ই রাখ। আমি গেলাম।
থমথমে পরিবেশে সবাই নিস্তব্ধ নীরব। সামান্য একটা বিষয়কে ঘিরে দুই বোনের মাঝে তর্কাতর্কি হওয়ায় সকলে নিশ্চুপ হয়ে গেল। সুফিয়া খান এমনই খান বাড়িতে ফিরতে চাইতেন না। কত কসরত করে অবশেষে তাঁকে খান বাড়িতে ফেরানো গেল। এখন যদি সালমা বেগমের কথায় রেগে সুফিয়া খান আবারও খান বাড়ি ছেড়ে দেন, তাহলে সুফিয়া খানকে পুনরায় খান বাড়িতে ফেরানো মুশকিল হয়ে যাবে। তাছাড়া মা হিসেবে সুফিয়া খান নিজের সন্তানের ভালো মন্দ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন, কিন্তু এর মাঝে সালমা বেগমের উত্তর করাটা বাড়াবাড়ি লাগল সকলের। উপস্থিত সকলে জানে সুফিয়া খান কিংবা নিহাল খান তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কারও হস্তক্ষেপ পছন্দ করেন না। সেখানে সালমা বেগমের অহেতুক কথায় সুফিয়া খান রেগে চলে যেতেই নিহাল খান শান্ত কণ্ঠে সালমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন…
‘শোনো সালমা। তুমি আমার শালী হও। আমার বোনদের মতো তুমিও আমার আরেকটা বোন। আর তোমার বোন সুফিয়া আমার বউ। বলতে পারো সুফিয়ার জন্যই তোমাকে চেনা। এখন আমার সাথে তোমার বোনের সম্পর্ক যেমনই হোক, আমি কখনোই কাউকে এই অধিকার দেইনি আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেউ কথা বলবে। সুফিয়া আজ ফিরুক, কাল ফিরুক কিংবা জীবনে কখনো না ফিরুক, তারপরও এই খান বাড়ি সারাজীবন সুফিয়ার শ্বশুর বাড়ি হয়েই থাকবে। বাকি রইল রিদ আর রাদিফকে নিয়ে? তাহলে ওরা নিজেরাই কখনো মেনে নিবে না ওদের মাকে তৃতীয় পক্ষের কেউ অপমান করবে সেটা। সন্তানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সকল বাবা-মার থাকে, কিন্তু খালাদের থাকে না। আমি আশা করব তোমার দ্বারা একই ভুল যেন দ্বিতীয় বার না হয়।
‘দুলাভাই, আমি তো…
সালমা বেগমের কথা শেষ করার আগেই গম্ভীর নিহাল খান জায়গা ছাড়লেন। রাগান্বিত সুফিয়া খান চলে যেতে যেতেও নিহাল খানের কথাগুলো ওনার কানে এসেছে। বিষয়টাতে তিনি কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া না দেখালেও উপস্থিত সকলে একে একে জায়গা ছাড়ল। রাগান্বিত সালমা বেগম অপমানে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাশে থাকা শশী মায়ের দিকে এগিয়ে এসে দুহাতে সামলা বেগমের দুহাত মুঠোয় চেপে নরম গলায় বলল…
‘ আমি জানি তুমি আমার বিষয়টা নিয়ে খালামণির সাথে রাগে আছো আম্মু। সবকিছু ভুলে যাও আম্মু। চলো আমরা লন্ডনে ফিরে যাই। নতুন পরিবেশে দেখবে আমিও মুভঅন করে যাব। রিদ ভাইকে ভুলে যাব। চলো না আম্মু, আমরা ফিরে যাই। এই পরিবেশে আমার দম বন্ধ লাগছে।
~~
খান বাড়িতে হঠাৎ আগমন ঘটলো মায়ার পরিবারের। আরিফ রেহেনা বেগম আর ফিহাকে নিয়ে খান বাড়িতে উপস্থিত হলো প্রায় দুপুরের নাগাদ। মায়া তখন কিচেনে ছিল সুফিয়া খানের সঙ্গে। যদিও মায়া বা সুফিয়া খান কেউ হাতে হাতে কাজ করছে না তবে ক্ষণে ক্ষণে সার্ভেন্টদের কাজের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে দাঁড়িয়ে। সকালের শশীর মা সালমা বেগমের বাড়াবাড়ি ব্যাপারটা মায়া কানে এসেছিল ড্রয়িংরুমে নেমে, কাজের মেয়ে মালার বলেছিল সেটা। তারপর থেকে মায়া আর সুফিয়া খানের সঙ্গ ছাড়েনি বরং শাশুড়ীর আশেপাশেই থাকছে। জুইকে দেখা গেল ফাহাদের মার সঙ্গে বসে থাকতে। এরমাঝে হঠাৎ আরিফের আগমন মায়া জুই দুইজনই দৌড়ে যায় সেদিকে। সকলের সামনে মা-ভাইকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে দুজনই কান্নায় ভেঙে পড়ে। অসুস্থ রেহেনা বেগম মায়াকে বুকে জড়িয়ে অশ্রু জড়ালেন। আজ কতোটা মাস, কতোটা দিন পর তিনি নিজের আদরের মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। কতটা অশান্তি ঝড়-ঝাপটার সময়ে সুফিয়া খান মায়াকে নিয়ে রাতে আঁধারের বেরিয়ে গিয়েছিল উনার অসুস্থ মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে নিয়ে আর আজ সুস্থ সবল, চঞ্চল মেয়েকে উনার বুকে ফিরত দিল। সুফিয়া খান তিনি নিজের কথা রেখেছেন। রেহেনা বেগম মায়ার পাশাপাশি জুইকেও জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আরিফের সঙ্গে চট্টগ্রামে চলে আসার পর খবর পেয়েছিল জুই খান বাড়ির ডাক্তার ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। যদিও জুইয়ের বাবা এখনো রেগে আছেন তবে জুইকে হাসিখুশি খান বাড়িতে দেখে তিনি শান্তি পেলেন। জুইয়ের মা সঙ্গে জুইয়ের যোগাযোগ আছে। মা-মেয়ের কথা রোজ রেহেনা বেগমের কানে আসে। জুই স্বামী ঘরে ভালো আছে এতেই সন্তুষ্ট জুইয়ের মা। আরিফ, রেহেনা বেগম, ফিহা একে একে খান বাড়ির সকলের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করতে গম্ভীর সুফিয়া খান এগিয়ে আসল। আরিফ সুফিয়া খানকে দেখে সালাম দিতে তিনি সালামের উত্তর দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল…
‘ তোমাদের আসতে সমস্যা হয়নি তো?
‘ না আন্টি।
এই দ্বিতীয় বারের মতোন দেখা আরিফের সঙ্গে সুফিয়া খানের। প্রথমবার আরিফ সুফিয়া খানকে রিদের এক্সিডেন্টের সময় হসপিটালের দেখেছিল আর আজ খান বাড়িতে। বলতে হবে ব্যক্তি হিসাবে চমৎকার ব্যক্তিত্বের মানুষ সুফিয়া খান। আজ আরিফদের খান বাড়িতে দাওয়াত সুফিয়া খানই করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে আরিফ মায়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু রিদের বেড়াজালে জন্য করতে পারেনি। আরিফ চাইলে সরাসরি রিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতো মায়ার জন্য কিন্তু সে তা করেনি নিজের চক্ষু লজ্জায়। অতীতে ঘটে যাওয়া মানসেপটে অনেক স্মৃতি আজও আরিফকে লজ্জিত আর বিবৃত বোধ করে বলে সে চেয়েও কখনো মায়ার খোঁজ নিজের মাকে দিতে পারেনি। তবে আজ সব সম্পর্কে মনোমালিন্যতা কাটিয়ে উঠতে দেখে আরিফের বুকে প্রশান্তি ঢেউ বয়ে গেল। এবার রিদের সঙ্গে আরিফের কথা বলা প্রয়োজন। অনেক তো হলো ভুল বুঝাবুঝি এবার না-হয় আন্তরিকতায় বজায় রাখল দুজনের মাঝে। বোনের জামাতা বলে কথা মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে আরিফের। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার আরিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মায়ার উচ্ছ্বসিত মুখটার দিকে তাকাল। পরিবারকে পেয়ে কতটা খুশি মায়া। অথচ একটা সময় অযত্নে অবহেলায় মুচড়ে গিয়েছিল। বিষাদময় স্মৃতিগুলো আরিফ আর মনে করতে চাইল না। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখল সকলের মাঝে।
দীর্ঘ সময় নিয়ে মায়া জুই দুজনই সুন্দর মূহুর্ত পার করলো পরিবারের সাথে। সুফিয়া খান রেহেনা বেগমের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে বেশ কিছুক্ষণ কথা চালাল। এরমাঝে ফাহাদের মাকে দেখা গেল রেহেনা বেগমের সঙ্গে বসতে। মুক্তার সঙ্গে করা অযাচিত ঘটনা গুলোর জন্য ক্ষমা চাইলেন তিনি। এবং খুব করে আবদার করলেন মুক্তাকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে। ফাহাদ এই নিয়ে বেশ কয়েকবার আশুগঞ্জ গিয়েছিল মুক্তাকে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু প্রত্যেকবারই মুক্তা ফিরিয়ে দিয়েছে ফাহাদকে ‘আসবে না বলে। সেজন্য মা হয়ে তিনি বেশ অনুতপ্ত প্রকাশ করল আরিফ ও রেহেনা বেগম কাছে। ফাহাদের মায়ের কথায় আরিফ কিংবা রেহেনা বেগম তৎক্ষনাৎ মুক্তার শ্বশুর বাড়িতে পাঠাবে বলে কিছু বলল না। তবে সময় নিয়ে ফাহাদের মাকে আশ্বস্ত করলো ওরা মুক্তার সঙ্গে এই বিষয় কথা বলবে। দীর্ঘ সময় নিয়ে সকলের মাঝে কথা চলল। দুপুরে আয়োজনে মায়ার পরিবার খান বাড়িতে সকলের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলো। রাত নয়টার দিকে আরিফ ফিহাকে নিয়ে চলে গেলেও রেহেনা বেগমকে রেখে দিলেন সুফিয়া খান। দীর্ঘদিন পর মায়ার সঙ্গে রেহেনা বেগমের দেখা। সেজন্য সময়টা ক্ষনস্থায়ী না করে দীর্ঘক্ষণ করতে মূলত রেহেনা বেগমকে রেখে দিলেন তিনি নিহাল খানের নির্বাচনের পযন্ত। এতো মানুষ ভিড়ে রেহেনা বেগমও থেকে গেলেন খান বাড়িতে। বয়স্ক হেনা খান, আরাফ খানের পাশাপাশি রিদের ফুপিদের সঙ্গেও বেশ সখ্যতা দেখা গেল রেহেনা বেগমের। রেহেনা বেগম শুধু একা রিদের শশুর নয় তিনি রিদের পাশাপাশি ফাহাদ, আয়নেরও শাশুড়ী হয়। সেই সুবাদে রেহেনা বেগমের কদর খান বাড়িতে একটু বেশিই দেখা গেল। ব্যস্ততা চাপিয়ে রিদের আগমন ঘটলো রাত বারোটা পর। খান বাড়ির বসার ঘরের তখন তেমন কেউ নেই। সকলেই বসার ঘর ছেড়ে যার যার রুমের দিকে হাঁটছিল। রেহেনা বেগমকে আরও খানিকটা আগেই একটা ঘরে দেওয়া হয়েছে। জুই আপাতত রেহেনা বেগমের সঙ্গেই আছে। কিন্তু অশান্ত মায়া সুফিয়া খানের পিছন পিছন ঘুরঘুর করছে অস্থির ভঙ্গিতে। মূলত মায়ার ভিতরকার অস্থিরতার কারণ, মায়া চাই সুফিয়া খান আলাদা ঘরে না থেকে নিহাল খানের ঘরে থাকুক। কিন্তু এই কথাটা মায়া সুফিয়া খানকে বলার সাহস পাচ্ছে না। মায়া কেন এই একটা কথা খান বাড়ির কারও সাহসের কুলাবে না সুফিয়া খানকে বলার। মায়ার শাশুড়ী যে মানুষ এসব বিষয়ে অন্য কারও কথা বলা মোটেও পছন্দ করবেন না তিনি। চিন্তিত মায়ার চিন্তা কমিয়ে বাড়িতে হাজির হলো আয়ন, রাদিফ, নিহাল খান। যদিও রিদ ওদের সাথেই ফিরেছে তবে সে ফোন কলের জন্য বাইরে রয়েছে। ক্লান্তিতে সকলে যার যার রুমের দিকে হাঁটলো ফ্রেশ হতে। রাদিফের গুমরা মুখ দেখে মায়ার আগ বাড়িয়ে রাদিফের সঙ্গে এই বিষয় কথা বলতে চাইল না। আজ সকালেই রাদিফের সঙ্গে সুফিয়া খানের বাকবিতণ্ডা হয়েছে। সেই সুবাদে রাদিফ সুস্থ মনমানসিকতা নেই যে এই বিষয়ে কথা বলবে। তাছাড়া রাদিফ সুস্থ মনমানসিকতা থাকলেও কোনো সন্তানই নিজের বাবা-মা’র একত্রে থাকা বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাইবে না চক্ষু লজ্জায়। মায়ার নিজের লজ্জা লাগছে এই বিষয়ে চিন্তা করে তারপর মায়া চুপ থাকতে পারছে না। কারণ আজ সুফিয়া খানকে ফোনে কাউকে বলতে শুনেছে তিনি কাল ঢাকা ফিরে যাবেন রাতের মধ্যে। সেজন্য অশান্ত অস্থির মায়া চাচ্ছে আজ রাতটা যে করেই হোক নিহাল খান আর সুফিয়া খানকে বন্ধ ঘরের ভিতর রাখতে। এতে করে দীর্ঘ পনেরো বছরের মনোমালিন্যতা দূর করার জন্য হলেও একান্ত কিছুটা সময় পাবে তারা। আয়ন, রাদিফ কেউকে আর নিচে দেখা গেল না। সকলেই ফ্রেশ হয়ে যার যার রুমে। অথচ রিদ তখনো বাহিরে। এরমাঝে মায়া দুবার বের হয়েছিল রিদ খোঁজে। রিদকে দেখা গেল ছেলেপেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কিসব বলতে। হয়তো নির্বাচনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কিছু হবে বলে মায়া কিচেন এসে রিদের জন্য লেবু পানি করে রাখল ফ্রিজে। তারপর নিজেদের ঘরে ফিরে রিদের ফ্রেশ হওয়ার জন্য তোয়ালে কাপড় খোলে রাখল ওয়াশরুমে। পুনরায় নিচে নামতে ড্রয়িংরুমে দেখল নিহাল খানকে। তিনি রাতের ডিনারের জন্য ডাইনিংয়ের দিকে যাচ্ছিল। কিচেনে সুফিয়া খান আছে। হয়তো এখনো দুজনের দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। নিহাল খান এদিক সেদিক তাকিয়ে সুফিয়া খানের খোঁজ করা বিষয়টা মায়া সিঁড়ি উপর দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো। তাড়াহুড়ো মায়া দ্রুত হাঁটলো নিহাল খানকে আঁটকে। নিহাল খান ডাইনিংয়ে যাওয়ার আগেই মায়া পিছন ডেকে বলল…
‘ বাবা?
‘ হুম?
তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে দিতে নিহাল খান পিছু ফিরল।
মায়াকে অস্বস্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিহাল খান ফের বলল…
‘কি বলবেন?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েও কথা বলতে হাসফাস করতে লাগল। নিহাল খান মায়াকে হাসফাস করতে দেখে আন্দাজ করে বলল…
‘ নির্ভয়ে বলেন আম্মু। আমি শুনছি।
মায়া অস্বস্তিতে সিঁটিয়ে হাসফাস করে বলল…
‘ আম্মু কাল ঢাকায় ফিরে যেতে চাচ্ছে। আম্মুকে আমরা আপনার মিথ্যা অসুস্থতার কথা বলে চট্টগ্রামে এনেছিলাম। এখন আপনার সুস্থতা দেখে তিনি আবার ঢাকা ফিরে যেতে চাচ্ছে। আম্মু যদি একবার ঢাকা ফিরে যায় তাহলে উনাকে আর চট্টগ্রামে ফিরানো যাবে না সেটা আপনিও জানেন বাবা। আম্মু শক্ত ধাঁচের মানুষ হলেও উনি উনার পরিবারের প্রতি খুব যত্নশীল। আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে আম্মু চট্টগ্রামে ফিরলেও আমরা চাই আম্মু সারাজীবন এই বাড়িতে থাকুক। সেজন্য আপনার আম্মুর সাথে কথা বলা জরুরি বাবা। আম্মু চলে গেলে বিষয়টা অনেক দেরি হয়ে যাবে।
সুফিয়া খানের ফিরে যাওয়ার বিষয়টা শোনে বুকে মুচড়ে উঠলো নিহাল খানের। অসহনীয় দহনে বুকে ছটফট করতে গলার সুর নরম হয়ে আসল নিহাল খানের। দীর্ঘ পনেরো বছরের দূরত্বে ক্লান্ত হয়ে উঠেছেন নিহাল খান। এবার তিনি এই দূরত্ব গুছাতে চাই। তবে মায়ার সাথে নিজেদের পারসোনাল বিষয়ে কথা বলতে খানিকটা দ্বিধা বোধ করলেন তিনি। আবার মায়ার থেকে সাহায্য না নিলেও তিনি সুফিয়ার অবধি পৌঁছাতে পারবেন না। কারণ সুফিয়ার সঙ্গে একান্ত কথা বলার সুযোগটাই পাচ্ছেন না তিনি। আর না সুফিয়া উনাকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে। অসহায় নিহাল খান নরম সুরে মায়ার থেকে সাহায্য চেয়ে বলল…
‘ আপনার শাশুড়ীর সাথে আমাকে কথা বলার একটু সুযোগ করে দিতে পারবেন আম্মু?
নিহাল খান যেন মায়ার মনের কথাটায় বলল। মায়া তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে বলল…
‘আপনি রুমে যান বাবা। আমি আম্মুকে বলে দিচ্ছি আপনি অসুস্থ। বুকে ব্যথা করছে। বাকিটা আপনি সামলে নিবেন।
মায়ার মিথ্যা বলার কারণটা বুঝতে নিহাল খান আর ডাইনিংয়ের দিকে এগোল না। বরং নিরবতা পালন করে বসার ঘর ছেড়ে সিঁড়ি দিকে হাঁটতে মায়া ফের নিহাল খানের পিছন ডেকে বলল…
‘ আপনার হাতে আজ রাতটা সময় আছে আব্বু আম্মুকে কনভেন্স করার জন্য। সকাল হতে আম্মু চলে যেতে চাইলে আমরা কিন্তু ফিরাতে পারব না উনাকে।
নিহাল খান চলে যেতে যেতে মায়ার কথা গুলো শুনলো। মায়া ওর শাশুড়ীকে উনার বুক ব্যথার মিথ্যা কথা বলবে অথচ সত্যি সত্যি তীব্র বুক ব্যথায় পিরিতি হচ্ছে উনি। এই ব্যথাটা সহনীয় নয়। বরং তীব্র অসহনীয় ব্যথায় তিনি গোটা পনেরো বছর পার করেছেন। মায়া নিহাল খানের গমন পথের দিকে তাকিয়ে সামনের ফিরতে চাইলে রিদের বুকে সঙ্গে মায়ার মুখ ঠেকে গেল। রিদ মায়ার শরীর ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল তাই রিদের বুকে সঙ্গে মায়ার মুখ ঠেকে যেতেই মায়া মুখ তুলে উপরের তাকাতে রিদ দুই আঙুলের মায়ার কপালে ঠুকা দিতে দিতে মোহনীয় গলায় বলল…
‘ আই মিস ইউ।
রিদের মুখে ‘আই মিস ইউ’ শব্দটা কেমন অবিশ্বাস্য শোনাল মায়ার কানে। রিদ সচারাচর কখনোই মায়াকে এসব কথা বলে না। অথচ আজ রিদ সেচ্ছায় মায়ার কাছে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে সে মায়াকে মিস করেছে বলে। হতবাক মায়া অবিশ্বাস্যে ন্যায় রিদকে ফের শুধিয়ে বলল…
‘সত্যি আপনি আমাকে মিস করেছেন?
রিদ সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বলল…
‘হুমম।
মায়া ঠোঁট প্রসারিত করে হাসতে রিদ ঝুকে চট করে মায়ার সেই হাসোজ্জ্বল ঠোঁট শব্দ করে চুমু খেতে মায়া লজ্জায় দু’হাতে মুখ লুকাল। রিদ দুষ্টু হেসে মায়ার মুখের হাতটা টেনে ধরতে মায়া তৎক্ষনাৎ দৌড়ে পালাতে চাইল কিন্তু তার আগেই রিদ হাত বাড়িয়ে মায়ার কোমরের কাছের লম্বা চুলের বেনি টেনে ধরতে মায়া একহাত চুলে রেখে পিছনে ফিরতে ফিরতে বলল…
‘উফফ! কি?
‘ রুমে আসো।
‘পারব না।
রিদ মায়ার চুলের বেনি টেনে মায়াকে কাছে টানল। মায়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরতে ধরতে রিদ বলল….
‘ জামাই ডাকলে বউদের আসতে হয়।
মায়া রিদের শরীর ঘেঁষে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আশেপাশে তাকাল কেউ আছে কিনা দেখতে। চারপাশটা শূন্য দেখে মায়া রিদের দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ আপনি ঘরে যান। আমি আসছি। আপনার জন্য লেবু পানিটা নিয়ে আসি কেমন?
‘আসবে তো? নাকি আবার ডাকতে হবে?
‘ না আসব। আপনি যান।
‘ওকে।
রিদ মায়ার গাল টেনে মায়াকে ছেড়ে নিজের ঘরে গেল। মায়ার ফ্রিজ হতে রিদের জন্য লেবু পানিটা নিতে নিতে সুফিয়া খানের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল…
‘ আব্বু নাকি ভিষণ বুক ব্যথা করছে আম্মু।
আরাফ খানের জন্য সুপ তৈরি করছিলেন সুফিয়া খান। মায়ার কথায় হাত থেমে যায় উনার। মায়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চেয়ে বলল…
‘ তুমি জানলে কিভাবে?
মায়া স্বতঃস্ফুর্তার সাথে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে বলল…
‘ আমি গিয়েছিলাম আব্বুকে খাওয়ার জন্য নিচে ডাকতে তখন আব্বু বলল উনি নাকি অসুস্থ, বুকে চাপ পরেছে সেজন্য আবার ব্যথা করছে তাই খাবে না।
‘ সবাই বাড়ি ফিরেছে?
‘ জ্বি।
সুফিয়া খানকে আর কিছু বলতে শোনা গেল না। বরং সুপের দুটো বাটিতে ধোয়া উড়ানো গরম সুপটুকু ঠেলে একটা বাটি পাশে দাঁড়ানো মালার হাতে দিয়ে বলল আরাফ খানকে দিয়ে আসতে। মালা ট্রে-তে করে সুপের একটা বাটি নিয়ে বেরিয়ে যেতে সুফিয়া খান মায়ার উদ্দেশ্যে বলল…
‘রিদ-রাদিফ, আয়নের খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। ওরা আসলে সার্ভেন্ট দিয়ে গরম করে নিবে খাবার গুলো। রিদের জন্য খাবার আলাদা রাখা আছে ফ্রিজে। ওহ তৈলাক্ত খাবার পছন্দ করে না। ওকে সেইভাবেই করে দিবে কেমন?
‘জ্বি আচ্ছা।
মায়ার সম্মতিতে সুফিয়া খান আর দাঁড়াল না। আলাদা বাটিতে রাখা সুপটুকু নিয়ে হাঁটল উপরের দিকে। মায়া সুফিয়া খানের পিছন পিছন গেল না। বরং কিচেন হতে উঁকি মেরে তাকিয়ে রইল সুফিয়া খানের গরম পথের দিকে। মায়া মনে মনে বেশ করে দোয়া করল যেন সুফিয়া খান অবশিষ্ট বাটিতে তুলা সুপটুকু নিয়ে নিহাল খানের ঘরে যায়। হলো তাই সুফিয়া খান নিজের ঘরে না ঢুকে নিহাল খানের ঘরে ঢোকতে উৎফুল্লতা মায়া তৎক্ষনাৎ ‘ইয়েস’ বলে মৃদু চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো খুশিতে। মায়ার খুশিটুকু কেউ দেখার আগেই মায়া আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে নিলো। যাক অবশেষে মায়ার প্লানিং কাজ করেছে এটা ভেবে খুশিমনে রিদের জন্য লেবুপানি নিয়ে রুমে গেল মায়া। খালি ঘরে রিদকে আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে মায়া বুঝতে পারলো রিদ তখনো ওয়াশরুমে গোসলে আছে। মায়া হাতের লেবু পানির ট্রে-টি সোফার টেবিল উপর রেখে বিছানায় পা দুলিয়ে বসল। আজ সারাদিন ভর মায়া মাথায় ওড়না বেঁধে ছিল হিজাবের মতো করে। কিন্তু এখন একা ঘরে কাউকে না দেখে মায়া মাথার ওড়না খোলে কাঁধে দু’পাশে চড়িয়ে দিল গুন গুন শব্দে গান গাইতে গাইতে। মায়ার বসে থাকার মাঝে রিদ আরও খানিকটা সময় নিয়ে ওয়াশরুম হতে বের হতে মায়াকে দেখল মায়া বিছানায় বসে পা দুলাতে দুলাতে গুনগুন শব্দ করছে গান গাইতে গাইতে। রিদ হাতের তোয়ালে মাথা মুছতে মুছতে মায়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে টেবিলের উপর থেকে লেবু পানিটা পান করলো। খালি গ্লাসটা পুনরায় জায়গায় রেখে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াতে মায়া এক আপত্তিকর কথা বলে বলল….
‘ আপনাদের তো কোনো বোন নেই। এবার আমি আপনাদের একটা বোন চাই। আপনার বোনকে আমি কোলেপিঠে বড় করব। তারপর বিয়ে দিব। বড়ো ভাবির সব দায়িত্ব পালন করব আমি দেখবেন।
মায়ার আপত্তিকর কথায় রিদ আয়ন নিয়ে মায়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। মায়ার এমন আপত্তিকর হুটহাট কথার মানে বুঝতে না পেরে রিদ তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করে বলল….
‘ মা না হয়ে ভাবি হতে চাচ্ছো? হঠাৎ এতো উদারতার কারণ?
মায়ার মাঝে তখনো উৎফুল্লতা বহমান। মায়া গুনগুন শব্দের গান ছেড়ে বড়দের মতো করে বুঝদার হতে চেয়ে বলল…
‘আপনি বুঝবেন না ঐসব। ছেলে মানুষ। আমি আপনার একটা বোনের কথা ভাবছিলাম। এবার আম্মুর একটা মেয়ে হলে খান বাড়িটা পরিপূর্ণ হবে। আপনারা দুই ভাইয়ের এক বোন বিষয়টা কিন্তু চমৎকার দেখাবে তাইনা?
মায়ার এতক্ষণে মনোভাব বুঝতে রিদ বিরক্ত হলো। তার মা এই বয়সে এসে মা হবে? যাতা চিন্তা ভাবনা তার বউয়ের। রিদ মায়ার ভুল ধারণা ভেঙে বলল…
‘তোমার শাশুড়ীর বয়স কতো জানো?
মায়ার আগের নেয় স্বতঃস্ফুর্তার সঙ্গে জবাব দিয়ে বলল…
‘কতো আর হবে? সাইত্রিশ কিংবা আটত্রিশ হবে। আর নয়তো বড়জোর চল্লিশ, এর বেশি তো হবেই না। আর মেয়েদের চল্লিশের পরও মা হওয়ার চান্স থাকে। যদি কম চান্স থাকে। তবে আমি জানি আম্মু আবার মা হতে পারবে শিওর।
মায়ার অদ্ভুত কথাবার্তায় রিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। একটা মানুষ কতোটা নিবোর্ধ হলে শাশুড়ী মা হওয়া নিয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করতে পারে। যেখানে রিদের বয়স ত্রিশ+ সেখানে শাশুড়ী বয়স সাইত্রিশ, আটত্রিশ কিংবা চল্লিশ বছরের কিভাবে হয়? রিদের মা কি রিদের থেকে মাত্র দশ বছরের বড়ো? রিদ পিছন ঘুরে মায়ার দিকে তাকিয়ে কোমর ঠেকিয়ে বসল ড্রেসিংটেবিল উপর। মায়া ভুল ভেঙ্গে বলল…
‘আমার বয়স কতো জানো?
‘কত?
‘আমার বয়স ত্রিশ+ চলে।
মায়া না বুঝে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে বলল…
‘ওহ আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি আপানার বয়স দেখে বিয়ে করেনি। আপনি বুড়ো হয়েছেন তো কি হয়েছে। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই, আমার বুড়ো জামাই চলবে। চিন্তা করবেন না।
মায়ার রিদকে বুড়ো বলায় চেতে গেল রিদ। মায়াকে ধমকে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে রিদ বলল…
‘ স্টুপিড! আমি বুড়ো?
মায়া রিদকে পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চেয়ে বলল…
‘ কেন আপনি বুড়ো নয়?
‘ শেটআপ ইডিয়ট! আমার বয়স ত্রিশ+ হলে তোমার শাশুড়ী বয়স চল্লিশ হবে কিভাবে? আম্মুর বয়স পঞ্চাশ+ রানিং।
‘কিহ? অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি না। আম্মু এখনো কত যোয়ান আর সুন্দরী। আপনি মিথ্যা বলছেন।
রিদের কাছে সুফিয়া খানের বয়স কথা জানতে মায়া লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল অবিশ্বাসে। রিদ মায়াকে কাছে ডেকে শান্ত কন্ঠে বলল…
‘ কাছে আসো।
মায়া রিদের দিকে এগিয়ে যেতে রিদ একহাতে মায়ার কোমরে হাত চেপে অপর হাতটা মায়ার গলার দাগগুলোতে ছুঁইয়ে দিয়ে মোহাচ্ছন্ন গলায় বলল…
‘ ভাবি না হয়ে মা হওয়ার অফারটা কি চমৎকার হবে। কি বলো?
রিদের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মায়া লজ্জায় সিঁটিয়ে তৎক্ষনাৎ নত মস্তিষ্কের হলো। প্রসঙ্গ পাল্টে মিনমিন করে বলল…
‘ নিচে চলুন খাবেন।
‘ খাব না।
‘কেন?
‘বাহিরে ডিনার করে এসেছি সবাই, বাবা বাদে।
‘ওহ!
‘তুমি খেয়েছ?
‘হুম।
‘ তাহলে এবার বলো অফারটা পছন্দ হয়েছে?
রিদের কথায় মায়া লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে রিদের বুকে মুখ লুকাতে লুকাতে বলল…
‘হয়েছে।
মায়ার উত্তরে রিদ প্রস্তর হাসল। দু’হাতে মায়াকে জড়িয়ে রিদ ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে বলল…
‘ আপনি মা হতে চাইলে আমিও ইন্টারেস্টড বাবা হতে বউ
#চলিত….