রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব-৭৪ এবং শেষ পর্ব

0
2

#রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

অন্তিম পর্ব [প্রথম খন্ড ]
খান বাড়ির জুড়ে এখন উৎসবের আবহ। নিহাল খানের বিশাল জয়! ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই গোটা এলাকায় যেন আনন্দের ঢেউ লেগেছে। পাড়ায় পাড়ায় বাজছে বিজয়ের গান, চলছে মিষ্টিমুখ, আর সবার মুখে একটাই নাম—নিহাল খান। এই উৎসবের মাঝেই রিদের উপস্থিতি। গত দুদিন ধরে বাবার নির্বাচনের ব্যস্ততায় সে বাড়ি ফিরতে পারেনি, আর না মায়ার সঙ্গে কথা হয়েছে। এই জনাকীর্ণ কোলাহলে রিদের একটাই লক্ষ্য ছিল—সবকিছু যেন সুষ্ঠু হয়। হলোও তাই। রিদের দৃঢ়তার ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং বিশাল জয়ের মাধ্যমে নিহাল খান রাজনৈতিক ময়দানে নিজের অবস্থান আরও দৃঢ় করলেন। জয়ের উল্লাসের দিন শেষে ধরনীতে রাত নামতেই খান বাড়ির পুরুষদের একে একে ক্লান্তিতে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল। রাত তখন প্রায় মধ্যাহ্নে। রিদকে তখনও বাড়ি ফিরতে দেখা গেল না। খান বাড়ির উৎসবের কোলাহল তখনও পুরোপুরি থামেনি। নিহাল খানের বিপুল বিজয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই পরদিন তাঁর শপথ গ্রহণের বার্তা শোনা গেল। খুব স্বাভাবিকভাবেই শপথ পাঠের জন্য ওনাকে ঢাকা যেতে হবে। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও সুফিয়া খান ভাবাবেগহীন। ওনার রাজনৈতিক মহল পছন্দ নয়। সেই পনেরো বছর আগে নিহাল খান সুফিয়া খানকে ছেড়ে রাজনৈতিক জগৎকে বেছে নিয়েছিলেন বলেই তিনি আত্মসম্মান নিয়ে এক কাপড়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছিলেন। আজও নিহাল খান সেই পথেই হাঁটছেন। নিহাল খানের জয়ের উল্লাস সাক্ষী দেয় যে সুফিয়া খান আরও একবার নিহাল খানের রাজনীতির কাছে হেরে গেছেন।
যদিও নিহাল খান আজকাল প্রকাশ করছেন যে তিনি সুফিয়া খানকে সঙ্গী হিসেবে চাইছেন, তবুও সুফিয়া খানের গুরুত্ব নিহাল খানের জীবনে তাঁর রাজনীতির পরেই আসে। যেখানে সুফিয়া খান স্ত্রী হিসেবে স্বামীর প্রায়োরিটি লিস্টে প্রথম নন, সেখানে সুফিয়া খানের খান বাড়িতে নিহাল খানের জীবনে থাকাটা মূল্যহীন। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুফিয়া খান আজও নিহাল খানের জয়ের নীরব দর্শক হলেন। জয় শেষে তিনি এবার নিজের নীড়ে ফিরতে চাইলেন। পনেরো বছর আগে তিনি যেমন এক কাপড়ে এই খান বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন, আজও তিনি সেই একই নীরব বিদ্রোহ নিয়ে এই বাড়ি ছাড়তে প্রস্তুত হলেন।
কিন্তু বিপত্তি ঘটল মায়াকে নিয়ে। সকাল থেকে রাতভর মায়াকে সুফিয়া খানের পিছন পিছন ঘুরঘুর করতে দেখা যায় সার্বক্ষণিক। সে ইতিমধ্যে খান বাড়ির সদস্যদের মাঝে শাশুড়ির-নেওটা পুত্রবধূ হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। তবে শ্বশুরের জয়ের উল্লাসে বিমোহিত মায়া তখনও সুফিয়া খানের বাড়ি ত্যাগ করার মনোভাব ঠাহর করতে পারেনি। সুফিয়া খান যখন রাতের মধ্যভাগে খান বাড়ি ছাড়তে প্রস্তুত হলেন, তখনই মায়ার টনক নড়ল। মূহুর্তে হৈচৈ করে কেঁদেকেটে সুফিয়া খানকে জাপটে ধরতে একে একে সকলের মধ্যে সুফিয়া খানের বাড়ি ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল। উল্লাসে মেতে থাকা পরিবেশ মুহূর্তে বিষাদে পরিণত হলো। খান বাড়িভর্তি মানুষ সুফিয়া খানকে ঘিরে উঠে দাঁড়াল। সকলের একই বক্তব্য—সুফিয়া খানকে থেকে যাওয়ার জন্য আহাজারি করে। হেনা খান, আরাফ খান, মায়াসহ—সকলে পথ আটকে দাঁড়াতে শক্ত সুফিয়া খান বিরক্তির কপাল কুঁচকাল। মায়া তখনও ওনাকে জাপটে ধরে কাঁদছে, যেতে দেবে না বলে। এই ব্যাপারটায় তিনি বেশ অতিষ্ঠ। ওনার পিছু পিছু মায়া সার্বক্ষণিক ঘুরঘুর না করলে হয়তো এতক্ষণে তিনি নিশ্চুপ চলে যেতে পারতেন। মায়ার জন্য সকলের দৃষ্টিতে ভিড়ল। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, ওনার বয়োজ্যেষ্ঠ শ্বশুর-শাশুড়িও সুফিয়া খানের পথ আটকে দাঁড়িয়ে। বিরক্তির সুফিয়া খান নিজের আশেপাশে সকলের ভিড় দেখে মায়াকে খানিকটা ধমকের সুরে বললেন,

‘ মায়া, ছাড়ো। লেট হচ্ছে আমার।

সুফিয়া খানের শক্ত গলায় মায়া ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,

‘ প্লিজ আম্মু আমাদের ছেড়ে যাবেন না। আমরা সবাই আপনাকে ভিষণ ভালোবাসি। প্লিজ আমাদের সঙ্গে থেকে যান আম্মু।

মায়ার কথায় সুফিয়া খান উপস্থিত সকলের দিকে এক পলক দৃষ্টি বোলাল। সকলে কেমন অসহায় দৃষ্টিতে সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটায় তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করতে মায়াকে তিনি আগের নেয় শক্ত গলায় বলল…

” আমি বিরক্ত হচ্ছি মায়া। ছাড়ো।

সুফিয়া খানের কথায় মায়া হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমি ছাড়ব না আম্মু। আপনি বিরক্ত হলেও ছাড়ব না। আপনি হীনা গোটা খান বাড়ি শূন্য। প্লিজ আম্মু, আমাদের ছেড়ে যাবেন না।

মায়ার কথায় খান বাড়ির সকলে সম্মতি জানাল। অস্থির উত্তেজিত ভঙ্গিতে সুফিয়া খানকে বোঝাতে চাইল একেকজন। সকলের হৈচৈয়ে সুফিয়া খান যেমন বিরক্ত, তেমনই অস্বস্তি বোধ করলেন। এর মাঝে আরাফ খান পরিস্থিতি বুঝে হাতের লাঠিতে ভর করে এগিয়ে এসে সুফিয়া খানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বেশ গম্ভীর মুখে বললেন,

” তুমি কি সত্যি চলে যেতে চাও সুফিয়া?

আরাফ খানের কথায় সুফিয়া খান ঘাড় ঘুরিয়ে আরাফ খানের দিকে তাকালেন। সোজাসাপটা উত্তরে বললেন,

“জ্বি বাবা।

সুফিয়া খানের উত্তরে ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাফ খান সম্মতি দিতে দিতে বললেন,

“বেশ, তোমার কথাই রইল সুফিয়া। তোমাকে আর কেউ বাঁধা দেবে না এই নিয়ে। অনেক তো হলো, এসব আর কতদিন চলবে? তুমি বা নিহাল, তোমরা কেউ ছোট নও। তোমাদের ছেলেরা বড়ো হয়েছে, তাদের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছ, তারপরও তোমাদের মনোমালিন্য শেষ হলো না। আমরা বুড়ো মানুষ, আজ বাদে কাল মারা যাব। আমাদের চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে তাদের দাম এমনই থাকে না। তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর কাছেও আমাদের গুরুত্ব কখনোই ছিল না। তোমরা শুরু থেকে তাই করেছ যেটা তোমাদের মন চেয়েছে। দীর্ঘ পনেরো বছর তোমাদের দুজনের পিছনে ছুটতে ছুটতে আজ আমরা ক্লান্ত। শেষ বয়সে এসে এবার আমরাও শান্তিতে মরতে চাই। তুমি যেহেতু খান বাড়িতে থাকতে চাইছ না, তাহলে আমাদেরও তোমার সাথে নিয়ে যাও। গোটা পনেরো বছর তোমাকে ছাড়া নিহালের সঙ্গে কাটালাম, বাকি যে ক’দিন বাঁচব সেটা তোমার সঙ্গে কাটাব ভাগাভাগি করে। আমি আর তোমার শাশুড়ি, দুজনই আজ তোমার সাথে খান বাড়ি ছাড়ব এক কাপড়ে, চলো।

আরাফ খানের কথায় তৎক্ষণাৎ হেনা খান সম্মতি দিলেন সুফিয়া খানের সঙ্গে যাবেন বলে। এর মাঝে মায়াও সাহস পেয়ে হৈচৈ করে ভেজা চোখে বলল সেও যাবে,

মায়ার কথার মাঝে গোটা খান বাড়ির সদস্যরা হৈচৈ করে উঠল সুফিয়া খানের সঙ্গে যাবেন বলে। আরাফ খানের দুই কন্যা, তাদের ছেলে-মেয়ে সবাই একত্রে সম্মতি দিতে সুফিয়া খান সকলের দিকে তাকালেন। আজ ওনাকে আটকাতে পুরো খান বাড়ি দাঁড়িয়ে। সকলে খান বাড়ি ছাড়তে প্রস্তুত, অথচ সুফিয়া খানকে নয়। ঠিক যেভাবে নিহাল খান সুফিয়া খানকে পনেরো বছর আগে ছাড়তে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু রাজনীতি নয়। শক্ত সুফিয়া খান নিজের কথায় অটল থেকে আরাফ খানের উদ্দেশ্যে বলল…

“আপনারা আমার সাথে যেতে চাইলে যেতে পারেন। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই বাবা, কিন্তু তারপরও আমার পক্ষে খান বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়।

সুফিয়া খানের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। রিদের অনুরোধে তিনি নির্বাচন পর্যন্ত খান বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু এখন নির্বাচন শেষ, ওনার এখানে থাকার আর কোনো কারণ নেই। যে প্রেক্ষিতে তিনি চট্টগ্রামে ছুটে এসেছিলেন, সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল। মায়া আর রাদিফের সাজানো মিথ্যা নাটক তিনি আরও অনেক আগেই ধরে ফেলেছিলেন, তখনই তিনি চলে যেতেন কিন্তু রিদের অনুরোধে, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত রয়ে গেছেন। সুফিয়া খান যখন আরও কিছু বলবেন, তার আগেই শোনা গেল নিহাল খানের ক্লান্তিময় কণ্ঠ।

” ঠিক আছে সুফিয়া। তুমি থাকতে না চাইলে কোনো সমস্যা নেই। পুরো খান পরিবারের জায়গা যখন তোমার ঘরে হবে তখন আমার একা মানুষের জায়গাও তোমার বাড়িতে হবে। তুমি থাকতে না চাইলে আমরা সবাই তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকব, তারপরও তোমার সঙ্গেই থাকব।

নিহাল খানের হঠাৎ কথায় সকলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দরজার দিকে। যেখানে নিহাল খানের সঙ্গে আয়ন, রাদিফ দুজনই দাঁড়িয়ে, থমথমে মুখে নিহাল খানের দিকে চেয়ে । এই অসময়ে নিহাল খান এমন কথা বলবে, কারও ধারণাতে ছিল না। সকলেই হতবাক। কিন্তু তীক্ষ্ণ সুফিয়া খান কপাল কুঁচকে তাকাল নিহাল খানের দিকে। এর মাঝে নিহাল খান এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে দাঁড়ালেন, তিনিও সুফিয়া খানের সঙ্গে খান বাড়ি ছাড়বেন বলে।

পরিস্থিতি যখন বেশ থমথমে, তক্ষুনি খান বাড়িতে প্রবেশ করল রিদ। গম্ভীর রিদের বিগত দু’দিনের ছোটাছুটি আর মাথা ব্যথায় চোখ দুটো রক্তিম হয়ে আছে। এর মাঝে মা-বাবার সঙ্গে পারিবারিক কলহের বিষয়টি তাঁর কানে এসেছে। মূলত এজন্যই তাঁর এখন বাড়ি ফেরা। রিদ একপলক মায়ার দিকে তাকাল। সুফিয়া খানকে জড়িয়ে মায়া রিদের দিকে তাকিয়ে। রিদের তাকানোতে খুব স্বাভাবিকভাবেই চোখাচোখি হলো দুজনের। ক্লান্তিময় মুখ আর রক্তিম চোখে রিদকে বেশ অন্যরকম দেখাল। রিদের অসুস্থতা তাঁর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে। রিদ মায়ার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুফিয়া খানের দিকে তাকাতেই আবারও চোখাচোখি হলো মায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সঙ্গে। রিদের অসুস্থতার বিষয়টি চট করে সুফিয়া খান বুঝে গেলেন। রিদ শান্ত গলায় সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,

“শেষ একটা সুযোগ সবাই ডিজার্ভ করে আম্মু। সবসময় সব জায়গায় আত্মসম্মান বজায় রাখতে নেই। আপনজনদের কাছে আত্মসম্মান নয়, ভালোবাসা রাখতে হয়—এটা তোমার দেওয়া একটা শিক্ষা। আজ বাবার পাশে কেউ নেই, সবাই বাবাকে একা করে তোমার সম্মানে পুরো খান পরিবার দাঁড়িয়ে। আমার মনে হয় এবার তোমার তাদের শেষ একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।

পুরো খান পরিবার নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রিদের কথায় নীরব সম্মতি জানাল। সুফিয়া খান নিজেও নিশ্চুপ। রিদ কিছু বললে যে সুফিয়া খান শুনবেন, সেটা সবাই জানে। সেজন্য সকলে চুপ থেকে রিদকে বলার সুযোগ দিল। রিদ পুনরায় একই ভাবে বলল,

” আমার জীবনে দেখা উত্তম নারী তুমি। তোমার হাত ধরে অনেক কিছু শিখেছি। একটা পরিবার, সংসার কিভাবে সামলাতে হয়, সেটা তোমার থেকে ভালো এখানে কেউ জানবে না। এসব পারিবারিক কলহ আর ভালো লাগছে না আম্মু। তোমাদের বিচ্ছেদের ভাঙন আমরা দুই ভাই গোটা পনেরো বছর পাড় করেছি। এবার না-হয় শেষটা সুন্দর হোক। নিজের জন্য না-হয় আমাদের জন্য থেকে যাও। দ্বিতীয়বার তোমার অযত্ন কেউ করবে না। ভরসা রাখো।

রিদের কথায় সুফিয়া খানের মাঝে নমনীয়তা দেখা গেল। রিদ কখনো এমন নরম সুরে ওনার কাছে কোনো কিছু নিয়ে আবদার করেনি। বাবা-মার বিচ্ছেদ নিয়েও কখনো কথা বলেনি। এই প্রথম রিদ কিছু বলল বাবা-মার বিচ্ছেদ নিয়ে। সুফিয়া খান কি নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে ওনার সন্তানদের কষ্ট দিয়েছিলেন এতকাল? এজন্যই রাদিফ বারবার আবদার করত বাবা-মার কাছে একত্রে হয়ে যাওয়ার? সুফিয়া খান নিজের ব্যক্তিগত জীবন আলোচনা করতে না চেয়ে সরাসরি রিদের অসুস্থতা সম্পর্কে জানতে চেয়ে বলল,

“তুমি কি অসুস্থ রিদ?

রিদ বুঝতে পারল সুফিয়া খান রিদের কথা মেনে তিনি খান বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। তাই রিদও মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে অল্প উত্তরে বলল,

” হুম একটু!

সুফিয়া খানের কঠিন মুখটা অবশেষে নরম হলো। এতক্ষণ যে সুফিয়া খান ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অনমনীয়, সেই নারী যেন নিমেষেই বদলে গেলেন। রিদের কপালের শিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, চোখের কোণে ক্লান্তি আর লালচে আভা। একজন মা সবসময় সন্তানের মন পড়তে পারে। তাই তিনি মায়ার উদ্দেশ্যে বললেন,

“রিদকে নিয়ে রুমে যাও মায়া।

মায়া ততক্ষণে সুফিয়া খানকে ছেড়ে পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল। রিদের অসুস্থতা মায়ার চোখেও পড়েছে। মায়া ব্যাপারটা নরমাল মনে করলেও রিদের অসুস্থতার বিষয়টি ছিল জটিল। রিদের মাথায় পরপর দুটো সার্জারি হয়েছিল অ্যাক্সিডেন্টের ফলে। তার নিয়মিত মেডিসিন চলে। চেকআপের জন্য লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রিদ সেই যে জেদ করে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরেছিল, তারপর আর লন্ডনের মাটিতে পা পড়েনি। বিগত কয়েক দিনের ব্যস্ততায় রিদের মেডিসিন নেওয়া হলো না। এতে করে রিদের ব্রেইনে চাপ অনুভব হতেই রিদ ক্রমাগত অসুস্থ অনুভব করছে। রিদ আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রুমের দিকে হাঁটতে মায়াও পিছন পিছন গেল।

ঘরে ফিরে রিদ সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল। অল্প সময় নিয়ে গোসল করে বের হতে মায়াকে দেখল বিছানায় বসে রিদের দিকে তাকিয়ে। রিদ তখনও কোনো কথা বলল না। মাথার শিরা ধপধপ করছে ব্যথায়। মায়ার নামিয়ে রাখা কাপড়গুলো রিদ গায়ে না জড়িয়ে পুনরায় ফরমাল প্যান্ট-শার্ট নামাল কবাট হতে। রিদকে পরিপাটি হয়ে রেডি হতে দেখে মায়া ভাবল রিদ আবারও বের হয়ে যাবে এই রাতে। রিদ আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজের মেডিসিন বক্স খুলে কয়েকটি ঔষধ মুখে পুরে অল্প পানি পান করতে মায়া উঠে এসে রিদের পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে জানতে চেয়ে বলল,

“আপনি কি অসুস্থ? এ-তো গুলো কিসের ঔষধ খেলেন?

রিদ মায়ার কথায় উত্তর না দিয়ে পুনরায় কবাট খুলল। ড্রয়ার হতে রিদের পাসপোর্টের সঙ্গে মায়ার পাসপোর্টও বের করতে মায়া রিদের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে বলল, “এই পাসপোর্ট দিয়ে কি করবেন? আপনি কই যাবেন?

মায়ার জানা ছিল না রিদের কাছে ওর পাসপোর্ট রয়েছে। রিদকে কথা বলতে না দেখে মায়া পুনরায় বলল,

“আপনি কথা বলছেন না কেন? কই যাবেন, বলুন না। আপনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন?

রিদ হাতে দুটো পাসপোর্ট নিয়ে কবাট লাগাল। রিদের ফোনের সাথে মায়ার ফোনটি হাতে নিয়ে অপর হাতে মায়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরতে ধরতে বলল,

“চলো।

কথাটা বলে রিদ মায়ার হাত টেনে বাইরের দিকে হাঁটতে মায়া আঁতকে উঠে বলল,

“চলো মানে? কই যাব আমরা?

নিশ্চুপ রিদ অল্প উত্তরে বলল,

“লন্ডনে।

রিদের কথায় মায়ার মাথা ঘুরে ওঠার মতো অবস্থা। মায়া মোটেও এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয় দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার মতো। মূলত মায়া শ্বশুর-শাশুড়ি সবেমাত্র একত্রে হয়েছে। ওদের কাছাকাছি এক ঘরে আনার দায়িত্ব মায়ার। মায়া সেই দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত ওহ কোথাও যাবে না। দ্বিতীয়ত, খান বাড়ি ভর্তি মেহমান। মায়ার মা, জুই সকলেই আছে খান বাড়িতে। এতসব মানুষের ভিড়ে মায়ার বেশ আনন্দে দিন কাটে। শ্বশুরের বিজয়ের উল্লাস এখনও শেষ হয়নি, তাই মায়া চায় না এতসব আনন্দের মুহূর্ত ছেড়ে রিদের সঙ্গে একা একা বিদেশ গিয়ে থাকতে। মায়া রিদের সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার হলে আরও কয়েকটা দিন পর যাবে প্রস্তুতি নিয়ে। বিনা প্রস্তুতিতে হুট করে এলোমেলো পোশাকে মায়া কখনোই বিদেশ যেতে চায় না। সেজন্য মায়া রিদের থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চেয়ে খানিকটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল,

“আমি কোনো লন্ডন-টন্ডনে যাব না নেতা সাহেব। আপনার যাওয়ার হলে আপনি যান। আমি সবার সাথে এখানেই থাকব।, কেমন?

মায়ার কথায় রাগে রিদের চোয়াল শক্ত হতে দেখা গেল, তারপরও রিদ মায়াকে কিছু বলল না। বরং শক্ত হাতে মায়ার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগল নিজের সাথে। মায়া যত বাঁধা দিচ্ছে, রিদ ততই টানছে মায়াকে। রিদের শক্তিতে না পেরে মায়া চিৎকার করতে লাগল রিদের সঙ্গে যাবে না বলে। মায়ার চিৎকারে পুনরায় বসার ঘরের সকলে ভিড় জমাল। রিদের কাছে জানতে চাইল কি হয়েছে। বিরক্তির রিদ মায়ার উপর রেগেমেগে মায়াকে কাঁধে তুলে নিতেই আরাফ খান রিদকে বাঁধা দিতে চাইল মায়াকে নিয়ে যেতে। তক্ষুনি রাদিফ পাশ থেকে আরাফ খানকে আটকে বলল,

“বাঁধা দিও না দাদাভাই। ভাই-ভাবির আজ ফ্লাইট আছে। ওরা লন্ডনে যাবে। ভাবি যেতে চাচ্ছে না বলে ভাই জোর করে নিয়ে যাচ্ছে।

রিদের ফ্লাইটের বিষয়টি কানে যেতেই বিস্ময়কর হলো আরাফ খান। বলল..

” রিদের ফ্লাইট মানে? কবে ঠিক করল ওরা লন্ডনে যাবে?

“অনেক আগেই টিকিট করা ছিল আজকের তারিখের।

“ওরা ফিরবে কবে?
“সঠিক বলতে পারছি না।
“আসিফ যাবে ওদের সাথে?
“না।

আরাফ খান বুঝলেন রিদ এবার লম্বা ছুটিতে দেশ ছাড়ছে। তিনি লাঠিতে ভর করে খান বাড়ির বাইরে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল, বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা হেলিকপ্টারে রিদ একপ্রকার মায়াকে ছুঁড়ে ভিতরে ফেলতে ফেলতে সে উঠে বসল। রিদ হেলিকপ্টারে উঠে বসতেই একজন দেহরক্ষী দ্রুত এগিয়ে এসে দরজা লাগাল। আসিফ বাইরে দাঁড়িয়ে। সে রিদের সঙ্গে যাবে না। বরং সে কাল ঢাকায় ফিরে যাবে রিদের কোম্পানির কাজে। দেশের বাইরে থেকেও রিদ আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এমনটাই নিধারিত।

রিদ মায়াকে নিয়ে হেলিকপ্টারে বসতেই হেলিকপ্টারের পাখা গোল গোল ঘুরিয়ে আকাশে উড়ে যেতেই মায়া আতঙ্কে রিদকে দু’হাতে জাপটে ধরল। রিদ মায়াকে না ছুঁয়ে শক্ত হয়ে বসল। তাদের শেষ রাতের দিকে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট আজ। এখন রাত বারোটা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পৌঁছাতে হেলিকপ্টারে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। এর মাঝে রিদের মাথা ব্যথাটা খানিকটা কমে আসলে আরাম পেতো বলে মনে করলো রিদ। রিদ যথাসম্ভব কথা না বলে রিদের মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু মায়ার ফ্যাচফ্যাচ কান্নায় তার মাথা ব্যথা বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। রিদ মায়াকে শক্ত গলায় ধমক লাগাতে গিয়েও লাগাল না। বরং মায়ার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল,

“দুনিয়ার সব বোঝো, শুধু আমাকে ছাড়া। সবাই তোমার প্রায়োরিটি লিস্টে পরে, শুধু আমি ছাড়া। জীবিত মানুষের মূল্যায়ন তোমার কাছে নেই। আমি মরে গেলে মূল্যায়ন করবে তো রিত?

রিদের কথায় মায়ার তৎক্ষণাৎ কান্না থেমে যায়। ভেজা দুই চোখের মনি দুটো স্থির হয়ে যায় রিদের মুখের ওপর। মায়ার নীরবতা বুঝে রিদ চোখের ওপর হাত ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ল সিটে। মায়া তখনও স্থির দৃষ্টিতে রিদের দিকে তাকিয়ে। পুরোটা সময় মায়া আর কোনো কথা বলল না। শুধু নিশ্চল দুই চোখ ঘুরে ঘুরে রিদের দিকে তাকাতে লাগল। রিদ বুঝেও না বোঝার মতো করে রইল।
ঢাকা পৌঁছাতে রিদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্টকে দেখা গেল মধ্যরাতে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকতে রিদের অপেক্ষায়। রিদ মায়াকে নিয়ে প্রথমে নিজের বাড়িতে গেল। সেখান হতে অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি টানল সোজা এয়ারপোর্টে। সময় থাকতে শেষ রাতের আগেই মায়াকে নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে রিদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট এগিয়ে আসল। রিদ এক হাতে মায়ার হাত চেপে অপর হাতে দুটো পাসপোর্ট নিয়ে হাঁটল কাউন্টারের দিকে। প্রয়োজনীয় সকল তথ্য শেষে মায়াকে নিয়ে প্ল্যানে উঠে বসতেই প্ল্যানটি সময় নিয়ে আকাশে উড়াল দিল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে।
প্ল্যান জার্নির পুরো রাস্তায় মায়া রিদের সঙ্গে টুঁ-শব্দটিও করল না। কেমন চুপচাপ বসে রইল বাড়ির কাপড়ে। মায়ার গায়ের এই শাড়িটা আজ মায়ার শাশুড়ি দিয়েছিল বাড়িতে নির্বাচনের উল্লাস ও লোকজনের আনাগোনা থাকবে বলে। সেই শাড়ি পরেই রিদের সঙ্গে এক দেশ হতে অন্য দেশে পাড়ি জমাল মায়া। রিদ মায়াকে শাড়িটা পরিবর্তন করার সময়টুকুও দিল না। অথচ রিদ নিজে গোসল করে নতুন কাপড় পরে বাবু হয়ে বসে আছে।

বাংলাদেশে গরম, অথচ লন্ডনের মাটিতে উষ্ণ ঠান্ডা। এখন সময় দশটা। বাংলাদেশ সময় হয়তো বিকাল তিনটার নাগাদ হবে। মায়া লন্ডনে এসেছে পর থেকে বাংলাদেশের কারও সাথে কথা হয়নি। হয়তো রিদের হয়েছে, তবে রিদ মায়াকে কিছু বলেনি এই বিষয়ে। মায়ারা আজ সকাল সাতটার নাগাদ লন্ডনে এসে পৌঁছায়। এয়ারপোর্ট থেকে রিদের লোক এসে মায়াদের রিসিভ করে, তারপর ওরা একটি হাসপাতালে যায়। মায়া হাসপাতালটির নাম জানে না। তবে সেখানে রিদকে চিকিৎসা নিতে দেখে মায়া বুঝতে পারে, এর আগে রিদের অ্যাক্সিডেন্টের সময় রিদকে হয়তো এই হাসপাতালেই রাখা হয়েছিল, তাই আজ মায়ারা লন্ডনে ফেরার পরপরই রিদ মায়াকে নিয়ে সোজা এই হাসপাতালে চলে এসেছে চেকআপের জন্য।
রাতের ব্যাপারটায় মায়া রিদের ওপর অভিমান করে বসে নেই, বরং মায়া রিদের কথায় কষ্ট পেয়েছিল বলে সে নিশ্চুপ। মায়ার জীবনে স্বামী হিসেবে রিদের গুরুত্ব অনেক। রিদের আগে মায়ার জীবনে কখনো কাউকেই প্রথম প্রায়োরিটিতে রাখেনি। মায়ার প্রথম প্রায়োরিটি মায়ার স্বামী। রিদের অসুস্থতার বিষয়টি মায়া জানত না, জানলে হয়তো মায়া কখনোই রিদকে বাঁধা দিত না। এখন মায়ার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে তখন রিদকে বাঁধা দিয়ে। মায়ার স্বামী নিশ্চয়ই মনে করছে মায়া ওর স্বামীর মন বোঝে না। সত্যি কি তাই? মায়ার তীব্র অপরাধ বোধে কান্না পেল। কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আসতে মায়া নিজের পাশে কারও উপস্থিতি টের পেল। মায়া ঘাড় বেঁকে তাকাতেই দেখল রিদ সবে গোসল করে কোমরে তোয়ালে বেঁধে খালি গায়ে দাঁড়িয়েছে। ভেজা চুল আর স্নিগ্ধ মুখে রিদকে দারুণ দেখাল। মায়া রিদের মুখে দিকে তাকিয়ে থাকতে রিদ কপাল কুঁচকে মায়াকে পরখ করলো। রিদ মায়াকে সেই ঘণ্টাখানেক আগে বলেছিল গোসল করে ফ্রেশ হতে, অথচ মায়া গোসল না করে রুমের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পথে চেয়ে আছে। কি এত ভাবছে কে জানে? তবে রিদের ধারণা, সে মায়াকে জোর করে নিজের সঙ্গে নিয়ে আসায় হয়তো মায়া এখনও অভিমান করে বসে। আর এই ব্যাপারটায় রিদ চট করে বিরক্ত বোধ করল। মায়ার দিকে বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ কি সমস্যা? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ফ্রেশ হবে না?

রিদকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দেখে মায়া ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিল। রিদের ভেজা শরীরে দু’হাতে জাপটে জড়িয়ে রিদের বুকে কপাল ঠেকাতে ঠেকাতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

‘ আমার একটাই আপনি ছিলেন নেতা সাহেব। আপনাকে ভালোবাসার স্বাদ এই জন্মেও শেষ হবে না।

রিদ বুঝতে পারল মায়া রিদের রাতে বলা কথাগুলো মনে পুষে কষ্ট পাচ্ছে। রিদ মায়াকে দু’হাতে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল, “তাই?
“হুম।”

#রিদ_মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

অন্তিম পর্ব [ শেষ খন্ড ]
পড়ন্ত বিকেল। রক্তিম সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। তার শেষ আলোয় রাঙা পৃথিবী। এমন এক সোনালি বিকেলে জুইয়ের মন ভালো নেই, যদিও খান বাড়ি আজও গমগম করছে অতিথিদের পদচারণায়। আজ মায়া লন্ডনে যাওয়ার তৃতীয় দিন, আর তার অনুপস্থিতিতে জুই অনুভব করছে এক গভীর শূন্যতা। উপরন্তু, নিহাল খানের নির্বাচন নিয়ে আয়নের তুমুল ব্যস্ততা জুইয়ের একাকীত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মায়ার মা রেহেনা বেগমকে কাল আরিফ এসে নিয়ে গেছে। শোনা গিয়েছিল আরিফের বাবা শফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিনের মনোমালিন্যতা ভুলে চট্টগ্রাম এসেছিলেন ফাহাদের সঙ্গে, রেহেনা বেগম ও ওনার নতুন পুত্রবধূ ফিহাকে সঙ্গে নিয়ে আশুগঞ্জ ফিরতে। ফাহাদ গতকাল শশুর বাড়িতে গিয়েছিল বউকে ফিরাতে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ক্ষমা চেয়ে অবশেষে মুক্তাকে নিয়ে খান বাড়িতে ফিরেছে সেও। মুক্তার অবশ্য মায়ার সঙ্গে দেখা হয়নি, তার আগেই রিদ-মায়া পাড়ি জমায় লন্ডনে তবে খান বাড়িতে ফিরে জুইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বর্তমানে মুক্তা জুইয়ের সঙ্গেই আছে খান বাড়িতে। দীর্ঘ মনোমালিন্যের অবসান ঘটিয়ে আরিফ, তার বাবা শফিকুল ইসলামকে ক্ষমা করে সপরিবারে ফিরে যায় নিজ বাড়িতে। শরিকুল ইসলাম চেয়েছিলেন এ সুযোগে রিদের সঙ্গে দেখা করে অতীতের ভুল বোঝাবুঝির জন্য অনুতপ্ত স্বীকার করবেন এবং রিদকে জামাতা হিসেবে বরণ করে নেবেন। কিন্তু রিদ ও মায়ার হঠাৎ লন্ডনে চলে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। তবুও শরিকুল ইসলাম আরিফের সঙ্গে মায়ার শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলেন একফাঁকে কাল। আরাফ খান, হেনা খান, নিহাল খান এমনকি সুফিয়া খানের কাছেও তিনি গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করেন। অনুতপ্ত হলেন। খান বাড়ির কেউই অতীতের তিক্ততাকে মনে ধরে রাখলেন না, বরং সাদরে গ্রহণ করলেন শরিকুল ইসলামকে। দুই পরিবারের পারস্পারিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার এই খবর মায়ার কানেও পৌঁছেছে। সরাসরি দেখা না হলেও ফোনে সে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথাও বলেছে। রিদ যদিও এ বিষয়ে নীরব ছিল, তবে মায়ার উচ্ছ্বাস সে কেবল নীরব চোখে দেখল। সে সহজে কিছু ভুলে যেতে পারে না; আর না কাউকে চট করে গ্রহণ করতে পারে। তার কাউকে ক্ষমা করতে সময় লাগে। যদি সে মায়ার পরিবারকে ক্ষমা করতে না পারে তারপরও সে বউয়ের জন্য মায়ার পরিবারের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখবে। মায়ার সাথে জুইয়ের আজ বেশ ফোনালাপ হয়েছে তিনটে নাগাদ। এখন পড়ন্ত বিকেল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, ঘড়িতে তখন পাঁচটা। পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে গেছে। জুই আয়নের ঘরের বারান্দায় রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে। খান বাড়ির কোলাহলেও ওর মন ভারাক্রান্ত। মায়ার অনুপস্থিতি আর আয়নের ব্যস্ততা আজ জুইকে একাকী করে তুলেছে। জুইয়ের শূন্যতার মাঝে হঠাৎ কোমরে এক উষ্ণ স্পর্শ পেতেই জুই চমকে উঠল। পিছন থেকে আয়ন জুইয়ের খালি কাঁধে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

” আপনার মন খারাপ জুই?

আয়নের উপস্থিততে জুইয়ের ভয়ার্ত মন শান্ত হলো।
অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জুই আয়নের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ না।

আয়ন জুইকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জুইয়ের চোখে চোখ রাখল। জুইয়ের গালে আসা এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,

‘ আপনার শশুর বাড়িতে যাবেন জুই? আমার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে লন্ডনে যাবেন?

আয়নের কথায় জুই বিস্মিত হলো। হতবাক গলায় বলল, ‘ লন্ডনে?

আয়ন জুইয়ের হতবাক মুখটার দিকে তাকিয়ে জুইয়ের গালে হাত রেখে খুব স্বাভাবিক নেয় আয়ন বলল…

‘ আম্মু বেশ কয়েকদিন ধরে ওনার ছেলের বউকে দেখার আবদার জানাচ্ছিল। ব্যস্ততার কারণে আপনাকে নিয়ে যেতে পারিনি এতদিন। এখন চলুন না জুই, ঘুরে আসি। আপনার শশুর বাড়িতে যাওয়াও হলো সঙ্গে আমার প্রথম হানিমুনটা করা হলো।

আয়নের কথায় জুই লজ্জায় নত মস্তিষ্কের হতেই আয়ন হাসলো। জুইয়ের ওপর খানিকটা ঝুঁকে নাকে নাক ঘষে আয়ন মোহাচ্ছন্ন গলায় বলল,

‘ কি যাবেন জুই?

‘ হুম।

নত মস্তিষ্কের জুই লজ্জায় তৎক্ষনাৎ সম্মতি দিয়ে উত্তর করতে করতে সে দু’হাতে আয়নকে ঠেলে নিজের থেকে দূরে সরাতে চাইল, কিন্তু আয়নকে সরাতে না পেরে জুই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

“আপনার আম্মু-আব্বু বাংলাদেশে আসেন না কখনো?

“আসে, কিন্তু খুব কম। আসলে আমার আব্বুর ব্যবসা বাণিজ্য সব লন্ডনে, সেজন্য আব্বুর ব্যস্ততার কারণে আম্মুর বাংলাদেশে আসা হয় না তেমন।

“তাহলে আপনি যে বাংলাদেশে থাকছেন? আপনিও কি বাংলাদেশ ছেড়ে লন্ডনে সেটেল হবেন নাকি?

“উহুম, না। আমার আপাতত লন্ডনে সেটেল হওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে আমাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য হয়তো কয়েক বছরের জন্য লন্ডনে সেটেল হতে পারি। ওরা যখন নিজের বুঝ বুঝতে শিখবে, তখন আমরা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসব। তারপরও লন্ডনে সেটেল হব না। বাংলাদেশেই থাকব।

আয়নের মুখে ভবিষ্যত ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কথা শুনতেই জুই লজ্জায় গুটিয়ে গেল। জুইকে হঠাৎ লজ্জা পেতে দেখে আয়ন প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরমুহূর্তে বিষয়টি অনুধাবন করেই সে হতাশ গলায় বলল,

” আপনি এখনো আমাদের ছেলে-মেয়েদের কথা শুনে লজ্জা পাচ্ছেন জুই? এত দিনেও আপনার লজ্জা ভাঙাতে পারলাম না? তাহলে আমি বাবা হব কবে? আমার আগে যদি রিদ বাবা হয়ে যায়, তাহলে আমার ছেলে কেস খেয়ে যাবে জুই। রিদ যে ত্যাঁড়া লোক, ও তো মেয়ে বিয়ে দিতে চাইবে না আমার ছোট ছেলের কাছে। আমার ছেলের ভবিষ্যৎ বলে কথা। আপনি তো আমার ছেলেকে বিপদে ফেলে দেবেন জুই।

আয়নের কথা শুনে জুইয়ের লজ্জা আরও বাড়ল। সে মুখ নিচু করে নিতে আয়ন জুইয়ের থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে চোখে চোখ রাখল। জুইয়ের গালে আলতো করে চুমু খেয়ে আয়ন বলল,

‘ শোনেন জুই, আপনি লজ্জা পাচ্ছেন এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। দরকার হলে আরও লজ্জা-টজ্জা পাবেন। আমি সেই ব্যবস্থা করে দিব আপনাকে, কিন্তু তারপরও আমার ছেলেকে দ্রুত দুনিয়াতে ডাউনলোড করতে হবে বুঝেছেন? আমি কিন্তু খুব সিরিয়াস। বাবা হয়ে ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে চাই না।

আয়নের কথায় জুই লজ্জায় আয়নকে দু’হাতে জড়িয়ে আয়নের প্রসস্থ বুকে মুখ লুকাতে লুকাতে বলল…

‘ আপনি আসলেই একটা অসভ্য ডাক্তার।

জুইয়ের কথায় আয়ন দু’হাতে জুইকে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল…

‘ আপনাকে সঙ্গী হিসাবে পেয়ে জীবনটা রঙিন মনে হচ্ছে জুই। আমার রঙিন জীবনের আপনিই প্রিয় পূর্ণতা।

তারপর? তারপর, দিনগুলো এভাবেই কাটছিল। তার এক সপ্তাহ পরপরই আয়ন-জুইকে নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমালো। আয়ানের মা-বাবা খুব সাদরেই গ্রহণ করল জুইকে। জুই নিজের শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে গোটা দুমাস কাটালো লন্ডন শহরে। এর মাঝে জুইদের রোজকার যাতায়াত থাকত রিদের ফ্ল্যাটে। মায়াও জুইকে পেয়ে লন্ডনের মাটিতে শূন্যতা ঘোচালো। রিদের চিকিৎসা আর কাজের ফাঁকেও রাতবিরেতে হঠাৎ করেই মায়াকে নিয়ে হারিয়ে যেত লন্ডন শহরের অলিগলিতে। আবেগী মায়া যেন এক অন্যরকম রিদ খানকে আবিষ্কার করল নিজের স্বামীস্বরূপ। যে রিদ নিজের ব্যক্তিত্বের গণ্ডি ভেঙে মায়ার জন্য সব কিছু করতে রাজি। মায়ার আবদারে রিদ কখনও কখনও বিরক্ত হলেও, সে মায়ার চাওয়া অপূর্ণ রাখত না। বরং বউয়ের আবদারটুকু পূরণ করতে পেরে যেন সেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। এর মাঝে কেটে গেল মায়ার উল্লাসের দিনগুলো। লন্ডনের শহরে রিদের সঙ্গে কাটানো দিনগুলো মায়ার কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। রিদ-মায়াকে নিয়ে বিশ দিনের মধ্যে তার অফিসিয়াল কাজে বাংলাদেশে ফিরে যায়। সেইবার মায়ার ভীষণ মন খারাপ হয় কেন রিদ এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছে সে নিয়ে। মায়ার এই লন্ডন শহরে রিদকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছে। এখানে রিদ মায়াকে সময় দেয়। শত ব্যস্ততায়ও রিদ মায়াকে একা ছাড়ে না হারিয়ে ফেলার ভয়ে। এই যে মায়াকে সর্বত্র নিজের পাশে রাখছে সেটা বাংলাদেশে ফিরে গেলে রিদ রাখবে না। তখন মায়া স্বামীকে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়বে, মায়াকে একা করে। সেজন্য মায়া চায় না এত তাড়াতাড়ি ওরা লন্ডন শহর ছাড়ুক। কিন্তু মায়ার চাওয়া আর না চাওয়াতে কি কিছু আসে যায় রিদের? মায়া লন্ডন আসতে চায়নি বলে রিদ জোর করে নিয়ে এল আর এখন মায়া যেতে চাচ্ছে না অথচ রিদ মায়াকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। তবে রিদ মায়াকে বলেছে সে মায়াকে নিয়ে খুব শীঘ্রই আবারও হানিমুনে যাবে সুইজারল্যান্ড। তখন এর থেকেও বেশি সময় পাবে মায়া। তারপরও রিদের এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। রিদের কথা অনুযায়ী মায়া তাই করল। রিদের হাত ধরে বাংলাদেশে ফিরল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল মায়ার রিদের সঙ্গে থাকা নিয়ে। মায়া চায় ও ওর শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে চট্টগ্রামে থাকবে। কিন্তু রিদ মায়ার সকল চাওয়ায় জল ঢালল। রিদ পরিষ্কারভাবে জানাল তার বউ তার সঙ্গে তার বাড়িতেই থাকবে। মায়ার রিদকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া হবে না। মায়ার রিদের বাড়িতে একা থাকতে প্রথম প্রথম বেশ কয়েকদিন কষ্ট হলো। চঞ্চল মায়া মানুষ ছাড়া থাকতে পারে না। অথচ রিদের বাড়িতে মানুষ আছে কিন্তু তারা সবাই বডিগার্ড আর নয়তো বাড়ির কাজের লোক। মায়ার টাইমপাস করার মতো কেউ নেই। রিদ রাতে বাসায় ফেরে। আর দিনে মায়ার একাকীত্ব লাগে বলে এই নিয়ে মায়া কত কান্নাকাটি করেছে রিদের কাছে মায়াকে চট্টগ্রামে সুফিয়া খানের কাছে রেখে আসতে কিন্তু রিদ তা করেনি। উল্টো রিদ মায়াকে শাসায়, ধমকায় ‘রিদকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবে না’ বলে। রিদ মায়ার একাকীত্ব ঘোচাতে মায়ার কলেজ ট্রান্সফার করায়। জুইয়ের পাশাপাশি মায়াকেও একই কলেজে ভর্তি করায় রিদ। মায়া যখন বুঝতে পারল রিদ মায়াকে কোথাও যেতে দেবে না সেজন্য মায়া রিদকে ছেড়ে মায়ার শাশুড়ীকে পটাতে চাইল যেন সুফিয়া খান রিদকে বলে মায়াকে চট্টগ্রামে রেখে আসতে ওনাদের কাছে। মায়ার মনে হয়েছিল এই কথা শুনে সুফিয়া খান হয়তো মায়ার হয়ে রিদের সঙ্গে কথা বলবে কিন্তু সুফিয়া খান আরও এক কাঠি ওপরে গিয়ে মায়াকে ধমক লাগাল। মায়াকে শাসিয়ে বলল, মায়ার চট্টগ্রামে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। মায়ার থাকতে হলে রিদের সঙ্গেই থাকতে হবে। মা-ছেলের ধমকা-ধমকিতে মায়ার আর সাহসে কুলাল না কাউকে বলতে মায়া রিদের সঙ্গে একা বাড়িতে থাকতে চায় না বলে। বরং মায়া নিজেকে মানিয়ে নিল। রিদের সঙ্গে একা বাড়িতে থাকতে থাকতে একটা সময় অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এভাবেই মায়ার রিদকে ঘিরে ছোট্ট সংসার চলল। দিন গেল মাস পেরোল। খান বাড়ির লোকজন প্রায়ই রিদের বাড়িতে আসে মায়ার সংসারে বেড়াতে। আরাফ খান, হেনা খান, সুফিয়া খান, রাদিফ, আয়ন, জুই, ফাহাদ, মুক্তা, এমনকি রিদের ফুফুদেরও দেখা যায় প্রতি মাসে যাতায়াত করতে রিদের বাড়িতে। সেজন্য মায়ার আর এখন একাকীত্ব অনুভব হয় না। বরং কলেজ, রিদ আর মায়ার সংসার সব মিলিয়ে দিন বেশ ব্যস্ততায় কাটে মায়ার। তবে এর মাঝে জুইয়ের বাবার মনও নরম হয়ে আসল একমাত্র মেয়ে জুইয়ের জন্য। আয়ন ছেলে হিসাবে ভালো সেটা তিনি জানেন। কিন্তু রাতের আঁধারে জুইকে নিয়ে আয়ানের হঠাৎ পালিয়ে যাওয়াতে জুইয়ের বাবা জামাল সাহেব বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। সমাজের সামনে সম্মান নষ্ট হওয়ায় তিনি মনে রাগ পুষে রেখেছিলেন এতদিন। কিন্তু আজকাল তিনি তার একমাত্র মেয়ে জুইকে বেশ মিস করেন। জুইয়ের বিদেশ চলে যাওয়ার বিষয়টা কানে আসতেই ক্রমাগত তার মন ছটফট করছিল। যদিও জুই এখন দেশে সেজন্য তিনি আয়ন ও জুইকে গ্রহণ করে আমন্ত্রণ পাঠালেন। আয়নও শ্বশুরের আমন্ত্রণ পেয়ে জুইকে নিয়ে ছুটে এল শ্বশুরবাড়িতে। সপরিবারে একত্রে খাওয়া দাওয়া করল। কিন্তু রিদকে দেখা গেল না মায়ার পরিবারের আমন্ত্রণে আসতে। তবে মায়া এসেছে রিদকে ছাড়া। নিজ পরিবারের সাথে উৎফুল্লতায় দিন কাটিয়েছে বটে তবে রিদকে ছাড়া মায়াও খাবার টেবিলে নিজের পরিবারের সঙ্গে বসেনি। মায়াও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল যেদিন সে স্বামীকে নিজের পরিবারের সঙ্গে বসিয়ে একত্রে খাওয়াতে পারবে সেইদিনই মায়া নিজের পরিবারে অন্ন-পানি পান করবে নয়তো না। বাবার বাড়িতে মায়া আসা যাওয়া থাকবে কিন্তু মায়া খাবার তখনই খাবে যেদিন মায়ার স্বামীর মান অভিমান ভাঙাতে পারবে। মায়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মায়ার পরিবারে দীর্ঘশ্বাসের কারণ হলো। মায়াকে বেশ করে বুঝাতে গিয়েও অক্ষম হলো তারা। মায়ার এই মনোবলে জুইয়ের বাবা জামাল সাহেবের মনে তীব্র অপরাধ বোধ সৃষ্টি করল। অতীতে মায়াকে ঘিরে তার ব্যবহারের জন্য তিনি বেশ অনুতপ্ত। প্রথমে মায়াকে রিদ আশুগঞ্জ আসতে দিতে চাইত না তবে আজকাল দেয়। হয়তো রিদ চায় মায়া যেন রিদের জন্য কোনো রকম কষ্ট না পায়। সেজন্য রিদ মায়াকে বাপের বাড়িতে যেতে দিলেও সে কখনও আশুগঞ্জ আসে না। আর না জামাল সাহেব রিদের কাছে বিগত দিনের জন্য ক্ষমা চাইতে পারে। যদিও তিনি মায়ার কাছে বেশ অনুতপ্ত প্রকাশ করেছেন অতীতের জন্য। তবে মায়া নিজের চাচার প্রতি কোনো রকম মনোমালিন্যতা মনে পুষে রাখেনি। তাই জুইয়ের সঙ্গেই মায়ার যাতায়াত হয় নিজ বাড়িতে। তবে সারাদিন পর সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফিরতে হয় মায়াকে। মায়ার দিনে কোথাও যাওয়ার অনুমতি থাকলেও মায়ার রাতে থাকার অনুমতি নেই। রিদের সাফ সাফ কথা তার বিয়ে করা বউ তার সাথে থাকবে। রিদ বাসায় ফিরে মায়াকে না পেলে তার মেজাজ খারাপ হয়। সেজন্য মায়ার যদিও নিজ বাড়িতে যাওয়ার হয় তাহলে সে রিদকে অফিসের জন্য বিদায় করেই ড্রাইভারকে নিয়ে যায় বাড়িতে।
এইতো রোজকার মতোই রিদ অফিসে যাওয়ার পথে মায়াকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যায়। একই কলেজে জুইকে পেয়ে মায়ার দিন ভালোই যাচ্ছে। সংসারের পাশাপাশি দুবোন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে মায়ার বিপত্তি ঘটে যখন শুনল মায়ার ভাবি ফিহা প্রেগন্যান্ট। মায়ারও বেবি চাই। কিন্তু মায়া প্রেগন্যান্ট হয় না কেন জানি। মায়ার ভাবি প্রেগন্যান্ট হওয়ার বিষয়টা মায়া বেশ উৎফুল্লতা দেখিয়ে রিদকে জানায়। মায়ার আশা ছিল এই খবরটা শুনেই রিদ খুশি হয়ে মায়াকে বলবে নিজেদের বেবির কথা অথচ মায়ার এত বড় একটা খুশির সংবাদ দেওয়ার পরও রিদ ভাবলেশহীন। সে ‘হুম’, ‘হ্যাঁ’ তেমন কিছুই বলল না। বরং মায়াকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলে। মায়া রিদের কথা শুনে ও ইনিয়ে-বিনিয়ে বেশ কয়েকবার রিদকে বুঝিয়েছে মায়ার বেবি চাই। কিন্তু রিদ মায়াকে এমনভাবে ইগনোর করল যেন রিদ শুনতে বা বুঝতেই পারেনি মায়া কি বলতে চাচ্ছে রিদকে। এতে মায়ার উদাসীনতা বাড়ে, রিদ যে বেবি নিতে ইচ্ছুক নয় সেটা তার হাবভাবে বুঝা যায়। কিন্তু মায়াও বা কি করবে? মায়ার তো একটা বেবি চাই। মায়ার বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সঙ্গে সংসারও করছে অথচ মায়ার বেবি হচ্ছে না। এমন না মায়া মেডিসিন নিচ্ছে সেজন্য মায়ার বেবি হচ্ছে না। মায়ার এমনিতেই বেবি হচ্ছে না। সেজন্য মায়া চায় ওকে কেউ বলুক মায়া বেবি হচ্ছে না কেন? মায়ার শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর কারও এসব বিষয়ে দায়িত্ব নেই। কেউ মায়াকে বেবি নেওয়ার জন্য ফোর্স করে না উল্টো সবাই মায়াকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলে।

মায়া ছাতার মাথা পড়াশোনায় মনোযোগী হবে। এত পড়াশোনা দিয়ে কি করবে মায়া যদি ওর একটা বেবিই না হয়। মায়ার হতাশা বাড়িয়ে দিয়ে তার পরপরই শুনল মায়ার বড় বোন মুক্তা প্রেগন্যান্ট। ফিহার মতো করে মুক্তার মা হওয়ার বিষয়টাতে মায়া বেশ খুশি হয়েছে। রিদকেও একই উৎফুল্লতায় খবরটা জানাল। তবে এবার ইশারা-ইঙ্গিতে নয় বরং মায়ার বেবি চাই এটা সরাসরি রিদকে বলল। রিদ থেকে জানতে চাইল মায়ারা কেন বেবি প্ল্যানিং করছে না। মায়ার কথার উত্তরে রিদ বলল, তাদের সময় হয়নি বেবি প্ল্যানিং করার। আপাতত রিদ বেবি নিতে চায় না। সময় হলে এমনিতেই বেবি হয়ে যাবে এমনটা বলে রিদ মায়াকে এড়িয়ে যায়। রিদের কথায় মায়া সেদিন বেশ কষ্ট পেয়েছিল খুব করে রিদকে বুঝাতে চেয়েছিল একটা বেবির জন্য কিন্তু জেদি রিদকে বুঝাতে অক্ষম মায়া। তারপর দিনগুলো মায়ার ভালোই কাটছিল। মাঝেমধ্যে রিদকে বেবির জন্য বুঝাত তবে রিদকে বিরক্ত করত না এই নিয়ে। মায়ার সঙ্গে রাফার যোগাযোগ ছিল বেশ। খুব স্বাভাবিকভাবে রাফার বিয়ের মাস ছয়েক পরপরই ওর মা হওয়ার বিষয়টা মায়ার কানে আসতে মায়ার মা না হওয়ার দুঃখটা যেন আকাশ সমান হয়। ফিহা, মুক্তা ওরা নাহয় সিনিয়র বলে মায়া এতদিন এই বিষয়টা নিয়ে কষ্ট পায়নি। কিন্তু রাফার তো মায়ার সহপাঠী, ওর বিয়েটা তো মাত্র সেদিন হলো। আর ছয়মাস না পেরোতেই রাফা প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল। অথচ মায়ার বিয়ের এত দিন পরেও প্রেগন্যান্ট হলো না? এই বিষয়টা মায়া সহজে হজম করতে পারল না। মায়া বান্ধবী প্রেগন্যান্ট হলে মায়া কেন প্রেগন্যান্ট হবে না। মায়ারও একটা বেবি চাই। তারপর থেকে মায়ার দুঃখ বাড়ল। সময়ে-অসময়ে রিদকে বিরক্ত করতে লাগল বেবি চাই, বেবি চাই বলে বলে। মায়ার বিরক্ত করার বিষয়গুলো যেন সে দেখেও না দেখার মতো করে থাকে। রাফার মা হওয়ার বিষয়টা আসিফের কানেও এসেছে কিন্তু এসব বিষয়ে আসিফ তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং নিশ্চুপ বিষয়টা এড়িয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষটা তার না হলেও সে ভালো থাকুক এটাই আসিফের চাওয়া। আসিফের ব্যস্ততা দিন কাটছে রিদকে ঘিরেই। হয়তো কোনো একদিন কোনো এক বসন্তে সে আবারও নতুন করে কারও প্রেমে পড়বে। তখন তার জীবনটাও রঙিন হবে। তখন আসিফ রাফার মতো করে আর কাউকে হারাবে না। বরং সঙ্গী করে নেওয়ার মতো শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ হবে।

জীবন বড়ই অদ্ভুত, যে আসিফ ভালোবেসেও রাফাকে হারিয়ে ফেলল অথচ রাদিফের ভালোবাসার মানুষ থাকা সত্ত্বেও সে গ্রহণ করল না। বরং রাদিফ রাহাকে বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসল। বিয়ে পাগল ছেলে রাদিফ হুট করে কেন রাহাকে বিয়েতে আপত্তি জানাল সেটা কেউ জানে না। আর না জানতে চায়। রাদিফ স্বেচ্ছায় বলতে না চাইলে কেউ রাদিফের প্রাইভেসি নষ্ট করবে না প্রশ্ন করে। তবে খান বাড়ির সকলেই বুঝতে পেরেছে রাদিফের সঙ্গে রাহার ব্রেকআপ হয়েছে। ছোট কোনো বিষয় নিয়ে যে রাদিফ ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দেবে না সেটা খান বাড়ির সকলেই জানে। রাদিফ আবেগী মানুষ। সে ভালোবাসার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে জানে। রাদিফের গার্লফ্রেন্ড রাহা রাদিফের অনুপস্থিতিতে লন্ডনে কারও সঙ্গে লিভ ইন রিলেশনশিপে জড়িয়ে পড়েছে এই ব্যাপারটা প্রথমে রিদের কানেই এসেছিল। তারপর রাদিফের। রিদ আসিফকে দিয়ে রাদিফের কাছে বেশ কিছু আপত্তিকর ডেটা ট্রান্সফার করায় রাহার। তারপর থেকেই রাদিফকে মাসখানেকটা নিশ্চুপ দেখা যায়। তবে সে ভেঙে পড়েনি। পুনরায় নতুন উদ্যোগে নিজেকে গুছানোর চেষ্টা চালাল। নিহাল খানের সঙ্গে রাদিফকেও দেখা যায় রাজনৈতিক মাঠে। প্রথম প্রথম সুফিয়া খানের রাদিফের রাজনীতি নিয়ে বেশ আপত্তি থাকলেও একটা সময় তিনিও চুপ করে যান। রাদিফ যখন স্বেচ্ছায় এই মাঠে থাকতে চাচ্ছে তখন বাঁধা দিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। তাছাড়া এই রাজনীতির জন্য তিনি গোটা পনেরো বছরের মনোমালিন্য কাটিয়েছেন স্বামীর সঙ্গে, আপাতত উনি এই রাজনৈতিক মহলটাকে মানিয়ে বাকিটা জীবন কাটাতে চায়। নিহাল খানের বহু চেষ্টায় আজকাল সুফিয়া খান খানিকটা সহজ হতে পেরেছে নিহাল খানের সঙ্গে সেজন্য তিনি রাজনীতি নিয়ে কথা বলে পুনরায় পরিস্থিতি বিগড়ে দিতে চায় না। কিছু জিনিস অগোছালো থাকুক। দিন তো এমনি এমনি কেটে যায়। কারও হতাশায় তো কারও উদাসীনতায়।

এর মাঝে সুফিয়া খান ঠিক করল রিদ-মায়ার বিয়ের আনুষ্ঠানিক আয়োজন করবেন তিনি। যেহেতু রিদ-মায়ার বিয়েটা আনুষ্ঠানিক বিয়ে ছিল না তাই তিনি বিশাল আয়োজনে রিদ-মায়ার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করতে চাইলে রিদ তাতে না করে। রিদ পুনরায় আনুষ্ঠানিক বিয়ে করতে চায় না। তবে তাদের বিয়ের খবরটা জানিয়ে খান বাড়িতে বিশাল মেজবানের আয়োজন করতে সে সম্মতি জানায়। রিদের কথা অনুযায়ী তাই হলো। রিদ-মায়ার আনুষ্ঠানিক বিয়ে বদলে খান বাড়িতে বিশাল আয়োজনে মেজবানের আয়োজন করা হলো। এর মাঝে আয়ানের বাবা-মাও লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরল। রিদের বিয়ের খবরের সঙ্গে আয়ন-জুইয়ের বিয়েটাও সমাজের কাছে জানাতে আনুষ্ঠানিক আয়োজন করল। বিশাল বড়ো মেজবানের আয়োজনে গোটা এলাকার মানুষদের খাওয়ানো হলো। দিনটা ছিল শুক্রবার। মায়ারা তখন খান বাড়িতে ছিল। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে মায়ার পরিবারের সকলে উপস্থিত হলো খান বাড়ির মেজবানের দাওয়াতে। রিদ-মায়া, আয়ন-জুই কেউ বর-বউ সাজল না। শুধু সমাজের মানুষদের নিকট তাদের বিয়েটা জানাতে বিশাল মেজবানের আয়োজন। সেই আয়োজনের এক ফাঁকে আরাফ খান রাদিফের বিয়ের কথা তুলতে রাদিফ তৎক্ষণাৎ জানাল সে আপাতত বিয়ে করবে না। সময় নিয়ে সে আরও পাঁচ বছর পর বিয়ে করবে। আপাতত রাজনীতি ছাড়া সে অন্য কিছু ভাবছে না। খান বাড়ির মেজবানে হৈচৈ গোটা দিন গেল সবার ব্যস্ততায়। সন্ধ্যা নাগাদ যখন সকলে খান বাড়ির ড্রইংরুমে বসে আড্ডায় মেতে ছিল তখনই জুই আকস্মিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেই সকলের মাঝে হৈচৈ পড়ে যায়। জুইকে নিয়ে হৈচৈ করে ডাক্তার দেখাতে আয়ন বাইরে থেকে দৌড়ে আসে। জুইয়ের চেক-আপের, পাশাপাশি শারীরিক দুর্বলতা আর জুইয়ের প্রেগন্যান্সির বিষয়টা খান পরিবারের ডাক্তার জানাতে সকলের মাঝে বিশাল হৈচৈ লেগে গেল জুইকে ঘিরে। মায়ার পরিবার, জুইয়ের মা-বাবা সকলেই জুইকে ঘিরে আনন্দটুকু প্রকাশ করতে মায়া সেখানে উপস্থিত রইল চুপচাপ। রিদ ব্যস্ততা চাপিয়ে সবে বাড়িতে ঢুকেছিল। বসার ঘরের সকলের মুখে মুখে শুনতে পেল আয়ানের বাবা হওয়ার কথাটি। আয়ন বাবা হবে এতে রিদের সমস্যা নেই, রিদের সমস্যা হলো তার আধা-পাগল বউকে নিয়ে। একে একে সকলেই মা হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে মায়া রিদকে এতদিন বেবির জন্য বিরক্ত করত এখন জুইয়ের মা হবার বিষয়টা নিয়ে নিশ্চয়ই রিদের উপর রেগে যাবে কেন তার বউ মা হচ্ছে না এই নিয়ে? রিদ জুইয়ের মা হওয়ার কথাটি শোনা সঙ্গে সঙ্গে বসার ঘরে মায়ার খোঁজ করল। মায়ার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে মায়ার খোঁজ করতে দেখতে পেল ড্রইংরুমে এক কোনায় দাঁড়িয়ে মায়া রিদের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে। ব্যাপারটা এমন না যে মায়া অতি রাগে রিদের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে বরং মায়া কান্না আটকাতে চেয়ে রিদের দিকে টলমল রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে। মায়ার অশ্রুভেজা চোখ দেখে রিদ আর মায়ার দিকে এগোল না। এখন বউয়ের কাছে গেলেই সমস্যা। এমনই তার বউ এখন ফায়ার হয়ে আছে রিদের উপর। রিদের এই মুহূর্তে বউয়ের কাছে যাওয়া মানে বোম ব্লাস্ট হওয়া। রিদ মায়াকে অদেখার মতো করে সিঁড়ি ধরে হাঁটল দোতলায় নিজের ঘরে দিকে। মায়া রিদকে চলে যেতে দেখে নাক ফোলাল রাগে। জেদি মায়ার চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগল গাল বেয়ে। তাই হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছতে মুছতে মায়া হাঁটল রিদের পিছন পিছন। আজ একটা বিহিত করে ছাড়বে এই রিদ সাহেবকে। মায়া ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করতে রিদকে দেখতে পেল আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাতে ঘড়ি খুলে রাখছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় তার এখন গোসল করা প্রয়োজন। এর মাঝে মায়া রাগে জেদে রিদের পিছনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল…

‘আমার একটা বেবি চাই।

‘ দারাজে অর্ডার করো।

‘আপনি কবে দিবেন সেটা বলুন।

‘কাল।

‘আমি কিন্তু সিরিয়াস।

‘মি টু।

মায়ার আবদারটুকু রিদের কাছে পণ্য কেনার মতোন লাগল। সেজন্য মায়ার কথার সঙ্গে সঙ্গে সে সেইভাবেই উত্তর দিল হেয়ালি গলায়। রিদের হেয়ালিপনায় মায়া আরও চেতে উঠে। মায়া রাগে-দুঃখে মেজাজ দেখিয়ে বলে….

‘আপনার জন্য আমার বেবি হয় না। আপনার মধ্যে সমস্যা আছে।

মায়ার রোজকার কথা এসব। রিদের সমস্যা সেজন্য মায়ার বেবি হয় না। নয়তো মায়াও সবার মতো করে এতদিন মা হয়ে যেত। অথচ রিদ বা মায়ার কারও কোনো সমস্যা নেই। রিদ মায়া অল্প বয়সে বেবি চায় না বলে সে মায়াকে রোজ পানির সঙ্গে মেডিসিন মিশিয়ে গ্লাস করে মায়াকে খাওয়ায় সেজন্য মায়া মা হয় না। এই ছোট বিষয়টা মায়া বোঝে না। রোজ রিদকে এটা সে বলে দোষ দেয়। রিদও কিছু বলে না। বউয়ের সামান্য বিরক্তবোধ তো নেওয়া যায় তাই না? রিদ হাতে ঘড়িটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে ছোট করে উত্তর দিয়ে বলল…

‘ওকে।

‘ওকে? ওকে মানে?’ রিদের এই ছোট উত্তরে মায়ার রাগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মায়া আগের মতোই বলল…

‘খবরদার আপনি যদি আমাকে আর ছুঁয়েছেন। আপনি আমাকে আর ছুঁতে পারবেন না, নিষেধ।

মায়ার শাসানোর মাঝে রিদ আবারও ওকে বলে উঠল…

‘ওকে।

রিদের ওকে বলতে দেরি, মায়ার রাগে রিদের হাত টেনে সেখানে কামড়ে বসাতে দেরি হলো না। মায়ার কামড়ে রিদ দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে উঠল…

‘উফফ রিত!

রিদ জোরপূর্বক মায়ার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ঝাঁকাল। মায়ার কামড়ে দেওয়া জায়গায় দাঁত বসে গেছে। রিদ হাতের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে রাগে কটমট করে মায়ার দিকে তাকাতেই মুহূর্তে রিদের মন নরম হয়ে আসল মায়ার চোখে পানি অনবরত গাল বেয়ে টপটপ করে পড়তে দেখে। রিদের মনে হলো বউটা তার সত্যি কষ্ট পাচ্ছে একটা বেবির জন্য। সেজন্য রিদ নিজের ব্যথা ভুলে হাত বাড়িয়ে মায়াকে কাছে টানতে টানতে বলল….

‘আচ্ছা কষ্ট পেয়ো না। কাছে এসো আদর করে দিই। মন ভালো হয়ে যাবে তোমার।

মায়া রিদের হাতটা ঝাঁকিয়ে ফিরিয়ে ফেলতে ফেলতে বলল…

‘আমাকে একদম ছোঁবেন না আপনি। আই হেইট ইউ।

কথাটা বলেই মায়া রাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রিদ মায়ার চলে যাওয়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে সেও স্বাভাবিকভাবে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটল গোসলের জন্য। এখন হয়তো মায়া রেগে আছে কিন্তু একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে এবং আবার রিদের পিছন পিছন ঘুরঘুর করবে। হলো তাই। সত্যি সত্যি রাত হতে হতে মায়া রিদের পিছন পিছন ঘুরঘুর করতে দেখা গেল রিদকে বেবির জন্য পুনরায় একই ভাবে বিরক্ত করে। মায়ারা খান বাড়িতে থাকায় রিদ-মায়ার ব্যাপার সুফিয়া খানের নজরে পড়েছে। মায়ার বেবিকে ঘিরে তীব্র আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পেরে তিনি রিদের অনুপস্থিতিতে পরদিন মায়াকে ডাকলেন নিজের কাছে। মায়া সুফিয়া খানের মুখোমুখি হতেই সুফিয়া খান বলল…

‘রিদ তোমাকে কোনো কিছু খেতে দিলে সেটা আর খাবে না কেমন?

সুফিয়া খানের কথার মানে মায়া প্রথমে বুঝতে না পেরে অবাক সুরে প্রশ্ন করে বলল….

‘কেন?

সুফিয়া খান সরাসরি মায়াকে রিদের ব্যাপারে বলে বলল…

‘তোমার বয়স কম। রিদ চায় না তুমি মা হও। যদিও আমি এই বিষয়ে রিদের সঙ্গে একমত পোষণ করছি। তবে দীর্ঘদিন ধরে যদি কেউ প্রেগন্যান্সি রোধের মেডিসিন সেবন করে তাহলে সেই নারীর মাতৃত্বের সমস্যা দেখা দেয়। সে পরবর্তীতে মা হতে পারে না। তোমরা একত্রে সংসার করছো প্রায় সাত-আট মাসেরও বেশি হয়েছে। সেজন্য আমার মনে হচ্ছে তোমার আপাতত ঐসব মেডিসিন সেবন বন্ধ করা উচিত নয়তো রিদের ভুলের জন্য তুমি নিজের মাতৃত্বের স্বাদ হারাতে পারো। এজন্য বলছি রিদ তোমাকে কোন কিছু খেতে দিলে সেটা আপাতত খেয়ো না। আমার মনে হচ্ছে রিদ তোমাকে মাতৃত্ব রোধের মেডিসিন কোনো কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াচ্ছে। রিদকে ব্যাপারটা বলতে যেও না তবে ওর দেওয়া কিছু খেতে সতর্ক অবলম্বন করবে বুঝেছ?

সুফিয়া খানের কথায় মায়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতোন মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এজন্য মূলত মায়া এতদিন যাবত কনসিভ করতে পারছে না। মায়ার এত কান্না, এত আহাজারি কি এই লোকের মন গলাতে পারেনি? এত কিসের জেদ এত লোকের বেবি না নেওয়ার পিছনে? মায়ার সমবয়সী মেয়েরা কি মা হচ্ছে না? তাহলে মায়ার মা হতে সমস্যা কোথায়? মায়া রিদের প্রতি আকাশ সমান অভিমান থাকার পরও রিদের সামনে সেটা প্রকাশ করল না। যদি মায়া এই মুহূর্তে রিদের সামনে এসব বিষয় নিয়ে রাগ প্রকাশ করে তাহলে রিদ বুঝে যাবে মায়া যে জেনে গেছে রিদের গোপন বিষয়টা। তখন রিদ সতর্ক হয়ে মায়াকে আর মা বেবি নিতে দেবে না। এর থেকে বরং মায়া নিজের রাগ নিজের কাছে পুষে রেখে সে একাই বেবি প্ল্যানিং করুক। যখন মায়া প্রেগন্যান্ট হবে তখন এই লোক এমনিতেই শাস্তি হবে। মায়াও দেখিয়ে দেবে মায়ার স্বামীর থেকে মায়াও কম চালাক না, হু। এরপর থেকে মায়া আর রিদকে ‘বেবি চাই, বেবি চাই’ বলে বিরক্ত করে না আর না রিদের দেওয়া কিছুই খায় না। এমনকি পানিটুকু পর্যন্ত নয়। রিদের সামনে খাওয়ার নাটক করলেও মায়া সেটা খায় না। রিদ মায়া হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রথমে সন্দেহ করলেও পরে সে এসব বিষয়ে খুব একটা মনোযোগ দেয়নি। তারপর দিন থেকে মাসগুলো মায়াকে ঘিরে রিদের ভালোই যাচ্ছিল। রিদ নিজের কোম্পানির কাজে দেশে-বিদেশে দুবাই যেতেই মায়াকে খান বাড়িতে পাঠানো হলো রিদের অনুপস্থিতিতে। মূলত রিদের দুবাইয়ে সপ্তাহখানেক থাকার কথা কিন্তু এর মাঝে রিদের কাছে খবর আসল সে বাবা হবে। রিদের তখন অনুভূতি প্রকাশ করার মতোন নয়। রাদিফের ফোন পেয়ে রিদ কেমন বোবার মতোন ঠায় বসে রইল জায়গায়। যখন রিদের হুঁশ ফিরল তখন সে সেই রাতেই কাজকাম ফেলে আসিফকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরল। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে মায়ার কাছে পৌঁছাল পরদিন। বাবা হওয়ার অনুভূতি রিদ প্রকাশ করতে পারল না চট করে তবে মায়ার হাসোজ্জ্বল মুখটার দিকে সে বেশ ভাবাবেগ হয়ে তাকিয়ে রইল। খান বাড়িতে নতুন অতিথির আগমনে সকলেই খুশি, সুফিয়া খান, হেনা খান, আরাফ খান মায়াকে নিয়ে ঢাকায় শিফট হয়ে যায় খান বাড়িতে। নিহাল খান, রাদিফ, রিদ ওদের তিনজনের ঢাকা টু চট্টগ্রাম যাতায়াত লেগেই থাকে সময়ে-অসময়ে।
~~
সন্ধ্যা ৭:৩০। খান বাড়িতে আবারও বিয়ের আমেজে মেতে উঠেছে পরিবেশ। আজ রাদিফ খানের বিয়ে। চারপাশে ফেয়ারি লাইটের আলোয় চকচক করছে খান বাড়ি। রাদিফের বউকে বসানো হয়েছে খান বাড়ির ড্রইংরুমের সোফায়। আপাতত বউ দেখার পর্ব চলছে। মেহমানরা সবাই রাদিফের বউকে ঘিরে বসে। আর মায়া, সে তো মেহমানদারিতে ব্যস্ত। যেন শ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। সেই সকাল থেকে মায়া ব্যস্ত। এত এত কাজের লোকের মাঝেও মায়ার ব্যস্ততা কমছে না। সুফিয়া খান নিজেও ব্যস্ততায় পা দুটো এক করতে পারছেন না। আজ তার ছোট ছেলে রাদিফকে বিয়ে করিয়ে খান বাড়িতে বউ এনেছেন। মেয়েটিকে পারিবারিকভাবে পছন্দ করা হয়েছে। যদিও রাদিফ বলেছিল সে পাঁচ বছর পর বিয়ে করবে কিন্তু রাদিফ পাঁচ বছর পর নয় বরং ছয় বছর পর বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। বয়স্ক আরাফ খানের সঙ্গে বসে আছে রিদের ছেলে মারিদ আর জুইয়ের দুই ছেলে রাদিল আর সাজিদ। সঙ্গে অবশ্যই আরিফের ছেলে ইফরান ও মুক্তা-ফাহাদের ছেলে রুহান, সোহানও রয়েছে। মূলত বয়স্ক আরাফ খানের আমেজ এসব বাচ্চা-কাচ্চাকে ঘিরে দেখা যায়। এর মাঝে রিদের ছেলে মারিদ হুট করে আরাফ খানের পাশ থেকে উঠে যেতেই আরাফ খান মারিদকে ডাকলেন। স্বল্পভাষী মারিদ বাবার মতোই চুপচাপ আর কথায় কথায় কপাল কুঁচকাতে দেখা যায়। আরাফ খানের ডাকে উত্তর না দিয়ে সে এগোল সিঁড়ির দিকে। দোতলায় সিঁড়ির গোঁড়ায় টলমল চোখে দাঁড়িয়ে আছে সুখ। পরনে সুন্দর লাল টকটকে বাবলি ফ্রক। মাথায় লাল ফিতা বাঁধা। ছোট শরীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে ভয় পাচ্ছে বলেই মূলত সে সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। মারিদ নিচ থেকে বোনের অসুবিধাটুকু বুঝতে পেরেই সে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। ভাইয়াকে দেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে সুখ অসাবধানতাবশত পা ফেলে নিচে নামতে চাইলে মারিদ তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে নিষেধ করল সুখকে নিচে নামতে। মারিদের চিৎকারে সুখ ভয় পেল। ভয়ার্ত মুখে মারিদের দিকে তাকাতে মারিদ দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে সুখের পাশে দাঁড়াতে সুখ ছোট ছোট হাতে মারিদের এক আঙুল নিজের মুঠোয় চেপে ধরে টলমল চোখে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে বলতে লাগল…

‘আব্বু তই? আব্বু নাই। আব্বু তাব।

মারিদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিজের বাবাকে খোঁজে। আশেপাশে কোথাও রিদকে দেখতে না পেয়ে মারিদ কপাল কুঁচকে সুখের দিকে তাকিয়ে বলল…

‘তুই এখানে এসেছিলি কিভাবে? কে নিয়ে এসেছে তোকে?

মারিদের কথার ঠিকঠাক উত্তর ছোট্ট সুখ দিতে পারছে না। সুখের বয়স মাত্র এক বছর এগারো মাস। দুবছর হয়নি, সামনে হবে। সেই তুলনায় মারিদের বয়স পাঁচ বছর চার মাস। মারিদ রাদিলের সমবয়সী তবে রাদিল মারিদ থেকে চার মাসের বড়। সুখ রাদিলকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দেখে অবুঝ সুখ অপর হাতের ছোট ছোট আঙুল তুলে রাদিলকে দেখাল রাদিল নিয়ে এসেছে ওকে এখানে। অথচ রাদিল মারিদের সঙ্গেই আরাফ খানের পাশে বসে ছিল এতক্ষণ। ছোট সুখ যে মানুষ চিনে বলতে পারছে না ওহ কার সাথে উপরে উঠেছে সেটা তবে মারিদ বেশ বুঝতে পারল বিষয়টা। সুখ সিঁড়ি বেয়ে উপরে কিংবা নিচে নামতে পারে না তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই সুখ কারও কোলে চড়ে ওপরে উঠেছে। মারিদ সময় মতো না আসলে হয়তো সিঁড়ি বেয়ে এতক্ষণ সুখ নিচে পড়েও যেত। মারিদ কপাল কুঁচকে সুখের আঙুল তাকের দিকে তাকাতেই রাদিলকে দেখল সিঁড়ি থেকে বেশ বড়সড় সাইজের একটা আম কুড়াতে। এই আমটা তখন সুখের হাত থেকে পড়েছে রাদিলকে দেখাতে গিয়ে। সাইজে বড় হওয়ায় আমটা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয় সুখকে। তারপরও সারাক্ষণ হাতে আম নিয়ে ঘুরবে মেয়েটা। সুখের হাতে আমটা পড়ে যেতেই সুখ পুনরায় কেঁদে উঠলো আমটার জন্য। কিন্তু চঞ্চল রাদিল সুখের কান্না বাড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সুখের সামনে আমটাতে কামড় বসাতেই সুখ চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। মারিদ বিরক্তি চোখে রাদিলের কাণ্ড দেখে সুখকে কোলে নিল। দিন দিন রোজকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে রাদিলের ছোট সুখকে কাঁদানো। রোজ নিয়ম করে সুখকে না কাঁদালে যেন চলেই না ওর। আর এই বিষয়টায় বেশ বিরক্ত হয় মারিদ। একটা মাত্র বোন তার। খুব আদরের। সে এবং তার বাবা দুজনই বোনকে খুব আদর করে যেখানে রাদিলের সুখকে কষ্ট দেওয়াটা পছন্দ নয় মারিদের। মারিদ সুখকে কোলে নিয়ে দুষ্টু রাদিলকে ঠেঙ্গিয়ে কিচেনে গেল। ফ্রিজ থেকে আম খুলে দিতে সেখানে হাজির হলো আরিফের মেয়ে পরি। ভাত খাওয়ার এঁটো হাতে মারিদের সাদা শার্টটি টেনে ধরতে মারিদ কপাল কুঁচকে নিচে তাকায়। তক্ষুনি পরি মায়ার মতো করে বলল….

‘ একতা আম তাও। [ একটা আম দাও]

পরির এঁটো হাতে মারিদের সাদা শার্টটি চেপে ধারায় ভিষণ রেগে গেল মারিদ। পরির থেকে শার্ট ছাড়িয়ে ধমক দিতেই মারিদের ভয়ে পরি আর সুখ দুজনই কেঁদে উঠলো তক্ষুনি। মারিদ পুনরায় ধমক দেওয়ার আগেই সেখানে হাজির হয় রাদিল। পরিকে কাঁদতে দেখে সে চট করে পরিকে কোলো নিয়ে বাহিরের দিকে চলে যেতেই কিচেন মায়া প্রবেশ করলো।
সুখকে কাঁদতে দেখে মায়া মারিদের কাছে জানতে চেয়ে বলল….

‘কি হয়েছে মারিদ? বোন কাঁদছে কেন?
মারিদ বাধ্য ছেলের নেয় মায়াকে সবটা জানিয়ে বলল…

‘কে যেন ওকে দোতলায় সিঁড়ির গোঁড়ায় রেখে এসেছিল আম্মু। এজন্য ওহ ভয় পেয়ে কাঁদছে।

মায়া দ্রুত এগিয়ে এসে সুখকে কোলে তুলে নিল। সুখের অশ্রুভেজা গাল মুছে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলল…

‘কি হয়েছে আম্মু ব্যথা পেয়েছ? না আর কেঁদো না।

মায়ের আদরের সুখ ঠোঁট ভেঙে কেঁদে আদুরে গলায় বলল….

‘আব্বু তই? আব্বু নাই। আব্বু নাই।

মায়ার মেয়ের অশ্রুভেজা গাল পুনরায় মুছতে মুছতে মারিদের কাছে রিদের কথা জানতে চাইবে তখনই কিচেনে হাজির হয় রিদ। মেয়ের কান্না সে দূর থেকে শুনতে পেয়ে সে ছুটে এসেছে। মায়ার থেকে সুখকে নিয়ে কোলে তুলতে আদরের সুখ ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো বাবার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে। রিদ মেয়েকে শান্ত করতে করতে বিরক্তি গলায় মায়াকে বলল..

‘কি হয়েছে, ও কাঁদছে কেন? কি করেছো তুমি?

‘আমি কিছু করেনি। আপনার মেয়ে ভয় পেয়েছে হয়তো সেজন্য কাঁদছে।

মায়ার কথায় রিদ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়। সে কতবার বলেছে তার ছেলে-মেয়েদের একা না ছাড়তে। খেয়াল রাখতে। এই নারী তার কথা শুনলে তো? রিদ মারিদের সামনে মায়াকে ধমক দিতে চাইল না। বরং সুখকে শান্ত করতে করতে রিদকে মারিদকে জিজ্ঞাসা করে বলল…

‘তুমি খেয়েছো মারিদ?

‘দাদীর সঙ্গে খাব।

খুবই অল্প কথায় উত্তর দিল মারিদ। সবসময় নিজের বাবাকে নয়তো দাদীকে অনুসরণ করে মারিদ। স্বভাবত বাবার মতোই হয়েছে সে। রিদ মারিদকে সাবধান করে বলল…

‘বাড়ির বাহিরে যাবে না। দাদীর সঙ্গে থাকবে মনে থাকবে?

‘জ্বি আব্বু।

রিদের কথার উত্তর দিয়ে মারিদ সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে চলে গেল। গায়ের শার্টটা পরি নষ্ট করে দিয়েছে। দাদীকে বলবে এটা চেঞ্জ করে দিতে। সুফিয়া খান বেশ আগলে রাখে মারিদকে। মারিদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে স্কুলে পাঠানো সবকিছু সুফিয়া খানের হাত ধরেই হয়। এই বছর থেকে মারিদকে স্কুলে পাঠানো হয়। প্রাইভেট স্কুলের পাশাপাশি মারিদকে টিউশন মাস্টারের ব্যবস্থা সুফিয়া খান নিজেই করেছেন। সেজন্য মারিদকে নিয়ে মায়ার তেমন টেনশন হয় না। সুফিয়া খান যেখানে আছে সেখানে মায়ার চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মারিদ চলে যেতে রিদও দোতলার নিজেদের ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মায়ার উদ্দেশ্যে বলল…

‘রুমে আসো রিত, কুইক।

রিদের কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ রুমে গেল না। বরং মায়া আরও খানিকটা সময় নিয়ে নিজের হাতের কাজটা সেরে ঘণ্টাখানেক পর ঘরে প্রবেশ করল। নিজেদের ঘরে প্রবেশ করতে মায়া সুখকে দেখল দোলনায় ঘুমিয়ে থাকতে। রুমের আশেপাশে রিদকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে মায়া বারান্দায় উঁকি মারতে রিদের দেখা পেল অন্ধকারে মাঝে। মায়া আবছা আলোয় অন্ধকারে রিদের শরীর ঘেঁষে দাঁড়াতে রিদ বিরক্তির চোখে তাকাল মায়ার দিকে। কটাক্ষ করে বলল…

‘সেই কখন ডেকেছিলাম আমি? শুনতে পাওনি? নাকি আসার সময় রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

রিদের তেঁড়া কথায় মায়া রিদের বাহু জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল…

‘বিয়ে বাড়িতে কত কাজ থাকে। ডাকলেই কি চলে আসা যায় বলুন?

মায়ার কথায় রিদ পুনরায় আগের নেয় বলল….

‘আজও আমি তোমার প্রায়োরিটির লিস্টে সবার পরে আসি রিত। আমার আগে গোটা দুনিয়া তোমার আপন।

রিদের কথায় মায়া রিদের বাহু ছেড়ে জড়িয়ে ধরল। রিদের বুকে মায়া মাথা রাখতে রাখতে বলল…

‘আপনি যে আমার কে? এটা এক আকাশ সমান বর্ণনা লিখলেও শেষ হবে না নেতা সাহেব। আমার পূর্ণতা বলতে আমি শুধু আপনাকেই চিনি। আমার খান সাহেবকে।

মায়ার কথায় রিদের মেজাজ শান্ত হলো। মায়াকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল….

‘ তোমাকে পেয়ে জীবনটা এত স্বগসুখের হবে ভাবিনি রিত। আজ বেঁচে থাকার স্বাদ দ্বিগুণ মনে হচ্ছে। তুমি আমার জীবনের সেই অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়, যেটার আমি কখনোই শেষ লিখতে চাইব না।

~~ সমাপ্ত