রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব-১
এক কাপ চা নিয়ে রুবায়েত ঘরের সামনে থাকা বারান্দায় দাড়ালো। বৃষ্টি পরছে টিনের চালে মনমুগ্ধকর রিমঝিম শব্দ। রিমঝিম শব্দটা মাথায় আঘাত করলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, প্রতিদিন একটা কেমন অনুভূতি যেন ও একা নেই রিমঝিম ওর সাথেই আছে। কখনো চা বানাচ্ছে, কখনো ওকে গান শোনাচ্ছে…অথচ…ঘরের ড্রয়ারে ডিভোর্স লেটারটা রাখা।
পেশায় মেডিসিনের ডাক্তার রুবায়েত ডিভোর্স লেটার হাতে পেয়ে কালবিলম্ব না করে বেসরকারি হাসপাতালের চাকরি আর সন্ধ্যার পরের চেম্বার সব ছেড়ে সুনামগঞ্জের এই গ্রামে আজ দিন পনেরো। এখন বর্ষাকাল, বাড়িটা পাকা শুধু মাথার উপর টিনের চাল। টিনের চালের উপর
টাপুর টুপুর করে বৃষ্টি পড়ছে, চারপাশে একটানা ঝিরঝির শব্দ। বাড়ির সামনে একটি ছোট ঘাট বাঁধানো পুকুর, যার জলে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বৃত্ত তৈরি করে মিলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বজ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে….
ঠিক তক্ষুনি সামনে তাকিয়ে রুবায়েত এর গা শিরশির করে উঠলো, ও যেন দিব্য চোখে দেখতে পেল, চারদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত, দূরে নীলচে পাহাড়ের সারি আর ওর এই ছোট্ট বাড়িটার সামনের কদম গাছের নীচে রিমিঝিম শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে, কদম ফুল কুড়াচ্ছে। আর গুনগুন করছে, “ আকাশ এত মেঘলা যেও না তো একলা…… বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। একটা ঘোর তৈরি করা দৃশ্য।
রুবায়েত মাথা ঝাড়া দিয়ে চোখের সামনে থেকে দৃশ্যটা সরিয়ে দিল। ওর কি হ্যালুসলেশন হচ্ছে? রিমঝিম এর সাথে তো ওর বিয়েটা পারিবারিকভাবে। মাত্র ছয় মাসে মেয়েটা কিভাবে ওকে এতটা দখল করে নিল? ও কেন পারল না? নাকি ও পেয়েছিল! এত বেশি পেরেছিল যে মেয়েটা সারাক্ষণ ওকে নিয়ে ইনসিকিউরিটি তে ভুগতো!!
সুনামগঞ্জের অদ্ভুত সুন্দর গ্রামে, এই বাড়িটি ও লন্ডন প্রবাসী বন্ধুর। না এখানে সারাজীবন থাকার কোন পরিকল্পনা নেই রুবায়েতের, কিছুদিন থাকবে মাথা ঠান্ডা করবে, তারপর ঢাকায় গিয়ে নতুন চাকরি খুঁজবে। তবে এখানে এসে, ছেলেবেলায় পড়া রচনা মনে হয়ে যাচ্ছে। বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরে যাব, এই কয়দিনে গ্রামের মানুষ ওকে আপন করে নিয়েছে। ইদানিং সাপে কাটা রোগী বেশি আসে। এখন বর্ষাকাল এখন যেন সাপের প্রকোপ বেশি। কাল কেউটে সাপের রোগী বেশি পায়।
ফস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবলো,বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখের মত মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন, এবং অন্তত ছয় হাজার মানুষ মারা যান।
কাল কেউটে কামড় দিলে তেমন ব্যাথা অনুভব হয় না, তাই চিকিৎসা নিতে নিতে বেশ দেড়ি হয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে, রিমঝিম এর কথা আবার মনে হল, মেয়েটা সব কিছু ভয় পায়, টিকটিকি, তেলাপোকা, জোক, কুকুর। নিজে নিজে হেসে ফেললে রুবায়েত। রাস্তায় কুকুর দেখলে লাফালাফি করত। তবে ও বিরক্ত হত না সুন্দর করে পার করিয়ে দিত। এরপর কুকুরের ভয় দূর করানোর জন্য দুইদিন রিমঝিম কে নিয়ে রাস্তায় কুকুরকে খাবার দিতে গিয়েছিল। হতাশ হয়ে মাথা নাড়লো, একটু পরপরই রিমঝিম কেন মাথায় হানা দিচ্ছে?
তখনই অল্প বয়সী কালো মত হ্যাংলা একটা ছেলে বৃষ্টির মধ্যে ছুটে আসলো হড়বর করে বলল,
“তাড়াতাড়ি আইবা, আমার বাপরে সাপ ফুইলছে!” ছেলেটা মৃদু ফোঁপাচ্ছে।
রুবায়েতের সিলেটি ভাষা বুঝতে সমস্যা হয়, তবে এখন অনেকটাই বুঝতে পারে। ছেলেটার বাবাকে সাপে কামড় দিয়েছে। ছেলেটার সাথে অ্যান্টিভেনম নিয়ে ছুটলো, ছাতা কিংবা রেইনকোট কিছু নিলো না। ভালো লাগছে রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজতে, মেঠো পথে সাইকেল চালিয়ে যেতে। একটা গান মনে হল-
রিমঝিম গিরে শ্রাবণ, ছুলাগ ছুলাগ যায়ে মন…
দৃষ্টি গেল দূরে চারিদিক অসহ্য সুন্দর, ঐ দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে, আর চারিদিকে পানি থৈ থৈ করছে।
তখন ভিজে ভিজে গিয়ে, এখন বাড়িতে এসে একটু জ্বর জ্বর লাগছে। ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চা চেষ্টা পাচ্ছে খুব । মনে হচ্ছে ঘরের ভিতরে ছোট রান্নাঘর, তাতে রিমঝিম হাতের চুড়ি নাড়িয়ে চা বানাচ্ছে। ফোঁস নিঃশ্বাস ফেলল, উঠে গিয়ে ওষুধ খেয়ে নিল। সাপের জন্য ঘরে কার্বলিক এসিড দেয়। আজ আর মশারী টানালো না।
ফজরের আজানের সাথে ঘুম ভাঙলো রুবায়েতের , বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে, নামাজ পড়ে জানলায় দাঁড়ালো কি অসাধারণ প্রকৃতি। সুনামগঞ্জ তো সুন্দর্যের লীলাভূমি, বর্ষাকালে চারিদিকে পানি থাকে বেশি, স্বচ্ছ সেই পানিতে আকাশে ছায়া পড়ে। পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে। জ্বর এখন আর নেই। একটা বই খুলে বসলো, বই পড়া রুবায়েতের বহু পুরনো অভ্যাস। বইয়ের নাম হচ্ছে, “ এন্টি ডোট, একজন তরুন ডাক্তারের লেখা। নাস্তা চিড়া আর কলা খায় বেশিরভাগ দিন। দুপুরে খাবার দেয় একটা পরিবার, রুবায়েত প্রতিদিন রাতে দুই বেলার টাকা দিয়ে দেয়৷ মাত্র এই কয়দিনে, ওকে গ্রামের মানুষ ভালোবেসে ফেলেছে, তাই প্রায় এটা সেটা খাবারও আসে। একজন ডাক্তার সহজে মানুষের আপন হয়ে যায়। জীবনে একটা কঠিনতম সময় সহজ হচ্ছে এজন্যই। আবার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে, সেটা টের পেয়ে রুবায়েত বিস্কুট আর কলা খেয়ে শুয়ে পরলো।
আবার রিমঝিমকে দেখছে, খুব ভালো গান গাইতে পারে। বিয়ের আগে বিষয়টা জানতো না, অবশ্য জানার কথা না। ওর বাবা-মা যখন ওর বড় ভাইয়ের কাছে আমেরিকাতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই ওর জন্য মেয়ে দেখা দেখি শুরু হয়। এরেঞ্জ ম্যারিজে যা হয়, ব্যাটে বলে কিছুই মিলে না। শেষ পর্যন্ত রিমঝিমকে তাদের পছন্দ হয়।নজর কাড়া সুন্দরী না, তবে চেহারাটা খুব স্নিগ্ধ, কন্ঠ মোলায়েম, গায়ের রঙ উজ্জ্বল। তারপর দ্রুততার সাথেই বিয়েটা হয়ে যায়।
বিয়ের পর একদিন রুবায়েতের অনেক জ্বর তখন রিমঝিম ওর কপালে জলপট্টি দিতে দিতে গুন গুন করছিলো। রুবায়েতের মনে হচ্ছিল, যেন ও ভালো হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে রিমঝিমের হাত ধরে ফেলেছিল, “ এত সুন্দর কন্ঠ তোমার, কই আগে কখনো বলোনি তো?”
রিমঝিম লাজুক চোখে তাকায়, “ আমি খুব চিন্তায় পড়লে গান করি। আপনার এই জ্বর যাচ্ছে না কেন? কি চিন্তা হচ্ছে আমার।”
ঘরের দরজায় ক্রমাগত ধাক্কাধাক্কি তে রুবায়েত বর্তমানে ফিরে এলো। কোন রুগি হবে বা গিট্টু নামে একটা ছেলে আছে, ওর নানী উনি মাঝেমধ্যে রুটি দিয়ে যায়। জ্বর জাকিয়ে বসেছে একদম। কদম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রুবায়েতের জ্বর এই ধারার ই। তাই তো বিয়ের পর প্রথম ওর জ্বর দেখে রিমঝিম অনেক ভয় পায়।
দরজা খুলে রুবায়েত কয়েকবার নিজের মাথা ঝাড়া দিল। জ্বরে কি আবারও উল্টা পালটা দেখছে! এই তো রিমঝিম সবুজ একটা তাঁতের শাড়ি পরে হাতে স্যুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে গিট্টুর নানী। পান খাওয়া দাঁত বের করে বললো,
“বউর বাড়ি খুজত আছিল, আমি লই আইলাম। মা শা আল্লাহ, হেব্বি গরৎ!”
রুবায়েতের অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ খুললো,
“যহন কয় ডাক্তার স্যারের বাড়ি, নাম না শুনরও বুজছি তোয়ার কথাই কয়। এতক্ষণে দরজা খোল, বউ ভিজ্জা গেইসে!”তাড়া দেয় বৃদ্ধা।
রুবায়েত তাকিয়ে দেখে আসলেই ভিজে গেছে রিমঝিম। দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো।
রুবায়েত শুয়ে শুয়ে রান্নাঘরে রিমঝিম এর হাতের চুড়ির শব্দ পাচ্ছে, চা বানাচ্ছে আর গান গাচ্ছে, “
আজ দোলে মন কার ইশারাতে
লাগে ভালো আজকে সারাদিন
খুশীতে যেন মন ভরে যায়
অলি আঁখি মেলে চায়…….
আজ দোলে মন কার ইশারাতে
লাগে ভালো আজকে সারাদিন
রুবাইয়েতের মনে হচ্ছে সব মিথ্যা, সেই রাতে রিমঝিমকে চড় মেরে বের হয়ে যাবার পর,পরদিন বাড়ি ফিরে আর পায়নি রিমঝিমকে। যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেও সম্ভব হয় নি, কোন ফোন ধরেনি রিমঝিম।কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স লেটার পেয়ে যায় রুবায়েত। তাহলে এই মেয়ে এখন সুদূর ঢাকা থেকে একা এত পথ পাড়ি দিয়ে এই গ্রামে কেন? কি চায়?
রিমঝিমের এই গ্রামটা খুব পছন্দ হয়েছে…কি সুন্দর চারিদিক। মানুষের জীবন কি অদ্ভুত পনেরো দিন আগে এই মানুষকে ডিভোর্স লেটার দিয়ে আজ ছুটে এসেছে। ফোঁস করে একটা নি:শ্বাস ফেললো রিমঝিম, সবাই বলে ও ওভার থিংকার, সন্দেহবাতিকগ্রস্থ আসলেও কি তাই?
ওর ভুল ছিল নি:সন্দেহে কিন্তু রুবায়েত কি করলো, উচিৎ ছিল না দেখা করার? ফোন করলেই হয়? স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে ফোনে শুকনো একখানা সরি নাকি খুশি হয়েছে, মুক্তি পাবে ভেবে? হতে পারে, আজকাল পুরুষদের কি ভরসা। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে এগুলো খুব দেখেছে রিমঝিম।
মাথা ঝাড়া দিল আবার এসব ভাবছি! চোখ বন্ধ করল মনে করার চেষ্টা করল কাউন্সিলার ম্যাডাম কি বলেছিলো! –সব নেগেটিভ চিন্তাকে দূর করে দিবে, সেগুলোকে পজেটিভ থিংকিং এ পরিনত করবে। অন্যের জীবনের সত্য তোমার জীবনেও হানা দিবে তা জরুরী নয়।”
রুবায়েতের জ্বর এখন কম, সত্যি রিমঝিম এখন ওর সামনে, চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আস্তে করে পাশে বসে কপালে হাত রাখলো, চা পাশের টেবিলে শব্দ করেই নামিয়ে রেখেছে। “ আদা গরম মশলা চা, তোমার প্রিয়।”
রুবায়েত নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চুলে খোঁপা আঁচল কোমড়ে গুজে, ওর পাশে কি সত্যি রিমঝিম।
“কারেন্ট বুঝি অনেক যায়? এত বৃষ্টি তবুও একটা ভ্যাপসা গরম তাই না? নাও চা খাও।” উঠে যাবে তক্ষুনি রুবায়ের রিমঝিম এর হাত ধরে ফেললো, “ কেন এসেছো তুমি? তুমি কি বাস্তব নাকি মায়া?”
রিমঝিম ফিরে তাকালো, “ তোমাকে নিতে এসেছি, আমি সত্যি এসেছি। বলে ঝুকে ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিল। “ স্পর্শ কি মিথ্যে হয়।”
“ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে কেন এসেছো?” উঠে বসলো রুবায়েত, “ তুমি যেভাবে এসেছো সেভাবেই ফিরে যাবে। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা গেলেও তা কখনো পরিষ্কার ছবি দেখায় না।”
“যদি বলি আয়নাটা ভাঙেই নাই….!
রুবায়েত কিছু বলে না চায়ের কাপ তুলে নেয়।
রান্নাঘরে গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে রিমঝিম আর গিট্টুর নানীর। রিমঝিম সম্ভবত রান্না করছে। একটা সিলিন্ডার চুলা আছে, মাঝেমধ্যে সেটাতে রুবায়েত চা খায়। ঘরে তো কিছুই নেই তবে…
চলবে…
আঞ্চলিক ভাষা পারি না,চ্যাট জিপিটির সাহায্য নিয়েছি। সিলেটি আপুরা বলবেন হয়েছে কি?
আর গরৎ অর্থ সুন্দর ❤️