রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব-২
রান্নাঘরের জানলা দিয়ে একটা পুকুর দেখা যাচ্ছে, জলে টুইটম্বুর কি অপূর্ব। রিমঝিম দেখলো রান্নাঘরে কিছুই নেই। তাহলে দুপুরে কি রান্না করবে? একটু বাদেই গিট্টুর নানী আসলো। নিজের পালা মুরগি কেটে ধুয়ে নিয়ে এসেছে।
রিমঝিম অপ্রস্তুত হয়ে গেল পুরাই, আরে কি করেছেন এসব? না না…
রিমঝিম কে থামিয়ে বৃদ্ধা বললো,
“মাইয়া, এট্টুকু করন তো যাই, তুমার সোয়ামী ফারেস্তার মতো, তার লাইগা আর কি করমু? মন্নে কর, ইটা বউয়ের মুখ দেইখা।”
রিমঝিম বুঝে রুবায়েতের প্রশংসা করছে। ওর ভালো লাগে। তারপর খানিক ইতস্তত করে কিছু সদাই আনিয়ে দিতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই বৃদ্ধার কি হাসি।
“কিতা লাগবো লেইস্ট কইরা দাও, আমার নাতি গিট্টু এক্কেবারে আইন্যা দিব। আজকা বিয়লা তুমি রান্ধবা? মইনার মারে তাইলে কইয়া দিমু, যাতে আর না রান্ধে।”
রিমঝিমের সমস্যা হয় বৃদ্ধার ভাষা বুঝতে, অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, “ময়নার মা কে?”
“মইনার মা তোমার স্বামি রে দুবেলা রান্ধা দিয়া দেয়।”
এই কথাটা রিমঝিম বুঝতে পারল, মায়নার মা হচ্ছে সেই মহিলা যে রুবায়েতকে দুইবেলা খাবার রান্না করে দেয়। লিস্ট নিয়ে গিট্টুর নানী চলে গেল। রিমঝিম এখন সামনের ঘরে বসে, বাইরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছে, বৃষ্টি মজে গেছে। টিনের চাল দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। সেদিক তাকিয়ে ওর মনে স্মৃতিরা হানা দিল,
বিয়ের দিনটি ছিল বৃষ্টি মুখর, ঠিক আজকের মত বৃষ্টি স্নাত। জানুয়ারি মাসের বৃষ্টি। রিমঝিম এর বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো ওর সেঝ খালা, রুবায়েতের এক চাচাতো বোন খালাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতো। একদিন রিমঝিমকে বারান্দায় দেখেই নাকি ভালো লাগে উনার, নিজের ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
দ্রুততম সময়ে দেখাদেখি হয়ে যায়। রিমঝিমের কিন্তু ডাক্তার পাত্র একদম পছন্দ না। কারণ ওর মনে হয় ডাক্তারেরা নাইট ডিউটি করে আর নার্সদের সাথে যত্তসব ফষ্টিনষ্টি আর ঢলাঢালি। কিন্তু বাসায় কাউকে এ কথা বুঝানো যাচ্ছে না। আক্ষেপ করে বান্ধবী রিতাকে এ কথা বলতেই, রিতা ভ্রু কুঁচকে নেয়, “ আচ্ছা, তুই এরকম কেন? দুনিয়া সুদ্ধ সব ডাক্তার এক রকম হবে কোন কথা আছে? আর এগুলো সব শোনা কথা। পড়াশোনা শেষ করেছিস এখন বিয়ের উত্তম সময়।”
রিমঝিম কিছু বলে না, রিতার কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে, এখন চাচ্ছে সব বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাক। এক শিয়ালের লেজ কেটেছে, এখন সে চাচ্ছে বাকিদের লেজ কাটুক।
দেখাদেখির দিন রিমঝিম একটা মেরুন জামদানী শাড়ি পড়েছিল, রুবায়েত প্রথম পাত্র না আগে দুজন দেখে গেছে। প্রতিবারই একই রকম অনুভূতি, খুবই অসহ্য লাগে রিমঝিমের। যাইহোক, এবার রক্ষে পাত্র একা কথা বলতে চায় না। মনে মনে ভাবে বাঁচা গেল, কি সব বোকা বোকা প্রশ্ন করে। রিমঝিম একবার দেখেও না রুবায়েতকে।
ঠিক তখনই ওর বাঁচার উপরে মরণ ঢেলে দিয়ে ওর ফাজিল বান্ধবী রিতা পাশ থেকে বলে ওঠে, “পাত্র-পাত্রীর অবশ্যই কথা বলা উচিত, পাত্রের কোন কথা না থাকতে পারে পাত্রী তো থাকতে পারে!”
আধুনিক পরিবার ওদের, তাই অন্যরাও মোটামুটি সায় দেয়, কি বিপদ! যাইহোক রিতা আর ওর ভাবির সাথে রিমঝিম ছাদে যায়।
রিমঝিম রিতার উপরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “ এত মুখ চলে কেন তোর? এই বিয়েটা হবে না দেখিস, হুদাই কথা বলা লাগবে!”
তখনই ওর ভাবি ওকে আলতো খোঁচা দেয়, তারপর রিতা কে বলে, “ চলো আমরা ছাদের ঐ দিকটাতে যাই।”
রুবায়েত যখন হেঁটে আসছিল শান্ত ভঙ্গিতে, তখন রিমঝিম তাকিয়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছে যেন একজন শান্ত স্বভাবের, ভদ্র, কম কথা বলা তরুণ। গায়ের রং ফর্সা নয়, তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চেহারা, চুলগুলো নিয়ম করে আঁচড়ানো, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। সেই সময়টা যেন রিমঝিম এর জন্য থমকে গেল… জীবনে পুরুষ তো কম দেখেনি, কিন্তু এ পুরুষ কে অন্যরকম লাগছে কেন?
বিকেলটা অদ্ভুত সুন্দর ছিল, রোদ ছিল না ছিল মুঠো মুঠো ঠান্ডা বাতাস, আর গাছের বিভিন্ন ফুলের সৌরভ।
রুবায়েত এগিয়ে এসে সালাম দিল আরষ্ট ভঙ্গিতে।
রিমঝিম এতক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে, মৃদু কন্ঠে সালামের উত্তর দিল।
রুবায়েত কথা শুরুই করল এভাবে, “ আপনার চা পছন্দ?” কন্ঠটা খুব সুন্দর, মেয়েরা ছেলেদের উচ্চতা আর কন্ঠের প্রেমে পড়ে সাধারণত, আর দুইটাই রুবায়েতকে আল্লাহ ভালোভাবে দিয়েছেন। এটাতেই রিমঝিমের সন্দেহ।
রিমঝিম কিছুটা হালকা বিরক্ত ভঙ্গিতে, “চা পছন্দ, কিন্তু খুব বেশি মিষ্টি হলে চলে না।”
“এটা ভালো, চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”
“ভাগ্যিস বলেন নাই চা খাওয়াই বাদ। আপনারা ডাক্তাররা চায়ের বদলে হয়তো ওআরএস-ই সাজেস্ট করেন বেশি, তাই না?”
রুবায়েত হেসে ফেললো, রিমঝিম আরেকবার মুগ্ধ হল এর হাসিও কি সুন্দর। “আমরা চা-ও খাই, আমি তো রীতিমতো চায়ের পোকা। তবে ওআরএস-ও দিই। কনফিউশনের রোগী থাকলে তো দুইটাই দরকার পড়ে।”
রিমঝিম হালকা ভ্রু কুঁচকে “মানে আমাকে কনফিউজড লাগছে আপনার?”
রুবায়েত যেন বিষম খেয়ে হেসে দেয়, “না না! আপনার কথা বলার ধরনেই বোঝা যায়—আপনি বেশ স্পষ্টভাষী।”
“আসলে আমি ডাক্তার পাত্র চাইনি। মেডিকেলের মানুষদের সময় কম থাকে, সারাক্ষণ পড়াশোনা আর আর…সেই কথাগুলো কিভাবে বলে তাই চুপ করে গেল।”
রুবায়েত আস্তে করে হেসে “আপনি বিয়েতে রাজি না তবে একান্তে কথা কেন?” চুল বাতাসে উড়ছে এখন রিমঝিমের ওকে নিতান্তই বেয়াড়া মনে হল।
এদিকে ওর গালে আচমকা অনেকগুলো রক্ত কনিকা ঝাঁপিয়ে পরলো একটু থেমে, চোখ সরিয়ে “আসলে বাসার সবাই জোর করেছে। আর…আমার বান্ধবী… “ কথা খুঁজে পায় না, যা বলছে সব নিজের কানেই বেখাপ্পা লাগছে।
খানিক নিরবতার পর, “আমি ডাক্তার হিসেবে যেমনই হই, আপনি কিন্তু বেশ খোলামেলা কথা বলেন। এটা ভালো লেগেছে। আমি অবশ্য চুপচাপ ধরণের মানুষ। শোনার অভ্যাসটা বেশি, বলার চেয়ে।”
রিমঝিম অদ্ভুত এক চোখের চাহনি দিয়ে তাকিয়ে, “মাঝে মাঝে বলতে হয়, সবাই কিন্তু নিরবতা পড়তে পারে না।” তারপর তীর্যক হেসে, “আর সব ভালো লাগলেই যে বিয়ে করা যায়, তা তো নয়।”
রুবায়েত মৃদু হেসে ” সেটা ঠিক বলছেন। কিন্তু ভালো লাগা থেকেই তো অন্য সব শুরু হয়।”
এরপরই বিয়ের সানাই বেজেই যায়… তক্ষুনি ওর ভাবনা গুলো সুতোকাটা ঘুড়ির ন্যায় উড়ে যায়, দরজা কেউ জোরসে ধাক্কাচ্ছে।
রুবায়েত যখন ঘুম থেকে উঠলো তখন ঘড়িতে দুপুর দুইটা বেজে চল্লিশ মিনিট। উঠে বসেই ঘ্রান পেল, ভুনা খিচুড়ি আর মুরগীর মাংসের। রিমঝিম এর রান্না আজ কতদিন পর…. বাথরুমে চলে গেল, জ্বর নেই। গোছল করবে। ডিপ টিউবওয়েল পানি উঠে ট্যাংকিতে। ঠান্ডা সেই পানিতে গা ভিজিয়ে রুবায়েতের মনে পরে যায়, প্রথম দেখায় রিমঝিম বলেছিলো ওর ডাক্তার পাত্র পছন্দ না। কিন্তু সে সব কথা কানে তোলার মত মনের অবস্থা রুবায়েতের থাকলে তো! এরকম দারুন স্নগ্ধ, আর স্পষ্টভাষী ছিল মেয়েটা যে কিভাবে মানা করে দিত রুবায়েত?
আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে চুল আঁচড়াচ্ছে। বাতাসে রান্নার সুঘ্রান যেন খিদে বাড়িয়ে দিচ্ছে…মেয়েরা কত সুন্দর সংসার আগলে নেয়। বিয়ের পাঁচদিনের মাথায় ওর বাবা মা আমেরিকা পাড়ি জমালে রিমঝিম যেন আকূল পাথারে পরে যায়। ভীত মুখে বলে,
“ শোন আমি তো রান্না করতে পারি না।”
রুবায়েত আশাও করে নাই এসব। আজকাল কোন মেয়েই বা রান্না পারে। “ আরে ইউ টিউব আছে না আর তোমার আম্মু ঠিক শিখে যাবে।”
সত্যি রিমঝিম শিখে নিয়েছিল অল্প দিনেই৷ তাতে হাত পুড়েছে, হাত কেটেছে কিছু খাবার মুখে দেওয়া যায় নি। কিন্তু সে এখন সফল।
“খাবার কি বিছানায় খাবে?” দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিমঝিম, এখন একটা হলুদ শাড়ি পরনে, ভেজা চুল মুখের এদিক সেদিক। না দেখেও রুবায়েত জানে পিঠ পুরো ভিজিয়ে ফেলেছে এই মেয়ে চুলের পানিতে। এতটা অস্থির যে চুল ভালো মত মুছেও না, ঘরময় পানির ছড়াছড়ি থাকে। আয়নায় ওকে দেখছে রুবায়ের, ওর যে কয়টা অন্যায় আবদার ছিল বিয়ের পর তার মধ্যে একটা ছিল রিমঝিম যেন সব সময় শাড়ি পরে, অন্তত রুবায়েত যতক্ষন বাসায় থাকে।
“ হুম দাও, তুমি খেয়েছো?” সহজ গলায় বললো রুবায়েত অথচ বুকের মাঝে অভিযোগ, অনুযোগ আর অভিমানের এক বিশাল অন্ধ কূপ, যাতে রুবায়েত না আপাদমস্তক ডুবে যাচ্ছে না উপরে উঠতে পারছে।
বিছানায় একটা পেপার বিছিয়ে দিল, তারপর খাবার এনে রাখলো রিমঝিম। যার বাড়ি সে বেশ গুছানো আর সৌখিন, রান্নাঘরের কেবিনেটে প্রয়োজনীয় সব কিছুই আছে। “একটা ভুল করে ফেলেছি জানো?” উত্তরের অপেক্ষা না করে,আবার মুখ খুলল, “ রান্না একটু বেশি হয়ে গেছে, আজ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা রাতে খেয়ে নেওয়া যাবে তারপরেও থেকে যাবে।” মুখ খানা খুবই চিন্তিত।
সেদিকে তাকিয়ে রুবায়েত একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, রিমঝিমের সবকিছুতে অনেক বেশি চিন্তা।এমনকি ভবিষ্যৎ নিয়ে অজানাকে নিয়ে। রুবায়েত প্রথম, প্রথম অবাক হত, ছোট ছোট জিনিস অনেক বেশি চিন্তা করত রিমঝিম। এমনকি নাটক সিনেমার বিষয়গুলো রিমঝিমকে অনেক ভাবাতো। ঘন্টার পর ঘন্টা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করত। এ টাইপের লোককে বলা হয় ওভার থিংকার।
“যেটুকু বেঁচে যাবে গিট্টু কে দিয়ে দিও।”
দুজন চুপচাপ খাচ্ছে, রুবায়েতের বলতে ইচ্ছে করছে রান্নাটা খুব মজা হয়েছে কিন্তু বলা হয় না। সুন্দর একটা সংসার শুরু করেছিল দুই জনে, কিন্তু কোথাও কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে।
রিমঝিম এ মন খারাপ লাগছিল, রুবায়েত নিবেদন পক্ষে ওকে একটা সরি বলতে পারত। অথবা খাবার কেমন হয়েছে সেটাও তো বলা যেত!
চলবে….