রিমঝিম বৃষ্টি পর্ব-০৩

0
17

রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা

পর্ব ৩

একটা বৃষ্টি ভেজা বিকেল, নদীর তীরে অপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা, নদীর জল ধূসর আকাশের প্রতিফলনে যেন রূপালী আয়নায় পরিণত হয়েছে। চারপাশে শুধু সবুজ আর মাটির সঙ্গে সোদা গন্ধ।ভেজা পাতাগুলো থেকে ঝরছে পানি টুপ টুপ করে, ডালে ডালে কাঠ বেড়ালির ছুটোছুটি। দূরে মেঘে ঢাকা মেঘালয়ের পাহাড়, মনে হচ্ছে যেন কুয়াশায় ঢাকা।

একটা টিলার ওপর বসে আছে রুবায়েত। চোখে এক ধরণের শান্ত উদাসীন দৃষ্টি,হয়তো প্রকৃতির সঙ্গে নিঃশব্দ এক কথোপকথনে মগ্ন। সাইকেলটা পাশে ঠেস দিয়ে রাখা। মাঠে গরু ছাগল চরে বেরাচ্ছে। দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে, ইশ কি শান্তি শান্তি পরিবেশ। রুবায়েতের বরাবর একা থাকতে ভালো লাগে।তবে রিমঝিম আসার পর সেটার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের তাকিয়ে ভাবছে, এই গ্রামে ডাক্তার হিসেবে ও আসেনি। এখানে এসেছিল কিছুদিন থাকতে। রিমঝিমকে চড় মেরে খুব একটা অনুশোচনা রুবায়েতের হয়নি, কারণ বিয়ের পর থেকে রিমঝিম বাড়াবাড়ি করেই যাচ্ছিল। আর যেটুকু অনুশোচনা ছিল সব ধুয়েমুছে গেছে ডিভোর্স লেটার পাবার পরে। এটাও ঠিক রুবায়েত কখনো কিছু বুঝিয়ে বলেনি। আর সেদিন রিমঝিম মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিলো। সবকিছুর উর্ধ্বে রুবায়েত একজন ডাক্তার সেটা রুবায়েত কিভাবে ভুলবে? যাইহোক এই গ্রামে কোন ডাক্তার নেই, তবে সদরে আছে সরকারি ডাক্তার। রুবায়েত আসার সময় ডাক্তারি কাজে লাগে এরকম অনেক কিছু নিয়ে এসেছিল। কখন কি কাজে লাগে। এবং কাজে লেগে গিয়েছিলো কিছুদিন বাদেই।

একটা স্বামী পরিত্যাক্ত মেয়ে বয়স এই আঠারো উনিশ হবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। এই মেয়ের মা’’ই ওকে রান্না করে দেয়। মেয়েটার নাম ময়না। ময়নার মুখটা মনে হতে রুবায়েতের হালকা অস্বস্তি হল। ওর কেন যেন মনে হয় মেয়েটা ওকে পছন্দ করে। করতে পারে, কারণ বয়স কম স্বামী পরিত্যাক্তা। কিন্তু রুবায়েত কখনোই প্রশ্রয় দেয় না, দিবে কিভাবে ওর মনের জমিনে রিমঝিম সারাক্ষণ টুপ টুপ বৃষ্টি ঝড়ায়।

মেয়েটা তার হাতের রগ কেটে ফেলেছিলো, কারন হয়ত বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী বিষন্নতা বা মানুষের কানকথা। বিবাহ বিচ্ছেদ কারো জন্য কত সহজ কারো জন্য কত কঠিন। মুখটা কঠিন হয় হঠাৎ রিমঝিমের মুখটা মনে পরে যায়। আর রিমঝিম?

সেদিন রুবায়েত খবর শুনেই প্রাথমিক ভাবে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে রক্ত বন্ধ করে করার চেষ্টা করে। লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া ছিল ওর কাছে। সেটা দিয়েই সেলাই করে দেয়। বাচ্চা মেয়ে তো অত গভীর করে কাটতে পারেনি। তবে এই ঘটনার পর গ্রামে নাম ছড়িয়ে পরে ওর। ওর ও ভালোলাগে। ওর সেই সিলেটি বন্ধু বেশ কিছু টাকাও ডোনেট করেছে ঔষধ পাতি আর অন্যান্য জিনিস এর জন্য৷ আকাশের দিকে তাকালো রুবায়েত কি অপূর্ব এই আকাশটা। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। রুবায়েত উঠে বসলো বাসায় যেতে হবে। রিমঝিম আছে বাসায়…চিন্তাটা এক সাথেই সুখ আর রাগের একটা অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে গেল রুবায়েতকে। আজানের জবাব দিতে দিতে চট করে প্রার্থনা করে ফেলে সব যেন ঠিক হয়ে যায়।

নামাজ পড়ে কেবল বের হয়েছে গিট্টু আর কচি দুইজন প্রায় যেন উড়ে আসলো ওর সামনে,

“ নয়া ভাবি ফিট খাইছে ডাক্তার সাব…! এরা পড়াশোনা করে ভাষা সুদ্ধ অশুদ্ধ মিশিয়ে বলে। বলে উঠলো কচি, গিট্টুর বয়সী এর বাবা নৌকা চালায়।

“সাপ দেহছে তো, ওই জইন্যে।” গিট্টু কাঁধ ঝাঁকালো।

রুবায়েত আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না। নিজের উপর রাগ হচ্ছে, কাল পাঠিয়ে দেবে ঢাকায় যেভাবে পারে।এই প্রত্যন্ত অঞ্চল রিমঝিমের জন্য না।

________________

সেদিন বিকেলে খাওয়া শেষ করে রিমঝিম একটু গা এলিয়ে দিয়েছিলো বিছানায়। ঘুম ভেঙে দেখে রুবায়েতকে নেই। গিট্টুর নানী বসে ছিল ঘরের দাওয়ায়। মন খারাপ হয় রিমঝিমের। ও তো ঢাকা থেকে সব ঠিক করতে ছুটে এসেছে, তবে কি রুবায়েত চায়না সব ঠিক হোক? এত সুন্দর একটা বিকেলবেলা, ওকে নিয়ে বেড়াতে গেলে কি হতো? ভাবতে, ভাবতে চোখে জল চলে আসলো। সেগুলো কি ছুটি দিয়ে, নামাজ পড়ে বাইরে গেল। এ বাড়ির উঠান টা অনেক সুন্দর। ঘাট বাঁধানো পুকুর আর কত গাছ।হাঁটতে হাঁটতে পুকুর পাড় গেল, একটা কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু ফুল গাছ, পুকুর পাড় ফুলের ছেয়ে আছে। যেন লাল আর হলুদের সন্ধি। ও পুকুরের সিঁড়িতে বসলো, পা ডুবিয়ে দিল পানিতে। পরিষ্কার আর স্বচ্ছ পানি। পানিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। পাশেই আরেকজনের মুখ আবিষ্কার করল, ফিরে তাকালো খুব সুন্দর একটা মেয়ে।

“আমার নাম ময়না, আপনি ডাক্তার সাবের বউ?” হাতে একটা বাটি তাতে আম মাখা। মুখটা অপ্রসন্ন।

“হ্যা, এসো বসো।” হাসিমুখে বললেও, রিমঝিম মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করছিল, সর্বনাশ এতো মহা সুন্দরী মেয়ে। এই মেয়ের হাতেই কি রুবায়েত সেলাই করেছিল? একটা নিঃশ্বাস ফেলল, মনের আয়নায় ভেসে উঠলো ওকে কাউন্সিলিং যে করায় সে ডাক্তারের মুখ, যেন খুব শান্ত ভঙ্গিতে বলছে, –“ বোকা মেয়ে, ডাক্তারদের কোন লিঙ্গ হয় না রোগী চিকিৎসার সময়। তুমি এত সংকীর্ণ ভেবোনা, এটা একটা মহান পেশা।তোমার বর গাইনি ডাক্তার না, কিন্তু ধরো একজন মা মারা যাচ্ছেন তখন কিন্তু তিনি সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, এটা একজন ডাক্তারের ধর্ম। তুমি শান্ত হয়ে এটা ভাবো তোমার স্বামী কত মানুষের দোয়া পাচ্ছে।

মেয়েটি শব্দ করে ওর পাশে বসে পরলো। ময়নার দিকে আবার দৃষ্টি দিল রিমঝিম, ময়নার দৃষ্টি পুকুরের জলে, পুকুরে লাল হলুদ ফুল পরে কি অপূর্ব লাগছে। ময়নার মন অসম্ভব খারাপ হয়েছে ডাক্তার সাবের বউ এসেছে শুনে। জলে রিমঝিমের প্রতিবিম্ব দেখে ভাবছে খুব কি সুন্দরী এই মেয়েটা?

“কি ভাবো?” রিমঝিম শুধোয়, মেয়েটা যেন খুব অস্থির।

“ভাবি আম মাখা খান, মা বানায় দিল।” বাটি এগিয়ে দিল। মুখে চাপা হাসি বেশ ঝাল ঝাল আম মাখা, শহরের মেয়ে নিশ্চয়ই ঝাল খেতে পারে না।

“তুমি কতদূর পড়েছো, কথা তো সুদ্ধ বল।” মুখে আমমাখা পুরে দিল রিমঝিম, ঝাঁ করে উঠলো কান, তবে ও ঝাল খেতে পটু। দূরে কোথাও আজান দিচ্ছে। মাথায় কাপড় দিল রিমঝিম, “ চল ঘরে যাই।”

ঘরে প্রবেশের পূর্বে সন্ধ্যার মৃদুমন্দ আলোতে সাপটা প্রথম দেখে ময়না, গাঁয়ের মেয়ে সাপ দেখে অভ্যস্ত তবুও বিকট চিৎকার দিল, “ সাপ..সাপ।”

ঘরে এক পা দিয়েছে রিমঝিম সাপটা দেখে বাটিটা ঠাস করে হাতের মায়া ত্যাগ করে মাটিতে পরে গেল সাথে সাথে রিমঝিম ও।

বাসায় এসে রুবায়েত দেখে রিমঝিম মোটামুটি সুস্থ জ্ঞান ফিরেছে। সাপটা লাঠি দিয়ে মেরে উঠানে লম্বা করে ফেলে রাখা হয়েছে। কিছু ছেলেপিলে পোড়াবার আয়োজন করছে। নাক কুঁচকে নিল রুবায়েত অনর্থক কাজ যতসব।

“তুমি ঠিক আছ?” রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো রুবায়েত, “ কাল তোমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিব।” কন্ঠটা কঠিন।

সেটা শুনে ময়নার মুখে যেন হাসি লক্ষ্য করলো রিমঝিম। তবে কিছুই বললো না। মনে অভিমানের ঢেউ উঠলো যেন….ঘরে বসেই উঠোনে রুবায়েত গলা শুনতে পেল রিমঝিম।

“এটা তো ঘরগীন্নি সাপ,এই সাপটা তো নির্বিষ! কার কাজ এটা?” বেশ বিরক্ত রুবায়েত।

পেটি কোঁচানো লুঙ্গি গায়ে কচির বাপ মগবুল নড়ে উঠলো,

“ডাক্তার সাব, সাপ তো সাপ হইলো! না কাটলে কি বুঝা যাইব বিষ আছে না নাই?”

“আপনারা এতদিনেও সাপ চিনেন না আশ্চর্য, সাপ কত উপকার করে। সাপ সেধে কামড় দেয় না, আর ও তো কোন ক্ষতিও করে নাই। শুধু শুধু।”

আরেকজন তরুন ছেলে হেসে বলে, “সাপ দেহি খুব ভয় লাগে গো ডাক্তার সাব, তাই দেহলেই মাইরা ফালাই।”

“ভয় থাকতেই পারে, কিন্তু ভয় মানেই মেরে ফেলতে হবে এমন তো নয়। আমি তো কতবার বলছি, নির্বিষ সাপ চিনার উপায় আছে। তার চেয়ে বড় কথা, কুসংস্কারে না থেকে আগে জানো, শেখো। এখন যদি প্রকৃতির ভারসাম্যই নষ্ট হয়ে যায়, তখন রোগ-জ্বালায় ভুগবা আর ভাববা কই থেকে আসলো।”

গিট্টুর নানী,আবছা সুরে
“এইডা ঠিকই কইতাছেন ডাক্তর সাব। অইভাবে সাপ মারার পর থেইকাই ইঁদুর আর ছুঁচো ভইরা গ্যাছে। ফসলডা নিয়া অখন অনেক ক্ষতি হইতাছে।”

রুবায়েত সন্তোষে মাথা নাড়ে, “আল্লাহ অযথা কিছুই সৃষ্টি করেন নাই। একেকটা প্রাণী মরে গেলে তার ফল আসে অন্যভাবে। আমি বলি কি, গ্রামের স্কুলে একটা সচেতনতা কর্মশালা করি। সাপ চিনা, কাজ জানা, আর ভয় দূর করার জন্য। কি বলেন?”

“ঠিক ঠিক, আমরার সাহায্য করমু। আমরার ছেলেমাইয়াগোর তো জানন দরকার।” উৎসাহে মাথা নাড়ে বিপিন মল্লিক, তারপর মাথা চুলকে বলে, “ “এইডা একন পোড়াইতে অইব”

“না, মাটিচাপা দিয়ে দাও, পরিবেশ দূষণ হবে শুধু শুধু।” বলে আবার উপর নজর বুলিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়লো, জানে এরা শুনবে না অন্যত্র নিয়ে ঠিক পুড়িয়ে দিকে। এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুসংস্কার। তক্ষুনি চোখাচোখি হল রিমঝিমের সাথে, চেহারাটা ম্রিয়মাণ, অনেক মায়া লাগলো রুবায়েতের। এই মেয়ে তেলাপোকা সহ্য করতে পারে না, আজ তো আস্ত সাপ দেখলো।

__________________

আজকের রাতটা দূর্যোগপূর্ণ,ঠিক ওদের বিয়ের রাতটার মতো। চারদিকে ঝোড়ো হাওয়া, মেঘের গর্জন, টিনের চাল কাঁপছে দমকা হাওয়ায়। বাইরে পুকুরের পানি ছলকে পাড়ে উঠছে,পেছনের গাছগুলো কাঁপছে অস্বাভাবিকভাবে। বিদ্যুৎ নেই, সুনামগঞ্জের এই ছোট্ট গ্রামটা এখন যেন কোনো ভূতের উপকথায় বন্দী। মোমের আলোতে ছায়ার খেলা। সামনের ঘরের বাঁশের চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছে রিমঝিম। ভাবছে আর গুনগুন করছে,

জেগে বেশ ঘুমিয়ে দেখে
কে আমার কাছে থাকে
কে আমার গানের কথার মানেই বোঝে না….
কে আমার গানের কথার মানেই বোঝে না…..
আমার মন মানে না
দেরি আর সয় না…..

রাতের খাবার শেষে রুবায়েত স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, কাল রিমঝিম যেন চলে যায়। সে নিজে বাসে তুলে দেবে।

জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় রিমঝিম। যাওয়া যাবে না কিছুতেই। আজ ময়নার চোখে ও রুবায়েতের জন্য যা আবিষ্কার করেছে, তারপর কিছুতেই না। আর এদিকে,একটা মরা সাপের জন্য যে পরিমাণ দয়া এই লোকের, ওর জন্য তাও নেই। অথচ ওর ডায়েরি বলে ভিন্ন কথা একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায় রিমঝিমের মুখে। ডায়েরিটা নিয়ে এসেছে, এ বাসায় ও একটা আবিষ্কার করেছে, মি:চুপচাপ আপনার মনের সিন্দুক আবিষ্কার করে ফেলেছি।

ঘরে হালকা কার্বলিক অ্যাসিডের গন্ধ। ভাগ্যিস সাপটা নির্বিষ ছিল! যদি বিষাক্ত হত,যদি কামড়ে দিত? মাগো! পায়ে দড়ি বেঁধে কে মুখ দিয়ে রক্ত টেনে দিত ক্ষতস্থান থেকে? আর যদি…. মাথা ঝাঁকায় সে। “আল্লাহ! আবার বেশি চিন্তা করছি!”

নিজেকে শান্ত করতে, মোবাইলটা বের করে, নিজেদের বিয়ের ছবি দেখে। মেরুন কাতানে ছিল সে, রুবায়েত পরেছিল অফ-হোয়াইট শেরওয়ানি। ছবিতে হাত বুলিয়ে সেই দিনটা আবার যেন অনুভব করে।

বিয়ের রাতে বউ সেজে খাটে বসে ছিল রিমঝিম, বাইরে কী প্রলয় হচ্ছে তখন! মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা বুঝি টলছে। আর ওর মনটাও। সারাজীবন বাবা-মা কখনোই কোথাও একা ছাড়েনি, পুরুষ মানুষের সাথে একা একা সময় কাটানো! ওরে বাবা! অথচ কি অদ্ভুত আজ তারাই আয়োজন করে একটা ছেলের কাছে পাঠিয়েই দিলো।

রুবায়েত যখন রুমে ঢোকে, রিমঝিম বুঝে নেয় ওর প্রতিটা চলন। ফ্রেশ হওয়া, পানি খাওয়া, হালকা কাশি সব। এদিকে ও নিজে তখন বিরক্তির চূড়ায়। ভাবে, “আয় না ব্যাটা, ঘোমটা তুলে মুখ দেখ! আমি সব ধুয়ে, কাপড় বদলে হালকা হই!”

রুবায়েত কাছে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে সালাম দেয়, “তুমি চেঞ্জ করে নাও আগে। ওভাবে বসে থাকলে পা জমে যাবে।”

রিমঝিম উঠে দাঁড়ায়। ভাবে, বাহ! ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’! উন্নতি তো! খুশি হয় কিছুটা। ঠিক তখনই একটা বিকট শব্দে বাজ পড়ে কোথাও, রিমঝিম ‘মাগো!’ বলে রুবায়েতকে জাপটে ধরে। একদম “চাচা জান বাঁচা” অবস্থা, কোনো রোমান্টিকতা নেই!

রুবায়েত প্রথমে থমকে যায়, তারপর নিজেও জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে, “বাজে ভয় পাও বুঝি?”

রিমঝিমের কান গরম হয়ে যায়। ভাবে, ধুর! প্রথম দিনেই ব্যাটা বুঝে ফেললো আমি ভীতু! ওকে ছেড়ে বলে, “হুম, খুব ভয় পাই।”

রুবায়েত হেসে ফেলে, “আর কী কী ভয় পাও?”

রিমঝিম জামা-কাপড় হাতে বাথরুমে যেতে যেতে বলে, “বহু কিছু। সবচেয়ে ভয় পাই সম্পর্ক হারাতে।”

রাত গভীর, বৃষ্টি ঝরছে ছাদের ওপর দারুন ঘোর লাগা সে শব্দ। হঠাৎ রুবায়েতের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ ভেসে আসে, “রিমঝিম, ঘুমাতে আসো। অনেক রাত হয়েছে। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, বাজ পড়লে ভয় পাবে।”

“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ঠিক আছি। এখন আর তেমন ভয় পাই না।”

“তা তো আজ দেখলাম। তবে এখন যে আর সম্পর্ক হারাতে ভয় পাও না, সেটা স্পষ্ট। চলো এখন।” কাছাকাছি চলে এলো, বিজলির চমকে চশমা ছাড়া রুবায়েতকে কেমন বোকা বোকা লাগছে।

উঠে দাঁড়ায় রিমঝিম। কাউন্সেলিং করা ডাক্তার বলেছিলেন, “সম্পর্কগুলোর যত্ন নিতে হয়। নিজের অহং, রাগ, জিদ এক পাশে রেখে সবকিছু আবার আগের মতো করার চেষ্টা করো। তারপর মিষ্টি হেসে, ইঙ্গিত পূর্ণ গলায় বলেছেন, “সময় তো পাবে সব হিসেব নেবার।”

রুবায়েতের দিকে তাকিয়ে রিমঝিম স্পষ্ট গলায় বলে, “সম্পর্ক হারাতে এখনো ভয় পাই… আর এজন্যই…”

কথা শেষ হবার আগেই রুবায়েত বলে ওঠে, “তাই!” বিদ্রুপে ভরা কণ্ঠ। ডিভোর্স লেটারে রুবায়েতের ইঙ্গিত সেটা বুঝে রিমঝিম।

“হুম, কোনো সন্দেহ?” উঠে দাঁড়ায় রিমঝিম।

ঠিক তখনই আরেকটা বাজ পড়ে যেন সামনেই। রিমঝিম টলে উঠলে রুবায়েত চট করে ওকে জড়িয়ে ধরে। “এখনো তো ভয় পাও বাজের শব্দে, অযথা বড়াই করলে।” মুখে মুচকি হাসি, কি মায়াময় লাগছে।

রিমঝিম ফিসফিস করে, “হয়তো সামলে নেবার মানুষ আছে তাই।”

রুবায়েতের চোখ যায় রিমঝিমের ঘুমন্ত মুখের দিকে। একটুখানি প্রশান্তি। ধীরে ড্রয়ার খুলে ডিভোর্স লেটারটা বের করে। খুলেও দেখেনি এতদিন, আজ হঠাৎ ইচ্ছে করল কারণটা পড়তে।কি কারনে ওকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলো রিমঝিম!

কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে হাসি পেয়ে যায় ওর। ছেলেমানুষী কাণ্ড! “ওক্কে ম্যাডাম, আপনি খেলতে চাচ্ছেন? আমিও দেখি, খেলি না হয় আপনার সাথে একটু! আপনার যাওয়া কাল আর হচ্ছে না তবে।”

চলবে……..

#রিমঝিম_বৃষ্টি
#কাজী_জেবুন্নেসা