রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব ১০
না ভালোবাসার বৃষ্টিতে তখন আর ভেজা হয় না দুজনের। বাসার কাছাকাছি আসতেই, ময়নার ছোট ভাই মুকুল দৌঁড়ে আসে,
“ডাক্তার সাব মায় জানি কেমন করতাছে, জলদী আহেন।”
রুবায়েত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজেকে আবারো একই জায়গায় আবিষ্কার করে। রিমঝিমের দিকে তাকায়, রিমঝিম নিজেকে সামলায়। মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলে, “যাও।”
রুবায়েত রিমঝিমের কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে, “কৃতজ্ঞ করে দিলে। তুমি ঠিক বলেছিলে ডাক্তার বিয়ে করা কোন কাজের কথা না।”
রিমঝিম সেই স্পর্শ টুকু নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে মনে মনে বলে, “কাজের হোক বা অকাজের এই ডাক্তারটাই এখন আমার সব, কি আর করা! সব কপাল।”
ময়না আঙিনায় দাঁড়িয়ে ছিল হাতে মেহেদি, রুবায়েত দ্রুত উঠান পেরুতেই আলগোছে হাত বাড়িয়ে ওর গেঞ্জিতে খানিক মেহেদী লাগিয়ে দিল। মুখ ভর্তি হাসি। ওর মায়ের অসুখ আর ও হাসছে? কারন অসুখের কারন ও নিজেই। বেশি করে জদ্দা দিয়ে পান দিয়েছিল। তেমন কিছু না অল্প মাথা ঘুরাচ্ছে।
রুবায়েত প্রেসার মেপে দেখলো অল্প বাড়তি, “কি খেয়েছিলেন?”
ময়নার মা লজ্জিত হাসি দিয়ে, “পান খাইছিলাম, জদ্দা তো খাই না রে, আইজ কেমনে জানি খাই ফালাইলাম!”
“এখন লেবু পানি খান, বেশি খারাপ লাগলে মাথায় পানি দিবেন। রাতে ঘুম হয়?”
“ঘুমাইলে, অই রে, এক্কেরে মইরা মানুষ হইয়া গইলাম!”
“আচ্ছা আমি উঠি।” বুঝতে পারল উনার ঘুম ভালো হয়।
তবে বাসায় যেতে আরও দেড়ি হয়ে গেল। আরও দুই জায়গায় যেতে হল। ভাইরাস জ্বর সর্বত্র। অবশ্য রুবায়েত এটাও চিন্তা করলো, এই গ্রামের মানুষরা ওর উপরে নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষিত কিছু ছেলেকে ভাবছে প্রাথমিক কিছু শিখিয়ে দিবে, গ্রামে একটা ডাক্তার নেই এটাও চিন্তার বিষয়। যে শহরে ডাক্তার আছে সেটাও দুই ঘন্টার পথ।
অনেক রাত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে, তা ছাপিয়ে ব্যাঙ এর ডাক। যেখানে ব্যাঙ সেখানেই সাপ। ভাবতেই রিমঝিমের গা শিউরে ওঠ, রুবায়েত কি ঘুমিয়ে গেল? আস্তে করে ওর প্রশস্ত বুকে নিজের মাথাটা রাখে, “রুমাল টা কিভাবে হারালে?” মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো রিমঝিম। নিজেকেই শুনিয়ে ভদ্রলোক তো ঘুম। আঙুল দিয়ে বুকে আলতো দাগ কাটছে।
“ভাইরে ভাই একটা রুমালের হিসাব আছে তোমার কাছে!” এক হাত রিমঝিমের পিঠে রাখে।
“ঘুমাওনি?” আহ্লাদী কন্ঠ রিমঝিমের।
“উহু, বৃষ্টির অপেক্ষায় আছি ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে। তা হঠাৎ রুমালের কথা মনে হল কেন?”
“কি করেছ, সেটা বল?” রাগ রাগ গলা রিমঝিমের।
ওর চুলে হাত বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুবায়েত, “ আশা করলাম বৃষ্টি তুমি তো বজ্রপাত করার মুডে। মুকুলের হাত কেটে গিয়েছিল একদিন, কিছু ছিল না তাড়াতাড়ি করে রুমাল দিয়ে হাতটা বেঁধে দিয়েছিলাম। পরে রুমালটা ধুয়ে ও নাকি উঠানে মেলে দিয়েছিল। আর পাইনি, উড়ে কোথাও চলে গেছে হয়ত। সরি।”
রিমঝিম কথাটা উল্টে পাল্টে দেখল, না ময়নাকে নিয়ে এখনই কিছু বলবে না। রুবায়েত ওকে সন্দেহপ্রবন ভাববে। মাথাটা উঁচু করল, “ ডাক্তার সাহেব কি শাস্তি চান বলেন? সরিতে কাজ হবে না।”
রুবায়েত ওকে দুইহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, “আপাতত বুকের জমিনে তোমাকে চাই বৃষ্টি হিসেবে, দুই চারটা শিল সহ। নিজে হতে চাই জলোচ্ছ্বাস।”
রিমঝিম এর হাসির শব্দ সমস্ত ঘরময় ভেসে বেড়াতে লাগলো।
__________________
ভোরবেলাটা যেন স্বপ্নময়, নামাজ শেষ করে সাইকেলে চেপে রুবাইয়াতের সাথে যেতে যেতে রিমঝিম এর মনে হচ্ছিল, এ পথ যদি আর শেষ না হতো! সাইকেল একটা বিলের সামনে থামালো রুবায়েত। সাইকেল থেকে নেমে, রিমঝিম বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“এটা শাপলা বিল।” রুবায়েত ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “সুন্দর না!”
“অপূর্ব!” মুগ্ধতা ঝরে পড়ল রিমঝিম এর কন্ঠ থেকে।
শাপলা বিলে যেন ধোঁয়াটে কুয়াশার চাদর পাতানো, বিল জুড়ে শাপলাগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সূর্যের আলোর অপেক্ষায়। লাল বর্নের শাপলা যেন লাল চাদর বিছানো। বিলের কোথাও কোথাও বকের দল ঠোঁটে জল তুলে নিচ্ছে। কতগুলো ঝাঁক বেধে উড়ে বেড়াচ্ছে।
বিলের ঠিক এক পাশে পাহাড়, সেই পাহাড় পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে ভারতের মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়ের রেখা। ভোরের প্রথম রোদের কিরণ পড়েছে পাহাড়ের গায়ে,এক অপার্থিব অসহ্য সৌন্দর্য যেন। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, একটা দোয়েল আপন মনে শিশ বাজাচ্ছে।
“নৌকায় উঠবে?”
রিমঝিম এখনো মোহাচ্ছন্ন, ঘাড় কাত করলো।
রুবায়েত আর রিমঝিম নৌকায় বসে আছে। রিমঝিমের চোখে বিস্ময় আর ভালোবাসার ছায়া। বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে, রিমঝিমের মনে হল,এই মুহূর্ত যেন শুধুই ওদের জন্যই তৈরি হয়েছে। রুবায়েত চুপচাপ দেখছে রিমঝিমকে, ওর ভালো লাগছে রিমঝিমের মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তি।আর রিমঝিম দেখছে এই প্রকৃতিকে।হৃদয় আজ সিক্ত মনে মনে বললো, “ ডাক্তার সাহেব তুমি পেরেছো মন দিয়ে মন স্পর্শ করতে।”
সাইকেলে চেপে যেতে যেতে রুবায়েত, “ রিমঝিম, তুমি খুশি হয়েছো?”
“ অনেক!” একটু চুপ থেকে, তুমি আমার আত্মা পর্যন্ত স্পর্শ করে ফেলেছো। জানো মাঝে মাঝে দূরত্ব ভালো।
“কেন?”
“আরও কাছে আসার জন্য।”
কিছু বলে না রুবায়েত কিন্তু এই বিষয়টা ও নিজেও অনুভব করে। সুনামগঞ্জের সব কিছুই ওর এখন মারাত্মক ভালো লাগছে।
________________
রুবায়েত প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে, চারদিকে এখন মোটামুটি পানি। বর্ষার সময় গ্রামগুলোতে পানির আধিক্য বেশি থাকে। রুবায়েত হেডমাস্টার সাথে আলোচনা করছে, চেয়ারম্যানের সাথে করতে হবে। গ্রামের কিছু শিক্ষিত ছেলেকে ভাবছে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা শিখিয়ে দিয়ে যাবে। আর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে গ্রামবাসীর সাথে। প্রজেক্টর থাকলে ভালো হতো, এ বিষয়ে কথা বলতে এসেছে হেড মাস্টার সাহেবের সাথে। সমস্যা হচ্ছে এখানে ইন্টারনেট কানেকশন বেশি ভালো না। তারপরে উনি আশা দিলেন দেখা যাক কি করা যায়। খরচের বিষয়টা রুবায়েত নিজেই দেখবে বলেছে। আরো কিছু চিন্তা করেছেন এই গ্রামের মহিলা গুলোকে যদি কিছুর প্রশিক্ষণ দেওয়া যেত! উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ইন্টারনেটের সুবিধা একটা অন্তরায় বটে। হেডমাস্টার সাহেব খুশি হলেন,
“তুমি গ্রামে বেড়াতে এসেছিলে, কিভাবে আমাদের আপন করে নিলে! তুমি খুব ভালো একটা ছেলে। চলে যাবে ভাবতে আমাদের অনেক খারাপ লাগছে।”
রুবায়েত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ যেতে তো হবেই, কিন্তু ইনশাল্লাহ আমি গ্রামটাকে ভুলবো না। যে কোনো সুবিধা অসুবিধায় আমাকে স্মরণ করবেন।”
এখান থেকে বের হতে না হতেই, উত্তর দিকে হাওড় এলাকায় ডাক পরলো ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। রিমঝিমের মুখটা মনে পরছে কাল রাতে ডায়েরিতে লেখা রিমঝিমের কথা গুলো পড়ে পুলক অনুভব করেছে।
–—- “রিমঝিমের জীবনে একজন পুরুষদের অস্তিত্ব আছে যার বিচরণ রিমঝিমের রুহ থেকে কায়া অব্দি। রিমঝিম অন্য কাউকে ভালোবাসবে বিয়ে করবে এ ভাবনা ভাবার দু:সাহস কে রিমঝিম ঘৃনা করে। আই হেট ইউ।”
মনে মনে হাসলো, “কিন্তু ম্যাডাম, আই লাভ ইউ। তোমার এই স্বীকারোক্তি আমার খুব ভাল লেগেছে। এই কারনে হেট করাটাও খুব রোমান্টিক।”
হাওড় এলাকার বাড়িগুলো সাধারণত উঁচু জায়গায় তৈরি করা হয়, যাতে বর্ষাকালে বা বন্যার সময় পানি উঠলেও বাড়ি ডুবে না যায়। কাঠ এবং টিনের ছাউনির পাশাপাশি কিছু জায়গায় মাটির ঘরও দেখা যায়। পিলারের ওপর বাঁশ বা কাঠ দিয়ে মাচান তৈরি করে ঘর বসানো হয়, বিশেষ করে যারা হাওরের গভীর অংশে থাকে।
রুবায়েত সাইকেল নিয়ে ঢুকলো ভেতরে। চারপাশটা যেন এক অপরূপ জলজ জগত। এ এলাকাটিকে রুবায়েত বলে “মৎস্য পল্লী”,কারণ এখানকার অধিকাংশ মানুষই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিছু মাঝিও আছে, যারা নৌকা চালায়।এদের জীবন যেন পানি কেন্দ্রিক,নদী আর খালের পথ চেনে হাতের রেখার মতো। বর্ষাকাল, তাই পুকুর আর খালগুলোর পানি টলটলে, শাপলা-শালুকে ভরে উঠেছে চারদিক।
প্রতিটি বাড়ির পাশে দেখা যাচ্ছে নারিকেল, সুপারি, কলাগাছ কিংবা নিমগাছ সহ নানা গাছ। বাঁশের বেড়ায় ঘেরা বাড়িগুলো, মাঝে মাঝে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি সরল বেড়াও চোখে পড়ে। উঠোনে মুরগির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে নির্ভয়ে, খোলা মাঠে গরু আর ছাগল চরে বেড়াচ্ছে । বর্ষার পানিতে চলাচলের জন্য প্রতিটি বাড়ির সামনে বাঁশ আর কাঠের সাঁকো বানানো।গ্রামবাসীর ছোট ছোট বুদ্ধিমত্তা রুবায়েতকে মুগ্ধ করে।এ যেন বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
এখানকার মানুষগুলো সহজ-সরল, অতিথিপরায়ণ। রুবায়েতকে তারা খুব ভালোবাসে, তাদের অসুখ-বিসুখ, ব্যথা-প্যারার কাছে ও যেন ভরসার আরেক নাম।
তবুও আজ সে বিরক্ত। তার ডাক পড়েছে এক অপ্রীতিকর কারণে। হারুন নামের এক জেল সে তার স্ত্রী শেফালীকে সামান্য কথা-কাটাকাটির পর মারধর করেছে। শেফালীর মাথা ফেটে গেছে, সেলাই লাগবে। রুবায়েত সেই চিকিৎসার জন্য এসেছে কিন্তু তার চোখে বিরক্তি, রাগ। এই ধরনের সহিংসতা মেনে নিতে পারছে না।
“ঘর মানে আশ্রয়, নির্ভরতা। সেটা যদি এরকম নির্যাতনের জায়গা হয়ে যায়, তাহলে তো সমস্যা।” রুবায়েত বলল, শেফালীর মাথায় ব্যান্ডেজ দিতে দিতে। শেফালীর নজর নীচের দিকে, আরো মারের চিহ্ন অনাবৃত স্থানে।
গ্রামের কয়েকজন মাঝিও এসেছে খবর শুনে, মহিলারা মুখে আঁচল গুজে উঁকি দিচ্ছে। একটা জব্বর খবর পাওয়া গেছে সারাদিন গবেষণা করার জন্য।
বছর পঞ্চাশের গম্ভীর মানুষ হল ফরিদ মাঝি, “হারুনরে তো আগেই বহুবার কইছি, কিন্তু হুনে না। এইবার যদি কিচ্ছু না হয়, তহন অবস্থা অইব আরও খারাপ।”
এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আরেক জেলে, কামাল। সে বলল,”মাইয়া মানুষরো দোষ আছে, ছেলেডার লগে এত কিতা কইতাছে?”
এটা শুনে দরজার সামনে দাঁড়ানো মহিলারা অসন্তোষ প্রকাশ করে। একজন মুরুব্বী বলে ওঠে, “হ, হেইডাই তো! মাইয়ারা মুখ খুললেই অইল অপরাধ! জামাই মারলে বলি ও জায়গা বেহেস্তও যাইব !”
রুবায়েত রাগী দৃষ্টিতে তাকায় সবার দিকে, “ আপনারা একেবারেই মূর্খ, ধর্মটাও জানেন না। এগুলো বাজে কথা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুবায়েত, চারপাশে গাছের ছায়া, পাখির ডাকে মিলিয়ে গেলো দীর্ঘশ্বাস। পুকুরে শাপলার পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন কান্না থেমে চুপ করে আছে। কিন্তু রুবায়েত জানে, এভাবে চুপ থাকলে চলবে না। সামনে বসে আছে অপরাধী।
হারুন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো। মাথা নিচু, তারপর হঠাৎ করেই কান্নাভেজা গলায়,
“ভুল অইছে ভাই, ভুল অইছে… শেফালী কত কিছু সহ্য করছে আমার লাইগা। কিন্তু আমি… আমি হেইডা কেমনে জানি বুঝতেও পারি নাই ঠিকমত!”
রুবায়েত শান্ত স্বরে বললো,
“বুঝছো, এইটা ভালো কথা। কিন্তু শেফালীর মাথার ব্যান্ডেজ তোমার অনুশোচনায় ঠিক হবে না।ঘর শান্তির জায়গা,আর স্ত্রী হলো সঙ্গী।সে আলাদা একজন মানুষ। তারও সম্মান আছে। মাফ চাইবা বুঝতে পারছ?”
হারুন মাথা নিচু করে,
“সেডা চামু তয় শাস্তি পাইলে ভালো হয়, ভাইজান।”
রুবায়েত কিছু বলে না ও কোন সমাজ সংস্কারক নয়। যা বলার বলেছে উঠে উঠানে গেল। চলে যাবে তখনই হঠাৎ….
শ্যামলীর জামাই মধু সামনে পরলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুবায়েত বলল, “ তুমিও শ্যামলীকে মারো মাঝেমধ্যে, শ্যামলী মারা গেলে সংসার নিয়ে কোথায় দাঁড়াবা ভাবো কখনো?”
মধু কাচুমাচু হয়ে যায়, “ আর হইব না ভাইজান।”
চারপাশে হাওয়া থেমে আসে।উঠানে দাঁড়ানো সবাই চুপ। হুট করেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, সেদিকে খেয়াল নেই। দূরের পুকুরে শাপলার পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ করে পড়ছে।
নিরবতা ভেঙে ফরিদ মাঝি বলে উঠে, “বুঝলা তোমরা,ঘরের মায়া থাকলে, ঘরে আগুন লাগে না। ঘরের আগুন বড় আগুন।”
কথাটা রুবায়েতের চেয়ে আর কে উপলব্ধি করতে পারে ভালো। কি চমৎকার কথা বললো এই লোক।
___________
রিমঝিম এর মন অনেক ভালো, অতিরিক্ত ভালো। যেন নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে। ইন্ট্রোভার্ট জামাইটাকে বুঝতে পারছে। তারপরে সুন্দর সুন্দর সময় কাটাচ্ছে দুইজন। কিছু মুহূর্ত মনে করে লাল হয়ে গেল একদম। মনে হচ্ছে যেন হানিমুনে এসেছে। রুবায়েতের গতরাতের খুলে রাখা গেঞ্জিটা হাতে নিতেই রিমঝিমের একটু অবাক লাগলো। নিজে নিজেই বলল, “ গেঞ্জিতে মেহেদির দাগ কেন? “ তারপরে কাঁধ ঝাকালো। শ্যামলী এখন আসেনি, কয়েকটা কাপড় কিন্তু নিজেই ধুয়ে ফেলবে ভাবছে।
উঠানের দিকে নজর গেল, কি সুন্দর পরিবেশটা। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। গিট্টুর নানী এসেছিল একটু আগে, মাখানো আম দিয়ে গেছে। এখন খাওয়ার সময় নেই, ঘড়ি দেখলে বেলা বারোটা বাজে।
শ্যামলী হাসিখুশি মুখে তখনই আসলো।
“ভাবী, আজ্কে একটু দেরি হইয়া গেল। ডাক্তার সাব তো আমরার দিকও গেছিলেন। আরে আফা, আপনে তো একদম ফেরেস্তা পাইছেন, ফেরেস্তা!”
রিমঝিমের মুখে কৌতুক ফুটে উঠে, “ সে ডাক্তার চিকিৎসা দিবেই, এতে ফেরেস্তার কি হলো?” মনের খুশি চেপে রাখে।
শ্যামলী তখন ঠাস করে নিচে চার হাত পা মেলে বসে গেল। সব ঘটনা বিস্তারিত বর্ননা করে তারপর বললো, “জানেন না! শেফালীর জামাই মাফ চাইছে! ভাইজানের কথা অইল না, ওটা কেডা ফালায় রাখে কওন?”
কথাগুলো শুনতে অবশ্য রিমঝিমে ভালো লাগছিল। গর্ব হচ্ছিলো, মনে মনে ডাক্তার রুবায়েতের ভক্ত হয়ে যাচ্ছে যেন। যেটা ঢাকায় উপলব্ধি করে নাই। উঠে রান্নাঘরে গেল,
“ চা খাবে শ্যামলী।”
“ভাবী আমি খাব।” ময়নার হাসিখুশি কণ্ঠ শোনা যায়। ফিরে তাকায় রিমঝিম, শ্যামলীর চোখে অপ্রসন্নতা খেয়াল করে।
ময়না এগিয়ে আসে, “ভাবি, দেহেন তো, হাতে মেহেদি দিছি, ভালো লাগতাসে?”
রিমঝিমের মাথা চক্কর দেয়। কথা খুঁজে পায় না খানিক। নিজেকে শান্ত করতে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে থাকে। আনমনে হাত পুড়িয়ে ফেলে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভাসছে, ময়না আর রুবায়েত হাসাহাসি করছে।
ময়নাকে বিদায় দিয়ে রান্না শেষ করে, রিমঝিম বৃষ্টি দেখতে দেখতে কান্না করে দেয়। সকালে তো মনটা কত ভালো ছিল। বুকের মাঝে কিসের কষ্ট? রুবায়েত ওকে ধোঁকা দিচ্ছে? নাকি ময়না মিথ্যে বলছে? দুইটা ডায়েরি টেনে নিল, যদি মন শান্ত হয়।
প্রথম ডাইরিটা খুলেই রিমঝিমের মাথায় যেন কিছু আঘাত করল। হ্যাঁ ডায়েরিতে সেই গন্ধ যেই গন্ধ ময়নার মায়ের বানানো বিশেষ তেলে পাওয়া যায়। ভাল করে দেখে ডায়েরির পাতায় কয়েক ফোটা তেলের দাগ। হঠাৎ জলের মতো সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। ডায়েরিটা ময়না নিয়েছিল, পড়েছে, রিমঝিমের সন্দেহ প্রবণতা সম্পর্কে জানে। তাই সেটাকে উসকে দিচ্ছে। যেন রিমঝিম আর রুবায়েতের মধ্যে আবার ঝগড়া হয়।
ডায়েরি বুকে জড়িয়ে রিমঝিম ফিসফিস করল, “ ময়না যে নোংরা খেলায় নেমেছো তোমাকে আমি জিততে দিব না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আমার চোখটা খুলে গেছে। না হলে আমি আবার রুবায়েতকে হারিয়ে ফেলতাম। বাইরের বৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ময়না চেষ্টাগুলো চমৎকার ছিল, কিন্তু আল্লাহ অন্যরকম পরিকল্পনা করেছেন। না হলে এখনই ডাইরিটা কেন হাতে নেবে রিমঝিম। ডায়েরি রেখে দৌঁড়ে উঠানে যায়।
রুবায়েত সাইকেল নিয়ে উঠানে প্রবেশ করে অবাক হয়ে যায়, রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজছে। বাড়ির চারদিকে গাছ থাকায়, আশেপাশ থেকে দেখার সম্ভাবনা নেই। খুব ভালো লাগছিল। আস্তে করে পেছনে দাঁড়ালো,
“আমাকে ছাড়া বৃষ্টিতে ভিজছো যে!”
রিমঝিম ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালো, “ আই লাভ ইউ…! হাসছে অনাবিল।
ওর হাসির দিকে দৃষ্টি রেখে রুবায়েত বললো, “ ডায়েরিতে তো লিখে রেখেছো আই হেট ইউ।”
রিমঝিম হাসে, বৃষ্টির পানি হাতের আজলায় নিয়ে রুবায়েতের মুখে ছুড়ে মারে, “ বোকা ডাক্তার, সেই হেট ইউর মাঝেই লাভ ইউ লেখা আছে বড় বড় করে।”
রুবায়েত এবার জড়িয়ে নেয় রিমঝিম কে, “আমি জানি।”
রিমঝিমের কন্ঠ উঠানের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ল,
–যদি ডেকে বলি এসো হাত ধরো
চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে
এসো গান করি মেঘো মল্লারে
করুনাধারা দৃষ্টিতে
আসবে না তুমি জানি আমি জানি
অকারনে তবু কেন কাছে ডাকি
কেন মরে যাই তৃষ্ণাতে
এইই এসো না চলো জলে ভিজি
শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে…..
রুবায়েত জড়িয়ে রাখা অবস্থায় ফিসফিস করে, “ এই তো আসলাম।শুধু শ্রাবণের রাত না, সব রাতেই রিমঝিম বৃষ্টি কি আমাকে ভেজাবে ভালোবাসায়?”
বৃষ্টির শব্দ রিমঝিমের হাসির শব্দ একাকার হয়ে তৈরি করল এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনা।
চলবে…
রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব –১১
বৃষ্টির বেগ এখন কম। রুবায়েত চশমা খুলে ফেলেছে। চশমা চোখে না থাকলে ওকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। রিমঝিম এগিয়ে গেল, রুবায়েতের চোখে চোখ রেখে বলল,
“জানো, আমি ডা:রুবায়েতের ভক্ত হয়ে গেছি।” রিমঝিম হাসে।
“আর তোমার রুবায়েত সে কি দোষ করলো?” রুবায়েত চোখ পিটপিট করল।
“সে দোষ তো করে নাই কিন্তু ডা:রুবায়েতের মত পারফেক্ট না।” ঠোঁট উলটে দিল রিমঝিম, হাতের আজলায় বৃষ্টির পানি, সেগুলো রুবায়েতের মুখে ছিটিয়েই ঘুরে দাঁড়ালো।
রুবায়েত মুখ ঝাড়া দিল, পেছন থেকেই ওকে জড়িয়ে নিল, “রিমঝিমের রুবায়েত পারফেক্ট হতেও চায় না, একটা মানুষের কাছে না হয় আমার ভুলের হিসেব জমা থাকুক।” পুকুরের জলে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে সে দৃশ্য বড় অপূর্ব।
রিমঝিম রুবায়েতের হাতে হাত রাখলো, ” ভুল গুলো একদিন রিমঝিম ঠিক মুছে দিবে…”
ওর গালে গাল ঠেকিয়ে, ” রুবায়েত আবার নতুন ভুল করবে…”
রিমঝিম খিলখিল করে হেসে ফেলে,..”আসছে আমার ভুলপুরুষ।”
“ভুল সুদ্ধ যেমন হই — শুধুই তোমার এটা সত্যি।”
রিমঝিমের হাসি আর বৃষ্টির টুপুরটুপুর শব্দ ভেসে বেড়ায় চারিদিকে।
বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেছে রুবায়েতের, শব্দ করে হাঁচি দিচ্ছে। বিছানায় আধ শোয়া হয়ে আছে। রিমঝিম আদা চা বানিয়ে নিয়ে আসলো।
“এটা খাও ভালো লাগবে।”
“ধন্যবাদ।” চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আরও একটা হাঁচি দিল। “ জ্বর আসবে মনে হচ্ছে।”
রিমঝিম ব্যস্ত হয়ে মাথায় হাত দিল, ইশ! আচ্ছা আমি.. আমি থার্মোমিটার নিয়ে আসি তুমি চা খেয়ে নাও।”
রুবায়েত রিমঝিমের হাত ধরলো, “এত জ্বর না তুমি পাশে বস, আমার প্যারাসিটামল।”
“আমি প্যারাসিটামল?” রিমঝিম ভ্রুঁ কুঁচকে নিল।
রুবায়েত ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, “শুধু কি তাই? তুমি আমার সেকলো, হিস্টাসিন, এমোডিস……”
“হয়েছে থামো…কিছুক্ষন পর বলবা কৃমির ঔষধ ছি:” মুখ কুঁচকে নেয়।
“ডা:রুবায়েতকে এত ভালো লাগার কারন কি?” ঠোঁট টিপে হাসে রুবায়েত, ঘরের পর্দা হালকা বাতাসে কাঁপছে।
“কারণ সে শুধুই রুগির সেবা করে না, তার কষ্টে ব্যথিত হয়, তার কষ্টের কারণ লাঘব করতে চায়। আজ না শ্রামলী তোমার এত প্রশংসা করলো!” রিমঝিমের গলায় একই সাথে আনন্দ এবং একটু আফসোস ঝরে পড়ল।
রুবায়েত ওর চুলে হাত বুলাতে লাগলো, “ আর তোমার রুবায়েত?সে কি শুধু কষ্টই দেয়?” কথাগুলো বলার সাথে সাথে রুবায়েত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রিমঝিম চোখ তুলে তাকালো, “ আমার রুবায়েত, কষ্ট দেয়, কষ্ট মিটায় কিন্তু নিজে কিছু বোঝেনা।”
“বাপরে! কি সব বল,ফিলোসফির ছাত্রী ছিলে নাকি? এখন একটা গান শোনাও।”
“ধুর, ছাড়ো, আমি খাবার গরম করি।” মুখে হাসি নিয়েই প্রস্থান করে রিমঝিম।
রান্নাঘর থেকে গান ভেসে আসছে……
“তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি।
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি।
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে।
বলো কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি।
সব চিঠি, সব কল্পনা জুড়ে,
রং মিশে যায় রুক্ষ দুপুরে।
সেই রং দিয়ে তোমাকেই আঁকি।
আর কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি।”
রুবায়েত গান শুনতে শুনতে ভাবলো, আমিও বা কি করে বোঝাই…আমিও আমার মত ভালোবেসেছি….
________________
সারারাত বৃষ্টির পর, বৃষ্টি থেমে গেছে ভোরে,কিন্তু টিনের চালের ধার দিয়ে এখনো ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। বারান্দার কর্নারে রিমঝিম দাঁড়িয়ে, রুবায়েত মাত্র বের হয়ে গেল। কি সব নাকি কর্মশালার আয়োজন করবে…মুখে হাসি ফুটে উঠলো রিমঝিমের গ্রামের মানুষ গুলোর প্রতি বেশ অনুরক্ত হয়ে গেছে রুবায়েত। ওর হাতে ধরা ডায়েরি। ভেজা চুলের ডগা দিয়ে পানি গরাচ্ছে, ঠোঁটে থমকে আছে এক রহস্যময় হাসি।ময়না দৃষ্টি সীমার মধ্যে আসলে সে হাসি বিস্তৃত হল।
ময়না সালোয়ার উঁচু করে আসছে, মুখে হাসি। বয়স কত হবে সেদিক তাকিয়ে রিমঝিম ভাবে মেরে কেটে সতেরো? একটা নি:শ্বাস বের হয় বুক চিরে। –
কাছাকাছি এসে ময়না মিষ্টি করে বল উঠে,
“ভাবী… কী করছেন এখানে ? বৃষ্টিতে ভিজা গেছেন তো?”
রিমঝিম চোখ না তুলে, ঠাণ্ডা গলায়, “ ভিজি নাই, গোছল করলাম মাত্র, কাল ভিজেছিলাম তোমাদের ডাক্তারের সাথে।”
ময়না হাসতে চেষ্টা করে কিন্তু চোখে জ্বলে ওঠা হিংসা ঢাকতে ব্যর্থ হয়,
“তাই! ভালা।”
বারান্দায় এসে রিমঝিম এর পাশে দাঁড়ায় ময়না, রিমঝিম জিজ্ঞেস করে, “কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলে তুমি?”
“ক্লাস নাইন।” ময়নার গলায় একটা কষ্ট ফুটে ওঠে, “ ভালা ছাত্রী আছিলাম ভাবী।”
রিমঝিম ধীরে মুখ ঘুরিয়ে তাকায়, চোখে গভীরতা। এক রাশ ঠান্ডা বাতাস দুইজনকে ছুঁয়ে যায়। একজন ভাগ্যবতী, একজন দুর্ভাগা। কিন্তু তাই বলে, অন্যের কিছুতে নজর দেওয়া জায়েজ হয়ে যায় না।
“ তুমি আবার পড়াশোনা শুরু করছ না কেন? তোমার মাথার বুদ্ধি গুলিকে ভালো কাজে লাগাও।”
ময়না হতবুদ্ধি হয়ে তাকায়, “ কি.. কি হইছে ভাবী? এরাম কথা কেন?”
“ময়না তুমি জানো lieutenant ইংরেজি শব্দটা লিখতে, একটা বুদ্ধি কাজে লাগাতে হয়, সেটা হল মিথ্যে তুমি দশ পিপড়ে।” রিমঝিমের দৃষ্টি ময়নার উপর স্থির। মিথ্যে শব্দটা শুনে ময়না ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।
“কি কইতাছেন, বুঝি না কিছু।” মিথ্যে শব্দটা শুনেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল ঠোঁট কাঁপতে লাগলো, ময়না নজর এদিক সেদিক দেয়।
“শুন ময়না একটা রুমাল, এক ফোটা মেহেদীর দাগ দিয়ে যে সম্পর্ক মোছার চেষ্টা করেছিলে, তা অনেক গভীর অনেক পবিত্র।”
ময়না নিরুত্তর ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। একটা দমকা হাওয়া উঠে আসে, রিমঝিমের চুল উড়তে থাকে।
রিমঝিম এক চিলতে হাসি দেয়, ময়নার হাত ধরে স্পষ্ট করে, “চেষ্টা চমৎকার ছিল ময়না।কিন্তু লাভ হল না। এবার নিজের জীবন গোছাও, পড়াশোনা শুরু কর। যার পেছনে ছুটছো, সে মরীচিকা।” তারপর হালকা গলায়, “চা খাবে?”
ময়না কিছু বলে না, ধরা পড়ে গেছে বুঝে ফেলল। এতে ওর জেদ যেন আরও বেড়ে গেল। মনে মনে বলল, মরীচিকা হলে আমি সেটাকে সত্যি বানাবো।কিছু না বলে আস্তে করে বের হয়ে গেল!
রিমঝিম চা বানাচ্ছে তক্ষুণি ফোনে একটা ম্যাসেজ আসলো,
“ ম্যাডাম আপনার ডাক্তার তো, স্কুল প্রাঙ্গণে কি জানি করছে আজ বিকেলে ! শুনলাম গ্রামের অনেক মেয়েরা আসবে। এভাবে ছেড়ে দিবেন না, তাকে আঁচলে বাঁধতে চলে আসুন..”
ম্যাসেজ পড়তে পড়তে রিমঝিম হেসে ফেলল।
______________________
সুনামগঞ্জের এই প্রত্যন্ত গ্রাম রুবায়েতকে খুব আপন করে নিয়েছে। তবে গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও, ওকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা আর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সংকট। তাই স্কুলের হেডমাস্টার আর চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে স্কুলের বড় ক্লাস রুমে একটা কর্মশালার আয়োজন করেছে স্কুল ছুটির পর। টানা করার ইচ্ছে…
“এই মানুষগুলার কাছে নিয়মিত চিকিৎসা পৌঁছায় না। ইদানীং বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়েছে তবে সব অসুখ হলেই ডাক্তারের কাছে ছোটার প্রয়োজন নেই। কিছু প্রাথমিক বিষয় শিখে নিলে অনেক কিছুই সহজ হবে।” — স্কুলর ক্লাস রুমে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রুবায়েত। বৃষ্টির পানির জন্য স্কুল প্রাঙ্গণে আয়োজন করা সম্ভব হয় নি
এক যুবক বলে উঠল, “ডাক্তার ভাই, আপনি যেইভাবে ব্যাখ্যা করতাছেন, আমরা অতো বুঝি না। একটু সহজ কইরা বলেন না?”
রুবাইয়েত হেসে বিষয়গুলো আরও সহজ করে বোঝাতে শুরু করলো, কিভাবে হাত ধুতে হয়, জ্বর হলে কী করতে হয়, খাওয়ার আগে-পরে পরিষ্কার থাকা কেন জরুরি, সাপে কাটার বিষয় গুলো ইত্যাদি।
গ্রামের স্কুলে আয়োজন করা এই ছোট্ট কর্মশালায় ছিল পঁচিশ-তিরিশ জন মানুষ। কেবল পুরুষ নয়, মহিলারাও এসেছে শিখতে। চেয়ারম্যান, হেডমাস্টার এর পাশে অপ্রসন্ন মুখে বসে আছে।
এক পর্যায়ে রুবায়েত বলো,“আপনাদের মাঝে যদি কেউ স্বাস্থ্য বিষয়ে একটু প্রশিক্ষণ পায়, তাহলে পুরো গ্রাম উপকার পাবে। এজন্য আমি চাই, আপনাদের মধ্য থেকে দুইজন যুবককে নিজ খরচে প্যারা মেডিকেল পড়াই। যাতে তারা ফিরে এসে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে পারে।”
একটা হট্টগোল পড়ে গেলো। কেউ খুশি, কেউ বিস্মিত। এদের জন্য কেউ এভাবেও ভাবতে পারে? তবে প্যারা মেডিকেল কি কেউ বুঝতে পারলো না বিশেষ।
এক মাঝবয়সী লোক বলল, “ডাক্তার সাব, আপনার মত মানুষ দুনিয়াত এখন আর নাই কইলেই হয়!” চোখে জল চিকচিক করছে।
আরেকজন তরুণ বলল, “আমরা আগ্রহী, কিন্তু এটা কি বিষয়? পইড়া কি কামে লাগবো, সেইডা বুঝি না।”
রুবায়েত একটু হেসে সকলকে শান্ত করলো তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“কথা হল স্বাস্থ্যসেবা যেখানে ভালো, সেখানে মানুষের কষ্ট অনেক কম। আমরা অনেক সময় সামান্য জ্বর, কাশি বা আঘাতেও বড় সমস্যার মুখে পড়ি, শুধু চিকিৎসার অভাবে। অথচ যদি আমাদের নিজের মাঝেই কেউ একটু প্রশিক্ষণ পায়, তাহলে এসব ছোটখাটো সমস্যা সহজেই সামাল দেওয়া যায়।” শেষ করে একটু হাসলো।
“ কেন এরকম ভাবছ পড়ে কি হবে? আমি বুঝিয়ে বলি, আপনাদের মধ্য থেকে দুইজন যদি প্যারা মেডিকেল কোর্স করে তাহলে তারা জ্বর, সর্দি, রক্তচাপ, সাপে কাটা,ডায়াবেটিস বা সাধারণ চিকিৎসা এসব করার যোগ্যতা তারা অর্জন করবে। কেউ দুর্ঘটনায় পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারবে, গর্ভবতী নারীর সেবা করতে পারবে। এমনকি, ওষুধ বুঝে দেওয়া, স্যালাইন দেওয়া, ব্যান্ডেজ করা, প্রেসার মাপা এসবও শিখে নিবে। ভাল হবে না বিষয় টা?
গুঞ্জন উঠলো “খুব ভালা হইবো…”
রুবায়েত হাসলো, “আমি খরচ দিব, আপনারা শুধু আগ্রহ দেখান।আর ফিরে এসে নিজেদের মানুষদের পাশে দাঁড়ান। এইটুকুই আমার চাওয়া।”
তার কথা শুনে লোকজন এবার একটু চুপচাপ হয়ে গেলো।অনেকের চোখে পানি, কই এভাবে তো এদের জন্য কোনদিন কেউ ভাবে নাই। ডাক্তার সাহেব যেন এদের আত্মা কিনে নিল।
রুবায়েত শান্তভাবে ব্যাখ্যা করলো, “আপনারা যদি এই কোর্সে প্রশিক্ষিত হন, তাহলে হালকা সমস্যা হলে নিজেরাই সামলাতে পারবেন। বড় সমস্যা হলে সঠিক সময়ে বাইরে নিতে পারবেন।”
এই কথা শুনে দুইজন যুবক রাজি হলো— রফিক আর হাসান। তারা কথা দিল, পড়ালেখা শেষ করে ফিরে আসবে গ্রামে।
রুবায়েত সবার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করলো “আমি হয়তো রইবো না, কিন্তু চাই এখানকার কেউ একজন হোক গ্রামের ডাক্তার।”
রিমঝিম স্কুল ঘরের জানলা ধরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টি দিচ্ছিলো। এই মানুষটা এত ভালো কেন? শুধু ওকেই বুঝে না তাছাড়া… রুবায়েত সেদিক তাকালো। মুখে হাসি ফুটে উঠলো বিরবির করলো, “ আমার বৃষ্টি হাজির।” হঠাৎ খেয়াল করলো চেয়ারম্যান ও সেদিক তাকিয়ে। ওর চোয়াল শক্ত হল। বের হয়ে গেল দ্রুত।
“ডা: রুবায়েত অটোগ্রাফ প্লিজ।” রিমঝিম খাতা কলম এগিয়ে দিল।
“ম্যাডাম আপনাকে অন্যভাবে অটোগ্রাফ দিব, বাসায় গিয়ে।” রুবায়েত হাসলো কিন্তু মনের মধ্যে কিছু যেন খচ খচ করছিলো।
_________________
এদিকে এই গ্রামের সুখী দম্পতি সালাম ও আলতা। দুই বছরের দাম্পত্য জীবন তাদের। আল্লাহ তাদের সন্তান দেন নাই কিন্তু সুখ দিয়েছেন। হাওরের পাড়ে, বাঁশঝাড় ঘেরা টিনের চালের ছোট্ট ঘরে থাকে সালাম আর আলতা। দারিদ্র্য থাকলেও নেই ভালোবাসার অভাব। সালামের তো মনে হয় তার ভাঙা ঘরে আলতা এক টুকরা চাঁদ। কিন্তু সেকি জানে চাঁদে নজর লেগেছে…
ভোরবেলা আলতা খালি পায়ে পুকুর পাড়ে যায়, মুখে হালকা হাসি।
সালাম তক্ষুনি জেগে উঠে, হাক লাগায় “আরে আলতা, চা বানাইছো?”
আলতা হেসে বলে, “তোমার লাইগা মিঠা দুধ রাইখা চা দিছি, তাড়াতাড়ি খাইয়া খামার চাইড়া আইসো।”
খামার মানে তাদের নতুন স্বপ্নের শুরু। চেয়ারম্যান মজিদ ব্যাপারীর কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছে সালাম। সেই টাকা দিয়া গোটা বিশেক মুরগি কিনে, তাদের জন্য একটা বাঁশের ঘর, আর একটু স্বপ্ন কিনেছে।
তাই হাওরের বাতাসে এখন মুরগির ডাক, আলতার হাসি, আর সালামের পরিশ্রমের গন্ধ মিশে থাকে। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর হালকা খুনসুটি। কিন্তু সুখের মাঝেই জমে উঠে কালো মেঘ। চেয়ারম্যান মুজিদ ব্যাপারী, বয়স পঞ্চাশের উপরে হইলেও চাহনিত কাম। তার নজর পড়ে আলতার উপর।
একদিন মাঝরাতে আগুন লাগে খামারে। দূরে দাঁড়িয়ে হাসে হাসমত।খামারটা পুড়ে ছাই সাথে সালাম আর আলতার স্বপ্ন । আগুন কে লাগিয়ে থাকতে পারে? গাঁয়ের মানুষ কি এত বোকা, বুঝতে পারলেও চুপ থাকে। মেরুদণ্ডহীন কেঁচোর জীবন এদের।
পরদিন মজিদ ব্যাপারী ডেকে পাঠায় সালামকে তার বৈঠক ঘর, যা অনেক মানুষের হাহাকারের সাক্ষী।
“ঐ সালাম, টাকা ফেরত লাগবো। দুই সপ্তাহর মধ্যে।”
সালাম হাত কচলায়, “ হুজুর খামারের খবর তো….
“ ওসব জেনে আমার কি লাভ? না পারলে… আলতারে এক রাতের লাইগা পাঠাইছোস আমার কাছে।” হুক্কা টানে জোরে জোরে।
সালাম থতমত খায়। এ খবর কারো অজানা না, সবাই না জানার ভান করে নিজেদের এই ঝামেলা থেকে বাঁচায়। ও শিউরে উঠে, চুপ থাকার পরিনাম যেন আজ ওর সামনে। মনে ক্রোধ, চোখে ঘৃনা তবুও মাথা নিচু করে বলে, “চেয়ারম্যান সাব, আমরার সব শেষ। আলতারে মইদ্দে দিয়েন না। এই কথা আর কইয়েন না।”
মজিদের চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি , “ভাবিস খানিক, সময় আছে।”
ঘরে ফিরে সালাম আলতার পায়ের কাছে বসে কাঁদে। আলতা চুলে হাত বুলিয়ে বলে “ভয় নাই। আল্লাহর উপর ভরসা। ”
গভীর রাত আলতা উঠে দাঁড়ায়, ভালবাসার মানুষের মুখে আদর আঁকে, ও জানে যার বদ নজর ওর উপর সে ওকে ছাড়বে না। ওর ভালো মানুষ জামাই কিছুই করতে পারবে না। এই হাওড়ে ভেসে বেড়ায় কত নারীর কান্না.. এসব আলতা জানে। চোখে পানি নিয়ে ফিসফিস করে–”আমার খামার পোড়াইছে, আমার ইজ্জত নিয়া খেলতে চায়ছে। এই জীবন আমি চাই না।”
#রিমঝিম_বৃষ্টি
#কাজী_জেবুন্নেসা
চলবে…..