রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
১২
নিশুতি রাত, হাওরের পাড়ে ঘুমিয়ে আছে নিস্তব্ধতা, শুধু দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক শোনা যায় হালকা করে। সেই নিস্তব্ধতা চিরে, ধীরে ধীরে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যায় আলতা,
গায়ের আঁচল কাঁধে টেনে নেয়, সালামের মুখের দিকে একবার ফিরে তাকায়। ও জানে মানুষটা বিপদে পরেছে ওর কারনেই। একবার ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায়,তারপর নিঃশব্দে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।
পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখানে সকালবেলায় সে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতো। কিন্তু আজ তার পা কাঁপছে, চোখ দুটো দিয়ে জল গড়াচ্ছে। নীরবে আকাশের দিকে তাকায়, তারপর নিজের আঁচল নামিয়ে নেয়, তাতে কেরোসিন ঢালে। বুকের ভেতর ভয়, রাগ, অপমান আর অসহায়ত্ব একসাথে জমে আছে, আর নিতে পারছে না, এই শরীর অঙ্গার হোক আজ। নারী দেহ…শেষ হোক এই দেহ।
সালাম হঠাৎ নড়ে উঠে, স্বভাব মত বিছানায় হাত দিল, আলতা কই?ধরমর করে উঠে বসলো…বাইরে বের হয়ে দেখলো..!
আলতা আগুন ধরায় নিজের গায়ে।
সালামের চিৎকারে যেন জেগে উঠে গ্রাম। সালাম দৌঁড়ে আসে, পুড়ে যাওয়া আলতাকে বুকে জড়িয়ে নেয়, পুকুরে ঝাপ দেয় কাল বিলম্ব না করে। সালাম চিৎকার করে কাঁদে। নিজেও খানিক দগ্ধ হয়।
“এইডা কী হইল আলতা, কি করলি!”
____________________
রুবায়েতের মাথায় অনেক চিন্তা, ডাক্তারি করছে বেশিদিন না।প্রথম, প্রথম বেতন বেশি পাওয়া যায় না। ফ্ল্যাটটা নিজেদের হওয়াতে রক্ষা। এদিকে গ্রামে তো বলে দিল দুজনে খরচ চালাবে পড়াশোনার, কিন্তু কিভাবে? নিজের বড় ভাই বন্ধুদের সাথে কথা বলেছে, সবাই আশ্বাস দিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইশ! অনেক টাকা থাকতো ওর। শুরু যখন করেছে শেষ হবে ইনশাল্লাহ, এই পর্যন্ত ঠেকে নাই। এসব ভাবতে ভাবতে কপালে অনেক গুলো ভাজ পরে গেল।
রিমঝিম তখন থেকে দেখে যাচ্ছে রুবায়েত কি যেন ভাবছে। চুড়ির শব্দ করলো, নাহ! ভদ্রলোকের কোন বিকার নেই।পাশে বসে কাঁধে মাথা রাখলো, “ কে জানি আমাকে বাসায় এসে অটোগ্রাফ দিতে চেয়েছিল? আমার জানি কার ডাইরি হওয়ার কথা ছিল? অথচ এই পুরো বাড়িতে এখন আমি একদম একা।”
রুবাইয়াতের ধ্যান ভাঙলো, “সরি।” ম্রিয়মান কন্ঠে বলল।
“কি হয়েছে তোমার?” রিমঝিলে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
“ডাক্তারদের অনেক পয়সা, জানো এ কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। ডাক্তারদের টাকা পয়সা হয় ঠিকই, একটা নির্দিষ্ট সময় পর।”
“ওরে বাবা আজকে এতো টাকা-পয়সার হিসাব?” রুবায়েতের এক হাত নিজের হাতে তুলে নেয়।
রুবায়েত পাশ ফিরে, রিমঝিমের চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়, কি সুন্দর ঘ্রান, এই মেয়েটা খুব পরিপাটি থাকে সব সময়। এই যেমন এখন কি সুন্দর একটা সালোয়ার পরেছে। চুল আঁচড়ে নিয়েছে, হালকা পারফিউম এর ঘ্রান গায়ে। “ কিছু কথা তোমার জানা প্রয়োজন, বিশেষ করে আমার টাকা পয়সার। আমি গ্রামে এসে একজনের ঋণ শোধ করেছিলাম লাখ খানের টাকা। আমি একা দেই নাই, ভাইয়ার যাকাতের কিছু টাকা ছিল আর আমার দুইটা মিলিয়ে দিয়েছি। মানুষের ঋণ শোধ করা অনেক বড় ইবাদত, যাকাতও আদায় করা যায় মানুষের ঋণ শোধ করে।”
রিমঝিম ওর হাত ধরে শব্দ করে একটা আদর দেয়, “ কি সুন্দর কাজ, মা শা আল্লাহ।”
রুবায়েত হাসে, স্ত্রী হিসেবে মাথা ঠান্ডা থাকলে রিমঝিম একদম অসাধারণ, ছোট ছোট স্পর্শ, কথা দিয়েই মন জয় করে নেয়। “ এখন কাল তো শুনলা কি ওয়াদা করলাম।”
“তো?” রিমঝিমের নির্বিকার কন্ঠ। ওড়নাটা কাধে তুলছে।
“তো, ম্যাডাম এত টাকা কই পাব? আপনার বিরহে তো চাকরি ছেড়ে গ্রামবাসে এসেছি… একাউন্টের টাকাও প্রায় শেষ।” মুচকি হাসে রুবায়েত চশমা ঠেলে নাকের উপর উঠায়।
রিমঝিম কিছু বলে না, খানিক চিন্তা করে। তারপর কানের ছোট ঝুমকাটা খুলে ফেলে, “ এটা নাও, এটা বিক্রি করে….!
রুবায়েত ওকে কথা শেষ করতে দেয় না, হাত থেকে ছোঁ মেরে দুল দুইটা নিয়ে ওর কানে পরাতে পরাতে বলে, “ এত বড় হাতেম তাঈ হই নাই যে বউ এর দুল বিক্রি করে দিব তাও যেটা তার বাবার দেওয়া।” দুল পরাতে পরাতে রিমঝিমের চোখের দিকে তাকায়, কাজল দিয়েছে খুব হালকা, “ তোমার অটোগ্রাফ তো নাও নাই।”
রিমঝিম রুবায়েতের চোখের দিকে তাকায়, এই চোখের ভাষা ওর মুখস্ত, আরেকটু সরে আসে প্রিয় পুরুষের কাছাকাছি, রুবায়েতের নি:শ্বাস এখন ওর মুখে বারি খাচ্ছে।
দরজায় তক্ষুনি জোরে জোরে ধাক্কাধাক্কি। রুবায়েত ভয় পেয়ে যায়, রাত সবে দশটা, গ্রামের জন্য এখন তো অনেক রাত। “ তুমি ঘরে থাকো, আমি দেখছি।”
সালাম, আলতা রুবায়েত, রিমঝিম আরো দুই একজন যখন হাসপাতালে পৌঁছালো, তখন রাত বারোটা। রুবায়েত চেক করে দেখেছে আলহামদুলিল্লাহ আলতার শ্বাসনালী পুড়ে যায়নি, পোড়া রোগীদের এটাই মারাত্মক। তবে মুখের এক পাশ পুড়েছে খানিক চুল। এবং শরীরের সামনের অংশ। রিমঝিমকে রেখে আসতে পারে নি, সাহস পায়নি।
হাসপাতালে আনলে জরুরি চিকিৎসা শুরু হয়। আর জেরা চলে, সালাম থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে সবকিছু—খামার পোড়ানোর কথা, মজিদের প্রস্তাব বলতে বলতে ভেঙে পরে যেন। “
“মোর আলতা কেমনে চিন্ত করল যে মই ওরে ওই শয়তানের লগে পাটাইতাম?”
রুবায়েতের চোখ লাল হয়ে যায়।গ্রামের যে দুইজন সাথে ছিল তারা নজর এড়ায়। রিমঝিম হাসপাতালের বেঞ্চে বসে কান্না করেই যাচ্ছে। আলতাকে ও চিনে না তবুও এত খারাপ লাগছিলো। ভাবছে কেন গায়ে আগুন দিল মেয়েটা? স্বামী তো মনে হলো অনেক ভালো, তবে?
রুবায়েতের ভেতর একটা ক্রোধ দলা পাকাচ্ছে, কত বড় অমানুষ, দৃষ্টি গেল দূরে বেঞ্চিতে বসা রিমঝিমের দিকে। দাঁত খিঁচে বলে,
“আলতা মরেনি, কিন্তু আমরা সবাই মরে গেছি ভিতরে ভিতরে। এই গ্রামের বিবেক মরে গেছে। একটা মেয়ে, যার কোনো দোষ নাই, তাকে কিভাবে কেউ বাধ্য করে…..”
অন্য দুইজন অপরাধী মুখ বানায়, “ডাক্তার সাব, আমরা গরিব মানুষ, অই চেয়ারম্যান অইর এত শক্তি সামর্থ্য। আমরা কি করমু?”
আরেকজন বলে “ হের নজর কারো উপরি জাইলে আর রেহাই নাই, একখান জইল্লা যদি বাঁচে আলতা।”
রুবায়েত অসহ্য রাগে নি:শ্বাস ফেলে, “যান তো সরেন।”
এক সপ্তাহ পরে,
আলতা হাসপাতালের বিছানায়। গায়ে ব্যান্ডেজ, চোখে কান্না, সালামের হাতে হাত রাখে ভাঙা গলায় বলে,
“অহন আর আগের মত সুন্দর নাই রইছি, তুই কি আবার বিয়া করবি? মুই তো ভাবি, ভালা হইছে…অ বদমাইশডা আর মোরে চায় না মনে হয়… টেকা দিবি কেমনে?” সত্যি ব্যাকুল হয় আলতা। গায়ে জ্বালা পোড়ার চেয়ে মনে জ্বলন বেশি৷ বেশি পুড়ে নাই, মুখের অল্প আর সামনের কিছু অংশ।
“চুপ কর, তুই কি আমার জানোয়ার ভাবছস? ট্যাকা কেমনে দিমু, নিজেই জানি না আলতা। হাসপাতালের টাহা ডাক্তার নিজেই দিতাছে। দেখি কি করা যায়। এইখানে এক কিস্তি আপার লগে কতা হইছে।” ওর পোড়া মুখে হাত বুলিয়ে দেয়, “ তুই অহনো আমার চাঁদ।”
আলতা হাসে, বড় সুন্দর দেখায় সেই হাসি।
_____________
রুবায়েতের দুই হাত চেয়ারের সাথে বাঁধা, মুখে মারের দাগ স্পষ্ট।
ওর মুখোমুখি চেয়ারে চেয়ারম্যান মজিদ ব্যাপারী বসে আছে হুক্কা টানছে, হুক্কার ধোঁয়া ওর মুখ বরাবর ফেলছে।
“কি ডাক্তার জব্দ হইলা তো। তোমার কপাল ভালো তোমার পরিবাররে আমার ভালো লাগছে।” খিক খিক করে হাসে চেয়ারম্যান, বড্ড নোংরা, গা গুলানো সেই হাসি।
পাশ থেকে হাসমত বলে, “ যে ব্যাটা বউ এর দুল বিক্রি করতে পারে সে বউ রেও পারে…!”
জোর করে জেগে উঠে রুবায়েত। গা ভিজে একাকার, গলা শুকিয়ে কাঠ। আগে আস্তাগফিরুল্লাহ বলে বা দিকে তিন বার থু: ফেলে। এখনো মনে হচ্ছে সব বাস্তব। মনের মধ্যে কোন শান্তি নেই। এই সাতটা দিন রিমঝিমকে অনেক বুঝিয়ে কাজ হয় নাই। এক কথা এক সাথেই যাবে। কিন্তু রুবায়েতের এখনো এদিকে কাজ বাকি। অর্ধেক কাজ ফেলে কিভাবে যায়? রিমঝিম বেঘোরে ঘুমুচ্ছে, জানলা গলে চাঁদের আলো আসছে, সেই আলোতে আরও মায়া মায়া লাগছিলো। রুবায়েত ওর গালে আঙুল বুলিয়ে দেয়, “ তোমাকে যেতেই হবে রিমঝিম, সুন্দর কথায় না হলে…. অন্যভাবে।”
উঠে গিয়ে ডায়েরি টেনে নেয়।
___________________
রিমঝিম ভোরে উঠে প্রতিদিনের মতো নাশতা বানাচ্ছে। রুবায়েত এখন পড়ছে। বেচারা খুব চিন্তায় আছে টাকা-পয়সা নিয়ে। ওর ভাই কিছু টাকা পাঠিয়েছিল, সেগুলো তো হাসপাতালে খরচ হয়ে গেল। কানের দুলে টোকা দিল হাত দিয়ে।
“এটা বিক্রি করলে কী এমন ক্ষতি!”
বেশি বোঝে, যা বোঝার তা বোঝে না..!
তারপর ভাবতে থাকে, গত পরশুদিন গিট্টুর নানীর সাথে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন।
সে নাকি চেয়ারম্যানের তিন নম্বর বউ, নাম মালা।
উনারা ওকে বলে গেছেন, রুবায়েতকে বুঝিয়ে যেন এই গ্রাম ত্যাগ করে।
কারণ চেয়ারম্যান উপরে উপরে ভালো দেখালেও ভেতরে, ভেতরে খুব হিংস্র একটা মানুষ।
রুবায়েতের ওপর খুব রাগ, ছাড়বে না, একটা ক্ষতি করবেই, এমনকি জানটাও যেতে পারে।
ভদ্রমহিলার বয়স বেশি না। আঁচলে চোখ মুছে বলেছেন, “অটা মানুষ না, জানোয়ার।”
গিট্টুর নানি পান খাওয়া দাঁত বের করে বলেছে,
“ডাক্তার কার লাইগা রক্ত পানি করতাছে? সব গা ভীতুর ডিম, বিপদ আইলে কেউ পাশে থাহব না। তুই তোর পতি নিয়া যা, তোর দায়িত্ব তোরই।”
যাবার আগে চেয়ারম্যানের বউ মালা বলে গেছেন,
“তোর জামাইরে কইস, ময়নার থেইকা সাবধানে থাহে — কম বয়সী মাইয়ার পিরিত অইল বড় ফাঁসার জিনিস।”
এরপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে, “জাউরা চেয়ারম্যান ত গন্ধ পাইছে, তরু মাগীরে কামে লগাইছে। সাবধানে থাহিস।”
কিন্তু ডাক্তার ভদ্রলোক কোন কথা শুনলে তো!
উল্টো রিমঝিমকে ঢাকায় পাঠাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।গত পরশুদিন থেকে রিমঝিম ঠিকমতো খেতে পারে না।রাতে ঘুমালে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে, চোখের নিচে কালি।
সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষী মনে হয়।
কয়েকটা কাউন্সেলিং তো আর ওর এতদিনের ওভারথিংকিং মনকে ঠান্ডা করতে পারে না।
এসব ভাবতে ভাবতে হাত পুড়িয়ে ফেলল।
“উফ!”
তাড়াতাড়ি হাত পানিতে চুবিয়ে দিল।
“কি হয়েছে?”
দরজার সামনে দাঁড়ানো রুবায়েত, চুল এলোমেলো, চেহারায় চিন্তার ছাপ।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল রিমঝিম।
কথা বলছে না।কেমন মায়া লাগছিলো, বলতে ইচ্ছে করলো, “ চল না নীড়ে ফিরে যাই।”
রুবায়েত ও তাকিয়ে রইল ওর দিকে। রিমঝিমের
চেহারা কেমন হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি।
“ কী হয়েছে? চুপ করে আছো কেন?”
“হাত পুড়েছে, অল্প।” রিমঝিম অল্প হাসে।
“দেখি।” এগিয়ে এলো রুবায়েত।
হাতে বার্নাল লাগাতে লাগাতে রুবায়েত গম্ভীর মুখে বলল,
“তোমার যে চাচা সুনামগঞ্জে থাকে, তাকে আজ আসতে বলেছি।
তুমি তার সাথে আজই ঢাকা যাচ্ছ!”
রিমঝিম রাগে-আবেগে হাতটা ছাড়িয়ে নিল,
“আর তুমি?”
রুবায়েত আরেকদিকে তাকিয়ে কঠোর গলায়,
“সেটা আমার দেখার বিষয়। তুমি যাচ্ছ, এটাই ঠিক। তোমার থাকার প্রয়োজন তো নেই।”
রিমঝিম শাড়ির আচঁল কোমড়ে গুছে নিল, উঁচু গলায় বললো,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না! তোমাকে না নিয়ে অসম্ভব। হুট করে এরকম সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পার না।”
রুবায়েত ঠাণ্ডা কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল,
“এখন এত কথা বলার সময় না, রিমঝিম। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নাও।” পাশ থেকে উঠে যায়।
রিমঝিম চিৎকার করে উঠে,
“তুমি কেন সব কিছু একা ঠিক করবে? আমাকে কিছুই বলবে না, শুধু ঢাকায় পাঠিয়ে দেবে?”
রুবায়েতের মুখোমুখি দাঁড়ায়, “ভুলে যাচ্ছ আমি এখানে এসেছিলাম তোমাকে নিতে, একা চলে যেতে না।”
রুবায়েত চোখ সরিয়ে নেয়,
“তুমি এসেছিলে মিটিমাট করতে সেটা হয়েছে, ব্যাস এবার তুমি যাও। তুমি থাকলে আমি কাজ ঠিকমতো করতে পারি না৷ বাসায় আসার তোমাকে সময় দেবার তাড়া থাকে।”
রিমঝিমের চোখে জল চলে আসলো না চাইতেও সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে মনে তবে কি ময়নার ফাঁদে ধরা দিল রুবায়েত। নইলে ওকে ফেরত পাঠাবার এত তাড়া কেন?
“তুমি আমাকে হঠাৎ দূরে ঠেলে দিচ্ছো, সেটা বুঝছো? আমি থাকলে কি সমস্যা? নাকি তোমার গোপন কিছুতে বাঁধা আমি?”
রুবায়েত থমকে যায়, যেই চোরাবালি থেকে সম্পর্ক কে টেনে তুলেছে সেদিকেই যেন যাচ্ছে আবার।
“ তোমার যা মনে হয় ভাবো, কারো চিন্তা আমি নিয়ন্ত্রণ বা বদলে দিতে পারি না।এটা কোনো অনুরোধ না, রিমঝিম। এটা আদেশ। তুমি যাচ্ছো। আজই।”
“ময়না তাই না? মেয়েটা তোমাকে ফাঁদে ফেলেই দিল..শুন ওর থেকে দূরে…”
রুবায়েত এবার চিৎকার করে উঠলো, “ যা ইচ্ছে ভাবো, তুমি আজ যাচ্ছো এটাই শেষ কথা। আমাকে আরও কঠিন কিছু বলতে বা করতে বাধ্য কর না।”
“কি করবে? আবার গায়ে হাত তুলবে…”
রুবায়েত তীব্র চোখে তাকালো, “ মুখের ভাষা না বুঝলে….”
“হাতের ভাষায় কথা বলবে? বার বার কিন্তু রিমঝিম তোমার ভুল মুছে দিবে না।” রিমঝিম চোখের পানি মুছে ঘরে চলে গেল, ব্যাগ গোছাবে। এতটা ছোট হয়ে, আত্মসম্মান হারিয়ে থাকবে না এখানে।
রুবায়েত চুপচাপ বসে রইলো সামনের রুমে, ফিসফিস করলো, “ শুন রিমঝিম আর হয়ত সাত দিন এরপর আমি তোমার সব রাগ ভেঙে দিব। সত্যিটা বললে আমাকে এই জায়গায় ফেলে তুমি কখনোই যেতে না!” হঠাৎ এই গ্রামটা খুব অসহ্য লাগছে রুবায়েতের।
________________________
বর্ষার শেষ দিক, মেঘলা আকাশ। দূরে দূরে কাদামাখা পথের ধারে জল থৈ থৈ করছে। খেজুর গাছের ছায়া পড়ে কাঁচা রাস্তায়। বাতাসে ধানের গন্ধ, পেছনে কোথাও একটা একতারা বাজছে।
ময়নার বাপ বদ্ধপরিকর সেই পাত্রের সাথেই ময়নার বিয়ে দিবে, এদিকে তরু চাচী ক্রমাগত উস্কানি দিচ্ছে একটা ফাঁদ, একটা চেষ্টা, ময়নাকে দিতে পারে ওর কাঙ্ক্ষিত জিনিস। আয়নার সামনে দাঁড়ানো ময়না, সত্যি ময়না এসব করতে চায় না। অন্যভাবে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেগুলো কোন ফল বয়ে আনলো না। ময়না আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে পারছে না, কিন্তু মনের সাথে যুদ্ধ পরাজিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ফোনটা হাতে নিল, তরু চাচির নাম্বারে ফোন করল,
“আমি রাজি।”
ফোনটা কেটে করে কেঁদে উঠলো, আমি ওরে ভালবাসি। আমি ডাক্তারকে কলঙ্ক দিতে চাই না। কিন্তু আমার সমাজ… আমার বাপজান… আর আমার মন আমারে এমন এক জায়গায় আনছে, যেইখান থেইকা ফিরার উপায় নাই।”
দূরে কোথাও একজন বাউল হাঁটছে কাদামাখা হাওর পথ ধরে। একতারা বাজাচ্ছে। তার কণ্ঠে বাউল গান শোনা যাচ্ছে…
“আসি বলে গেল বন্ধু আইলো না
যাইবার কালে সোনা বন্ধ
নয়ন তুলে চাইলো না
আসবে বলে আসায় রইলাম
আশাতে নিরাশা হইলাম
বাটাতে পান সাজাই থুইলাম
বন্ধু এসে খাইলো না
সুজন বন্ধুরে ছাইড়া
মনে বড় ব্যথা পাইয়া
আমি শুধু তার গান
সে আমার গান গাইলো না
#রিমঝিম_বৃষ্টি
#কাজী_জেবুন্নেসা
চলবে…